আজ বিতানদের বাড়িতে একটা ছোট্টখাট্টো উৎসবের পরিবেশ। পাড়ার লোক, কাছাকাছি বাস করেন যেসব আত্মীয়রা, সকলেই ওর সাথে দেখা করে যাচ্ছেন এসে। স্কুলের মাস্টারমশাইরাও একে একে এসে দেখা করেছেন। বিতানের মা মধুছন্দাদেবী একা একা সব সামলাতে হিমসিম খাচ্ছেন। এমন দিনেও বিতানের বাবাকে অফিস যেতে হল! অবশ্য প্রাইভেট কোম্পানির সামান্য মাইনের চাকুরের এছাড়া উপায়ই বা কী।
বিতানের রেজাল্টের খবরটা শুনে সকাল সকাল এক হাঁড়ি মিষ্টি কিনে বাড়িতে রেখে হাতের চেটোয় করে চোখের জল মুছতে মুছতে বেরিয়েছেন পরিমলবাবু। ছোট্ট বুবাই, মানে বিতানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল ওঁর। ছোটো থেকেই বিতান বড়ো মেধাবী। সমস্ত শিক্ষক, আত্মীয়স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষীরা সকলেই বরাবর বলতেন, “দেখো পরিমল, তোমার ছেলে তোমার নাম উজ্জ্বল করবে একদিন!”
সবার আশাকে সত্যি করে বিতান এ-বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে। লোকাল নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিক, নামী সংবাদপত্রের সাংবাদিক, সকলে যখন ওর সাক্ষাৎকার নিয়ে চলে গেল, তারপরেও বিতানের অবিশ্বাসের ঘোর কাটেনি। শুধুমাত্র বাবা-মায়ের ছলছল চোখগুলোর দিকে চেয়ে ছোট্ট বুবাই অনুভব করছিল যে ও পেরেছে। যদিও সামনে এখন অনেক পথ বাকি, তবুও প্রথম ধাপটা টপকাতে পেরেছে। সারাদিন সবার অভিনন্দন কুড়োতে কুড়োতে বারবার মনে হচ্ছিল, বাবা কখন ফিরবে। সকালে তো এত ভিড়, সাক্ষাৎকার সবকিছুর মাঝে বাবার সাথে কথাই হল না ভালো করে। সবাই প্রশ্ন করছে, এবারে তোমার লক্ষ্য কী? বিতান জানে ওর লক্ষ্য কী। ওর লক্ষ্য ভালো একটা মানুষ হওয়া, ঠিক বাবার মতো। সবার বিপদে বাবা যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ে, তেমনটি করার। যদিও মা বাবাকে খুব বকে এই স্বভাবের জন্য। কিন্তু বিতান জানে, মাও মনে মনে বাবাকেই সমর্থন করে।
সন্ধে নামতে ঘর একটু ফাঁকা হল। বিতান আর মা দু’জন একবাটি করে চাউমিন নিয়ে খেতে বসেছে। বিতান চাউমিন খেতে খুব ভালোবাসে। তাই মধুছন্দা এত লোককে চা, মিষ্টি, বিস্কুট দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকেই ছেলের জন্য বানিয়ে ফেলেছেন। দু’জনে সবে টি.ভি.টা চালিয়ে বসেছে, অমনি হইহই করে পরিমলবাবু এসে হাজির হলেন। ডাক শোনা গেল, “বুবাই! বুবাই! ছন্দা! কোথায় গেলে তোমরা সব?”
বিতান অমনি এক লাফে উঠে ছুটল দরজা খুলতে। দরজার ও-পারে পরিমলবাবু দাঁড়িয়ে, দু’হাত ভর্তি জিনিস। মধুছন্দাও এসেছেন ছেলের পেছন পেছন। দু’জন মিলে জিনিসগুলো নিয়ে টেবলের ওপর রাখলেন। গল্পের বই, পেন, মিষ্টি, চকলেট, আরও কত কী!
“এ কী! সারা মাসের মাইনে আজই খরচ করে ফেলেছ বুঝি?” ছদ্মরাগে বললেন মধুছন্দা।
বিতানকে বুকে জড়িয়ে ধরে পরিমল বললেন, “আজ তোমার কোনও বারণই শুনব না বুবাইয়ের মা! তাও আসল জিনিসটা তো বার-ই করিনি।” এই বলে পরিমলবাবু অফিসের ব্যাগ থেকে একটা নীল রঙের ল্যাপটপ বার করলেন। সন্তর্পণে টেবলের ওপর রেখে বললেন, “কী রে, বুবাই? দেখ তো পছন্দ কি না! চালিয়ে দেখ।”
এবার বিতান আর মধুছন্দা সত্যি সত্যিই ভীষণ অবাক হয়ে গেল। এই সামান্য মাইনের চাকরিতে ল্যাপটপ কেনা…
ওদের হতভম্ব মুখ দেখে ব্যাপারটা আঁচ করে নিয়ে পরিমল বললেন, “ওরে না না, অত চিন্তা করিস না তোরা। আমি চুরি-ডাকাতি করিনি। আমার অফিসের বড়ো স্যার মিঃ পূর্ণেন্দু সেনগুপ্ত, উনি এটা দিলেন। নতুন নয় অবশ্য, ওঁর ছেলে সৌরভের ল্যাপটপ এটা। বেচারা সবেধন নীলমণি ছেলেটা, মাস ছয়েক আগেই মারা গেল। কুড়ি-একুশ বছর বয়সের বড়োলোকের ছেলে, ড্রাগের নেশায় বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিয়ে… মিঃ সেনগুপ্তকে দেখলে বড্ড খারাপ লাগে। কী ভালো মানুষটা…”
মধুছন্দা বলে ওঠেন, “আজকের দিনটায় থাক না এসব কথা। হ্যাঁ গো, এত দামী জিনিসটা উনি এমনি এমনিই দিয়ে দিলেন?”
“সত্যি বলতে কী জানো, প্রথমে আমার নিতে খুব একটা ইচ্ছে করছিল না। এক তো এত দামী, দুই হচ্ছে সৌরভের ব্যাপারটা। কিন্তু মিঃ সেনগুপ্তর মুখটা দেখে না করতে পারলাম না। সন্তানহারা পিতা, অন্যের সন্তানের ভালো রেজাল্ট দেখে আনন্দ করে এটা দিলেন। কী করে না বলি, বলো তো?”
“না না, এত ভেবো না। ভালোবেসে দিয়েছেন উনি এটা, এ তো আমাদের বুবাইয়ের কাছে আশীর্বাদই হল, তাই না?”
বিতানের কানে বাবা-মায়ের এতকিছু কথা যাচ্ছিল না। ল্যাপটপটা চালানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল ও।
রাতের খাওয়া শেষ হতে বিতান মা-বাবাকে বলল, “আমি আরেকটু জেগে থাকি, প্লিজ? ল্যাপটপটা একটু চালাতে ইচ্ছে করছে।”
পরিমল আর মধুছন্দাও অমত করলেন না। ক’টা দিন একটু মজা করে নিক, তারপর আবার তো সেই পড়াশোনার জাঁতাকল। আর ভালো রেজাল্ট একবার করলে প্রত্যাশাটা অনেক বেশি বেড়ে যায়। সেই চাপ বিতানকে সামলাতে হবে সারাজীবন।
“খুব রাত কোরো না যেন! সারাদিন অনেক ধকল গেছে। কাল সকালে একবার মন্দিরে যাব কিন্তু, বেশি দেরিতে উঠলে চলবে না।”
বিতান লম্বা করে ঘাড় হেলাল। মা-বাবা শুতে চলে গেল।
২
চার্জারটা প্লাগে গুঁজে ল্যাপটপটা অন করে বিতান। ল্যাপটপটা একদম নতুনই আছে বলতে গেলে। হার্ড ডিস্কটা প্রায় ফাঁকা। সিস্টেম ফাইলগুলো ছাড়া আর বিশেষ কিছু নেই। লাট্টুদাদের বাড়ি গিয়ে ওকে বলতে হবে একটু দেখেশুনে সব সফটওয়্যার ইনস্টল করে দিতে। লাট্টুদা কম্পিউটারে তুখোড়, জয়েন্ট পাশ করে ইনফরমেশন টেকনোলজি নিয়ে পড়ছে।
ল্যাপটপটায় কিছু গেম আছে, আর গোটা কয়েক স্যাম্পল ছবি আর ভিডিও আছে। অবশ্য একটা অন্য ভিডিও-ও আছে – একটি ছেলে নীল টি-শার্ট পরে গিটার বাজাচ্ছে। ছেলেটি বিতানের চেয়ে কিছুটা বড়ো হবে। ল্যাপটপের ক্যামেরা অন করে রেখে সামনে বসে ভিডিওটা তোলা। খুব কম সময়ের, মাত্র পনেরো সেকেন্ড। ও-ই তাহলে সৌরভ, মিঃ সেনগুপ্তর ছেলে! কিন্তু এত সহজ সরল ছেলেটা, মায়াময় চোখের দৃষ্টি, কী সুন্দর গিটার বাজাচ্ছে, এ নাকি ড্রাগস নিত! এও সম্ভব? ওর জীবনে তো কোনও অভাব ছিল না। তাহলে বাবা-মাকে কেন এমন করে কষ্ট দিল? বিতান তো কোনও দিনও এভাবে মা-বাবাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না!
আজকের দিনটায় মন খারাপ করতে একদম ভালো লাগল না বিতানের। তাই মনটাকে অন্যমনস্ক করতে ল্যাপটপে তাসের গেম খুলল, সলিটেয়র। প্রতিটা রঙের কার্ডের পুরো সিরিজটা মিলিয়ে বানানোর খেলা। হার্ট, ডায়মন্ড, স্পেড, ক্লাব – হরতন, রুইতন, ইস্কাপন, চিঁড়েতন। স্কুলের কম্পিউটার ক্লাসে স্যার না থাকলে ওরা টুকটাক গেম খেলত। আর তাছাড়া লাট্টুদার বাড়ির ডেস্কটপেও টুকটাক গেম খেলেছে বিতান। সলিটেয়রের একটা ইজি লেভেল শুরু করে। মিনিট তিন-চারের ভেতরেই জিতে যায় বিতান। স্ক্রিনে অ্যানিমেটেড বাজি ফাটতে থাকে। সবুজ ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর নানা রঙের বুটি ছড়িয়ে পড়ে। আরও কয়েকবার ইজি লেভেলটা খেলার পর হার্ড লেভেল সিলেক্ট করে বিতান। বেশ কিছুক্ষণ ধরে খেলার পর সেই লেভেলটাও জিতে যায় বিতান। স্ক্রিনে ফের বাজির চমক।
কিন্তু হঠাৎই বাজির বদলে একরাশ রক্তের মতো লাল রঙ ছড়িয়ে পড়ে স্ক্রিনে। ঠিক যেন কেউ দোলের রঙ-ভরা বেলুন স্ক্রিনে ছুড়ে মারল। বাইরে থেকে নয়, ল্যাপটপের ভেতর থেকে। চমকে উঠে চোখ রগড়ায় বিতান। এ আবার কী! ফের স্ক্রিনের দিকে চেয়ে দেখে সব স্বাভাবিক। বাজি ফেটে চলেছে সমানে। তড়িঘড়ি গেমটা বন্ধ করে দেয় বিতান। অন্য একটা গেম খোলে। জলের ভেতর মাছ, বড়ো মাছটা ছোটো মাছগুলোকে খেয়ে খেয়ে আস্তে আস্তে বড়ো হবে, আর একটা একটা করে লেভেল টপকাবে এইভাবে। এটাও বেশ মজার খেলা। বেশ ক’টা লেভেল পেরোয় বিতান। কিন্তু হঠাৎই একটা লেভেলে এসে স্ক্রিনের ওপর জলের দৃশ্যটা কেমন লালচে হতে থাকে। ল্যাপটপের ওপরে যেখানে ক্যামেরার ছিদ্র, ঠিক সেই জায়গাটা থেকে যেন কেউ লাল রঙ গড়িয়ে দিচ্ছে। সেটা এসে জলে মিশছে। বিতান এবার বেশ ঘাবড়ে যায়। কীসব কাণ্ড হচ্ছে! গেমটা বন্ধ করে কাঁপা হাতে।
তড়িঘড়ি ল্যাপটপটা বন্ধ করতে যায়। বারবার স্যুইচটা টিপতে থাকে, ল্যাপটপ বন্ধ হয় না। স্যুইচটা টিপে ধরে থাকে রিবুট করার জন্য, কিচ্ছু হয় না। হঠাৎ টাচ প্যাডের ওপর ওর আঙুলগুলো যেন নিজে থেকে চলতে শুরু করে। ওর নিজের বশে নেই ওর হাতটা। স্ক্রিনে পয়েন্টারটা নড়তে থাকে। ডি ড্রাইভের ভেতর ঢোকে তার ভেতর ‘ভিডিও’ লেখা একটা ফোল্ডারে ঢোকে। এই ফোল্ডারটাতেই তো সৌরভের গিটার বাজানোর ভিডিওটা ছিল। কিন্তু এ কী! দুটো ভিডিও কোত্থেকে এল? বিতানের খুব ভালো মনে আছে, ও একটাই ভিডিও দেখেছিল এই ফোল্ডারে। টাচ প্যাডে নড়তে থাকে বিতানের আঙুলগুলো। সেই সাথে পয়েন্টারটাও স্ক্রিনের ওপর সরে সরে গিয়ে ক্লিক করে দ্বিতীয় ভিডিও ফাইলটার ওপর।
ফাইলটা খুলতে সবার প্রথমে ভেসে ওঠে একটা ঘর, বেশ বড়োলোকের বাড়ির একটা ঘর। অনেকটা যেমন ওই বাংলা সিরিয়ালে দেখায়, সুন্দর সাজানো গোছানো, সেইরকম। দেওয়ালে শেলফ, দামী সব শো-পিস। এমন সময় একজন মানুষ এসে ঘরটায় ঢোকে, লম্বা দোহারা চেহারা। চোখে ভীষণই মোটা আতস কাচের মতো চশমা। বেশ ভালোই পাওয়ার চশমাটায়, লেন্সের পেছনে চোখদুটো ইয়াব্বড় গোল গোল লাগছে। লোকটা খুব দ্রুত একটা আলমারির চাবি ঘুরিয়ে সেটা খোলে। তারপর ভেতর থেকে একটা কালো রঙের ব্যাগ বার করে আনে। তার ভেতর থেকে কিছু ফাইল বার করে সেই ফাইলের পাতাগুলোর ছবি তুলতে থাকে একটা মোবাইলে করে ঝটপট।
এমন সময় সেই ছেলেটি, যে আগের ভিডিওতে গিটার বাজাচ্ছিল সে ঘরে এসে ঢোকে। চশমাওয়ালা লোকটাকে দেখে কিছু বলে ছেলেটি, কিন্তু ভিডিওটায় কোনও শব্দ নেই তাই বিতান কিছু বুঝতে পারে না। লোকটাও উত্তরে রেগে কিছু বলে। দু’জনের বেশ ভালোরকম কথা কাটাকাটি হতে থাকে। উত্তেজনার বশে চশমা পরা লোকটা জোরে ধাক্কা মারে ছেলেটাকে। ছেলেটা ছিটকে পড়ে একটা টেবলের ওপর, কোণটায় লেগে মাথাটা কেটে যায়।
ওই অবস্থাতেই উঠে ছেলেটা আবার ছিনিয়ে নিতে যায় লোকটার হাত থেকে ফোনটা আর ফাইলগুলো। এবার চশমা পরা লোকটা একটা ভারী পেতলের ফুলদানির মতো শো-পিস তুলে নিয়ে মারে ছেলেটার মাথায়। লুটিয়ে পড়ে ছেলেটি।
তারপর আরেকটা দৃশ্য ফুটে ওঠে ল্যাপটপের স্ক্রিনে। এটা অন্য একটা ঘর। চশমা পরা লোকটা একটা বড়ো বিছানার ওপরের গদিটা ঠেলে সরিয়ে কাঠের অংশটার একদিকে চাপ দিল। খুট করে খুলে গিয়ে একটা ছোট্ট বাক্সের মতো অংশ দেখা গেল। তার ভেতর থেকে সাদা গুঁড়ো-ভর্তি ক’টা প্যাকেট বার করে আনল।
ঘামতে ঘামতে ল্যাপটপটা থেকে দূরে সরে যায় বিতান। এ কী দেখছে চোখের সামনে ও? খুন! তাহলে বাবার অফিসের মিঃ সেনগুপ্তর ছেলে সৌরভকে খুন করেছে ওই চশমাওয়ালা লোকটা?
স্ক্রিনের দিকে ফের চোখ পড়ে ওর। এবার একটা বারান্দা ফুটে উঠেছে। সেই চশমা পরা লোকটা পকেট থেকে ঐ সাদা গুঁড়োয় ভরা প্যাকেট একটা বার করে সৌরভের মুখটা ফাঁক করে মুখে খানিকটা, গায়ে খানিকটা ঢেলে দেয়। তারপর অচৈতন্য সৌরভের শরীরটা বারান্দার রেলিংয়ের ওপর দিয়ে ঠেলে দেয়।
বিতানের গলা থেকে ‘নাআআআ’ করে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। ল্যাপটপের ঢাকনাটা বন্ধ করে ছোটে মা-বাবার ঘরের দিকে। বিতানের হঠাৎ এককম অবস্থা দেখে ওঁরাও ঘাবড়ে যান। কোনওমতে হাঁপাতে হাঁপাতে ও সবটা বলে বাবা-মাকে। ওঁরা তড়িঘড়ি এসে ল্যাপটপটা চালাতে বলেন বিতানকে। বিতান কাঁপা হাতে ল্যাপটপের লিডটা তোলে। স্বাভাবিক স্ক্রিন, একটা পাহাড়ি ঝরনার ছবি স্ক্রিন সেভারে। ডি ড্রাইভের ফোল্ডারটায় ঢোকে বিতান। একটাই ভিডিও আছে শুধু, সৌরভের গিটার বাজানোর। টাচ প্যাড, পয়েন্টার সবই স্বাভাবিক। কিছু ভেবে পায় না বিতান।
“বাবা, মা, বিশ্বাস করো, আমি মিথ্যে বলছি না। এই… এই ল্যাপটপটায় সত্যি ওইসব দেখাচ্ছিল। আরেকটা ভিডিও ফাইল ছিল, কিন্তু সেটা আর দেখতে পাচ্ছি না এখন।”
মধুছন্দা বলেন, “তুই নির্ঘাত ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলি। সৌরভের ঘটনাটা শুনেছিস তোর বাবার মুখে, মনে প্রভাব ফেলেছে ওটাই। শোনো বুবাইয়ের বাবা, এই ল্যাপটপটা তুমি বরং মিঃ সেনগুপ্তকে ফেরত দিয়ে দাও কাল। আমার যেন কেমন ভালো ঠেকছে না।”
পরিমল মনে মনে কিছু একটা ভেবে চলেছেন। বিতানের বলা ঘটনাগুলোয় কেমন যেন খটকা লাগে। যে ফাইলের কথা বিতান বলল সেটা কী তবে ঐ প্রজেক্টের ফাইল? পরিমলের মনে আছে, সৌরভের মৃত্যুর কিছুদিন আগেই নিশ্চিতভাবে পাবে এরকম একটা কাজের টেন্ডার জমা দিয়েছিল ওদের কোম্পানি। কিন্তু পরে দেখা যায় মার্জিনালি ওই প্রজেক্টটি হারায় মিঃ সেনগুপ্তর কোম্পানি তার প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির কাছে। ছেলে-স্ত্রীর কাছে কিছু বললেন না। মুখে বললেন, “কাল তো রোববার, অফিস ছুটি। আমি বরং ওঁর বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসব ল্যাপটপটা।”
বিতান বলে উঠল, “আমিও যেতে চাই বাবা তোমার সাথে।”
৩
মধুছন্দার খুব একটা ইচ্ছে না থাকলেও বিতান গেল বাবার সাথে মিঃ পূর্ণেন্দু সেনগুপ্তর বাড়ি। কোন্নগর থেকে ট্রেনে হাওড়া, সেখান থেকে বাসে করে দক্ষিণ কলকাতায়, গড়িয়াতে ওঁর সুদৃশ্য ডুপলেক্স ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাটে পা রাখা মাত্র বিতানের কেমন যেন চেনা চেনা লাগল পরিবেশটা। মিঃ সেনগুপ্ত এগিয়ে এলেন ওঁদের দেখে। পরিমল ওঁদের আসার কথা আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন ফোনে।
“আসুন, পরিমলবাবু। এসো এসো, ইয়ংম্যান। মেনি মেনি কংগ্র্যাচ্যুলেশনস মাই বয়। সরমা! এসো শিগগির। বিতান এসেছে।”
ঘরের ভেতর থেকে ‘মা মা’ দেখতে এক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন। বিতান সকলকে প্রণাম করল। উনি বুকে জড়িয়ে মিষ্টি হেসে আশীর্বাদ করলেন ওকে।
খানিকটা ইতস্তত করার পর পরিমলবাবু বললেন, “স্যার! ইয়ে মানে… আসল ব্যাপারটা হল, এত দামী ল্যাপটপটা… বিতানের মা আর আমি দু’জনেই একটু অস্বস্তিতে পড়েছি।”
মিঃ সেনগুপ্ত একটু চুপ করে থেকে বললেন, “পরিমলবাবু, এই ল্যাপটপটা আমি সৌরভকে গিফট করার দু’দিন পরেই ওই অ্যাকসিডেন্টে ও চলে যায় আমাদের ছেড়ে। আপনি তো সবই জানেন। এত স্নেহ-ভালোবাসায় ছেলেটা বিগড়ে গিয়ে শেষ অবধি ড্রাগস… ল্যাপটপটা সৌরভের কাকু, মানে আমার ভাই রীতেন্দুর কাছেই ছিল এতদিন। ও খুব একটা ইউজ করত না, নতুনই পড়ে ছিল জিনিসটা। বিতানের ভালো রেজাল্টের খবর পেয়ে আমি আর সরমা দু’জনেই ভেবেছিলাম, এটা এমন কেউ পাক যে ডিজার্ভ করে। কিন্তু আপনারা যদি অস্বস্তি বোধ করেন তাহলে আমরা জোর করব না।”
বিতান চমকে বলে, “আঙ্কল, আপনার ভাই এখানেই থাকেন?”
পূর্ণেন্দুবাবু সেলফের ওপর সাজানো কতকগুলো ছবির দিকে আঙুল দেখিয় বলেন, “হ্যাঁ, এখানেই থাকে। ওই তো সৌরভের সাথে ওর ছবি।”
ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে বিতানের মাথাটা ঘুরে যায়। এ তো ভিডিওতে দেখা সেই লোকটা! কিন্তু চোখে সেই মোটা চশমাটা নেই।
“আঙ্কল, আপনার ভাই কি কনট্যাক্ট লেন্স ইউজ করেন?”
মিঃ সেনগুপ্ত খুব আশ্চর্য হয়ে বললেন, “হ্যাঁ! কিন্তু তুমি কী করে জানলে? ওর চোখের পাওয়ার মাইনাস নাইন। লেন্সই বেশি ইউজ করে, মাঝেসাঝে বাড়িতে চশমা পরে।”
বিতান সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে, “আমাকে প্লিজ একবার সৌরভদাদার ঘরটা দেখতে দেবেন? আর অন্য ঘরগুলোও।”
খুব অবাক হলেও মিঃ সেনগুপ্ত বলেন, “সরমা, বিতানকে একটু ঘরগুলো দেখাও।”
সৌরভের ঘরে গিয়ে চিনতে পারল বিতান। সেই সাথে বারান্দাটাও চিনতে পারল। মিসেস সেনগুপ্তর সাথে ওঁদের বেডরুমে গিয়ে দেখতে পেল সেই আলমারিটা, যেটা থেকে ওই লোকটা মানে সৌরভের কাকু ফাইলগুলো চুরি করেছিল। যে টেবলে লেগে সৌরভ মাথায় চোট পেয়েছিল সেটাও দেখতে পেল। সরমাকে জিজ্ঞাসা করল, “রীতেন্দুবাবু কোন ঘরে থাকেন?”
“ও তো ওপরের রুমে থাকে। কিন্তু এখন তো বাড়িতে নেই, বেরিয়েছে। ছুটির দিনে বাড়িতে থাকে না সাধারণত। তুমি ওকে খুঁজছ কেন বাবা?”
বিতান নিজের মনের মধ্যে চলতে থাকা ঝড়টাকে কোনওমতে শান্ত করে বাইরের ড্রইংরুমে এসে বলল, “বাবা, আমি নিশ্চিত রীতেন্দুবাবুই সেই চশমাওয়ালা লোক যে সৌরভদাদাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে বারান্দা থেকে। তুমি এবার সবটা বুঝিয়ে বলো ওঁদের।”
বিতানের কথা শুনে মিঃ সেনগুপ্ত চিৎকার করে উঠলেন, “ক-কী বলছ, বিতান? পরিমলবাবু, কী বলছে আপনার ছেলে? আমার নিজেরই ভাই আমার ছেলেকে খুন করেছে? এ কী করে সম্ভব!”
“স্যার, আপনি ব্যস্ত হবেন না। মাথা ঠাণ্ডা করে পুরোটা শুনুন।” বলে ওঠেন বিতানের বাবা।
সরমাদেবী ধপ করে বসে পড়েন সোফায়।
পরিমলবাবু যথাসাধ্য সব বুঝিয়ে বলেন ওঁদের, ল্যাপটপটায় বিতান ঠিক কী কী দেখেছে।
“স্যার, আপনার মনে আছে, ঐ সময়টায় বেশ বড়ো কিছু টেন্ডার আমাদের হাতছাড়া হয়ে যায়? কেউ আমাদের কনফিডেনশিয়াল ফাইলগুলোর তথ্য অন্য কম্পিটিটর কোম্পানির হাতে তুলে দিয়েছিল হয়তো মোটা টাকার বিনিময়ে। আমার ধারণা, সৌরভ সেগুলোর জন্য যে আপনার ভাই দায়ী সেটা ধরে ফেলেছিল। আর তাই…”
উত্তেজিত হয়ে মিঃ সেনগুপ্ত বলে উঠলেন, “এও কী সম্ভব! রীতেন্দু এমন কাজ… আর সৌরভের এভাবে যোগাযোগ স্থাপন। না না, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। সরমা, রীতেন্দু বাড়িতে নেই, না? আমি এক্ষুনি ওর ঘরটা একবার সার্চ করে দেখতে চাই।”
এই বলে মিঃ সেনগুপ্ত দোতলায় ভাইয়ের ঘরের দিকে ছুটলেন। পেছন পেছন সরমাদেবীও। পরিমলবাবু আর বিতানও গেল ওঁদের সাথে।
রীতেন্দুর ঘরটাও দামী দামী আসবাবে ভর্তি। ড্রেসিং টেবলের ওপর একাধিক দামী ঘড়ি, পারফিউম। দেওয়ালে বড়ো টি.ভি., পাশে একটা একটা ট্রেডমিল। বেশ শৌখিন লোক। মিঃ সেনগুপ্ত ওদিকে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলেন ঘরের প্রতিটি কোণ। হঠাৎ বিছানাটার দিকে চোখ পড়তে বিতানের খেয়াল হল, এটা তো সেই ঘরটা। তখন অবশ্য এই বড়ো টি.ভি. আর ট্রেডমিলটা ঘরটায় ছিল না। তাই চট করে মনে পড়ছিল না বিতানের।
আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে বিছানাটার গদিটা ঠেলে সরিয়ে একটা উঁচুমতো জায়গায় চাপ দিল। খুট করে কাঠের টুকরোটা খুলে গিয়ে একটা খুপরি দেখা গেল। তার মধ্যে সেই ভিডিওতে যেমন দেখেছিল তেমন সাদা গুঁড়ো ভর্তি প্যাকেট, ড্রাগস। ওগুলো দেখে পাগলের মতো চারদিক উল্টে ছত্রাকার করতে থাকলেন মিঃ সেনগুপ্ত। দেওয়ালের ওয়ার্ড্রোবটা খুলতে গিয়ে দেখলেন লক করা। সরমাদেবী বললেন, “বাড়ির সব আসবাবের একটা ডুপ্লিকেট চাবির গোছা আছে, আমি আনছি।”
ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ওয়ার্ড্রোবটা খুলে একটু ঘাঁটতেই জামাকাপড়ের ভাঁজ থেকে বেরলো কিছু ফাইল, আর টাকার বাণ্ডিল। ফাইলের ভেতর গত কয়েকমাসের কোম্পানির নানা প্রোজেক্টের টেন্ডারের জেরক্স কপি।
ধীর পায়ে ফাইল, টাকা আর ড্রাগসের প্যাকেটগুলো নিয়ে নিচে নেমে এলেন মিঃ সেনগুপ্ত। দীর্ঘক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলেন। তারপর হাত বাড়িয়ে ল্যাপটপটা নিলেন। গায়ে হাত বোলালেন ল্যাপটপটার। ধরা গলায় বলে উঠলেন, “আগের ল্যাপটপটা খারাপ হয়ে গেছিল, তাই ওর জন্মদিনে এটা দিয়েছিলাম ওকে। গান শুনতে ভালোবাসত, গিটার বাজাত। আর ল্যাপটপে তাসের খেলা খেলত খুব। ও চলে যাওয়ার পর দিনের পর দিন ওকে ড্রাগ অ্যাডিক্টেড ভেবে কষ্ট পেয়েছি, দোষ দিয়েছি। ল্যাপটপটা আর খুলে দেখিনি, রীতেন্দুকে দিয়েছিলাম। ও এটা ব্যবহার করত না। এখন বুঝলাম কেন করত না। যে ভাইপোকে নিজের হাতে খুন করেছে তার ল্যাপটপ ইউজ করবে কী করে! রীতেন্দু অসৎ সঙ্গে পড়েছিল জানতাম, কিন্তু এত বড়ো সর্বনাশ আমার করবে এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।”
চোখের কোণ বেয়ে ঝরঝর করে জল নেমে আসে মিঃ পূর্ণেন্দু সেনগুপ্তর। ফুঁপিয়ে ওঠেন সরমাদেবীও।
কিছুক্ষণ পর মোবাইলে নাম্বার ডায়াল করে নিজের বন্ধুস্থানীয় লালবাজারের এক পুলিশকর্তাকে ফোন করেন মিঃ সেনগুপ্ত। বলেন, “হ্যাঁ আমি বলছি, পূর্ণেন্দু সেনগুপ্ত। আমার ছেলের হত্যা এবং কোম্পানির গোপন তথ্য পাচারের অভিযোগে আমি কেস করতে চাই আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে। হ্যাঁ! আমি ঠিকই বলছি রণদেব, তুমি সুবিচার পেতে আমায় সাহায্য করো।”
কিছুক্ষণ আরও কথা বলার পর ফোন রেখে মিঃ সেনগুপ্ত বললেন, “আমার বন্ধু রণদেব, পুলিশ অফিসার। ও সব ব্যবস্থা করবে। কিন্তু সৌরভ যেভাবে বিতানের সাথে সংযোগস্থাপন করে ওকে সবটা জানিয়েছে সেটা তো পুলিশ মানবে না। আমি আমার সন্দেহ আর এই ফাইল, ড্রাগস এসবের ভিত্তিতেই অভিযোগ আনব রীতেন্দুর বিরুদ্ধে। ও বাড়ি ফেরার আগেই রণদেব এখানে চলে আসবে ফোর্স নিয়ে।
“পরিমলবাবু, আপনি বিতানকে নিয়ে বাড়ি যান। ওকে আর জড়ানোর দরকার নেই এই ব্যাপারে। আমার ছেলেকে ও আগের মতো নির্দোষ প্রমাণ করেছে আমাদের চোখে, এই আমাদের সবচেয়ে বড়ো পাওয়া। বিতান, সৌরভের এই ল্যাপটপটা যদি তুমি না নিতে চাও কোনও ব্যাপার নয়। আমি তোমায় নতুন একটা কিনে দেব।”
বিতান মাথা নেড়ে, “না, আঙ্কল! আমি এই ল্যাপটপটাই চাই।” এই বলে সরমাদেবী আর পূর্ণেন্দুবাবুকে প্রণাম করে। ওঁরা ওকে বুকে জড়িয়ে অনেক আদর করেন।
“এ-বাড়িতে মাঝে মধ্যে এসো বাবা!”
বিতান মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।
৪
রীতেন্দু সেনগুপ্তকে পুলিশ সেদিনই ধরে এবং ক’দিন জেল-হাজতে থাকার পর জেরার মুখে ভেঙে পড়ে সব স্বীকার করে রীতেন্দু। জুয়া, ড্রাগস এসবেরই নেশা ছিল ওর। সেই নেশার রসদ জোগানোর জন্যই দাদার কোম্পানির তথ্য বাইরে সরবরাহ করে পয়সা জোগাড় করত। সৌরভকে আহত করাটা অ্যাকসিডেন্টালি হলেও তারপর ঠাণ্ডা মাথাতেই সৌরভকে ড্রাগ অ্যাডিক্টেড সাজিয়ে বারান্দা থেকে ফেলে দিয়েছিল। এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছিল। নিজের কুকর্মও লুকিয়েছিল আর দাদার সম্পত্তিতে নিজের একচ্ছত্র অধিকারও স্থাপন করেছিল। কিন্তু ওই ল্যাপটপটাই কাল হল। রীতেন্দু জানতেও পারল না ও কীভাবে ধরা পড়ল।
এর ক’দিন পর ল্যাপটপে ফের সলিটেয়র খেলছিল বিতান। গেম জেতার পর বাজি ফাটার অ্যানিমেশনের বদলে ফুটে উঠেছিল ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ লেখাটা। তারপর আর কোনওদিন ল্যাপটপটায় অন্যরকম কিছু ঘটতে দেখেনি বিতান। সৌরভের আত্মা নিজেকে বাবা-মায়ের কাছে নির্দোষ প্রমাণ করার পর নিশ্চয়ই মুক্তি পেয়েছে এই জগৎ থেকে।
……………………………………………(সমাপ্ত)……………………………………