আমাকে একবার কিছুদিনের জন্যে পচাগর যেতে হয়েছিল। কাউকে চিনি না আমি সেখানে, আমার অফিসের একজন একটা বাসা খুঁজে বের করে দিল। বাসার মালিক আমাকে চাবিটি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, থাকেন এখানে যতদিন খুশি। তবে─
তবে কী?
রাতবিরেতে বাসায় নানারকম শব্দ শোনা যায়, ভয় পাবেন না।
আমি কৌতূহলী হয়ে বললাম, কিসের শব্দ?
ভদ্রলোক কাঁধ-ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, লোকে বলে ভূতের। তবে কখনো কারও ক্ষতি করে না।
পরিষ্কার দিনের আলোয় কথা বলছি, ভদ্রলোকের মুখে ভূতের নামটি এত হাস্যকর শোনাল যে বলার নয়! আমি ভদ্রতা করে হাসি গোপন করে বললাম, ক্ষতি করলেই আর কী! আমার কী আছে ক্ষতি করার?
ভদ্রলোক চোখ কুঁচকে বললেন, আপনি ভূত বিশ্বাস করেন না?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ভূত, প্রেত, জিন, পরী, রাক্ষস এবং খোক্কস─ এই ছয়টি জিনিস আমি বিশ্বাস করি না।
ভদ্রলোক একটু চিন্তিতভাবে বললেন, মানুষ চাঁদে গেছে, সেটাও অনেকে বিশ্বাস করে না। তবে এতে কিছু আসে যায় না, আপনি ভয় পান কি না সেটা হচ্ছে বড় কথা। ভূত বিশ্বাস করে না কিন্তু ভূতে ভয় পায় এরকম অনেক লোক আছে জানেন তো?
আমি বললাম, জানি। তবে আমি সেরকম লোক না। বাজি ধরে লাশকাটা ঘরে আমি রাত কাটিয়েছি।
ভদ্রলোক বললেন, চমৎকার! রাতবিরেতে কুটখাট শব্দ শুনলে মাথা ঘামাবেন না। সেটা নিয়ে। ইদানীং কারও কোনো ক্ষতি হয়েছে বলে শুনি নি।
আমি একটু কৌতূহলী হয়ে বললাম, ইদানীং ক্ষতি হয় নি বলছেন─ আগে কখনো কি ক্ষতি হয়েছে?
ভদ্রলোক কাঁধ-ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, সেটা অনেক লম্বা গল্প। অনেক পুরুষ থেকে বাসাটি আমাদের। আমার দাদার ছেলেবেলায় নাকি বীভৎস একটা ঘটনা ঘটেছিল একবার। দাদার বাবার সাথে এক তান্ত্রিকের গোলমাল লেগেছিল। সেই তান্ত্রিক নাকি পিশাচসিদ্ধ ছিল। তার পোষা পিশাচ লেলিয়ে দিয়েছিল এ বাড়িতে। ছোট বাচ্চাদের নাকি কচমচ করে খেয়ে ফেলত সেই পিশাচ। অনেক কষ্টে পিশাচকে দূর করা হয়েছে। পুরোপুরি দূর হয় নি। এখনও রাতবিরেতে তার খুটখাট শব্দ শোনা যায়। আমি ভূত বিশ্বাস করি না। কিন্তু এ বাসায় এককালে পিশাচ ছোট বাচ্চাদের কচমচ করে খেয়ে ফেলেছিল শুনে কেমন জানি দমে গেলাম। পিশাচ না হোক, কোনো কোনো জন্তু-জানোয়ার নিশ্চয়ই কোনো বাচ্চাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কী ভয়াবহ ব্যাপার!
ভদ্রলোক বললেন, তারপর তিন পুরুষ পার হয়ে গেছে, কখনোই কিছু হয় নি। ভয় না পেলেই হলো। শব্দ তো কত রকমই হয়। আমি বললাম, আপনি নিশ্চিন্ত থাকবেন, আমি ভয় পাব না। ভদ্রলোক চাবিটি হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যেতে যেতে বললেন, দক্ষিণ দিকের ঘরটি তালা মারা আছে, সেটার চাবি নেই। ঘরটি সব সময় তালা মারাই থাকে।
সব সময়?
হ্যাঁ, একশো বছরের ওপর হলো।
কখনো খোলা হয় নি?
না। পিশাচদের দূর করার সাথে ঘরটার কী একটা সম্পর্ক আছে। খোলা নিষেধ। আমার বাবা বলে গেছেন যেন কখনো খোলা না হয় ঘরটা। আমরা খুলিনি। ঠিক আছে।
আমি বাসাটি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বাসাটি অনেক পুরাতন। ইদানীং নানারকম কাজকর্ম করা হয়েছে, তবু স্থানে স্থানে পুরনো বাসার চিহ্ন রয়ে গেছে। বাসার দক্ষিণের সেই ঘরটিও দেখলাম। মস্ত একটা তালা ঝুলছে,
প্রাচীনকালের অতিকায় একটা তালা দেখে ভক্তি এসে যায়।
প্রথম দিন কাটল আমর জিনিসপত্র টানাটানি করে, তাই ঘুমাতে ঘুমাতে অনেক দেরি হয়ে গেল। খুব ক্লান্ত ছিলাম, বিছানায় শোয়ামাত্রই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙল পরদিন সকালে অনেক বেলাতে। ভূত বলে কিছু একটা বাসায় আছে সেটা আমার মনেই ছিল না। ঘুমের মাঝে শুধু একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম যে, আমি দক্ষিণের বন্ধ ঘরের সামনে গিয়ে দরজার তালাটা ধরে টানাটানি করছি। কেন এ স্বপ্ন দেখলাম কে জানে!
পরদিন রাতেও একই স্বপ্ন দেখলাম। বন্ধ ঘরের সামনে গিয়ে তালাটি ধরে টানাটানি করছি। স্বপ্নটি অত্যন্ত বাস্তব, যেন সত্যি সত্যি টানছি। তৃতীয় রাতে আবিষ্কার করলাম, স্বপ্ন নয়, সত্যি সত্যি আমি ঘুমের মাঝে হেঁটে হেঁটে বন্ধ ঘরের সামনে গিয়ে তালাটি ধরে টানাটানি করছি। ঘুমের মাঝে হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস আমার কোনো কালেই ছিল না, হঠাৎ কেন শুরু হলো কে জানে! ঘুম ভাঙার পর অকেক্ষণ লাগে বুঝতে আমি কোথায়, কী করছি। যখন বুঝতে পারলাম আমি বন্ধ ঘরটির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, কেন জানি গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি তালাটি ছেড়ে সরে এলাম। আর ঠিক তখন প্রথমবার আমি বাড়ির মালিকের বলা ভুতুড়ে শব্দ শুনতে পেলাম। শব্দটি ঘরটির ভিতর থেকে আসছে। কেউ যেন লাথি মারছে দেয়ালে, ধুপ ধুপ একটা শব্দ। একটানা অনেকক্ষণ শব্দ হয়, তারপর থেমে যায়। তারপর আবার হঠাৎ করে শুরু হয়।
প্রথম আমার কেমন জানি একটা আতঙ্কের মতো হলো, ইচ্ছে হলো চিৎকার করতে করতে ছুটে পালাই। কিন্তু এতদিনের বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত নিজেকে সাহস জোগাল, ব্যাখ্যার অতীত কোনো জিনিস নেই, এই বিশ্বাস নিয়ে আমি সাহস করে দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজেকে একটু শান্ত করে আমি সুইচটা বের করে বাতি জ্বালালাম। সাথে সাথে ম্যাজিকেরl ভিতরের শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। আলোতে যাবতীয় ভুতুড়ে এবং রহস্যময় জিনিসও যেন উবে গেল। ঘরটি ভালো করে দেখলাম, চারদিক বন্ধ, কোনো দরজা বা জানালা নেই। ভিতরে শব্দটা কেমন করে হয় কে জানে! ব্যাপারটা কী হতে পারে, সেটা নিয়ে খানিকক্ষণ চিন্তা করে আমি ঘরে ফিরে গেলাম ঘুমানোর জন্যে। ঘরটি খুলে দেখার একটা বৈজ্ঞানিক ইচ্ছা প্রথমবার আমার মাথায় চাড়া দিয়ে উঠল।
পরের দিন একজন অতিথি এলো আমার বাসায়─ মোটাসোটা একটা হুলো বিড়াল। বিড়াল আমি দুচোখে দেখতে পারি না, কিন্তু এই নির্বোধ পশুটি এত বন্ধুভাবাপন্ন যে আমি তাকে দূর করে দিতে দিতে পারলাম না। একেবারে আমার গাঘেঁষে লেজ লম্বা করে মিঁয়াও মিঁয়াও করে ডাকাডাকি করে এমন আহ্লাদ শুরু করল যেন কতদিন থেকে আমাকে চেনে! কষে একটা লাথি দেব দেব করেও আর দিলাম না। খাবার জন্যে আধখানা কলা ছিল, তা-ই ছুড়ে দিলাম তার দিকে। বিড়াল কলা খায় না সেটা আমি
তখনই জানতে পারলাম। সারাদিন কাজকর্মে ব্যস্ত থেকে রাতে ফিরে এসে এই স্বাস্থ্যবান হুলো বিড়ালটিকে খারাপ লাগল না। বাসায় রান্নাবান্নায় ঝামেলা নেই। বাইরে থেকে খেয়ে আসি। তাই বিড়ালটার জন্যে পরদিন কিছু বিস্কুট কিনে আনলাম। দেখা গেল বিড়ালটির বিস্কুটেও খুব রুচি নেই। আমার কাছে এসেছে খানিকটা বন্ধুত্বের জন্যে। কষে লাথি না মেরে সেটা তো দিয়েছিই, এর বেশি আর কী করতে পারি?
রাতে একটা বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙল বিড়ালটির চিৎকারে। মাঝরাতে বিড়ালের কান্না ভয়াবহ জিনিস, খানিকক্ষণ চিৎকার করে থেমে যায়, আমার চোখে যখন ঘুম নেমে আসে বিড়ালটি তখন আবার কান্না শুরু করে। কয়েকবার চেষ্টা করে আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম, ঠিক তক্ষুনি শুনতে পেলাম বন্ধ ঘরে ধুপ ধুপ করে সেই শব্দটা হচ্ছে। হঠাৎ করে কেন জানি আমার শরীরট কাঁটা দিয়ে ওঠে। আমি মোটামুটি দুঃসাহসী মানুষ। দুঃসাহসী মানুষ ভয় পায় না সেটা সত্যি নয়, দুঃসাহসী মানুষেরাও ভয় পায়। তবে ভয় পেলেও মাথা ঠাণ্ডা রাখে। মাথা ঠাণ্ডা রাখলে দেখা যায়, যে জিনিসটা দেখে ভয় পাচ্ছে, সেটাতে ভয়ের কিছুই নেই। আমিও মাথা ঠাণ্ডা রেখে নিজেকে বোঝালাম, শব্দ হচ্ছে সত্যি, কিন্তু শব্দটি অলৌকিক হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। নিশ্চয়ই কোনো একটি কারণ আছে। একটা কিছু হয়তো বেকায়দাভাবে ঝুলছে, বাতাস এলেই ওটা নড়ে কোথাও লেগে শব্দ হচ্ছে। কিংবা কে জানে হয়তো স্বাস্থ্যবান কিছু ইঁদুর, বিড়াল বা অন্য কোনো জন্তু-জানোয়ার শব্দ করছে।
নিজেকে সাহস দিয়ে আমি ঘর থেকে বের হয়ে বন্ধ ঘরটির সামনে দাঁড়ালাম। সাথে সাথে ভিতরের শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। বিড়ালটিও তার কান্না থামিয়ে একটু ভয় পেয়ে যেন আমার দিকে তাকাল। আমি তার দিকে একটু এগিয়ে যেতেই লেজ ফুলিয়ে এমন ভয়ংকর একটা ভঙ্গি করল যেন আর একটু এগোলেই সে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি একটু সরে এলাম। এত বন্ধুভাবাপন্ন বিড়ালটি হঠাৎ খেপে গেল কেন কে জানে।
বিড়ালটি হঠাৎ আগের মতো কান্নার সুরে ডাকতে শুরু করে। শুধু যে ডাকতে শুরু করে তা-ই নয়, সাথে সাথে ছটফট করতে থাকে। একটা প্রচণ্ড অস্থিরতার মতো, একবার এগিয়ে যায় আবার পিছিয়ে আসে, হঠাৎ মাটিতে গড়াগাড়ি দিতে থাকে। ভারি বিচিত্র ব্যাপার! আমি কী করব বুঝতে না পেরে কষে একটা লাথি দেবার জন্যে এগিয়ে গেলাম। ঠিক তক্ষুনি ঘরের ভিতর থেকে ধুপ ধুপ শব্দ শুরু হয়ে যায়। বিড়ালটি হঠাৎ থেমে গেল, তারপর মাটি খামচে প্রায় গড়িয়ে গড়িয়ে আমার কাছে এগিয়ে এলো। ব্যাটা ভয় পেয়েছে।
সত্যি কথা বলতে কি, আমারও ভয় করতে থাকে, সেটাই হয়েছে মুশকিল। ভয়কে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক না। মানুষ ভীতু হয়ে যায় তাহলে। আমি ঠিক করলাম ঘরের ভিতর ঢুকে দেখতে হবে কী আছে। কাছে গিয়ে তালাটা যেই স্পর্শ করেছি, সাথে সাথে ভিতরের শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। বিড়ালটাও দেখলাম সোজা হয়ে দাঁড়াল তখন। লেজটা লম্বা করে একবার আদুরে গলায় ডাকল আমাকে।
তালাটি পুরনো হলেও মজবুত। ভাঙা প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। আবার ভালো করে পরীক্ষা করে আবিষ্কার করলাম কবজাগুলি ক্ষয়ে গেছে, সহজেই খুলে আসবে। যাওয়ার সময় নতুন কবজা কিনে লাগিয়ে দিলেই হবে, বাড়ির বাড়ির মালিক কখনো জানতেও পারবেন না যে এটা খোলা হয়েছিল। আমি আমার যন্ত্রপাতির বাক্সটা নিয়ে এলাম। মানুষজন শুনে অবাক হয়ে যায়, কিন্তু সত্যি আমার একটা ছোট যন্ত্রপাতির বাক্স আছে। সেই বাক্সে হাতুড়ি, প্লায়ার্স, স্ক্রু-ড্রাইভার, ড্রিল, নাট-বল্টু এসব থাকে। কখনো এই বাক্স আমি হাতছাড়া করি না, কাজেই প্রয়োজনের সময় একটা স্ক্রু-ড্রাইভারের জন্যে কখনোই আমার সারা বাড়ি আকাশ-পাতাল করে খুঁজে মেজাজ গরম করতে হয় না।
দরজার প্রথম কবজাটা খুলে শেষ করতে করতেই বিড়ালটির একটি পরিবর্তন হলো। হাসি-খুশি বিড়ালটি আবার খেপে গেল। চিৎকার করে লাফিয়ে-কুদিয়ে এমন একটা ভয়াবহ পরিবেশের সৃষ্টি করল যে, আমি সত্যি সত্যি এবারে কষে একটা লাথি লাগালাম। আশ্চর্য ব্যাপার, লাথি খেয়েও সেটা পালিয়ে গেল না। আমার চারদিকে ঘুরে ঘুরে ডাকতে থাকল। আর ঠিক তখন হঠাৎ ঘরের ভিতর থেকে ধুপ ধুপ শব্দ শুরু হলো।
বিড়ালটা তখন আবার ভয়ে আধমরা হয়ে আমার কাছে কোনোমতে এগিয়ে এলো।
আমি এই মাঝরাতে কয়েকটি বিচিত্র জিনিস আবিষ্কার করলাম। প্রথমত, ঘরের ভিতরে ধুপ ধুপ শব্দ শুরু হওয়ার আগে বিড়ালটি কেমন করে যেন টের পায়। তখন সেটি ভয়ানক অস্থির হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, আমার এত জোরে লাথি খেয়েও বিড়ালটি পালিয়ে না গিয়ে আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। এই জায়গাটি ছেড়ে বিড়ালটির সরে যাবার ক্ষমতা নেই। কিছুক্ষণের মাঝে রহস্য পরিষ্কার হবে চিন্তা করে আমি জোর করে উৎফুল্ল হওয়ার চেষ্টা করতে থাকি।
ভিতরে ধুপ ধুপ শব্দের মাঝেই আমি দরজার দ্বিতীয় কবজাটি খুলে ফেলি। টেনে পুরনো ভারী দরজা সরাতেই আমি অবাক হয়ে দেখলাম, সামনে দেয়াল। ইট গেঁথে কে যেন পাকাপাকিভাবে বন্দ করে দিয়েছে। আশাভঙ্গ না হয়ে আমি কেন জানি খুশি হয়ে উঠলাম। ভিতরে ঢুকতে কী দেখব সেটা নিয়ে কেমন একটা চাপা অশান্তি আর ভয় ছিল। এখন ঢুকতে পারব না জেনে নিজের অজান্তেই খুশি হয়ে উঠলাম!
নিজের ঘরে ফিরে এসে আমি পুরো ব্যাপারটা আবার খানিকক্ষণ ভাবলাম। সবাই জানে আমি দুঃসাহসিক ব্যক্তি। সেটি সত্যি নয়, আমি আসলে ভীতু। ঘরটায় ঢুকতে না পেরে তাই খুশি হয়ে উঠেছি। নিজের কাছে নিজেকে ছোট করা যায় না। আমি তাই আবার উঠে দাঁড়ালাম, দেয়ালটি ভেঙে ভিতরে ঢুকতে হবে। প্রমাণ করতে হবে আমি ভীতু নই।
জিনিসটি যত কঠিন ভেবেছিলাম তত কঠিন নয়। নিশ্চয়ই প্রচুর বালু মেশানো ছিল। একটু চেষ্টা করতেই একটা ইট খুলে এলো। ইট সরে এসে দেয়াল ছোট একটা গর্ত হয়েছে। ভয়ে ভয়ে উঁকি দিয়ে দেখি ভিতরে নিশ্চিদ্র অন্ধকার। আমার যন্ত্রপাতির বাক্সে একটি ছয় ব্যাটারির টর্চলাইট থাকত। আমি সেটা নেবার জন্যে নিচু হতেই একটি বিচিত্র ব্যাপার ঘটল। বিড়ালটি হঠাৎ আবার খেপে উঠে চিৎকার করে দেয়ালের ওপর আঁচড়াতে থাকে। তারপর কিছু বোঝার আগেই কয়েকটা লাফ দিয়ে সেই গর্তটা ধরে ঝুলে পড়ে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করতে থাকে।
একটা বিড়াল ছোট একটা গর্তে ঢোকার চেষ্টা করছে সেটা বিচিত্র কিছু নয়, কিন্তু আমি অবাক হয়েছি অন্য কারণে। বিড়ালটি ভয়ংকর ভয় পেয়েছে। কিন্তু ভয় পেয়েও সে গর্তটা দিয়ে ঘরটায় ঢুকে যাচ্ছে। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি বিড়ালটি ঘরটাতে ঢুকতে চায় না। কিন্তু তার কোনো উপায় নেই। আমি পশুবিশারদ নই। কিন্তু বেঁচে থাকা সংক্রান্ত আদিম প্রবৃত্তিগুলি মানুষ আর পশু সবার বুঝি একই রকম।
বিড়ালটিকে টেনে নামিয়ে আনব আনব করতে করতেই সেটি ভিতরে ঢুকে গেল। ভিতরে খানিকক্ষণ প্রাণ-ফাটানো চিৎকার আর হুটোপুটি জাতীয় একটা শব্দ হলো, তারপর হঠাৎ কোনো শব্দ নেই। একেবারেই কোনো শব্দ নেই। ভয় পেলে মানুষের শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের একটা স্রোত বয়ে যায় বলে শুনেছিলাম। সত্যি সত্যি সেটা আমার শিড়দাঁড়া দিয়ে বয়ে গেল। আমি ভয়ে ভয়ে ছোট গর্তের দিকে তাকিয়ে থাকি। কেন জানি মনে হয়, এখনই গর্ত থেকে একটি বীভৎস মুখ বের হয়ে আসবে। ঘরটিতে একটি পিশাচ বন্দি করে রাখা ছিল। আমি নিশ্চয়ই তাকে খুলে দিয়েছি।
কয়েক মুহূর্ত আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। গর্তটি থেকে কিছু বের হলো না। কিছু দেখাও গেল না। আমি বড় টর্চলাইটটা নিয়ে আস্তে আস্তে গর্তের কাছে এগিয়ে গেলাম। সাবধানে আলোটা ভিতরে ফেলে উঁকি দিলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না, ছোট একটা চৌকোনা ঘর, ভিতরে কিছু নেই। অবিশ্বাস্য ব্যাপার! এইমাত্র বিড়ালটা লাফিয়ে ঢুকেছে ভিতরে, বিড়ালটাও নেই। বিস্ময় থেকেও আমার বেশি হলো আতঙ্ক। ছয় ব্যাটারির বড় টর্চলাইটের তীব্র আলোতে ঘরটা আলোকিত হয়ে আছে, কোথাও কিছু নেই। শুধু ঘরের মাঝখানে মেঝেতে একটা বৃত্ত আঁকা, ধুলায় ঢাকা পড়ে গেছে, আবছা দেখা যায়। সেই বৃত্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। আর হঠাৎ করে কোথা থেকে জানি ঘরের ঠিক মাঝখানে বিড়ালের মাথাটা পড়ল। কেউ যেন কামড়ে মাথাটি আলাদা করে নিয়েছে। রক্তে মাখামাখি বীভৎস একটা জিনিস।
আমি একটা চিৎকার করে সরে এলাম। থরথর করে শরীর কাঁপছে, কিছুতেই থামাতে পারছি না। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করলাম। আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে, আমি খুলে-আনা ইটটা তুলে গর্তটা আবার বন্ধ করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু হঠাৎ কেন জানি মনে হলো আমার এখন ভিতরে ঢুকতে হবে। ভয়ে আমার শরীর কাঁপছে। কিন্তু তবু আমার মনে হতে থাকল ভিতরে ঢুকতে হবে। কেন সেটা জানি না, কিন্তু ঢুকতেই হবে। একটু আগে বিড়ালটিও ভয় পেয়েছিল, তবু বিড়ালটি ঢুকেছিল। এখন আমিও ভয় পেয়েছি, আমাকেও ঢুকতে হবে। প্রচণ্ড জ্বর হলে মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা যেরকম গুলিয়ে যায়, আমারও সেরকম হলো। হাতুড়ির আঘাতে আমি দ্রুত দেয়াল থেকে ইট খুলে নিতে থাকি। কয়েক মিনিটেই কোনোমতেই শরীর গলিয়ে ঢুকে যাওয়ার মতো একটা বড় গর্ত করে ফেললাম।
ঠিক কীভাবে আমি ভিতরে ঢুকেছি পরিষ্কার মনে নেই। শুধু আমার মনে হচ্ছিল ঘরের ভিতর ঢুকলে ভয়ানক কিছু একটা ঘটে যাবে। কিন্তু তবু আমাকে ঢুকতেই হবে। ভিতরে ঢুকে মনে হলো কিছুতেই ঘরের মাঝখানে যাওয়া ঠিক হবে না, কিন্তু ভয়ানক কিছু একটা আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতে থাকে মাঝখানে যাওয়ার জন্য। আমার হঠাৎ বিড়ালটির কথা মনে পড়ল। অসহায় বিড়ালটি কীভাবে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঘরের ভিতরে ঢুকেছিল। আমিও কি সেই বিড়ালটির মতো শেষ হয়ে যাব? আমার ছিন্ন মাথাটাও কি বৃত্তের মাঝখানে এসে পড়বে? ভয়াবহ আতঙ্কের মাঝেও বেঁচে থাকার আদিম প্রবৃত্তি ভিতরে কাজ করতে থাকে। আমি জোর করে নিজেকে ঘরের এক কোনায় টেনে নিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসে থরথর করে কাঁপতে থাকি। প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকি নিজের আচ্ছন্ন ভাবটা ঝেড়ে ফেলতে।
ঘরের মাঝখানে হঠাৎ একটা হুটোপুটির মতো শব্দ হলো, মুখে গরম বাতাসের হলকা এসে লাগল। সাথে সাথে মাংস পোড়ার মতো একটা গন্ধ আসছে কোথা থেকে। কিছু একটা আছে এই ঘরে, ভয়ংকর শক্তিশালী একটা কিছু, প্রচণ্ড আক্রোশে সেটা ছিন্নভিন্ন করে দেবে সবকিছু। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি এই ঘরে আমার সাথে আরও একজন আছে। ভয়ংকর অশুভ একটা জীব, দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করবে কে? আমার নিঃশ্বাস আটকে আসতে থাকে। সমস্ত শরীর ঘামতে থাকে কুলকুল করে। ঘরের মাঝখানে আবার একটা শব্দ হলো, বীভৎস একটা শব্দ, গরম বাতাসের হলকা আবার ছুঁয়ে গেল আমাকে। আমি আহত পশুর মতো গড়িয়ে গড়িয়ে আরও পিছিয়ে আসি। গোঙানোর মতো একটা শব্দ বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে।
আমি জানি আমার আর কিছু করার নেই। ভয়ানক এক অশুভ প্রাণী আমাকে পেয়েছে তার হাতের মুঠোয়, এক মুহূর্তে আমি শেষ হয়ে যাব চিরদিনের মতো।
পিছিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ হাতে কী যেন ঠেকল, একটি কাগজের মতো। ছোঁয়ামাত্র হঠাৎ আশ্চর্য একটি ব্যাপার ঘটল। হঠাৎ ঘরটা আশ্চর্য রকম নীরব হয়ে গেল, আর প্রথমবার আমি পুরোপুরি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। প্রচণ্ড আতঙ্কটা নেই, এখনও বুক ধুকধুক করে শব্দ করছে, কিন্তু অসহায় পশুর সেই আতঙ্কটুকু যেন উবে গেছে। আমার হাতের ছয় ব্যাটারির টর্চটা জ্বালালাম আমি। হাতে এক টুকরো মোটা কাগজ, ওপরে কী যেন আঁকিবুঁকি করা। নিচে গোটাগোটা হাতে কী যেন লেখা। হাতের লেখা প্যাঁচানো, পড়তে কষ্ট হয়, কিন্তু পড়া যায়। সেখানে সাধু ভাষায় লেখা :
‘যাহার হাতে এই কাগজ তাহার সমূহ বিপদ। অতএব এই কাগজ সে হাতছাড়া করিবেক না। তাহা হইলে পিশাচ অবিলম্বে দেহনাশ করিবেক। কোনমতে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিবেক না। পিশাচ তিন গণ্ডীতে আবদ্ধ ছিল, ঘরে প্রবেশ করিতে হইলে দুই গণ্ডী ছিন্ন হয়। তৃতীয় গণ্ডী দুর্বল, অবিলম্বে নতুন গণ্ডী প্রদান করিবেক, নতুবা পিচাশ মুক্ত হইবেক। …’
এরপর কীভাবে পিশাচকে আটকে রাখার জন্যে আরও দুটি গণ্ডি দিতে হবে সেটা লেখা রয়েছে।
আমি ভূত-প্রেত কিংবা পিশাচ বিশ্বাস করি না। কিন্তু এই জীর্ণ কাগজে লেখা নির্দেশ অক্ষরে-অক্ষরে মেনে দুটি নতুন বৃত্ত এঁকে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিলাম। ইট গেঁথে দেয়াল বন্ধ করার আগে কাগজটি আবার ভিতরে রেখে দিলাম। ভবিষ্যতে আমার মতো কেউ যদি ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করে, কে জানে হয়তো এটাই আবার তার প্রাণ বাঁচাবে।
……………………………..(সমাপ্ত)……………………………..