সহযাত্রী

সহযাত্রী

প্লেনে আমার পাশে যে লোকটা বসেছে তার মুখে একটা কাটা দাগ। দীর্ঘদিন থেকে বিদেশে আছি, তাই লোক দেখানো ভদ্রতাগুলি বেশ শিখে গেছি। জিজ্ঞেস করার জন্যে মুখটা সুড়সুড় করছে, তবু কেমন করে এত খারাপভাবে মুখটা কাটল জিজ্ঞেস করছি না। প্লেনটা আকাশে ওঠামাত্র লোকটি এয়ার-হোস্টেসের কাছ থেকে চেয়ে ছোট ছোট বোতলে মদ নিয়ে নিল। ভদ্রলোকেরা অবিশ্যি মদকে মদ বলে না, যেটার যে-নাম সে-নামে ডাকে, কোনোটা বিয়ার, কোনোটা ওয়াইন, কোনোটা হুইস্কি। যারা জিনিসটা খায়, তারা তো এখনও মদ কথাটিকেই রীতিমতো অপমানজনক মনে করে। আমি এখনও দেশি মানুষ, জিনিসটা কখনো খাইনি। তাই বিভিন্ন মদের সূক্ষ্ম পার্থক্য এখনও ধরতে পারি নি, সেটা নিয়ে মাথাও ঘামাই নি এবং সবগুলিকে এককথায় মদ বলে ডাকি। তাছাড়া এ জিনিসটা আমি দুচোখে দেখতে পারি না, বিশেষ করে প্লেনে। একবার প্লেনের সিট নিয়ে কী একটা গোলমাল হবার পর আমাদের কয়েকজনকে ফার্স্ট ক্লাসে তুলে দিল। ফার্স্ট ক্লাসে বিনি পয়সায় মদ খেতে দেয়। আমার পাশে যে বসেছিল বিনে পয়সার মদের লোভ সামলাতে না পেরে একের পর এক গ্লাস মদ খেতে থাকে। ঘণ্টা দুয়েক পর সেই ব্যাটা মদের কল্যাণে কথা নেই বার্তা নেই ওয়াক করে আমার ওপর বমি করে দিল। নিজের বমিতেই মানুষের ঘেন্নায় মরে যাবার মতো অবস্থা হয়, অন্যের বমির কথা তো ছেড়েই দিলাম, তার ওপর যদি ভোজনবিলাসী মানুষের বমি হয়!

যাই হোক, এবারেও লোকটাকে ছোট ছোট বোতল খেতে দেখে আমি সাবধান হয়ে গেলাম। মদ একেকজন মানুষকে একেকভাবে পালটে দেয়। এই গোমড়ামুখী মানুষটিকে মনে হলো হাসি-খুশি করে দিল। প্রথম বোতলটা খেয়েই আমার দিকে দাঁত বের করে হাসল, বলল, প্লেনে উঠতে আমার দারুণু ভয়।

আমি একটু অবাক হলাম। আমার ধারণা ছিল, প্লেনে উঠতে ভয় পায় আমার মতো একেবারে দেশজ বাঙালি মানুষ, এই সহযাত্রীর মতো হাট্টাকাট্টা বিদেশি মানুষ বুঝি এসবকে ভয়ডর পায় না। একটু হেসে বললাম, আমারও প্লেনে ভয় করে।

লোকটা এবারে একটু গম্ভীর হয়ে গেল, বলল, না না না, আমি যত ভয় পাই, আর কেউ তত ভয় পায় না। সেজন্যে প্লেনে আমি উঠতেই চাই না। উঠলেই আমাকে ড্রিংক করতে হয়। বেশি করে খানিকটা ড্রিংক করে নিলে মাথাটা হালকা হয়, ভয় কমে আসে।

আমি একটা জ্ঞানগম্ভীর মন্তব্য করার চেষ্টা করলাম, বললাম, হ্যাঁ, উচ্চতার ভীতির একটা নাম আছে, বলে এক্সোফোবিয়া─

লোকটা মাথা নেড়ে বলল, না না, এটা এক্সোফোবিয়া না। এটা হয়েছে কয়েক বছর আগে। আমি একবার─

লোকটা হঠাৎ থেমে গেল, ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ হাতের ছোট বোতলটার দিকে তাকিয়ে কোঁত করে পুরোটা একেবারে গিলে ফেলল। আমি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, একবার কী হয়েছিল?

আমি প্লেনে যাচ্ছিলাম। প্লেনটা ক্র্যাশ করে গিয়েছিল।

কী সর্বনাশ! আমি ভাল করে লোকটার দিকে তাকালাম-বলছে কী এই লোক!

হ্যাঁ। ভয়ংকর ব্যাপার। এই যে কাটা দাগ দেখছ গালে, সেটা তখনই হয়েছে। লোকটা বেশ আদর করে গালের কাটা দাগটায় একবার হাত বোলাল।

কীভাবে ক্র্যাশ করল? লোকজন কি মারা-টারা গিয়েছিল কেউ?

লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে একটু অদ্ভুতভাবে হাসল। তারপর বলল, একশো ঊনাশিজন মানুষ মারা গিয়েছিল।

একশো ঊনাশি! কী সর্বনাশ! আমার সারা গায়ে কেমন জানি কাঁটা দিয়ে ওঠে। আমাদের এই প্লেনেও তো মনে হয় প্রায় সেরকম মানুষই আছে। জিজ্ঞেস করলাম, কয়জন ছিল প্লেনে?

লোকটা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, একশো আশি।

আমি চমকে উঠে বললাম, মানে শুধু তু-তুমি?

হুঁ। লোকটা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে, আমি লক্ষ করলাম তার শরীরটা অল্প অল্প কাঁপছে। খানিকক্ষণ পর সে আমার দিকে তাকাল, আমি দেখলাম তার চোখ অল্প অল্প লাল। কে জানে মদের কেরামতি কিনা।

লোকটা আরেকটা ছোট মদের বোতলের ছিপি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলতে খুলতে বলল, আমি সেই ঘটনার কথা মনে করতে চাই না। একটা ভয়ংকর বিভীষিকার মতো ব্যাপার।

আমি একটু থতমত খেয়ে বললাম, আমি খুব দুঃখিত, আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিতে চাই নি। আমি খুব দুঃখিত─

তোমার দুঃখিত হবার কিছু নেই। আমিই তো শুরু করেছি।

শুরু করেছ বলেই যে তোমাকে এটা নিয়ে কথা বলতে হবে সেটা কে বলেছে! অন্য কিছু নিয়ে কথা বলা যাক। কতদূর যাচ্ছ তুমি?

লোকটা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, ঘটনাটা মাথা থেকে সরানো কঠিন। মনে হয় তোমাকে যদি খুলে বলি, হয়তো বুকটা হালকা হবে। বলব?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, বলো। প্লেনে বসে প্লেন ক্র্যাশের গল্প শুনতে ভাল লাগার কথা নয়, কিন্তু এরকম গল্প আমি কোথায় পাব?

শোন তাহলে। লোকটা একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে শুরু করে।

আমি তখন মোটরোলা কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেনটিটিভ। কাজের জন্যে অনেক ঘোরাঘুরি করতে হয়। বিয়েটিয়ে করি নি, ঘরে স্ত্রী-পুত্র নেই, ঘোরাঘুরিতে সময় কাটাতে খারাপ লাগে না।

অফিসের কাজে একবার গিয়েছি ভ্যানকুবার কানাডায়─ ছবির মতো শহর। বরফে─ ঢাকা পাহাড়, নীল হ্রদ, সবুজ পাইনগাছের সারি দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। একদিন থাকার কথা, তিন দিন থেকে গেলাম।

তিন দিন পর ফিরে আসব, ভ্যানকুবার থেকে প্লেনে উঠেছি, সিয়াটল হয়ে যাব টাম্পা, ফ্লোরিডা। ওয়েস্টার্ন ফ্লাইট নাম্বার তিনশো এগারো। প্লেনটা ভ্যানকুবার ছেড়েছে বিকেল পাঁচটায়, সিয়াটল পৌঁছেছে সাড়ে

পাঁচটায়। যাত্রী ওঠানামা করিয়ে আবার যখন ছাড়ল, তখন ছয়টা বেজে গেছে। সিয়াটলে খুব বৃষ্টি হয়, যখন প্লেন ছেড়েছে তখন আকাশজোড়া মেঘ, অন্ধকার, থমথমে ভাব। প্লেনটা মেঘ কেটে ওপরে উঠতেই দেখা গেল ঝকঝকে আলো, বিকেলের রোদ বেশ জানালা দিয়ে ভিতরে আসছে।

ঘণ্টাখানেক পেরিয়েছে, তখন হঠাৎ করে প্লেনের একটা ইঞ্জিন থেমে গেল। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে প্লেনটা ঘুরে যাচ্ছিল, পাইলট সামলে নিল। ওপর থেকে জিনিসপত্র পড়ে ভিতরে একেবারে আতঙ্ক। পাইলট অভয় দিয়ে বলল, যান্ত্রিক গোলযোগ, একটা ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে। ভয়ের কোনো কারণ নেই, কারণ বোয়িং ৭২৭ একটি ইঞ্জিনেই অনির্দিষ্ট সময় নিরাপদে যেতে পারে। তবুও সে কোনো ঝুঁকি নেবে না। কাছেই স্পোকেন

এয়ারপোর্টে নেমে যাচ্ছে। এখন থেকে বড়জোর পেনেরো মিনিটের পথ। আমরা সবাই সিটবেল্ট লাগিয়ে নিঃশব্দে বসে রইলাম।

এরপর দু-মিনিটও যায় নি, হঠাৎ করে প্লেনের গর্জন থেমে গেল, দ্বিতীয় ইঞ্জিনটিও গিয়েছে। নিঃশব্দে একটি প্লেন থেকে ভয়ংকর কিছু হতে পারে না। আমরা টের পাচ্ছি একটা মাটির ঢেলার মতো প্লেনটা নিচে নেমে যাচ্ছে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে সবার। ভয়াবহ একটা আতঙ্ক, তার মাঝে শুনলাম─ পাইলট বলল, ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং করছি আমরা। হাঁটুতে মাথা দিয়ে বসে থাকো সবাই।

বোয়িং সেভেন টুয়েন্টি সেভেন চমৎকার প্লেন, কোনো ইঞ্জিন ছাড়াই চমৎকার ভেসে যেতে পারে বেশ অনেক দূর। কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়, ল্যান্ড করার জন্যে সমতল জায়গা দরকার, প্লেনের দিক্ পরিবর্তনের জন্যে হাইড্রোলিক সিস্টেম দরকার। এসব কিছু ছাড়া প্লেন ল্যান্ড করার চেষ্টার বিশেষ কোনো মূল্য নেই। আমি জানালা দিয়ে তাকালাম, নিচে সুবিস্তীর্ণ ক্যাসকেড মাউনটেনস, শেষবিকেলের আলো পড়ে বরফ চিকচিক করছে। তার মাঝে প্রায় দুইশো মানুষ নিয়ে একটি প্লেন নিঃশব্দে মাটির দিকে ছুটে যাচ্ছে। প্লেনে একটি শব্দ নেই, প্রতিটি মানুষ নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে।

লোকটা একটা জায়গায় এসে একটু থামল, বোতল থেকে খানিকটা তরল পদার্থ গলায় ঢেলে দিল। আমি আড়চোখে লেবেলটি পড়ে দেখলাম, জিনিসটা হুইস্কি, যতদূর জানি এটা একটা কড়া মদ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছিল প্লেনে?

জ্বালানি তেল নিয়ে গোলমাল হয়েছিল। কানাডায় ম্যাট্রিক সিস্টেম, আমেরিকায় ব্রিটিশ সিস্টেম। প্লেনে তেল ভরার সময় দুই সিস্টেম নিয়ে গোলমাল করে যেটুকু ভরার কথা তার থেকে অনেক কম তেল ভরেছিল

সত্যি?

হ্যাঁ।

কী হলো তারপর?

সেই মুহূর্তগুলির কথা আমি বলতে পারব না। বলা সম্ভবও না। একেবারে শেষ মুহূর্তে, প্লেনটা একটা পাহড়ে ধসে পড়ার আগের মুহূর্তে শুনলাম একটা মেয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। তারপর প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেল প্লেনটা, কানে তালা-লাগানো একটা শব্দ, এরপর আর কিছু মনে নেই।

আমার যখন জ্ঞান হলো, আমি দেখলাম একটা পাইনগাছ থেকে আমি উলটোভাবে ঝুলছি। প্লেনের পুরো সিটে আমি তখনও বাঁধা। আমার শরীর কেটে-ছড়ে গেছে। কিন্তু আঘাত নেই। আমি তখন একটা ঘোরের মাঝে হাতড়ে হাতড়ে কীভাবে কীভাবে জানি গাছ থেকে নেমে এলাম। আচ্ছন্নের মতো বরফের মাঝে ইতস্তত ঘুরে বেড়ালাম খানিকক্ষণ। আমি যে বেঁচে আছি সেটাও ভালো করে বুঝতে পারছি না। সত্যি কথা বলতে কি, বেঁচে আছি কি নেই, সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল না।

ক্যাসকেড পাহাড়ের ওপর ভয়ানক ঠাণ্ডা, কিন্তু আমার সেরকম ঠাণ্ডাও লাগছিল না। খানিকক্ষণ ইতস্তত হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ করে প্লেনটা আবিষ্কার করলাম। পাহাড়ের একটা ঢালুতে ফিউসলেজটা পড়ে আছে, ঠিক মাঝখানে ভেঙে দুই টুকরো। আমি এই ভাঙা অংশ দিয়ে ছিটকে বের হয়ে এসে বেঁচে গেছি। প্লেনের পাখা দুটি নেই, ভেঙে অন্য কোথাও পড়ে আছে। প্রথমে মনে হলো হয়তো আরও অনেকে বেঁচে আছে। কাছে চিৎকার করে ডাকলাম বারদুয়েক। নিজের কানেই ভারি আশ্চর্য শোনাল সেই ডাক, কেমন যেন অতিমানবিক। কেউ কোনো উত্তর দিল না। পাহাড়ের ওপর গোধূলি বেলায় একটা আশ্চর্য রকমের নীরবতা। আমি হঠাৎ করে টের পেলাম আমার শীত করছে।

পাহাড়ে সূর্য ডোবার পর খুব দ্রুত তাপমাত্রা নেমে যায়। এ ঠাণ্ডায় মানুষের হাইপোথার্মিয়া হয়ে যেতে পারে। হাইপোথার্মিয়া হলে শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়। তখন মানুষ ঠিক করে চিন্তা করতে পারছিলাম না, হঠাৎ করে মনে হলো প্লেনের ভিতরে নিশ্চয়ই আছে। তখন ঠিক করলাম ভিতরে গিয়ে ঢুকি।

প্লেনের শরীরটা, যাকে ফিউসলেজ বলে, সেটা কাত হয়ে পড়ে আছে। দরজা শক্ত করে বন্ধ। টেনে খোলা গেল না। তখন ফিউসলেজের মাঝখানে ভাঙা অংশটুকু দিয়ে টেনেহিঁচড়ে কোনোমতে ভিতরে ঢুকে গেলাম। ভিতরে আবছা অন্ধকার, বেশ দেখা যায়। চারদিকে ধবধবে সাদা বরফ থাকলে কখনোই ঘুটঘুটে অন্ধকার হয় না। আমি ভিতরে ঢুকে কিছু গরম কাপড় খুঁজতে লাগলাম।

উপরে কম্বল রাখা থাকে। প্রচণ্ড আঘাতে ভিতরে সবকিছু ভেঙেচুরে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। কোনটা ওপরে কোন নিচে কিছু বোঝার উপায় নেই। তার মাঝে সারি সারি মৃতদেহ স্থির হয়ে পড়ে আছে। আমি আবছা অন্ধকারে হাতড়াতে থাকি, কিন্তু কোনো লাভ হলো না, কোনো কম্বল খুঁজে পেলাম না। আমি হাল ছেড়ে দিচ্ছিলাম, হঠাৎ করে মনে হলো এই লোকগুলি তো মরে গেছে, ওদের তো আর কাপড়ের দরকার নেই। ওদের গা থেকে খুলে নিই না নিচে কিছু বোঝার উপায় নেই। তার মাঝে সারি সারি মৃতদেহ স্থির হয়ে পড়ে আছে। আমি আবছা অন্ধকারে হাতড়াতে থাকি, কিন্তু কোনো লাভ হলো না, কোনো কম্বল খুঁজে পেলাম না। আমি হাল ছেড়ে দিচ্ছিলাম, হঠাৎ করে মনে হলো এই লোকগুলি তো মরে গেছে, ওদের তো আর কাপড়ের দরকার নেই। ওদের গা থেকে খুলে নিই না কেন?

কাজটা সহজ নয়-আমি আমার সেই অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই না। খানিকক্ষণ আগেও এই মানুষগুলির জীবন ছিল, এখন নেই-এই ধরনের কোনোরকম দার্শনিক চিন্তা আমার মাথায় আসে নি। আমার গরম কাপড় দরকার, যেভাবে সম্ভব এদের গা থেকে কাপড় খুলে নিতে হবে-এরকম একটা অন্ধ গোঁ ভিতরে কাজ করছিল। যতই অসুবিধে হচ্ছিল, ততই আমি এই মৃত মানুষগুলির ওপর খেপে উঠছিলাম। কতক্ষণ লেগেছিল জানি না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি কয়েকটা কোট খুলে নিতে পারলাম। প্রথমে একটা দিয়ে নিজের মাথা ঢেকে নিলাম। যত ঠাণ্ডাই হোক, মানুষের শরীর কখনো মাথায় রক্তসঞ্চালন বন্ধ করে না, তাই বেশি ঠাণ্ডায় মাথা খোলা থাকলে শরীরের তাপ খুব দ্রুত বের হয়ে যায়।

শরীর একটু ঢেকে নেওয়ার পর মনে হলো ভিতরে থাকি। কিন্তু একটু পর কেমন জানি ভয় লাগতে শুরু করল, অকারণ অর্থহীন ভয়। এতগুলি মৃত মানুষের নিশ্চয়ই কোনো একটা প্রভাব আছে। আমি তখন ভিতর থেকে বের হয়ে এলাম।

ফিউসলেজ থেকে একটু সরে একটা গাছের নিচে আগুন জ্বালাতে পারলে হতো-কিন্তু আগুন জ্বালানোর কিছু নেই, হাতের আঙুল ঠাণ্ডায় অসাড় হয়ে আছে, কিছু খুঁজে বের করারও আর ক্ষমতা নেই, তাই সে চেষ্টা করলাম না। আমি পাহাড়ে বহু রাত কাটিয়েছি, প্রতিকূল অবস্থায় কেমন করে বেঁচে থাকতে হয় জানি, কাজেই সেটা নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তা ছিল না। যেটা নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছিল সেটা খুব বিচিত্র, শুধু মনে হচ্ছিল ফিউসলেজ ভিতরকার মৃতদেহগুলি বেঁচে গেছি বলে আমার ওপর ভয়ানক রেগে আছে। তারা সবাই মিলে একটা প্রতিশোধ নেবে। ভয়ংকর ইচ্ছে করছিল এই ফিউসলেজ থেকে দূরে সরে যেতে।

কিন্তু গরম কাপড় পরে শরীরটায় উষ্ণতা ফিরে আসার পর আমার চিন্তাও খানিকটা পরিষ্কার হয়েছে। আমি জানি প্লেনটাকে খোঁজ করার জন্যে উদ্ধারকারী দল আসবে এখানে, আমি যদি দূরে সরে যাই আমাকে আর খুঁজে পাবে না। আজ রাতে আমাকে যদি খুঁজে না পায়, আমার বেঁচে যাবার সম্ভাবনা কম। আমি তাই ফিউসলেজের কাছেই থেকে গেলাম। চুপচাপ বসে বিশ্রাম নিই, যখন ঠাণ্ডায় শরীর একেবারে অবশ হয়ে যায়, উঠে খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে শরীরে একটু উষ্ণতা ফিরিয়ে আনি।

আশ্চর্য নীরব রাত সেটি। মাঝরাতে চাঁদ উঠল, সাথে সাথে পুরো পাহাড়-বনাঞ্চল আলোকিত হয়ে উঠল। পাখা ভেঙে গেছে বলে প্লেনের ফিউসলেজটাকে দেখাচ্ছে একটা সাপের মতো।

মাঝখানে ভাঙা, উঁচু হয়ে আছে। আমি বসে বসে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। তখন একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। হঠাৎ করে আমি দেখলাম প্লেনের ভাঙা অংশের মাঝখানে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।

ভয়ানক ভয় পেলাম আমি। চিৎকার করতে গিয়ে অনেক কষ্টে শান্ত করলাম নিজেকে। কী হবে চিৎকার করে?

আমি আবার তাকালাম সেদিকে। একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, একটা হাত উড়ে গেছে তার, রক্তে মাখামাখি শরীর। কোথা থেকে এসেছে সে?

মানুষটা সেখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ে আমার সারা শরীর শিউরে উঠল।

আমি দেখলাম, প্লেনের ভিতর থেকে আরেকজন মানুষ বের হয়ে তার পাশে এসে দাঁড়াল। মাথার একপাশ থেঁতলে ভিতরে বসে গেছে তার। তারপর আরেকজন।

মৃত যাত্রীরা উঠে আসছে। এক এক করে। ভয়ংকর আতঙ্কে আমি দিশেহারা হয়ে গেছি। তার মাঝে দেখলাম, তারা একে একে ফিউসলেজ বেয়ে নেমে আসছে। নরম তুষারে পা ফেলে ধীরে ধীরে আসছে আমার দিকে। অনেকটা দম-দেওয়া পুতুলের মতো।

আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকি। কোথায় যাব আমি? কী করব?

দেহগুলি আস্তে আস্তে হাত তুলে এগিয়ে আসে। ফিসফিস করে কী যেন বলছে আবার। আমি শোনার চেষ্টা করলাম। প্রথমে বুঝতে পারি নি, হঠাৎ বুঝতে পারলাম, সবাই বলছে, আমার কাপড়-আমার কাপড়-

আমি আর পারলাম না। ভয়ংকর একটা চিৎকার করে পাগলের মতো ছুটতে শুরু করলাম। পাথরে হোঁচট খেয়ে ছিটকে পড়লাম একবার। কোনোমতে উঠে আবার ছুটতে শুরু করেছি, তখন হঠাৎ প্রচণ্ড আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। জ্ঞান হারানোর আগে শুনতে পেলাম হেলিকপ্টারের শব্দ। উদ্ধারকারী দল এসে গেছে।

সহযাত্রী একটু থেমে ছোট বোতলটার অবশিষ্ট তরলটুকু কোঁত করে গিলে ফেলল। আমি সাবধানে নিঃশ্বাসটা বের করে বললাম, তারপর?

হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে সহযাত্রী বলল, বেঁচে গেলাম আমি। সবাই বলে আমি নাকি দীর্ঘদিন পাগল ছিলাম। আস্তে আস্তে ভালো হচ্ছি।

ভালো হচ্ছ? এখনও হও নি?

পুরোপুরি হই নি।

লোকটি অপ্রকৃতিস্থের মতো আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর বলল, এখনও কোন পাহাড়ে কিংবা বরফের ওপর যেতে পারি না। প্লেনে চড়তে ভয় হয়। মাঝে মাঝে কোনো কারণ ছাড়াই ভয়ংকর শীত লাগতে থাকে, তখন নাকি লোকজনের গা থেকে জোর করে কাপড় খুলে নিতে চেষ্টা করি।

আমি কিছু না বলে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। লোকটা হঠাৎ একটু শিউরে উঠল। আমি ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হলো?

না, কিছু না, একটু শীত করছে।

শীত করছে? শীত! আমি লাফিয়ে উঠে চিৎকার করতে থাকি, এয়ার-হোস্টেস, এয়ার-হোস্টেস, একটি কম্বল এদিকে, কম্বল─

প্লেনের সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল।

……………………………….(সমাপ্ত)……………………………..

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত