আমি আগাগোড়াই রাজধানীতে বেড়ে উঠা মানুষ। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব ঢাকাতেই ছিল। কিন্তু বর্তমানে চাকুরী করছি ঢাকার বাইরে। মূলত ভালো বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার লোভেই এখানে আসা। আমার পরিচিত বলতে এখানে কেউ নেই। বা-মা, বন্ধু-বান্ধব, আত্নীয়-স্বজন সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন আছি গত মাস-চারেক ধরে। প্রথম প্রথম কয়েকদিন খুব খারাপ লেগেছিল। পরিবারের মানুষগুলোর কাছ থেকে কখনো দূরে থাকতে হয়নি বলে তাদের অভাবও কোনোদিন অনুভব করিনি। আসলে মানুষ যখন নিয়মিত কাউকে দেখে, কারো সাথে মেশে…তার অভাব কখনো বোধ করেনা বরং তার নিয়মিত উপস্থিতিই মাঝে মধ্যে একঘেঁয়ে লাগে।
আমাদের কোম্পানীতে স্টাফদের থাকার জন্য একটি আলাদা কোয়াটারের ব্যবস্থা আছে। সমস্যা একটাই, তা হল-এক রুম দুজনকে শেয়ার করতে হয়। আমার রুমমেট হলেন আদিল ভাই। তিনি আমার ডিপার্টমেন্টেই কাজ করেন। আদিল ভাইকে পছন্দ করে এমন একজন লোকও অফিসে নেই। অপছন্দের কারনটা ২-১দিনের মাথায় বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম। উনি কখনোই কোনো কথা সোজা ভাবে বলেন না। প্রত্যেকটা কথার মধ্যে একটা খোঁচা থাকবেই। আকার-ইঙ্গিতে, ভাব-ভঙ্গিতে সবসময় বোঝাতে চেষ্টা করেন যে তার চেয়ে জ্ঞানী এবং দক্ষ লোক এই অফিসে আর কেউ নেই। আর চোখে মুখে সর্বদাই কেমন যেন একটা রহস্যের আঁভা দেখতে পাওয়া যায়। ভাবখানা এমন যে উনি কোনো আধ্যাত্নিক টাইপের লোক। অফিসের মোটামুটি সব কলিগের সাথেই নাকি অন্তত একবার হলেও তার কথা কাটাকাটি হয়েছে। ইদানিং অবশ্য সবাই তাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। আমার এমনই পোঁড়া কপাল যে এই লোকই আমার রুমমেট!
একসাথে একই রুমে থাকলে মানুষের ভীমরতিগুলো খুব চোখে পড়ে। প্রত্যেকটা মানুষেরই অবশ্য কিছু না কিছু ভীমরতি থাকে সেটা মেনে নেয়াই যায় কিন্তু এই লোকের ভীমরতির কোনো শেষ নেই। তাছাড়া মাঝে-মধ্যে এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা বলেন যে হজম করা খুব কষ্ট হয়ে পড়ে। মোট কথা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে তার সাথে একরুমে থাকা প্রায় অসম্ভব। ৩-৪ দিনের মাথায় আমার নাভিশ্বাস উঠে গেল। আমি অফিসের আর একজন সিনিয়র কলিগ রেহান ভাইয়ের সাথে আমার সমস্যার কথা শেয়ার করলাম। রেহান ভাইয়ের সাথে প্রথম দিন থেকেই আমার একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। উনি জানালেন যে কেউই নাকি আদিলের রুমে বেশিদিন টিকতে পারে নাই। ঐ রুমে নাকি একটা বেড বেশিরভাগ সময় ফাঁকাই থাকে । তবে তিনি আমাকে হুট করে রুম না ছাড়ার পরামর্শ দিলেন। কারন হিসেবে বললেন যে, আদিল মারাত্নক গিরিঙ্গিবাজ ও ঝঁগড়াটে লোক। রুম ছাড়ার মত ছোট একটা ঘটনাকে বিশাল ইস্যু বানিয়ে গ্যাঞ্জাম-ক্যাচাল সৃষ্টি করবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত। আমার মত একজন নতুন ইমপ্লয়ীর জন্য সেটা নাকি মোটেও সুখকর হবেনা।
কিন্তু এদিকে তো আমার জান যায় যায় অবস্থা। মাঝে মাঝে আদিলের উপর মেজাজ এমন খারাপ হয় যে ইচ্ছে করে বাম হাতে একটা থাপ্পর লাগাই। এই তো সেদিন…কথা নাই বার্তা নাই রাত তিনটার দিকে হঠাৎ আমাকে ডাকতেছে, তাও আবার উচ্চস্বরে! আমি তো হুরমুর করে জেগে উঠলাম। উঠে দেখি উনি একটা নিভানো সিগারেট মুখে নিয়ে বসে আছেন। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “”আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? হঠাৎ সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখি ম্যাচ নেই। আপনার কাছে ম্যাচ হবে”?” আমার মেজাজটা এত খারাপ হয়েছিল যে বলার মত না! নিজেকে অনেক কষ্টে সামলালাম। তাকে কোনো উত্তর না দিয়েই আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন অফিসে গিয়ে রেহান ভাইকে বললাম, “ভাই আপনি আমাকে এই ভেজাল থেকে উদ্ধার করেন নাহলে আমার চাকরিই ছাড়তে হবে””। আমার কথা শুনে রেহান ভাই কিছুক্ষন হাসলেন। তারপর বললেন, “”আসলে আপনাকে আগে কোনোদিন রুম শেয়ার করতে হয়নি তো তাই আপনি একটু বেশিই বেকায়দায় পড়ে গেছেন। তাছাড়া আপনার ভাগ্যটাও এত খারাপ যে আদিলের সাথেই আপনাকে রুম শেয়ার করতে হচ্ছে। যাকগে টেনশনের কিছু নেই। আপনার একটা ব্যবস্থা আমি করবই””। রেহান ভাইয়ের কথায় আমি আশ্বস্ত হতে পারলাম না। উনি কিইবা ব্যবস্থা করবেন? হয়ত আমাকে একটু সান্ত্বনা দিলেন। হয়ত তিনি ধরে নিয়েছেন কদিন পর আমার এমনিতেই এডজাস্ট হয়ে যাবে। মানুষ পারে না এমন কি কিছু আছে?
এভাবেই আরো বেশকটা দিন পার হয়ে গেলো। আদিলের সাথে এডজাস্ট করা কোনোদিনই সম্ভব হবে না তা আমি ভালোভাবেই জানতাম। পরিবার পরিজন থেকে দূরে থাকায় এমনিতেই মন খুব একটা ভালো থাকে না তার উপর আদিলের মত একটা পেইন! মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম…আমার সমস্যার কথা বসকেই জানাবো। তিনি কোনো ব্যবস্থা না করলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবো।
এর মাঝে তিনদিনের টানা ছুটি পেয়ে একদিন ঢাকায় চলে গেলাম। ছুটি কাটিয়ে যখন আবার কোয়াটারে ফিরলাম তখন দেখি আদিল নামক “পেইন”টা নেই। আশেপাশের কলিগদের কাছে জানতে পারলাম সে নাকি ৭দিনের ছুটি নিয়েছে। কথাটা শুনে মনে মনে ঈদের আনন্দ পেলাম। যাক ৭দিন অন্তত মহাসুখে কাটানো যাবে। কিন্তু সেদিন রাতেই ঘটল আমার জীবনে এক স্মরনীয় ঘটনা। বলে রাখা ভালো যে, আমি যে রুমে থাকি তা নিচতলায় অবস্থিত। নিচতলায় মশার উপদ্রপ বেশি বলে কখনোই জানালা খুলে ঘুমাই না। সেদিন কেন জানি মনে হচ্ছিল জানালা খুলেই ঘুমাবো। পরে আবার চিন্তা করলাম…থাক দরকার নেই। দরজা-জানালা সবকিছু লক করা আছে কিনা তা চেক করে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
মাঝরাতে হঠাৎ নিম্নচাপ অনুভব করায় ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। উঠে যা দেখলাম তা দেখে তো আমার চক্ষু ছানাবড়া। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে যা দেখছি তা ঠিক দেখছি কিনা! ভালো করে চোখ ডলতে লাগলাম। দেখলাম…আদিল ভাইয়ের খাটের উপর যে তোশক এবং চাঁদর ছিলো তা মেঝেতে ফালানো। খাটের এক কোনার দিকে তা স্তুপাকৃতি হয়ে আছে। কিন্তু কে করলো এই কাজ? বাসায় তো আমি একা! চোর ডাকাত ঢুকলো নাতো বাসায়? আমি উঠে দরজা-জানালা সবকিছু আবার চেক করলাম। কই সবই তো ঠিক আছে। চোর ডাকাত ঢুকলে তো দরজা-জানালা ভেঙ্গে ঢুকতে হবে। সব দরজা-জানালা ভিতর থেকে লক করা। তাহলে চোর ঢুকলো কিভাবে? তাছাড়া আমার দুটা দামী মোবাইল সেট, নেটবুক ছাড়াও আরো অনেক জিনিসপত্র আছে বাসায়। চোর ঢুকে থাকলে সেগুলো রেখে যাবে কেনো? তার মানে কি দাড়ালো এটা কোনো ভুত-প্রেতের কাজ?…এছাড়া এই ঘটনার আর কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারলাম না। আমি ছোটবেলা থেকেই ভুত-প্রেতে বিশ্বাস করিনা। কিন্তু এখন চোখের সামনে যা দেখছি তাই বা অবিশ্বাস করি কিভাবে? মনে মনে ঠিক করলাম অন্য কলিগদের এত রাতে আর বিরক্ত করবনা। একটু পরেই তো সকাল হবে তখন সবাইকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলব।
ভোরের আলো ফুটতেই আমি নক করলাম লিমন ভাইদের ফ্ল্যাটে। আমার ঠিক পাশের ফ্ল্যাট। এত সকালে আমাকে দেখে একটু অবাকই হলেন লিমন ভাই। আমি লিমন ভাইকে রুমে নিয়ে আসলাম। পুরো ব্যাপারটা খুলে বললাম। উনি আমার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন…””তার মানে আপনি বোঝাতে চাচ্ছেন এগুলা ভুতের কাজ? দেখেন…আমি এসব অতিপ্রাকৃ্তিক ব্যাপার স্যাপার একদমই বিশ্বাস করিনা। আপনার নিশ্চয়ই কোনো ভুল হচ্ছে। হয়ত আপনি ঠিকমত দরজা লক করে ঘুমান নি। দরজা খোলা ছিল এবং খোলা দরজা দিয়ে কেউ ঢুকে এই কাজ করেছে”।” আমি লিমন ভাইকে বললাম, ““ভাই, আমারও আপনার মতই এরকম কিছু একটা সন্দেহ হচ্ছিল। তাই সবার প্রথমে দরজা খোলা আছে কি না তা চেক করেছি। আর খামাখা তো আমার এরকম একটা নাটক সাজানোর কোনো দরকার নেই, তাই না?”” লিমন ভাই হেসে বললেন, ““আমি কি বলেছি নাকি আপনি নাটক সাজিয়েছেন? তবে আমার মনে হচ্ছে ঘুমের ঘোরে কাজটা আপনিই করেছেন কিন্তু এখন আর মনে করতে পারছেন না”।” লিমন ভাইয়ের কথা শুনে আমার মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেলো। আমি চিৎকার করে বললাম, “”তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি সিজোফ্রেনিক?”” আমার চিৎকার শুনে দেখি রেহান ভাই হাজির। উনি আমার সব কথা শুনে বললেন, “”আচ্ছা আপনি কি নিশ্চিত যে আপনার কোনো কিছুই খোয়া যায় নি? আপনি একটু ভালো করে দেখবেন সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা?”” আমি রেহান ভাইকে বললাম, “”ভাই আপ্নারা কেনো বিশ্বাস করছেন না যে এখানে চোর ঢোকেনি। এখানে অন্যরকম কিছু একটা ঘটেছে”।” রেহান ভাই বললেন…””আপনি এই মূহুর্তে মেন্টাল স্ট্রেসের মধ্যে আছেন। এই অবস্থায় স্বাভাবিক চিন্তা করাটা কঠিন। আমি যা বলি শুনুন। একটু ভালো করে খোজ করুন যে আপনার কিছু খোয়া গেছে কিনা!”” রেহান ভাইয়ের কথা শুনে মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ মনে হল যে আমার মানিব্যাগটা চোখে পড়ছে না। তন্ন তন্ন করে সারা রুম খুজলাম কিন্তু মানিব্যাগটা আর খুজে পেলাম না। আমার মনে পড়ল যে কাল রাতে আমি আমার মানিব্যাগটা রেখেছিলাম আদিল ভাইয়ের খাটের উপর। রেহান ভাই বললেন, “”কাল রাতে একটা চোর আমার রুমের জানালাও খোলার চেষ্টা করেছে কিন্তু ভিতর থেকে লক করা ছিল বলে খুলতে পারেনি। আমার অবশ্য সেই সময় চিৎকার করা উচিৎ ছিল তাহলে হয়ত চোরটা পালিয়ে যেত আর আপনার উপর দিয়ে এই শনির দশা যেত না। ভুল হয়ে গেছে। আমি খুবই সরি”।” আমি বললাম…””ভাই আমার জানালাও তো লক করা তাহলে চুরির ঘটনা কিভাবে ঘটল? আমি বা আদিল ভাই তো কখনো জানালা খুলিনা। এই দেখেন এখনো জানালা লক করা”।” রেহান ভাই লক করা অবস্থায় আমার থাই জানালা খোলার চেষ্টা করলেন এবং অবাক বিস্ময়ে দেখলাম জানালাটি খুলে গেলো। রেহান ভাই হেসে বললেন, “”আপনার জানালার লক নষ্ট। চোর ঠিকই জানালা খুলেছে এবং হাত বাড়িয়ে আস্তে আস্তে আদিলের তোশকটি টেনে এনেছে। তার চুরির লক্ষ্যবস্তু ছিল আপনার মানিব্যাগটি যা আপনি ভুলে আদিলের বিছানার উপর রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তবে রসিক চোর চৌর্যকর্ম শেষে জানালাটা টেনে ঠিক আগের অবস্থায় রেখে গেছে। তাই তাৎক্ষনিকভাবে চুরির ব্যাপারটা আপনার মাথাতেই আসেনি”।”
রেহান ভাইয়ের কথা শুনে লিমন ভাই হো হো করে হাসতে লাগলেন। আমাকে টিটকিরির সুরে বললেন, “”ভাই আমি আপনার কথা শুনে কিন্তু একটা সময় বিশ্বাসই করে ফেলছিলাম যে এটা ভুতের কান্ড। আপনি আমার এতদিনের লালিত বিশ্বাস মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রায় ভেঙ্গে ফেলেছিলেন…হাহাহাহাহাহা!”” উনার কথা শুনে আমিও হেসে দিলাম।
রেহান ভাই আমাকে বললেন, “”এখন অফিসে গিয়ে পুরো ব্যাপারটা বসকে জানান। গিয়ে বলেন যে এই রুমে আপনি মোটেও নিরাপদ না। আর দোতালায় জহির সাহেবের রুমে একটা বেড খালি আছে। আপনি বসকে বলে আজকেই সেখানে উঠে যান”।”
আমি বসকে পুরো ব্যাপারটা জানালাম। উনি কোয়াটারটির সিকিউরিটি ম্যাটার নিয়ে খুবই কনসার্ন্ড হলেন এবং পুরো ব্যাপারটার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমি সেদিনই আমার রুম চেঞ্জ করে ফেললাম। সেদিন থেকে আজ অবধি বেশ শান্তিতে আছি। আমি এখন আদিল থেকে মুক্ত। যদিও আমার মানিব্যাগে হাজার পাঁচেক টাকা ছিল এবং বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজ ছিল কিন্তু এটা কোনো ব্যাপারই না। মানিব্যাগটা চুরি না হলে তো আর আদিলের মত মহাপেইন থেকে মুক্ত হতে পারতাম না এত সহজে!
ঘটনার সপ্তাহখানেক পর একদিন রেহান ভাই আমার সেই হারানো মানিব্যাগ আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি অবাক হয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম…”এটা আপনি এতদিন পর কোথায় পেলেন?” উনি রহস্যমাখা একটা হাসি দিয়ে বললেন, “”আমি কিন্তু কথা দিয়েছিলাম যে আপনাকে আদিল থেকে মুক্ত করার একটা ব্যবস্থা করবই”।”