আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে, ঠিক এমনি এক দিন রাতের বেলায় আমি আর নিতাই-দা বেড়িয়ে ছিলাম হসপিতাল থেকে লাশ নিয়ে, নিতাই দা বরাবর-ই রাতের বেলায় লাশ নিয়ে যাবার সময়, আমাকে হাক পাড়তো। আর আমিও যেতাম, যা টাকা পেতাম পুষিয়ে যেত। আমি হেল্পার ছিলাম, তখন আমার বয়স অল্প ছিলো, ভারী ভারী কাজকর্ম নিমেষে সেড়ে ফেলতাম। আমি যেদিন কার কথা বলছি সেদিন শীতের রাত ছিলো, রাত ৮.০০ টার সময় নিতাই-দা আমার বাড়িতে এম্বুলেন্স নিয়ে আসে, এবং বলে আজ একটা লাশ, কলকাতার আশেপাশে কোন এক জায়গাই নিয়ে যেতে হবে, বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকাপাবো।
আমিও রাজী হলাম, কলকাতা এখান থেকে অনেক দূরে, বেশ লম্বা যাত্রা, লাশ নিয়ে বেড়োতে বেড়োতে সেদিন রাত ১১.০০ টা বেজে গেছিলো।
হসপিটাল থেকে রাত ১১.০০ টার সময় রওনা দিলাম। ব্যস, তারপর থেকেই শুরু হলো ভুতুড়ে উপদ্রব।
বেশ খানিক – টা এগিয়ে গেছি হসপিটাল থেকে, আমি জিজ্ঞেস করলাম – নিতাই-দা সুইসাইড নাকি মার্ডার। আর কার লাশ-ই বা নিয়ে যাচ্ছি আমরা।
নিতাই-দা – চুপ….তোকে সব পড়ে খুলে বলবো। খালি এই টুকু জেনে রাখ, এটা একটা দাগী আসামির লাশ।
আমি চুপ করে গেলাম। রাতের বেলায় হসপিটাল থেকে এর আগেও অনেক অনেক লাশ নিয়ে গেছি ব্যাপার – টা জানি, আমি রাতের বেলায় পথ পুরো ফাঁকা, শীতের রাত।
বেশ জোরেই ছুটছিলো এম্বুলেন্স। হঠাৎ এম্বুলেন্সের পেছন থেকে অদ্ভুত একটা গোঙানির আওয়াজ এলো,
আমি ব্যাপার – টা এড়িয়ে গেলাম। এতো জোরে চলছিলাম যে নিমেষের মধ্যে মাঝামাঝি পথ অতিক্রম করে ফেলেছিলাম। ব্যাপার -টা ভালোভাবে খেয়াল পড়লো তখনি,
এম্বুলেন্সের পেছন থেকে একটা ভারী পুরুষের গলা ভেসে এলো – দরজা-টা খোল, আমার কষ্ট হচ্ছে।
আমি নিতাই-দা বললাম – পেছনে-কি কেউ বসে আছে নাকি?
নিতাই-দা – কই কেই নেইতো কেন?
আমি – এম্বুলেন্সের পেছন থেকে কেমন একটা আওয়াজ পেলাম, কে যেন বলে উঠলো….আমাকে ছেড়ে দে। আমার কষ্ট হচ্ছে।
নিতাই-দা বললো – তোর মনের ভুল, আমি অনুমান করতে পেরেছিলাম, নিতাই-দা পুরো ব্যাপার-টা এড়িয়ে যেতে চাইছে।
ধীরেধীরে পেছন থেকে আওয়াজ আসতে লাগলো, কেউ যেমন দরজা ধাক্কালে যেমন আওয়াজ হয় ঠিক সেইরকম। যার পরিমাণ ধীরেধীরে বাড়তেই চলেছিলো, আমরা আমাদের গন্ত্যবের পথে দ্রুত এগোচ্ছিলাম, হঠাৎ এম্বুলেন্সের চাকা পাংচার করে,
নিতাই-দা গাড়িটাকে দ্রুত দাঁড় করিয়ে দেয়,
নিতাই-দা – যাতো এম্বুলেন্সের পেছনের দরজা খুলে লাশের মাথার কাছে একটা টায়ার আছে, ওই টায়ার-টা নিয়ে আয়।
নিতাই-দার মুখের দিকে আমি তাকিয়ে রইলাম, নিতাই-দা আবারো বললো – কি রে যা, নিতাই-দা বোধহয় আমার অবস্থা বুঝতে পেরেছিলো, তাই বললো থাক, যেতে হবেনা। আমার ড্রাইভর সীটের নীচে একটা টায়ার আছে, তুই বেড়ো, আমাকে টায়ার লাগাতে সাহায্য কর।
আমি – গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেড়োলাম। প্রচণ্ড শীত ছিলো, আমি আর নিতাই-দা দ্রুত টায়ার লাগানোর কাজ সারছিলাম। হঠাৎ এম্বুলেন্সের মধ্যে ভৌতিক ক্রিয়াকালাপ শুরু হতে লাগলো,
চিন্তা করে দেখবেন ফাঁকা রাস্তায় আপনি ও আপনার বন্ধু দাঁড়িয়ে আছেন, সাথে আছে একটা এম্বুলেন্স যাতে করে আপনি লাশ নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু হঠাৎ সেই এম্বুলেন্সের মধ্যে যদি ভৌতিক ক্রিয়াকালাপ ঘটে তখন আপনি কি করবেন। একটু চিন্তা করে কমেন্টে উত্তর দেবেন।
আমাদের টায়ার লাগানোর কাজ প্রায় শেষ এমন সময় এম্বুলেন্সের হর্ণ আপনা আপনি বেজে উঠলো, তারপরেই কে জেন বলে উঠলো – এতক্ষণ অনেক ভালোভাবে বলেছি দরজা খোলার কথা, তোরা খুললি না। এবার দেখ দরজা খুলতে হয় কিভাবে, এইবলে এম্বুলেন্সের পেছনের সজোরে ধাক্কাতে থাকে, তিন-চার বার এতো জোরে ধাক্কা দেয় যে দরজা-টা ওই এম্বুলেন্স থেকে প্রায় দশ হাত দূরে ছিটকে পড়ে, এম্বুলেন্সের থেকে একজন ভারী চেহারার কেউ একজন নীচে নেমে আসলো, উনি যেই আমাদের সামনে ঘুরে দাঁড়ালো, তখন আমরা দুইজনেই চিৎকার করে উঠলাম। একজন ভারী বয়সের উলঙ্গ পুরুষ দেহ। যার বুকে-পেটে ছিলো অজস্র সিলাই এর দাগ, মাথার কাছে অর্ধেক অংশ বিশ্রী ভাবে ফেঁটে গেছে, একটা চোখ নেই, আর আরেক-টা চোখ বাইরে বেড়িয়ে এসেছে। আমরা ওই দেখে প্রাণপণ দৌঁড় দিলাম, পেছনে ঘোরার সাহস দেখালাম না। যেইনা ত্রিরিশ-চল্লিশ হাত দূরে চলে এলাম তখনি পেছন থেকে একটা বিস্ফোরণের আওয়াজ পেলাম, আমরা তবুও আমরা পেছন ঘুরিনি, বেশ অনেক-টা দূরে গিয়ে পেছন ফিরে দেখি আমাদের থেকে শত হাত দূরে এম্বুলেন্স-টা আগুনে জ্বলছে।
আমরা এবার ধীরেধীরে হাঁটা শুরু করলাম। আর পারছিলাম না পেটে ব্যথা করছিলো, বেশ অনেক-টাই এগিয়ে গেছি হঠাৎ পেছন থেকে অদ্ভুত একটা আওয়াজ পেলাম। আমরা পেছন ফিরে চমকে উঠলাম, আমরা পেছন ফিরে দেখি ওই সেই ডেডবডি-টা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। রাগে পুরো গজগজ করছে। আমরা দিলাম দৌঁড়, গায়ে যতো জোর আছে দৌঁড়ানোর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলাম। কত-টা দৌঁড়েছি জানিনা, একসময় আমরা দুইজন-ই চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম, আশেপাশের সব কেমন ঘোলাতে ঘোলাতে লাগলো। তারপর কি হয়েছে, আমরা কেউ জানিনা, সকালে উঠে দেখি, আমরা এম্বুলেন্সেই বসে আছি, আমরা দ্রুত এম্বুলেন্স থেকে নেমে পড়লাম।
তারপর কি হয়েছিলো বাবা? বলো বলো।
রাত অনেক হয়েছে – ঘুমা।
বলোনা বাবা তারপরে কি হয়েছিলো, ওইতো ওই কদমগাছ-টা দেখছিস। ওইখানে এম্বুলেন্স-টা দাঁড়িয়ে ছিলো, আমরা এম্বুলেন্স থেকে নেমে দেখি, ওই ডেডবডি-টা সহ আমি ও নিতাই-দা মাটিতে পড়ে আছি, আশেপাশে পুলিশ ও জনগণে ভীড় করে আছে।
নে এইবার ঘুমিয়ে পড়, নাহলে তোর মা এসে আমাকে বকা দেবে। কি আজব ছেলেপুলে আমার, ভুত হয়ে ভুতের গল্প শুনছে, ভুত সমাজের নাম মাটিতে মিশিয়ে দিলো।
এই তোরা ঘুমিয়ে পর, আমি একপাক সামনের ওই ঘোষবাবুর পুকুর থেকে ঘুরে আসি, বেশ টাটকা টাটকা মাছ ওই পুকুরের, তোরা ঘুমো, কাল সন্ধ্যাবেলা খাবার নিয়ে আসবো ক্ষণ।