রাজপুত্রী

রাজপুত্রী

আজো শেষ রাতে কারোর আর্তচিৎকারে ঘুম ভাঙলো তুয়োশার গ্রামবাসীর। জংগলের মধ্যে পরে আছে একটি
ছেলের লাশ। ঠিক আগের মতো করেই মৃত্যু ঘটেছে এই ছেলেটিরও। ইতমধ্যে রাজা অরকনের কাছে খবর পৌছে
তিনিও উপস্থিত হয়েছেন ঘটনাস্থলে। সূর্য ওঠা শুরু করেছে ইতোমধ্যে। “কি আশ্চর্য!”, বলে উঠলো রাজা
অরকন। এক মাসে পাঁচ পাঁচ টা খুন একই ভাবে। “মন্ত্রী”, হুংকার ছাড়লেন অরকন সিং। “কে? কে করছে এসব?
এভাবে এতোগুলা খুন হয়ে গেলো কিভাবে? কে করছে কিভাবে করছে এখনো কিছু জানা গেলো না। ছিঃ কি
লজ্জার বিষয়। আর এই ছেলেটা কে? কার পুত্র?” “এখনো কিছু জানা যায়নি মহারাজ” প্রতিউত্তরে বললেন
মহামন্ত্রী। “মহারাজ মহারাজ” পাশে থেকে করুণ স্বরে বলে উঠলো এক গ্রামবাসী লোক “মহারাজ এই ছেলের
নাম রোমান। রামদাসের ছেলে। এরো কাল বিয়ে ছিল। “ওরে আমার ছেলে রে”, দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে দুই বুড়
বুড়ি। “আমার ছেলের এ কি হলো রে। ওই ডাইনিটাই মেরেছে আমার ছেলেকে” বলে কাঁদতে লাগলো রামদাস আর তার বউ। এই একমাসের মধ্যে পাঁচ টা খুন হয়েছে। সবগুলো খুন একই পদ্ধতিতে করা হয়েছে। অত্যন্ত নিষ্ঠুর ভাবে। ঘাড়ের কাছে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। রক্ত ক্ষরণ হয়ে মারা গেছে। যারা মারা গেছে তাদের সকলেরই ছিল পরেরদিন বিয়ে। আর প্রত্যেকবার লাশের পাশে নূপুর পরে থাকতে দেখা গেছে। একই নকশার পাঁচটি নূপুর। প্রথমে মনে করা হয়েছিল যে খুনি হয়তো ভুলে তার নূপুর ফেলে রেখে গেছে। কিন্তু বারবার একই কান্ড দেখে
বোঝা যায় যে সে ইচ্ছে করেই নূপুর থুয়ে যায়। গ্রামবাসীর ধারনা যে এ নিশ্চয় কোনো ডাইনির কাজ। আর এই নূপুরগুলো সাধারণ নূপুর নয়। হিরে দিয়ে অত্যন্ত সুন্দর নকশা করা নূপুর। এর সৌন্দর্য কল্পনারও বাইরে। আর এর চমক এতো যে একটি ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘর আলোকিত করতে যথেষ্ট। এই আলোর জের ধরেই লাশ খুঁজে পাওয়া যায় বারবার। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। হঠাৎ প্রাসাদে রাজপুরোহিতের আগমন। মহারাজ নিজ কক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। চিন্তায় তার মাথায় হাত। সারাদিনই ভেবেছেন এই খুন গুলো নিয়ে। নাওয়া খাওয়া ডগে উঠেছে তার। কিন্তু
বিকালের দিকে খবর এসেছিল, রাজপুরোহিত নাকি এই নূপুর সম্পর্কে তথ্য জোগার করেছেন। সেই কথা শুনে একটু সস্তির নিঃশ্বাস দিয়েছেন মহারাজা অরকন সিং। পুরোহিতের আগমনের খবর পেয়ে তাকে নিজ কক্ষে ডেকে পাঠালেন অরকন সিং। “আসেন পুরোহিত মশাই, বসেন” বললেন মহারাজ, “তাড়াতাড়ি বলেন নূপুর গুলো কার?
রাজপূরোহিত বলা শুরু করলেন “মহারাজ, এই নূপুর গুলো কোনো যাতা নূপুর নয়। আর এগুলো এখানে পাওয়াও যায়না। কতটুকু সত্যি জানি না কিন্তু কাহিনী খুবই অদ্ভুদ। আপনি তো জানেন এই রাজ্য থেকে অনেক দূরে সুগভীর রূহ সাগর আছে। কিন্তু বহুকাল আগে সেখানে ছিল একটি নগরী। নাম ছিল রূহী নগরী। এই নগরীর রাজপুত্রী ছিলেন রূহানী। রাজা রানীর একমাত্র কন্যা রূহানী। রুপে গুনে কোনো কমতি ছিলনা তার। রাজ্যের সবাই তাকে ভালোবাসতো। দেখতে দেখতে রাজকন্যা বিয়ের উপযোগী হয়ে গেলো। একদিন তার বিয়ে ঠিক হলো তুয়োশা রাজ্যের মানে এই রাজ্যেরই এক রাজপুত্র মহারাজা বিজয় সিং এর পুত্র কুমার অনুপম সিং এর সাথে। কিন্তু কুমার অনুপম বেশ সুবিধার ছিলেন না। রাজ বন্ধুত্বের জন্যই তার বাবা এই বিবাহের সিদ্ধান্ত তার ঘারে চাপিয়ে দিয়েছিলেন। এর আগে অনুপম অনেক মেয়ের ধর্ষণ করেছিল। রাজপুত্র বলে তার বিচার হয়নি কখনো। তাছাড়াও বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনেক ছোটো ছোটো রাজ্যের রাজপুত্রী দের সাথেও…কিন্তু কারোর সাথেই বিবাহ করেনি। এই নিয়ে মহারাজা বিজয় সিং এর অনেক শত্রু গড়ে উঠেছিল। অনেক বন্ধু রাজ্য শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ছেলেকে অনেক ভালোবাসতেন তিনি। তাই সব অন্যায় মেনে নিতেন। এতে তুয়োশার রাজবংশ সহ রাজ্য পর্যন্ত কলঙ্ক এর আধারে ঢেকে গিয়েছিল। কিন্তু কারোর কিচ্ছু বলার ছিল না। এভাবে শত্রুর পরিমাণ এতো বেড়ে গেলো যে রাজবংশের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার মতো অবস্থা চলে আসলো। ওই সময় রূহী নগরী ছিল অনেক উন্নত আর শক্তিশালী। তাই নিজেদের অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে রাজা বিজয় সিং ফন্দি আটলেন। আর নিজের লম্পট ছেলের সাথে রাজপুত্রী রূহানীর বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে পাঠালেন। রূহী নগরীর রাজা তা গ্রহণ করলেন। কিন্তু রূহানীর মত ছিলনা এ বিয়েতে। তবুও রূহানীর কোনো কথাই শুনলেন না তার বাবা। ঠিক হয়ে গেলো রূহানী আর অনুপমের বিবাহ। বিয়ের কোনো ইচ্ছাই ছিলনা অনুপমের। ধান্ধায় ছিল বিয়ে ভাঙার। কিন্তু সে এতোটাই দুশ্চরিত্র ছিল যে বিবাহের ইচ্ছা না থাকলেও রাজপুত্রীকে ভোগ করার ইচ্ছা প্রবল ছিল তার। বিয়ের আগের দিন সে প্রস্তাব দিল যে রাজকন্যাকে নিয়ে সে বনে ঘুরতে যাবে। রাজকন্যার এই বিয়েতে মত ছিলনা তাই ঘুরতে যেতেও রাজী হলেননা তিনি। কিন্তু হবু জামাইয়ের আবদার রাখার জন্য রীতিমতো জোর করেই রূহানীকে পাঠানো হলো অনুপমের সংগে। তারপরের কাহিনী খুব করুণ। অনুপম তার আসল রূপ দেখালো। এদিকে প্রাসাদে কারোর ঘুম নেই। সারারাত পার হয়ে যেতে লাগলো কিন্তু অনুপম আর রূহানীর কোনো খবর নেই। সকালে মহারাজ তার দল বল নিয়ে নিজেই গেলেন তার পুত্রী আর হবু জামাইকে খুঁজতে। অনুপম ততক্ষণে তুয়োশা রাজ্যের পথে রৌনা দিয়েছে। আর রাজা খুঁজে পেলেন তার আদরের পুত্রীর নিথর দেহ। অনুপম নামের দানবটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছিল রাজপুত্রীর পুরো শরীর। তার দেহের পাশেই ছিঁড়ে পরেছিল তার শখের একটি নূপুর। আরেকটি পায়েই ছিল। সেই নূপুর আর এই নূপুর দুটির নকশা একই। আর এই বিশেষ জাতের নূপুর শুধু রূহী নগরীতেই
পাওয়া যেতো। আর রাজপুত্রী রূহানীর সবচেয়ে পছন্দের অলংকার হিসেবে এর খ্যাতিও কম ছিলনা। আর
তারপরের ঘটনা শুনুন। রূহানীর এই করুণ পরিণতি দেখে রাজা নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। রাজা যুদ্ধ ঘোষণা করলেন বিজয় সিং ও তার পুত্র অনুপমের বিরুদ্ধে। কিন্তু পরাজিত হলো রূহী নগরী। তারপর একদিন প্রলয় দেখা
দিলো। সারারাত মহা দুর্যোগের পর সকাল হতে হতে বিলীন হয়ে গেলো রূহী নগরী। আর জন্ম হলো রূহ সাগরের।
কিন্তু মজার বিষয় হলো সেই মহা দুর্যোগে সেই রাজ্যের একটি নারীও মারা যায়নি। কিন্তু একটা পুরুষেরও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। রানী জীবিত ছিলেন কিন্তু রাজাকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আপনি তো
জানেন, রূহ সাগরের পাশে অনেক কুঁড়েঘর আছে যেখানে শুধু মেয়েদের থাকতে দেখা যায়। এই সাগরের ধারের কাছেও কোনো পুরুষ গেলে আর ফিরে আসেনা। বলা হয়
যে সেইদিনকার সেই দুর্যোগ রাজপুত্রী রূহানীর রুহ এর অভিশাপে এসেছিল। তাই এই সাগরের নাম রূহ সাগর।
এখনো বলে সেখানে রূহানীর রূহ বসবাস করে। তাই কোনো পুরুষ সেখানে গেলেই সেই সাগর তাকে খেয়ে ফেলে। এই ছিল ঘটনা মহারাজ।
“কিন্তু পুরোহিত মশাই”, বলা শুরু করলেন মহারাজ অরকন সিং, “এতো বহুকাল আগেকার ঘটনা। ওদের কেউই বেচে নেই। আর নাই আছে সেই নগরী। তাহলে কে প্রতিশোধ নিবে আর কেনো? তাছাড়াও ওই নূপুরই বা এখানে কিভাবে আসবে?
“এবার আমি যা বলতে যাচ্ছি তা অত্যন্ত ভয়াবহ”, বললেন রাজপুরোহিত, “মহারাজ আপনার মনে আছে? এই একমাস আগে আপনার কন্যা, এই রাজ্যের রাজপুত্রী ইলিনা রূহ সাগর ভ্রমনে গিয়েছিলেন।”
“কী বলতে চান আপনি পুরোহিত মশাই?”, রাগত স্বরে প্রশ্ন ফেললেন রাজা। “অপরাধ নিবেননা মহারাজ” করুন স্বরে বললেন পুরোহিত মশাই, “কিন্তু আপনি তো নিজেই দেখেছেন, রাজ্যে ফিরে রাজপুত্রী কেমন বদলে গিয়েছেন। একমাস হতে আসলো তবুও তিনি এখনো বিষণ্ণ থাকেন। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়াও করেন না। কারো সাথে কথা বলেন না। উনাকে দেখলে কেমন যেন অসুস্থ মনে হয় আজকাল। আপনি তো বাবা, আপনি একটু আপনার পুত্রীর সাথে কথা বলেন। জানার চেষ্টা করেন যে কি হয়েছিল রূহ সাগর ভ্রমণের সময়। আর অবশ্যই কোনো কবিরাজ দিয়ে দেখান। যেন আমাদের রাজপুত্রীর কোনো ক্ষতি না হয়ে যায় আবার। ওই শত্রু সাগরে কি হয়েছে তা কি আর আমরা জানি?মহারাজ এবার অনেক বেশী চিন্তিত হয়ে উঠলেন। পুরোহিত মশাই ভুল বলেননি। রূহ সাগর ভ্রমণের পর প্রাসাদে ফিরে তার পুত্রী আসলেই অনেক বদলে গেছে। কিন্তু রাজকার্যে ব্যস্ত থাকায় উনি তার দিকে অতটা যত্নও নিতে পারছেন না। এদিকে রানীও প্রাসাদে নেই। তার শ্যালকের বিয়ের জন্য বাপের বাড়ি গিয়েছেন। অন্য সময় হলে রাজকন্যাও যেতো কিন্তু এইবার রাজকন্যাকে এতো অনুরোধ করেও নিয়ে যেতে পারেননি রানী। রাজকন্যার সখীদের আজকাল দেখা যায়না। কারোর সাথে মেশে না সে। আগে রাজপুত্রী তার বাবা মায়ের সাথেই ভোজন করতেন। কিন্তু এখন নীজ ঘরেই একা একা খান। অনেক বলেও তাকে কক্ষের বাহিরে আনা যায়না। তবে প্রায়ই মাঝরাতে বের হন। যখন সবাই ঘুমিয়ে পরে তখন তার প্রিয় ঘোড়ায় চরে হাতে তলোয়ার নিয়ে রাজ্য ভ্রমণে বের হন তিনি। রাতের প্রহরী বাদে কেউ দেখার থাকে না। আর রাজপুত্রীকে বাধা দেয়ার সাহস প্রহরীদের নেই। রাজা আজ ঠিক করলেন, যেভাবেই হোক আজ রাতের ভোজন উনি রাজপুত্রী ইলিনার সাথেই করবেন। রাঁধুনিদের বলে দেয়া হলো আজ রাতে প্রাসাদে শুধু রাজপুত্রীর পছন্দের সব খারার রান্না করা হয় যেন। রাজপুত্রী যা যা খেতে চাই সবার জন্য যেন তাই রান্না করা হয়। তাই করা হলো। ভোজনের সময় রাজা নিজে গেলেন তার একমাত্র কন্যা ইলিনা কে ডেকে আনতে। রাজকন্যার ঘরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাজা আলো জ্বালাতে গেলে ইলিনা বলে উঠলো, “খবরদার আলো জালাবেননা মহারাজ অরকন সিং”। বলেই প্রাসাদ কাপানো হাসি হেসে উঠলো ইলিনা। রাজপুত্রীর এরূপ আচরণ দেখে মহারাজের মাথাই যেন আকাশ ভেঙে পরলো। রাজা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে ইলিনার মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,” বিচলিত হওয়ার দরকার নেই মহারাজ। এখন বিনাশের সময় এসেগেছে। আমি রূহানী। রূহী নগরীর রাজপুত্রী রূহানী। রূহ সাগরের রানী রূহানী। শতকাল প্রতিশোধের আগুনে জ্বলেছি আমি। এতোকাল পরে আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে এসেছে। এই রাজ্যের বিনাশ আর আমার মুক্তি হতে চলেছে। আমাদের মাফ করে দেও রূহানী,”করুণার স্বরে অনুরোধ করলেন রাজা অরকন সিং,”আমি জানি আমার পূর্বপুরুষ দ্বারা তোমার অপমান অতঃপর মৃত্যু হয়েছিল। আমি তার জন্য অনেক লজ্জিত। তাই আমি তোমার কাছে মাফ চাইছি রূহানী। আমাকে আর আমার এই রাজ্যকে মাফ করে দাও তুমি।”
“কখনো না” হুংকার করে বললো রূহানী,” নারীর অপমান সর্বদা ধ্বংস বয়ে নিয়ে আসে। আমার এই করুণ পরিণতিতে আমার পিতারও ভুল ছিল। তাই আমার অভিশাপে বিলীন হয়ে গিয়েছিল রূহী নগরী। আর জন্ম হয়েছিল পুরুষ নাশী রূহ সাগরের। কিন্তু সেটা ছিল আমার প্রতিশোধের একটি ছোট্ট শুরু মাত্র। আমার প্রতিশোধ তখনই পূরণ হবে যখন এই তুয়োশা রাজ্য পরিণত হবে এক বিভৎস ধ্বংস স্তুপে। যেদিন রাজকন্যা ইলিনা আমার সাগরে প্রবেশ করে সেইদিন আমি এতোটা খুশি হয়েছিলাম যে এতো কাল সাগরে শত যুবকের প্রাণ নিয়েও সে সস্তি আমি পাইনি। যখন সে সাগরের মধ্যে অবস্থিত মায়াবী দ্বীপে আশ্রয় নেয় তখন আমি ঢেউয়ের পানির মধ্যে আমার সখের নূপুর গুলো দিয়ে পৌছে দিই মায়াবী দ্বীপে। রাজকন্যা নূপুরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাৎক্ষনাৎ তা নিজের পায়ে পরিধার করে। আর আমি তার আত্মাকে বশ করে তার শরীর নিজের আয়োত্বে নিয়ে ফেলি। ইলিনার কোনো ক্ষতি আমি করবো না। আমার প্রতিশোধ পূর্ণ হলে আমি তার শরীর ছেড়ে দিব। আর এই কয়েকদিনের খুনগুলো ছিল একটি বিপদসংকেত মাত্র। আমি চেয়েছিলাম যে মরার আগে যেন তোমরা তোমাদের মৃত্যুর কারণ জেনে যেতে পারো। আর দুনিয়াবাসীও জানুক কোনো পুত্রীর এরূপ অপমানের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে।”
“না রাজপুত্রী না” ,কাঁদো কাঁদো কন্ঠে আকুতি বিনতি করতে লাগলো তুয়োশা রাজ্যের মহারাজ অরকন সিং,”আমি আমার মাথার তাজ, আমার সিংহাসন সব তোমার পায়ের কাছে অর্পণ করছি কিন্তু তুমি এই ধ্বংস খেলায় মেতে উঠো না রাজকন্যা রূহানী”।
“আমিও ওইদিন এমন করে নিজের সম্মান আর প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলাম। কই আমার কথা তো কেউ শোনেনি সেদিন। তবে আমি কেনো শুনবো?” হুংকার করে উঠলো রূহানী,”আমি রূহী নগরীর রাজপুত্রী রূহানী ও রূহ সাগরের
রানী অভিশাপ দিচ্ছি, আগামী দুই দিনের মধ্যেই এই তুয়োশা রাজ্য পরিণত হবে এক ধ্বংস স্তুপে। আর সেই মুহূর্তে আমি ইলিনাকে মুক্ত করে চিরতরে চলে যাব।”
“না রাজপুত্রী তোমার পায়ে পরি রাজপুত্রী রূহানী”, কাঁদতে লাগলেন রাজা অরকন সিং,”এমন অভিশাপ তুমি দিয়োনা”। আমার অভিশাপ আমি ফিরাবোনা”, বললেন রাজপুত্রী রূহানী, “তবে হ্যা, আমি বরদান দিচ্ছি যে, আমার রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ন্যায় এই রাজ্যের ধ্বংসস্তূপ পুরুষ বিদ্বেষী হবেনা। এখানে যেই পুরুষই আসবে ফিরবার সময় তার চরিত্র ফুলের ন্যায় সুন্দর হয়ে যাবে। আর আমার রাজ্যের ন্যায় এই রাজ্যেরও কোনো নারীর ক্ষতি হবেনা এই ধ্বংস লীলায়।” তারপর জ্ঞান হারিয়ে পরে গেলো রাজপুত্রী ইলিনা। পরে যাওয়ার সময় তার ঘাগরা পায়ের গোড়ালি থেকে দুই ইঞ্চি উপড়ে উঠে পায়ে পরিহিতা রূহানীর নূপুর বের হয়ে এলো। আর সেই নূপুরের ঝলকানিতে আলোকিত হয়ে উঠলো পুরো কক্ষ। মহারাজ ওই রাতেই তাৎক্ষণিকভাবে রাজ্যের সব পুরোহিত, জ্ঞানীগুনী ব্যক্তি, কবিরাজ সবাইকে রাজসভায় ডেকে পাঠালেন। সবাইকে সব খুলে বললেন রাজা, পুরো রাজ্য জুরে নেমে এলো আতংক। অনেকে তো রাজ্য ছেড়ে পালাতে শুরু করলো। কিন্তু কি আশ্চর্য নারীরা পালাতে পারলেও কোনো পুরুষ পালাতে পারলোনা। কখনোবা রাস্তা ভুল করে আবার কখনো বা কোনো কারণ বশত আটকে পরতে হলো তাদের। কিছুতেই রাজ্যের বাইরে এক কদমও রাখতে পারলোনা তুয়োশা রাজ্যের কোনো ছেলে। খবর পেয়ে রানী ফিরে এলো
রাজ্যে।
“সকাল হয়ে এলো” বলে উঠলো রাজা, “রূহানী আমাদের দুই দিনের সময় দিয়েছেন। কিছু না করতে পারলে যে বিলীন হয়ে যাবে তুয়োশা”। রাজসভায় একজন কবিরাজ হঠাৎ বলে উঠলো,” মহারাজ অপরাধ না নিলে আমি একটা সমাধান দিতে পারি। এছাড়া রাজ্য বাঁচানোর আর কোনো পথ আছে বলে মনে হয়না”। “বলো, তাড়াতাড়ি বলো”, বলে
উঠলেন মহারাজ। “মহারাজ, রূহানীর সব ক্ষমতা রাজপুত্রীর শরীর থেকে আসছে”, মাথা নিচু করে বলতে লাগলো কবিরাজ,
“রাজপুত্রী ইলিনাকে শেষ করলেই বাচানো যাবে তুয়োশাকে”। কবিরাজের এরূপ কথা শুনে মহামন্ত্রী আর সেনাপতি হুংকার দিয়ে তাৎক্ষণাৎ তাদের তলোয়ার বের করে ওই কবিরাজকে মারবে এমন সময় মহারাজ তাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন,”আমি একজন রাজা হিসেবে রাজ্য আর প্রজাদের রক্ষা করাই আমার প্রধান কর্তব্য। তার জন্য যদি আমার স্বীয় পুত্রীর প্রাণও নিতে হয় আমাকে তাহলে তাই নিব আমি”। “না মহারাজ এই ভুল কোনোভাবেই করবেন না”, বলে উঠলেন রাজপুরোহিত,”মহারাজ নারীর অপমান আর হত্যার অপরাধেই এই অবস্থার সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাদের, আর আমরা আবার যদি একই ভুল করি তাহলে আরো দ্বিগুণ অভিশাপ পোহাতে হবে আমাদের। রূহানী কোনো না কোনো ভাবে আবার ফিরবে আর এবার রূহানীর সাথে ইলিনাও…না না মহারাজ এতে বিপদ আরো বাড়বে”।
“তাহলে কিভাবে বাঁচাবো আমার এই রাজ্য আর নিষ্পাপ প্রজাদের?” প্রশ্ন ছুড়লেন মহারাজ। সবাই মাথাই হাত দিয়ে বসে রইলেন। একটু পর সভায় বসে থাকা একজন জ্ঞানী ব্যাক্তি যিনি কিনা ডাকিনী বিদ্যা সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখেন, হঠাৎ বলে উঠলেন,”মহারাজ আপনি বলেছিলেন যে রূহানী তার নূপুর দিয়ে রাজপুত্রীকে বশ করেছেন। তারমানে রাজপুত্রী নিশ্চয় এখনো সেই নূপুর পরে আছেন। কোনোভাবে সেই নূপুর খুলে দিতে পারলে হয়তো বাচতে পারবে এই রাজ্য।” তার কথার সাথে সম্মতি জানালো সবাই। “তবে তাই করা
হোক” বললেন
রাজা।
রাজপুত্রী ইলিনার কক্ষে পাঠানো হলো কিছু দাসী। তার পায়ের থেকে নূপুর খোলার জন্য। কিন্তু একি! ইলিনা তার কক্ষে নেই। পুরো প্রাসাদ খুঁজেও ইলিনাকে পাওয়া গেলো না। পুরো রাজ্যে খবর পাঠিয়ে দেয়া হলো। তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও পাওয়া গেলো না রাজপুত্রীকে। এরই মধ্যে চলে আসলো সেই ভয়াবহ রাত্রি। হঠাৎ করে প্রাসাদের হলঘরে দেখা গেলো রাজপুত্রীকে। সবাই উপস্থিত হলো উনার সম্মুখে। রাজা- রানী পুত্রীর কাছে যাবে এমন সময় রাজপুত্রী বলে উঠলেন, “সময় শেষ”। শুরু হলো মহা প্রলয়। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলো তুয়োশা রাজ্য। এরপর থেকে কোনো পুরুষ কোনো নারীর কোনোরকম অপমান কিংবা ক্ষতি করলে তাকে তুয়োশার ধ্বংসস্তুপে ঘুরতে পাঠানো হয়। আর রাজপুত্রীর বর অনুযায়ী, ফেরার সময় তার মনে-প্রাণে নারী মর্যাদার সঞ্চার হয় আর তার চরিত্র হয়ে ওঠে ফুলের ন্যায় সুন্দর। এভাবেই পূরণ হয়েছিল রাজপুত্রীর প্রতিশোধ।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত