ক্লাস শেষ করে কুরিয়ার সার্ভিসের দিকে এগোলাম। আমার নামে একটা পার্সেল নাকি এসছে। কোন এক অপরিচিত কুরিয়ার সার্ভিস। নামটাও বিদঘুটে। “দ্যা এক্সচেঞ্জ” কুরিয়ার সার্ভিস। এর আগে কোনদিনই নাম শুনিনি। নতুন বোধহয়। দুটো পুরাতন বাড়ির মাঝখান দিয়ে একটা সরু গলির একদম শেষ মাথায় অফিস। খুঁজে পেতেই সমস্যা হচ্ছিলো। এত নামকরা কুরিয়ার সার্ভিস থাকতে এই অখাদ্য কুরিয়ার সার্ভিসে আমাকে কে কি পাঠিয়েছে কে জানে।
অফিসে ঢুকে আমার নাম আর মোবাইল নাম্বার দেয়ার পর তারা অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে একটা নীল র্যাপিং পেপারে মোড়ানো বাক্স আমার সামনের টেবিলে রাখলো। র্যাপিং পেপারটা যেনতেন সস্তা পেপার নয়। দামীই মনে হচ্ছে। অবশ্য শুধু কাভার দেখে কি হবে। ভেতরে কি আছে ঈশ্বর জানেন। আমার নামে যেসব কুরিয়ার আসে তার বেশীরভাগ গল্পের বই। আজ এই প্রথম অন্যকিছু এলো। সবই ঠিক ছিলো কিন্তু প্রেরকের নামের জায়গাটা দেখতে গিয়ে একটু অবাক হলাম। প্রেরকের নাম ঠিকানা যেন জল ঢেলে সযত্নে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। কুরিয়ারের কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করে বুঝলাম আমার ধারণাই ঠিক। কুরিয়ার এসে পৌঁছেছে বৃষ্টির দিনে। অনেক মালামাল নষ্ট হয়েছে। সেজন্য নতুন কুরিয়ার সার্ভিসকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে অনেক টাকা। আমার মালটাই কোনোমতে প্রাপকের নামসমেত ভালোমত পৌঁছেছে। মনে মনে খুশি হলাম। যাই আসুক ক্ষতি তো হয়নি। যদিও পরে এরজন্যে আমাকে আফসোস করতে হবে তা জানতাম না।
বিল পে করেই পাঠানো হয়েছে পার্সেল। এত দরদি আমার আত্মীয়স্বজন , বন্ধুবান্ধব বা পরিচিতদের মধ্যে আচ্ছে কিনা সেই নিয়ে সন্দেহ আছে আমার। একটা আজব চিন্তা এলো মাথায়। হয়তো বন্ধুরা মজা করে কিছু পাঠিয়েছে। যেমন পাঠিয়েছিলো অরুণ স্যারের বাসায়। স্যারের গ্যাসের সমস্যা অনেক আগে থেকে। বয়স্ক মানুষ। ক্লাস নিতে নিতে মাঝেমধ্যে গ্যাস ছেড়ে বিতিকিচ্ছিরি কান্ড করেছেন বটে তাই বলে কুরিয়ারে করে তাকে তিন কেজি মুলা পাঠানোটা কোনধরনের রসিকতা!
আমার ক্ষেত্রে খুব বেশি হলে গাজর বা শালগম আছে। সে যাই হোক ক্লাস করতে করতে প্রচন্ড টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিলাম। মেসের রুমে ফিরে এসে কোনোমতে মধ্যম ওজনের বাক্সটা টেবিলে রেখে যা পরে ছিলাম তাই পরে সোজা বিছানায়। রুমমেট সুমনদা আমার আগেই ঘুমিয়েছে। আমিও যোগ দিলাম তার কাতারে।
শীতের কুয়াশাঘেরা সন্ধ্যায় ঘুম ভাঙলো একটা প্রবল ধাক্কাতে। কম্বল থেকে মাথা বের করে দেখি সুমনদা পাগলের মতন আমায় ডাকছেন।
“তন্ময় ওঠ তাড়াতাড়ি। তুই বাক্সে করে কোন জীবন্ত প্রানী এনেছিস নাকি! ওটা অমন নড়ছিলো কেন তখন?”
আমি উনার চোখমুখ দেখেই বুঝলাম উত্তরাঞ্চলের গাজার প্রভাব ওনার ওপর ভালোভাবেই পড়েছে! চোখ টকটকে লাল। কথা বলতে গিয়ে হাঁপিয়ে যাচ্ছেন। উদভ্রান্তের মতন দেখাচ্ছে।
আবার একই সুরে জিজ্ঞেস করলেন সুমনদা “ কি আছে ঐ বাক্সে পাখি না খরগোশ? অমনভাবে কোন জীবন্ত প্রানীকে কেউ আঁটকে রাখে?”
আমি মনে মনে একচোট হেসে নিলাম। নতুন সিদ্ধীসেবী আমার এই রুমমেট বড়ভাই নেশার ঘোরে আবোলতাবোল বকছেন। বললাম “ ওটাতে জীব তো নেই ই। ভালো কোন জড়বস্তু থাকার সম্ভাবনাও যৎসামান্য। বন্ধুদের কেউ পাঠিয়েছে মনে হয়। ওরা আমায় থান ইট র্যাপিং করে পাঠালেও অবাক হবোনা।
“কিন্তু আমি যে স্পষ্ট নড়তে দেখলাম বাক্সটাকে!” বলে আরো কিছুক্ষণ আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে শেষে চলে গেলেন বাথরুমে ফ্রেশ হতে। এটা রোজকার ঘটনা। বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পরে বেচারার এই দশা। দিনদিন নেশার প্রতি আকর্ষন যেন শুধু বাড়ছেই। আমি পাত্তা দিলাম না। মোবাইল আনলক করে দেখিন রাফেলের দুটো মিসড কল আর একটা মেসেজ ভাসছে স্ক্রিনে। মেসেজের মর্মার্থ হলো আটটার দিকে সিনেমা দেখতে যাবে সবাই। আমাকেও যেতে হবে। রাফেল ওর জন্মদিনের ট্রিট দিচ্ছে। ফ্রিতে খাবারের ব্যবস্থাও আছে। মিস করা ঠিক হবেনা ভেবে রওনা দিলাম। বাক্সটা রাতেফিরে এসে খোলা যাবে।
ওদিকে সুমনদা চলে গেলো তার গাজার আসরে। আজ রাতে নাকি ফিরবেনা।
আমার ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা বাজলো। বিছানা গুছিয়ে শুয়ে পড়তে যাবো এমন সময় মনে হলো টেবিলের ওপর বাক্সটা সত্যিই যেন একবার নড়ে উঠলো। মাত্র একবার। কিন্তু দেখার কোন ভুল নেই। সত্যিই নড়েছে। রুমমেটের নেশার প্রভাব কি আমার ওপর পড়লো নাকি! অবশ্য বাইরে যাবার আগে উনার উল্টোপাল্টা কথা শুনে গিয়েছি । সেটাই হয়তো অবচেতন মনে একটা ছাপ ফেলেছে। মনের ভুলে তাই বাক্সটাকে নড়তে দেখেছি। ভেবেছিলাম বাক্স তো আর পালিয়ে যাচ্ছেনা। সকালে উঠেই খোলা যাবে। কিন্তু একটা অদম্য স্পৃহা আমাকে র্যাপিং পেপারটা খুলতে বাধ্য করলো। মনে হলো এই বাক্সে কি আছে না দেখে ঘুমানো ঠিক হবেনা । তড়িঘড়ি বাক্সের ডালা খুলতেই বেরিয়ে এলো আকারে আরেকটু ছোট একটা লম্বাটে বাক্স। সেটা কালো স্কচটেপ দিয়ে পেঁচানো।। কেঁচি দিয়ে সেটা কেটে নিতে হলো। ওটার ডালাটা খুলতেই চমকে গিয়ে কেঁপে উঠলাম। হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গেলো হাতের বস্তুটা। এ আমি কি দেখলাম!
বাক্সের ভেতর একটা কনুই পর্যন্ত কাটা হাত দেখতে পেয়েছি। দেখেই গা টা ঘিনঘিন করে উঠেছে। খানিক এভাবেই নিস্তব্ধভাবে কেটে গেলো। নিজেকে সাহস দিতে সময় লাগলো। মাথায় একটা ক্ষীণ বুদ্ধি
এলো। ওটা নিশ্চয়ই খেলনা জাতীয় কিছু। আজকাল অনলাইনে তো কত আজব জিনিস বিক্রি হয়। হয়তো তেমন কোন কিম্ভূত রাবারের খেলনা হবে। তাই সাহস করে মেঝে থেকে তুলে নিলাম বস্তুটা। নেড়েচেড়ে দেখলাম আসলে কি ওটা। কিন্তু এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। রাবারের হলেও ওটার ফিনিশিং খুব নিখুঁত সেটা বলতেই হচ্ছে। কিন্তু এমন অদ্ভুতুড়ে জিনিস আমায় পাঠাবে কে? চিন্তায় পড়ে গেলাম। কনুইটা সত্যি কোন মানুষের হলে আমাকে নিশ্চিত বিপদে পড়তে হবে।
বস্তুটার ব্যপারে একটা কথা মনে পড়তেই গা টা শিউরে উঠলো। সুমনদা নাকি বাক্সের ভেতর থেকে জীবন্ত বস্তুর মত কিছু নড়াচড়ার আওয়াজ পেয়েছে। তাহলে কি এই হাতটাই নড়ে উঠেছিলো জীবন্ত বস্তুর মতন? নাকি সব তার নেশার ঘোরে দেখা ভ্রম!
কাটা হাতটা আরো ভালো করে খেয়াল করলাম। একজন মাঝবয়সী পুরুষ ডানহাত। পশম দেখে আন্দাজ করা যায়। কনুইয়ের কাছে কালো স্কচটেপ দিয়ে কাটা অংশটা ঢেকে দেয়া হয়েছে। ভালোই হয়েছে। যদি ঐ কাটা অংশটা চোখের সামনে পড়তেও তাহলে পার্টির সমস্ত খাবার পেট উলটে বেরিয়ে আসতো বাইরে।
কিন্তু মানুষের মন বড্ড অদ্ভুত। নতুন কিছু দেখার লোভ সামলাতে হিমশিম খায় সবসময়। আমিও আমার মনের কাছে হার মানলাম। খানিক বাদেই ইচ্ছা হলো যে ঐ স্কচটেপে পেঁচানো অংশের ভেতরটা দেখতে আসলে কেমন। দেরি করলাম না। কেঁচি দিয়ে কেটে ফেললাম কালো স্কচটেপ। অসাবধানতাবশত ধারালো কেঁচির একটা খোঁচা লাগলো কনুইয়ের একটু নিচে। আর সঙ্গে সঙ্গে একটু নড়ে উঠলো ওটা। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো হাতটা থেকে। ঠিক যেন জ্যান্ত মানুষের হাত। সভয়ে ছেড়ে দিলাম হাতটা। যখন দেখলাম রক্ত থামছেনা তখন অনিচ্ছাস্বত্তেও টেবিল থেকে টিস্যুপেপার ছিড়ে চেপে ধরলাম কাটা জায়গাটায়। রক্ত বন্ধ হতে সময় লাগলো। এ কোন আজব বস্তুর পাল্লায় পড়লাম আমি! আমি তো নেশা করিনি তাহলে কিভাবে ওটাকে নড়তে দেখলাম! তাহলে সত্যিই নড়ে উঠেছে হাতটা। আমি এখনো আশা করছি যে বস্তুটা নকল কিছু হবে। হয়তো ব্যাটারীচালিত কিছু। এর ফাংশান বুঝতে পারিনি দেখেই ভড়কে যাচ্ছি । মানুষের মন সদা সংশয়বাদী। আবার একইসাথে আশাবাদীও বটে।
ভাবলাম আমি আজ এই বস্তুটার কীর্তির শেষ দেখে ছাড়বো। বিছানার খানিকটা অংশ রক্তে ভেসে গেছে। বিশ্রী লাগছে দেখতে। সেটা জল দিয়ে ধুয়ে নিলাম। তারপর হাতটার কাটা অংশটা ভালোমতন পর্যবেক্ষন করতে লাগলাম। কনুইয়ের শেষপ্রান্তের অনাবৃত অংশটায় পাঁচটা আলাদা আলাদা রঙয়ের তার ঝুলছে। গোলাপী, নীল, আকাশী, স্যালাইনের লাইনের মতন স্বচ্ছ আর কমলা। আকাশী তারের নিচে একটা আংটির মতন অংশ আছে।
এগুলোর কাজ কি হতে পারে জানিনা। হাতটাকে ঘুরিয়ে দিলাম। হাতের উলটো পিঠে একটা ছকের মত আঁকা। ছকের চারপাশে অক্টোপাসের শুঁড়ের মতন পেঁচানো শুঁড়।
ঠিক আঁকা নয় উল্কি করা। তাতে নানা রঙয়ের পরশ আছে। মোট দশটি বর্গক্ষেত্র । পাঁচটি বর্গক্ষেত্রের ঠিক নিচেই পাঁচটি বর্গক্ষেত্র।
উপরের ঘরগুলোর প্রত্যেকটিতে একটা করে সিম্বল দেখা যাচ্ছে। সব সিম্বলেই যেন প্রান আছে। বাম দিক থেকে প্রথম সিম্বলটা আগুনের। ছোট একটা সিম্বল অথচ দাউদাউ করে জ্বলছে ঈষৎ কমলা ক্ষুদ্র অগ্নিকুন্ডলীর শিখা। অগ্নিশিখার দপদপ শব্দও পাচ্ছি যেন। এরপরের সিম্বল সম্ভবত বাতাসের। শো শো শব্দ আসছে কানে। পরের সিম্বলটা নীল আকাশের। ছোট সিম্বলটাতে দুই টুকরো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। পরের সিম্বলটাতে একটা ঘুর্নায়মান গোলক দেখতে পেলাম। নীল রঙয়ের গোলকটা আর কিছুই নয় আমাদের পৃথিবী। একদম শেষের সিম্বলটা একটা জলাধার যাতে ঢেউ খেলতে দেখলাম। সমুদ্রের গর্জন এলো কানে।
এখন আসি নিচের সারির বর্গে। আগুনের নিচের বর্গে ইংরেজি বড় হাতের অক্ষরে লেখা “T” বাতাসের সিম্বলের নিচে লেখা “I” আকাশের নিচে “M” পৃথিবীর নিচে “R” আর জলাশয়ের নিচের অক্ষরটা “P”!
এই অক্ষরগুলোর সাথে ওপরের সিম্বলের কোন মিল তো অবশ্যই আছে। তাই ভাবতে শুরু করলাম। নানা রঙয়ের তারগুলোও দেখছি। কালার প্যাটার্নের কোথাও এক হঠাৎ একটা মিল খুঁজে পেলাম।
শেষের অক্ষরটা P। যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে তবে P তে PINK অথবা PINKY হবে। তারগুলোর মধ্যে একটা তারের রঙ তো সত্যিই পিংক বা গোলাপি। আবার পিংকী মানে কনিষ্ঠা আঙ্গুল। হাতের কব্জিতে কনিষ্ঠা আঙ্গুল তো আছেই । এবার শুরু থেকে যদি দেখি তাহলে T তে THUMB বা বৃদ্ধাঙ্গুলি, I তে INDEX FINGER বা তর্জনী, M তে MIDDLE FINGER বা মধ্যমা, R তে RING FINGER বা অনামিকা।
কিন্তু আগুনের সাথে বৃদ্ধাঙ্গুলি, বাতাসের সাথে তর্জনী , আকাশের সাথে মধ্যমা ,পৃথিবীর সাথে অনামিকা বা জলাধারের সাথে কনিষ্ঠার কি মিল তা বুঝলাম না।
তবে আমার আগের ধারনাটা যে সঠিক তা বুঝলাম গোলাপী তারটা হালকা টান দিতেই যখন কাটা হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুলটি নড়ে উঠলো। কমলা তারের টানে নড়লো বৃদ্ধাঙ্গুলি, তর্জনী কেঁপে উঠলো স্বচ্ছ তার ধরে টানতেই। একে একে আকাশী আর নীল তারের টানে বেঁকে গেলো মধ্যমা আর অনামিকা!
কিন্তু সব তার টানা শেষ হতেই একটা রক্তাভ আলো জ্বলে উঠলো ছকে। যেন কোন সাবধানবানী উচ্চারিত হলো । বুঝলাম কোথাও ভুল হয়েছে। তাই আবার T থেকে P সিরিয়াল ধরে টান দিতেই ছকের অংশটা ডালার মতন খুলে গেলো। যেন সুনিপুণভাবে কাটা হয়েছে জায়গাটা। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম একটা পেঁচানো সিড়ি ধরে গোপন পথ নেমে গেছে সেই চতুর্ভুজাকৃতির গর্তটার ভেতর দিয়ে। মাথাটা ঘুরে উঠেছিলো। কারনটা একটু পর বুঝতে পারলাম ।
আমার নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি সেটা ধীরে ধীরে ছোট হচ্ছে। পরে খেয়াল করে দেখি পুরো দেহটাই আকারে ছোট হয়ে যাচ্ছে। কোন অদৃশ্য শক্তির বলে আমি যেন প্রস্তুত হচ্ছি সেই সিড়িঘরে ঢোকার জন্য!
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমি একটা মলিন ধূলিধূসর সিড়িঘরে পড়ে আছি। শরীরে ময়লা, কালিঝুলি লেগে আছে। ধাতস্থ হতে সময় লাগলো। আস্তে আস্তে সব মনে পড়লো। তার মানে আমি এখন সেই রহস্যময় কনুইয়ের ভেতরে অবস্থান করছি। শরীরের ময়লা ঝেড়ে নিয়ে আমি সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম । একটা সরু গলি সামনের দিকে চলে গিয়েছে। সেটা আরেকটু এগোতেই দেখলাম পাঁচদিকে ভাগ হয়ে পাঁচদিকে চলে গেছে। ওগুলো নিঃসন্দেহে আঙ্গুলের মধ্যকার গর্ত । কিন্তু আমি যাবো কোনদিকে? এক এক করে সবগুলো পথে ঘুরে আসবো কিনা বুঝতে পারছিনা। নিজেকে বন্দি বন্দি মনে হচ্ছে। এখানে আমার কি কাজ জানিনা। কিভাবে ফিরে যাবো তাও অজানা। শেষে সব পথেই একবার করে যাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম । কিন্তু দশমিনিটের মাথায় শুন্য অবস্থায় ফিরে আসতে হলো । কোথাও কেউ নেই। কোথাও কিছু নেই। পরে ভাবলাম সেই আগের সিরিয়াল ধরে অর্থাৎ TIMRP অনুযায়ী যদি আবার পথগুলোতে ঢুকি তাহলে বোধহয় কাজ হতে পারে। যেই ভাবা সেই কাজ। কিন্তু এবারও কোন কাজ হলোনা। হতাশ অবস্থায় সিড়িঘরে ফিরে এলাম। ভাবলাম সিড়ি ধরে ওপরের দিকে উঠলে যদি আবার নিজের ঘরে ফেরা যায় তবে সেটাই ভালো। কিন্তু আমার ওঠার আওয়াজ পেয়েই কিনা জানিনা দেখলাম ওপরের ডালাটা হুট করে নিচে নেমে এল। যেন ওপর থেকে কেউ ধাক্কা দিয়ে বন্ধ করে দিলো ফিরে যাবার একমাত্র পথ। অর্থাৎ যে আমাকে এখানে এনেছে সে চায়না আমি আর ওপরে ফিরে যাই।
এবার ভয় আমাকে জাপটে ধরলো।কি করবো এখন এমনটা ভাবছি তখন কানে ভেসে এলো একটা গমগমে কণ্ঠস্বর!
“কেমন আছো নতুন মানুষ তন্ময়? কেমন লাগছে এখানে এসে?”
আকস্মিক আলাপে হতবুদ্ধি হয়ে গেছি। কে আমাকে নাম ধরে প্রশ্ন করছে। আর “নতুন মানুষ তন্ময়” মানেটাই বা কি! মানুষের মধ্যে আবার নতুন আর পুরাতন হয় নাকি? কন্ঠটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে । যেন রোজই শুনি।
গলা শুকিয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে গলাটা ভিজিয়ে নিলাম। তারপর উত্তরে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম “ আমি…ভা…ভা…ভালো আছি। কে…কে তুমি? আমায় এখানে এনেছো কেন? জলদি আমাকে ফিরে যেতে দাও।
আমার কথার জবাবে একটা অট্টহাসি শোনা গেলো। ভয় জাগানো সেই হাসি পুরো জায়গাজুড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। আমার চারদিকের দেয়ালে ভেসে উঠতে লাগলো একটা বীভৎস প্রানীর মুর্তি। যার মাথা দেখা যাচ্ছেনা। কিন্তু গলার নিচ থেকে দেহটা দেখতে ভয়ানক এক দানবের বলে মনে হলো।বিশাল দেহের তলা দিয়ে বের হয়েছে ভয়ংকর অক্টোপাসের মতন ক্লেদাক্ত শুঁড় ! সেগুলো হাসির তালে তালে দুলে উঠছে।
সে বিকট শব্দে হাসছে আর বলছে “এবার তো তুমি ফেরত যাবেনা। যাবো আমি। তোমায় ভবিষ্যতে পাঠিয়েছিলাম জগতটা ভালো করে দেখবার জন্য। আর তুমি কিনা স্বার্থপরের মতন থেকে গেলে সেই দুনিয়ায়। নিজের আদিম স্বত্বাটাকে বেমালুম ভুলে গেলে মানুষের দুনিয়ায় গিয়ে! কিন্তু এমন তো কথা ছিলনা। আমি তো তোমাকে অতীত থেকে ভবিষ্যতে পাঠিয়েছিলাম যেন আমাকেও নিয়ে যেতে পারো তুমি। কিন্তু তুমি বিশ্বাসঘাতক! আমার সাথে যোগাযোগ করার মডিউল এই কাটা হাতটা পর্যন্ত গায়েব করে দিলে। এর শাস্তি তোমায় পেতে হবে । “
বলে নিজের গা টা একবার ঝাড়া দিয়ে উঠলো শুড়ে আচ্ছাদিত প্রাণীটা। ওর আঁকাবাঁকা শুঁড় ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসতে লাগলো। নিমেষেই রুপ নিলো একটা মানুষের আকারের। যার ডান হাতটা কাটা। সাধারণ মানুষের আকৃতি নিতেই আমি বুঝলাম এই প্রাণীটা আর কেউ নয়। স্বয়ং আমিই। এইজন্যই কন্ঠটা এত পরিচিত বলে মনে হচ্ছিলো। আমার নিজের কন্ঠ ওটা। দেয়ালে ফুটে ওঠা মানুষের মূর্তিটা যেন আমার আয়নায় প্রতিবিম্ব। শুধু একটা হাত নেই এটাই পার্থক্য। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢের মতন শুধু তাকিয়ে রইলাম।
আমার চারপাশের পরিবেশ মূহুর্তের মধ্যেই বদলে যেতে শুরু করলো। টের পেলাম ঘাড়ের ওপর কেউ যেন উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলছে। তাকিয়ে দেখতেই চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেলো। ওটা গরম নিঃশ্বাস নয় ওটা আসলে আগুনের হলকা । বেরিয়ে এসেছে পেছনের বুড়ো আঙ্গুলের গলি থেকে। আমি প্রানপনে দৌড়াতে লাগলাম। কিন্তু তর্জনীর বাতাসের তোড় আমাকে টেনে নিয়ে প্রায় মাটিতে আছড়ে ফেললো । তার পরেই একটা একগুচ্ছ পেজা তুলার মতন দেখতে মেঘ আমায় ভাসিয়ে নিয়ে চললো একটা নীলচে সবুজ গোলকের দিকে । যেটা আয়তনে আমার তুলনায় তিনগুন বড়। মেঘপুঞ্জ আমায় ঐ গোলকের কাছে নিয়ে গিয়ে ফেললো। আমি দ্রুত সাঁই করে সরে না গেলে গোলকটা গড়িয়ে গড়িয়ে আমায় পিষে চলে যেতো সামনে। ওটা আর কিছুই না অনামিকা আঙ্গুলের গলি থেকে বের হওয়া একটা পৃথিবীর গোলক। প্রত্যেকটা আঙ্গুল আমায় আক্রমন করে যাচ্ছে তাদের নিজ নিজ সিম্বল অনুযায়ী। পাশাপাশি ছন্দ মিলিয়ে শোনা যাচ্ছে অবিকল আমারই মতন দেখতে শয়তানটা! আমি ব্যথায় জর্জরিত হয়ে পড়ে আছি মেঝেতে। কনিষ্ঠা আঙ্গুলের গলি থেকে হয়তো যেকোন সময় জলের জোয়ার আসবে। আমি হয়তো ডুবে যাবো । আমার বাঁচার আর কোন আশা নেই। কোন দোষে এমন শাস্তি পাচ্ছি জানিনা। আমি কি সত্যিই ঐ ভয়ঙ্কর প্রানীর অতীত অবয়ব? তাই তো মনে হচ্ছে। নইলে আমার দেহ কেন ধীরে ধীরে পালটে যাচ্ছে! ঠিক দেয়ালে ভেসে ওঠা প্রানীটাকে প্রথম যেমনটা দেখেছিলাম ঠিক সেরকম।
আমার হাত পা জড়িয়ে যাচ্ছে। সেখানে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে ক্লেদাক্ত শুঁড়! দেহের আয়তন যাচ্ছে বেড়ে। নিজের বিদঘুটে দেহে নিজেই বন্দি হচ্ছি আমি! জলের স্রোতের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কনিষ্ঠা আঙ্গুল তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। কাটা হাত নিয়ে আমার মতন দেখতে মানুষটা চলে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে। বিনিময় হচ্ছে অতীত আর ভবিষ্যতের। কুৎসিত সে বিনিময়!
এতটুকু বলে আমাদের ইংরেজির প্রফেসর টিম রসকো পল থামলেন। তার নিজের লেখা একটা গল্পের বই থেকে একটা গল্প পরে শোনাচ্ছিলেন। গল্পটার নাম “দ্যা এক্সচেঞ্জ”! আমরা সম্মোহিতের মতন শুনছিলাম গল্পটা। তার বাম হাত থেকে বইটা নামিয়ে রাখলেন টেবিলে । তার ডানহাতের কনুইয়ের জোড়ার নিচের অংশটা ফাঁকা। কনুই থেকে কব্জির অংশটা নাকি কোন একটা এক্সিডেন্টে কাটা পড়েছে। যদিও পুরো ঘটনাটা তিনি আমাদের কখনোই খুলে বলেননি।
স্যার গল্প বলার সময় দশটি বর্গক্ষেত্র হোয়াইট বোর্ডে এঁকেছিলেন। আমি সেটা খাতায় তুলে নিয়েছিলাম। রাতে ইংরেজি খাতাটা খুলতেই ভয়ে শরীরের পশমগুলো সব দাঁড়িয়ে গেলো।
দশটি বর্গক্ষেত্রের ছকে সিম্বলগুলোর নিচের সারিতে যে অক্ষরগুলো আছে তা হলো TIMRP!
যা বিশ্লেষণ করলে একটা নাম পাওয়া যায়। TIMRP- টিম রসকো পল!
………………………………………………(সমাপ্ত)………………………………………