ভ্রূণ

ভ্রূণ

একজন মানুষের ভাগ্য যে কতটা খারাপ হতে পারে সেটা সুবোধবাবুকে না দেখলে আন্দাজ করা যায় না। সে ছেলেবেলায় পরিক্ষার সাজেশানই হোক কিম্বা অফিসের চাকরির ইন্টারভিউ। যেখানেই ‘লাক’-এর প্রশ্ন আসে সেখানেই ‘লাক’ থেকে লাখ লাখ মেইল দূরে সুবোধবাবু। বার দুয়েক লটারির টিকিট কেটেছিলেন। তা উনি তো পুরষ্কার পান-ই নি, উল্টে ওনার টিকিটের আগের পাঁচ হাজার পরের পাঁচ হাজার কেউই পান নি। ওনাকে জিজ্ঞেস করলে বলেন যে অন্য যারা আশা করে লটারির টিকিট কাটেন, উনি এখন তাদের কথা ভেবে টিকিট কাটেন না।
সুবোধ কুমার পাল কলকাতার খুব কাছাকাছি বাটানগর নামক একটা মফঃস্বলে থাকেন। চাকরি করেন পার্ক স্ট্রিটের একটা রেস্তরায়, একাউন্টেন্টের। রোজ সকালে সাড়ে আটটার ট্রেন ধরে যান টলিগঞ্জ তারপর ওখান থেকে মেট্রো। সাধারণত মাশিক টিকিট কেটে রাখেন উনি। কিন্তু কোনদিনই চেকার ওনার কাছে টিকিট দেখতে চান না। কিন্তু গত সপ্তাহে বাড়ি থেকে বেরতে দেরি হয়ে যাওয়ায় প্রায় দৌড়ে গিয়ে ট্রেন ধরেছিলেন। মাথাতেই ছিল না যে মন্থলিটা শেষ হয়ে গেছে। আর ঠিক, সেইদিনই রানিং চেকার উঠে জানলার ধারে বসে সুবোধবাবুকে বললেন, “আপনার টিকিটটা দেখি?”
সেদিন ফাইন দিতে হয়েছিল সাড়ে পাঁচশো টাকা।
সুবোধবাবুর তো মাঝে মাঝে মনে হয় যে উনি যদি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতে চান তাহলে হয়তো দড়িটাই ছিঁড়ে পড়ে যাবে, ওনার ‘লাক’-টা এমনই।
এই খারাপ ‘লাক’এর জন্যই সুবোধবাবুর মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখা দিয়েছে গত বছর পাঁচেক। যেহেতু ওনার জীবনে কখনও ভালো কিছু হয় না, তাই উনিও যেন কারুর ভালো সহ্য করতে পারেন না। কথায় কথায় মানুষকে মনে মনে অভিশাপ দেন। একে বলেন ‘তুই এক্সিডেন্টটে মরবে,’ তো ওকে বলে ‘তুই মরবি ছাদ থেকে পড়ে’। আর এই যে অভিশাপ দেন, তার কারণ যে বিরাট বড় কিছু, তাও নয়। সামান্য সব ব্যাপারে উনি এই সব ভাবেন মনে মনে। কিন্তু তাতে যে বিশেষ ফল হয় তা নয়, তবুও অন্য লোকের কারাপ চেয়ে উনি কিছুটা মনের জ্বালা মেটান।
এই ভাগ্য ছাড়া ওনার আরও একটা প্রব্লেম আছে। আর সেটা হল ওনার স্ত্রী মণিমালাদেবী। ওনাদের বিয়ে হয়েছে বছর দশেক, কিন্তু ওনাদের সম্পর্ক এখন শুধু ঝাগড়ার। ঠিক ঝগড়া না, মণিমালাদেবী ওনার উপর চেঁচান আর সুবোধবাবু, সুবোধ বালকের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনেন। সুবোধবাবুর মাঝে মাঝে মনে হয় এও হয়তো সেই ‘লাক’ নামক বস্তুটির বদান্যতা। কারণ বিয়ের পর পর বেশ সুখেই সংসার করছিলেন দুজনে। তারপর একটা গণ্ডগোল হয়, যার ফলে সব কিছু কেমন গোলমাল হয়ে গেল ওনাদের জীবনে।
বছরটা ছিল ২০১২। এক রবিবার সকালে বেশ লাজুক লাজুক মুখ করে মণিমালাদেবী জানালেন যে উনি মা হতে চলেছেন। আনন্দ সংবাদটা শুনে তো সুবোধবাবু প্রায় খাট থেকে পড়েই যাচ্ছিলেন। কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না। আসলে উনি ছেলেবেলায় বাবা মা হারিয়ে এক বুড়ি পিসিমার কাছে মানুষ। সেই বুড়ি পিসিমাও গত হয়েছেন বছর পনেরো। তাই ওনার আত্মীয় বলতে মণিমালাদেবী ছাড়া আর একজন আসছে শুনে উনি ভীষণই আনন্দিত।
তারপর শুরু হল ডাক্তার দেখানো, ওষুধ খাওয়া, মনে মনে নাম ঠিক করা এই সব। বেশ ভালোই চলছিল। সুবোধবাবুর ইচ্ছে ছিল মেয়ে। ঠিক করেছিলেন নাম দেবেন দেবস্মিতা, দেবীর মত হাসি যার। আর ছেলে হলে? সেটা ঠিক করার দায়িত্ব ছিল মণিমালাদেবীর। সুবোধবাবু ঠিক করে নিয়েছিলেন মেয়ের অন্নপ্রাশন কোথায় করবেন, কোন স্কুলে পড়াবেন, দশ বছরের জন্মদিনে সাইকেল কিনে দেবেন, তারপর ইঞ্জিনিয়ারিং…
। সুবোধবাবু মনে মনে ভাবতেন, ‘আমার যা ভাগ্য, এই সুখ সহ্য হবে তো?’
শেষমেশ সুবোধবাবুর ভাগ্যই জিতল।
পুরো ব্যাপারটা কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল একদিন। তখন মণিমালাদেবী পাঁচ মাসের অন্ত্বসত্বা। হঠাৎ মাঝরাত থেকে পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। সুবোধবাবু ডাক্তার ডেকে আনলেন। ডাক্তারবাবু বললেন, “এখন তো পেট ব্যাথা হওয়ার কথা নয়… আপনি বরং একবার হাসপাতালে নিয়ে যান। এই সময় বাড়িতে রাখাটা রিস্কি হতে পারে।” সুবোধবাবু স্ত্রীকে নিয়ে ছুটলেন হাসপাতালে। হাসপাতালের ডাক্তারবাবু দেখে বললেন, “কমপ্লিকেশন আছে।”
সুবোধবাবু ইষ্টনাম জপলেন। বললেন, “মানে?”
ডাক্তারবাবু মাথা নাড়িয়ে বললেন, “আসলে আম্বেলিকাল কর্ডটা ফিটাসের গলার জড়িয়ে গেছে। ভেরি সিরিয়াস। আমরা অপারেট করব। আই আম সরি মিঃ পাল।”
সুবোধবাবু ধপ করে মাটিতে বসে পড়েছিলেন। ঝর ঝর করে জল গড়িয়ে পড়েছিল দু চোখ থেকে। সত্যিই, সুখ ওনার ভাগ্যে নেই। দিনটা ছিল ১৬ই জুলাই ২০১২।
এই ঘটনার পর থেকেই মণিমালাদেবী কেমন যেন বদলে গেলেন। প্রথমে শুধুই কাঁদতেন, তারপর কথায় কথায় রেগে যেতেন। সেই থেকে চলছে এই চেঁচামিচি। সুবোধবাবু যে ওনার কষ্টটা বোঝেন না, তা নয়। কিন্তু প্রায় ছ’বছর তো হল, আর কতদিন।
আজকাল এই ঝগড়া ঝাটির ফলে সুবোধবাবু যতটা সময় পারেন বাড়ির বাইরেই কাটান। অফিস থেকে ফিরতে প্রায় সাড়ে আটটা বেজে যায়। ট্রেন থেকে নেমেই সোজা চলে যান যোগেশ মিত্তিরের বাড়ি, তাস খেলতে। ব্রিজ খেলা হয়। সুবোধবাবু যদিও বিশেষ খেলেন না। কিন্তু বসে বসে খেলা দেখতে ওনার দিব্যি লাগে। কার হাতে কোনবার কেমন তাস পড়ছে, কে কত ডাক দিচ্ছে আর কে কোনবার জিতছে, এইসব। উনিও মাঝে মাঝে যে খেলেন না তা নয়, তবে এখনও অবধি কোনদিন জিততে পারেননি। মিত্তিরবাবু হেসে বলেন, “বুঝলে পাল, তোমার ভাগ্যটা ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা উচিৎ।”
মিত্তর মশাইয়ের বাড়িতে আসা অভিক সেন একবার বলেছিলেন, “পালদা, আপনি বরং একটা আংটি টাংটি নিয়ে দেখুন, তাতে যদি কোন কাজ হয়।”
কিন্তু ওনার যা ভাগ্য তাতে আংটিও ফেল মেরে গেল।
কিন্তু গত ডিসেম্বর মাসে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো। ব্যাঙ্কের কিছু কাজ থাকায় ছুটি নিয়েছিলেন সুবোধবাবু। এই সময় বিশেষ ছুটি পাওয়া যায় না রেস্তরাগুলোয়, কিন্তু উনি সারা বছর প্রায় ছুটিই নেন না, তাই উনি ছুটি চাইলে রেস্তরার ম্যানেজার না করেন না। হঠাৎ ভোর বেলায় একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙে গেল ওনার। ঝড়ফড়িয়ে উঠে বসলেন বিছানায়।
মনে করার চেষ্টা করলেন স্বপ্নটা। একটু চেষ্টা করতেই স্বপ্নটা মোটামুটি মনে পড়ে গেল। একটা বাচ্চা মেয়ে, বছর পাচ-ছয় বয়স হবে। ওনার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওনাকে যেন এক ধাক্কা মেরে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে বলল, “বাপি, আমার জন্মদিনের গিফট কই?”
সুবোধবাবু অবাক হয়ে চেয়ে আছেন। মেয়েটার মুখটা ঝাপসা। ঠিক বুঝতে পারছেন না। ওনাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা বলল, “আমি দেবস্মিতা গো, তোমার সাথেই তো থাকি সবসময়। তাও তুমি চিন্তে পারলে না? গিফটও আনোনি। ঠিক আছে, আজ আমি তোমায় এই গিফটটা দিলাম।” এই বলে একটা লালচে র্যাপিং কাগজে মোড়া একটা ছোট্ট বাক্স তুলে দিলে সুবোধবাবুর হাতে। সুবোধবাবু মন্ত্র মুগ্ধের মত বাক্সটা খুললেন। আর ওমনি একটা প্রচন্ড আলোয় ওনার চোখ ঝলসে গেল। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলেন ঘুম ভেঙে।
ঘড়িতে দেখলেন সাড়ে চারটে বাজে। এই রকম স্বপ্ন উনি আগে কখনও দেখেছেন বলে মনে পড়ল না সুবোধবাবুর। ওনার ভীতরে কেমন যেন একটা কান্না দলা পাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি ভেসে যাবেন।
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তে একটু বিচলিত হয়ে পড়লেন সুবোধ কুমার পাল। স্পষ্ট মনে আছে স্বপ্নে যখন মেয়েটাকে দেখলেন, তখন নাকে একটা মিষ্টি গন্ধ আসছিল। গন্ধটা ওনার খুব চেনা কিন্তু গন্ধটা যে কিসের সেটা ঠিক বুঝতে পারলেন না সুবোধবাবু। উনি ভাবলেন, “স্বপ্নে কি গন্ধও পাওয়া যায়? কি জানি?”
এই গন্ধটা উনি আগেও পেয়েছেন। ঘরের ভীতরেই পেয়েছেন। কখনও সিঁড়ির কাছে, কখনও শোবার ঘরের বিছনায়। কখনও বাথরুমে। কিন্তু পাত্তা দেননি কোনদিন। ভেবেছেন ওনার স্ত্রী হয়তো কোন ক্রিম জাতীয় কিছু মেখেছেন। কিন্তু ওনার স্ত্রী সামনে এলে গন্ধটা উনি কোনদিনই পাননি। এই নিয়ে মাথাও ঘামাননি কোনদিন। কিন্তু সেইদিন স্বপ্নটা দেখার পর থেকেই কিরকম একটা অদ্ভুত নেশা লেগে গেছে ওনার ওই গন্ধটার প্রতি।
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে আবার শুয়ে পড়লেন সুবোধবাবু।
ঘুমটা ভাঙল মণিমালাদেবীর চেঁচানিতে, “আটটা বাজে, অফিস কি আমি যাব?”
এই রে, আজ যে অফিস ছুটি নিয়েছেন সেটা কাল রাতে বলা হয়নি মণিমালাদেবীকে। সুবোধবাবু আমতা আমতা করে বললেন, “আরে, তোমায় বলা হয়নি, আজ একটু ব্যাঙ্কের কাজ আছে। তাই ছুটি নিয়েছি।”
“আমাকে আর বলবে কেন? আমি উঠে সকাল থেকে খেটে মরি আর কি…” এই বলে মণিমালাদেবী গজগজ করতে করতে রান্না ঘরে চলে গেলেন।
সেইদিন ব্যংকে গিয়ে প্রায় একঘন্টা লাইন দিতে হল। সুবোধবাবু সপ্তাহের মাঝখানে ছুটি নিয়েছিলেন ব্যাংক ফাঁকা থাকবে বলে, কিন্তু কোথায় ফাঁকা। দেড় ঘণ্টা পরে যখন কাউন্টারে পৌঁছলেন তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা। টাকা তুলে চলে আসার সময় মনে মনে ভাবলেন, ‘সরকারি ব্যাংক বলে এরা কি যা ইচ্ছে তাই করবে? চারটে কাউন্টারের মধ্যে তিনটে বন্ধ করে রেখেছে? আর ব্যবহার কি? আমরা যেন ওদের চাকর। শালা, ওই ব্যাটার মাথায় ফ্যানটা ভেঙে পড়লে বেশ হয়। বদমাইশ কোথা…’
হঠাৎ পিছনে একটা চেঁচামিচি শুনে পিছন ফিরে দেখলেন সুবোধবাবু। যে ভদ্রলোক টাকা দিচ্ছিলেন, তার মাথার উপর থেকে ফ্যানটা ভেঙে পড়েছে। আর উনি প্রচন্ড রকম আঘাত পেয়েছেন। মাথা ফেটে গলগোল করে রক্ত বেরোচ্ছে। তিন চারজন লোক ওনাকে ধরাধরি করে নীচে নিয়ে গেলেন।
সুবোধবাবু একটু অবাক যে হননি তা নয়, তবে বেশ ভালোই লাগল ওনার। ভাবলেন, ‘যার যা হওয়া দরকার তাই হল। কাকতালীয়র একটা লিমিট থাকে। এটা তো কাকতালীয়র বাবা।’
পরের দিন ট্রেনে করে অফিস যাওয়ার সময় জানতে পারলেন যে কাল ব্যাঙ্কে যে ভদ্রলোকের মাথায় ফ্যান ভেঙে পড়েছিল, উনি নাকি হ্যামারেজ হয়ে আজ সকালে মারা গেছেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল সুবোধবাবুর। চোখের সামনে একজন মারা গেলেন আর উনি তাকে মনে মনে কত গালাগালিই না দিচ্ছিলেন কাল।
এই ঘটনার আরও দিন দুয়েক পর একদিন তাসের আড্ডায় গিয়েছেন উনি। সেইদিন কেন জানিনা ওনার তাস খেলতে খুব ইচ্ছে করছিল। কিন্তু উনি আসার আগেই চারজন বসে গেছে খেলতে। তাই আর কি করবেন, চুপ করে বসে খেলা দেখছিলেন। প্রায় আধ ঘণ্টা খেলা দেখার পর তুহিন নামক ছোকরা ছেলেটাকে বললেন, “ভাই তুহিন, সর দেখি। এক হাত খেলি।”
তুহিন ওমনি বলল, “আপনি বরং খেলা দেখুন সুবোধদা। আমরা পায় জিতে এসেছি। আপনি বসলেই তো হার নিশ্চিত।”
মাথাটা চট করে গরম হয়ে গেল সুবোধবাবুর। সাধারণত উনি খুব একটা রেগে যান না কিন্তু সেইদিন কি জানি কি হল। মনে মনে ভাবলেন, “শালা, বখাটে ছোকরা। বড় প্লেলেয়ার হয়েছে। ট্রাক চাপা পড়ে মরবি শালা শয়তান।”
ওনাকে রেগে গজগজ করতে দেখে মিত্তির মশাই বললেন, “আরে তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? এসো আমার হাতে বসো।”
একটু না না করে মিত্তিরবাবুর জায়গায় খেলতে বসলেন সুবোধবাবু। আর যথারীতি দু হাত খেলতে না খেলতেই হেরে ভূত হয়ে গেলেন। তুহিন বলে ছেলেটা কেমন একটা বিচ্ছিরি রকমের হাসল। গা-টা চিড়বিড় করে উঠল সুবোধবাবুর।
পরের দিন সন্ধ্যায় অফিস ফেরত আবার গেলেন মিত্তির মশাইয়ের বাড়ি। যাওয়ার কারণ সময় কাটানো আর বাড়িতে দেরি করে ফেরা। মণিমালাদেবীর সাথে যত কম থাকা যায় আর কি। কিন্তু মিত্তির মশাইয়ের বাড়িতে ঢুকেই উনি অবাক। আজ তাসের আড্ডা বসেনি। সুবোধবাবুকে আসতে দেখে মিত্তির মশাই বললেন, “কি হে, খবর পাও নি?”
সুবোধবাবু একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, “কিসের খবর?”
“আর কি বলব বল তো? এই কাল রাতে বাড়ি ফেরার সময় তুহিনের বিরাট এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে।”
“সে কি?”
“সবে সাইকেল নিয়ে বড় রাস্তায় উঠেছে, ওমনি একটা ট্রাক এসে… ইস। হাসপাতাল অবধিইও পৌঁছয়নি বেচারা।”
সুবোধবাবুর ভীষণ খারাপ লাগল কথাটা শুনে। ভাবলেন, ‘আহা রে, কতই বা বয়স হবে ছেলেটার, বছর পঁচিশ। সবে বিয়ে করেছিল।’ তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ির পথে রওনা দিলেন।
পথে যেতে যেতে একটা খটকা লাগল ওনার। ভাবলেন, ‘কালই তো ছেলেটার সাথে একটু ইয়ে হয়ে গেল আর আজকেই শুনি…’
ওনার শিরদাঁড়া দিয়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। ভাবলেন, ‘তাই তো, কালই তো মনে মনে ওকে গালাগাল দিতে দিতে বললাম ওকে যেন ট্রাকে চাপা দেয়। আর রাতেই কিনা… আর সেই দিন ব্যংকে? সেও তো সেই একই ব্যাপার। ভাবতে না ভাবতেই লোকটার মাথায় ফ্যান ভেঙে পড়ল। এগুলো কি শুধুই কাকতালীয় না অন্য কিছু?’
ব্যাপারটা যে কাকতালীয় নয় সেটা বুঝতে সুবোধবাবুর বেশি দিন লাগল না।
পরের দিন সকালে ট্রেনে করে অফিস যাওয়ার সময় ঘটল তৃতীয় ঘটনাটা। ট্রেন দিব্যি চলছে ঢিকির ঢিকির করে। আগের ট্রেনটা বেশ খানিকটা লেট-এ যাওয়ার ফলে ভিড়ও নেই সেরকম। এদিকে সেদিকে কিছু ডেলি প্যাসেঞ্জার বসে গল্প করছে। চলছে কলেজ স্টুডেন্টদের হা হা হি হি।
খান দুয়েক স্টেশন পর থেকে দুটো ছেলে উঠল। আর ওঠার পর থেকেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়েকে উত্যক্ত করতে শুরু করে দিল। প্রথমে কেউ তেমন গা করে নি, কিন্তু সুবোধবাবু লক্ষ্য করেছিলেন ব্যাপারটা। উপরের হ্যান্ডেল ধরার নাম করে বারবার মেয়েটার গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছে ওই দুজনের মধ্যে একজন। মাথাটা গরম হয়ে গেল ওনার। মনে মনে ভাবলেন, ‘সব কিছুর একটা লিমিট আছে। শালাকে এক চড়ে ফেলে দিতে হয়।’
পর মুহূর্তেই উনি দেখলেন যে জানলার পাশে বসে একটা বেশ সাস্থবান একটি ছেলে উঠে ওই দুজনের সাথে বচসা শুরু করল। চেঁচামিচি থেকে শুরু হয়ে ব্যাপারটা ধাক্কাধাক্কির পর্যায় চলে গেল। তারপর যেটা হল সেটার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। সাস্থবান ছেলেটি হঠাৎ একটা চড় কষিয়ে দিল ওই ছেলেটির গালে, আর চড় খেয়ে টাল সামলাতে না পেয়ে ছেলেটি চলন্ত ট্রেনের দরজার বাইরে পাশের লাইনের উপর পড়ে গেল। আর তৎক্ষণাৎ ওই লাইনটি দিয়ে প্রচন্ড গতিতে ছুটে গেল আর একটি ট্রেন।
ট্রেনের মধ্যে একটা হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু সুবোধবাবু যেন অন্য জগতে। ওনার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। গলার শুকিয়ে কাঠ। এই নিয়ে তিন বার হল। এটা কাকতালীয় নয়। এটা অন্য কিছুই।
সারা দিন মাথার মধ্যে ওইটাই ঝুরছিল সুবোধবাবুর। লাঞ্চ টাইমে উনি খেতে গেলেন না। চুপ করে বসে থাকলেন। আর মনে মনে গুছিতে নিলেন পুরো ব্যাপারটা। উনি ঘটনাগুলো পর পর সাজিয়ে এইটুকু বুঝতে পারলেন যে উনি যেটা মনে মনে ভাবছেন, সেটা কোন এক অলৌকিক উপায়ে সত্যি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা কি করে যে হচ্ছে আর কেনই বা হচ্ছে সেটা বুঝতে পারলেন না। অনেক ভেবে কোন কিছু কারণ না পেয়ে উনি বাইরে গেলেন একটা সিগারেট খেতে। বাইরের রাস্তাটার পাশে দাঁড়িয়ে সুখটান দিচ্ছেন, এমন সময় একটা খুব চেনা গন্ধ ওনার নাকে এলো। পাশ ফিরে দেখেন একজন ভদ্রমহিলা তার বাচ্চাকে প্যারাম্বুলেটরে নিয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছেন। আর গন্ধটা আসছে প্যারাম্বুলেটার থেকে। জনসন বেবি পাউডারের গন্ধ। মুহূর্তের মধ্যে মনে পড়ে গেল সুবোধবাবুর। মাঝে মাঝে উনি এই গন্ধটাই তো পান। আর সেইদিন স্বপ্নের তো ঠিক এই গন্ধটাই…। ব্যাপারটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে ওনার চোখের সামনে। অনেকক্ষণ পর মেঘ সরে গিয়ে সূর্যের দেখা পেলেন উনি। মনে মনে ভাবলেন, ‘তার মানে, সেই দিন স্বপ্নের সেই মেয়েটাই… কিন্তু সেটা তো স্বপ্ন ছিল… নাকি…সত্যি? তারমানে কি আমার অজন্মা মেয়ে দেবস্মিতা আমাকে …’ আর ভাবতে পারলেন না। দু চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু ধারা। সুবোধবাবু সিগারেটটা ফেলে অফিসে ঢুকে গেলেন।
বাড়ি ফেরার সময় ট্রেনের জানলার ধারে বসে ভাবলেন, ‘আচ্ছে, দেখি তো যেটা ভাবছি ওটা হয় কিনা?’
এই বলে এদিকে ওদিক দেখে সুবোধবাবু ভাবলেন, “আচ্ছা ওই জানলার ধারে যে লোকটা বসে আছে লোকটা জোরে একটা হাঁচি দিক।”
এই ভেবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন লোকটার দিকে। পনেরো মিনিট কেটে গেল। লোকটা হাঁচি দিল না। সুবোধবাবু আবার ভাবলেন, ‘লোকটা একটা জব্বর হাঁচি দিক তো।’
কিন্তু এবারেও হাঁচি দিলেন না। লোকটা এক মনে বাদাম খেয়ে যাচ্ছে। এবার একটু রাগ হল সুবোধবাবুর মনে মনে ভাবলেন, ‘ধুর ছাই, এর কিছু হবে না। শালা বাদাম গলায় আটকে মর না…’
পর মুহূর্তেই জানলার পাশে বসা লোকটা বিষম খেয়ে ভীষণ রকম কাশতে শুরু করে দিল। আর মিনিট দশেক এই ভাবে কাশতে কাশতে ট্রেনের মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। এর মধ্যে স্টেশন চলে এসেছে তাই সুবোধবাবু তাড়াতাড়ি নেমে গেলেন। লোকটাকেও ধরাধরি করে নামানো হল। একজন হাতের নাড়ি টিপে বললেন, “পালস নেই। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যান।”
বাড়ি ফেরার পথে আজ আর উনি মিত্তিরদের বাড়ি গেলেন না। বরং সাইকেলটা হাঁটাতে হাঁটাতে বাড়ির দিকেই রওনা দিলেন। আর যেতে যেতে ভাবলেন যে উনি যেটাই ভাবছেন সেটা কিন্তু হচ্ছে না। কারণ হাঁটতে হাঁটতে উনি অনেক কিছুই ভেবেছেন যেমন রেস্তরার মালিক ফোন করে ওনাকে বলবেন ওনার বেতন বেড়ে গেছে, ওনার বন্ধু সুখময় বিশ্বাস ফোন করে বলবেন ওনার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, বা মণিমালাদেবী ফোন করে জিজ্ঞেস করবেন উনি কখন বাড়ি ফিরবেন ইত্যাদি। কিন্তু কোনটাই হল না। এবার ওনার মাথায় একটা ফন্দি এল। উনি সাইকেলে উঠে রওনা দিলেন বড় রাস্তার দিকে। বড় রাস্তায় পৌঁছে উনি এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন চুপ করে। একের পর এক ট্রাক, বাস, গাড়ি চলে যাচ্ছে। উনি হঠাৎ মনে মনে ভাবলেন, ‘ওই যে নীল গাড়িটা আসছে, ওটার সাথে ওই ট্রাকটার মুখোমুখি সংঘর্ষ হোক।’
তারপর মিনিট দশেকের অপেক্ষা। সুবোধবাবু ঠোঁটের কোণায় একটা ক্রুর হাসি নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। ওনার এই অদ্ভুত শক্তি সম্পর্কে এখন উনি নিশ্চিত। এই কিছুক্ষণ আগেই উনি দেখে এলেন সেই নীল গাড়ি আর ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ।
এই ঘটনার পর থেকে সুবোধবাবু যে কোন কিছু ভাবার আগেই থেমে যান। তারপর খুব সাবধানে আস্তে আস্তে চিন্তা করেন। উনি অকারণে কারুর ক্ষতি করতে চান না। তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝে বোর ফিল করলে উনি এর ওর খারাপটা ভেবেই ফেলেন।
সুবোধবাবু আর একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছেন যে উনি ভালো কিছু ভাবলে সেটা হয় না তবে খারাপটা ভাবলেই হয়, আর ভাবনাটা যাই থাক, ঘটনাটা শেষ হয় মৃত্যুতে।
গত এক সপ্তাহ ধরে প্রায় প্রাকটিস করে করে উনি এখন এমন ভাবে ভাবতে পারেন যেটা হয়তো এখুনি না হয়ে আগামী কাল ঘটবে, তাও সময় মেনে। আর একটা ব্যাপার যেটা বেশ অবাক করেছে ওনাকে, সেটা হল যত দিন যাচ্ছে, ঘরের মধ্যে সেই মিষ্টি গন্ধটা যেন আরও প্রখর হচ্ছে। আর শুধু উনিই নন, গন্ধটা ওনার স্ত্রী মণিমালাদেবীও যে পাচ্ছেন সেটার প্রমান উনি পেয়েছেন।
সুবোধবাবু আরও দেখেছেন যে কারুর খারাপ হলেও ওনার কোন ভালো হয় না তাতে। যেমন দিন চারেক আগে উনি ভাবলেন যে যদি রেস্তরার চিফ একাউন্টেন্ট বাড়ি যাওয়ার পথে বাস থেকে পড়ে যান, তাহলে উনিই হবেন চিফ আর বেতনটাও বাড়বে কিছু।
চিফ একাউন্টেন্ট বাস থেকে পড়ে মারা গেলেন ঠিকই, কিন্তু সুবোধবাবু আর প্রমোশান পেলেন না। নতুন চিফ এল একদিনের মধ্যেই।
সুবোধবাবুর এই অনুশীলন করার পিছনে একটা কারণ আছে। উনি একজনের ব্যাপারে খারাপ কিছু ভাবতে চলেছেন, আর সেই ব্যক্তি হলেন ওনার স্ত্রী মণিমালাদেবী। এই ভাবে একজনের সাথে থাকার চেয়ে একা থাকা ভালো। আরও তিন দিন কেটে গেল এই ভাবে। সুবোধবাবুর অনুশীলনের ফলে পাড়ার গুন্ডা দুটো কাল নিজেদের মধ্যের মারামারি করতে করতে একে অপরকে গুলি করেছে। ট্রেনে গত দু দিনে তিনজন কাঁটা পড়েছে যার মধ্যে সুবোধবাবুর অপ্রিয় প্রতিবেশী রমেশ সরকারও আছেন।
আজ সকালে অফিস যাওয়ার আগে বিছানায় চুপ করে এসে বসলেন সুবোধবাবু। চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলেন, ‘আমি অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার ঠিক পরে, এই ন’টা নাগাদ মণিমালা যখন রান্না করতে যাবে, তখন গ্যাস লিক করে একটা বিরাট বিস্ফোরণ…।’
‘তাড়াতাড়ি গিলে অফিস যাও দেখি।’
মণিমালাদেবীর চিৎকারে চিন্তায় ছেদ পড়ল সুবোধবাবুর। আজ কিন্তু উনি রাগ করলেন না। বললেন, “আসছি।”
খাওয়া দাওয়া সেরে যখন বাড়ি থেকে বেরলেন, তখন বাজে আটটা পঁয়ত্রিশ। সাইকেলে চেপে রওনা দিলেন স্টেশনের উদ্দেশ্যে। আজ পরের ট্রেনটা ধরবেন বলে ঠিক করেছেন উনি। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলেন সামনে থেকে একটা কম বয়সি ছেলে খুব জোরে বাইক নিয়ে আসছে। আর দেখেই মনে হচ্ছে যে ছেলেটা ঠিক সামলাতে পারছে না বাইকটা।
‘ধাক্কা না দেয়,’ মনে মনে ভাবলেন সুবোধবাবু। আর তারপরই ওনার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। এ কি করলেন উনি?
পরক্ষনেই বাইকের এক মোক্ষম আঘাতে সাইকেল থেকে ছিটকে পড়লেন সুবোধ কুমার পাল। বিশেষ কিছু হয়নি, শুধু ডান পা-টায় ভীষণ চোট পেয়েছেন। হাতের কনুইটা চিরে রক্ত বেরছে। আর মাথায় লেগেছে। পিছনের দিকটায়, তবে ফাটেনি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে ওনার। একটু সম্ভিত ফিরতেই সুবোধবাবু ভাবলেন, ‘এটা কি হল? এতদিন যা খারাপ হয়েছে তা শেষ হয়েছে গিয়ে মৃত্যুতে। কিন্তু আমার তো সেরকম কিছু…তারমানে কি মাথায় হ্যামারেজ…’
ওনাকে পড়ে যেতে দেখে রাস্তার লোক ছুটে এল।
একজন পরিচিত লোক বলল, “আরে সুবোধদাকে তুলে তাড়াতাড়ি বাড়ি নিয়ে যা।”
বাড়ির কথা শুনেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল সুবোধবাবুর। উনি বললেন, “আরে না, না। আমি ঠিক আছি। বাড়ি যাওয়ার দরকার নেই।”
কিন্তু রাস্তায় যারা ভিড় করেছিলেন, তারা কেউ ওনার কথায় কান দিলেন না। ওনাকে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে এলেন ওনার বাড়িতে। সারাটা রাস্তা সুবোধবাবু প্রায় কেঁদে কেঁদে বলে গেলেন, “আমি বাড়ি যাবো না। আমি যাব না।”
সুবোধবাবু শুয়ে আছেন রান্নাঘরের পাশের ঘরটার বিছানায়। মণিমালাদেবী গেছেন সামনের বাড়ির ডাক্তারবাবুকে ডাকতে। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। ঘরের মধ্যে গ্যাসের গন্ধটা আস্তে আস্তে গাড় হচ্ছে। পাশে ঠাকুর ঘর থেকে আসছে একটা হাল্কে ধুপের গন্ধ।
হঠাৎ সেই গন্ধটা ছাপিয়ে একটা মিষ্টি গন্ধে ঘরটা ভরে গেল। সুবোধবাবু অবুঝের মত প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বললেন, “কেন? কেন?”
কানের কাছে যেন একটা বাচ্চার গলায় ফিসফিস করে এল, “আমি খুব একা বাপি।”
সুবোধবাবু যেন মুহূর্তের জন্য দেখতে পেলেন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বাচ্চা মেয়ের অবয়ব। তারপরই চোখটা গেল দরজার ঠিক উপরে লাগানো দেওয়াল ঘড়িটার দিকে। ছোট কাঁটাটা প্রায় নয় ছুঁইছুঁই আর বড় কাঁটাটাও আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে নয়-এর দিকে।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত