এপারে তিনজন, ওপারে একজন

এপারে তিনজন, ওপারে একজন

ঘরটা অন্ধকার। শুধু নীল রঙের দুটো শিখা জ্বলছে। আবছা আলোয় দেখে মনে হচ্ছে, টেবিলে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো মোমবাতি থেকেই আলোটা
বেরোচ্ছে, তবে সাধারণ মোমবাতি ওগুলো নয়। বোধহয় সিজিয়ামের কোনও কম্পাউন্ড দিয়ে তৈরি। রুনিয়ার সাবজেক্ট ছিল কেমিষ্ট্ৰি। আর ছিল নানান আবিষ্কারের বাতিক। সে-বাতিক যে এখনও সুপার-অ্যাক্টিভ সেটা এই মোমবাতিগুলো দেখেই বোঝ যায়। এসব নিৰ্ঘাত ওর কাণ্ড।
প্ল্যানচেটে বসলে যে নীল আলোর মোমবাতি জ্বালতে হবে তার কোনও
বাঁধাধরা নিয়ম নেই। তবে হলদে শিখার চেয়ে নীল শিখা খারাপ কী! বরং
নীল আলোর মধ্যে একটা যেন সুপারন্যাচারাল এলিমেন্ট রয়েছে।
প্ল্যানচেটের টেবিল ঘিরে আমরা তিন বন্ধু বসে আছি। আমি চন্দ্ৰশোভন
ওরা সবাই আমাকে চ্যানি’ বলে ডাকে। আমার ডানপাশে, মোটামুটিভাবে
একশো কুড়ি ডিগ্রির কৌণিক দূরত্বে সুরপতি। ও যেমন মোটা ঠিক ততটাই
ভারী ইন্টেলেকচুয়াল। আমরা ঠাট্টা করে ওকে ডক্টর বলে ডাকি যদিও ওর
ডক্টরেট ডিগ্রি নেই। সুরপতির ডানদিকে, আরও একশো কুড়ি ডিগ্রি পর বসেছে রুনিয়া।
প্ল্যানচেটের গোল টেবিলের ওপরে পাতা আছে একটা তেকোনা বোর্ড।

বোর্ডের তিনটে খাটো পায়া তিনটে স্টিলের বল দিয়ে তৈরি-যাতে বোর্ডটা।
সহজেই টেবিলের ওপরে চলে বেড়াতে পারে।
এ ছাড়া বোর্ডের ওপরে পাতা রয়েছে একটা এ-ফোর মাপের সাদা কাগজ।
কাগজের ওপরে রুনিয়ার পেনসিল ধরা হাত। আমি বাঁ-হাতে সেই হাতের
বাহর কাছটা আলতো করে ভূয়ে আছি। বেশ টের পাচ্ছি, রুনিয়ার হাত
কাঁপছে।
আমার ডানহাত সুরপতির হাতের মুঠোয়। সে-মুঠো ঘামছে। শুধু ঘামছে।
সুরপতির ডানহাত রুনিয়ার বাঁ-হাতে। সেই মুঠোটার কী অবস্থা কে জানে!
অন্ধকারে চুপচাপ বসে আমরা পমপমের কথা ভাবছিলাম। এটা জানি যে,
ওর কথা মন দিয়ে ভাবতে-ভাবতেই একসময় ও আসবে। আসবেই। কারণ,
আমরা চারজন এমন বন্ধু ছিলাম যে, সবাই আমাদের মজা করে ‘ফোর
স্কোয়ার’ বলে ডাকত। তো সেই স্কোয়ারের একটা কোণা দুসপ্তাহ আগে ভেঙে গেছে। আমরা তিনজন আর একজন, দু-ভাগে ভাগ হয়ে আলাদা হয়ে গেছি।
আমাদের মাঝখান দিয়ে জীবন-মৃত্যুর সীমারেখা চলে গেছে।
আচমকা একটা মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট আমাদের আলাদা করে দিয়েছে। আর এই আলাদা হওয়ার ঘটনায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে রুনিয়া। কারণ, ও পমপমকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। এখনও ভালোবাসে।
নীল আলোর অন্ধকারে বসে থাকতে-থাকতে ধৈর্যে টান পড়ছিল। পরিস্থিতিও যেন গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হয়ে পড়ছিল। তার সঙ্গে ঘরের বাতাসের চাপও
বাড়ছিল। তাই হালকা হওয়ার চেষ্টায় সুরপতিকে আলতো গলায় জিগ্যেস
করলাম, ডক্টর, একটা কথা বলি। প্ল্যানচেট নিয়ে তোর মনে কোনও ডাউট
ফাউট নেই তো?
‘নো, চ্যানি—অ্যাবসোলিউটলি জিরো পার্সেন্ট ডাউট। কেন, তোর কি
ডাউট আছে?’
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফিসফিসে গলায় বললাম, না, সেরকম।
কোনও পজিটিভ ডাউট নেই। তবে আমার এক আঙ্কল প্ল্যানচেটকে সবসময়
হেসে উড়িয়ে দিতেন। ঠাট্টা করে প্ল্যানচেট ওয়ার্ডটার একটা মজার ব্যাসবাক্য বলতেন…।
‘ব্যাসবাক্য মানে?’ সুরপতি একটু অবাক হয়ে জানতে চাইল।
আমি চাপা হাসলাম ঃ ‘ব্যাসবাক্য মানে সেই সমাস আর ব্যাসবাক্য।
তো আমার জিতু আঙ্কল বলতেন, প্ল্যানচেটের ব্যাসবাক্য হল, প্ল্যান করে
চিট করা-
রুনিয়া ফুপিয়ে উঠে বলল, কী হচ্ছে এসব! উই শুড বি ড্যাম সিরিয়াস..
কথা শেষ করতে করতে কেঁদে ফেলল ও।
সুরপতি গাৰ্জেনি সুরে আমাকে বলল, ‘চ্যানি, তোর বোধহয় জানা নেই,
কথাটা প্ল্যানচেট নয়—প্ল্যানশেট। যাক গে, বাজে কথা ছাড়—লেট আস
কনসেনট্রেট অন পমপম।’
‘ওকে, ওকে।’ বলে সিরিয়াস হতে চাইলাম আমি। পমপমের ওপরে
কনসেনট্রেট করতে চাইলাম। ওর কথা ভাবতে লাগলাম একমনে। আর সেটা
করামাত্রই অ্যাক্সিডেন্টের কালো রাতটা চিতাবাঘের মতো একলাফে চলে এল চোখের সামনে।
মোটরবাইক চড়ে শান্তিনিকেতন বেড়াতে যাওয়ার অ্যাডভেঞ্চার প্ল্যান।
করেছিলাম আমরা। দুটো মোটরবাইক, আর আমরা চারজন সবুজ ছেলেমেয়ে।
আমি আর পমপম বলতে গেলে এক্সপার্ট বাইকবাজ। আমার পেছনে
সুরপতিকে লোড করেছি, আর পমপমের বাইকে সঙ্গিনী হয়েছে রুনিয়া।
পমপম
সবসময় হেসে বলত রুনিয়া পেছন থেকে জড়িয়ে না ধরলে ওর নাকি বাইক
চালানোর মুড আসে না। এতে রুনিয়া চোখে সরু করে ইশারায় ওকে ধমক
দেওয়ার চেষ্টা করত বটে, কিন্তু পমপম সেটা গ্রাহের মধ্যেই আনত না।
শুধু হাসত। আর হাসলে ওর গালে ফ্যান্টাস্টিক একজোড়া টোল পড়ত।
আমি তখন পমপমকে চোখ মটকে বলতাম, ঠিক, ঠিক। তোর পিঠের
টেম্পারেচারটাই তো তোর বাইক চালানোর আসল ইনম্পিরেশান, বস।
এইভাবে হাসি ঠাট্টা করতে করতে নানান জোক মারতে-মারতে আমরা
শান্তিনিকেতনে পৌছে গিয়েছিলাম।
আমরা ঠিক করেছিলাম, একটা রাত্তির থাকব। তার জন্য পমপম ওর চেনা
একজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে একটা বাড়ি ফিট করেছিল। তবে বাড়িটা
মোটেই শান্তিনিকেতনে নয়। শান্তিনিকেতন ছাড়িয়ে প্ৰান্তিক—সেই প্রান্তিকের শেষ প্রান্তে।
অযত্নে পড়ে থাকা ছোট মাপের একটা দোতলা বাড়ি। সঙ্গে লাগোয়া
বাগান। বাড়ির যেমন লজঝড়ে চেহারা, বাগানেরও তাই। বাগান জুড়ে শুধু
আগাছা। তবে তারই মধ্যে ছোট-ছোট গোলাপি আর হলদে রঙের ফুল ফুটে আছে।
সব মিলিয়ে বোঝা যায়, বাড়িটা বহুকাল মানুষজনের মুখ দেখেনি। অনায়াসে তার গায়ে ভূতুড়ে বাড়ি’ তকমা এটে দেওয়া যায়।
এ নিয়ে পমপমকে আমরা কম আওয়াজ দিইনি। তাতে ও একসময় খেপে
গিয়ে বলল যে, আমরা অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছি। সেই স্পিরিটের সঙ্গে বাড়িটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট মানিয়ে গেছে।
শুধু সেই স্পিরিট কেন, বাড়িটা অন্যরকম স্পিরিটের পক্ষেও বেশ
মানানসই। এ-কথা বলেছিল ডক্টর সুরপতি। আর তখন ওর মোটা শরীরটা
ভুড়ি কাপিয়ে নাচছিল, কারণ ও হাসছিল।
পমপম তার উত্তরে এক পশলা খিস্তি দিয়ে সুরপতিকে বেদম ঝেড়েছিল।
রুনিয়া হাত-পা ছুড়ে চেচামেচি করে পমপমকে মুখ খারাপ করতে বারণ।
করছিল, কিন্তু পমপম শুনলে তো!
রুনিয়া যখন রাগ-টাগ করে গুম মেরে গেল তখন পমপম ওকে মাস্টারির
স্টাইলে বোঝাতে শুরু করল, ‘শোন, রুনিয়া শোন–প্লিজ। খিস্তি হচ্ছে বাংলা
ভাষার আলিয়েস্ট ফুড ফর্ম। সেটাই ছ’-সাত বার চোলাই হয়ে ভদ্দর লোকেদের।
ভাষা তৈরি হয়েছে। ফিলোলজির কোনও প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করে দেখিস..
প্লিজ.এবার টেম্পারেচারটা একটু কমা।’
আমি রুনিয়াকে চোখ মেরে বললাম, ‘বেশি কমাস না—তা হলে ফ্রিজিড
হয়ে যাবি।’
পমপম ওর গায়ের টি-শার্টটা খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শালা
ফ্রয়েডের বাচ্চা!’ বলে ওটা আমার মুখে ছুড়ে মারল।
বাড়িটায় পৌছোনোর পর থেকেই আমাদের ঠাট্টা-ইয়ারকি হইহল্লা চলছিল।
তখনও জানি না, রাত্তিরে কী হতে চলেছে। জানি না, আমাদের তিনজন আর
পমপমের মাঝে লক্ষ্মণরেখা টানার জন্যে নিয়তি কলম নিয়ে তৈরি হচ্ছে।
এখন ঘরে ঠান্ডা বাতাস চলে বেড়াচ্ছিল। নীলচে অন্ধকারে সেটাকে আরও
ঠান্ডা বলে মনে হচ্ছিল। ঘরের দরজা হাট করে খোলা। এ ছাড়া দু-দিকের
দেওয়ালের দু-দুটো জানলাও। বাতাসটা এত ভারী যে, মনে হচ্ছিল আমি কত
হালকা। এই বুঝি পালকের মতো বাতাসে ভেসে পড়ব।
একতলার এই ঘরটা আমাদের কাছে নতুন। কিন্তু উপায় কী! দোতলার
ঘরটার তো একদিকের দেওয়াল আর নেই। সে-রাতে আমরা দোতলার বড়
ঘরটাতেই ছিলাম। মাত্র দুসপ্তাহ আগের ব্যাপার, অথচ মনে হচ্ছে কত যুগ।
আগের কথা।
প্রান্তিকের শেষ প্রান্তের সেই অভিশপ্ত বাড়ি। তার দোতলার অভিশপ্ত ঘরটা আর ঠিকঠাক নেই বলেই আমরা এবার একতলার বাগানের লাগোয়া একটা
ঘরে আস্তানা গেড়েছি। পমপমকে প্ল্যানচেটে ‘নেমস্তানের ‘ আসর বসিয়েছি।
ওকে যে আমাদের ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে! বিশেষ করে । রুনিয়া তো ওকে
একটিবার দেখার জন্যে পাগল। আমাদের টানে পমপমকে আজ আসতে হবে।
আসতে তো ওকে হবেই!

রুনিয়া গুমরে কেঁদে উঠল।
পমপম! পম! হানি বানি, তুই কোথায়?’ রুনিয়ার গলাটা হঠাই ফিসফিসে
হয়ে গেল ঃ ‘আয় রে.জলদি আয়.আই নিড য়ু, হানি বানি।’
মোমবাতির নীল শিখা দুটো কাপতে লাগল। ভারী বাতাস ধাক্কা মারতে
লাগল আমাদের গায়ে। দরজা আর জানলা দিয়ে বাইরের আগাছার জঙ্গল
চোখে পড়ছিল। অন্ধকারেও গোলাপি আর হলদে ফুলগুলো স্পষ্ট—যেন
ফুওরেসেন্ট রঙে আঁকা ছবি। আগাছার ডালগুলো এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ছে।
ওরা যেন পাগল হয়ে গেছে।
এমন সময় পায়ের শব্দ শোনা গেল। কারা যেন এগিয়ে আসছে এই ঘরের
দিকে। পমপম ? নাকি ওর সঙ্গে আরও কেউ রয়েছে?
আমরা তিনজনে ফিসফিস কবে পমপমের নামটা বিড়বিড় করতে লাগলাম।
যেন ওই চার অক্ষরের নামটা একটা অমূল্য বীজমন্ত্ৰ ।
‘পমপম…পমপম…পমপম…পম…’
সেদিন রাতে আাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা হয়েছিল মাঝরাতে। আমরা দোতলার
ঘরের মেঝেতে দুটো বিছানা পেতে গল্প করতে করতে কখন যেন ঘমিয়ে
পড়েছিলাম। তারপর, আচমকা একটা মেগা -এক্সপ্লোশানে আমরা জোগে
গিয়েছিলাম। কয়েক সেকেন্ডের টুকরো ছবিতে যা দেখেছিলাম তা এককথায় অবিশ্বাস্য।
আমাদের ঘরের পুবদিকের দেওয়ালটা ভ্যানিশ। আমরা সব বোমার
সখ্রিস্টারের মতো শূন্যে পাগল-করা গতিবেগে ছুটে চলেছি। চারপাশে দাউদাউ
আগুন। চোখে কোটি-কোটি সরষে ফুল। আমাদের শরীরগুলো আস্ত না ধ্বস্ত
জানি না। তবে সেগুলো বিস্ময় আর যন্ত্রণায় যে অসাড় সেটা এক মুহুর্তের
জন্যে হলেও অনুভব করেছিলাম।
এই মারাত্মক দুর্ঘটনার কথা আলোর চেয়েও দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল।
অঞ্চলে। আর বিস্ফোরণের দাপটে থরথর করে কেঁপে উঠেছিল প্রায় এক
বর্গকিলোমিটার এলাকা। লোকের মুখে-মুখে তার পুলিশের কথাবার্তায় জানা গিয়েছিল, প্রান্তিকের ওই ছন্নছাড়া বাড়িটা নাকি জঙ্গিদের হাই মেগাটন বোমা
বানানোর গোপন ঘাটি ছিল। আমরা যে-ঘরটা ঝাড়পোছ করে এক রাতের
জন্য বেডরুম বানিয়ে নিয়েছিলাম, ঠিক তার পেছনের ঘরটাতেই নাকি বারুদের
মশলা আর ইলেকট্রনিক সুইচিং সার্কিটের কাজ-টাজ চলত।
ওই একটা মারণ দুর্ঘটনা পমপমকে আমাদের কাছ থেকে দূরে দিল।
ঠেলে
পমপম! পমপম!
রুনিয়ার পেনসিল ধরা হাত উত্তাল সমুদ্রে ডিঙি নৌকোর মতো টলছে।
কে, কে এসে দাঁড়াল দরজায়? ওই তো একটা ছায়া!
‘চ্যানি–চ্যানি, পমপম এসে গেছে!’ ফিসফিস করে বলল রুনিয়া।
‘ডক্টর, ওই দ্যাখ –’ আমি সুরপতির হাত সাঁড়াশি-মুঠোয় চেপে ধরলাম ।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পমপম নয়—পমপমের ছায়া। ছায়াটা যে ওর সেটা
বোঝা যাচ্ছে ঝাকড়া চুলের সিলুয়েট দেখেই। কিন্তু তার পেছনে আরও দুজন
ছায়া। পমপমের তুলনায় আরও রোগা কিন্তু লম্বা।
রুনিয়া হঠাৎ যেন পাগল হয়ে গেল। পমপমের নাম ধরে ও চিৎকার
করে উঠল। কিন্তু পমপম কিছুই শুনতে পেল না।
রুনিয়াকে ফিসফিসে ধমক দিয়ে আমি আর ডক্টর চুপ করাতে চেষ্টা।
করলাম ; কিন্ত ও শুনলে তো!
রুনিয়া দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল, অথচ ওর পেনসিল-ধরা হাত কাগজের
ওপরে চলছিল। মোমবাতির নীল আলোর আভায় কাগজটা দেখা যাচ্ছিল, তবে
তার ওপরে পেনাসলের লেখা বোঝা যাচ্ছিল না।’
হঠাই ঘরের ভারী বাতাস ছুটোছুটি করতে শুরু করে দিল। মোমবাতির
শিখা দুটো পতাকার মতো লতপত করতে লাগল। কাগজের একটা কোনা।
বাতাসী পাখির মতো উড়াল দিতে চাইল।
আমরা তিনজনে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
ঘরের দরজার কাছে এসে থমাক দাঁডাল পমপম।
সেই অ্যাক্সিডেন্টের পর ওকে নার্সিং হোমে এগারো দিন কাটাতে হয়েছে।
তারপর আরও দু-বন্ধুকে জোগাড় করে ও আবার প্ল্যানচেটের আসর বসানোর
ব্যবস্থা করেছে। এবং চোদ্দো দিনের মাথায় ফিরে এসেছে অকুস্থলে—প্ৰান্তিকের সেই অভিশপ্ত বাড়িটায়।

প্ল্যানচেটের সব আয়োজন ও একার হাতে করেছে। টেবিল, চেয়ার,
তেকোনা বোর্ড, কাগজ, পেনসিল, মোমবাতি—সব। তারপর ও আরও দুজন
বন্ধুকে ডাকতে গিয়েছিল। কারণ, প্ল্যানচেট করতে হলে অন্তত তিনজন তো
দরকার!
পমপম চোখের জল থামাতে পারছিল না। কারণ, রুনিয়ার কথা মনে ।
পড়ছিল। গলার ভেতরে একটা উলের বল যেন নড়াচড়া করছে সমসময়।
ওর আরও মনে পড়ছিল চ্যানি আর ডক্টরের কথা।
একটা রাত, একটা ভয়ংকর অ্যাক্সিডেন্ট। মৃত্যু এসে এক ছোবলে ওদের
চারজনের বন্ধুত্বে চিড় ধরিয়ে দিল। চিড় নয়, চওড়া এক কালো ফাটল। তার
একদিকে একজন, আর এক দিকে তিনজন। সেই তিনজনকে আজ এখন,
প্ল্যানচেটে ডাক পাঠাবে পমপম। ওঃ, কতদিন দেখেনি ওদের! কতদিন দেখেনি
রুনিয়াকে!
দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল পমপম। ঘরের অন্ধকারে মোমবাতির
শিক্ষা দুটো ওর নজরে পড়ল। ও তো মোমবাতি জেলে যায়নি। দেশলাই
তো এখনও ওর পকেটে!
তা ছাড়া নীল রঙের শিখা কেমন করে তৈরি হল? কোন অলৌকিক
ম্যাজিকে?
ঘরের তিনটে চেয়ারই খালি. অথচ পেনসিলটা নিজে থেকেই খাড়াভাবে।
শাড়িয়ে রয়েছে কাগজের ওপরে! আর শুধু দাড়িয়ে নেই, কাগজের ওপরে
চলে বেড়াচ্ছে!
কোন এক লুকোনো বাতাসে মোমবাতির শিখা দুটো ছটফট করছিল। সেই
বাতাসের ঝাপটা পমপমের গায়ে লাগতেই ওর গায়ে কাটা দিল; কী ঠান্ডা!
ও ভয় পেয়ে গেল। চোখের জল মুছে পাগলের মতো দৌড় লাগাল।
ওর বাকি দুজন বন্ধু কোনও কিছু না বুঝেই ওর পিছন পিছন ছুটতে শুরু
করল।
পমপম বুঝতে পারল না, ওর প্রাণের তিন বন্ধু প্রাণ চলে যাওয়ার পরেও
ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আর সেইজন্যই ওরা পমপমাকে ‘ডাকতে
ওদের প্ল্যানচেটের আসর বসিয়েছিল।

…………………………………………..(সমাপ্ত)…………………………………………..

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত