পৃথিবীতে আশ্চর্য ঘটনা ঘটে অনেক, কিন্তু সেসবে বিশ্বাস করে এমন লোক খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না।
আমার জীবনে এরকমই একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল, তা শুধু আশ্চর্য নয়, অত্যাশ্চর্যও বটে। তোমাদের কাছে আজ সেই ঘটনার কথাই বলব, বিশ্বাস করতে হয় কোরো, না করলেও দুঃখিত হবো না।
আমি তখন সরকারি কাজে হাজারিবাগ অঞ্চলের এক জায়গায় থাকি। একটা মানুষখেকো বাঘের অত্যাচারে তখন সে অঞ্চলের মানুষের ‘ত্রাহি ত্রাহি’ রব। দেশী-বিদেশী বহু শিকারীর গুলি হজম করে নাকি বেঁচে আছে বাঘটা। সেই অঞ্চলের লোকেরা বলে, বাঘটা নাকি সাধারণ বাঘ নয় – বাঘের ছদ্মবেশে হিংস্র কোনো অপদেবতা। কেউ কেউ নাকি আবার তাকে চোখের সামনে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেখেছে। তাকে মানুষের ভাষায় কথা কইতে শুনেছে, এমন লোকেরও অভাব নেই! বনের ভেতর বসে সে নাকি মেয়েমানুষের গলায় আর্তনাদ করত। তার সেই কান্নাকে মানুষের কান্না ভেবে যে বনের ভেতর ঢুকত, সে আর ফিরে আসত না। লোকে তাই তাকে ‘শয়তান’ বলে ডাকত। ‘শয়তান’কে দেখলেই চেনা যেত, কারণ তার ল্যাজ ছিল না! হয়তো বনের ভেতর অন্য কোনো জন্তুর সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে সে ল্যাজের গৌরব থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। কিন্তু লোকের বিশ্বাস, ‘শয়তান’ এর এই লাঙ্গুলহীনতাই তার অলৌকিকত্বের মস্ত প্রমাণ। বাঘের ল্যাজ নেই, তাও কখনো সম্ভব?
এসব গল্প যে মিথ্যে তাতে আর ভুল নেই। মানুষখেকো বাঘেরা প্রায়ই চালাক হয়। বড় বড় শিকারীদেরও তাদের বধ করতে হিমসিম খেতে হয়। তাই তাদের নামে এমনি সব গল্পও শোনা যায়। বৃক্ষ বিশেষের আশ্চর্য শিকড়ের গুণে মানুষ বাঘের রূপ ধরতে পারে, এমন গল্পও শুনেছি। কিন্তু আধুনিক যুগে নিতান্ত মূর্খ ভিন্ন আর কেউ এসব গল্প বিশ্বাস করবে না।
‘শয়তান’ যে সাধারণ বাঘ, একদিন তার প্রমাণ পেলুম।
বন্ধু হরিশের সঙ্গে সন্ধ্যার আগে হরিণ মেরে ফিরে আসছি! আমাদের পিছনে পিছনে আসছিল মরা হরিণটাকে কাঁধে করে দুজন কুলি, আর বাঘের মতোই বড় আমার শখের কুকুর ‘টাইগার’। বনের ভেতর একটা মোড় ফিরতে সামনেই দেখি, পথের ওপর বিড়ালের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে মস্তবড় একটা বাঘ। তার ল্যাজ নেই!
পিছনের কুলীরা রুদ্ধশ্বাসে, অস্ফুটস্বরে একসঙ্গে বলে উঠল – “শয়তান!”
পর মূহুর্তেই আমি আর হরিশ – দুজনেই একসঙ্গে বন্দুক ছুঁড়লুম!
শয়তান লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠেই আবার পড়ে গেল – আর নড়ল না!
এত সহজে শয়তান’কে ঘায়েল করে আমাদের আনন্দের আর সীমা রইল না। কুলি দুজনও মনের খুশীতে ধেইধেই করে নাচ জুড়ে দিল! আশপাশের গাঁয়ে সে খবর তখনি ছড়িয়ে পড়ল – দলে দলে লোক দেখতে এল ‘শয়তান’কে। অনেকে তার মৃতদেহের ওপর কিল-চড়-লাথি বৃষ্টি করে মনের ঝালও ঝেড়ে নিল। অনেক কষ্টে তাদের থামিয়ে জনাকয়েক কুলির সাহায্যে ‘শয়তানে’র দেহ তুলে আবার নিজেদের বাসার দিকে রওনা হলুম।
……….খানিক দূর যেতেই, বিরাট এক ক্রুদ্ধ দৈত্যের মতো সারা আকাশ জুড়ে একখানা মিশমিশে কালো মেঘ ছুটে এল ভীষণ ঝোড়ো নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে। শহরে বসে তোমরা এই মেঠো বুনো ঝড়ের কথা কল্পনাও করতে পারবে না।
দেখতে দেখতে পরেশনাথ পর্বতের আকাশভেদী চূড়া ধুলো-মেঘের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল, বনের গাছগুলো পাগলের মতো মাটির ওপর বারবার মাথা কুটতে লাগল, আর যেন কার বিপুল ফুৎকারে সারা পৃথিবীর আলো কাঁপতে কাঁপতে নিবে গেল! খানিক তফাতেই একখানা পুরনো বাংলো ছিল, আমরা তাড়াতাড়ি তার ভেতর গিয়ে আশ্রয় নিলুম। ঝড়ের পর এল বৃষ্টি – সন্ধ্যার অন্ধকারকে সঙ্গে করে।
বুঝলুম, আজ আর বাসায় ফেরা হবে না। কারণ এখান থেকে আমার বাসা অন্তত পাঁচ মাইল তফাতে। মাঝে আবার নদী আছে। সেই পাহাড়ে নদী বৃষ্টিধারায় পুষ্ট হয়ে এতক্ষণে দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে নিশ্চয়।
কুলিরাও চলে যেতে চাইল – বখশিশের লোভও গ্রাহ্য করল না।
তারা দুটো কারণ দেখাল – প্রথমত, শয়তানের মৃতদেহের সঙ্গে তারা রাত্রিবাস করবে না। দ্বিতীয়ত, এই বাংলোয় আগে এক সাহেব থাকত,কারা নাকি তাকে এই বাংলোতেই খুন করে রেখে গিয়েছিল। সেই থেকে এই বাংলোয় কোনো মানুষই টিকতে পারে না।
সেই বৃষ্টিতেই কুলিরা বাংলো ছেড়ে পালালো।
শিকারি মানুষ, সবরকম বিপদের জন্যেই সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হয় – সঙ্গে লন্ঠন এনেছিলুম, তাই জ্বাললুম। ব্যাগের ভেতর তখনো কয়েক টুকরো স্যান্ডুইচ আর খানিকটা ‘গোয়াভা জেলি’ ছিল, তাই দিয়ে আমার, হরিশের আর টাইগারে’র নৈশ আহার শেষ করতে হবে। উপায় কি? আমরা যে খোলা মাঠে নেই, এখন এইটুকুই পরম স্বান্তনার কথা।
মাঝের হলঘরে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলুম। ঘরখানা প্রকাণ্ড – দেয়ালে দেয়ালে উইদের রাজত্ব, সমস্ত দরজা জানলাই ভাঙা, মেঝেতে পুরু ধুলোর প্রলেপ – তার ওপর নানা জন্তুর পায়ের দাগ – বাঘের, ভাল্লুকের, শেয়াল-কুকুরের! এখানে ওখানে হাড় পড়ে আছে….কোনো কোনো হাড় মানুষের বলেও সন্দেহ হলো। বুঝলুম, মানুষের বাড়ি আজ বাঘ-ভালুকের আস্তানায় পরিণত হয়েছে।
বন্ধু হরিশকে বললুম, “হরিশ, এখানেও আমরা নিরাপদ নই। যে কোনো মূহুর্তেই বাঘ-ভালুকের সঙ্গে আবার দেখা হতে পারে, বন্দুকে টোটা ভরে তৈরি হয়ে থেকো”।
হরিশ আমার কথামতো কাজ করতে করতে বলল, “আজ রাত্রে দেখছি ঘুমের দফারফা! ”
‘শয়তান’ আর হরিণের দেহ দুটো ঘরের এক কোণে রাখলুম।
……………………..রাতের আকাশকে ছ্যাঁদা করে জলধারা অবিশ্রান্তভাবে গড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর বুকে। বিদ্যুৎ-সাপগুলো কিলবিল করে ক্রমাগত চলে যাচ্ছে শূন্যতার এধার থেকে অন্য ধার পর্যন্ত। বৃষ্টি-বাণে আহত অরণ্যের কান্নায় চারিদিক পরিপূর্ণ।
‘টাইগার’ এই পোড়োবাড়ির ভাঙা ঘর মোটেই পছন্দ করলে না। ঘরময় ছড়ানো হাড়গুলো সে আগে শুঁকে শুঁকে অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করল। তারপর ওপরদিকে মুখ তুলে কিসের যেন ঘ্রাণ নিতে লাগল – যেন কোনো অদৃশ্য বিভীষিকার সন্ধান পেয়েছে! টাইগার সাহসী কুকুর, বাঘ দেখলেও ডরায় না। কিন্তু সে আজ অত্যন্ত ভয়ে অস্থির হয়ে উঠল – পেটের তলায় ল্যাজ ঢুকিয়ে একবার এখানে একবার ওখানে গিয়ে বসে পড়ে, আবার উঠে কান খাড়া করে যেন কার পদশব্দ শোনে! আমি তাকে ডাকলুম, কিন্তু সে কিছুতেই কাছে এল না। থেকে থেকে চমকে ওঠে, আর হা-হা করে লম্বা জিভ বের করে হাঁফায়!
হরিশ আশ্চর্য হয়ে বলল, “টাইগার আজ এমন করছে কেন? সে কি দেখেছে? ”
আমারও মনে ওই একই প্রশ্ন। চারিদিকে তাকিয়েও সন্দেহজনক কিছুই দেখতে পেলুম না। আগেই বলেছি, ঘরটা মস্ত বড়। আমার এই ছোট লন্ঠনের আলোয় সে ঘরের অন্ধকার দূর হয়নি। হঠাৎ মনে হলো, দেয়ালের ওপর দিয়ে যেন একটা লম্বা ছায়া দুলতে দুলতে সরে যাচ্ছে……..
হরিশের একখানা হাত চেপে ধরে বললুম, “দ্যাখো, দ্যাখো!”
টাইগারও মনে হলো ছায়াটাকে দেখতে পেয়েছে। সে ঊর্ধ্বমুখে চেয়ে অস্বাভাবিক, তীক্ষ্ণ শেয়ালের মতো স্বরে কাঁদতে লাগল।
হরিশ বলল, “কি? কি দেখব?”
“….ওই ছায়াটা’কে দেখতে পেলে?”
“…..কোথায়? ”
“….ওই যে! দেয়ালের ওপর দুলছে!”
“….তুমিও পাগল হলে নাকি? ওখানে তো কিছুই নেই!”
চোখ রগড়ে চেয়ে আমিও আর কিছু দেখতে পেলুম না। নিজের ভ্রম বুঝে লজ্জায় চুপ করে রইলাম।
বাইরে বনের ভেতর থেকে একটা বাঘ ক্রমাগত গর্জন করতে লাগল। হয়তো ‘শয়তানে’র বউ। বনে বনে স্বামীকে খুঁজে খুঁজে ডেকে ডেকে বেড়াচ্ছে! গর্জনটা ধীরেধীরে অস্পষ্ট হয়ে গেল!
হঠাৎ মনে হলো আমার কানে কানে কে যেন কথা কইল!
রোমাঞ্চিত দেহে আমি হরিশের কাছ ঘেঁষে সরে বসলুম!
আমার মুখের ভাব দেখে হরিশ বলল, “আবার কি হল?”
“…..কে যেন আমার কানে কানে কথা কইলে!”
“…সুরেন, তোমার মাথা বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে! তুমি যে এমন ভীতু তা জানতুম না!”
তার ধিক্কার শুনে মনটাকে আবার শক্ত আর চাঙ্গা করে তোলবার চেষ্টা করলুম। কিন্তু কেন জানি না, বুকের ছমছমানি কিছুতেই আজ থামতে চাইল না। খালি মনে হতে লাগল, আমার চারিপাশ দিয়ে আজ সেইসব পা চলে বেড়াচ্ছে, যেসব পা চললে কোনো শব্দ হয় না। আমার চারিপাশে সব অদৃশ্য চোখ। আমরা তাদের দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু তারা আমাদের দেখতে পাচ্ছে! কি অসোয়াস্তি। ওদের চোখ এড়াই কেমন করে?
বললুম, “হরিশ, এ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি চলো। এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলেই আমি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাব”।
হরিশ বলল, “কুলিদের বাজে কথা তোমার মনের ওপর কাজ করছে। তুমি শান্ত হও। এরকম পোড়োবাড়িতে এলে অকারণেই গা একটু ছমছম করে বটে, কিন্তু ও কিছু নয়”।
“…..কিন্তু টাইগার’ও অমন কাতরাচ্ছে কেন? সে তো কুলিদের কথা বোঝেনি!”
“….টাইগার হচ্ছে অবোধ জন্তু, মিছিমিছি ভয় পেয়েছে। সে ভয় পেয়েছে বলে তুমিও ভয় পাবে? তুমি যে মানুষ! ”
……………….এবার সত্যি সত্যিই ঘরের বাইরেকার দালানে দ্রুত পদশব্দ শোনা গেল। শব্দটা একটা দরজার কাছে এসে, আবার দূরে চলে গেল।
হরিশ বলল, “কোনো জন্তুর পায়ের শব্দ।” কিন্তু আমার মন বলল, এটা কোনো জন্তুর পায়ের শব্দ নয়!”
জীবনে আমার মনের ভেতর এমন অলৌকিক ভাবের উদয় হয়নি। ভাগ্যে সঙ্গে হরিশ আছে, নইলে যে আমার কি অবস্থা হতো!
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, রাত বারোটা। হরিশ খাবারের ‘বাস্কেট’ বের করে বলল, “অনেক রাত হয়েছে। এসো, এইবার আমরা খেয়ে নিই”।
আমি বললুম, “তুমি একলা খেয়ে নাও! আজ আমার খিদে নেই”।
…….ঠিক এইসময়, খুব কাছেই আবার বাঘের ঘনঘন চিৎকার শুরু হল।
শয়তানের সঙ্গিনী কি খোঁজ পেয়েই এখানে এসে হাজির হয়েছে?
হরিশ বলল, “বন্দুক নাও! বাঘটা ভেতরে আসতে পারে!”
খুব দীর্ঘ, করুণ ও অস্বাভাবিক এক চিৎকার করে বাঘের ডাক থামল – সঙ্গে সঙ্গে ভাঙা জানলা দিয়ে ঝটপট করে ঘরের ভেতর কালো কুচকুচে কি একটা ঢুকে পড়ল।
হরিশ আশ্চর্য হয়ে বলল, “বাদুড়! ”
তারপরেই দরজার চৌকাঠের ওপর এসে দাঁড়াল মস্তবড় একটা কালো কুৎসিত বিড়াল। বাদুড়টা ঘরের চারিদিকে চক্রাকারে উড়তে লাগল আর কালো বিড়ালটা ল্যাজ তুলে ক্রমাগত ডাকতে লাগল, ম্যাও! ম্যাও! ম্যাও! ম্যাও!
বাদুড়টা হঠাৎ গোঁত্তা খেয়ে শয়তানের মৃতদেহের ওপর গিয়ে বসল, তারপর দুই ডানা বিস্তার করে সেইখানেই স্থির হয়ে রইল – একটা মূর্তিমান অভিশাপের মতো।
টাইগার আবার দাঁড়িয়ে উঠল এবং ভয়ানক এক আর্তনাদ করে আমার পায়ের কাছে ছুটে এসে ধুপ করে পড়ে গেল। কাঁপতে কাঁপতে তার গায়ে হাত দিয়ে দেখি, সে মারা গেছে।
হরিশ সবিস্ময়ে বলল, “সুরেন, দ্যাখো, দ্যাখো!”
ওঃ! সে কি দৃশ্য!
যাকে আমরা স্বহস্তে গুলি করে মেরেছি – যার মৃতদেহ এতগুলো কুলি কাঁধে করে বয়ে এনেছে , যে মরে এতক্ষণে কাঠ হয়ে গিয়েছিল, সেই শয়তান এখন আমাদের চোখের সামনেই চার পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে…. আর, তার দুটো চক্ষু আগুনের দুটো গোলার মতো দাউদাউ করে জ্বলছে! সে চোখটা যেন আমাদের ভস্ম করে দিতে চায়।
বাইরে আবার বাঘ ডাকতে লাগল।
শয়তান ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেল ধীরেধীরে।
বাদুড় আর কালো বিড়ালকেও আর দেখতে পেলুম না। চিৎকার করে আমি মাটির ওপর পড়ে গেলুম।
………….সেই সপ্তাহেই দরখাস্ত করে অন্য দেশে বদলি হয়ে গিয়েছি – পাছে শয়তানের সঙ্গে আবার দেখা হয়!
হরিশের মতে, আমাদের বন্দুকের গুলিতে শয়তান মরেনি, মূর্ছিত হয়ে পড়েছিল মাত্র। হতেও পারে। নাও হতে পারে।
…………………………………………………( সমাপ্ত)……………………………………………
গল্পের বিষয়:
ভৌতিক