রাতের বুক চিরে মেল ট্রেনটা তীব্র বেগে ছুটে চলেছে।
চারদিকে প্রচণ্ড দুর্যোগ, মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশে ঘন কালো মেঘের বুক চিরে মাঝেমাঝে বিদ্যুতের আলো ঝলসে উঠছে। প্রচণ্ড শব্দে থেকে থেকে বাজ পড়ছে। কিন্তু এসব দুর্যোগকে উপেক্ষা করে ট্রেনটা গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে।
ফার্স্ট ক্লাস কামরার একটি কুপে জানলা দরজা বন্ধ করে অতনু বসে বসে অলসভাবে একটা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে। হাতে তার ধরা জ্বলন্ত সিগারেট। বাইরে প্রবল বৃষ্টির ছাঁট বন্ধ জানলার সার্সির ওপর আছড়ে পড়ছে। ক্লান্তভাবে অতনু কুপের বড় লাইটটা নিভিয়ে শুয়ে পড়ে আর রিডিং ল্যাম্পটা জ্বালায়।
এই কুপটাতে সে একা। অবশ্য এইরকম একা যাতায়াত করা তার অভ্যাস আছে। তার ট্যুরের চাকরি। অফিসের কাজে প্রায়ই তাকে কলকাতার বাইরে যেতে হয়, এই রকমই একটা কাজে সে দিল্লী চলেছে। কিন্তু আজ তার মনটা একটু বিক্ষিপ্ত, বার বার চেষ্টা করেও সে বইয়ের পাতায় মন দিতে পারছে না। বারবার অফিসের বড় সাহেবের কথাগুলো কেবলই তার কানে বাজছে :
“…দেখবেন মিঃ চৌধুরী, এই এসাইনমেন্টের সাকসেসের ওপর আপনার প্রমোশন নির্ভর করছে। অতএব….. ” পরিশেষে হাসিমুখে বলেছিলেন, ” বেস্ট অফ লাক…”। আসার সময় স্ত্রী মিলি’ও এই ব্যাপারে খুব উদ্বিগ্ন হয়েছিল। ট্রেনে সী অফ করতে এসে বার বার ওকে বলেছে, ” কোনওরকম টেনশনে থেকো না কিন্তু। রিলাক্স করো। সব ঠিক হয়ে যাবে”।
না, অতনু কিছুতেই বিমর্ষ হবে না। তাই অফিসের কাজের টেনশন মন থেকে তাড়াতেই সে এই হালকা নভেলটার পাতায় চোখ বুলোচ্ছে। বাইরের দুর্যোগের কারণে তার বারবারই মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে সে বইটা নামিয়ে রাখল। মনে মনে এক কাপ চা হলে ভালই হতো। ট্রেনের গতি হঠাৎ বেশ কমে আসছে। অতনুর চিন্তায় ছেদ পড়ল। বিরক্তিতে তার ভ্রু কুঁচকে ওঠে – ‘ আবার কোনও স্টেশন এল নাকি? তাহলে তো আবার যাত্রীদের ওঠানামার শব্দ, দরজার শব্দ, ভারী ভারী মালপত্র টানা হ্যাঁচড়ার আওয়াজ, কুলিদের চেঁচামেচি – এইগুলো অতনুর বড়ই বাজে লাগে।
ট্রেনটার গতি খুব আস্তে হয়ে এল এবং বেশ কিছুক্ষণ ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে হঠাৎ হ্যাঁচকা টান দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। চায়ের আশায় অতনু কুপ ছেড়ে বেরিয়ে এসে ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে একটা চা’ওয়ালাকে ধরে চা কিনল, চায়ের ভাঁড় হাতে নিয়ে কুপের ভেতর এসে ঢুকল।
ঢুকতেই চমকে গেল অতনু। প্রায়ান্ধকার কুপের মধ্যে তার সিটের বিপরীত দিকের সিটে কে একজন বসে আছে। আলো আঁধারিতে অতনু দেখতে পেল, লোকটার গায়ে বর্ষাতি, মাথার টুপিটা টেনে সামনের দিকে নামানো যাতে তার মুখ ভাল করে দেখা যাচ্ছে না।
অতনু কুপে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিতে দিতে একটু বিরক্ত হল, অবশ্য পরক্ষণেই সে একটু খুশীও হল। প্রথমটায় ভেবেছিল বেশতো সে একা যাচ্ছিল। কে একটা উটকো লোক এসে জুটল, কিন্তু তারপরেই সে ভাবল, যাক, লোকটার সাথে দুটো কথা বলে একঘেয়েমিটা কাটানো যাবে।
নিজের সিটে বসেই অতনু চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিল। আলাপ জমানোর সুরে বলল, ” এটা কোন স্টেশন, মশাই?”
লোকটি ফ্যাসফ্যাসে গলায় উত্তর দিল – ” পাহাড়পুর “।
“…..সে কি! এখানে তো ট্রেন থামার কথা নয়!”
“….না, লাইন ক্লিয়ার পায় নি তো, তাই দাঁড়িয়ে গেছে”।
অতনু এবার জিজ্ঞেস করল, ” মশাইয়ের কোথায় যাওয়া হবে?”
লোকটা তেমনিই ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ” কোথায় আবার? আপনি যেখানে চলেছেন”।
এ কথায় অতনু ঘাবড়ে যায়। ‘ কি ব্যাপার? লোকটা কি অন্তর্যামী নাকি?’
মুখে কিছু না বলে সে সিগারেটের কেসটা লোকটার দিকে বাড়িয়ে ধরে। লোকটা মাথা নেড়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বলে, ” না, আমি স্মোক করি না”।
অগত্যা অতনু একাই একটা সিগারেট ধরিয়ে অন্য প্রসঙ্গ টানে।
জিজ্ঞেস করল, ” মশাইয়ের কি করা হয়?”
লোকটি কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে অদ্ভুত গলায় বলে, “…..আপনারই মতো একটা ট্যুরের চাকরী আমি করতাম”।
অতনু মনে মনে ভাবে, হয় লোকটা অভদ্র আর নয়তো খুবই কম কথার মানুষ। আর একটা জিনিস লক্ষ্য করে তার অদ্ভুত লাগল, লোকটা তার ভেজা বর্ষাতিটা খোলার কোনও নামগন্ধই করছে না। ধড়াচূড়ো পরে ঠায় সিটে বসে একদৃষ্টে অতনুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অতনুর কেমন যেন অস্বস্তি লাগল, একটু গা ছমছমও করল। ওদিকে বাইরে দুর্যোগ জাঁকিয়ে এসেছে আর ট্রেনটাও চলতে শুরু করেছে। চা খাওয়া শেষ করে অতনু টান টান হয়ে নিজের সিটে শুয়ে পড়ে। ভাবে, যদি একটু ঘুমোন যায়। বাইরের জলো হাওয়াটা তার বেশ ভালই লাগছিল। হয়তো একটু তন্দ্রা এসেছিল, হঠাৎ অতনুর ঘুমটা ভেঙে যায়। তার মনে হল, কুপের ভেতরটা হঠাৎ কিরকম অস্বাভাবিক রকম ঠাণ্ডা হয়ে উঠেছে। চমকে পাশ ফিরে দেখে, সেই লোকটি তার সিটে বসে একইভাবে পাথরের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অতনুর প্রচণ্ড অস্বস্তি হতে হতে লাগল। এই ভাবটা কাটাতে সে লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি শোবেন কখন? ”
লোকটি সেই একরকম ফ্যাসফ্যাসে গলায় কিরকম রহস্যপূর্ণ ভাবে বলল, ” তার দরকার নেই, আমি এভাবেই বসে থাকব”।
এ কথাটায় অতনু বিষম আশ্চর্য হল। এর মানে? লোকটা এভাবেই বসে থাকবে মানে!! ওর কি ঘুম-টুম নেই! কি বলে লোকটা! তার মনে হল, লোকটার নিশ্চয় মাথায় ছিট আছে। আর নয়তো…..কোনও বদলোক নয় তো? হয়তো তার ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষায় আছে। সে ঘুমিয়ে পড়লেই লোকটা খারাপ কিছু করার মতলবে আছে……! ট্রেনের গার্ডকে ডেকে তার আশঙ্কার কথা জানাবে নাকি! কিন্তু পরক্ষনেই তার মনে হল, এখনো তো লোকটার দিক থেকে খারাপ কোনও ব্যবহার সে পায়নি, কাজেই গার্ড ডেকেও কোনও লাভ হবে না। কারোর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ করলে, তার স্বপক্ষে প্রমাণও দেখাতে হয়, নইলে সেই অভিযোগ ধোপে টেকে না।
অতনু আর কিছু বলল না। সে বেশ বুঝতে পারছে, এই অদ্ভুত লোকটার কারণে আজ রাতে সে আর দু’চোখের পাতা এক করতে পারবে না। তাই সে পাশ ফিরে ঘুমোনর ভান করতে চেষ্টা করল। কিন্তু কখন যে ওর অজান্তে তার দু’চোখে ঘুম নেমে এল, নিজেও টের পেল না।
ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল বরফের মতো একটা ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শে। ঘুমের ঘোরে অতনু টের পেল, একটা বরফঠান্ডা হাত তার বাঁ হাতের কবজি ধরে টানাটানি করছে। ধড়মড় করে জেগে গিয়ে লাফিয়ে উঠে বসতেই কুপের অল্প আলোয় যা দৃশ্য চোখে পড়ল, তাতে তার নার্ভাস ব্রেকডাউন হবার যোগাড় হল।
অতনু দেখল, তার বিপরীত দিকের সিটে সেই লোকটা একইভাবে বসে কিন্তু তার গলার মাঝখানটা কেটে দু-খানা হয়ে গেছে আর সেখান থেকে গলগল করে টাটকা লাল তাজা রক্ত বেরিয়ে কুপটা ভরে উঠেছে। অতনু যেদিকেই তাকায়, সেদিকেই দেখতে পায়, তাজা লাল রক্ত থৈথৈ করছে! ভয়ে, আতঙ্কে তার গলা দিয়ে কোনও স্বর বের হয় না। উঠে যে কুপের বড় আলোটা জ্বালাবে, সেই শক্তিও সে হারিয়ে ফেলেছে। কোনওমতে গোঙাতে গোঙাতে সে একবার শুধু বলতে পারল – ” খুন! খুন!”
হঠাৎ কুপের দরজায় বাইরে থেকে কিছু লোকের দরজা ধাক্কানোর শব্দ শুনতে পেল অতনু। দেহের সমস্ত শক্তি জড়ো করে সে কোনওরকমে উঠে দরজার বোল্টটা কোনমতে খুলেই আর নিজেকে সামলাতে পারল না। সে হয়ত কামরার মেঝেতে পড়েই যেত কিন্তু তৎপর হাতে ট্রেনের কর্তব্যরত গার্ড তাকে ধরে ফেলল এবং সিটে শুইয়ে দিল।
জ্ঞান ফিরলে অতনু দেখল, কুপের মধ্যে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। সেই লোকটি বা রক্তের কোনও চিহ্ন কোথাও নেই। কোনওমতে হাঁফাতে হাঁফাতে সে গার্ডকে পুরো ঘটনাটার বিবরণ দিল। সব শুনে উপস্থিত অন্যান্য যাত্রীরা তো হতবাক। কিন্তু গার্ড মাথা নেড়ে বলল, ” আপনি ঠিকই দেখেছেন। এই দৃশ্য এই কুপে এর আগেও কয়েকজন দেখেছেন। আজ থেকে দু’বছর আগে এই ট্রেনে এবং এই কুপেই এক ভদ্রলোক দিল্লি যাচ্ছিলেন অফিসের কাজে। তার সঙ্গের ব্যাগে প্রচুর টাকা ছিল। তারই এক সহযাত্রী কিভাবে যেন তা জানতে পেরে যায় এবং মাঝরাতে ভদ্রলোককে ওইভাবে গলা কেটে খুন করে, তাঁর টাকার ব্যাগটি নিয়ে উধাও হয়ে যায়। আজও সেই খুনের কিনারা হয়নি। সে রাতটাও আজকের মতো এমন দুর্যোগপূর্ণ ছিল। তাই এই তারিখে ঝড়জল হলেই সেই মৃত ভদ্রলোক ফিরে আসেন তাঁর সহযাত্রীদের নিজের হত্যাকান্ডটি দেখাতে।
গল্পের বিষয়:
ভৌতিক