হামিদ মিঞা কথা দিয়েছিল বিয়ের পর লাকি বেগমকে নিয়ে এমন একটা বাসায় উঠবে যেখানে অন্য মানুষের সাথে টয়লেট বা রান্নাঘর ভাগাভাগি করতে হয় না। আলফা ফ্যাশন গার্মেন্টস এর ফ্লোর সুপারভাইজার হামিদ প্রেমে পড়ে িছ ল শিক্ষানবীস লাকি বেগমের।
গরীবের ঘরে এমন অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়ে জন্ম নিতে পারে তা লাকিকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। লাকির বাবা-মা নেই, চাচার বাসায় থেকে কাজ করে। একদিন ধমক দিয়েছিল হামিদ বেমাক্কা। তার পর এক অপ্রত্যাশিত চোখ ভাসানো ভেউভেউ কান্না। সেদিনই হামিদ সিদ্ধান্ত নেয় এই মেয়েকে জীবনে আর কখনো কষ্ট দেবে না। তারপর মেয়েটিকে বিয়ে করা। গত পরশু লাকির চাচার বাসায় সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জোড় বেঁধে গেল হামিদ-লাকির। লাকির আত্নীয়-স্বজনরা তাড়াহুড়ো করছিল, বলছিল শুভ কাজে দেরী করতে নেই। তো সেই হুড়োহুড়ীতে লাকির বিয়েটা অনেকটা অগ্রিমই হয়ে গেল যেন। বিয়ের দিনক্ষণ যখন পাকা তখন হামিদ হণ্যে হয়ে ঘুরছে একটা সুবিধাজনক বাড়ী খুজে পেতে। পরিচিত লোকজনদের অনুরোধ করেছে তেমন সন্ধান পেলে হামিদকে জানাতে। এভাবেই সন্ধান পেয়ে গেল আলেখা লজ নামের বাড়ীটির। গাজীপুরে এমন বাড়ী রয়েছে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। কোন ব্রিটিশ আমলে বানানো বাড়ী।
মূল মালিকের খোঁজ নেই, নানান হাত বদল হয়ে বর্তমান মালিকের হাতে এসেছে। মালিক ঢাকায় থাকে, কেয়ারটেকার আহাম্মদ আলীর হাতে বাড়ীর দেখভালের দায়িত্ব। লাকিকে নিয়ে আজ সকালেই নতুন বাড়ীতে উঠেছে হামিদ। বিয়ে উপলক্ষ্যে তিনদিন ছুটি পেয়েছিল। আজ তার শেষ দিন। হামিদ ব্যাগ, রংচটা সুটকেস আর টিনের ট্রাঙ্কটা রিক্সা থেকে নামিয়ে সেই রিক্সা নিয়েই ছুটল বাজারের দিকে। সাথে লাকি। আনন্দ আর ধরে না। আজ প্রথম বৌয়ের হাতের রান্না খাবে হামিদ। তাই বেশ ক’টা টাকা বেরিয়ে গেলেও মাঝারী একটা ইলিশ মাছ কিনে ফেলে সে, সাথে তাজা পুঁই পাতা। চাল, আলু, পেয়াজ আর সরিষার তেলে চলে গেল আরো,বেশ কিছু টাকা। হামিদের পকেটের স্বাস্থ্য তখন বেশ ক্ষীণ। তবু মনে আনন্দের জোয়ার, সুন্দরী নতুন বউ ঘরে, তার জন্য রান্না করবে, তাকে আদর করে ঘুম পাড়াবে! ভরপেট রাতের রান্না খেয়ে শোয়ার আয়োজন করছে হামিদ দম্পতি। কাল সকালে আবার কাজে লেগে পড়তে হবে। ঘুম থেকে উঠতে হবে সুর্য্য উঠার সাথে। তাই হামিদ যখন আধশোয়া হয়ে বিছানায় কম্পমান অপেক্ষায় তখন দেরী না করে আরো কিছু গোপনীয়তার আশায় লাকি উঠে গেল রাস্তার পাশের জানালাটি সাঁটিয়ে দিতে। রাস্তাটি এরই মধ্যে বেশ নির্জন হয়ে গেছে। এমনিতে এই বাড়ীর ত্রিসীমানায় অন্য কোন বাড়ী নেই তার উপর ঘর গোছাতে গোছাতে রাত প্রায় সাড়ে দশটা। লাকি আলগোছে দৃষ্টিপাত করে রাস্তার পরে। হঠাৎ বুকের মধ্যে ধক্ব করে ওঠে তার। কেপেঁ ওঠে সারা শরীর। একটা খনখনে বুড়ি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। পরনে সাদা শাড়ী, বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে আছে সামনের দিকে। চোখের দৃষ্টিতে শত জন্মের বিতৃষ্ণা আর ঘৃণা। চোখ নয়, যেন দুটো চকচকে রৌপ মুদ্রা বসানো অক্ষি কোটরে। গা শিরশির করে উঠে লাকির। মনের কোণায় বাসা বাধে গুমোট একটা ভয়ের অনুভূতি। তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে বিছানায় উঠে আসে সে। নিজ সংসারে বাতি নেভানো প্রথম সোহাগের সময় কেমন একটা নিস্পৃহ শীতলতা গ্রাস করে লাকিকে।
সে রাতে ভাল ঘুম হলো না লাকির। অবচেতন মনের কোনে ভেসে ভেসে আসে বুড়ী ঘৃণা মাখানো তীব্র দৃষ্টি। ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্নে দেখলো বুড়ী তাকে আঙ্গুল তুলে শাসাচ্ছে আর অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করছে, অস্বস্তি নিয়ে ঘুম ভাঙ্গে লাকির। ভোরে ভোরেই হামিদ মিঞা কাজে গিয়েছে। পান্তা ভাত, কাঁচা পিঁয়াজ আর বাসী তরকারীর ঝোলই ছিল নাস্তা। যদিও ইচ্ছে ছিল পরোটা- আলু ভাজি করার কিন্তু গত রাতের অস্বস্তি হেতু অনিদ্রার কারনে লাকিকে এগুতে দিল না। বিয়েতে উপহার পাওয়া একটা নতুন সুতির শাড়ী নিয়ে গোসলখানায় ঢোকে লাকি। গোসলখানাটি বাড়ীর বাহিরের দিকে। শ্যাওলা পড়া পুরানো পাঁচিল, টিনের দুমড়ানো দরজা। সকালের আলো ফুটে উঠছে তখন। ধীরে ধীরে নিরাভরণ হয় লাকি, শরীরের আনাচে কানাচে বইয়ে দেয় বরফ শীতল পানি। সদ্য মোড়ক খোলা সুগন্ধি সাবানের গন্ধে ম ম করছে পুরো গোসলখানা। ঠিক এমন সময় একটা অদ্ভুত অনুভূতি গ্রাস করে লাকিকে। মনে হচ্ছে কোন এক গোপন গবাক্ষপথে লাকির সুঢৌল গোলাপী দেহলতা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে কেউ। লজ্জা, ভয়, অস্বস্তি আর রাগে সারাদেহে চুমকুড়ি খেয়ে ওঠে সহসাই লোমকুপ গুলো। নিশ্চিত হওয়ার জন্য হঠাৎ টিনের দরজাটার হুড়কো খুলে বাহিরে চোখ বোলালো লাকি। দেখে নাহ্ কেউই নেই। আবেশ মুছে দ্রুত গোসল সেরে ঘরে ঢুকে পড়ে। চুল এলিয়ে দিয়ে চালের কাঁকর বাছতে বসে লাকি। বিগত জীবনের কত স্মৃতি মনে উঁকি ঝুঁকি দেয়! আসলে মানুষের জীবনটা কত বিচিত্র। সে কোথায় ছিল আর এখন কোথায় এলো । ভাবতে ভাবতে একটু তন্দ্রা মত আসে, আটকে থাকা বাঁধ ভেঙ্গে কোথা থেকে যেন আছড়ে পড়ে এক রাশ ঘুম তার চোখের জমীনে।
একটু শীত শীতও লেগে উঠে। দু’চার বার ঝিমিয়ে চালের থালার উপর পড়তে গিয়ে লাকি চৌকিতে গিয়ে উঠে। ঘুমিয়ে নিতে হবে খানিকটা ক্ষণ। বেহেড মাতালের মত অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে পড়ে সে। কত সময় পেরিয়ে গেল, লাকির ঘুম অশান্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। মনে হয় কোন অন্ধ জগতে আটকে গেছে তার আত্না। শরীরে আর ফেরত আসতে পারছে না। নিঃশ্বাসে বদ্ধ বদ্ধ ভাব আর অনিয়মিত হৃদস্পন্দন। গলাটাও শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। হঠাৎ বোধ হলো তার নাকে, চোখে, মুখে অস্বস্তিকর সুড়সুড়ি লাগছে। মুখটাকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে অস্বস্তি থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা করে সে। কিন্তু ক্রমশ বাড়তে থাকে তা। ঝট করে চোখ মেলে লাকি। ঠিক একফুট উপরে সমান্তরাল ভাবে শুণ্যে ভেসে আছে একটা বুড়ি। ঘোলা চোখে তীব্রভাবে লাকির দিকে তাকিয়ে আছে সে। অন্তরাত্তা ছিটকে বেরিয়ে আসতে চায় লাকির, মুখ দিয়ে গোঙ্গানীর শব্দ বের হয় তবুও নড়তে পারে না একচুলও। হঠাৎ একটা বুকভাঙ্গা আত্নচিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে লাকি। সাথে সাথে ঘোর ভাঙ্গে যেন। দেখে কেউই নেই ঘরে। সারা শরীর ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। ছাতিফাটা তৃষ্ণায় শুষ্ক হয়ে আছে কন্ঠনালী। টলতে টলতে উঠে বসে লাকি। হাফ টাইম শেষে দুপুরে খাবার খেতে বাসায় আসছিল হামিদ মিঞা। দূর থেকে টিনের গেটটা হাট করে খোলা দেখে বিরক্ত বোধ করে সে। যাওয়ার সময় লাকিকে বারবার বলে গেছে নতুন এলাকা তাই সামনের গেটটা বন্ধ রাখতে।
এই সময় হঠাৎ দেখে ভেতর থেকে শশব্যস্ত হয়ে বের হয়ে আসে এক বুড়ি। মুখে কাপড় চাঁপা দিয়ে ব্যস্ত পায়ে ঢুকে গেল পাশের গলিতে। উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা নিয়ে দ্রুত পায়ে বাড়ি ঢুকলো হামিদ মিঞা। চৌকিতে বসে আছে লাকি। মানুষের সাড়া পেয়ে ম্যাও করে হাড়ি পাতিল উল্টে পালিয়ে গেল একটা কালো বিড়াল। কাছে গিয়ে জোরে কয়েক বার ঝাকি দেয়ার পর ধীরে ধীরে মুখ তুলে চাইলো লাকি। স্বামীকে দেখে ঝাপিয়ে কান্না এলো তার দুচোখে। নাহ্, হামিদ মিঞা বিশ্বাস করলো না লাকির কথা। ঘুরে ফিরে শ্বান্তনা দিতে গিয়ে বলল দুঃস্বপ্ন দেখেছে সে। দিনে দুপুরে তার রুদ্ধঘরে কিভাবে ঢুকবে বুড়ি! আর বাতাসেই বা ভাসবে কিভাবে? লাকি যতই বলুক হামিদ শ্বান্তনা দেয় তাকে। বলে নতুন বাসা গোছানোর ক্লান্তিতে গভীর ঘুম হয়েছিল তার আর ঘুমের ঘোরে দেখেছিল দুঃস্বপ্ন। লাকির শারীরিক আর মানসিক অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নেয় যে আজ আর কাজে যাবে না। লোডশেডিং এ হারিকেনের টিমটিমে আলোতে রাতের খাবার খেতে বসে হামিদ আর লাকি। বিকেল থেকে লাকি ধীরে ধীরে সুস্থ্য হয়ে উঠে। আর কোন অসুবিধা হয়নি তার পর। বরং সন্ধ্যায় চা বানিয়ে আগুন গরম পুরি সিঙ্গারা দিয়ে খেয়েছিল দুই টোনাটুনি। আর গুটগুট করে গল্প করেছিল ভবিষ্যতের। খেতে বসে হামিদ ভাবে এক ফালি লেবু হলে ভাল জমতো খাবারটা।
লাকি কে বলতেই রহস্যময় হাসি হেসে উঠে গেল সে। একমনে খাচ্ছিল হামিদ মিঞা। হঠাৎ সামনের দেয়ালে ঝিকমিক করে উঠলো ধাতব প্রতিফলন। তড়িৎ গতিতে পেছনে ফিরে পাথরের মত জমে গেল হামিদ। লাকি এক হাতে ছোরা উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে। হামিদের মাথার তালুর দিকে তাক করা। চোখে কোন কালো অংশ নেই, পুরোটাই সাদা। বন বন করে ঘুরছে চার পাশে। আরেক হাতে অর্ধ কাটা কাগজী লেবু থেকে ঝর ঝর করে গড়িয়ে পড়ছে তাজা রক্ত। লাকির হাতের তালু বরাবর ফালি ফালি গভীর ক্ষত। ‘লাকি’! বলে তীব্র কন্ঠে আর্তনাদ করে উঠে হামিদ। কা কা করে কর্কশ কন্ঠে ডেকে উঠে পাশের আমগাছে আশ্রয় নেয়া কয়েক শত কাক। নরক গুলজার শুরু হয়ে গেছে যেন চারপাশে। এবার বিস্ফোরিত চোখে হামিদ দেখে লাকির লম্বা চুলগুলো উপরে উঠে যাচ্ছে। সাথে সাথে লাকিও। চুল ধরে কেউ তাকে ঝুলিয়ে রেখেছে ছাদের সাথে। হঠাৎ হঠাৎ মুখের চামড়া কুঁচকে গিয়ে রূপ নিতে চায় কোন বিভৎস বুড়ির। যেন ভেতর থেকে জোর করে ফেঁড়ে ফুঁড়ে বের হতে চায় অন্য কোন স্বত্তা। এমনি সময় কোথা থেকে এক বুক সাহস এসে ভর করলো হামিদ মিঞার কলিজায়। লাকির প্রতি স্নেহে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল মন। এক লাফে চৌকির উপর দাঁড়িয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে লাকির হাটু ধরে নীচের দিকে টান দিল সে।
নারিকেল গাছের মৃত শাখার মত ঝুপ করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো লাকি। জ্ঞানহীন। ফস করে শাড়ির আঁচল ছিড়ে লাকির হাতের ক্ষত বাঁধলো হামিদ। তারপর তাকে পাঁজাকোলে তুলে ছুট দিল বাহিরে। আপাততঃ কোন হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ভর্তি করতে হবে তাকে। মালপত্র যা আছে পড়ে থাক, এই সর্বনাশা অভিশপ্ত বাড়িতে আর এক মুহূর্তও নয়। মানুষের জীবন বাঁচলে তবেই তো মাল পত্র! উদ্ধশ্বাসে হামিদ ছুটতে থাকে সদর রাস্তা ধরে। অন্ধকার ফুঁড়ে আঁধার গলি থেকে বের হয়ে এলো এক বুড়ি। নাক উচিয়ে এদিক ওদিক কি যেন শুকলো বাতাসে। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিল রক্তে ভেজা এক টুকরো শাড়রি আঁচল। কুচকুচে কালো আর সরু জিভ বের করে একটু চাটলো সেটা। মুখের মধ্যে টাস টাস করে শব্দ করলো দুবার। কোমরে গুঁজে নিল টুকরোটি। তারপর চাপা কন্ঠে খল খল করে হাসতে হাসতে স্বাগোক্তি করলো ‘যাবি কই’! আবারো অন্ধ গলিতে ঢুকে গেলো বুড়িটা।