ব্ৰহ্মডাঙার মাঠ

ব্ৰহ্মডাঙার মাঠ

যে সময়কার কথা বলছি তখন আমার বয়স চোদ-পনেরোর বেশি নয়। মাকড়দার কাছেই আছে ঝাঁপড়দা। নামটা শুনলেই তখন হাসি পেত। তা সেই ঝাঁপড়দাতে আমাদের এক বন্ধু ছিল, তার নাম ক্যাবা। ক্যাবলাকান্ত থেকে ক্যাবা কিনা জানি না, ওই নামেই তাকে ডাকত সবাই । তা সেই বন্ধুটি বেঙড়পাড়ায় মুড়িউলি মাসির বাড়িতে আসত বলেই তার সঙ্গে আমার এবং আমার বন্ধুদের পরিচয়।
সে যাই হোক, একদিন ক্যাবা আমাদের ধরে বসল দু-একদিনের জন্য ওদের গ্রামে যেতে হবে। ওর এই আমন্ত্রণে আমরা কেউ না করলাম না। গোরা, আমি আর পল্টন তিনজনেই লাফিয়ে উঠলাম। যেহেতু মুড়িউলি মাসির বোনপো, তাই বাড়িতেও কেউ এই যাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি করল না। মুড়িউলি মাসির বাড়ি নার্নায়। ক্যাবাদের দক্ষিণ ঝাঁপড়দায়। আমাদের হাওড়া শহর থেকে জায়গাটার দূরত্বও বেশি নয়।
একদিন সকালে ক্যাবার সঙ্গেই আমরা চললাম ওদের দেশে। তখন হাওড়া ময়দান থেকে মার্টিন কোম্পানির ট্রেন চালু ছিল। সেই ট্রেনে চেপে আমরা ঘণ্টা দেড়েকের জার্নির পর ডোমজুড়ে এসে নামলাম।
ডোমজুড় তখন এত উন্নত ছিল না। চারদিকে মাটির অথবা ছিটেবেড়ার ঘর এবং বন জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। এইখান থেকে দক্ষিণ ঝাঁপড়দা হয়ে একটি বনপথ সোজা চলে গেছে নানার দিকে। নার্নার পঞ্চানন্দ হলেন অত্যন্ত জাগ্রত।
যাই হোক, সেই পথ ধরে একসময় শ্মশান পার হয়ে একটি গ্রামে এসে পৌঁছলাম আমরা। সেইখানে অনেক সুপ্রাচীন বট ও অশ্বত্থের সমারোহ দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। তারই মাঝে বহুদিনের পুরনো একটি ভগ্নদশাপ্রাপ্ত বাড়িতে এসে ঢুকলাম আমরা।
ক্যাবা বলল, “এই আমাদের বাড়ি।” বাড়ির চেহারা দেখে বুক শুকিয়ে গেল। এ তো ভূতের বাড়ি। এই বাড়িতে কোনও মানুষ বাস করে? বাড়ির ইটগুলো সব নোনা লেগে ঝরে পড়ছে। কোথাও জোরে একটু শব্দ হলেও বোধ হয় ভেঙে পড়বে বাড়িটা। এই বাড়ির দোতলার একটি ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল।
সব দেখেশুনে গোরা বলল, “খুব জোর একটা রাত, তার বেশি নয়। কাল সকাল হলেই পালাব আমি।”
পল্টন বলল, “এ নির্ঘাত ভূতুড়ে বাড়ি। আজ রাতে ভূত এসে যদি আমাদের গলা টিপে না মারে তো কী বলেছি।”
আমি বললাম, “তার চেয়েও বেশি ভয় হচ্ছে আমার সাপ অথবা বিছের।” যে ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল সেই ঘরে সাবেক কালের একটা পুরনো পালিশ ওঠা ভাঙা খাট ছিল। তাতে ছিল দুর্গন্ধযুক্ত তেলচিটে বালিশ আর চটের ওপর ছেড়া কাঁথা বিছানো গদি। এই বিছানায় শুতে হবে ভেবেও গা যেন ঘুলিয়ে উঠল।
একটু পরে ক্যাবা আমাদের নীচে নিয়ে গিয়ে ওর বাবা-মা’র সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। ওঁরা সবাই খুব খুশি হলেন আমাদের দেখে। ক্যাবার মা বললেন, “গরিবের বাড়িতে কেউ তো আসে না বাবা, তোমরা এসেছ বলে খুব আনন্দ হচ্ছে আমার। আমাদের ঘরদোর ভাল নয়, বিছানাপত্তর ভাল নেই। খুব কষ্ট হবে তোমাদের।”
ক্যাবার মায়ের আন্তরিকতাপূর্ণ কথা শুনে মন ভরে গেল আমাদের। সত্যিই স্নেহময়ী জননী তিনি। বললাম, “তাতে কী ? ও আমরা ঠিক মানিয়ে নেব।”
ক্যাবার মা বললেন, “যাও, কুয়োতলায় গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে এসো। আমি তোমাদের জলখাবারের ব্যবস্থা করি।”
আমরা ক্যাবার সঙ্গে কুয়োতলায় গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে নিলাম। ও দড়ি-বালতি নিয়ে জল তুলে দিতে লাগল। আমরাও জল খরচ করতে লাগলাম। তারপর গামছায় মুখ-হাত মুছে ঘরে আসতেই ক্যাবার মা আমাদের প্রত্যেককে মেঝেয় আসন পেতে বসিয়ে গরম গরম লুচি, আলুভাজা, বোদে আর পানতুয়া খেতে দিলেন। খুব তৃপ্তির সঙ্গে আমরা খেয়ে নিলাম সেগুলো ।
খাওয়াদাওয়া হলে আমরা ক্যাবার সঙ্গে গ্রামের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। এখানে এত ঘন ও বড় বড় গাছ চারদিকে যে, মনে হল এর পত্রছায়া ভেদ করে সূর্যের আলো বোধ হয় কারও ঘরে কখনও ঢোকে না। দিনমানেও তাই অন্ধকার।
যাই হোক, এইভাবে আমরা সারা গ্রাম তোলপাড় করে একসময় স্টেশনের দিকে এগোলাম ।
এখানটা তবু জমজমাট। চাঁপাডাঙার দিকে যাওয়ার জন্য একটি ট্রেন তখন তার দেশলাই খোলের মতো শরীর নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। আমরা যাওয়ার পরই হুইসল দিয়ে নড়ে উঠল ট্রেনটা। আর তার একটু পরেই চারদিক থেকে রব উঠল, গেল-গেল-গেল।
কী ব্যাপার? না, স্টেশন থেকে বেরিয়ে দক্ষিণবাড়ির মাঠের দিকে যেতে গিয়ে একটা ছাগলকে চাপা দিয়ে উলটে গেছে ট্রেনটা।
আমনই ছোট-– ছোট— ছোট।
অনেক লোকের সঙ্গে আমরাও ছুটলাম। কতকগুলো লোক ট্রেনের মাথায় বসে ঠ্যাং ছড়িয়ে বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে যাচ্ছিল, তাদেরই অনেকে ছিটকে ছুটকে পড়ায় লেগেছে খুব। বাকি যারা, তারা ট্রেনের কামরা থেকে সামান্য আঘাত পেয়ে বেরিয়ে এসে দড়ি বাঁশ ইত্যাদি নিয়ে চেষ্টা করছে আবার কামরাগুলোকে লাইনের ওপর তুলে বসানোর জন্য। একটা বোকা পাঠা এমনভাবে কাটা পড়েছে যে, তার ধড় একদিকে মুণ্ডু আর একদিকে হয়ে গেছে।
যাই হোক, প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের চেষ্টায় কাত হওয়া দু-তিনটে বগিকে ঠিকভাবে বসানো হল।
আবার নড়ে উঠল ট্রেন। আমরাও বিদায় নিলাম। দুপুরবেলা স্নানপর্ব শেষ হলে মধ্যাহ্নভোজন। কাসার থালায় মোটা চালের ভাত। বড় জামবাটিতে করে পেয়াজ দিয়ে মুসুর ডাল। এছাড়া শাকভাজা, আলুভাজা, ঢ্যাঁড়সভাজী। পোস্তর চচ্চড়ি, শোলমাছের ঝোল আর আমের চাটনি তো ছিলই সময়টা তখন গরমের দিন। বৈশাখ মাস।
আমরা বেশ পরিতৃপ্তির সঙ্গে খাওয়াদাওয়া সেরে সুপুরি এলাচ মুখে দিয়ে ওপরের ঘরে শুতে এলাম। এতক্ষণে কিন্তু পরিবেশটা আমরা মানিয়ে নিতে পেরেছি। খাটে না শুয়ে ঘরের মেঝেয় মাদুর পেতেই আমরা শুয়ে পড়েছি। শুয়ে শুয়ে কত গল্পই না হল আমাদের! বেশি গল্প করতে লাগলাম ট্রেন ওলটানোর ওই ব্যাপারটা নিয়ে। ভাগ্যে বগিগুলো সব কাত হয়েছিল, না হলে কেউ না কেউ মরতই।
পল্টন বলল, “রেল দুর্ঘটনায় মরলেই লোকগুলো সব ভূত হত।”
গোরা বলল, “তা কেন হবে ? ওরা হত কন্ধকাটা।”
আমি বললাম, “বা রে! কন্ধকাটা বুঝি ভূত নয়?”
ক্যাবা বলল, “যতক্ষণ না কেউ নিজে থেকে রেললাইনে মাথা দিয়ে গলা না কাটাবে ততক্ষণে সে কন্ধকাটা হবে না।
তবে অপঘাতে মরলে অন্য ভূত সে হবেই।”
আমাদের যখন এইরকম সব আলোচনা হচ্ছে তখন হঠাৎই নাদাপেটা কদমছাঁটা একটা ছেলে এসে ক্যাবাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে চুপিচুপি ফিসফিস করে কী যেন বলল।
শুনেই তো লাফিয়ে উঠল ক্যাবা। বলল, “দারুণ হবে রে! কোথায় করবি ? ব্রহ্মডাঙার মাঠে ? তবে আর দেরি কেন? জোগাড়যন্তর কর সব।”
ছেলেটা চলে যেতেই ক্যাবা এসে বলল, “আজ রাতে একটা জোর পিকনিক হবে আমাদের। খালধারে ব্রহ্মডাঙার মাঠে। তোরাও থাকবি।”
পল্টন বলল, “বলিস কী রে! তা মেনুটা কী শুনি?”
“গরম ভাত, পাঁঠার মাংস আর আমের চাটনি।”
গোরা বলল, “চাঁদা কত করে? পাঠার তো অনেক দাম।”
ক্যাবা বলল, “তেল-নুনটা ঘর থেকেই জোগাড় হয়ে যাবে। চালেরও অভাব হবে না। আমও আছে গাছের ডালে, দু-চারটে পেড়ে নিলেই হবে। কিনতে হবে শুধু গুড়, চিনিটা। মাংসটা তো ফাউ। অর্থাৎ কিনা তখনকার সেই কাটা পড়া পাঠাটাই হবে আজ রাতে আমাদের খোরাক। আমার বন্ধু ওই হেবোটা সবার নজর এড়িয়ে সরিয়ে নিয়ে এসেছে পাঁঠাটাকে। অমন নধর পাঠা সচরাচর পাওয়া যায় না। সত্যি, ভোজটা যা হবে না!”
ক্যাবার কথায় গোরা, পল্টন উৎসাহিত হলেও আমার মন কিন্তু সায় দিল না। বললাম, “দ্যাখ, খাওয়ার জন্য একটা পাঠাকে যদি কাটা হয় বা ঠাকুর দেবতার থানে বলি দেওয়া হয়, সে আলাদা কথা। কিন্তু রেলে কাটা পড়া বা অন্য কোনওভাবে অপঘাতে মরা কোনও প্রাণীর দেহ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ না করাই ভাল।”
ক্যাবা বলল, “দুর বোকা, কেটে খাওয়া আর রেলে কাটা পড়া একই ব্যাপার হল। কিছুই হবে না ওতে। চল তো !”
আমার গা ঘিনঘিন করলে কী হবে, গোরা আর পল্টনের দেখলাম উৎসাহ খুব। অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতেই হল ওদের সঙ্গে।
ব্ৰহ্মডাঙার মাঠে তখন হেবো ছাড়াও আরও দু-তিনজন জড়ো হয়েছে। সবাই মিলে একটা গাছের ডালে পাঠাটাকে ঝুলিয়ে তার ছাল-চামড়া ছাড়াতে লেগে গেছে।
এই করতে-করতেই বেলা কাবার। সন্ধেবেলা মাঠে গর্ত করে সেই গর্তের মুখে ইট বসিয়ে উনুন তৈরি করা হল। তারপর শুকনো ডালপাল জোগাড় করে তাই জ্বাল দিয়ে শুরু হল রান্নাবান্না। দেখতে দেখতে আমরা প্রায় দশ-বারোজন হয়ে গেলাম। আমের চাটনি, ভাত আগেই তৈরি হয়েছিল। গরম গরম মাংস রান্না হলেই শুরু হবে খাওয়াদাওয়া। কুমোরদের বাড়ি থেকে কিছু মাটির গেলাস চেয়ে আনা হয়েছিল। একটা বালতিতে করে নিয়ে আসা হয়েছিল এক বালতি জল। ক্যাবা একটা কলাগাছ থেকে কতকগুলো পাতা কেটে এনেছিল। সবই ঠিক ছিল। কিন্তু সবকিছুই ওলটপালট হয়ে গেল খেতে বসবার সময়।
গরম মাংসর হাঁড়ি উনুন থেকে যেই না নামানো আমনই শুনতে পেলাম, “ব্য-ব্যা-ব্যা।” চমকে উঠলাম সবাই, এত রাতে ব্ৰহ্মডাঙার মাঠে কাদের ছাগল ডাকে? যেমন-তেমন ডাক নয়, অস্তিমের ডাক বলির আগে পাঠারা যেভাবে ডাকে, ঠিক সেইরকম। আর তারপরই মনে হল, মাঠময় কী যেন ছুটে বেড়াচ্ছে।
একটু পরেই হঠাৎ একটা ঢিপ করে শব্দ। যেন ভারী কিছু একটা লাফিয়ে পড়ল গাছের ডাল থেকে। আমাদের সঙ্গে দুটো হ্যারিকেন ছিল। সে দুটোও নিভে গেল দপদপিয়ে। আর সেই অন্ধকারে আমরা দেখতে পেলাম কিম্ভূতকিমাকার একটা মূর্তি লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রান্না হওয়া সেই মাংসর হাঁড়িটার দিকে।
আমরা তখন আর আমাদের মধ্যে নেই। বাবা রে মা রে করে যে যেদিকে পারলাম পালালাম। ক্যাবা, আমি, গোরা আর পল্টন এক ছুটে ওদের বাড়িতে।
ক্যাবার মা তো সব শুনে খুব বকলেন ক্যাবাকে। বললেন, “বলিহারি রুচি তোদের! অপঘাতে মরা কোনও প্রাণিদেহর মাংস কেউ খায় ? তার ওপরে ভর সন্ধেবেলা তোরা গেছিস ব্রহ্মডাঙার মাঠে। ওটা যে একটা দোষান্ত মাঠ তা বুঝি ভুলে গিয়েছিস ?”
আমরা সবাই মাথা হেঁট করে বকুনি হজম করলাম। যাই হোক, সে রাতে মাংস-ভাতের বদলে দুধ-ভাত খেয়েই শুতে গেলাম আমরা। পরদিন সকাল হতেই আমরা বাড়ির দিকে রওনা হলাম।
পরে—অনেক পরে ক্যাবার মুখে শুনেছি, একটা মুণ্ডহীন ছাগলকে প্রায়দিনই সন্ধের পর রেললাইনের ধারে অথবা ব্ৰহ্মডাঙার আশেপাশে তার ছায়াশরীর নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। সে কারও ক্ষতি করে না, ভয় দেখায় না, ডাকেও না। শুধু দেখা দেয় আর মিলিয়ে যায়। তবে আমরা কিন্তু আর কখনও ও-মুখো হইনি।
……………………………………………….(সমাপ্ত)……………………………………………..

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত