কাপাসিয়া গ্রাম। সুজলা-সুফলা, শস্য শ্যামলা গ্রামটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। এই গ্রামেরই প্রাথমিক স্কুলের প্রাথমিক বাংলা শিক্ষক মনির রশিদ। মা আর ছোট বোন খুশী ছাড়া এই জগতে ওর আর কেউ নেই। বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। অনেক সংগ্রাম, অনেক কষ্ট করে বি.এ. টা পাশ করেছে মনির কিন্তু আর পড়ার সামর্থ্য হয়নি। আজকাল আর এত মামুলি বিদ্যায় ভাল চাকরী পাওয়া সম্ভব নয়। অনেক তদ্বির করে অবশেষে স্কুলের এই কাজটি পেয়েছে সে।
নরসিংদীর বেলাবোতে মনিরদের আদি ভিটা….কিন্তু এখন আর ওখানে কিছুই নেই। সহায়সম্বল যতটুকু যা ছিল, সব বিক্রি করে চিরকালের মতো গ্রামের পাট চুকিয়ে শহরে চলে এসেছিল। তারপরের জীবন তো একটা সংগ্রাম…..জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। মা সেলাই করেছেন, খুশী তার মাধ্যমিক পাশের বিদ্যে নিয়ে টিউশনি করেছে। সবাই মিলে চেষ্টা করেছে সংসার সমুদ্রটাকে পাড়ি দিতে কিন্তু যন্ত্রণার এই অথৈ সমুদ্রের যে কোনও কূলকিনারা নেই!
এক বন্ধুর সুপারিশে মনির এই স্কুলের চাকরীটা পায়। এই কাজটা পেয়ে সংসারে যে খুব সুবিধা, স্বচ্ছলতা এসেছে তা নয়….কিন্তু সংসারের নিত্য নেই-নেই, হায়-হায় রবটা কেটেছে।
গ্রামের প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষকদের থাকার ব্যবস্থা এই গ্রামেই আছে, কিন্তু মনির যেহেতু বাইরে থেকে এসেছে সুতরাং তার থাকার কোনও ব্যবস্থা করা হয় নি। আপাতত তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে গ্রামের একপাশে বাঁশ, খড় আর মাটি দিয়ে তৈরি ছোট একটা ঘরে। খুব অল্প জায়গার ওপর ঘরটা তাড়াহুড়ো করে তৈরি করা হয়েছে। সামনেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা একচিলতে রান্নাঘর। আশেপাশে কয়েকটা বেল, আম, পেয়ারা এবং কলার গাছ আর একটু দূরেই খুব ঝোপালো একটা বাঁশঝাড়…. এই বাঁশঝাড়ের কাছেই গোসলের ব্যবস্থা এবং টয়লেট। দীর্ঘদিন শহরে থাকতে অভ্যস্ত খুশীর ভালো লাগে না গ্রামে থাকতে…..বিশেষ করে বাথরুমের সমস্যা তার কাছে খুব ভীতিকর। সে এমনিই একটু ভীতু প্রকৃতির মেয়ে। দিনের বেলা যেমন তেমন, রাতের বেলা পারতপক্ষে খুশী বাথরুমে যায় না। গ্রামের মানুষ সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর সন্ধ্যে হতে না হতেই ঘুমিয়ে পড়ে। আসার সময় খুশী কিছু গল্পের বই এনেছিল, মায়ের পাশে শুয়ে সেগুলো পড়েই কাটিয়ে দেয়। মনির স্কুল ছুটির পর দু-চারটে টিউশনি করে বাড়ি ফেরে, স্বাভাবিকভাবেই তার আসতে একটু রাত হয়। মাকে আর জাগতে দেয় না খুশী… মনির ফিরলে তাকে খাইয়ে তবেই খুশী শুয়ে পড়ে। এই গ্রামে সাধারণত কোনও বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। অবস্থাপন্ন দু- চারজনের ঘরে টিভি থাকলেও সেখানে গিয়ে দেখার প্রশ্নই ওঠে না। মনিরদের ঘরে টিভি নেই, থাকলেও দেখা সম্ভব হত না, কারণ মনিরদের ঘরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই….হ্যারিকেনে কাজ চালাতে হয়। থাকার জায়গা নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকলেও আপাতত মনিরের করার কিছু ছিল না। স্কুল কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাইরে থেকে যেসব শিক্ষকরা আসবে, তাদের স্কুলের পাশের জমিতে বাসা তৈরি করে দেওয়া হবে। ততদিন পর্যন্ত যা হোক করে কাটাতে হবে। এক ঘরে মা- বোনের সাথ্র শুতে মনিরের বেশ সঙ্কোচই হয়, তবু এই ভেবে স্বান্তনা পায় যে অন্তত থাকার জন্য তাকে কোনও বাড়িভাড়া দিতে হয় না। এখানে জিনিসপত্রের দামও বেশ কম, যাতে ওর মতো নগন্য গ্রাম শিক্ষকের বেশ ভালোই কেটে যায়।
আস্তে আস্তে খুশী বর্তমান পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে থাকে……মনীরও ছুটির দিনে গ্রামের একমাত্র মুদির দোকানে গিয়ে বসে। সেখানে চায়ের ব্যবস্থা আছে, চা- পানের জন্য অনেকেই এসে বসে…. তখনই গল্প-স্বল্প হয়। মুখচোরা মনির কথা বলার চাইতে চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দেয় আর অন্যদের গল্প শোনে মনোযোগ দিয়ে। গ্রামের কয়েকজন বৃদ্ধ এই দোকানের নিয়মিত খদ্দের…..বসে বসে আড্ডা দেওয়া ছাড়া বিশেষ কিছুই করার নেই তাদের। কতরকম আজব কথাবার্তা শোনা যায় এই মুরুব্বিদের কাছ থেকে……এমনকি ভূতপ্রেতের প্রসঙ্গও বাদ যায় না। বলতে গেলে এটাই ওদের প্রথম এবং প্রধান বিষয়। কে কোন আমলে কি দেখেছিল, দেখে কতখানি ভয় পেয়েছিল, তার বিস্তারিত বর্ননা। এরা ভয়ও পায় আবার এই নিয়ে কথা বলা পছন্দও করে। এদের কথাবার্তা শুনে মনে মনে হাসে মনির। যুগ কোথায় এগিয়ে চলেছে আর এরা পড়ে আছে কোন আদিম আমলে!
একদিন একজন হঠাৎ মনিরকে প্রশ্ন করে, ” আচ্ছা, মাস্টার সাব, আপনি ওইহানে এতদিন আছেন, কিছু দেহেন নাই?” ” কি দেখব? কিসের কথা বলছেন?” অবাক হয়ে বলল মনির।
” না মানে, আপনারা যেইহানে থাহেন, জায়গাডা ভাল না। বহতদিন আগে এই গ্রামেরই এক মাইয়া ওই বেল গাছডার ডালে গলায় ফাঁস দিয়া মরছেল…….’
আরেকজন বলতে থাকে, ” অনেকেই দ্যাহে, ওই মাইয়াটা সাদা কাপড় পরে রাতের আঁধারে ওইহানে ঘুরিয়া বেড়ায়। ডরে আমরা কেহ রাতে ওইহানে যাই না।”
বিস্মিত মনির বলে, ” কই, আমরা তো কিছু দেখি নাই। আরে ওসব হল মনের কল্পনা, চোখের ভুল। বাস্তবে ওসবের কোনও অস্তিত্ব নেই।”
ওদের মধ্যে একজন তখন গম্ভীর ভাবে বলল, ” আপনে আমাডের কথাটা বিশ্বাস করিলেন না। তবু হেড মাস্টার সাবকে বলিয়া জায়গা বদল করেন। আর একটা কথা বলি নাই…..প্রতি অমাবস্যায় ওইহানে…….’
তার কথার মাঝেই ” আচ্ছা, আমার কাজ আছে” বলে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে মনির। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দেয় বাসার দিকে। সর্বনাশ, গ্রামের দু-একজন মেয়ের সাথে ভাব হয়েছে খুশীর। মার কাছেও প্রতিবেশী মহিলারা যাতায়াত শুরু করেছে। এসব ভয়াবহ খবর ভীতু বোনটির কানে যেতে বেশী দেরী লাগবে না। মুশকিল হল দেখি, আর রাত করে বাড়ি ফেরা যাবে না….কোনদিন ভয়টয় পাবে। জায়গায়া নিয়ে মা’রও খুঁতখুঁতানি আছে….তাঁর মতে বাঁশঝাড় আর বেল গাছ হচ্ছে ভূতেদের প্রিয় জায়গা। তিনিও এসব বিশ্বাস করেন বটে কিন্তু খুশীর মতো কাতর হয়ে থাকেন না ভয়ে। সেদিন দুপুরের পর থেকে আকাশে মেঘ জমেছে, এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছে, শেষে টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হল। খুশী মনিরকে বলে, ” ভাইয়া, আজ আর পড়াতে নাই বা গেলে।”
হাসে মনির। বোনের চুলটা টেনে দিয়ে বলে, ” কেন রে? তোর এত ভয় কিসের? মা তো থাকেনই তোর সাথে।”
সলজ্জ হাসে খুশী। বলে, ” মা তো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন। তখন গা- টা কেমন ছমছম করে। তুমি ভাইয়া বেশী রাত কোর না, জলদি চলে এসো। ” তাড়াতাড়ি আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মনির চলে গেল ছাত্র পড়াতে । রাতে ফিরে এসে যখন ভাই-বোনে একসাথে খেয়ে শুয়ে পড়ল, তখন বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে।
অনেক রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল মনিরের….টয়লেটে যাবে। বাইরে বেরিয়ে দেখল, বৃষ্টি কমে গেছে বটে, তবে একেবারে থামে নি, পড়ছে ঝিরঝির করে। মনির এগোতে যাবে, নজর গেল টয়লেটের দিকে। দেখে, কে একজন যেন টয়লেটে ঢুকল। অন্ধকারে বোঝা না গেলেও খুশী ছাড়া আর কে….অনুমান করে নিল মনির। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বেশ অবাকও হল। এই গভীর রাতে এই ভরা দূর্যোগে খুশী মাকে ছাড়া একা একা বাথরুমে ঢুকেছে! অন্যসময় তো, খুশী রাতে বাথরুমে গেলে মাকে রীতিমত হ্যারিকেন নিয়ে বাথরুমের দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মনে মনে খুশি হল মনির। যাক, খুশীর ভয়টা ভেঙেছে তাহলে। সে বাথরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল, খুশীর বেরোবার অপেক্ষায়। আশ্চর্য! খুশী সেই যে ঢুকেছে আর বেরোবার নামই নেই! কতক্ষণ বাইরে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায়! গায়ে গুড়িগুড়ি বৃষ্টির ছাঁট লাগছে, জোর হাওয়া, চোখে ঘুম!….. অসহ্য! আর থাকতে না পেরে মনির এবার চড়া গলায় ডাকল, ” খুশী, খুশী! জলদি বেরিয়ে আয়!”
মনিরকে চমকে দিয়ে ঘরের ভেতর থেকে খুশীর ঘুমজড়ানো গলায় সাড়া এল, ” ভাইয়া, আমি তো শুয়ে আছি। ডাকছ কেন?”
বিস্মিত মনিরের গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোল না। ভেতরে কিছুক্ষণ আগে কে ঢুকল তবে! তারপরেই মনে পড়ল, তাদের ঘরের দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধই ছিল, সেই-ই তো খুলে বেরিয়েছে…..তাহলে?
এরপর যা দেখল মনির, তাতে সে শিউরে উঠল। বাথরুম থেকে সাদা কাপড় পরা নারীমূর্তি বেরিয়ে আসছে। ঘোমটায় মুখ দেখা, সুতরাং মুখ দেখার উপায় নেই। এরপর একের পর এক একই রকম সাদা কাপড়ে ঢাকা নারীমূর্তি বেরোতেই লাগল আর মিলিয়ে যেতে লাগল বাঁশঝাড় আর বেলগাছের মধ্যে। বিস্মিত মনির নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলল। জায়গাতেই জমে দাঁড়িয়ে রইল। সরে যাবে, সেই শক্তিও রইল না তার। এইসময় একটা মূর্তি মুখের ঘোমটা সরিয়ে মনিরের দিকে চেয়ে বিশ্রী ভাবে হেসে উঠল। স্তম্ভিত মনির দেখল, টানা টানা দুই চোখে মনি নেই, লাল রক্তে ভরা, নাক নেই, মুখের মধ্যে লম্বা লম্বা তীক্ষ্ণ দুপাটি দাঁত। লম্বা জিভটা বেরিয়ে আছে একপাশে।
সাহসী ছেলে মনিরের সমস্ত অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল…..বিশ্বাসের ভিত টলে গেল। কিভাবে যে ঘরে ঢুকে সে দরজা বন্ধ করেছিল, তা সে মনে করতে পারল না। দরদর ধারায় ঘামছে সে। গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেছে ওর, ভয়ের শিহরনে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে ওর। মা বা খুশী কাউকে ডাকতে পারল না। বিছানায় শুয়ে আচ্ছন্নের মতো হয়ে রইল সে, আর কিছু মনে রইল না ওর।
Dec 5 at 12:33pm · Sent from Mobile
Priya Banerjee
পরের কটা দিন কেমন উদভ্রান্তের মতো হয়ে রইল মনির। ভাল করে খেত না, কাজে গেল না, শরীর খারাপের অজুহাতে বিছানায় শুয়ে রইল। মা আর খুশী তো অবাক……মনির কখনো কাজ কামাই করে না, আবার পরিষ্কার করে কিছু বলছেও না, ওর কি হয়েছে। শক্ত মনের মানুষ মনির অনেক কষ্টে চোয়াল শক্ত করে নিজেকে সামলাল। সে ঠিক করল, হেডমাস্টারমশাইকে বলে সে অন্য জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করবে। যদি ব্যবস্থা হয় তো ভাল, নাহলে চাকরীই ছেড়ে দেবে সে।
যে ভয়ঙ্কর দৃশ্য সে দেখেছিল, তাতে তার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়। সে রাতে প্রকৃতই সে কি দেখেছিল? পেত্নী? পিশাচ? সত্যিই কি তাহলে এই পৃথিবীতে অশরীরী, অপার্থিবের অস্তিত্ব আছে! রহস্যময় এই পৃথিবীর কতটুকু সে জানে?
হেডস্যারকে বলেও কোন লাভ হল না। তিনি এত তাড়াতাড়ি কোনও বিকল্প বাসার ব্যবস্থা করতে পারলেন না। শুধু মনীরের কথায় ঘরের পাশেই নতুন একটা টয়লেট বাঁধিয়ে দিলেন। আর পুরনো টয়লেটটা বাঁশটাঁশ দিয়ে বন্ধ করে দিল। সেরাতের কথা সে কাউকে বলতে পারেনি। খুশী জানলে খুব খারাপ হবে। বোনকে সে জানের সমান ভালোবাসে। ওর কোনও ক্ষতি সে সইবে না। অন্য চাকরীর সন্ধানে রইল। এই গ্রামেই আর সে থাকবে না। কিছুদিন পর থেকে মনির খেয়াল করল, খুশী আর আগের মতো হাসে না, দুষ্টুমি করে না, সবসময় কেমন গম্ভীর হয়ে থাকে। মায়ের সাথে কথা বলে মনির আরও ভয়াবহ ব্যাপার জানল যে খুশী আজকাল একা একা বাঁশবনে ঘুরে বেড়ায়, বেলতলায় বসে থাকে….আর সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার, কি করে যেন পুরনো টয়লেটের বাঁশ সরিয়ে ঐ পরিত্যক্ত টয়লেটের ভেতর ঢুকে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। স্তম্ভিত হয়ে গেল মনির…. যেভাবে বাঁশটাঁশ দিয়ে পুরনো টয়লেটটা বেঁধে দিয়েছিল সে, তাতে অন্যের সাহায্য ছাড়া সেইসব বাঁশ সরানো অসম্ভব।
মায়ের কপালেও চিন্তার রেখা। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ” সেয়ানা মেয়ে, ওর বিয়েটা দিয়ে দিলেই ভাল হোত। তাছাড়া, জায়গাটারও বদনাম আছে, এখান থেকে চলে গেলেই ভাল হয়।”
মনির বলে, ” চিন্তা কোর না মা, চট করে তো আর এই চাকরীটা ছাড়া যায় না। আমি অন্য চাকরি দেখছি। এখানেও আর থাকব না। খুশীর বিয়েরও ব্যবস্থা করব। তুমি ওকে একটু নজরে নজরে রাখো। বাইরে বেরোতে দিও না।”
সেদিন মনির সারাটাদিন কেমন আনমনা রইল….কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারল না। কেবলই ভাবে, কেমন করে খুশী একা হাতে ঐসব বাঁশ সরাতে পারল! কেনই বা হঠাৎ এমন পালটে গেল! অবচেতন মনের অজানা আশঙ্কায় সে শিউরে উঠল।
সেদিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার…..উথাল পাথাল হাওয়া….ঝড়বৃষ্টি হওয়ার আলামত। এখনো খুশী ভাইয়ার জন্য রাতে অপেক্ষা করে ঠিকই কিন্তু খেতে দেবার সময় কোনও কথা বলে না। মনির এটাসেটা কত কথা বলে কিন্তু খুশীর দিক থেকে কোনও উত্তর আসে না। সারাদিনের ক্লান্ত মনির আর বিশেষ কিছু ভাবনাচিন্তা করতে পারে না। সে খেয়ে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর খুশী কি করে, মনির জানে না।
আজ মনির বেরোবার সময় কোথাও খুশীর দেখা পেল না। আজ আর কেউ ওকে তাড়াতাড়ি ফেরার আবদার করলে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনির কাজে গেল।
আজ কাজ থেকে ফেরার পথে দারুন খুশি ছিল মনির। ওর এক ছাত্রের বাবার বন্ধুর বিশাল চাল ডালের আড়ত আছে বাজারে। সেখানে ক্যাশিয়ারের কাজের ব্যবস্থা হয়ে গেছে তার। আড়তের পাশেই মালিকের ঘর। সেখানেই দুটো ঘর ওকে দেওয়া হবে, যেখানে ও পরিবার নিয়ে উঠবে। মালিক লোকটিও ভালো মানুষ। ভাল মাইনে ছাড়াও অনেক সুযোগ সুবিধারও আশ্বাস দিয়েছেন মনিরকে। এই সুখবরটা মাকে দেওয়ার জন্য তর সইছে না মনিরের। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার ধৈর্য হচ্ছে না মনিরের। আজ সারাদিন আকাশ মেঘলা ছিল……কিছুক্ষণ আগে থেকে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। বৃষ্টির বেগ ততটা না হলেও প্রকৃতির থমথমে ভাবে অজান্তেই গা টা ছমছম করে উঠল মনিরের।
ঘরের সামনে এসে দ্যাখে, একি! ঘর আজ অন্ধকার! খুশী আলো না জ্বেলেই শুয়ে পড়েছে। অন্যদিন খুশী উঠোনে পানির বালতি রেখে দেয় মনিরের হাত মুখ ধোয়াত জন্য, তার সাড়া পেলে আলো হাতে করে এসে দাঁড়ায়। আজ খুশী না- ই পানির বালতি রেখেছে, না-ই আলো হাতে এসে দাঁড়াল। মনির কয়েকবার “খুশী, খুশী ” বলে ডাকল। কেউ সাড়া দিল না। শুধু ভেতর থেকে একটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেল মনির। একি! খুশী কাঁদছে! বিস্মিত মনির জিজ্ঞেস করল,
” খুশী, খুশী, কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন?”
বলতে বলতে হ্যারিকেনের দিকে এগিয়ে গেল মনির। আহ, দেশলাইটাও নেই। এইসময় আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। সেই আলোয় দেখা গেল, বিছানায় মা চিত হয়ে শুয়ে আছেন আর তাঁর পাশে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে মিহিসুরে কেঁদে চলেছে খুশী। বাতি জ্বালাতে হল না। আকাশে আবার বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। সেই আলোয় এবার দেখা গেল, মা’র দুই চোখ খোলা, বিস্ফারিত, গলা বুক রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মা আর বেঁচে নেই।
” খুশী! ”
আতঙ্কিত চিৎকার করে উঠল মনির।
ধীরে ধীরে মুখ তুলল খুশী। মনিরের মেরুদণ্ড বেয়ে যেন হিমস্রোত নেমে গেল। সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল তার। এ কে? সেই টানা টানা দুটো চোখে মনি নেই, লাল রক্তে ভরা, নাক নেই, লম্বা লম্বা দু পাটি দাঁত, জিভটা একপাশে বেরিয়ে আছে……সেই ঝোড়ো রাতে দেখা অশুভ প্রেত।
ধীরে ধীরে পিছু হটছিল মনির। থেমে গেল। খুশীর দেহে ভর করা পিশাচী ঝাঁপিয়ে পড়ল মনিরের ওপর। তীক্ষ্ণ দাঁতে তার গলার কণ্ঠনালি ছিঁড়ে গেল। চিৎকার করার অবকাশটুকুও পেল না মনির।