অদেখা বন্ধু

অদেখা বন্ধু

আশিকুজ্জামান সাহেব চোখে ভাল দেখেন না। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, তাতেও না। তবে তাঁর ঘর ভর্তি বই, দেখলে তাক লেগে যায়। ন্যাপথালিনের গন্ধটা একধরণের মাদকতা সৃষ্টি করে রেখেছে ঘরটাতে।
ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা ছোট্ট টেবিল, তাতে দাবার ছক সাজানো। পাথরের দাবা সেটটা খুব দামী, তাঁর অল্প কিছু শখের জিনিসের একটি।

তাঁর চাওয়া-পাওয়ার তেমন কিছু নেই, সারাদিন বই পড়ে কাটান। তাতে ক্লান্তি এসে গেলে দাবা খেলেন। ছেলের সংসারে গলগ্রহ হয়ে আছেন, এক কোণায় পড়ে থাকা আর দিন পার করা। মাঝে মাঝে লাঠিখানা নিয়ে বাইরে হাঁটতে যান, বাইরের বাতাস গায়ে লাগান। ইদানীং তাঁর একটা সমস্যা হয়েছে, খুব একা একা লাগছে। কিন্তু কার সাথে কথা বলবেন? কারো একটু সময় নেই, সবাই ভীষণ ব্যস্ত। ছেলে ব্যস্ত তার অফিস নিয়ে, ছেলের বউ ব্যস্ত তার সংসার নিয়ে, নাতিনাতনিরা তাদের স্কুল, পরীক্ষা এসব নিয়ে তাদের বাবা-মায়ের চেয়েও ব্যস্ত।

রাত তিনটা। ইনসমনিয়া আছে তাঁর, ঘুম আসে না কিছুতেই। রাতে একা একা দাবা খেলেন তিনি। ঘোর অন্ধকার করে টেবিলল্যাম্প জ্বেলে খেলেন, অনেকদিনের অভ্যাস। চাল দিয়ে বসে আছেন, ওপাশে সাজানো আছে কালো রঙয়ের গুটিগুলো, কিন্তু চালতে ইচ্ছে করছে না। অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে আছেন তিনি, খেয়াল করলেন একসময়, তিনি শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, তাঁর তাকিয়ে থাকায় কোন উদ্দেশ্য নেই, কোন অর্থ নেই। নীরবতা যেন চেপে ধরল তাঁকে, চারিদিক থেকে।

তাঁর নীরবতা ভেঙে গেল। ওপাশের গুটিটা নড়ে উঠলো, ঘোড়াটা আড়াই কোট পার হয়ে বসলো নিজের জায়গায়।

নড়েচড়ে বসলেন তিনি, কী দেখছেন এসব? দাবার গুটি কি নিজে নিজে নড়তে পারে? গুটিটা ধরে দেখলেন তিনি, নেড়েচেড়ে দেখলেন। কোন সমস্যা তো নেই।

তাহলে? নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন তিনি, বোর্ডের ওপাশটা ঘুরে দেখলেন, কেউ নেই। কেউ থাকবেই বা কেন? আবার নিজের চেয়ারে এসে বসলেন, ধপ করে বসে পড়ে নিঃশ্বাস ফেললেন। বড় বড় নিঃশ্বাস নিলে মাথাটা পরিষ্কার হয়, তাই করলেন। পরের চাল দিলেন তিনি।

আবারো নড়ে উঠলো ওপাশের গুটিগুলোর একটি। সৈন্যটা এগিয়ে এলো দুই ঘর।

ভয় পেলেন তিনি, কে? কে এখানে?

জবাব নেই। বাইরের অন্ধকার রাতের মতোই জমাট বেঁধে আছে নীরবতা। হঠাৎ এক ঝলক বাতাস এসে তাঁকে স্পর্শ করলো, কি শীতল! সেই বাতাসে কিছু একটা যেন ছিল, আশিকুজ্জামান সাহেবের ভয় কেটে গেল, তিনি খুশি হয়ে উঠলেন। অনেকদিন পর একজন সঙ্গী পাওয়া গেছে, দেখা যাক আর না যাক, সঙ্গী তো!
তিনি চাল দিলেন। আশা করে রইলেন, ওপাশ থেকে নড়ে উঠবে গুটি। কয়েক মিনিট গেল, কোন নড়াচড়া নেই। হতাশ হয়ে উঠলেন তিনি, তাহলে কি সবই ভুল?
নীরবতা ভঙ্গ হল আবার। পাথরের গুটি নড়ে উঠলো, মন্ত্রী কোণাকুণি এসে কিস্তি দিল তাঁকে।

ভারী মজার একটা খেলা পেয়েছেন তিনি, কেউ কোনদিন এমন খেলা কি খেলেছে, যেখানে প্রতিপক্ষকে দেখা যায় না?

কথা বলা শুরু করলেন তিনি, তুমি যে-ই হও না কেন, আমার কিছু এসে যায় না। তুমি করে বলে ফেললাম, কিছু মনে কোরো না। আমার বয়স অনেক, চোখেও ভাল দেখি না। কবে ওপারের ডাক এসে যায়, কোন ঠিক নেই। বলে চলেন তিনি, তাঁর কথা, তাঁর পরিবারের কথা, মৃতা স্ত্রীর কথা, ছেলেমেয়ের কথা, তাঁর নাতিনাতনির কথা, তাঁর অবসর জীবনের আগে যে চাকরিটা করেছেন সেটার কথা। খেলা এদিকে এগিয়ে চলে। টানা দুঘণ্টা। ওপাশ থেকে তাঁর কথার কোন জবাব আসে না, কিন্তু তাতে কি?

হাতিটা এগিয়ে দিয়ে হাসিমুখে আশিকুজ্জামান সাহেব বললেন, কিস্তিমাৎ!

অস্পষ্ট হলেও একটা হাসির শব্দ শোনা গেল। এই প্রথম ওপাশের মানুষটি (নাকি অন্য কিছু!) থেকে কোন সাড়া পেলেন তিনি।

তিনি যখন শুতে যাচ্ছেন, তখন রাত প্রায় শেষ, ভোর হয়ে এসেছে। রোজ রাতেই এমন হয়। এখন ঘণ্টা তিনেক ঘুমোবেন তিনি, তারপর উঠবেন। আজ বড় শান্তির ঘুম দিলেন তিনি, কি একটা তৃপ্তিতে ভরে গেছে মন। একা একা খেলতে কি ভাল লাগে? আজ একজন সঙ্গীর সাথে খেলে খুব ভালো লাগলো তাঁর, যেন অনেকদিনের পুরনো অনুভূতি ফিরে এলো, যখন তাঁর অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। কেউ যদি তাঁর দিকে তাকাত, দেখতে পেত, ঘুমের মধ্যেও তাঁর মুখে লেগে আছে এক চিলতে হাসি।

এদিকে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তাঁর পুত্রবধূর, রাতে পানি খেতে উঠে সে শোনে, তার শ্বশুরের ঘর থেকে কথার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, একা একা কার সাথে কথা বলছেন তিনি? কান লাগায় সে দরজায়, থেকে থেকে আসে অস্পষ্ট কথার শব্দ। নিজের গল্প করছেন তিনি। ঘরে কি আর কেউ আছে, নাকি বুড়ো মানুষটার মাথাই খারাপ হয়ে গেছে? দরজার নিচ দিয়ে আসছে ম্লান আলো, আর কিছু বোঝার উপায় নেই। ডাকবে নাকি তাঁকে? থাক, সকালে দেখা যাবে। একটা অস্বস্তি নিয়ে ঘুমোতে যায় সে।

সকালে তার স্বামীকে সে খুলে বলে সব, শুনে একটা অস্বস্তির ছাপ পড়ে তার কপালে। বাবাকে খাবার টেবিলে জিজ্ঞেস করতে হবে সব।

টেবিলে সবাই একসাথে বসেছেন। জিজ্ঞেস করলো রাতুল, তার বাবাকে, বাবা, তুমি নাকি রাতে একা একা কার সাথে কথা বলছিলে?

বিষম খেলেন তিনি, হাতের কাপ থেকে ছলকে পড়লো চা। দ্রুত ভেবে নিলেন তিনি, মাত্র দুই সেকেন্ডের মধ্যে। না না, ওদেরকে বলা যাবে না। বললে বিশ্বাসও করবে না।

জবাব দিলেন তিনি, কই, না তো। আমি তো একা থাকি, কার সাথে কথা বলবো? ঠিক মিথ্যে কথা নয়, তিনি এমন একজনের সাথে কথা বলছিলেন, যাকে দেখা যায় না। এটাকে কী বলা যায়?

বলছিলে না? আবার জিজ্ঞেস করলো রাতুল।

মাথা দুদিকে নাড়েন তিনি। কেন, কেউ কি বলেছে তোকে?

না, বাবা। রাতে আপনার ঘর থেকে মনে হল শব্দ পাওয়া গেল। তাড়াতাড়ি বলল তাঁর পুত্রবধূ।

হুম। চুপ করে যায় সে। হাঁপ ছেড়ে যেন বাঁচেন তিনি।
খাওয়া সারা হয়, সবাই খুব চুপচাপ হয়ে গেছে।

অফিসে যাবার আগে আড়ালে স্ত্রীকে ডেকে নেয় রাতুল। তুমি ঠিক শুনেছিলে?

অবশ্যই। আমি কি মিছেমিছি বলছি?

দুশ্চিন্তা নিয়ে অফিসে যায় রাতুল, পেছন থেকে তাকিয়ে থাকে তার স্ত্রী। পাঁচ বছরের ছেলেটা তার আঁচল ধরে টান দেয়। দাদু পাগল হয়ে গেছে, তাই না মা? সে যেন খুবই আনন্দিত। একমাত্র শিশুরাই এসব বিষয়ে আনন্দিত হয়।

জবাব দেয় না সে, ঘরের কাজ সামলাতে যায়।
সবাই খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে, একমাত্র নিশ্চিন্ত আছেন আশিকুজ্জামান সাহেব।

সে রাতে দাবা খেলা আরও জমে উঠলো। তবে আজ রাতে তিনি আরও সতর্ক, নিচু গলায় কথা বলেন তিনি, কেউ শুনে না ফেলে। ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। এই তো ভাল আছি। সুখ এলে সেটাকে যত্ন করে ধরে রাখতে হয়, প্রশ্ন করতে হয় না, সন্দেহ করতে হয় না, পাছে সেই সুখ বিদায় নেয়।

পুনশ্চঃ
আশিকুজ্জামান সাহেব তাঁর সেই অদৃশ্য সঙ্গী নিয়ে বেশ আছেন, রাতে মাঝে মাঝে তাঁর ঘর থেকে ছেলে আর ছেলের বউ মাঝেমাঝেই কথা বলতে শোনে। কিন্তু জিজ্ঞেস করে না, করলে সরাসরি অস্বীকার করেন তিনি। সেই দুঃখী ভাব তাঁর চেহারায় আর নেই, বেশ হাসিখুশি মানুষ বলে মনে হয় তাঁকে।
বিজ্ঞান সবকিছুর ব্যাখ্যা দাবী করে। কিন্তু সবকিছুরই ব্যাখ্যা থাকতে হবে কে বলেছে?

……………………………………………(সমাপ্ত)…………………………………….

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত