জনাব “ক”

জনাব “ক”

রাত একটা। আমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসেছি। ঘুম তাড়াতে হবে। লেখক, কবি-সাহিত্যিক এঁদের রাত না জাগলে চলে না। পৃথিবীর সব নামীদামী লেখকেরা দিনে ঘুমোন এবং রাতে জাগেন। তাঁরা সবাই হন নিশাচর। দিবাচর লেখকদের দেখা পাওয়া ভার। কারণ কী কে জানে, হয়তো জগতের সব মহৎ চিন্তা রাতেই এসে ভিড় করে।

আমি এখন কথা বলছি আমার সামনে “উপবিষ্ট” লেখক জনাব “ক” এর সাথে। তাঁর চোখ কোটরাগত, গাল ভেঙে বসে গেছে, মাথার চুল উষ্কখুষ্ক। দুই চোখ লাল, অনেকদিন ভালোমতো ঘুমোন নি মনে হচ্ছে। আমার ঘরে এখন অনেকটা টক-শো এর মতো অবস্থা। টিভি চ্যানেলে রাত এগারোটার পরে শুরু হয় বিরতিহীন টক-শো, সেখানে নামীদামী ব্যক্তিত্বরা এসে দেশ এবং জাতির বর্তমান অবস্থা নিয়ে হা-পিত্যেশ করেন এবং সমাধান উগড়ে দেন। তাঁদের সামনে থাকে গরম চা কিংবা কফির কাপ, সেটা এমনভাবে ক্যামেরার দিকে ঘোরানো থাকে যেন কাপের ওপরের লেখাটা পড়া যায়। কাপে লেখা থাকে চ্যানেলের নাম অথবা অনুষ্ঠানের নাম। মাঝে মধ্যে তাঁরা চায়ের কাপে চুমুক দেন, রাতজাগা দর্শকদের প্রশ্ন গ্রহণ করেন এবং জবাব দেন। সব চ্যানেলের অনুষ্ঠানই এক, শুধু ফার্নিচারগুলো আলাদা। অনেক দর্শক সেগুলো দেখার জন্যই বসেন। হিন্দি সিরিয়াল দেখার জন্য যেমন অনেক “মা-বোন” বসেন শুধু গয়না, শাড়ি ইত্যাদি দেখতে। আমি এসব থেকে শতহস্ত দূরে থাকি, কারণ টক-শো হচ্ছে অনিদ্রার মহৌষধ। আমার সেই মহৌষধ গ্রহণের কোন ইচ্ছা নেই। আমি রাত জাগছি এবং জাগবো। টেবিলে পড়ে আছে আমার বর্তমান উপন্যাস “কেন চলে গেলে প্রিয়তমা”-র অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি। বুড়ো হাবড়াটা এসে বসেছে বলে লিখতে পারছি না।

হ্যাঁ, আমি একজন লেখক, কথা বলছি আরেকজন লেখকের সাথে, যাকে মনে মনে “বুড়ো হাবড়া” বলছি। তবে জনাব “ক” এর ব্যাপারে একটা কথা বলতেই হয়, তিনি পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন। আমি নিজে গিয়ে তাঁর কুলখানির অনুষ্ঠানে দুঃখ দুঃখ চেহারা করে ঘুরে এসেছি। তাহলে তিনি এখানে কেন?

ভাবছেন, আমি পাগল, মাথা খারাপ? মোটেই মিথ্যা নয়। সব কবি-সাহিত্যিকের মাথা অল্পবিস্তর “আউলা” থাকতে হয়, নইলে ভাল গল্প বের হয়না। গোছানো মাথা থেকে বের হয় পাটের আঁশ থেকে “জুটন” বের করার প্রক্রিয়া, আর আউলা মাথা থেকে বের হয় গল্প, কবিতা, উপন্যাস। কাজেই মৃত লেখক যে আমার বাড়িতেই বেড়াতে আসবেন এ আর আশ্চর্য কী?

আমার ভয় পাবার কথা, আমি পাচ্ছি না। বরং বেশ মজা লাগছে। অনেকদিন পরে তাঁকে দেখলাম, পুরনো জিনিস নতুন করে ফিরে পেতে কার না ভালো লাগে?
টেবিলের এক পাশে আমি বসেছি, আরেকপাশে জনাব “ক”। এককালে, অর্থাৎ বহু বছর আগে, আমি যখন নিতান্তই “শিশু” লেখক, তখন বিধাতার অশেষ কৃপায় এই লেখকের মৃত্যু হয়েছিল, অনেকটা যেন ডি-বক্সের ভেতরে আমাকে গোল করার সুযোগ দিয়ে সরে গেল গোলকিপার। তিনি যতদিন ছিলেন, ততদিন আমার বই বিকোত না, কত সৌজন্য কপি কতজনকে দিতে হয়েছে। দিনরাত খেটে তৈরি করতাম এক একটা সুন্দর গল্প, সেগুলো ছাপতে চাইতো না কেউ। কিন্তু জনাব “ক” যদি কলম দিয়ে কাগজে দু’লাইন আঁকিবুঁকি করে দিতেন, সেটাও বের হতো ছাপা হয়ে।

কিন্তু সুদিন সবারই আসে। আমারও এলো। জনাব “ক” এর মৃত্যুর পর আমি দ্রুত উপরে উঠতে লাগলাম, ক্রমে সবাই বুঝি ভুলে গেল “ক” নামে একজন লেখক ছিলেন। অনেকটা অন্ধের দেশে একচোখা লোকই যেমন রাজা হয়ে বসে, তেমনি আমার লেখাগুলোও পেয়ে গেল উঁচুমানের সাহিত্যের মর্যাদা।

ভাবছেন, আমরা লেখকেরা কেন একজন আরেকজনের সম্পর্কে এত নিচু ধারণা নিয়ে বসবাস করি? আমাদের মন এত ছোট কেন, এত নোংরা কেন? আমরা হলাম জাতির মস্তিষ্কের মতো, আমাদের চিন্তাভাবনা তো এমন হবে যেন চিন্তা থেকেও সুঘ্রাণ আসে। ভুল, একেবারেই ভুল। আমরা কথা বলি শুদ্ধ ভাষায়, বিনম্র শ্রদ্ধায় গলে পড়ি, কিন্তু ভাবি নোংরা, লিখিও নোংরা। এতোই নোংরা যে বিষ্ঠার গন্ধ আসে। নোংরা সাহিত্য পাবলিক খুব “খায়”। আমার কথাই বলি। আমার বিবেচনায় আমার লেখাগুলোর মধ্যে সেরা হচ্ছে “বৈঁচিফলের ঘ্রাণ”, একটা গ্রাম্য পটভূমিতে লেখা, সেখানকার জীবনযাত্রা নিয়ে লেখা উপন্যাস। কিন্তু সেটা কয় কপি বিক্রি হয়েছে জানেন? মাত্র পাঁচ কপি। আর আরেকটা লেখা “উচ্ছৃঙ্খল মেয়ে”, উপন্যাসের নাম দেখেই গত বইমেলায় আট-আটটি সংস্করণ শেষ হয়ে গেছে; বলতে হয় না, এটা একটা অশ্লীল উপন্যাস। ভালো লেখক আর জনপ্রিয় লেখক এক জিনিস নয়, সেটা অনেক আগেই পরিষ্কার হয়ে গেছে, পাবলিক “খাবে” এমন লিখতে হলে লিখতে হবে অশ্লীল জিনিস, হা হা হা।

নীরবতা ভাঙলেন জনাব “ক”। তারপর, মিস্টার “খ”, জনপ্রিয় লেখক? কেমন আছ?

জি, আপনার দোয়ায় ভাল আছি।

তুমি করে বলছি, কিছু মনে কোরো না। তুমি আমার হাঁটুর বয়সী, আর লেখালেখিতে পায়ের গোড়ালির বয়সী।

না না, মনে করার কী আছে?

পা নামিয়ে বসলে কেন? আরাম করে পা তুলে বস, চা খাও। কাপটা হাতে নিয়ে খাও। একজন মৃত লেখকের জন্য এত বিনয় দেখাচ্ছ কেন? মনে মনে তো আমাকে গাল দিচ্ছ, ইউ ফুল।

এই রে! আড়ালে আবডালে গালাগালি চলে ঠিকই, কিন্তু ইনি তো সামনাসামনিই শুরু করেছেন!

শোন ছোকরা, তুমি যা লেখালেখি শুরু করেছো তাতে আর না এসে পারলাম না।

কেন, আমি কী লিখেছি? কয়েকদিন আগে পেপারের “কলামে” একটা নিবন্ধ লিখেছিলাম, সেখানে কিছু রাজনৈতিক কথা ছিল, সেটার কথা বলছেন নাকি ভদ্রলোক?

তোমার সেই উপন্যাস, “উচ্ছৃঙ্খল মেয়ে” না কী যেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ, আরে সেটা নিয়ে বলার কী আছে? বইমেলার হটকেক। আমি তো নিজেও চিন্তা করিনি এতটা বিক্রি হবে। আপনার কোন উপন্যাসও তো এতটা কখনো বিক্রি হয় নি।

বদমাশ ছোকরা, ওটা কোন উপন্যাস হয়েছে? লেখালেখি নিয়ে ফাজলামি? তোমাকে ধরে চাবকানো উচিৎ।

দেখুন, আপনি শুধু শুধু উত্তেজিত হচ্ছেন।
শাট আপ ইউ রাস্কেল।

আমি একটু দূরে সরে বসলাম, ভদ্রলোক খুব গরম অবস্থায় আছেন, যেকোন সময় পেপারওয়েটটা ছুঁড়ে মারতে পারেন, আমার মাথাটা ফেটে হাড়ির মতো ফুটো হয়ে যাবে। তাছাড়া ভদ্রলোক কথা বলার সময় খুব থুথু ছিটাচ্ছেন।

তোমার উপন্যাসটা তো নোংরা বটেই, অখাদ্য। আমি পাতা উল্টে দেখেছি, দু’পৃষ্ঠা পড়েই বমি এসে গেছে। না আছে লেখার কোন স্টাইল, না আছে কোন শ্রী। আবার কবিতার লাইনও ঢুকিয়ে দিয়েছ, বেতমিজ।

“বনভূমি ছেয়ে গেল ফুলে ফুলে
কপাল ঢাকিয়া গেল চুলে চুলে।”

এটা কী ধরণের কবিতা? কপাল ঢাকিয়া গেল চুলে চুলে? এটা কোন কবিতার চরণ হতে পারে? ইউ … …
ভদ্রলোক যুতসই শব্দ খুঁজে পাচ্ছেন না, প্রতি লাইনে একটা করে গালি দিচ্ছিলেন আমাকে, কিন্তু মনে হয় শব্দভাণ্ডার ফুরিয়ে গেছে। এমনটা হলে চলবে না। একজন শক্তিশালী লেখকের শব্দভাণ্ডার হতে হবে অনেক, পাঠক যাতে বুঝতেও না পারে যে তাঁকে একই জিনিস ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলা হচ্ছে, একই কুমিরের ছানা বারবার দেখানো হচ্ছে, একই জিনিস বারবার গেলানো হচ্ছে।

পারে যে তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। শুনুন, আপনি থাকেন অন্যলোকে, এই কয়েক বছরে যে সাহিত্য কতটা বদলে গেছে আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। আমি তো তা-ও ছন্দ দিয়ে লিখেছি, কিন্তু আজকাল ছন্দ কবিতার কোন বাধ্যতামূলক অংশ নয়, গদ্যছন্দেও কবিতা লেখা হচ্ছে হরহামেশাই। আমি একবার পেপার থেকে পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন ভেঙে ভেঙে কয়েক লাইনে লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সবাই ওটাকে কবিতা বলে ধরে নিয়েছে, হা হা হা।

নালায়েক, আমাকে তুমি কবিতা শেখাচ্ছ? আমাকে?
শ্বাসটান উঠে গেল তাঁর, কাশতে শুরু করলেন, শব্দ শুনেই বোঝা যায় যে প্রচুর কফ জমা আছে বুকে। শ্লেষ্মাজড়িত ভারী শব্দে কাশি। জীবিত অবস্থাতেও অনেক অসুখবিসুখ ছিল তাঁর, বাতের ব্যথা, অ্যাজমা, ডায়াবেটিস, প্রেশার। দেখলেন তো? প্রতিপক্ষ হলেও উনার খোঁজখবর ঠিকই রেখেছি। হয়তো ওনার মৃত্যুর প্রহর গুনছিলাম। মরে গেছেন ঠিকই, কিন্তু অসুখ তো সারেনি দেখা যাচ্ছে। লেখক সাহেব আরবী ফার্সি ভাষা ব্যবহারে দক্ষ, বোঝাই যাচ্ছে। গালি দিচ্ছেন নালায়েক, বেতমিজ বলে। যে এখনো “লায়েক” বা সাবালক হয়নি তাকে বলে নালায়েক, আর যে কোন “তমিজ” বা সম্মান দেখিয়ে কথা বলে না সে হল বেতমিজ।

সময় নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কাশলেন তিনি, উঠে গিয়ে জানালা দিয়ে থুথু ফেলে এলেন।

আমি হাঁ হাঁ করে উঠলাম। আরে, আরে, কী করছেন? এটা এপার্টমেন্ট, এখানে বাইরে থুথু ফেলা যায় না। সিভিক সেন্সের একটা ব্যাপার আছে।

মোটেও লজ্জিত দেখাচ্ছে না। তোমার সিভিক সেন্সে আমি পিশাব করি। তাছাড়া থুথুই তো ফেলেছি, “গু” তো আর ফেলিনি।

এমন লোকের আমি কী জবাব দেবো? ভদ্রলোকের মুখ খুব আলগা, বোঝাই যাচ্ছে। আলগা মুখের মানুষদের মন খুব পরিষ্কার হয়, এই ভদ্রলোকও নিশ্চয়ই খুব পরিষ্কার মনের মানুষ ছিলেন। আমার মতো নোংরা মনের নন।

স্টুপিড, আমি দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে লিখেছি, একটা বাজে কথা কোথাও লিখি নি, আর তুমি সেদিনের ছোকরা আজেবাজে জিনিস পাঠকদের হাতে তুলে দিচ্ছ?

কথাটা সত্যি। এই লেখক যা লিখতেন, সেটা ছিল শুদ্ধ। তাঁর লেখা পড়লে মনে হতো, তিনি শব্দ দিয়ে ভারী সুন্দর একটা ছবি তৈরি করেছেন, যেখানে সব রং পড়েছে জায়গামত, কোথাও কমবেশি নেই। লেখালেখি ছিল তাঁর কাছে একটা খেলা, একই সাথে একটা শখ এবং সাধনা। কিন্তু আমি কী করবো? আমি তো এখন আর নিজের ইচ্ছেয় লিখি না, লিখি প্রকাশক যেমন চায়। ব্যাটা মোতাহার খুব পাখোয়াজ, যে উপন্যাস চলবে বলে মনে করে, সেটাই শুধু সে ছাপায়। এক সময়, যখন বয়স, অভিজ্ঞতা আর বুদ্ধি সবকিছুই ছিল কম কম, তখন শুদ্ধসাহিত্যের চর্চা করেছি। কিন্তু সেসবের এখন “ভাত” নেই। আমি নিজেও ভক্ত পাঠক ছিলাম এই লেখকের, কিন্তু কী নিয়তি, সময়ের ফেরে হয়ে গেলাম রাইভাল।

তুমি তো দেখছি কিছুই বাদ দাও নি, গল্প, উপন্যাস, কবিতা। বলা বাহুল্য, কোনটাই তুমি ঠিকভাবে লিখতে পারো না। বোকা লেখকেরা কোথায় ভাত পায় জান? যেখানে পাঠকেরা বোকা হয়। যে দেশে চোর বুদ্ধিমান, সেই দেশেই পুলিশ বুদ্ধিমান হয়। চোর বোকা হলে পুলিশও বোকা হয়।

ঠিক বলেছেন, আমি সায় দিলাম।

আমার কথায় তাল দিয়ে গেলেই ভেবেছ তোমাকে ছেড়ে দেব, ফাজিল ছোকরা? আমি “ক”, কাউকে ছেড়ে কথা বলিনা। আমি নেতাদেরকেও আহা উঁহু করে কথা বলিনি, ন্যাংটা করে ছেড়ে দিয়েছি আমার লেখায়। সবসময় সত্যি লিখেছি, কাজেই আমার কথা মন দিয়ে শোন, তোমারই মঙ্গল হবে।

কথাটা সত্যি। তিনি তাঁর কলামে এমন সব ড্যামেজিং লাইন জুড়ে দিতেন, যাতে দুই দলই কচুকাটা হয়ে গিয়েছিল। দুই দলের কেউই তাঁকে দেখতে পারতো না। তবে আমি নিজে সাবধানী লেখক, কিছু বলতে হলে এমনভাবে বলি, যেটার অর্থ বের করতে হলেই কালঘাম ছুটে যাবে সবার।

তুমি তো একটা চোর, বলে উঠলেন তিনি।
অ্যাঁ, আমি চোর?

অবশ্যই চোর। তুমি তোমার লেখায় আমার লেখার নকল করেছো, বাজে অংশগুলো বাদে। পাঠকেরা বুঝবে কী করে? তারা তো আমার ছায়া খুঁজে বেড়াচ্ছে। সেই সুযোগটাই তুমি নিয়েছ। সবাই তোমাকে বাহবা দিচ্ছে, কিন্তু তারা তো তোমার লেখা পড়ে না, তারা আমার লেখা চেয়েছিল। তোমার মধ্যে তারা আমাকে খুঁজে পাওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে।

আমি চুপ মেরে আছি। ভদ্রলোক একেবারে আসল জায়গায় গুঁতো মেরেছেন। আমি নকল করেছি সেটা ঠিক, কিন্তু এমনভাবে যে কারো ধরতে পারার কথা নয়।
ফেকলু কোথাকার, তুমি জান আমি লেখা নিয়ে কত পরীক্ষানিরীক্ষা করেছি? কত পড়াশোনা থাকতো এক একটা লেখার পেছনে? আর তুমি তো সব মেরে মেরে লেখ, মাঝখানে ঢুকিয়ে দাও বস্তাপচা কিছু রোমান্টিক এলিমেন্ট।

মহা মুশকিল হল, এই কথাগুলো সবার সামনে বললে তো কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। ভাগ্যিস রাত! “ফেকলু” বলে কি কোন শব্দ আছে? থাকলে এটার অর্থ কী?

ভদ্রলোক তখন থেকে বকাবকি করে যাচ্ছেন আমাকে, আমার একজীবনে আমি এত গালি খাই নি। কিন্তু ভালো লাগছে, বেশ ভালো লাগছে। মিথ্যা কথা খুব সুন্দর শোনায়, কিন্তু অপ্রিয় সত্যি কথা শুনলে সবার খারাপ লাগে, পেটের ভেতর গুড়গুড় করে। আমার করছে না কেন কে জানে?

অনেকক্ষণ কথা বলে বোধহয় হাঁপিয়ে গেছেন ভদ্রলোক, চুপ করে গেছেন তিনিও। বাইরে উথালপাথাল জোছনা। খোলা জানালা দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।

শোন ছেলে, এতক্ষণে একটা ভদ্র সম্বোধন করলেন তিনি, আমি বারবার আসতে পারবো না, কষ্ট হয়। আজ এসেছি, অনেক ঝামেলা করে। তোমাকে সাবধান করতে এসেছি। এভাবে তুমি বেশিদিন চালাতে পারবে না, কেউই বেশিদিন পারেনি। ভাল কিছু লেখার ক্ষমতা তোমার নেই, সেটা জানি, তোমার মাথার খুলিটা ভাঙলে সেখান থেকে বের হবে বাসী গু। এখনই গন্ধ আসছে, তুমি পাচ্ছ না?

এমন নির্মম সত্যি কথা কেউ কোনদিন আমাকে বলেনি। আমি হাসিমুখে চুপ করে রইলাম।

ভাবছ, এই বুড়ো এসেছে, আমাকে আজেবাজে কথা শোনাচ্ছে, এদিকে আমার উপন্যাসটা শেষ করতে হবে, আরেকটা অখাদ্য উপন্যাস। কিন্তু এবার থামো, অনেক তো হয়েছে। ভাল কিছু লিখতে না পারো, খারাপ লিখ না, আমার খুব কষ্ট হয়।

আপনার কষ্ট হয়? সেটা কীরকম?

কীরকম তুমি কী করে বুঝবে? তুমি কি লেখক? তুমি তো একটা চোর। লেখকের কষ্ট শুধু লেখক বোঝে। চোর বোঝে চোরের কষ্ট।

আপনি আমাকে কী করতে বলেন?

লেখালেখি ছেড়ে দাও। তোমার লেখালেখি করার কোন অধিকার নেই।

বলেন কী? লেখালেখি আমার রুটিরুজি।
লেখালেখি করা তোমার রুটিরুজি নয়, মোটেই নয়। তোমার দরকার দুটো বলদ, যেগুলো দিয়ে গ্রামে গিয়ে হালচাষ করবে।

আমি জবাব দিলাম না। ছোটবেলায় যখন পরীক্ষায় খারাপ করতাম, তখন মা ঠিক এই কথাই বলতেন।
শোন, সবাই লেখার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় না, কিছু কিছু “Gifted” লোক লিখতে পারে। যে পারে না, সে বসে বসে এইসব অখাদ্য লিখবে, এটা আমি সহ্য করবো না। আমার কথা আমি বলে গেলাম, তুমি কী করবে তুমি ঠিক করো। আমি এখন যাবো।
যাবেন?

হ্যাঁ। এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারো? খুব ঠাণ্ডা পানি। সেটাতে গুণে গুণে তিনটা আইস কিউব দেবে।
আমি লেখকের নির্দেশমতো পানি এনে দিলাম। তিনি গ্লাস খালি করে একটা আইস কিউব তুলে নিলেন, তারপর মুখে পুরে চুষে খেতে লাগলেন, যেমনটা ছোট ছেলেমেয়েরা করে। বয়স হয়ে গেছে, তিনি এখনো আছেন শিশুর মতোই।

যাই। মনে রেখো, মৃত মানুষ কখনো মিথ্যে বলে না।
তিনি বিদায় নিলেন। দূরে তাঁর ছায়া মিলিয়ে যাচ্ছে। মৃতদের ছায়া পড়েনা, এটা ঠিক নয়।

আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। তারপর ফিরে গেলাম নিজের লেখার টেবিলে, উপন্যাসটা শেষ করতে হবে।

পুনশ্চঃ
না, আমি লেখার টেবিলে ফিরে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু অসমাপ্ত উপন্যাসটা অসমাপ্তই রয়ে গেল। আমি সেটাকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেললাম, নিজের বাড়ির লনে। চোখের সামনে নিজের সৃষ্টি পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, ব্যাপারটার মধ্যে একটা উচ্চমার্গীয় গন্ধ আছে।
আর আমার বেস্টসেলার বইটা? সেটা বাজার থেকে উঠিয়ে নিয়েছি।

সেদিনের পরে আর এক লাইন লেখাও আমার কলম থেকে বের হয় নি। মোতাহার খুব হৈচৈ করেছে, আরে, আপনি কি আমাকে পথে বসাবেন নাকি? আমার পাবলিকেশনের জিনিসপত্র সেরদরে বেচে দিতে হবে। তারপর থালা নিয়ে রাস্তায় নেমে সুর করে ভিক্ষা করবো, “দয়া কইরা দুইডা ট্যাকা কইরা যান গো দান, আমার আল্লাহ নবীজির নাম। আখেরাতে সওয়াব পাইবেন পাহাড় সমান … …” অদূর ভবিষ্যতের কল্পচিত্র দাঁড় করিয়ে ফেলেছে সে।

আমি কোন কথাতেই কান দিই নি; যদিও আমার মধ্যে আবেগের ব্যাপার কখনোই ছিল না, আমি ছিলাম পুরোদস্তুর ব্যবসাদার লেখক, কিন্তু প্রয়াত লেখকের গালিগালাজ শুনে মনটাই বদলে গেছে। কে জানে, আমার লেখা বন্ধ হবার কারণে কোন তরুণ লেখকের কপাল হয়তো খুলে গেছে, ঠিক যেমন বহুদিন আগে আমার কপাল খুলে গিয়েছিল। কোন এক গভীর রাতে কি তার বাড়িতেও মৃত লেখকের আত্মা হানা দেবে?

…………………………………………..(সমাপ্ত)…………………………………….

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত