চুড়ি

চুড়ি

তাঁর পুরো নাম মাওলানা হাবীবুল্লাহ বোগদাদী। জন্ম যশোরে। কেন তাঁর নাম বোগদাদী হল সেটা এক রহস্য। তাঁর জন্ম ইরাকের রাজধানী বাগদাদে হয়নি।
বাংলাদেশে অনেকের নামের শেষে জায়গার নাম দেখা যায়। ময়মনসিংহের ত্রিশালে জন্মালে নামের শেষে অনেকে ত্রিশালি যুক্ত করেন, এরকম উদাহরণ আছে। এতে নামেই বোঝা যায় তিনি কোথা থেকে এসেছেন। মাওলানা সাহেবের বাবা ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক, তিনি কেন ছেলের নামে এই পদবী যুক্ত করলেন সেটা তিনি কখনো জানতে পারেন নি, কারণ বাবা তাঁর ছয় বছর বয়সে মারা গেছেন। মা মারা গেছেন বছর বারো হয়ে গেল। এখন আত্মীয়ের মধ্যে আছেন শুধু বড় চাচা, তিনি ভাইয়ের জমি ষোল আনা দখল করে বসে আছেন, সেটা নিয়ে তাঁর কোন বিকার নেই; এমনকি তাঁর সাথে মাঝে মাঝে চিঠি চালাচালি হয়, সেসব চিঠিতে তিনি গ্রামের অবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি মাওলানা সাহেবকে বেশ স্নেহ করেন, সাধারণত এক ভাই আরেক ভাইয়ের সম্পত্তি দখল করে নিলে যেমন দা-কুমড়ো সম্পর্ক থাকে তেমন নয়। বছরে দুবছরে একবার তিনি সেখানে যান, চাচা খুব যত্ন করেন, শুধু জমিজমা আর বাড়িঘরের কথা তোলেন না, যেন কিছুই ঘটেনি। এই অতি ধূর্ত লোকটি, যে মাওলানা সাহেবকে আক্ষরিক অর্থেই পথে বসিয়ে দিয়েছে, তাকে দেখতে যাওয়ার মধ্যে একটা অস্বস্তি কাজ করে মাওলানা সাহেবের, কিন্তু তবুও তিনি যোগাযোগ রাখেন।

খালিশপুর উপজেলার খাতুনগঞ্জ একটা গ্রাম। অনেকটা ভেতরে, সদর এখান থেকে বিশ কিলোমিটার। যেতে হয় ভ্যানগাড়িতে, কাঁচা রাস্তা, কাজেই যেতে দু-তিন ঘণ্টা লাগে। গ্রামের বুক চিরে চলে গেছে ছোট্ট একটা খাল, সেটাতে হাত বিশেকের বেশি পানি কখনোই থাকে না। বর্ষায় এখানে কোথা থেকে ভেসে আসে প্রচুর মাছ, খলসে, সরপুঁটি, নলা আরও কত কী। ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে জেলেরা, এমনকি সাধারণ মানুষও ঝাঁকিজাল নিয়ে নেমে যায়। বর্ষা শেষে কর্পূরের মতো যেন উবে যায় মাছগুলো। খালের নাম ঝিলিমিলি। অদ্ভুত নাম। হয়তো সূর্যের আলোতে পানি ঝিলমিল করে বলেই এই নাম। কে এই নাম দিয়েছে কেউ জানে না।

খাতুনগঞ্জের লোকসংখ্যা সাকুল্যে এক-দেড় হাজার। বেশিরভাগ লোক চাষবাস করে। সবাই মোটামুটি দরিদ্র। অবস্থাপন্ন লোকের মধ্যে আছে শুধু বল্টু মেম্বার। একজন বয়স্ক সম্মানী লোকের নাম কখনো নাটবল্টু টাইপের হয় না। কিন্তু এই নামেই সবাই তাকে চেনে এবং পরিচয় দেয়। বল্টু মেম্বারের সেটা নিয়ে কোন ক্ষোভ নেই, বরং তিনি বেশ খুশি বলেই মনে হয়।

বল্টু মেম্বার অতি পাখোয়াজ ব্যক্তি, তার অপকর্মের সংখ্যা নেই। রিলিফের গম চুরি তো অনেক ছোট মানের কাজ, তিনি পুকুর চুরিতেও সিদ্ধহস্ত। সিদ্দিক মিয়ার তিন বিঘা জমি তিনি এমনভাবে মেরে দিয়েছিলেন যে, টিপসই দেবার দু’বছরেও সেটা সিদ্দিক মিয়া জানতে পারে নি। যেদিন বুঝতে পারলো সেদিন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো, কিন্তু কিছু করার ছিল না। টাকাপয়সা মানুষের স্বভাব নষ্ট করে, বল্টু মেম্বারেরটা বেশি করে করেছে, তার চরিত্রের দোষ সর্বজনবিদিত। অল্পবয়সী মেয়েদের পিতামাতা খুব ভয়ে ভয়ে থাকেন, কারণ বল্টু মেম্বারের চোখ পড়লে সর্বনাশ। কত মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে, কিন্তু কেউ বল্টু মেম্বারের গায়ে একটা টোকাও দিতে পারেনি, কারণ পুলিশে তার বিস্তর জানাশোনা, ওসি সাহেব এসে চা-বিস্কুট খেয়ে চলে যান। এখন তার বাড়িতে দুই বউ, তারা সারাদিন চুল ছিঁড়াছিঁড়ি করে। শোনা যাচ্ছে যে সে আরেকটা বিয়ে করতে যাচ্ছে। যেকোনো সালিশে বল্টু মেম্বারের সুচিন্তিত অভিমত ছাড়া চলে না, সব অনুষ্ঠানে তাকে দাওয়াত করা বাধ্যতামূলক। তার চোখ এড়িয়ে গ্রামে কোন কাজ হয় না, এমনকি একটা পাখিও উড়তে পারে না। একজন মেম্বার কী করে এমন ক্ষমতা পেলেন সেটা একটা জিজ্ঞাসার বিষয়, নিশ্চয়ই পাণ্ডববর্জিত গাঁ বলেই।

তবে বল্টু মেম্বার খুব ধর্মভীরু মানুষ। পাপী মানুষদের ধর্মভীরু হতে হয়, পাপ কাটান দিতে হবে না? বছরে একবার তিনি উপজেলার সব মৌলভী সাহেবদের একসাথে ডেকে খাওয়ান। গরুছাগল জবাই করে একটা হুলুস্থুল কাণ্ড করা হয়, গ্রামে উৎসবের মতো হয়। পুরো গ্রামের লোককেও খাওয়ানো হয়, তারপর সব হুজুরের সাথে মিলে বল্টু মেম্বার জিকিরে বসেন। চোখের পানিতে তখন তার বুকের কাপড় ভিজে যায়, তাকে দেখলে যে কেউ বলবে এ তল্লাটে তার মতো পরহেযগার কজন আছে? এভাবে বছরে একবার তিনি পাপ কাটান দেন। তারপর নতুন করে পাপ করেন। শুধু পাপ করলে হবে কেন, কিছু কাটান দিতে হবে।

পাপ কাটান দেওয়ার জন্য বল্টু মেম্বার নানাকিছু করেছেন। মসজিদ ঘরটা তাঁরই করে দেয়া, আগে কাঁচা ছিল, এখন পাকা দেয়াল হয়েছে, নতুন টিনের ছাদ, ফুটো দিয়ে পানি পড়ে না। গতবছর পাকা মিম্বর বসিয়েছেন। শোনা যাচ্ছে, মাইকও চলে আসবে। টাকায় কী না হয়, বাঘের চোখও মিলে যায়। মাওলানা হাবীবুল্লাহ বোগদাদী এই মসজিদের ইমাম, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ান। তাঁর বেতন আসে বল্টু মেম্বারের কাছ থেকে।

মাওলানা সাহেবদের প্রতি বল্টু মেম্বারের বিশেষ মহব্বত ও টান আছে, তিনি তাঁদেরকে বিশেষ খাতির করেন। টাকাপয়সা দিতে কার্পণ্য করেন না। গেলবছর মাওলানা সাহেবকে তিনি নতুন লেপ বানিয়ে দিয়েছেন, নিজের খরচে। আল্লাহওয়ালা মানুষকে একটু খাতির যত্ন। তীব্র শীত কোন দিক দিয়ে গেছে টেরই পাওয়া যায় নি। মসজিদের পাশেই একটা ছোট ঘর আছে ইমাম সাহেবের, সেটাও মেম্বারের করে দেয়া। ইমাম সাহেব দরিদ্র মানুষ, চিটাগাং মাদ্রাসা থেকে কপর্দকশূন্য অবস্থায় এখানে এসেছিলেন, মেম্বার ঘর না করে দিলে মসজিদেই ঘুমোতে হতো।

মাওলানা হাবীবুল্লাহ সাহেব ব্যক্তিগতভাবে বল্টু মেম্বারকে মোটেও পছন্দ করেন না, কিন্তু এলাকায় কারো ঘাড়ে দুটো মাথা নেই যে মেম্বারের দিকে চোখ তুলে কথা বলবে। সবাই লোকটার সামনে এসে কেমন ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়, মাওলানা সাহেবও চুপসে যান। এ কারণে মনে মনে নিজেই শরমিন্দা বোধ করেন, মানুষের সামনে এতটা নীচু হওয়া ঠিক না। মানুষ শুধু নিচু হবে আল্লাহপাকের সামনে। কিন্তু মাওলানা সাহেবের সুবিধা-অসুবিধার দিকটা এই মেম্বারই খেয়াল রাখেন। তাঁর তিনবেলার খাবার মেম্বারের বাড়ি থেকে আসে।

সকাল হয়েছে। সূর্য আস্তে আস্তে মাথার উপরে উঠে আসছে। সকালে কোরআন তিলাওয়াত শেষে মাওলানা সাহেব একটু হাঁটতে বের হন, এতে সকালের সুন্দর বাতাসটা পাওয়া যায়। সকালের এই মৃদু বাতাস আল্লাহপাকের একটা রহমত।

কৃষকেরা ব্যস্তসমস্ত হয়ে হালের বলদ নিয়ে মাঠে যাচ্ছে। ঐ তো ময়েজুদ্দিনকে দেখা যাচ্ছে, মাথায় গামছা বাঁধা, একটা ছেঁড়া গেঞ্জি পরনে। তাঁর সামনে দিয়েই চলে গেল, বলল, সালাম ইমাম সাব। গরুর পশ্চাৎদেশে লাঠির বাড়ি দিল, লেজ ধরে টান দিল।

ইমাম সাহেব বললেন, ওয়ালাইকুমুস সালাম। মনে মনে বললেন, সালাম এভাবে দিতে হয় না, বলতে হয় আসসালামু আলাইকুম। এক সালামে পাওয়া যায় দশ নেকী। কিন্তু গ্রামের লোককে এসব বলে লাভ নেই। তারা সওয়াব-গুনাহ, আখেরাত-কেয়ামত নিয়ে চিন্তা করেনা, সবাই দুনিয়ার পাবন্দী করছে। কখন গরুকে ঘাসবিচালি দিতে হবে, কখন ক্ষেতে পানি না দিলে চারা শুকিয়ে যাবে, এসব নিয়েই দিনরাত পড়ে আছে। কী করলে আল্লাহপাক রাজিখুশি হবেন সেটা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। শেষজামানা উপস্থিত, অবস্থা আরও খারাপ হবে। আল্লাহপাকের নাম নেয়ার লোক দিনে দিনে কমে যাচ্ছে।

ঝিলিমিলির পাড় ধরে কিছুক্ষণ হাঁটলেন ইমাম সাহেব। নাদান মানুষজন খালের পাড়ে প্রাতঃকৃত্য সেরে রেখেছে, এদের জ্ঞানবুদ্ধি কবে হবে? মানুষের অভ্যাস বদলাতে চায় না। বাড়িতে পাকা পায়খানা থাকলেও তারা রাতবিরেতে বদনা নিয়ে হাঁটা দেবে বালুর চরার দিকে, খালের পাড়ের দিকে, মৃদুমন্দ বাতাস গায়ে লাগাতে লাগাতে কাজ সারবে। দেয়াল ঘেরা টাট্টিখানায় নাকি তাদের দম বন্ধ হয়ে আসে।

কাঁচা রাস্তায় ভটভট আওয়াজ তুলে একটা মোটর সাইকেল এদিকে আসছে। কার হোন্ডা, বলতে হয় না, বল্টু মেম্বারের। এই গ্রামের একমাত্র যান্ত্রিক বাহনটির অধিকারী তিনি। তাঁর মতো মানুষ সাধারণ লোকের মতো পায়ে হেঁটে কিংবা ভ্যানগাড়িতে যাতায়াত করবেন, এটা ভাবাই যায় না। তাই তিনি সদর থেকে সিঙ্গার কোম্পানির পঞ্চাশ সিসির হোন্ডাটি আনিয়েছেন। যেদিন এটা কেনা হয়েছিল, সেদিন মিলাদ পড়িয়ে লোক খাওয়ানো হয়েছিল।

মেম্বার সাহেব প্রায়ই সকাল সকাল সদরে যান, বিভিন্ন লোকের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়। আজও যাচ্ছেন। তাঁর হোন্ডায় যাতায়াত একটা দেখার মতো বিষয়, সামনে একজন বসে বাইকটা চালায়, তার নাম মফিজ, গুন্ডা টাইপের ছেলে, খুনখারাপিতে সিদ্ধহস্ত। সে রোদবৃষ্টি সবকিছুতেই চোখে সানগ্লাস পড়ে বাইক চালায়, নিজেকে পরিচয় দেয় মেম্বার সাহেবের “ডেরাইভার” বলে। মাঝখানে বসেন মেম্বার সাহেব নিজে। পেছনে বসে আরেকজন, নাম দবির। তার কাজ মেম্বার সাহেবের মাথায় ছাতা ধরে রাখা এবং তিনি যাতে পড়ে না যান সেদিকে খেয়াল রাখা। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামের লোক আঙুল উঁচু করে দেখিয়ে বলে, “ঐ দ্যাখ, বল্টু মেম্বার যাইতাছে।” এই অতি দুর্বল গড়নের দ্বিচক্রযানটি কী করে তিনজনকে বহন করে, সেটা এক রহস্য।

মাওলানা সাহেবের সামনে এসে হোন্ডা স্লো করা হল, মেম্বার সাহেব হাসিমুখে বললেন, আসসালামু আলাইকুম।

ওয়ালাইকুমুস সালাম।

কেমন আছেন ইমাম সাব?

আলহামদুলিল্লাহ, ভাল।

সদরে যাইতাছি। একজন বিশিষ্ট লোকের সাথে বাহাস করতে হইব। আমার পিছনে লাগছে, শায়েস্তা করন লাগবো। কী যে সমস্যা, শরীরটা খারাপ, কিন্তু “রেস” নেওয়ার উপায় নাই। সকাল থেইকা কয়েকবার দাস্ত হইছে, কিন্তু ঘরে বইসা থাকলে চলব ক্যান?

ঠিক কথা। আপনি ব্যস্ত ব্যক্তি।

দোয়া রাইখেন।

মাওলানা সাহেব হাসলেন, কিছু বললেন না। এই লোকের সব কাজই সন্দেহজনক, দোয়া রাখা ঠিক হবে কীনা তিনি বুঝতে পারছেন না।

আপনারে একটা কথা কই, ইমাম সাব, গলার স্বর নিচু করলেন বল্টু মেম্বার। রাইতে একটা খারাপ খোয়াব দেখছি। দেখি একটা মেয়েছেলে আমারে দাও দিয়া কোপাইতাছে। কপাল চিচিং ফাঁক। গলগল কইরা রক্ত বাইর হইতাছে। মেয়েছেলের বয়স পনেরো ষোল, বড়ই সুন্দর। মাথায় ঘোমটা, পরনে রাঙ্গা শাড়ি। দুই হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি, এক একটা কইরা কোপ দেয়, আর চুড়ি রুনঝুন শব্দ কইরা বাজে। এই খোয়াবের কী তাবির কন তো?

ইমাম সাহেব বললেন, দুঃস্বপ্ন কাউরে কইতে হয় না, মেম্বার সাব। আর দেখলে বামদিকে তিনবার থুথু ফেইলা আল্লাহপাকের কাছে শয়তান থেইকা পানাহ চাইতে হয়।
রোজ রাইতে এই একই খোয়াব দেখতাছি, এর নিশানাটা কী?

নিশানা বলা খুবই কঠিন। স্বপ্নের অনেক মানে হয়, সঠিক মানে আমার মতো নাদান ব্যক্তি বলতে পারবে না। আপনে আল্লাহ-বিল্লাহ করেন।

অবশ্যই, অবশ্যই। ধইন্যবাদ, ইমাম সাব। মেয়েছেলের খোয়াব, বড়ই চিন্তার বিষয়। পরিবারের সাথে আলাপ করি নাই, শুধু আপনেরেই কইলাম। মেয়েছেলে এইসব খোয়াবের অন্য অর্থ করবো। আসি ইমাম সাব।
মেম্বারের হোন্ডা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বিকট শব্দ তুলে চলে গেল। যন্ত্রটির গতির তুলনায় শব্দ বেশি, সারা গ্রামের মানুষ জেনে যায় যে বল্টু মেম্বার যাচ্ছে।
মাওলানা সাহেব নিজের ঘরের পথ ধরলেন। চিন্তা করছেন। মেয়েছেলের খোয়াব? হু, মেম্বারের চিন্তা কখন কোন মেয়ের সর্বনাশ করা যায়, তাই হয়তো খোয়াবে মেয়েছেলে দেখতেছে। অনেক পাপ হইছে তার, পাপের সাজা পাইতে হবে না? পাপ বাপেরেও ছাড়ে না। এখন খোয়াব দেখতেছে, হয়তো এইভাবেই কারো হাতে খুন হইয়া যাবে। স্বপ্নের মানে করা কঠিন, খুবই কঠিন। মাথায় ঘোমটা দেয়া লাল শাড়ি পড়া মেয়েছেলে? দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। শরিফার কথা মনে পড়লো। হ্যাঁ, তাঁর স্ত্রী ছিল একসময়। পনেরো বছর বয়সের বালিকা বধূ। বিয়ের রাতের কথা মনে পড়ে তাঁর, তিনি নওশার সাজ পড়ে ঘরে ঢুকে দেখেন, শরিফা খাটের ওপর জড়সড় হয়ে বসে আছে। তিনি এসে বসতেই সে আরও দূরে সরে বসলো। তিনি আলাপ পরিচয় করার চেষ্টা করলেন, কোন কথারই সে জবাব দেয় না। এক সময় তিনি চুপ করে গেলেন। স্বামী স্ত্রী পাশাপাশি চুপচাপ বসে আছে, অস্বস্তিকর পরিবেশ। একসময় তিনি খেয়াল করলেন, শরিফা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, শরিফা, আমার সাথে বিবাহ হওয়াতে তুমি কি কষ্ট পাইছো? আমি অতি দরিদ্র মানুষ, কষ্ট পাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু উপায় কী? কার সাথে কার মিল হবে এইটা আল্লাহপাক ঠিক কইরা রাখছেন, তোমার আমার কোন হাত নাই।

সাথে সাথেই কান্না থেমে গেল শরিফার। ঘোমটা সরিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকাল সে। মাওলানা সাহেব অবাক হয়ে গেলেন, এত সুন্দর মানুষ হয়? কী গভীর মায়াময় দুটি চোখ। সুবহানাল্লাহ। অনেকক্ষণ পরে টের পেলেন, তিনি হাঁ করে নবপরিণীতা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। লজ্জা পেয়ে তিনি নিজেই চোখ সরিয়ে নিলেন, শরিফা তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। বাসরঘরে স্বামী মাথা নিচু করে বসে আছে, আর স্ত্রী তাকিয়ে আছে, এমন ঘটনা বোধহয় আর ঘটেনি। তিনি আবার চোখ তুললেন, আর শরিফা খিলখিল করে হেসে ফেললো। কী সুন্দর সেই হাসি!

বিয়ের দেড় বছরের মাথায় শরিফার কোল আলো করে এলো মায়া, তাঁদের মেয়ে। মায়া নামটা শরিফার দেয়া। মাওলানা সাহেব আপত্তি করেছিলেন, মায়া? এইটা কেমন নাম? একটা সুন্দর নাম দেয়া উচিৎ, মুসলমান নাম দেওয়া লাগবো। আমি নাম দিলাম মোসাম্মাৎ রুকাইয়া বেগম।

শরিফা বলল, রুকাইয়া নাম আপনে দিছেন, কিন্তু আমি ওরে মায়া বইলাই ডাকবো।

সত্যি, শিশুকন্যাটি খুব মায়াবতী ছিল। হাত পা নেড়ে খেলা করতো, মাঝে মাঝে হাসতো, অবিকল শরিফার মতো খিলখিল করে হাসি। গায়ের রং ছিল শরিফার মতো, নাকমুখও শরিফার মতো। মাওলানা সাহেব কোলে নিলেই শুধু কাপড় ভিজিয়ে দিত, আর শরিফা হাসত। মাওলানা সাহেব একজীবনে যতকিছু দেখেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হল তাঁর বালিকা বধূ মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছে। তিনি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতেন, শরিফা বলতো, এমন কইরা কী দেখেন? বড় সুখের সময় ছিল তখন।

কিন্তু নিউমোনিয়া হয়ে মেয়েটা মারা গেল। ডাক্তার আনতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল তাঁর, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শ্বাসকষ্টে নীল হয়ে গেল মেয়েটার ছোট্ট শরীরটা, অসহায় পিতা চেয়ে চেয়ে দেখলেন; ডাক্তার সদরে বসেন, বহুদূরে, যানবাহনের ওভাবে হাসপাতালে নিতে পারলেন না। মেয়ের শোকে পাগলপ্রায় হয়ে গেল শরিফা, তিনদিন পানি পর্যন্ত স্পর্শ করলো না। ইমাম সাহেব বোঝালেন, আরও সবাই বোঝাল, কোন কাজ হল না। ইমাম সাহেব বলেছিলেন, শরিফা, আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়া গেছেন, তুমি এমন কইরা না খাইয়া বইসা থাকলে চলব ক্যামনে?

শরিফা তাকাল তাঁর দিকে, বলল, বাপ হইয়া আপনে এমন কথা কইলেন?

মাওলানা সাহেব চুপ করে রইলেন।

শরিফা উঠে বসলো, আবার আগের মতো কাজ করতে লাগলো, কিন্তু মাওলানা সাহেব দেখলেন, কোথায় যেন গোলমাল হয়ে গেছে, সুখের সংসারে সেই আগের মতো সুখ নেই। শরিফা সংসারের কাজ করে, কিন্তু দরকার ছাড়া একেবারেই কথা বলে না। একটা চাপা কষ্ট নিয়ে ঘোরাফেরা করতেন মাওলানা সাহেব, বুঝতে পারতেন, তাঁর স্ত্রী মৃত সন্তানের কথা ভেবে কতটা কষ্ট পাচ্ছে। সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করতেন, কিন্তু শরিফা যেই নির্বাক সেই নির্বাকই রয়ে গেল।

তবে বেশিদিন নয়, চৈত্রের এক রাতে গা কাঁপিয়ে শরিফার জ্বর এলো, সারারাত প্রলাপ বকতে লাগলো সে। আমার মায়া কই, আমার মায়া?

মাওলানা সাহেব অস্থির হয়ে পড়লেন, মাথায় জলপট্টি, আকন পাতার সেঁক, জইনের গুঁড়া কিছুতেই কিছু হল না। শরীর আগুনের মতো গরম। এত রাতে ডাক্তার পাবেন কোথায়?

শেষরাতের দিকে শরিফার গা এলিয়ে পড়লো, মাওলানা সাহেব লক্ষ করলেন, তাঁর হাতে ধরা শরিফার হাত ক্রমে শীতল হয়ে আসছে।

সেই গ্রামেই স্ত্রী-কন্যার কবর রেখে এসেছেন, সেখানে আর মন বসে নি। এখন বহুদূরের এই গ্রামে বাস করেন, বল্টু মেম্বার প্রায়ই বলেন একটা বিয়ে করতে, কিন্তু তিনি রাজী হননি। বয়স হয়ে গেছে, তাছাড়া কোন মেয়ে কি শরিফার জায়গা নিতে পারবে?

হ্যাঁ, শরিফারও দুই হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি ছিল, সে যখন চলাফেরা করতো, তখন রুনঝুন শব্দ পাওয়া যেত। বড় ভালো লাগতো মাওলানা সাহেবের। এখনো চোখ বুজলে শুনতে পান মাওলানা সাহেব। বল্টু মেম্বার কাকে স্বপ্নে দেখেছে? বিস্তারিত জিজ্ঞেস করতে হবে।

এশার নামাযে মুসল্লি বরাবরই কম হয়, আজকের অবস্থা দেখে মাওলানা সাহেবের মন আরও খারাপ হল। মাত্র পাঁচজন মুসল্লি। অশীতিপর বৃদ্ধ মজনুর বাপ রোজ আসে, আজ আসে নি, পাশা খেলার আসরে বসে পড়েছে। লোকজনের মন ইবাদত-বন্দেগী থেকে উঠে যাচ্ছে, সে স্থানে আসছে সব নাজায়েজ কাজ। এমনটাই হবে, শেষ জামানায় ভালো ভালো সব উঠে যাচ্ছে, খারাপ জিনিসে দুনিয়া সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। খুব খারাপ সময় এসেছে, খুব খারাপ। ফজরের নামায তো কখনো কখনো একাই পড়তে হয়, মোরগ যখন আজান দেয়, সৃষ্টির সেরা জীবগুলো তখন ঘুমে অচেতন।

আরও লোকজনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন মাওলানা সাহেব, বিরক্ত গলায় তাড়া দিল একজন, নামায শুরু করেন, ইমাম সাব।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। আল্লাহর ঘরে বসে থাকাও সওয়াবের কাজ, সেটাও লোকগুলো করতে চাইছে না। তিনি নামাযে দাঁড়ালেন। এমনিতে নামাযে দীর্ঘ সূরা পড়েন তিনি, আজ সংক্ষিপ্ত করলেন। লোকের বিরক্তি নিয়ে ইবাদাত করা ঠিক না।

নামাযের শেষে পাঁচ-দশ মিনিট তিনি কোরআন হাদিসের কথা বলেন, কিন্তু আজ সবাই যেন বাড়ি ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। তিনি আজ আর তেমন কথা বলতে পারলেন না।

রাতের রান্না চড়িয়ে দিয়েছেন মাওলানা সাহেব, আলুভর্তা, ডাল আর ছোটমাছ দিয়ে ভাত। রান্নার হাত খারাপ নয় তাঁর, কিন্তু একজন নারীর হাতের রান্নার মতো কি আর হবে? শরিফার হাতের রান্না ছিল অমৃত।
ডালে বাগাড় দিতে দিতে ভাবেন মাওলানা সাহেব, আজ শরিফার কথা এত মনে পড়ছে কেন? বল্টু মেম্বারের স্বপ্নের কথা শুনেই কি?

খেতে খেতে ভাবলেন তিনি, এই রিজিক তো আল্লাহপাক জুগিয়েছেন। তিনি অতি ক্ষুদ্র পিপীলিকা থেকে বৃহৎ তিমিমাছেরও খাদ্য জোগান দেন, মানুষের তো বটেই। এই যে তিনি হাবীবুল্লাহ বোগদাদী বসে বসে তৃপ্তির সাথে খাচ্ছেন, এই খানাও আল্লাহপাকের ইশারায় এসেছে, ইশারা না থাকলে না খেয়ে থাকতে হতো। তারপরও আমরা নাদান বান্দা শোকর আদায় করি না। বড়ই আফসোস।

মাদ্রাসা জীবনের কথা মনে পড়ে তাঁর, বড় কষ্টের সময় ছিল। ভোররাতে ঘুম থেকে উঠতে হতো, ছোট ছোট ছেলেগুলো উঠতে চাইতো না, ঘুমাতে চাইতো। কিন্তু বেতের বাড়ি খেয়ে উঠতেই হতো। কয়েক সবক মুখস্ত করে হুজুরের কাছে পড়ে শুনাতে হতো। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম, শুধু পড়াশোনা, খেলাধুলা নামেমাত্র। মাদ্রাসার পড়া অনেক বেশি, মুখস্ত করতে করতে জান কাবার হয়ে যেত। খাওয়ার কষ্টটা ছিল সবচেয়ে বেশি, সবদিনই ভাত আর ডাল, সাথে কচু দিয়ে পানি পানি করে রান্না করা তরকারী। মাছ পাওয়া যেত কালেভদ্রে। ভাতের চালটাও ভালো ছিল না, অনেক মোটা।
অনেকের শরীরই ভেঙে গিয়েছিল দিনের পর দিন এসব খেয়ে। বাড়ন্ত শরীরে বেশি খাবারের দরকার হয়, সেখানে তা ছিল না।

মাওলানা সাহেব ছিলেন মেধাবী ছাত্র, তিনি প্রায়ই সবার আগে পড়া দিতেন। মরহুম ওস্তাদ কেরামত আলী তাঁকে বড় স্নেহ করতেন। তাঁর মাথায় হাত রেখে দোয়া করেছিলেন, তুই একদিন অনেক বড় আলেম হবি। তোর কণ্ঠ হবে অতি সুমিষ্ট। তোর কেরাত শুনে লোকজন চোখের পানি ফেলবে। এই মাদ্রাসার জীবন অনেক কষ্টের, কিন্তু এখান থেকে তুই অবশ্যই কিছু না কিছু অর্জন করে নিয়ে যাবি। ওস্তাদের কথা শুনে চোখে পানি এসে গিয়েছিল তাঁর।

মরহুম ওস্তাদের দোয়া বিফলে যায় নি। তিনি এখন একজন হাফেজ এবং ক্বারী। কণ্ঠ অতি সুমিষ্ট। কোরআন হাদিস থেকে গড়গড় করে উদ্ধৃতি দিতে পারেন। তাঁর কেরাত শুনে জুমার নামাযে বল্টু মেম্বারের মতো অতি পাপী লোকও চোখের পানি ফেলে। এখন তাঁর খাওয়াদাওয়ার কষ্ট নেই। আল্লাহ রিজিক দেনেওয়ালা। আর তিনি যে তৃপ্তি করে খেতে পারেন, বল্টু মেম্বার কি আর সেভাবে খেতে পারবে? তিনি শুনেছেন, “বিশেষ জিনিস” ছাড়া আর কিছুই হজম করতে পারেন না বল্টু মেম্বার, আর দিনে তিনবার দাস্ত হয়, সাথে টক ঢেঁকুর ওঠে। দিনে দুইবারের বেশি যার দাস্ত হয়, সে ব্যক্তি রোগী বিবেচ্য।

শোয়ার বন্দোবস্ত করছেন মাওলানা সাহেব। তক্তপোষে চাদরটা বিছিয়ে শুয়ে পড়েছেন। খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে। বন্ধ করে দিতে হবে। মাওলানা সাহেব আয়াতুল কুরসি পড়লেন, এই দোয়া ঘুমের আগে পড়লে শয়তান সারারাত কাছে আসতে পারে না। ডানকাত হয়ে গালের নিচে হাত দিয়ে ঘুমোতে হবে।
তিনি জানালা বন্ধ করে দিতে যাবেন, এমন সময় তাঁর চোখে পড়লো জিনিসটা।

জিনিস নয়, একটা মানুষ। মেয়েমানুষ। দীর্ঘাঙ্গী। পরনে লাল শাড়ি। মাথায় ঘোমটা। দুই হাত ভর্তি চুড়ি, হাঁটার সাথে সাথে টুংটাং আওয়াজ তুলছে। এতরাতে কে যায়? মেয়েটার চলার সময় শুকনো পাতায় খসখস আওয়াজ হচ্ছে, সে কোনদিকে চাইছে না। খালের দিকে যাচ্ছে। কোন বাড়ির মেয়ে এটা? এতরাতে তো কেউ বের হয় না।

চোখের ধান্দা না তো? চোখ কচলালেন তিনি। না, ঠিকই দেখছেন।

ইমাম সাহেব ডাক দিলেন, কে? কে যায়?

মেয়েটা থমকে দাঁড়ালো, পেছনে ফিরল। তাঁর দিকে তাকালেও মুখ ঢাকা, চেহারা দেখতে পেলেন না তিনি।
কে যায় গো? আবার শুধোলেন ইমাম সাহেব।
মেয়েটা জবাব দিল না। হঠাৎ ঘুরে যেদিকে যাচ্ছিল সেদিকে দ্রুতপায়ে চলে গেল। পিছু নেবেন কিনা ভাবলেন তিনি, কিন্তু সাহস হল না। অন্য কেউ দেখলে খারাপ কথা রটাতে পারে। তাজ্জব হয়ে বসে রইলেন। কে? এত রাতে ঐদিকে যাচ্ছেই বা কেন? কথার জবাব দিল না কেন? আরও আজব ব্যাপার হল, মেয়েটার গড়ন হুবহু শরিফার মতো।

ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার চেষ্টা করলেন তিনি, জালা থেকে এক গেলাস পানি ঢেলে খেয়ে ফেললেন। ভয় লাগছে তাঁর, হাতের তালু ঘামছে। ওদের কেউ নয় তো? ভূতপ্রেত না থাকতে পারে, কিন্তু জিন তো আছে। পাক কোরআনে জিনের কথা আছে। কোন কোন জিন খুব বদস্বভাবের হয়, মানুষের ক্ষতি করে। তিনি দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলেন। তার মধ্যেও কেন যেন মনে হল, শরিফার মতো দেখতে এই মেয়েটার কোন উদ্দেশ্য আছে। আর কেউ কি মেয়েটাকে দেখেছে? কাল সকালে জানা যাবে।

শয়তানের ওসওয়াসা হতে পারে। শয়তান মানুষের শিরায় শিরায় ঘোরাঘুরি করে। কুমন্ত্রণা দেয়াই তার কাজ। তিনি একা পুরুষমানুষ, তাঁকে কি ভোলাতে চাইছে মেয়েছেলে দেখিয়ে? খারাপ মানুষের পেছনে শয়তান লাগে না, তিনি ভালো মানুষ, অন্তত ভালো থাকার চেষ্টা করেন, তাঁকে দিয়ে কি খারাপ কিছু করাতে চাইছে? আল্লাহপাকের কাছে শয়তান ওয়াদা করেছিল, সে মানুষকে সবদিক থেকে আক্রমণ করবে। মাওলানা সাহেব একমনে আল্লাহর নাম নিতে লাগলেন।

সকাল দশটা। মাওলানা সাহেব নারায়ণের চায়ের দোকানে বসে আছেন। আরও কয়েকজন লোক বসে আছে, সবার হাতে চায়ের কাপ। নারায়ণের চায়ের সুখ্যাতি আছে, লোকে বলে, তার চা এক কাপ খেলে চায়ের অসম্মান হবে, তিন থেকে চার কাপ খেতে হয়। মাওলানা সাহেবও এদিকে এলে চা খেয়ে যান।

কয়েকজনের মধ্যে আছে বুড়ো সলিমুদ্দি, রহিতনের বাপ, আয়েজুদ্দিন এরা। গ্রামের সাধারণ মানুষ, অবসর সময়ে একসাথে চায়ের দোকানে বসে বসে রাজা উজির মারে। সব কথাই অন্য মানুষের নিন্দা, কোন লোকটা গরুচোর, কার নজরে দোষ আছে, কার কুষ্ঠ হয়ে মরা উচিৎ, এইসব। মানুষের পেছনে নিন্দা করা ঠিক না, ধর্মে নিষেধ আছে, মাওলানা সাহেব পছন্দ করেন না। কিন্তু এই লোকগুলোর একটা দিক ভালো লাগে তাঁর, এরা মুখে যা বলে তাই বিশ্বাস করে। মুখে এক আর অন্তরে আর এক, এটা এদের মধ্যে নেই, খুব দিলখোলা। মাওলানা সাহেবকে নিজেদের লোক মনে করে তারা, বাইরের কেউ মনে করে নিচু গলায় কথা বলে না। শুধু নারায়ণ লোকটা সবসময় চুপচাপ, সে ফুটো ময়লা গেঞ্জিটা পরে স্মরণাতীত কাল থেকে চা বানিয়ে চলেছে। পানিতে চা-পাতা দিচ্ছে, কাপে ঢালছে, দুধ-চিনি মেশাচ্ছে। জগতের অন্য কিছু সে জানে বা বোঝে বলে মনে হয় না।

রহিতনের বাপ বলল, ঘটনা শুনছেন ইমাম সাব?
কী ঘটনা? চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ইমাম সাহেব।

বল্টু মেম্বারের তো প্যাট নাইমা গেছে। সকাল থেইকা পাতলা পায়খানা। হ্যাহ হ্যাহ হ্যাহ। বিকট আওয়াজে হাসল রহিতনের বাপ, কালো রঙয়ের মাড়ি দেখা গেল। বল্টু মেম্বারের দুরবস্থা দেখলে সবাই খুব খুশি হয়।
ক্যান? কী হইছে?

রাইতে সে নাকি খোয়াবে একটা মেয়েছেলে দেখছে। হাতে ইয়া বড় দাও। ওনারে খুন করতে আইতাছে। সে কি চিক্কুর। ভয়ে প্যাট খারাপ। পায়খানায় যাওয়া আসা করতে করতে শরিল দুর্বল হইয়া গেছে, দুই বউ ধইরা ধইরা পায়খানায় নিয়া যায়, হ্যাহ হ্যাহ।

চায়ের স্টলে সবাই হেসে উঠলো, বল্টু মেম্বারের সামনে সবাই কেঁচো হয়ে থাকে, কিন্তু আড়ালে সবাই তাকে নিয়ে রগড় করে।

ইমাম সাহেব সোজা হয়ে বসেন। মেয়েছেলে?
জে। রাঙ্গা শাড়ি পড়া। হাত ভর্তি চুড়ি। টুংটাং। হাত নেড়ে দেখাল আয়েজুদ্দিন। সবাই আবার হেসে উঠলো।
চিন্তিত বোধ করলেন ইমাম সাহেব। আমারে তো কইছিল সে প্রতিদিন এই খোয়াব দেহে। আইজ এই অবস্থা ক্যান?

কী জানি। জিনিস মনে হয় বেশি খাইয়া ফালাইছিল, আর শরীরে নিতে পারে নাই। মেয়েছেলে দেইখা টাব্বুস।
ইমাম সাহেব উঠে পড়লেন। একবার দেখা করে আসা উচিৎ। হাজার হলেও অসুস্থ মানুষ। তাছাড়া আসল খবর না গেলে জানা যাবে না। গ্রামের মানুষজন খুব দিলখোলা হলেও অতিরঞ্জিত কথা বলতে পছন্দ করে। কারো পায়ে কাঁটা ফুটেছে, এই কথা লোকের মুখে ছড়াতে ছড়াতে হয়ে যায় মরে কি বাঁচে ঠিক নাই।
পেছন থেকে রহিতনের বাপ বলল, পাপ বাপেরেও ছাড়ে না, ইমাম সাব। এতদিনে সাজা হইতাছে।

বল্টু মেম্বারের চৌচালা সুদর্শন বাড়িটা অনেকটা জায়গা নিয়ে করা। ইমাম সাহেব বাইরে থেকে ডাক দিলেন, মেম্বার সাব ঘরে আছেন?

একজন মহিলা উঁকি দিল, মেম্বারের বড় বউ। ইমাম সাহেবকে দেখে বড় করে ঘোমটা দিল। উনার তো শরিল খারাপ। আসেন, ভিতরে আসেন।

ঘরে মোড়া পেতে দেয়া হল, তিনি বসলেন। বল্টু মেম্বার ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। এই কিরা কাইটা কইতাছি ইমাম সাব, খোয়াব না, দিনের আলোর লাহান পরিষ্কার। আমারে দাওয়ের বাট দিয়া বাড়ি দিছে, এই দ্যাহেন, হাত অখনো লাল হইয়া আছে। আমারে বাঁচান ইমাম সাব। ঐ মেয়েছেলে আমারে মাইরা ফালাইবো।

মেম্বারের কনুইয়ের কাছে সত্যিই একটা লাল দাগ। হয়তো হুটোপুটি করতে গিয়ে কিছুর সাথে গুঁতো খেয়েছে।

ইমাম সাহেব দোয়া করে দিলেন, যেন এই উপদ্রপ দূর হয়। কিন্তু মনে শান্তি পেলেন না। মনে অশান্তি নিয়ে দোয়া করলে সেই দোয়ায় তেজ থাকে না। দোয়ার মাঝখানে উঠে দৌড় দিল বল্টু মেম্বার, পেটে আবার কামড় পড়েছে, এখন তার দ্বিতীয় বাড়ি হল ছোটরুম। যখন এসে খাটে বসলো, তখন দেখে অবাক হয়ে গেলেন ইমাম সাহেব, এই দুর্ধর্ষ লোকটার মুখ এতটুকু হয়ে গেছে, কি অসহায় লাগছে বল্টু মেম্বারকে। বারবার ছোটরুমে আসাযাওয়া করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়েছে।

ইমাম সাব, আমি কি বাঁচবো? নাকি আমার দিন শ্যাষ? কাতর স্বরে বলল সে।

ছি ছি, অমন কথা কইতে হয় না, মেম্বার সাব। একটু বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করেন। সবকিছু আল্লাহপাকের হাতে। তিনি চাইলে সব সমস্যা দূর হইয়া যাইবো। ওষুধপানি খান।

তাঁর কথায় বল্টু মেম্বার খুব একটা ভরসা পেয়েছে বলে মনে হল না। আরেক দফা সাহস দিয়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। বল্টু মেম্বার তখনো বলে চলেছে, আমার দিন শ্যাষ। ঐ মেয়েছেলে আমারে মাইরা ফালাইবো … …।
রাত অনেক হয়েছে। অনেকক্ষণ যাবত নফল নামায পড়েছেন ইমাম সাহেব, একা একা তিনি এই কাজটা প্রায়ই করেন। ফরজে যেসব ঘাটতি হয়, সেসব পুষিয়ে নেয়া যায় নফল নামায দিয়ে।

নামাযের পাটিটা গুছিয়ে রেখে তিনি শুয়ে পড়বেন, খসখস আওয়াজটা তখনই কানে এলো।
হ্যাঁ, সেই মেয়েটা। আজও যাচ্ছে। তবে আজ খালের দিকে যাচ্ছে না, অন্য দিকে। এই পথ ধরে গেলে বল্টু মেম্বারের বাড়িতে যাওয়া যায়। ওদিকে কেন যাচ্ছে মেয়েটা?

আজও মেয়েটার পরনে লাল শাড়ি, হাতভর্তি কাঁচের চুড়ি শব্দ করছে, রুনঝুন রুনঝুন। বড় করে ঘোমটা দেয়া, চেহারা দেখা যাচ্ছে না। ইমাম সাহেবের ভয়টা বেড়ে উঠলো, তিনি জানালা বন্ধ করে দিলেন। অশুভ কিছু কি ঘটতে যাচ্ছে? ইয়া মাবুদ, সাহায্য করো। আজ আর মেয়েটাকে ডাকতে সাহস পেলেন না তিনি। মেয়েটা পথ ধরে এগিয়ে চলছে।

সারারাত ঘুম হল না ইমাম সাহেবের। ফজরের নামায পর্যন্ত জেগে থাকলেন তিনি। নামাযের পরই দুচোখ ভেঙে এলো ঘুম।

ইমাম সাব, ইমাম সাব। কেউ প্রচণ্ড জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছে, যেন খুব তাড়া। ঘুম টুটে গেল ইমাম সাহেবের। ধড়মড় করে উঠে বসলেন তিনি। কে এলো?

দরজা খুললেন তিনি। রহিতনের বড় ভাই সুরুয মিয়া দাঁড়িয়ে আছে। দুই পায়ে মাটিমাখা, কোমরে গামছা বাঁধা। দৌড়ে এসেছে বোধহয়।

কী হইছে? হাঁপাইতাছ ক্যান?

বল্টু মেম্বার মইরা গেছে, ইমাম সাব।

কও কী?

হ। আসেন জলদি।

গায়ে পাঞ্জাবীটা চাপিয়ে তিনি সুরুজ মিয়ার সাথে ঊর্ধ্বশ্বাসে চলে এলেন বল্টু মেম্বারের বাড়িতে।
অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সামনে, কেউ ভেতরে ঢুকছে না। মানুষ মরে গেলে খুশি হতে নেই, কিন্তু লোকগুলোর মুখে একটা চাপা খুশির ছায়া দেখতে পেলেন ইমাম সাহেব। যেন অনেকদিনের শত্রু দূর হয়েছে।

ইমাম সাহেব লোকের ভিড় ঠেলে ঢুকলেন।
খাটে চিত হয়ে পড়ে আছে বল্টু মেম্বার, দুই পা দুদিকে ছড়ানো। মুখ হাঁ হয় আছে, ময়লা দাঁত বেরিয়ে আছে, সেখানে কয়েকটা নীল মাছি ভনভন করছে। দুই চোখ বিস্ফারিত, ভীষণ ভয়ে যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। কাঠির মতো শরীর, বীভৎস মুখটা দেখে ভয় পেয়ে যাবে যে কেউ।

ইমাম সাহেব কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। দুই চোখ বুজিয়ে দিলেন বল্টু মেম্বারের। পেছন থেকে চাপা গলায় কেউ একজন বলল, কইছিলাম না? গলার স্বরে বুঝতে পারলেন ইমাম সাহেব, রহিতনের বাপ।
গঞ্জ থেকে দুপুরের মধ্যে ডাক্তার এলো, বলল, ভয় পেয়ে হার্ট ফেইলিউর হয়ে মারা গেছে লোকটা।

বল্টু মেম্বারের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে উচ্চস্বরে নারীকণ্ঠের বিলাপ শুনতে পেলেন তিনি। মেম্বারের দুই বউ আছাড়িপিছাড়ি করে কাঁদছে, বুক চাপড়াচ্ছে, আর ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদছে। আহারে, মানুষটা মইরা গেল গো, লইয়া গেছে গা রে … …

এমন করে কাঁদতে নিষেধ আছে, এতে মৃত ব্যক্তির কষ্ট হয়। ইমাম সাহেব একজনকে ডেকে বললেন, উনাগোরে কও এইভাবে না কানতে।

কথায় কাজ হল না, কান্নার জোর আরও বাড়ল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইমাম সাহেব বের হয়ে গেলেন।
বল্টু মেম্বারের দাফন কাফন, জানাযা সব হয়ে গেল। জানাযায় দেখা গেল মফিজকে, তার চোখে পানি। ইমাম সাহেব দেখলেন, আজ তার চোখে সানগ্লাস নেই। দবিরও আছে। তাকে আর মেম্বারের ছাতা ধরতে হবে না।

কবর দেয়া হল জারুল গাছটার নিচে। শোনা যাচ্ছে, কয়েকদিনের মধ্যেই তার দুই ছেলে মিলে কবরটা পাকা করে বাঁধিয়ে দেবে।

রাত। মনটা খারাপ লাগছে ইমাম সাহেবের। একটা মানুষ মারা গেলে কেন যেন খুব মন খারাপ হয় তাঁর। অথচ মৃত্যু হল জগতের সবচেয়ে স্বাভাবিক ঘটনাগুলোর একটা। আল্লাহপাক মানুষের মনে একজনের জন্য আরেকজনের মনে অনেক মায়া দিয়েছেন। ভালো মানুষের জন্য তো বটেই, মন্দ মানুষের জন্যও দিয়েছেন। নইলে বল্টু মেম্বারের জন্য তাঁর মন খারাপ হবে কেন?

খসখস শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মেয়েটা আবার এসেছে, পথ ধরে যাচ্ছে। ইমাম সাহেব জানালা বন্ধ করে দিলেন। কী দরকার দেখে? সে তো কখনো চেহারা দেখাবে না। সে কি আসলেই শরিফা? নিশ্চয়ই নয়। মানুষ মরে গেলে আর ফিরে আসে না।

পুনশ্চঃ
ইমাম সাহেব এখনো নামায পড়ান। রহিতনের বাপ আর সলিমুদ্দির সাথে চায়ের দোকানে বসে গল্প করেন। মফিজকে দেখেন, ছেলেটা চাষবাসে মন দিয়েছে, গুণ্ডামি করে না আর। দবির গ্রাম ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেছে। বল্টু মেম্বারের জায়গায় নতুন মেম্বার এসেছেন, নাম সোলায়মান মিয়া। অতি সজ্জন ব্যক্তি। বল্টু মেম্বারের দুই বউ আবার তাদের চুলোচুলিতে মন দিয়েছে। তাদের দুই ছেলে বিষয়সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে কদিন আগেও মারামারি করেছে।

প্রতি রাতে ঐ পথ ধরে মেয়েটাকে চলে যেতে দেখেন ইমাম সাহেব, কিন্তু জানা হয়নি সে কে। আর কেউ দেখে না তাকে, কেন কে জানে। মাথায় একহাত ঘোমটা টানা থাকে, চেনা যায় না, চেহারা দেখা যায় না। শুধু চুড়ির শব্দ পাওয়া যায়, হাতভর্তি কাঁচের চুড়ি, টুংটাং টুংটাং। সেই শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যান ইমাম সাহেব। শরিফার কথা মনে পড়ে তাঁর, দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আরেকবার যদি সে ফিরে আসতো!

যেকোনো কবরই কয়েকদিনের মধ্যে কচিঘাসে ছেয়ে যায়, কিন্তু বল্টু মেম্বারের কবরে ঘাস জন্মায়নি। নগ্ন কবরটা যেন চেয়ে থাকে, দেখলে অস্বস্তি হয়। লোকে বলে, জারুল গাছটার ছায়া নাকি কবরটার ওপর পড়ে না, সবসময় অন্যদিকে পড়ে। আল্লাহর দুনিয়ায় কত যে আজব জিনিস আছে, বলে শেষ করা যাবে না, আশ্চর্য হন ইমাম সাহেব।

শুধু মাঝে মাঝে খোলা জায়গাটা দিয়ে উতলা হাওয়া বয়ে যায়। সেই হাওয়ার খানিকটা পরশ কি এই পাপী মানুষটিও পায়?

……………………………………………….(সমাপ্ত)……………………………………………

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত