কুকুর

কুকুর

ছোট্ট পরিবারটি। জেনিফার আর টম। স্বামী-স্ত্রী। ছিমছাম সংসার। এক বছর হয় তাদের বিয়ে হয়েছে, এখনো গুছিয়ে উঠতে পারেনি।

তরুণ এই দম্পতি চাকরি করে টাকা জমাচ্ছে একটা সুন্দর ফ্ল্যাট কেনার জন্য। জেনিফারের শখ নতুন একটা গাড়িরও। তবে সেটা এত সহজ হবে না। টাকা জমাতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে দুজনের, এই দেশে কেউ ডলার ছাড়া একটা কাশিও দেয় না, এখানে সেখানে প্রচুর টাকা খরচ হয়ে যায়। তার ওপরে দুজনেই অল্পবয়সী ছেলেমানুষ, হিসাব ঠিক রাখতে জানে না, মাসের প্রথম দিকে ঝোঁকের মাথায় বেশ খানিকটা খরচ করে ফেলে, শেষের দিকে সঞ্চয়ের কথা মনে পড়ে। তবে দুজনের মধ্যে বোঝাপড়া ভালো, তাই সব অসুবিধা সহজেই মিটমাট হয়ে যায়, উটকো ঝামেলা নেই বলে ছোট্ট এই বাসাটাকেও সুখের একটা নীড় বলে মনে হয়।

টম ম্যাকগিল তার পুরো নাম। সে কাজ করে “অডি” কোম্পানিতে, একটি খ্যাতনামা গাড়ির ব্র্যান্ড, সবার চেনা। সেখানে অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সুবাদে চাকরি বাগিয়ে নিয়েছে, নতুন চাকরিতে থিতু হতে সময় লাগছে। জেনিফার হুইটেকার, বর্তমানে “মিসেস ম্যাকগিল”, আছে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির জুনিয়র অ্যাডভাইজারের কাজে। দুজনে বলা যায় দুই ভুবনের বাসিন্দা, টম একেবারেই শান্ত প্রকৃতির আর জেনিফার বেজায় চঞ্চল, তাদের মধ্যে ভাব কীভাবে হল সেটা এক মজার ঘটনা। একই ভার্সিটিতে পড়তো দুজন, টম ভার্সিটির একটা চত্বরে বসে বসে নিজের খেলনা চেহারার গাড়ির মডেলের সার্কিটের রূপদানে ব্যস্ত থাকতো। জেনিফার তার ডিপার্টমেন্টে যাওয়ার জন্য রোজ এই রাস্তা ব্যবহার করতো। এই শান্ত চেহারার রূপবান ছেলেটিকে প্রতিদিন ওখানে বসে কাজ করতে দেখত সে, চোখাচোখি হয়ে যেত প্রায়ই, কেউ কাউকে চিনত না, কিন্তু একটা হাসি ঠিকই বিনিময় হতো। ক্রমে সে আগ্রহী হল টমের প্রতি, একদিন গিয়ে ওর পাশে বসলো। কথায় কথায় পরিচয় হল, কয়েক মাসে বন্ধুত্ব গাঢ় হল, কবে যে সেখানে রোমান্স এসে আসন গাড়ল, কেউ টেরই পেলো না। জেনিফার রাইম লিখত, আর কাউকে দেখাতে সাহস পায় নি, ছোট ছোট কিন্তু মিষ্টি সেই কবিতাগুলো টমের কাছে ভারী মজার মনে হতো, সে মন দিয়ে শুনত। আর টম যেই নীরস চেহারার তার, টিউব আর ব্যাটারির স্তুপের মতো দেখতে গাড়ির কিংবা মেশিনের মডেল বানাত, তাও কেন যেন জেনিফারের বেশ ভালো লাগা শুরু হল। তারপর একসাথে কফি খাওয়া, এখানে সেখানে হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়ানো, সবই শুরু হল। ক্যাম্পাসের সবাই দেখলেই হেসে বলে উঠত, ঐ দেখো, মানিকজোড় যাচ্ছে।

একসময় তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলো। নাটকীয় কিছু যে টম কখনো করতে পারে, সেটা জেনিফার ভাবতেও পারে নি। গ্রাজুয়েশনের অনেক পরের কথা, তখন দুজন সবে চাকরি জুটিয়েছে, ব্যস্ত রাস্তার পাশের ফুটপাতে দুজন হাত ধরাধরি করে হাঁটছিল, হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই টম হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো জেনিফারের সামনে। কোথা থেকে যেন বের হয়ে এলো একটা লাল গোলাপ, সেটা সামনে বাগিয়ে ধরে সে বলল, জেনিফার, আমাকে বিয়ে করবে? জেনিফার কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো, বুঝতে খানিকক্ষণ সময় লাগলো। তারপর খুশিতে চোখে পানি এসে গেল। চারিদিকে তখন লোক জমে গেছে, তারা হই হই করে উঠলো, হাততালি দিল।

তার কয়েকদিন পরেই বিয়ে। সেই কয়েকদিন দুজনেরই যেন ঘোরের মধ্যে কেটেছে, কারোর আর মনে নেই ঠিক কী ঘটেছিল। এখন তারা ঘরকন্না করছে। নবীন দুটি প্রাণের ভালোবাসা আগের মতোই আছে, এখনো দুজনে একসাথে ছুটিছাটায় বাইরে খেতে কিংবা সিনেমা দেখতে যায়, এদেশে যেমন সবকিছু দুদিনেই পুরনো হয়ে যায়, তেমনটি হয়নি।

হাতের কাজ অনেক, “অডি” গাড়ির অনেক অংশই হাতে, অর্থাৎ ম্যানপাওয়ার ব্যবহার করে তৈরি হয় বলে চারিদিকে সুনাম আছে, টম দরদর করে ঘামছে, অন্যদের তুলনায় সে বেশি ঘামে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ফ্যাক্টরি রুম, তারপরেও সে একটু পর পর ন্যাপকিনে কপালের ঘাম মুছছে। তাদের টীমের চিফ মিস্টার বয়েল কঠিন মানুষ, কাজেকর্মে গাফিলতি একদম দেখতে পারেন না, একটু পর পর সবাইকে তাড়া দিচ্ছেন। এখনো এটা শেষ হয় নি? ফুয়েল লাইন কে জোড়া দেবে? ওখানে স্ক্র্যাচ পড়লো কী করে? আচ্ছা মুশকিল হল দেখছি, এদেরকে দিয়ে তো আর পোষাবে না। চারিদিক তদারক করতে করতে টম আর ছোকরা মেকানিক স্টুয়ার্টের অবস্থা কাহিল।

চারিদিকে চোখ বুলিয়ে সন্তুষ্ট বোধ করলেন মিস্টার বয়েল, হাতের কাছ থেকে তুলে নিলেন ক্যানটা, পানীয়ে চুমুক দিলেন। আহ! জিনিস বটে একটা, ভেতরটা পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

পেটের অবস্থা সুবিধের নয়, ক’দিন ধরেই ট্রাবল দিচ্ছে, কিন্তু ছাইপাঁশ না গিলে থাকতে পারেন না মিস্টার বয়েল, স্ত্রী গাইগুঁই করেন, কিন্তু তিনি শোনেন না। এসব ডেলিকেট কাজ জিনিস পেটে না পড়লে ভালোভাবে করা যায় না, কিন্তু কে বোঝে?

তলপেটে চাপ দিচ্ছে, খালি হয়ে আসা দরকার, ভাবলেন তিনি। তবে যাবার আগে সবাইকে আরেক দফা তাড়া দিয়ে গেলেন, ইয়াং মেন, হাত লাগিয়ে কাজ কর। ময়দা পেষার কাজ নয় এটা, এই গাড়ি দেখে অনেকের চোখ আলুর মত গোল হয়ে কপালে উঠে যাবে, বুঝলে? এখনো চেসিসটা লাগানো হয় নি বলে খালি গায়ের একজন মানুষের মতো কিম্ভূত লাগছে গাড়ির এই “প্রাক-মূর্তিকে”, চোখ কপালে ওঠার মতো চেহারা নিতে দেরী আছে।

সুন্দর ঝকঝকে সিরামিকের কাজ করা বাথরুম, কেন যেন এখানে এলেই শান্তি শান্তি লাগে তাঁর। পৃথিবীর অনেক মহৎ চিন্তার উন্মেষ হয় এই বাথরুমে, যুগান্তকারী সব গাড়ির ফর্মুলা থেকে সংসারে সুখের রহস্য, এমন জটিল ব্যাপার নিয়েও মাথা ঠাণ্ডা করে চিন্তা করা যায় এখানে।

ফ্লাশ করে দিলেন তিনি, পানির তোড়ের আওয়াজ এলো। বেরিয়ে এলেন, তখন সামনের জিনিসটা দেখে বরফের মতো জমে গেলেন তিনি।

সামনে দাঁড়িয়ে আছে দশাসই আকারের একটা কুকুর, গ্রেট ডেন জাতের, দেখেই চিনতে পারলেন তিনি। উচ্চতায় তিনি ফুটের কম হবে না, গায়ের রং কুচকুচে কালো, চোখের রং হলুদ, মুখ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে। এখানে এটা এলো কোত্থেকে? কর্মচারীদের কেউ আনে নি, এত বড় একটা জিনিস নিয়ে কেউ কাজ করতে আসে না, এলে সকালেই চোখে পড়তো। কড়া নিষেধ অমান্য করে এমন কিম্ভূত একটা জীব কে নিয়ে এসেছে? আবার ছেড়ে রেখেছে?

সারাদিনের পরিশ্রমে ভুলভাল দেখছেন না তো? চোখ কচলালেন তিনি, চিমটি কাটলেন নিজের গায়ে। না, জিনিসটা দাঁড়িয়ে আছে।

কুকুরটা খানিকক্ষণ হাঁপাল লম্বা লাল জিভ বের করে, তারপর ঠোঁট চাটল জিভ দিয়ে। গা ঝাড়া দিল লটপট করে। মতলব সুবিধের মনে হচ্ছে না, ধারালো দাঁত বের করে গররররর করে চাপা আওয়াজ করলো। ঘাড়ের কাছের লোমগুলো দাঁড়ানো, মিস্টার বয়েল দেখতে পাচ্ছেন এখান থেকেই।

এদিকে এগিয়ে আসছে জিনিসটা, ভয় পেয়ে এক পা পিছিয়ে গেলেন তিনি। হুশ, হুশ, শব্দ করে তাড়ানোর চেষ্টা করলেন কুকুরটাকে। চারপাশে তাকালেন, কই, কেউ তো নেই। এত নির্জন কেন? চিৎকার করে ডাকবেন কাউকে, সাহায্য চাইবেন? এত বড় একটা কুকুরের সামনে ছোটখাটো শরীরের মিস্টার বয়েলকে সত্যিই হাস্যকর লাগছে, মনে হচ্ছে চাইলেই কুকুরটা তাঁকে কোঁৎ করে গিলে ফেলতে পারে।

অনেকটা কাছে এসে গেছে ভয়ংকর কুকুরটা। কুকুর বরাবরই অপছন্দ করেন তিনি, এখন পাচ্ছেন ভয়। পুডল কিংবা এমন ছোট জাতের কুকুর হলে ভয়ের কিছু ছিল না, কিন্তু গ্রেট ডেন কিংবা ডোবারম্যান টাইপের কুকুরগুলোর বিশালবপু দেখেই পিলে চমকে যায়। কামড়ে দেবে না তো?

হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। কাছে এসে থেমেছে কুকুরটা, লকলকে জিভের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ধারালো শ্বদন্ত, কণ্ঠনালী পর্যন্ত শুকনো ঠেকছে মিস্টার বয়েলের, তিনি পেছাতে পেছাতে দেয়ালে গিয়ে ঠেকেছেন।

কুকুরটা আর দাঁড়ালো না, লম্বা লাফ দিয়ে এসে কামড়ে ধরল তাঁর গলা, কামড়ে টুঁটি আলাদা করে ফেলবে ধড় থেকে।

মিস্টার বয়েল প্রাণভয়ে কাতর স্বরে চিৎকার করলেন, কে আছ বাঁচাও! বাঁচাও!

বস, বস। চোখ খুলুন, ভয়ের কিছু নেই।

চোখ খুললেন মিস্টার বয়েল, তাঁর মুখের ওপর ঝুঁকে আছে একটা পরিচিত মুখ। টম।

আরে, টম, তুমি এখানে কী করছ?

ওয়াশ রুমে এসেছিলাম। এসে দেখি আপনি চিত হয়ে পড়ে আছেন আর চিৎকার করছেন। কী দেখে ভয় পেয়েছিলেন?

একটা কুকুর। বিশাল সাইজ। এইয়া মোটা।

কুকুর? এখানে? হাহ। কী বলছেন?

বিশ্বাস কর। কোন স্টাফের কুকুর তো হতে পারে।

স্যার, এখানে কোন পোষা পশুপাখি নিয়ে কেউ আসে না। জানেন তো ভালো করেই।

হ্যাঁ, কিন্তু দেখলাম যে?

বেশ, মানলাম দেখেছেন। তা ঐ কুকুর কী করলো? আপনার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লো?

হ্যাঁ, কেঁপে গেল মিস্টার বয়েলের গলা।

হাসল টম। ভুল দেখেছেন স্যার। পরিষ্কার দিনের বেলা, ভূতটুতের ভয় নেই তো?

নাহ, জোর গলায় বললেন বয়েল। ভূতের ভয় থাকবে কেন?

তাহলে বোধহয় বেশি … … গলা খাঁকারি দিয়ে থেমে গেল টম। কী বোঝাতে চাইছে সে, বুঝতে পারলেন বয়েল। ড্রিংক বেশি করেছেন, সেটা বলতে চাইছে।

না না, সেরকম কিছু নয়। আচ্ছা, বাদ দাও। ভুল দেখেছি তাহলে। কাজ পড়ে আছে, দেখি গিয়ে। তড়িঘড়ি করে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন বয়েল, টম ধরে পপাৎ ধরণীতল হওয়া ঠেকাল।

ওকে, ওকে, আই ক্যান ম্যানেজ। ঘাড়ের ঘাম মুছলেন তিনি রুমাল বের করে, শুকনো একটা হাসি দিয়ে ঝট করে বেরিয়ে গেলেন।

কাঁধ ঝাঁকাল টম। বুড়ো সারাদিন নানা চিন্তায় অস্থির থাকে, নির্জন বাথরুমে কী দেখতে কী দেখেছে কে জানে। শিস দিতে দিতে বাথরুমে ঢুকে গেল সে।
এদিকে মিস্টার বয়েল চিন্তায় পড়েছেন। কুকুরটাকে একদম বাস্তব মনে হয়েছে। বেশি ড্রিংক করার ফল? অসম্ভব। তিনি মদ খান ঠিকই, কিন্তু মাতাল হন না কখনোই, বাজি রেখে বলতে পারেন। তাছাড়া হ্যালুসিনেশন হলে সেটা আবছা আবছা হতো, এত পরিষ্কার হতো না। কিছু একটা গোলমাল নিশ্চয়ই আছে, সেটা বের করতে হবে। ভয় পেয়েছেন তিনি, ভীষণ ভয়।

আজ অ্যালান এবং শ্যারনের অ্যানিভার্সারি। সেই উপলক্ষে দুজন আয়োজনের চূড়ান্ত করেছে। কাছের বন্ধু, দূরের বন্ধু কেউই এই পার্টির দাওয়াত থেকে বাদ যায় নি। সবাই জোড়া বেঁধে এসেছে, খুব মজা হচ্ছে, কোণায় কোণায় চলছে পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন, খুনসুটি, হাসাহাসি। কেউ স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে, কেউ বান্ধবীকে, একজন আরেকজনকে বগলদাবা করে মুখে একটা চওড়া হাসি নিয়ে এদিক থেকে সেদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক কোণায় মৃদু সুরে মিষ্টি করে বাজানো হচ্ছে পিয়ানো, সেটা বাজাচ্ছে রবার্ট, অ্যালান ওকে টেক্সাস থেকে ধরে এনেছে, আজ বন্ধুদের সভায় বন্ধুই বাজাবে। এখানে ঢুকলে এক ঝলক তারুণ্যের বাতাস এসে গায়ে লাগে, হঠাৎ করেই মনে হয় এই নবীন তাজা প্রাণের তরুণ-তরুণীগুলোকে তো আনন্দ করাই মানায়। খানিকক্ষণ পরপর হাসির রোল উঠছে, রোজিলিনের গায়ে ইচ্ছে করে পানি ফেলে দিল ডোনাল্ড, সেটা দেখে হেসে খুন হয়ে গেল অন্য বন্ধুরা। খাওয়াদাওয়া কিংবা পান করার সুযোগ আছে এন্তার, যে যখন ইচ্ছে তুলে নিচ্ছে গ্লাসভর্তি পানীয়, নিমেষেই খালি হয়ে যাচ্ছে। রাতটি রঙিন, বর্ণিল, মাদকতায় ভরা। কারো কোন তাড়া নেই, সবাই চাইছে এই রাতের আনন্দফুর্তি যেন শেষ না হয়, চলতেই থাকে, চলতেই থাকে।

টম আর জেনিফারও এসেছে। ওরা বন্ধুদের সাথে মিশে গেছে, গল্প করছে, ওপর থেকে দেখলে অনেক জোড়া কপোত-কপোতীর মধ্যে ওদেরকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না।

আজ জেনিফার পড়ে এসেছে গাঢ় লাল রঙয়ের একটা গাউন, খুব সুন্দর লাগছে তাকে। টম পড়েছে কালো স্যুট আর জেনিফার নিজের হাতে ওর গলায় বেঁধে দিয়েছে একটা লাল টুকটুকে নেকটাই। বারবার সেটাতে হাত বুলোচ্ছে টম, আশেপাশে হাসিমুখে তাকাচ্ছে থেকে থেকে। দুজনের হাতে ধরা গ্লাস, তাতে গাঢ় লাল রঙয়ের পানীয়, এখনই মাথা ঘুরছে জেনিফারের, কেমন সব এলোমেলো লাগছে, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না, অফুরন্ত প্রাণশক্তি তাকে এখনো দাঁড় করিয়ে রেখেছে, পরের ইভেন্টটির জন্য সে অপেক্ষা করছে।

নাচের পালা শুরু হল। অনেক জোড়া তরুণ-তরুণী জোড় বেঁধে নাচতে শুরু করলো। জেনিফারের এসবের অভ্যাস নেই, কিন্তু তাতে কী? এখানে নাচ জানার কোন দরকার নেই, শুধু নাচতে হবে বলে নাচা।

সবাই, এমনকি অ্যালান আর শ্যারন মিলে জোর করাতে সে আর টমও বিশাল হলরুমের ঠিক মাঝখানে চলে এলো। টম ওর কোমর জড়িয়ে ধরল, তারপর বাজনার তালে তালে সবাই একসাথে নাচতে শুরু করলো। ঘুরে ঘুরে তালে তালে নাচ। ক্রমে মিউজিক জোরালো হল, তাল, লয় আর সুর সবকিছু আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো, দ্রুত হতে লাগলো, চারিপাশের সবকিছু যেন বনবন করে ঘুরতে লাগলো। তবু কারো নাচ থামছে না, পায়ে তাল ঠুকে নেচেই যাচ্ছে সবাই, আর প্রতি মিনিটে সেটা আরও দ্রুত হয়ে যাচ্ছে। সবাই কিন্তু নাচছে না, কেউ নাচছে, কেউ দূরে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে গানের সাথে তাল দিচ্ছে, এক ফাঁকে তাদের কাউকে লক্ষ করলো জেনিফার। সবাই খুব খুশিতে আছে, আনন্দে আছে।
টানা আধঘণ্টা একটানা নেচে গেল টম আর জেনিফার, ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়লো সবাই, যে যার জায়গায় বসে হাঁপাতে লাগলো। হাততালি পড়লো চারিদিকে, বিশাল হলরুম গমগম করছে।

জেনিফার ট্রলির ওপর থেকে টেনে নিলো একটা গ্লাস, তাতে গাঢ় লাল রঙয়ের ওয়াইন দেখলেই কেমন একটা নেশা লেগে যায়, সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো হাতে ধরা স্ফটিকস্বচ্ছ গ্লাসের দিকে, ঘোরের মধ্যে চলে গেল যেন। অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে নেচেছে তারা, মাথা ঘুরছে এখনো।

পাশ থেকে টমের গলা শুনে ঘোর কাটল তার, চমৎকার নেচেছ, সোনা।

পাশে তাকাল জেনিফার, টমের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে, সেও নিশ্চয়ই হাঁপিয়ে গেছে। নিজেও একটা গ্লাস টেনে নিলো, তাতে ঢালছে পানীয়, তাকিয়ে আছে জেনিফার।

গ্লাস ভর্তি করে চুমুক দেবার আগে জেনিফারের গ্লাসের সাথে একটা ঠোকা দিল টম, আবার ঘোর থেকে বাস্তবে ফিরে এলো সে। নিজের পানীয়তে চুমুক দিল। উফ, ভারী খাটুনি হয়েছে। তবে নাচের মুহুর্তে কিচ্ছুটি টের পাওয়া যায় নি, মনে হয়েছে সে না থেমেই নেচে যাবে সারাজীবন।

অনেক রাতে পার্টি ভাঙল, সবাই অ্যালান আর শ্যারনকে ধন্যবাদ জানালো চমৎকার একটা পার্টির জন্য। বিত্তবান এই দম্পতি আজ যা করেছে সেটা তাদের সব বন্ধুবান্ধব অনেকদিন ধরে মনে রাখবে।
বাসায় ফিরেই বিছানায় এলিয়ে পড়লো জেনিফার, ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। ধকল গেছে খুব, তবে টম মোটামুটি স্বাভাবিক আছে, পুরুষ মানুষ বলেই হয়তো। খুব ঘুম পাচ্ছে সোনা, বলে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল জেনিফার, কয়েক সেকেন্ডেই ঘুমিয়ে কাদা, পোশাক বদলাতেও মনে রইলো না।

টম সময় নিয়ে ফ্রেশ হল, কাপড় চেঞ্জ করলো, ঘরে এসে দেখল জেনিফারের একটা পা বিছানার বাইরে পড়ে আছে, বেকায়দা অবস্থানে থেকেও কি অঘোরে ঘুমোচ্ছে তার স্ত্রী। পা-টা বিছানায় তুলে দিল সে, গায়ের ওপর টেনে দিল কম্বলটা, বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। এইবার নিদ্রা, সকালে উঠে আবার ছুট লাগাতে হবে।
ঘরটাতে দুইজনের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।

জেনিফারের হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো, কেন সেটা বুঝতে চেষ্টা করলো সে। ঘরে একটা নীরবতা, পাশে টম নেই। চমকে উঠলো সে, পরক্ষণেই ফ্লাশের শব্দ শুনে বুঝতে পারলো, টম ওয়াশরুমে গেছে। নিজের দিকে চোখ পড়লো তার, পার্টির পোশাক পড়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে, এখনো ক্লান্তি দূর হয় নি, চোয়াল ভেঙে হাই উঠলো তার।

ভাবছে, পোশাক বদলে একটু হাতেমুখে পানি দিয়ে আরাম করে শুয়ে পড়বে, তখন বাথরুমের দরজাটা খুলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে জমে গেল জেনিফার।
দরজা খুলে টম বের হয়নি, বেরিয়েছে একটা দশাসই কুকুর। কুচকুচে কালো লোমে ভরা শরীর, হলুদ চোখ অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করছে, লকলকে জিভ বেরিয়ে প্রায় মাটি ছুঁয়েছে। হাঁপাচ্ছে জীবটা, সাদা দাঁত বের করে মুখ খিঁচোল জেনিফারের দিকে তাকিয়ে, তারপর টলতে টলতে এগিয়ে আসতে লাগলো তার দিকে। গ্রেট ডেন কুকুর, দেখেই বুঝতে পারলো জেনিফার, তিনফুট উঁচু প্রাণীটাকে দেখে কুকুর না, দানব বলে মনে হচ্ছে তার।
বিছানায় বসে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলো সে, কুকুরটা থামছে না, এদিকেই এগিয়ে আসছে।

মাথা ঠাণ্ডা কর, নিজেকে বোঝাল জেনিফার, এই ঘরে কোন কুকুর নেই। অন্ধকারে ভুল দেখছ তুমি। চোখ বন্ধ কর, তিনবার বড় বড় করে নিঃশ্বাস নাও, তারপরে চোখ খুললেই দেখবে কিচ্ছু নেই। পার্টিতে নেচেছ তুমি, অনেক পরিশ্রম হয়েছে, মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়ে আছে, কেজেই এমনটা হতেই পারে, ভয় পেয়ো না, কুকুরটা ওখানে নেই। চোখ বন্ধ কর।

প্রায়ই টেনশনে পড়লে এই পদ্ধতি খাটায় জেনিফার, তিনবার বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিলে মাথা ঠাণ্ডা হয়ে আসে, সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে ব্যাপারটার মধ্যে, সে অসংখ্যবার নানা বেকায়দা জায়গায় বসে মাথা ঠাণ্ডা করেছে এভাবে।

অটোসাজেশন অনেক সময় ওষুধের চেয়ে ভালো কাজ করে।

চোখ বন্ধ করলো জেনিফার। নিজেকে বলল, ওখানে কিচ্ছু নেই, সব মনের ভুল, অলীক কল্পনা। ধীরে ধীরে শ্বাস নাও, ধীরে ধীরে ছাড়।

একবার, দুবার, তিনবার। বড় বড় করে শ্বাস নিলো আর ছাড়ল জেনিফার।

চোখ খুলল সে, আর ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। কুকুরটা তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে, গরম দুর্গন্ধময় নিঃশ্বাস এখানে থেকেও টের পাচ্ছে সে।

হাঁ করলো কুকুরটা, দুসারি ধারালো দাঁত দেখে শিউরে উঠলো জেনিফার। প্রাণপণে চিৎকার করে উঠলো, টম! টম! বাঁচাও!

হেই, জেনিফার, জেনি সোনা, চোখ খোল। এই তো আমি।

ধীরে ধীরে চোখ খুলল জেনিফার, তার ওপরে ঝুঁকে আছে একটা উদ্বিগ্ন মুখ। টম।

কী দেখে ভয় পেলে, ভীতুর ডিম? হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো টম।

একটা … … একটা কুকুর। ওখানটাতে দাঁড়িয়ে ছিল।
কুকুর? এখানে?

হ্যাঁ, বিশ্বাস কর, আমি মিথ্যে বলছি না। প্লিজ, কেঁদে ফেলবে যেন জেনিফার, ভয় এখনো কাটে নি তার, থেকে থেকে কেঁপে উঠছে।

আচ্ছা, এখানে কুকুর কোথা থেকে আসবে, তুমিই বল? মাথাটা গুবলেট হয়ে গেছে, বুঝলে? সস্নেহে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল টম। পার্টিতে বেশি নেচেছ, মাথা গরম হয়ে গেছে, তাই ভুলভাল দেখছ।

তুমি কোথায় গিয়েছিলে?

ওয়াশরুমে, আবার কোথায়? এসে দেখি তোমার দাঁতকপাটি লেগে গেছে। এত ভয় পায় কেউ?

আমার এখনো ভয় করছে।

ভয়ের কিচ্ছু নেই। আমি আছি না? এখন ঘুমোবার চেষ্টা কর।

কটা বাজে?

ঘড়ি দেখল টম। ওরেব্বাস, তিনটা দশ। জেনিফার হাঁপাচ্ছে দেখে সে বলল, পানি খাবে?

হুঁ, মাথা নেড়ে সায় দিল সে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। পানি এনে দিল টম, ঢকঢক করে পুরো গ্লাস পানি খেয়ে ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো সে। উফ, যা ভয় পেয়েছিলাম! বলেই হেসে ফেললো সে, কুকুরটা যে কল্পনা ছাড়া কিছুই নয় সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
তাড়াতাড়ি পোষাক পাল্টে স্লিপিং গাউন গায়ে চড়িয়ে নিলো জেনিফার, কী করে এই জবরজং জিনিসটা পরেই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল, ভেবে অবাক হল। শুয়ে পড়লো। কি পাগলামিটাই করেছি, তাই না? জিজ্ঞস করলো সে।

ঘুমিয়ে পড় তো। আবার কোন কুকুর এলে আমি ঠেঙিয়ে তাড়িয়ে দেবো, বলল টম।

হাসল জেনিফার, ভয়টা কেটে যেতে শুরু করেছে, নিজের শরীরে উষ্ণতা ফিরে আসছে, টের পাচ্ছে সে। তার স্বামীটি সবসময়ই মজা করে কথা বলে।

টমকে জড়িয়ে ধরে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়লো সে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে আবার কাদা হয়ে গেল। ওর ঘুমন্ত কোমল মুখখানি দেখে মমতায় বুকটা টনটন করে উঠলো টমের, নিচু হয়ে জেনিফারের কপালে চুমু খেলো সে।

যখন তার ঘুম ভাঙল, তখন সকাল সাতটা। আরেকটা সুন্দর দিনের সূচনা হয়েছে।

ডক্টর সিম্পসন জিজ্ঞেস করলেন, তারপর?

জেনিফার হুইটেকার বলল, তারপরের ঘটনা আমি বলতে চাই না, ডক্টর। এরপরে যা ঘটেছে, তা আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের ঘটনা।

নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন সিম্পসন, কিন্তু ডক্টরের কাছে কিছু কি গোপন করতে আছে? সময় নিন, জেনিফার।

নিজের মাথার আয়নার মতো চকচকে টাকে হাত বুলোলেন তিনি, জেনিফারের কাহিনী খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে। কিন্তু এই মেয়ের বয়স কম, আবেগ বেশি, কথায় কথায় কান্নায় ভেঙে পড়ে। তাই প্রায়ই কাহিনীতে “ব্রেক” চলে আসছে, জমাট গল্পে বিরতি কারই বা ভালো লাগে? তবুও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলেন তিনি, সাইকিয়াট্রিস্টদের ধৈর্য হতে হয় রবার্ট ব্রুসের মতো। তিনি তো আর চাইলেই কষে ধমক লাগাতে পারেন না।
মুখ ঢেকে নিচু গলায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে জেনিফার, তাকে সহজ হতে সময় দিলেন ডক্টর সিম্পসন। টিস্যু দিয়ে নাক মুছে আবার কথা শুরু করলো সে। মত পাল্টেছে নিশ্চয়ই, বাকী কাহিনী এখন শোনা যাবে, কাউচে নড়েচড়ে বসলেন ডক্টর। বাকী কাহিনী ডক্টরের সহকারী মরিসন এভাবেই লিখেছে,
সেটি ছিল ভীষণ শীতের রাত। বাইরে তুমুল তুষারঝড়, ঘরের ভেতরে ফায়ারপ্লেস জ্বালিয়ে জেনিফার আর টম বসে আছে, আলো-আঁধারি জড়ানো বেশ উষ্ণ রোম্যান্টিক একটা পরিবেশ। টম মাউথ অর্গান বাজাচ্ছে, জেনিফার তন্ময় হয়ে শুনছে। অনেকক্ষণ ধরে বাজাল টম, তারপর থামিয়ে উঠে দাঁড়ালো, জেনিফারের খুব কাছে এসে দাঁড়ালো। হাসল জেনিফার।

তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।

কী? ওর হাতে হাত ঘষছে সে।

তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি, জেনি।

জানি আমি। নতুন করে বলতে হবে না। আমিও তোমাকে ভালোবাসি। আর কিছু? কৌতুকের সুরে শুধোল জেনিফার।

আমাকে কখনো ছেড়ে চলে যাবে না তো?
কখনো না। অসংখ্যবার টম এই প্রশ্নটি করেছে জেনিফারকে, জেনিফারও একই জবাব দিয়েছে।
আমি একটা জিনিস তোমাকে দেখাতে চাই।
কী?

তুমি বিশ্বাস করবে না।

কে বলেছে? আমি তোমার স্ত্রী, আমি বিশ্বাস করবো না?
ব্যাপারটা এতোই অবিশ্বাস্য, তুমি দেখেও হয়তো চোখের ভুল ভাববে।

ভাববো না। তুমি দেখাও তো। কিছু মনের মধ্যে চেপে রাখতে হয় না। কারো কাছে বলে হালকা হয়ে যেতে হয়। আমাকে দেখছ না? আমি কখনো তোমার কাছে কিছু লুকিয়েছি?

তুমি জানলে আমাকে ঘৃণা করবে।

এটা তুমি কেমন করে ভাবছ? আমি আবার বলছি, আমি তোমাকে ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি। তোমার সবকিছু নিয়েই আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি কখনো তোমাকে ঘৃণা করবো না। অসম্ভব। কী হয়েছে বলে ফেল তো, এত ভূমিকার দরকার নেই।
টম ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, কিছু বলছে না।

হেসে ফেললো জেনিফার। কি, আমাকে ছাড়াও আর কোন মেয়েকে ভালোবেসেছিলে? সে তোমাকে পাত্তা দেয়নি? ধ্যাত!

টম মাথা নাড়ল, না, সেরকম কিছু নয়। মাথা নিচু করে আছে সে, চোখের পানি গোপন করার চেষ্টা করছে, চোখ এড়ালো না জেনিফারের। কিছু একটা গুরুতর নিশ্চয়ই, টমের থুতনি ধরে উপরে তুলল সে। হ্যাঁ, টমের চোখে জল। কী হয়েছে খুলে বল, সোনা। আমি তোমাকে সাহায্য করবো। বিশ্বাস কর, আমি কিচ্ছু মনে করবো না।

যা দেখাবো, তারপরেও?

তারপরেও। দৃঢ় কণ্ঠে বলল জেনিফার।

তাহলে দেখো। জেনিফারের হাত ছেড়ে দিল টম। পিছিয়ে দাঁড়ালো। হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো।

ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে দেখল জেনিফার, তার স্বামীটির শরীর আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে, গায়ের শার্টের বোতাম পটপট করে ছিঁড়ে গেলো, বেরিয়ে এলো ভেতরটা। ঘন কালো লোমে ঢাকা বুক।

একটা চিৎকার করতে যাচ্ছিলো জেনিফার, কিন্তু পরের ঘটনা তার বাকশক্তিও যেন কেড়ে নিলো।

টমের শরীর আস্তে আস্তে একটা কুকুরের শরীরে বদলে যাচ্ছে। জেনিফার চিনতে পারলো, এই কুকুরটাকেই সে দেখেছিলো সে রাতে।

না, টম, না। চিৎকার করে উঠলো জেনিফার।
টমের সারা গা কুচকুচে কালো লোমে ছেয়ে গেল, চোয়াল আরও চওড়া হল, কান দুটো সূচালো হয়ে উঠলো, বেরিয়ে এলো লকলকে জিভ, যেন মাটি স্পর্শ করবে। সুন্দর বাদামী চোখজোড়া এখন গাঢ় হলুদ, জন্ডিস রোগীর কথা মনে পড়ে যায়। তবে সেসব চিন্তা আসছে না জেনিফারের, সে ভয় পাচ্ছে, প্রচণ্ড ভয়। পা মেঝেতে শেকড় গেড়ে ফেলেছে যেন, নাড়াতে পারছে না।

জিনিসটা আস্তে আস্তে নিজের রূপান্তর পূর্ণ করছে, লালা গড়াচ্ছে ঠোঁট দিয়ে, শ্বদন্ত দেখে গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়। চারপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালো প্রাণীটা, গররররর করে চাপা আওয়াজ করলো। এগিয়ে এলো জেনিফারের দিকে। সোজা হয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে বুঝতে পারলো জেনিফার, একটা কালো গ্রেট ডেন কুকুর, উচ্চতায় তিন ফুটের কম হবে না।

পালাও, জেনিফার, তার মাথার মধ্যে কে যেন বলে উঠলো। বেঁচে থাকা সংক্রান্ত আদিম প্রবৃত্তি, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, যা-ই হোক না কেন, কেউ তাকে সতর্ক করে দিচ্ছে।
কুকুরটা ডাক ছাড়ল, প্রলম্বিত চিৎকার। গায়ের রক্ত জল হয়ে গেল জেনিফারের, সে এক মুহূর্ত দ্বিধা করলো, তারপর ছুট লাগাল সে। বাঁচতে হলে এখান থেকে পালাতে হবে, যে করেই হোক।

কীভাবে সে অনেকগুলো সিঁড়ি টপকে সদর দরজা পেরিয়ে বরফে ঢাকা রাস্তায় নেমে এসেছে মনে নেই, শুধু মনে আছে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সে ছুটছে। তুষারঝড় তখন তুমুল আকার ধারণ করেছে, চারিপাশে কোন জনমানুষ নেই, তার মধ্যেই জেনিফার ছুটছে, একটা পাতলা কাপড় তার পরনে, কিন্তু শীত টের পাচ্ছে না। এদিকে ফুসফুস জ্বালা করা শুরু করেছে, কিন্তু সে থামতে সাহস পাচ্ছে না, প্রচণ্ড আতঙ্ক তাকে থামতে দিচ্ছে না। পেছনে তার ফ্ল্যাট থেকে ভেসে আসছে চিৎকার, একটা কুকুর চিৎকার করছে। মৃত্যুভয় স্বামীর কথা ভুলিয়ে দিল জেনিফারকে, সে থামল না।
এখানেই ঘটনার ইতি, চোখ মুছল জেনিফার। ডক্টর লক্ষ করলেন, জেনিফারের চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে, পুরনো ভয় নিশ্চয়ই এখনো তাকে তাড়িয়ে ফেরে।

তীব্র তুষারঝড়ের রাতে আপনি বের হয়ে পড়েছিলেন, ভয়ে না হোক, শীতে আপনার মৃত্যু হয়ে যেতে পারতো।
হ্যাঁ, তা তো পারতোই। কিন্তু মৃত্যু কপালে ছিল না। খুব সৌভাগ্য আমার, একজন পুলিশ অফিসার আমাকে দেখতে পান, এত দুর্যোগের রাতে তিনি বাইরে কী করছিলেন, জিজ্ঞেস করা হয় নি। তিনি নাকি দেখতে পান, আমি বাড়ি থেকে অনেক দূরে একটা জায়গায় বরফের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছি, যখন আমাকে টেনে তুললেন, তখন আমি অজ্ঞান, শীতে জমে গেছি, মরমর অবস্থা। নাড়ী চলছে দেখে তিনি তড়িঘড়ি করে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন, সেখানে অনেক চেষ্টার পর আমার জ্ঞান ফিরে আসে, ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠি।

টমের কী হল?

জেনিফার দীর্ঘ এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো ডক্টরের দিকে, পরদিন টমের লাশ পায় পুলিশ, ফ্ল্যাটের ভেতরেই, গায়ে কোন কাপড় নেই, সিঁড়ির গোড়ায় পড়ে আছে, ঘাড় ভাঙা। গলা ধরে এলো জেনিফারের।
আর কোন কিনারা হয় নি?

হয়েছে। টমের ব্যক্তিগত ক্যাবিনেট থেকে পুলিশ একটা বোতল উদ্ধার করেছে, সেটাতে একটা নতুন ধরণের ড্রাগ পেয়েছে তারা। তীব্র হ্যালুসিনেশন তৈরি করে ড্রাগটি, অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়ের সাথে অল্প মাত্রায় মিশিয়ে পান করলে আপনি উল্টোপাল্টা জিনিস দেখবেন।

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকলেন ডক্টর সিম্পসন, তাহলে তো ব্যাপার পরিষ্কার। মিস্টার বয়েল যখন ওয়াশরুমে প্রথম কুকুরটাকে দেখেন, তার আগে তিনি প্রচুর পরিমাণে ড্রিংক করেছিলেন, তারপরেই তিনি টমকে দেখেন একটা কুকুর রূপে। দ্বিতীয়বার, যখন আপনি দেখেন, তখন আপনি সদ্য পার্টি থেকে ফিরেছেন, তাতে হয়তো টম মিশিয়ে দিয়েছিল জিনিসটা, কাজেই আপনি নিজেও দেখলেন একটা কুকুর।

মাথা নাড়ল জেনিফার, টমের মৃত্যুর আগে যখন আমি পালিয়ে যাই ঘর থেকে, তার আগে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমি কোন ড্রিংক করি নি, ডক্টর সিম্পসন। দু’ঘন্টার মধ্যে পানি পর্যন্ত খাই নি। আর যদিও বা অন্য কোনভাবে আমার মধ্যে ড্রাগটি গিয়ে থাকে, টমের মৃত্যুর কী ব্যাখ্যা দেবেন?

চুপ করে গেলেন ডক্টর, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন জেনিফারের দিকে। সে-ও তাকিয়ে আছে, অনেকক্ষণ কেউ চোখ সরালেন না।

জেনিফার উঠে পড়লো। আজ আমি যাই, ডক্টর।
ঘর অন্ধকার করে বসে রইলেন ডক্টর সিম্পসন, তিনি যেন বোবা হয়ে গেছেন।

পুনশ্চঃ
জেনিফার সামলে উঠেছে অনেকদিন হয়। সে বিয়ে করেছে তার সহকর্মী হবসনকে। সুদর্শন, হৃদয়বান একজন পুরুষ। তাদের একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে, তারা তার নাম রেখেছে জুলিয়া। এখন এই নতুন পিতামাতা যতক্ষণ বাসায় থাকে, ব্যস্ত থাকে তাদের মেয়েকে নিয়ে।

জেনিফার আর কখনো কুকুরটাকে দেখে নি। কিন্তু মাঝে মাঝে স্বপ্নে টম এসে তাকে বলে, তুমি কথা দিয়েছিলে আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। তারপরও চলে গেলে, কেন?

তখন ঘুম ভেঙে যায় জেনিফারের, সে বিছানায় বসে বসে কাঁদে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। হবসন তাকে তখন সান্ত্বনা দেয়, স্ত্রীকে সে খুব ভালোবাসে, যত্ন করে। তারপরও কি সে টমের জায়গা নিতে পারবে? প্রথম ভালোবাসা কেউ ভুলতে পারে না, জেনিফারও পারবে না।

মিস্টার বয়েল এখনো “অডি” গাড়ি বানিয়ে চলেছেন। এখন আর “ছাইপাঁশ” খান না, সেই কুকুর দেখে ভয় পাবার পর থেকে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, এই জন্যই তাঁর মাথায় ভালো কোন গাড়ির ডিজাইন আসছে না। আবার একদিন চোখকান বুজে ওসব খাওয়া শুরু করবেন বলে আশায় আছেন, সাহস করে উঠতে পারছেন না।
আর ডক্টর সিম্পসন? তিনি ল্যাবরেটরিতে হানা দিয়েছিলেন, সেই ভয়ংকর ড্রাগটি উল্টেপাল্টে দেখেছেন। এটা দিয়েই সবকিছু ব্যাখ্যা করে দেয়া যেত, কিন্তু জেনিফারের শেষ কটি কথা তাঁকে এখনো ধন্দে ফেলে রেখেছে। তিনি চকচকে টাকে হাত বুলোতে বুলোতে প্রায়ই ব্যাপারটা চিন্তা করে চলেন, কিন্তু কিছুতেই কোন সমাধানে পৌঁছতে পারেন না। মনোবিজ্ঞানীদের যেমন সফলতা আছে, তেমনি বিফলতাও আছে। শুধু মনোবিজ্ঞানী কেন, সবারই আছে। একজন যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে তাঁর সেটা মেনে নেবারই কথা, কিন্তু কেন যেন তিনি মেনে নিতে পারছেন না।

……………………………………………………(সমাপ্ত)……………………………………………….

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত