‘বাড়িটা তাে ভালই, কিন্তু এত বড় বাড়ি সাজাব কী দিয়ে?’
স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন মাজেদা বেগম ৷
অসুবিধা কী ৷ ফার্নিচার আমাদের কম নেই খুব একটা।‘
‘আব্বু, আমরা মোটে চারজন ৷ এত বড় বাড়িতে থাকব কী করে?’
মেয়ের দিকে তাকালেন আহাদ সাহেব ৷ বাড়ি দেখে মেয়ে খুশি হয়েছে কিনা বুঝতে পারলেন না ৷ তবে চঞ্চলতা আছে খুব ৷ ছুটাছুটি করে বেড়াচ্ছে ৷
পুরনো লাল ইটের বাড়ি ৷ খুব সস্তায় পেয়ে গেছেন আহাদ সাহেব ৷ পাহাড়তলীতে ভাড়া বাসায় এতদিন ছিলেন। জাকজমক সেখানে ভালই ছিল। তবুও তাে ভাড়া বাড়ি।
তা ছাড়া রমরমা প্রাকটিস। ডাক্তার হিসাবে নামডাক কিছুটা ছিল ৷ সব ছেড়েছুড়ে চলে এলেন কুসুমপুরে ৷ চিটাগাঙে এই অঞ্চলটাই সবচেয়ে প্রাচীন ৷ হিন্দু জমিদারদের বাড়িঘর আছে ছড়ানাে ছিটানাে। ভাঙা চােরা। পলেস্তরাে খসা ৷
এই বাড়িটড়াই সবচেয়ে ভাল ৷ মালিক কাদের চৌধুরী কেন যে হুট করে বিক্রি করে দিলেন বুঝতে পারলেন না আহাদ সাহেব ৷ তেমন কিছু জিজ্ঞেসও করেননি এ ব্যাপারে।
হাজার হোক জমিদারী শানশওকত আছে ৰাড়িটাতে ৷ সুযোগ বারবার আসে না। বিশাল বাড়িটার দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন আহাদ সাহেব ৷ ‘একটু নির্জন, এই যা।’
‘একটু না, বেশ নির্জন। আমার তো রাত বিরেতে গা ছমছম করবে একা বেরুতে।‘ মাজেদা বেগম ক্ষোভ চেপে রাখার চেষ্টা করলেন না।
‘আরে না না ৷ ওই তো ওদিকে রশীদ চেয়ারম্যানের বাড়ি ৷ আর পুবে ফজুমিয়ার বাড়ি। তেমন কোনও অসুবিধা হবে না,’ স্ত্রীকে আশস্ত করার চেষ্টা করলেন আহাদ সাহেব ৷
“এই তোমরা সব দেখছ কী? মালপত্র গুলো নামাও না৷ বিকেল হতে তাে আর বাকি নেই। ‘
তাড়া খেয়ে ঠেলাঅলারা ধরাধরি করে মালপত্র নামাতে শুরু করল। সেগুন কাঠের ভারি ভারি খাট পালঙ্ক। টেনে হিচাড় নামাৰার চেষ্টা করতেই হ্যা হ্যা করে উঠলেন আহাদ সাহেব ৷ “আহ হা ৷ আচড় লাগবে তো খাটে। আলগা করে তুলে নামাও না। কাজকর্ম শেখোনি কিছু?’
বিকেল নাগাদ সব জিনিসপত্র ঘরে তোলা হয়ে গেল। মিতার উত্সাহের অন্ত নেই। এটা সেটা ধরে টানাটানি করছে ৷ আহাদ সাহেব খুশি হলেন ৷ একে নিয়েই চিন্তা ছিল। ভীষণ জেদী মেয়ে। যদি অপছন্দ করে বসত তা হলে মুশকিল হত খুব।
“কি মা, পছন্দ হয়েছে বাড়ি?”
“হ্যা… খুব সুন্দর। কেমন রাজবাড়ি রাজবাড়ি ভাব, না?’
“আরে রাজবাড়িই তো ছিল এটা।”
মেয়ের কথায় হাসলেন আহাদ সাহেব ৷ ‘জমিদার নারায়ণ চন্দ্র চৌধুরীর বাড়ি ছিল এটা ৷ কাচারী বাড়ি। কোলকাতা থেকে এখানে এসে থাকতেন মাঝে মাঝে।’ আমার রুম ঠিক করে… ফেলেছি দোতলায়।’
“তাই নাকি? তুমি একা একা থাকতে পারবে আলাদা রুমে?’
“বারে আগের বাসায় ছিলাম না?‘
ঠোট ওল্টাল মিতা।
“ঠিক আছে। তোমার মাকে বলে দেখো ৷’ কোমরে আঁচল, পেঁচিয়ে বিছানাপত্র ঠিকঠাক করছিলেন মাজেদা বেগম। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। এখন তার পরিশ্রম করার সময় নয়৷ হাবুর মাকে চিৎকার করে কিছু একটা বলে এ ঘরে এসে ঢুকলেন।
‘কি কথা হচ্ছে বাপ মেয়েতে?’
‘মিতা দোতলায় আলাদা ঘরে থাকতে চাইছে ৷’ “বললেই হলো। ওই একরত্তি মেয়ে দোতলায় একা থাকবে?”
“আহা… তা কেন? আমরাও তো দোতলায়ই থাকব। ‘ ‘মােটেই না একতলায় থাকব সবাই। দোতলায় কাঠের বড় বড় জানালা। কেমন একটা প্রাচীন প্রাচীন ভাব। মাকড়সার জালে ভর্তি ৷’
স্বামীর কথা আমলেই আনলেন না মাজেদা বেগম ৷ ওপরতলাটা পছন্দ হয়নি তার। অনেক উঁচুতে সিলিং আর অদ্ভুত তিনকােনা জানালা ৷ দেয়ালের গায়ে বড় বড় কাঠের আলমারি ৷ ওখানে থাকতে রাতে ভয় লাগবে তার।
‘জানাে, আবার, দোতলায় বাদুড় আছে।,
চোখ বড় বড় করে বলল মিতা। ‘বাদুড় ? কোথায়?’
‘দােতলায় ভেন্টিলেটরে অনেকগুলো দেখলাম।’
‘তাের আর ওপরে গিয়ে কাজ নেই। মুখে খামচে দেৰে,’
মেয়েকে সাবধান করে দিলেন মাজেদা বেগম। আহাদ সাহেব বললেন, “যাক না। খেলুক ওপরে গিয়ে ৷ বাদুড় কাউকে খামচায় না।’
এই এক দূর্বলতা তার। মেয়েটার মুখের দিকে চাইলে কিছুতেই তাকে না বলতে পারেন না। বারো বৎসরের বিবাহিত জীবনে কোনও সন্তান হয়নি তাদের। চার বৎসরের মাথায় এতিমখানা থেকে চেয়ে নিয়েছিলেন মিতাকে।
চার বৎসর বয়স তখন মিতার ৷ আহাদ সাহেব বা মাজেদা বেগম কোনওদিনই বুঝতে দেননি কাউকে মিতা তাদের পালিতা মেয়ে। যদিও মিতা জানে।
মা বাবার অভাব কখনও বোধ করেনি সে। সুযোগ হয়নি। আদরে স্নেহে তাকে ঘিরে রেখেছেন আহাদ দম্পতি।
সন্ধ্যা নামছে পাহাড়ে ৷ দূরের সমুদ্রে অবিশ্রাম গর্জনে ভেঙে পড়ছে ঢেউ। সেদিকে তাকিয়ে রইলেন আহাদ সাহেব ৷ সাগর পারের নতুন জীবন কেমন হবে কে জানে।
খুশিতে নাচতে নাচতে ঘরে ঢুকল মিতা। আব্বু, আব্বু, দেখো এটা কী?”
প্রায় দেড়ফুট লম্বা একটা পুতুল মিতার হাতে। ‘কােথায় পেলে এটা?’
‘দোতলায়। দেয়াল আলমারির ভেতরে ছিল। ইস, কী সুন্দর না পুতুলটা?’ খুশিতে চকচক করছে মিতার চোখ।
ভাল করে পুতুলটা দেখলেন আহাদ সাহেব। অনেক পুরনো। তিরিশ চল্লিশ বছরেরও হতে পারে। এর আগে এ ধরনের পুতুল চোখে পড়েনি তার। কালো ফ্রক পরা। মাথায় ইউরোপিয়ান বাচ্চাদের মত কালো বনেট ৷
মনে হয় কাদের সাহেবের জিনিস। ভুলে ফেলে গেছে। কাল একসময় দিয়ে আসতে হবে ওটা।
“না, দেব না এটা আমি। আমি পেয়েছি এটা ৷ আমার পুতুল।‘ বুকের সাথে চেপে ধরল মিতা পুতুলটা৷ যেন কেউ কেড়ে নেবে বলে ভয় পাচ্ছে।
মাজেদা বেগম ঘরে ঢুকলেন ৷ মুখে ক্লান্তির ছাপ। ‘না, আজকে সব গোছগাছ করা সম্ভব না। হাবুর মা তো একটা আলসের হদ্দ। তোমার ফার্মেসীর ওরা খাট পালং গুলো ফিট করে না দিয়ে গেলে মেঝেতে শুতে হত আজ।’
আহাদ সাহেব হাসলেন। স্ত্রীর এই গােছগাছ করার অভ্যাস অনেক পুরানো। একদিনেই সব করে ফেলতে চায়।
‘দেখো কী পেয়েছে তোমার মেয়ে।”
‘দেখেছি আমি। সকাল থেকেই তো দোতলায় পই পই করে ঘুরছে। আরও কত কী যে আবিষ্কার করবে কে জানে। এই মিতা, যা হাতমুখ ধুয়ে আয়। মাকড়সার জাল আর তেলেপােকার লাদি দিয়ে তো ঢেকে গেছে মাথা।‘
‘আঃ, মা। কী বলো তুমি!’ ঘেন্নায় তিড়িন বিড়িন করতে লাগল মিতা। মাথা ঝাঁকাল কয়েকবার।
‘চা খাইবেন, আসেন।’ নতুন পাকের ঘর থেকে বেরিয়ে এল হাবুর মা। আদর্শ ফোকলা বুড়ি। কানে প্রায় শোনেই না। তবে শরীর শক্ত সমর্থ। কাজ করতে পারে খুব।
‘খাওয়া যাক এক কাপ, কী বলাে।” স্ত্রীর দিকে চাইলেন আহাদ সাহেব।
‘হরলিকস বানাও। টায়ার্ড লাগছে। ‘ চেয়ারে বসলেন মাজেদা বেগম।
‘আম্মু, এটার নাম কি জানাে?’ আদর করে পুতুলটার মাথায় হাত বুলাচ্ছে মিতা। অদ্ভুত একটা পুতুল। চোখ দুটো একদম সাদা। মাথাটা সামান্য ওপর দিকে তোলা, মনে হয় যেন অন্ধ।
‘পুতুলটা পুরনো মনে হয় না? তাই নাম দিলাম জুলেখা৷’
নাম ?’ ভ্রু কুচকে গেল মাজেদা বেগমের।
‘জুলেখা একটা একটা নাম হলো? কত সুন্দর সুন্দর নাম আছে। তা না একটা গাইয়া নাম রাখলি। ‘
‘আমার বন্ধু। আমার যা খুশি রাখব।‘ ঠোট ফুলাল মিতা। মায়ের খোঁচাটি ভাল লাগেনি ওর।
বাপের গা ঘেঁষে গিয়ে দাড়াল মিতা। ‘তােমার বন্ধু বুঝি এটা?’
‘হ্যাঁ। এতবড় ডল পুতুল আর কারও নেই।’
‘ঠিক আছে। আমরা তা হলে পাচজন হলাম বাসায়, না?’
হেসে ফেলল মিতা। তার নিজের রুমের দিকে চলে গেল সে।
নীচতলায় মোট পাচটা রুম। সামনের দিকে ড্রইং রুম। মাঝখানের ঘরটাকে লিভিংরুম বানানো হয়েছে। উত্তর দিকের ছোট রুমটায় মিতা আর বুয়া থাকবে। পুবের ঘরটা আহাদ সাহেবের স্টাডি রুম। পাঁচ নম্বর কক্ষে রান্নাঘর।
নতুন বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি, পানি, সবই আছে। নিজের ঘরে ঢুকে সুইচ টিপতেই উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল চারদিক ৷
বাইরে রাত নেমেছে। গ্রামটা এখন সুনসান, নীরব মনে হচ্ছে। শুধু সমুদ্রের চাপা গর্জন শোনা যাচ্ছে ! জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল মিতা ৷
জোনাকীর আলোয় ভরে গেছে সমুদ্রের ধার। সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। তারপর সমুদ্রের উচু পাড় ৷ পায়ের শব্দে পিছনে চাইল মিতা ৷ আহাদ সাহেব ঢুকলেন ভিতরে ৷ ‘
‘বাহ ৷ চমৎকার সাজানো হয়েছে তো মা মণির রুম।’
“জুলেখা থাকবে আমার পড়ার টেবিলের ওপর, আর বুয়া ওই দিকে। আচ্ছা, আব্বু, ওই ফাঁকা জায়গাটায় তো আমরা রাতে বেড়াতে পারব, না?’
জানালা দিয়ে বাইরে তকােলেন আহাদ সাহেব। কী গর্জন! অথচ কী সুন্দর ৷ অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। চিটাগাঙের হৈ হুল্লোড়ের সাথে কোনও তুলনাই হয় না।
চাঁদের আলোয় দুই ফিটের মত উঁচু লাল ইটের দেয়ালটা চোখে পড়ল এতক্ষণে। হঠাৎ একটা অশ্বস্তিতে ভরে উঠল মন ৷ এই রুমে মিতাকে থাকতে দেয়া কি ঠিক হলো? জানালা দিয়ে তাকালেই ওর চোখে পড়বে ওটা।
চৌধুরীদের পুরনো পারিবারিক গোরস্তান। এই ঘরে বসে গোরস্তানটাই চোখে পড়বে ওর সবার আগে ৷ ছোট মেয়ে। ভয় পাবে না?
অথচ যে রকম জেদী ৷ একবার যখন নিজে পছন্দ করেছে শত চেষ্টাতেও আর রুম বদলাতে রাজি হবে বলে মনে হয় না ৷ খুঁতখুঁত করছে আহাদ সাহেবের মন।
’ওটা কবরস্থান, মা। ওখানে বেড়াতে যেতে পারব না আমরা। চাইলে ওই দিকের রুমটা নিতে পারো ৷ ‘
‘কেন?
“রাতের বেলা ভয় করবে না?’
‘নাহ। আমরা তো তিনজন থাকব এ ঘরে। ‘
তিনজন মানে?’
“বারে l আমি বুয়া আর জুলেখা। তিনজন হলাম না?’
ভুলেই গিয়েছিলেন আহাদ সাহেব ব্যাপারটা। ‘ওহহাে। তাই তো৷ তোমার তো আবার একজন বন্ধু জুটেছে।’
রাতের খাবার শেষে তড়ােতাড়ি শোওয়া হলো আজ। নতুন বাড়ি। মাজেদা বেগম একা উঠোনে যেতে রাজি হলেন না। তাঁর নাকি গা ছমছম করে। বুয়া গিয়ে উঠোনের দিকের দেয়ালের ছোট গেটটা বন্ধ করে দিয়ে এল ৷
বেশ কয়েকটা বড় বড় শিশু আর ইউক্যালিপ্টাস গাছ উঠোনে। একটা দুর্লভ গাছ আছে ৷ নাগলিঙ্গম।
মিতাকে শুইয়ে দিতে এসে আহাদ দম্পতি উঠোনটা আরেকবার দেখলেন ভাল করে। মাজেদা বেগমের মনে হলো এই বাড়িতে আরও কিছু লোক থাকলে ভাল হত।
‘চাের ডাকাতের ভয় নেই তো?’
আরে না। এই তো কাছেই পুলিশ ফাঁড়ি আছে একটা ৷ তা ছাড়া লোকজনও খুব ভাল এদিকটায় ৷’
স্ত্রীকে আশ্বস্ত করবার জন্য বললেন বটে কথাটা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই ব্যাপার আরও ভাল করে ভেবে দেখা উচিত ছিল তাঁর। বাড়িটা সত্যি বড্ড নির্জন।
মিতার রুম থেকে নিজেদের ঘরে চলে আসবার সময় পুতুলটাকে দেখতে পেলেন আহাদ সাহেব। টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে জানালার বাইরে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ একটা অদ্ভুত চিন্তা মাথায় এল আহাদ সাহেবের। মনে হলো সত্যি সত্যি দশ বারো বছরের একটা মেয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে ৷ চোখ দুটো দুধ সাদা, অদ্ভুত।
কিন্তু মনে হচ্ছে দেখতে পাচ্ছে সব কিছু৷ জীবন্ত
মেয়ের গােঙানির শব্দে ঘুম ভাঙল মাজেদা বেগমের। ঘুম প্রায় আজকাল হয়ই না তার। এখন সাত মাস চলছে৷ শুয়ে বসে কোনভাবেই স্বস্তি পান না।
তাড়াতাড়ি উঠে আলো জ্বাললেন। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন ৷ হালকা নীল আলোর চুপচাপ শুয়ে আছে মিতা। মশারীর ফাঁক দিয়ে সুন্দর মায়া ভরা মুখটকু দেখা যাচ্ছে। ‘এই মিতা।‘ ঝাঁকানি দিলেন মেয়েকে মৃদুভাবে। ‘স্বপ্ন দেখছিলি ?’
চোখ চাইল মিতা। কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে রইল ফ্যালফ্যাল করে। তারপর স্বাভাবিক হয়ে এল। “হ্যা। এখন না। সকালে বলব।’
“ওই ঘরে শুবি? ভয় লাগছে?”
ঘাড় নাড়ল মিতা ৷ কী যে হয়েছে মেয়ের-সাত আট মাস হয়ে গেল সব সময় আলাদা বিছানায় ঘুমাবে ৷ মেঝেতে অঘোরে ঘুমুচ্ছে হাবুর মা। বুকটা সামান্য ওঠানামা করছে। তাতেই বোঝা যাচ্ছে বেচে আছে ৷
শুয়ে শুয়ে মিতা স্বপ্নটার কথা ভাবছে। বড় অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছে সে।
অন্ধ একটা মেয়ে হেটে যাচ্ছে সমুদ্রের ধারের রাস্তা দিয়ে। কয়েকটা ছেলেমেয়ে পিছু নিয়েছে তার। ক্ষ্যাপাচ্ছে ৷
‘সামনে একটা পাথর আছে। ঘুরে যাও।’
‘এদিকে গেলে সোজা পানিতে পড়বি ৷’
চুপচাপ হাঁটছে মেয়েটা। দশ এগারো বছর বয়স। দৃষ্টিহীনের আড়ষ্ট, সাবধানী হাঁটা। দুই হাত শূন্যে ভাসছে। বোঝার চেষ্টা করছে কোনও বাধা আছে কি না।
হাসছে দুষ্টু ছেলেগুলো। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ মেয়েটা। সন্দেহ দেখা দিল মনে। এই পথ তার মুখস্থ ৷ বহুবার গেছে এখান দিয়ে। তবু কোনও ভুল হচ্ছে না তো?
কী করবে যে এখন। মনকে শান্ত করল অনেক চেষ্টা করে। ছেলেদেরকে পাত্তা না দেওয়াই ভাল। পাজী ছেলেমেয়ে সব।
‘তাের মা নাগর নিয়ে বসে আছে। জলদি বাড়ি যা।’
‘তাের বাবাই নাকি ভাড়া খাটায়। আব্বার কাছে শুনেছি।’
কান ঝাঁ ঝাঁ করছে মেয়েটার ৷ মাথা ঠাণ্ডা রাখতে চেষ্টা করল তা সত্বেও ৷
সামান্য ভুল হলেই বিপদ হতে পারে। কয়েকবার এদিক ওদিক পা বাড়িয়ে পরখ করল সে। কয়েকটা নুড়ি ঠেকল পায়ে। এই পথে তো নুড়ি নেই। তা হলে ? সমুদ্রের আওয়াজ শুনে দিক খোঁজার চেষ্টা করল মেয়েটা। জোরে বাতাস বইছে আজ। চারদিক থেকেই ভেসে আসছে জলরাশির গর্জন। ভয় পেল সে এবার।
হাততালি দিয়ে হাসছে ছেলেমেয়েগুলাে ৷ মনে হচ্ছে চারদিক ঘিরে রেখেছে ওরা। বায়ে একটু ঘুরল মেয়েটা। সম্ভবত এটাই।
পাঁচ সাত হাত এগিয়ে গেল সামনে। হঠাৎ একটা বড় পাথরে ঠেকল হাত। ক্ষুদ্র বুকটা কেঁপে উঠল অজানা আশঙ্কায়।
ঠিকই আছে ৷ যাও না, বিকৃত স্বরে বলল একজন।
কয়েক পা পিছিয়ে এল সে এবার। সমুদ্রের গর্জনের শব্দ হঠাৎ বেড়ে গেল। একটা গাংচিলের কর্কশ ডাক শোনা গেল কাছেই।
সোজা সামনে হাটবার চেষ্টা করল মেয়েটা। অসহায় বোধ করল ভীষণ ভাবে। আর কত দূরে ?
এক পা সামনে এগোতেই বুঝতে পারল ভুল হয়ে গেছে ৷ পিছিয়ে আসার চেষ্টা করল তাড়াতাড়ি ৷ কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ৷
শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেল। বাতাসে কয়েকবার দ্রুত পাক খেল ছোট দুটো হাত। টের পেল শূন্যে ভাসছে তার শরীর।
চারপাশ থেকে ঠাণ্ডা পানি এসে যখন তাকে ঘিরে ধরল তখন কোনও কষ্ট অনুভব করল না মেয়েটা।
তার সমস্ত মন জুড়ে তখন ভর করেছে ভীষণ ক্রোধ। কেন, কেন সে দেখতে পায় না? কেন তাকে এভাবে অসহায় অবস্থায় পড়তে হলো?
ঘৃণা আর রাগে তখন চারপাশের পরিস্থিতি বেমালুম ভুলে গেছে মেয়েটা। ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে আর তখনই মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙল মিতার ৷ বুঝতে পারল ঘেমে গেছে সারা শরীর৷ স্বপ্নের মেয়েটার কথা মনে পড়ল। খুব মায়া হলো তার জন্যে ৷ কেমন যেন চেনা চেনা লাগল ওকে। কোথায় দেখেছে আগে?
নতুন স্কুলে আজই প্রথম গেল মিতা। চট্টগ্রাম শহরের স্কুলের সাথে কোনও তুলনাই চলে না এর। সব কিছু ছোট ছোট। শেলী আর চম্পাকে খুব ভাল লাগল ওর। প্রথম দিনই ওকে বেঞ্চে বসার জায়গা করে দিয়েছে ওরা।
কিন্তু শিউলিকে পছন্দ হয়নি। কেমন যেন হিংসুটে চেহারা মেয়েটার। মিতা স্কুলে ফার্স্ট হত শুনে চেহারা শুকনো হয়ে গেছে ওর। এ পর্যন্ত শিউলিই ছিল ফার্স্ট গার্ল। শেলীই সাবধান করে দিল ওকে।
‘শিউলিটা খুব হিংসুটে আর খুব ডাট। ওর বাবা তো সওদাগর। খুব বড়লােক। কাউকে পাত্তাই দেয় না। ‘
মিতার মন খারাপ হয়ে গেল। নতুন জায়গায় এসেই কারও সাথে মন কষাকষি করতে চায়নি ও। কিন্তু কপাল খারাপ। আমি ওর সাথে ঠিকই খাতির জমাতে পারব দেখো। আমার নামই তো মিতা।’
‘চেষ্টা করেই দেখো না।’
ঘণ্টা বাজার পর এগিয়ে গেল মিতাই ৷
‘তোমার নাম শিউলি?’
‘হ্যা। তোমার?
‘তোমরা ওই পুরনো জমিদার বাড়িটা কিনেছ?’
‘হ্যাঁ। খুব সুন্দর না বাড়িটা?’
‘সুন্দর না ছাই। ক’দিন গেলেই বুঝতে পারবে।‘
খেঁকিয়ে বলব শিউলি। মুখ কালো করে চলে এল মিতা৷ মেয়েটা আসলেই হিংসুটে। ওরা জমিদারবাড়ি কিনেছে বলে হিংসা কাছে ৷ মনে মনে রাগ হলো তার।
‘তােমরা আমাদের বাসাতে খেলতে এসো, কেমন?’ চম্পা, শেলীদেরকে বলল মিতা
মুখ চাওয়াচাওয়ি করল ওরা।
“না, ভাই। অতদূরে মা যেতে দেবে না। তারচে’ তুমিই বরং এসো আমাদের বাসায়।‘
“বারে,আমার বুঝি দূর হবে না?’
তা হলে সাগরের ধারে আম বাগানে খেলব আমরা, কেমন?’
তা না হয় হলো। তাই বলে আমাদের বাসাতে আসবে না কেন?’
চোরা চােরা মুখে হাসল শেলী ৷ কোনও উত্তর দিল না।
ক্লাশে প্রথম দিনটা ভালই কাটল মিতার ৷ বাসার ফিরতেই মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীরে, কেমন লাগল স্কুলে।’
“খুব ভাল। জানাে, আম্মু, এখানে আপা, স্যাররা না খুব ভাল ৷ একদম বকে না। শেলী, চম্পা, চিত্রা এরাও খুব ভাল ৷’
‘এরি মধ্যে এত বন্ধু জুটে গেছে?’
“হ্যা ৷’ হঠাৎ কী মনে পড়ল, বলল, কালকে জুলেখাকে স্কুলে নিয়ে যার, আম্মু ৷ আজকে মনেই ছিল না।’
“কথা শোনো ধাড়ি মেয়ের। ক্লাস ফাইভের মেয়ে পুতুল নিয়ে স্কুলে গেলে হাসাহাসি করবে না সবাই?’
‘করলে করবে। আমি ওদের ধার ধারি নাকি?’
হাত মুখ ধুতে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল মিতা। মাজেদা বেগম্ খুশি হয়েছেন যে মিতার স্কুল ভাল লেগেছে। চট্টগ্রাম শহরের স্কুলের কথা মনে পড়ল তার। মেয়ে, ‘পালিতা মেয়ে’ বলে খুঁচিয়ে প্রায় পাগল বানিয়ে দিয়েছিল মিতাকে।
সেই ভয় এখনও কাটেনি তাঁর৷ এখানে কেউ যদি আবার জেনে ফেলে তা হলে? মেয়ের মায়াভরা মুখটা মনে হতেই বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠল। বারো বছর পর তার নিজের সন্তান আসছে।
সহ্য করতে পারবে তো মিতা? নাকি নিজেকে অবহেলিত মনে করবে? মনস্তাত্তিক সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে না তো? অজানা আশঙ্কায় মুখটা মলিন হয়ে গেল।
হাজার হোক মিতাই তাদের প্রথম সন্তান।
বিকেলবেলা হাটতে বেরুল মিতা। উত্তর দিকে চট্টগ্রামের রাস্তা ৷ সেদিকে গেল না সে ৷ পুব দিকে সাগর৷ ওদের বাসা থেকে প্রায় চারশো গজ দূরে হবে।
সরু পায়ে চলা পথ। কিছুদূর হাঁটতেই গোরস্তানটা চোখে পড়ল মিতার। অনেক পুরনো লাল ইটের নিচু দেয়াল। পলেস্তরাে খসে পড়েছে ৷ ঝোপঝাড় লজ্জাবতী লতায় ভর্তি। সিমেণ্ট আর মার্বেল পাথরে ঘেরা কবরগুলাে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। কয়েকটা হেডস্টোন খুব উঁচু। ত্রিশ চল্লিশটার মত কবর। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল মিতা।
ভেতরে ঢোকবার ইচ্ছা হলো। কিন্তু একটু ভয় ভয়ও লাগছে। আম বাগানটা নজরে পড়ল ওর৷ কবরস্তানের পাশেই ৷
দোলনায় দুলছে একটা ছোট ছেলে। আরেকটা মেয়ে ধাক্কা দিচ্ছে পাশে দাঁড়িয়ে। মিতার চেয়ে ছোটই হবে মেয়েটা ৷ ছেলেটা আরও ছোট।
ওদের দিকে এগিয়ে গেল মিতা। দাঁড়িয়ে রইল দোলনার পাশে।
‘তুমি দোলনায় ঝুলবে?’ ছোট্ট ছেলেটা বলল। খুব মিষ্টি চেহারা ছেলেটার।
ইস্ ৷ এ রকম একটা ভাই থাকত আমার। ভাবল মিতা ৷ মনটা খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ। নিজের বাবা মারই খবর নেই। আবার ভাই।
দোলনা থেকে নেমে এসে হাত ধরে ওকে টানছে ছেলেটা৷ “তুমি খেলবে? তা হলে এসো।‘
“তোমার নাম কি?”
“টুনু। ওর নাম বিলু।” মেয়েটাকে দেখাল টুনু।
খুশীভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। কিন্তু কিছু বলছে না ৷ আবার কথা বলল টুনু। “বিলু কথা বলতে পারে না।’
‘তোমার বোন না?’
‘হ্যাঁ।’
দােলনায় দুলতে গিয়ে হাত থেকে ফসকে নীচে পড়ে পেল মিতার পুতুলটা ৷
চম্পাকে দেখতে পেল সে। আম বাগানে এসে দাড়িয়েছে। ‘কী, তোমার পুতুল। খুব সুন্দর তাে।
চম্পার কাছ থেকে নিয়ে নিল পুতুলটা মিতা। ‘এইটা আমার বন্ধু ৷’
‘কোথেকে কিনেছ?’
‘পেয়েছি। আমাদের নতুন বাসার দােতলায়,’ খুশীভরা কণ্ঠ মিতার।
সন্দেহভরা চোখে চাইল চম্পা। আগে থেকেই ছিল ওটা?’
‘হ্যাঁ।’
‘পুতুলটা ফিরোজার ছিল। আমি দেখেছি ওর কাছে
এটা ফেলে দিও। ভাল না।,’ বিরল চোখে বলল চম্পা ৷
‘এত্তবড় পুতুল ফেলে দেব, না?
‘নইলে ফিরােজার মত তুমিও মরবে ৷’
চম্পার উপর রাগ হলো মিতার ৷ এসব কথার মানে কী? ‘মরব মানে?’
‘তােমাদের বাসায় আগে থাকত ফিরোজা। দুদিন পুতুলটা দেখেছিলাম ওর কাছে ৷ তারপরই তো ছাদ থেকে পড়ে মারা গেল ও ৷ হাতে তখন এটা ছিল।’
‘ধ্যাৎ ৷ ‘
“চলো ওই দিক থেকে ঘুরে আসি।শেলীদের বাসা না ওটা?’
‘চলো।’
টুনুদের রেখে হাঁটতে লাগল ওরা ৷ শেলীকে দেখা গেল ওদের বাসার বারান্দায় ৷ মিতাদের সাথে যোগ দিল সেও।
‘এখানে এসে অনেক বন্ধু হলো আমার। সবচেয়ে আগে বন্ধু হয়েছে জুলেখা।’ বুকে চেপে ধরল মিতা জুলেখাকে।
‘কে?’ অবাক হলো শেলী ৷
পুতুলটাকে দেখাল মিতা।
বিস্মিত চোখে চম্পার দিকে চাইল শেলী।
‘এই নামটা তুমি কোথায় পেলে?’
“মনে হলো তাই দিলাম ৷ একটু পুরনো ধরনের পুতুল তো।’
‘কেউ বলেনি তােমাকে?’ চোখ আরও বড় হলো।
‘নাহ। ‘
মিতাকে এড়িয়ে আবার মুখ চাওয়া চাওয়ি করল ওরা। কিছু একটা কথা বিনিময় করল চোখে চোখে।
‘এসো আমার সঙ্গে ৷’
মিতাকে টানতে টানতে কবরস্তানের দিকে নিয়ে গেল শেলী। ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ, বুঝতে পারছে মিতা। সেও কোনও কথা না বলে ওদের সাথে ঢুকল গোরস্থানে।
একটা অনেক পুরনো কবরস্তানের কাছে এল শেলী। ঝুঁকে দেখল কিছু একটা। তারপর ঘাস লতাপাতা হাত দিয়ে সরিয়ে একটা হেডস্টোন বের করল। খোদাই করা সিমেন্টে ছোট্ট করে লেখা, ‘জুলেখা।’
আর কিছুই লেখা নেই। কবে জন্ম… কবে মৃত্যু, বাবা মার নাম, নেই।
মিতা কিছু বুঝতে পারল না। শেলী আর চম্পা বিচিত্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কিন্তু ঘাবড়াল না মিতা।
‘চলো আম বাগানে গিয়ে খেলি ৷’ কিন্তু শেলী আর চম্পার মধ্যে খেলার কোনও আগ্রহ দেখা গেল না।
বেশ কয়েকবার মিতাকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখল ওরা।
স্কুলে শিউলির সাথে ছোটখাটো একটা ঝগড়াই হয়ে গেল মিতার। কোথা থেকে যেন শুনেছে যে মিতা বাবা মার পালিত মেয়ে৷ এতিমখানায় ছিল ৷ সেটা ধরেই খোঁচা দিল সে ৷
‘তুমি তো আহাদ সাহেবের মেয়ে না। এতিমখানায় ছিলে। তুমি আমাদের সাথে খেলবে না।’
রাগ চেপে রাখতে পারল না মিতা। শেলী আর চম্পার দিকে তাকাল সে ৷ খবরটা শুনে ওদের মুখেও একটা পরিবর্তন লক্ষ করল। আরও কয়কজন
আছে এই দিকে।
‘খবরদার, বাজে কথা বলবে না। আমি তো আম্মুরই মেয়ে ৷’
‘ৰাড়িতে থাকলেই মেয়ে হয় না। ’ বিদ্রুপ ঝিলিক দিয়ে উঠল শিউলির চোখে।
অসহায় বোধ করছে মিতা ৷ শেলীরাও কিছু বলছে না। মিতা জানে শিউলি সত্যি কথা বলেছে ৷ কিন্তু আব্বু আম্মু এত আদর করে ওকে। ওরাই তাে তার বাবা মা। হঠাত্ কান্না পেল মিতার।
শেলী থামিয়ে দিল শিউলিকে। ‘বেশি প্যাটপ্যাট করো তুমি। এসব নিয়ে তোমার কথা বলার কী দরকার?’
বাসায় ফেরার সময় কেমন জ্বর জ্বর বোধ করল মিতা। শরীর খারাপ লাগছে বলে আপার কাছ থেকে এক ঘন্টা আগেই ছুটি চেয়ে নিয়েছে।
সমুদ্রের ধার দিয়ে হেঁটে আসছে মিতা৷ একা৷ মন খুব খারাপ। শিউলি, শেলী, চম্পা, সবার ওপর রাগ হচ্ছে তার। কচুর স্কুল। আর যাবে না সে ওখানে।
মাথাটা ঝিমঝিম করছে ৷ সমুদ্রের দিকে চাইল কয়েকবার ৷ ফিকে হয়ে আসছে রোদ ৷ কয়েক মিনিটের মধ্যে কুয়াশায় ঢেকে গেল চারদিক।
কেমন একটা অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছে। কুয়াশার পথ ঘাট কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
একটা হালকা ছায়ার মত আবছা দেখতে পেল মিতা ৷ কালো ফ্রক পরা একটা মেয়ে হেঁটে আসছে যেন এদিকে। কুয়াশার ঘর পর্দা ভেদ করে কিছু দেখতে পাচ্ছে না মিতা ৷
গন্ধটা হঠাৎ করেই চিনতে পারল সে। কর্পুরের গন্ধ।
আন্দাজে পা ফেলতে গিয়ে তাল হারিয়ে ফেলল মিতা। জ্বরের ঘোরে বুঝতে পারল না কী ঘটতে যাচ্ছে ৷ হালকা ছায়াটা বাতাসে মিলিয়ে যাবার আগেই উপর থেকে নীচে পড়ল মিতা ৷
বাতাসে তখন সমুদ্রের বুনো গর্জন ছাড়া আর কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
ৰিলুই প্রথম দেখল জ্ঞানহীন দেহটা ৷ বোৰা ৰিস্ময়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল উঁচু রাস্তা থেকে ৷ নীচে কয়েকটা পাথরের উপর অদ্ভুত ভঙ্গিতে শুয়ে আছে সেই একটু আগে দেখা মেয়েটা৷
আহাদ সাহেব থরথর করে কাপছেন ৷ বিলুর দুর্বোধ্য চিত্কারে কয়েকজন লোক জুটে গিয়েছিল ৷ তারাই ধরাধরি করে মিতাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।
যতটা ভয় করেছিলেন ততটা ক্ষতি হয়নি। বাম পায়ের হাড়ে ফ্রাকচার হয়েছে ৷ গ্রীনস্টিক ফ্রাকচার।
‘আল্লার রহমত, মাজেদা ৷ মিতা ভয়েই জ্ঞান হারিয়েছিল৷ চিন্তার কিছু নেই।’
মাজেদা বেগম নির্বাক হয়ে রইলেন। এক্স যে রিপোৰ্টটা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন তারা ৷ মিতা শুয়ে রইল ৰিছানায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধা পা নিয়ে।
রশীদ চেয়ারম্যানের বউ খবরটা শুনে সন্ধ্যার দিকে আহাদ সাহেবের বাড়িতে এলেন।
“এইমাত্র শুনলাম খবরটা। আহা হা ৷ আসতে না আসতেই কী একটা বালা মুসিবত!’
‘আগেই বলেছিলাম পাহাড় পর্বতের কাছে বাড়ি কিনে কাজ নেই… উনি শুনলেন না।’
পাহাড় পর্বতের দোষ নয়, ভাবী, তবে ৰাড়িটা একটু দেখে শুনে কিনলেই হত। ‘
‘এই বাড়িটা তো ভালই। একটু বেশি বড় অবশ্য৷’
‘রাতে একা বাইরে যাবেন না, ভাবী ৷ উঠােনের পাছপালাগুলো অনেক পুরনো তো। সাবধান থাকা ভাল।’
‘কেন?’
‘না, পােয়াতী মেয়েদের একটু সাবধান থাকা ভাল।’
‘ও,’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন মাজেদা বেগম ৷
খারাপ কিছু শুনবেন ভেবেছিলেন … বাড়িটা তাঁর নিজেরই এখন আর ভাল লাগছে না৷ মিতার পা টা ভাঙল এখানে আমার জন্যেই তো৷
জ্বরের ঘোরে মাথা এপাশ ওপাশ করছে মিতা। চোখ মেলে তাকিয়ে আছে মায়ের মুখের দিকে। অপরিচিত আরেকজনকে দেখতে পেল পাশে। রশীদ চেয়ারম্যানের বউ।
আমি চম্পার মা। কেমন আছ তুমি?
উত্তর দিল না মিতা৷ ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘জুলেখা কােথায়?’
“কাকে খুঁজছ?”
জুলেখা! ওর পুতুলের নাম ৷’
কথাটা এখানেও ছড়িয়ে গেছে … ‘মিতা আপনার পালিতা মেয়ে নাকি?’ আস্ত পানটা গালে পুরে জিজ্ঞেস করলেন রশীদ গিন্নী।
“নিজের মেয়ের চেয়ে বেশী ভালবাসি আমরা ওকে,’ বলেই হেসে ফেললেন মাজেদা বেগম। এ ব্যাপারে আর কিছু বলতে চান না।
‘এই পুতুলটা কোথোয় পেলেন?’ প্রায় চমকে উঠলেন রশীদ গিন্নি। প্রাচীন চেহারার পুতুলটা এতক্ষণে চোখে পড়েছে তাঁর৷ টেবিলের ওপর নির্মিমেষ দাঁড়িয়ে আছে।
আমার মেয়ে খুঁজে বের করেছে। দােতলায় দেয়াল আলমারির ভেতর ছিল। ‘
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না রশীদ গিন্নী ৷ কাদের খানের একমাত্র মেয়ে ফিরোজা দােতলায় ব্যালকনি থেকে পড়ে মারা যাবার পর তার বউ নিজে চুলোর আগুনে পুড়িয়ে ছাই করেছিলেন এটাকে। ফিরে এসেছে পুতুলটা। ‘ শিরশির করে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল মেরুদণ্ড দিয়ে। এরই নাম জুলেখা ৷ নামটাও কেমন যেন। কোথায় যেন শুনেছেন আগে ৷ আর দেরি করলেন না। ‘আজ উঠি, ভাবী। কোনও চিন্তা করবেন না। মিতা ভাল হয়ে উঠলে আমার বাসায় বেড়াতে যাবেন কিন্তু।
‘ কার নিয়ে এসেছিলেন রশীদ গিন্নী। স্টার্ট দিচ্ছে ড্রাইভার গাড়িতে ৷ সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন তাকে মাজেদা বেগম ৷ রশীদ আহমেদ বাড়িতেই ছিলেন। হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন তার স্ত্রী।
‘ওগো শুনছ?
“কী ব্যাপার, চম্পার মা?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠ রশীদ সাহেবের।
“কাদের সাহেবের মেয়েটা মারা যাবার সময় একটা পুতুল নিয়ে তার বউ খুব হৈ চৈ করেছিলেন, তোমার মনে আছে?’
না তো।কোন পুতুল?’
‘ফিরোজা সারাদিন ওটা নিয়েই থাকত ৷ শেষের দিকে ৰিড়বিড় করে নাকি আলাপও করত ওটার সাথে।’
“তো কী হয়েছে? বাচ্চা মেয়েরা এমন করতেই পারে।’
‘ আরে না। গভীর রাতে ওই পুতুল হাতে নাকি ছাদে ঘুরে বেড়াত ফিরোজা ৷ ফরিদা ভাবীর ধারণা পুতুলটাই ধাক্কা মেরে তার মেয়েকে দোতলা থেকে ফেলে দিয়েছিল। ফিরেজো মারা যাবার পর চুলোর আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন উনি পুতুলটাকে।’
‘ব্যস, চুকে গেল।‘ মুচকি হাসি রশীদ সাহেবের ঠোটে।
‘ওই পুতুলটা ফিরে এসেছে…’ ফিসফিস করে বললেন রশীদ গিন্নী ৷
“তার মানে…” ভ্র কূচকে গেল রশীদ সাহেবের। ‘এইমাত্র আমি নিজে দেখে এলাম। মিতার পড়ার টেবিলে সাজানো রয়েছে। ‘
‘ওরকম পুতুল আরও থাকতে পারে।’
‘না। দােতলায় দেয়াল আলমারির ভিতর পেয়েছে ওটাকে মিতা। তা ছাড়া অদ্ভুত একটা পুতুল। আমাদের দেশে এ রকম তৈরি হয় না।’
‘আমি তাে এর মধ্যে কোনও রহস্য দেখি না ৷’
‘কি নাম রেখেছে জানাে? জুলেখা।‘ তুরুপের তাসটি টেবিলের রাখলেন রশীদ গিন্নি।
‘তাই নাকি?’ এবার আর কণ্ঠে হালকা সুরটি নেই। “আসতে না আসতেই পা ভাঙল মেয়েটার। দেখো আরও কত কী হয়৷’
চুমকির কাজ করা শাড়ির মত লাগছে সমুদ্রকে ৷ প্রখর রোদ পড়ে ঝিকমিক করছে। কুসুমপুরের সবুজ প্রকৃতিতে যেন আনন্দের শিহরন জেগেছে৷
সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটছে মিতা ৷ পায়ের ব্যাথাটি এখন আর নেই। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে আর কখনও হাঁটতে পারবে কিনা জানে না সে। স্কুলে যেতে চায়নি ও। কিন্তু মাজেদা বেগম বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠিয়েছেন। বিষন্ন হয়ে আছে মিতার চেহারা। ডাইনে দূরে তাকিয়ে দেখতে পেল গোরস্তানের পাশের আম বাগানে এককা দোককা খেলছে তিনটে মেয়ে। বিলুকে চিনতে পারল। ‘ও কি আর কোনওদিন ওদের মত দৌড়ঝাঁপ করতে পারবে? স্কুলে অন্য মেয়েরা কীভাবে তাকাবে ওর দিকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মিতা। পায়ে সামান্য ব্যাথা লাগছে এখন। বাসায় ফিরে যাবে কি? ‘ শিউলির চেহাড়ারাটা দেখতে পেল মনের পর্দায়। মন শক্ত করল মিতা। কারুর সাথে কথা বলবে না সে। দরকার হলে একাই থাকবে। জুলেখার কথা মনে পড়ল ৷ নিয়ে এলে ভাল হত না ?
‘কী তোর পা সারেনি?’ রুপালি আপা জিজ্ঞেস করলেন ক্লাশে৷
‘সেরেছে।’
‘তাে খুঁড়িয়ে হাটছিলি যে?’ অনেক কষ্টে স্বাভাবিকভাবে হাটবার চেষ্টা করেছে মিতা।
পারেনি। চম্পা আর শিউলির দিকে তাকাল। ওরা আজ একসাথে বসেছে ৷ নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছে। ওর দিকে চেয়ে হাসল চম্পা মিতাও চেষ্টা করল হাসতে ৷ কিন্তু পারল না৷ কান্না পাচ্ছে ওর। শেলীদের খুজল বার কয়েক। আসেনি ও। ঢিফিনের সময় শিউলিকে ক্লাশ রুমের কোণায় স্কিপিং করতে দেখল মিতা। চম্পা এসে জিজ্ঞেস করল, ‘স্কিপিং করতে পারবে? তা হলে এসো।’
মিতার খুব রাগ হলো। কোনও সন্দেহ নেই শিউলিই পাঠিয়েছে চম্পাকে ইচ্ছা করেই ৷ ওকে অপমান করতে চায়।
‘ আমি খেলব না। তুমি খেলোগে যাও।’
‘পারলে তাে খেলবে ৷ তোমার তো পা খোঁড়া।’ শিউলি বলল রুমের কােনা থেকে।
‘খোঁড়া!’ মাথার মধ্যে আগুন ধরে গেল মিতার। মনে হলো শিউলিকে খামচে রক্তাক্ত করে দিলে ওর ভাল লাগত। অন্য আরেকটা মেয়ে বোধহয় উপরের ক্লাশের, ধমক দিল শিউলিকে। মিতা আর এক মুহূর্ত দাড়াল না সেখানে ৷ অভিমানে, দুঃখে চোখে পানি এসে গেল। বইখাতা হাতে নিয়ে বাড়ির পথ ধরল। সমুদ্রের ধার দিয়ে উঁচু রাস্তা। মিতা একা হাঁটছে। মার কথা মনে পড়ল। বার বার সাবধান করে দিয়েছেন মা। ‘কিনার দিয়ে হাঁটবি না। সামনে ডাইনে বাঁয়ে দেখেশুনে চলবি। ‘
চোখ ঝাপসা হয়ে এল আবার। অস্বচ্ছ হয়ে গেল চারদিক ৷ রােদের আলো তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে হারিয়ে গেল হঠাৎ। ঘন কুয়াশায় আটকা পড়ল মিতা। এবার আর ভুল করল না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। একটা ছায়া নড়ে উঠল ওর সামনে। ছোট একটা মেয়ে। কালো ফ্রক পরা। মাথায় কালো কাপড়ের কুঁচি দেয়া বনেট।
ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল মিতা। দশ বারো বছরের একটা মেয়ে। ওর পাশে এসে দাড়াল। ইচ্ছে করলেই ছুঁতে পারে মিতা। ইচ্ছে করলেই ৷
দূর্বল একটা কণ্ঠ শোনা গেল ৷ মিতার কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। মনে হলো ওকে কেউ জোর করে ধরে রেখেছে। এখন ইচ্ছা করলেও আর হাঁটতে পারবে না ও।
‘ওরা কেউ তোমাকে দেখতে পারে না।’ ফিসফিস করল মেয়েটা ৷ বাতাসে কাপছে শরীর। ‘তুমি আমার বন্ধু হও। আমরা দুজনে বেড়াব। খেলব। ‘
ঠাণ্ডা হাওয়া লাগল মিতার চোখে মুখে।পুরনো গন্ধটা আবার পাচ্ছে। কপুঁরের গন্ধ ৷
‘কে তুমি?’
‘তােমার বন্ধু।’
‘কেউ আমার বন্ধু না। সবাই শিউলির মত।’ বিড়বিড় করল মিতা।
‘শিউলিকে আমি দেখে নেব। তোমাকে আর খোড়া বলার সাহস পাবে না।’ হিসহিস করে উঠল কণ্ঠস্বর।
মিতার মনে হলো সে এখন স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে পারবে। শরীরটা হালকা লাগছে। বাড়ির দিকে রওনা হলো মিতা। সত্যিই সে হাঁটতে পারছে ৷
কুয়াশা কেটে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। রোদের আলোর ঝলকানিতে মিতা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সমুদ্র, পাহাড়, গ্রাম সবকিছু ৷
টুনু খেলছে আম বাগানে। মিতার খুব ইচ্ছা করছে ওর সাথে দোলনায় দুলতে। একটু আগে দেখা মেয়েটাকে হঠাৎ চিনে ফেলল মিতা। একেই দেখেছে সেদিন স্বপ্নে ৷
গোরস্তানের কাছাকাছি আসতেই আবার খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল মিতা। ভেতরে ঢোকার একটা অদম্য আগ্রহ বোধ করল। নিজের অজান্তেই হাঁটতে শুরু করল সেদিকে।
দোলনায় দোলা বন্ধ করে টুনু একদৃষ্টে চেয়ে দেখছে মিতাকে। গােরস্তানের দিকে কেন হাঁটছে মেয়েটা?
সরু কাঁচা রাস্তার দু পাশে সারি সারি কবর। কেমন যেন নেশার মতো হাঁটছে। সেই কববটার সামনে এসে দাঁড়াল। দুহাত দিয়ে সরিয়ে দিল ঝোপঝাড়। ছোট্ট একটা নাম। জুলেখা। মিতা তাকিয়ে বইল সেদিকে। ওর পুতুলের নাম।
রান্নাঘরে অনেকক্ষণ বসে থেকে হাপিয়ে উঠলেন মাজেদা বেগম। খোলা বিশাল জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যায়। ডানদিকে দিগন্ত ভেদ করে উঠেছে সারি সারি পাহাড়।
বাতাস শির শির করে ঢুকছে রান্নাঘরে। মাজেদা বেগম উদাসভাবে তাকিয়ে রইলেন সমুদ্রের দিকে।
আরে কে ওটা? চমকে উঠলেন মাজেদা বেগম। গোরস্থানের ভাঙা দেয়ালের ওপাশে ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা খুঁজছে মিতা। কী করছে এখানে?
স্কুলে যায়নি ? অজানা অশেঙ্কায় কেঁপে উঠল বুকটা। অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। এরকম একা ভর দুপুরবেলা গোরস্তানে কী করছে?
মিতা দাড়িয়েই আছে৷ নড়ছে না। মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য নিজেই বাড়ি থেকে বের হয়ে এলেন তিনি ৷ জোরে হাঁটতে লাগলেন। ভারী শরীর… হাসফাস করছেন ক্লান্তিতে। জোরে হাটার উত্তেজনায় বুক ধড়ফড় করছে। ঘাম ঝরছে শরীর বেয়ে।
প্রায় সাত মিনিট হেঁটে গোরস্তানের সামনে এসে পড়লেন মাজেদা বেগম।
হাবুর মা বাড়িতে থাকলে তাকে এই কষ্টটা করতে হত না
‘এই মিতা এখানে কী করছিস?
মায়ের গলার আওয়াজ শুনে চমকে গেল মিতা ৷
‘এমনি, আম্মু। জুলেখার কবর দেখছিলাম।’
‘কার কবর?’
‘জুলেখার।‘ হাত তুলে দেখলে মিতা।
“তোর কী মাথা খারাপ হয়েছে? স্কুলে যাসনি?’
‘চলে এসেছি।’
‘বাসায় চল। ‘ মেয়ের হাত ধরে টানলেন মাজেদা বেগম।
‘জুলেখার কবরটা দেখবে না , মা?’
মেয়ের মুখের দিকে তকােলেন মা। শান্ত সমাহিত মুখ। কী মনে করে ঝুঁকে পড়লেন হেডস্টোনটার দিকে লেখাটা চোখে পড়ল।
‘জুলেখা ৷’ অবাক হয়ে উঠে দাড়ালেন।
পাশের কবরটার দিকে নজর গেল। সাদা সিমেন্টের ওপর কালো অক্ষরে লেখা।
‘গুলবাহার বেগম।
পাপে মৃত্যু
১৮ ৭০ সাল।’
এটা কী ধরনের লেখা? এর মানে কি? কুসুমপুর এলাকাটাই যেন কেমন রহস্যে ঘেরা। চিন্তাগ্রস্ত মনে সোজা হয়ে দাড়াতে গেলেন মাজেদা বেগম। হঠাৎ তীব্র ব্যথায় অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশ। কােমরের কাছটায় লক্ষ লক্ষ সূচ ফোটাচ্ছে কেউ।
মায়ের চেহারা দেখে ঘাবড়ে গেল মিতা। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন মাজেদ বেগম ‘জলদি দৌড়ে যা ফার্মেসীতে। তৌর আব্বাকে খবর দে,বলেই বসে পড়লেন মাটিতে।
সময় হয়ে গেছে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড়াচ্ছে মিতা। পিছন থেকে আধাশোয়া অবস্থায় অসহায়ভাবে চেয়ে রইলেন মাজেদা বেগম।
শেষ পর্যন্ত তার প্রথম সন্তান ভুমিষ্ঠ হতে যাচ্ছে এইখানে। এই গোরস্থানে। হায় খোদা!
তুলতুলে পেঁজা তুলোর মত একটা শিশু। আহাদ সাহেব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন। ঠিক মায়ের আদল পেয়েছে। চুমো দিলেন মেয়ের লালচে গালে। দাড়ির খোঁচায় কেঁদে উঠল অবােধ শিশু।
“আবার তুমি কাদাচ্ছ ওকে?’ মাজেদা বেগম কৃত্রিম রেগে বললেন।
মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিলেন আহাদ সাহেব বাচ্চাটাকে। কান্না থামবার কোনও লক্ষণ নেই পিচ্চিটার।
‘মিতা কােথায়?’
“কী জানি। সকাল থেকেই তো দেখছি না ওকে। স্কুলেও গেল না আজকে।’
মিতাকে পাওয়া গেল তার ঘরে। জুলেখাকে বুকে ধরে ঘুমিয়ে আছে।
উদ্বিগ্ন হলেন আহাদ সাহেব। এই সময় কখনও ঘুমায় না মেয়েটা। অসুখ করেনি তো? চোখের কোনা সামান্য চকচক করছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে মিতা ৷
সকাল থেকে একটু দুরে দুরে ছিল মিতা। ব্যাপারটা মাজেদা বেগমকে বলতেই উত্তর দিলেন, ‘তােমাকে আগেই বলেছি, মিতার ব্যাপারে একটু কেয়ারফুল থাকা দরকার। কােনওভাবেই ও যাতে মনে না করে যে ওকে আমরা অবহেলা করছি ৷ ‘
আমি তো খুব কেয়ারফুলই থাকি ৷ ‘
সকাল থেকে একবারও মিতার সাথে কথা বলেছ তুমি?’
আমতা আমতা করলেন আহাদ সাহেব ৷ সত্যিই খেয়াল করেননি ব্যাপারটা।
উঠোনের কোনায় একটা ছোট ঘর। লাল ইটের তৈরি। টালির ছাদ। দেখলেই বোঝা যায় বহুকাল ব্যবহার করা হয়নি ওটা।
হাবুর মা সকাল থেকেই পরিষ্কার করছিল ঘরটা। মাকড়সা, তেলাপোকা আর ছুঁচোর মচ্ছব ভিতরে। ধুলায়, ময়লায় কাশতে কাশতে হার্টফেল হবার দশা
ভেতরটা খারাপ নয়। অদ্ভুত কিছু জিনিস পাওয়া গেল সেখানে৷ কয়েকটা পেইন্টেড আর কয়েকটা খালি ক্যানভাস। ছবি আঁকত চৌধুরীদের কেউ। মেঝেটা দেখে অবাক হলেন মাজেদা বেগম। পুরোটাই মােজাইক্ করা।
জবরজং ছোট্ট ঘরটার এত সুন্দর মেঝে ভাবাই যায় না।
ঝেড়েমোছে ঝকঝকে করে ফেলল রুমটা হাবুর মা।
চিমসে বুড়িটার গায়ে শক্তি আছে বটে। কালো একটা লম্বা দাগ কিছুতেই উঠছে না। প্রায় দেড় ফুট লম্বা বিচিত্র ধরনের একটা দাগ।
কিছু একটা পড়েছিল মেঝেয়। এখনও উঁচু হয়ে আছে। কীসের দাগ?
হঠাৎ ভয় পেয়ে গেলেন মাজেদা বেগম।
কোনও সন্দেহ নেই। রক্তের দাগ ৷ এখানে রক্তের দাগ কেন? দ্রুত হেঁটে গিয়ে আহাদ সাহেবকে ডেকে নিয়ে
এলেন তিনি। ‘এই দেখ, এটা কীসের দাগ? কিছুতেই উঠছে না। ‘
‘কত কিছুর দাগ হতে পারে। কী করে বলি।’
আমার মনে হয় রক্তের দাগ, ‘ ফিসফিস করে বললেন মাজেদা বেগম।
‘এরকম মনে হলো কেন তােমার?’
‘এই বাড়িটায় ভূতুড়ে কিছু একটা আছে। পুরনো জমিদারবাড়ি। এখানে রক্তের দাগ থাকতেই পারে।”
আহাদ সহেবের গা ঘেষে দাড়ালেন মাজেদা বেগম৷
‘খুঁচিয়ে তুলে ফেলো দাগটা, হাবুর মা ৷ দা, ছুরি কিছু একটা, দিয়ে খোঁচাও।’ বললেন আহাদ সাহেব।
স্কুলে আবার শিউলির’ সাথে ঝগড়া হয়ে গেল মিতার। সবার আগে এসে সামনে বসেছিল মিতা। লাল সুটকেসটা রেখে বাইরে গিয়েছিল।
দশ মিনিট পরে এসে দেখল আগের জায়গায় নেই সুটকেসটা ৷ কেউ ওটাকে দ্বিতীয় বেঞ্চে নিয়ে রেখে দিয়েছে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল মিতার।
শিউলির কথাই মনে পরল প্রথম। তাই হবে ৷ ওর ব্যাগটা রয়েছে সামনের বেঞ্চে ৷
আমার সুটকেস সরিয়েছ কেন?
আমার বয়েই গেছে তোমার সুটকেস ধরতে,’ ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল শিউলি। ‘আমি সরিয়েছি ওটা মিতা। আমরা একসঙ্গে বসব।‘ পিছন থেকে বলল শেলী।
‘আন্দাজী কথা বলো কেন তুমি? আমি আপাকে বলে দেব।‘ খেপে উঠল শিউলি।
“বলো গে।’
বলবই তো ৷ বেশি ডাট হয়েছে না? ল্যাংড়া মেয়ের এত ডাট ভাল না।’ খোঁচা দেবার জন্যেই বলল শিউলি।
কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল মিতার। আর কিছু শুনতে পাচ্ছে না সে। অস্পষ্ট কয়েকটা কথা কানে গেল ৷
ঢং কত, ধাড়ি মেয়ে পুতুল নিয়ে স্কুলে আসে ৷’
মিতাকে টেনে বাইরে নিয়ে গেল শেলী ৷ ইচ্ছা করছিল খামচে রক্তাক্ত করে দেয় শিউলির মুখচােখ ৷
টপ টপ করে কয়েক ফোটা পানি পড়ল মিতার চোখ বেয়ে ৷
‘শিউলিটা না ভারি পাজি। তুমি কিছু মনে কােরাে না, কেমন?’ সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল শেলী।”
কেন, ওর কী দোষ? না জেনে শিউলিকে বলতে গেল কেন মিতা?’ পেছন থেকে বলল আরেকটা মেয়ে।
রাগে দুঃখে স্কুল থেকে বেরিয়ে এল মিতা। পায়ের ব্যাথাটা বাড়ছে দ্রুত। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল। সুটকেসটাও ভারী মনে হচ্ছে খুব।
জুলেখার দিকে চোখ পড়া মিতার। দুধ সাদা চোখ দুটো ভাবলেশহীন চেয়ে আছে। মনে হচ্ছে খুব দুঃখ পেয়েছে সেও।
সমুদ্রের ধারে আসতেই বাতাসের ঠাণ্ডা ছোঁয়া লাগল শরীরে ৷ হঠাৎ কেঁপে উঠল সূর্যের আলো। দেখতে দেখতে ঘন কুয়শায় ঢেকে গেল চারপাশ।
বাতাসে তাসছে সেই পুরনো গন্ধ। কালো ফ্রক পরা ছায়াটাকে আবার দেখতে পেল মিতা। বাতাসে তির তির কাপছে৷ ‘বাড়ি যেও না, মিতা। বসে থাকো ওই গাছের আড়ালে ৷’ আদেশের সুরে বলল মেয়েটা ৷ জুলেখাকে আরও জোরে বুকের সাথে চেপে ধরল মিতা৷ পায়ের ব্যথাটা একদম সেরে গেছে। মন্ত্রমুগ্ধের মত কাজ করল সে। হেঁটে গিয়ে বিশাল বটগাছটার আড়ালে শিকড়ের ওপর বসে রইল। ঘন কুয়াশার চাদর ঢেকে দিয়েছে সব কিছু ৷ ঘুম পাচ্ছে এখন ওর। মিনিট, ঘণ্টা কীভাবে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না কিছু। ঘোর লেগে গেছে। কালো বনেট পরা ছায়াটাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও৷ হঠাৎ দূরে হাসির শব্দ শোনা গেল। বারো তেরো বছরের কয়েকটা মেয়ে হাসছে ৷ আসছে এদিকে ৷ কান খাড়া করে রইল মিতা। পরিচিত কণ্ঠটা শুনতেই রাগে হাত পা জ্বলতে লাগল ওর। ফ্রক পরা ছায়াটাকেও দেখা গেল হঠাৎ। কোনও কিছু বোঝার আগেই পা টিপে টিপে উঠে এল মিতা৷ হিস হিস করে উঠল একটা মিহি কণ্ঠ , ‘আসছে। এই সুযোগ ৷’ কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করল মিতা। চুম্বকের মত টানছে ওকে ফ্রক পরা মেয়েটা ৷ ‘আমি তোমার বন্ধু৷ ওরা তোমাকে ভালবাসে না। এসো আমার সঙ্গে।‘
দুই দিকে বেণী ঝোলানাে একটা মেয়েকে আবছা মত দেখতে পেল মিতা। কাঁধে ঝুলছে দামী স্কুল ব্যাগ৷ একা। কেমন সতর্ক পায়ে এগুচ্ছে মেয়েটা। এখনও ওর মুখোমুখি যায়নি মিতা। দু ধার দিয়ে উঁচু ঢাল ৷ প্রায় পঁচিশ তিরিশ ফুট নীচে চিকচিক করছে বালু আর পাথর ৷ ঢালের ওপর দিয়ে হাটছে মেয়েটা ৷ মিতাকে দেখেই চমকে উঠল ৷ দু’হাতে বিদ্যুৎ খেলে গেল মিতার।
নিজেও চমকে উঠল সে। এত শক্তি সে পেল কোথায়? ওর আর মেয়েটার মাঝখানে কালো ফ্রক পরা ছায়াটাকে মুহূর্তের জন্যে দেখতে পেল মিতা। সাদা চোখ দুটো পাথরের মত নিষ্প্রান। মূহূর্তের মধ্যে কেটে গেল কুয়শার মেঘ। ঝলমল করে উঠল রােদেলা দুপুর।
বিশাল চালের ওপর একা দাড়িয়ে আছে মিতা। পায়ে ভীষণ ব্যাথা। কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠল। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা ৷ সুটকেস হাতে নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো সে। যে কোনও সময় ও জ্ঞান হারাতে পারে। খুব দুর্বল লাগছে। এদিকে বোবা বিলু তখন আতঙ্কিত চোখে চেয়ে আছে মিতার দিকে।
কয়েকশ গজ দূরে আমবাগানে খেলতে খেলতে খুব খারাপ কিছু একটা দেখেছে সে। খুব খারাপ।
স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরছিলেন হাশেম সাহেব। সমুদ্রের পাশে পাশে অনেকদূরে যেতে হয় তাঁকে। সাইকেল চেপেই যাতায়াত করেন প্রতিদিন। শাহবাজপুর প্রায় আড়াই মাইল দূরে এখান থেকে।
রোদ এখনও চড়া। ঘামে ভিজে উঠছে সার্ট। কুসুমপুর জামে মসজিদের গম্বুজে ঠিকরে পড়ছে রোদ। খুব ধীরে প্যাডেল করছেন হাশেম সাহেব।
সামনে বড় একটা বাঁক। বাঁকের মাথায় বুড়ো বটগাছটা ঝিরঝির বাতাস ছাড়ছে।
নীচে ঢেউয়ে ঢেউয়ে নাচছে সমুদ্র।
আরে ! কী ওটা?
জোরে প্যাডেল করে কাছে চলে এলেন হাশেম সাহেব। ভাল করে দেখে চমকে উঠলেন ভীষণভাবে ৷
ত্রিশ হাত নীচে বড় পাথরগুলাের মাঝখানে চার হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে কাজেম সওদাগরের ছোট মেয়ে শিউলি।
জোয়ারের পানি প্রায় ছুয়ে ফেলেছে ওর পা। দেখলেই বোঝা যায় প্রাণহীন দেহটা অনুভব করতে পারছে না কিছুই। তাড়াতাড়ি সাইকেল থেকে নেমে চালের নীচের দিকে রওনা হলেন হাশেম সাহেব।
আর দশ মিনিট দেরি হলে পানিতে ভেসে যাবে লাশটা। তার আগেই তুলে আনতে হবে ওকে। পরে খবর দেয়া যাবে লোকজনকে ৷
জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে মিতা ৷ ডাক্তার বলেছেন চিন্তার কিছু নেই। কড়া রোদে অনেকক্ষণ বসেছিল বোধ হয়। তাই জ্বর উঠেছে ৷
বিলুর কাছ থেকে জানতে পেয়েছেন মাজেদা বেগম দৃপুরের রােদে সমুদ্রের ধারে গাছের কাছে বসেছিল মিতা। আরও কী কী যেন বলতে চাইছিল মেয়েটা। তিনি বুঝতে পারেননি।
মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন মাজেদা বেগম ৷ বিড়বিড় করে জুলেখার নাম বলছে মিতা। ‘ওহ পুতুলটাই মত নষ্টের মূল।’ মনে মনে বললেন তিনি।
রশীদ চেয়ারম্যানের বউ অনেকভাবে চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিলুর কথা বুঝতে পারছেন না কিছুতেই ৷ বোবা মেয়েটা হাত নেড়ে মুখের বিচিত্র ভঙ্গি করে কিছু একটা বলতে চাইছে।
শুধু বুঝতে পারলেন শিউলির মৃত্যুর সাথে মিতার একটা সম্পক আছে।
কি সেটা?
সকালবেলা উঠোনের ধার ঘেঁষে লাগানো ফুলের চারাগুলােতে পানি দিচ্ছিলেন মাজেদা বেগম ৷ মৌসুমী ফুলের চাষ করা তাঁর পুরনো অভ্যাস ৷
টালির ঘরটাকে স্টোর রুম হিসাবে ব্যবহারের ইচ্ছা আছে তাঁর। টুকিটাকি জিনিসপত্র রাখা যাবে ওখানটায়৷
দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন মাজেদা বেগম। ঝকঝক করছে ঘর।
মেঝের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেলেন। মেরুদণ্ড বেয়ে বয়ে গেল ঠাণ্ডা একটা স্রোত ৷
লম্বা কালচে দাগটা তেমনি আছে ৷
দৌড়ে বেরিয়ে এলেন মুহূর্তে ৷ সমস্ত শরীর কাঁপছে।
স্পষ্ট মনে আছে গতকাল খুন্তি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পুরো দাগটা ভুলে ফেলেছিল হাবুর মা।
তখনও ফার্মেসীতে যাননি আহাদ সাহেব ৷ সব শুনে থ হয়ে গেলেন। নিজে এসে দেখলেন বিদঘুটে দাগটা ৷ কোনও কথা সরল না মুখে ৷
“এই ঘরটা ব্যবহার না করাই ভাল ৷ বন্ধ করে রাখো এটা৷ দরকার নেই স্টোর রুম।’
এই বাড়িটায় যে অস্বাভাবিক কিছু একটা আছে এতদিন পর সেটা স্বীকার করলেন আহাদ সাহেব।
আরও খোঁজ খবর নিয়ে ফেলা উচিত ছিল বাড়িটা।
স্কুলে মিতাকে এড়িয়ে চলতে লাগল ওরা ৷ একমাত্র শেলি ছাড়া ওর আর কোনও বন্ধু সেই। চম্পা ওকে দেখলেই কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে যায়।
কথাটা ছড়িয়ে পড়েছে ভেতরে ভেতরে। মিতার পুতুলটার কথাও জানে ওরা। হেডমাস্টারকে সব কথা খুলে বলেছেন আহাদ সাহেব।
“হয় এ রকম ৷ আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে ৷ আশ্বাস দিয়েছেন উনি ৷’
পিছনের বেঞ্চে চুপচাপ বসে থাকে মিতা। কখনও খেলতে যায় না। শেলির সাথে কথা বলে মাঝে মাঝে।
শুক্রবার সকালে হাঁটতে হাঁটতে আম বাগানের কাছে চলে এল মিতা। খুব অস্থির লাগছে ওর। জুলেখার সাথে কথা বলেছে রাতে ৷
ঘুমুতে যাবার পরপরই একটু শীত শীত লাগছিল ওর। বাতাসে একটা গন্ধ ভেসে এল হঠাৎ ৷ টেবিলের ওপর রাখা জুলেখার দিকে চাইল মিতা।
ভুল দেখল কী?
আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে ওটা। এক সময় হাওয়ায় ভাসতে লাগল যেন।
বিছানায় সেঁটে গেল মিতা। মেঝেতে নাক ডাকচ্ছে হাবুর মা। মিহি একটা অস্পষ্ট স্বর শোনা গেল ৷
‘তােমাকে খুব পছন্দ করি আমি। কিন্তু তোমার আববু আম্মু তোমাকে ভালবাসে না ৷ ‘
প্রতিবাদ করতে চাইল মিতা ৷ কিন্তু গলায় জোর পেল না।
‘তুমি ওদের মেয়ে নও, রীতা ওদের মেয়ে। রীতা’কে আদর করে ওরা। ও থাকলে তোমাকে কেউ ভালবাসবে না।‘
একঘেয়ে সুরে বলে যাচ্ছে কেউ।
কই উঠে পড়ো ৷ এখনই সময়।’
চিন্তা করবার শক্তি হারিয়ে ফেলল মিতা। স্বপ্ন দেখছে বলে মনে হলো।
হঠাৎ পাশের রুম থেকে কেঁদে উঠল রীতা ৷ অবুঝ শিশুর আতঙ্কিত কান্না ৷
মাঝখানের দরজা খােলাই ছিল। পায়ে পায়ে এগিয়ে এল মিতা। কখন যে ৰিছানা থেকে উঠে পড়েছে খেয়াল নেই। রীতার বিছানার কাছে চলে এল নিঃশব্দে ৷
আহাদ সাহেব, মাজেদা বেগম কেউ নেই। এখনও শুতে আসেননি ওরা। ড্রয়িং রুমে রয়েছেন।
ছোট মশারীটা গুটিয়ে তুলতুলে ফর্সা শিশুটিকে কোলে তুলে নিল মিতা। আরও জোরে কাঁদতে শুরু করল রীতা। বুকের সাথে জোরে ঠেসে ধরল ওকে।
ইস কী সুন্দর ৷ গালে একটা চুমাে দিল মিতা। কিন্তু নিজের হাত দুটাকে কিছুতেই সামলে রাখতে পারছে না ও, আরও জোরে পিচ্চিটাকে ঠেসে ধরল দুহাত দিয়ে ৷
কর্পূরের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে এ ঘরেও। ভয় পেল মিতা। নীল হয়ে উঠেছে বাচ্চাটার ফর্সা মুখ ৷ শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। হাত থেকে ছেড়ে দিতে চেষ্টা করল ওকে ৷ কিন্তু পারছে না।
প্রাণপণে চেঁচাতে গিয়ে খুক খুক করে কাশছে রীতা।
কী রে মিতা কী হয়েছে?‘ গলা মাজেদা বেগমের ৷ কান্নার শব্দে উঠে এসেছেন ওপরে ৷
“কাদছে মা। রীতা কাঁদছে। ‘ ঘোর কেটে গেছে মিতার।
‘আমাকে ডাকিসনি কেন! দেখি দেখি। ইস ৷ এত ঠেসে ধরে কোলে নেয় কেউ। আরেকটু হলেই তো দম বন্ধ হয়ে যেত।’
কড়া গলায় ধমক দিলেন মাজেদা বেগম।
রীতাকে কোলে নিয়ে আদর করছেন ৷ “শুয়ে পড়গে যা।’
চোখে জল এসে গেল মিতার। অভিমানে কোনও কথা বলল না ৷ চুপচাপ এসে শুয়ে রইল বিছানায়। রাতে আবার সেই স্বপ্নটা দেখল ৷
কালো ফ্রক পরা একটা অন্ধ মেয়েকে সবাই মিলে খেপিয়ে, খুঁচিয়ে উত্ত্যক্ত করে তুলছে। শেষ পর্যন্ত উচু ঢাল থেকে নীচে পড়ে পেল অসহায় মেয়েটা।
ছোট্ট মেয়েটার চোখে মুখে কী অসহ্য বেদনা। ক্রোধ আর প্ৰতিহিংসার আগুন। ঢাল বেয়ে উঠে আসছে সে অদ্ভুত ভঙ্গিতে। সাদা দৃষ্টিহীন চােখ জুড়ে প্রচণ্ড আক্রোশ।
ঘামে বালিশ ভিজে গেল মিতার। শরীরটা অল্প অল্প কাঁপছে। মার কাছে গিয়ে শুতে ইচ্ছে করল খুব। কিন্তু রীতা আছে ওখানে। অন্ধকারে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল মিতা ৷
‘শুনছ, মিতার ভাবসাব খুব একটা ভাল মনে হচ্ছে না।‘
‘কী করেছে?‘
‘একটু আগে রীতার কান্না শুনে ওপরে উঠে দেখি ওকে ধরে চাপ দিচ্ছে মিতা। দম প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নীল হয়ে গিয়েছিল চেহারা। আমি সময়মত না গেলে হয়তো মরেই যেত।‘
‘কি যা তা বলছ?’ উষ্মা প্রকাশ করলেন আহাদ সাহেব।
‘হ্যা। আমার মনে হয় কিছু একটা আছে ওর সঙ্গে। কেমন ঢুপচাপ হয়ে গেছে হাসি খুশি মেয়েটা৷’
‘ওসব না। পা টা নরমাল হচ্ছে না বলে খুব আপসেট হয়ে আছে ও।’
‘ঢাকায় নিয়ে দেখানো দরকার। মেয়েমানুষ। আল্লা না করুক কিছু একটা হয়ে গেলে… তখন?’
মাজেদা বেগমের গলা দুশ্চিন্তায় কেঁপে উঠল।’
‘প্রফেসর শরীফকে দেখিয়েছি না? উনি তো বললেন আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।’
দােলনায় দুলছিল বিলু। পেছন থেকে ধাক্কা দিচ্ছে টুনু৷ সুন্দর ছেলেটাকে দেখে ওর এর দিকে এগিয়ে গেল মিতা। এই ছেলেটা খুব ভাল। সুন্দর করে হাসে।
তুমি খেলবে?’ আগ্রহের সঙ্গে বলল টুনু।
“হ্যা।’ ঘাড় কাত করল মিতা।
মিতাকে দোলনার দিকে আসতে দেখে নেমে পড়ল ৰিলু৷ মিতা ধাক্কা দিক এটা চায় না সে। শিউলি মারা যাবার সময় চালের ওপরে ওর সাথে মিতাকেও দেখেছে সে। ঠিক বুঝতে পারেনি কী ব্যাপার। কিন্তু হঠাত্ করে দেখল আচমকা ঢালের ওপর থেকে নেই হয়ে গেছে শিউলি।
কিন্তু টুনু নাছেড়াড়বান্দা। মিতাকে খেলতে নেবেই সে। বেশ কয়েকবার ওকে দোলনায় তুলে ধাক্কা দিল টুনু। ভাল লাগছে।
এবার উঠল বিলু। দুজনে খুব জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে। প্রায় সাত আট ফিট্ উঠে যাচ্ছে দোলনা। খিল খিল করে হাসছে বোবা মেয়েটা।
এখন থামা দরকার। দম হারিয়ে ফেলেছে সে। কিন্তু থামছে না মিতা। ব্যা ব্যা করে কিছু একটা বলল বিলু। বুঝতে পারছে না মিতা। আরও জোরে ধাক্কা দিল এবার।
ভয় পাচ্ছে বিলু ৷ প্রায় দশ এগারো ফিট উঠে আসছে দোলনা। আর্তনাদ করছে সে। কিন্তু কিছুতেই থামছে না মিতা।
মিতার চারপাশে তখন ঘন কুয়াশা। কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে কেউ “এই মেয়েটা তোমার শত্রু। তোমাকে খেলায় নিতে চায়নি ৷ তোমাকে পছন্দ করে না। এই সুযোগ। ’
নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারছে না মিতা। সবাই তার শত্রু, শুধু জুলেখা তার একমাত্র বন্ধু। ‘কোথায় জুলেখা।‘
‘এই যে। তোমার পেছনে৷’
হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে এক ধাক্কা মারল মিতা। প্রায় চােদ্দ ফুট উপরে উঠে পেল বিলু। হাত থেকে ছুটে গেল মোটা দড়ি ৷
হাওয়ার উড়ে এল যেন মেয়েটা৷ মাথাটা আগে পড়ল শক্ত মাটিতে। ধড়ম করে পুরো শরীরটা বাড়ি খেল প্রচণ্ড ভাবে।
প্রাণঘাতী আর্তনাদ করে উঠল বিলু। ভ্যা করে কেঁদে ফেলল টুনু ৷ হাত পা মাটিতে ছড়িয়ে নিথর হয়ে গেল বোবা মেয়েটা।
তখনও অনবরত দুলছে দােলনাটা। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাড়িয়ে রইল মিতা ৷ বিলুর নাক দিয়ে দু ফোটা রক্ত গড়িয়ে পড়ল। পায়ের ব্যাথাটা আবার বাড়ছে ৷ খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে দৌড়াতে লাগল মিতা৷ চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়াচ্ছে।
মিতার কাছে খবর পেয়ে সবাই জানতে পারল কী ঘটেছে। টুনু একটানা কাদছে তো কাঁদছেই! মিতাকে দেখাচ্ছে আর বলছে, ‘ধাক্কা দিছে এ্যা এ্যা এ্যা।’
গলা শুকিয়ে গেল মিতার। কােনওমতে ওকে বাসায় নিয়ে এলেন আহাদ সাহেব ৷ বিলুর মায়ের গালাগালি আর আহজারিতে পাগল হবার দশা তার।
সবাই সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে মিতার দিকে। রশীদ চেয়ারম্যান বলেই ফেললেন, ‘মেয়েটাকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিন, আহাদ সাহেব। এখানে থাকাটা ওর নিজের জন্যেই খারাপ হবে।’
মাজেদা বেগম এই প্রথম মারলেন মেয়েকে। চড় খেয়ে কোনও কথা বলল না মিতা। কাঁদল না পর্যন্ত। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। চুপচাপ নিজের ঘরে এল সে। সেই কপুঁরের গন্ধটা নাকে এল ৷ হিসহিস করে উঠল পরিচিত কণ্ঠ।
“আমি ছাড়া আর কেউ তোমার বন্ধু নয়। শত বছর ধরে তোমার অপেক্ষায় ছিলাম আমি। ‘তুমিও আমার বন্ধু নও। তুমি আমার ক্ষতি করতে চাও।’
ক্ষুব্ধ স্বরে বলল মিতা। “না না।’ আর্তনাদ করে উঠল কণ্ঠটা ৷ ‘তােমার চোখেই আমি দেখছি সব ৷ কাউকে আমি ছাড়ব না।’
‘কী চাও তুমি’? কান্না কান্না সুরে বলল মিতা ৷
“আমার মায়ের কী হয়েছিল দেখতে চাই। দেখাও আমাকে।”
“কী দেখাব?’
‘উঠানে চলো… ওঠাে।’ দরোজার খিল খুলে বাইরে বেরিয়ে এল মিতা। খালি পায়ে নিঃশব্দে হাটছে। বুকে শক্ত করে ধরে রেখেছে জুলেখাকে। উঠানে নেমে স্টোররুমের কাছে এল ও।
‘ভেতরে ঢোকাে৷’
“কী করে ঢুকব্? তালা দেযা যে ৷’ অসহায় শোনাল ওর গলা।
“ভাঙো তালা৷”
ভাঙো’ কর্কশ শোনাচ্ছে কন্ঠ। ছোট্ট টিপ তালাটায় প্রচণ্ড জোরে চাপ দিল মিতা। কখন যে কেটে গেছে নরম হাত বুঝতেও পারল না। কিন্তু খুলে গেল তালা। উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সব৷ কাঁচের জানালা দিয়ে চুইয়ে পড়ছে আলো ৷ অদ্ভুত আলো আঁধারির খেলা ঘরটাতে। এক কােনায় কিছু জিনিসপত্র স্তুপ করা। ‘দেখো কী হচ্ছে এখানে। দেখো ৷ বলো আমাকে।’
প্রাচীন খসখেসে গলায় বলল সে। এতক্ষণে কালো ফ্রক পরা মেয়েটাকে দেখতে পেল মিতা। দাঁড়িয়ে আছে ওর পাশেই। কড়া গন্ধে ভরে গেল ঘরটা। মিতার চোখের সামনে ধোয়াটে আবছায়া ৷ মনে হচ্ছে কোনও এক অজানা পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে সে। কয়েকবার কেঁপে উঠল ওর সামনের কুয়শার চাদর। স্পষ্ট দেখতে পেল সে খুব সন্দর চেহারার একটা মেয়ে শুয়ে আছে দামী চাদরে ঢাকা বিছানায়। অদ্ভুত মায়াবী হাসি ওর মুখে। সামনেই বসে আছে লম্বা একহারা একটা লোক। পুরু গোঁফ আর ঝাকড়া চুল লোকটার ৷ সালােয়ার কামিজ পরা মেয়েটার মাথা হাতের ওপর নিয়ে বসে আছে সে। মাথাটা ঝুঁকিয়ে কিছু একটা বলছে ৷
“বলো কী দেখছ। বলো আমাকে।”
তীব্র কঠিন কণ্ঠে বলল কালো ফ্রক পরা মেয়েটা। হুবহু বর্ণনা করল মিতা যা দেখছে তাই। এবার হাসছে ওরা ৷ পকেট থেকে দামী একটা নেকলেস বের করল লোকটা। খুব যত্ন করে পরিয়ে দিল মেয়েটার গলায়৷ চোখে চোখে তাকিয়ে হাসল ওরা ৷
এই পর্যন্ত শুনেই করুণ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল কালো ফ্রক পরা মেয়েটা, “হায় হায় আমাকে যারা খেপাচ্ছিল… ওরা তা হলে মিথ্যে বলেনি ! ‘
হিংস্র দেখাচ্ছে কালো ফ্রক্ পরা মেয়েটাকে। ঘৃণায়, কষ্টে বিকৃত হয়ে গেছে ওর মুখ। হঠাৎ চমকে উঠল গোঁফঅলা লোকটা।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়েছে আরেকজন লোক। জমিদারী কেতায় শেরওয়ানী পরে আছে। দু চোখ ঠিকরে আগুন রেরােচ্ছে ওর। দাঁতে দাঁত চাপছে রাগে।
আচমকা বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে এক প্রচণ্ড ধাক্কায় শেরওয়ানী পরা লোকটাকে ঘরের কোনায় পাঠিয়ে দিল গোঁফঅলা ৷ তারপর এক দৌড়ে বাইরে চলে গেল। সেদিকে ফিরেও তাকাল না নতুন লোকটা। তার হাতে ততক্ষণে চলে এসেছে লম্বা একটা ছুরি। দুপা সামনে এগিয়ে এল সে।
ভয়ে, আতঙ্কে বিছানার সাথে কুঁকড়ে গেছে মেয়েটা। করুণ সুরে মিনতি করছে ৷ ‘ ম্লান আলোয় ভরে গেছে ঘর। নির্মমভাবে পুরো ছুরিটা খ্যাচ করে মেয়েটার বুকে বসিয়ে দিল লােকটা। রক্ত পানি করা স্বরে আর্তনাদ করে উঠল মেয়েটা। আর্তনাদ করে উঠল মিতাও ৷ রক্তে ভেসে যাচ্ছে বিছানা, মেঝে। দুহাতে চোখ ঢাকল সাথে সাথে। মিলিয়ে যাবার আগে কঠোর কণ্ঠে বলল কালো ফ্রক পরা মেয়েটা, ‘উচিত শিক্ষা হয়েছে তোমার গুল বাহার বেগম।‘
ঘোর কেটে গেল মিতার। নিজেকে আবিষ্কার করল সে উঠােনের ছোট ঘরের ভেতর একা। সারা শরীর কাঁপছে উত্তেজনায় ৷
একটা আর্তচিত্কার শুনে ঘুম ভেঙে গেল মাজেদা বেগমের। কী ব্যাপার? চোর ডাকাত? নাকি অন্য কিছু? স্বামীকে ডেকে তুললেন তিনি। দরজা খুলে ৰারান্দায় এসে দাড়ালেন কী ব্যাপার জানতে। উঠানের দিক থেকেই এসেছে চিতকারটা।
এদিক ওদিক কিছুক্ষণ তাকিয়েই ছোট্ট ঘরটার দিকে দৃষ্টি গেল মাজেদা বেগমের ৷ দরজা খোলা কেন? ‘এই দেখছ ওই ঘরের দরজা খোলা কেন ?’
‘চাের নাকি?’ ফিসফিস করে বললেন আহাদ সাহেব।
হঠাৎ একটা হার্টবিট মিস হয়ে গেল তাঁর ৷ মাজেদা বেগমেরও রক্ত হিম হয়ে গেল ভয়ে।
খোলা ঘরের ভেতর থেকে জুলেখাকে কোলে নিয়ে সন্তর্পণে হেঁটে বেরিয়ে আসছে মিতা।
কিংকর্ভা1বিমূঢ় হয়ে পড়লেন আহাদ সাহেব। হাতের টর্চটার কথা মনে পড়ল তাঁর। সরাসরি মেয়ের মুখের উপর ফেললেন আলো ৷
‘ওখানে কী করছ, মা এত রাতে?’
চমকে বারান্দার দিকে চাইল মিতা। ভিড়মি খাবার যােগাড় হলো আহাদ সাহেবের। সারামুখে রক্তের দাগ মিতার।
‘ও মাগাে।‘ বলেই জ্ঞান হারালেন মাজেদা বেগম। খপ করে পড়ন্ত শরীরটাকে ধরে ফেললেন আহাদ সাহেব ৷ আস্তে করে শুইয়ে দিলেন বারান্দার ওপর।
মিতা উঠে আসছে ওপরে ৷ সিঁড়িতে হালকা পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
বাড়িটা ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন আহাদ সাহেব। এখানে থাকলে মাজেদা বেগম হয়তো পাগল হয়ে যাবেন। মিতাকেও হারাতে হতে পারে।
এরিমধ্যে সবার আতঙ্কের বস্তুতে পরিণত হয়েছে মেয়েটা। স্কুলে যাওয়া বন্ধ ৷ কেউ খেলতে চায় না ওর সাথে। মাথা খারাপ হতে দেরি নেই ওরও।
ওদিকে রশীদ গিন্নী বাড়ি বাড়ি বলে বেড়াচ্ছেন মিতা ইচ্ছা করেই বিলুকে মেরে ফেলেছে ৷ শিউলিকেও ওই ফেলে দিয়েছে ঢাল থেকে।
এখানে আর না। কেউ বাড়িটা না কিনলে এটাকে ফেলে রেখেই চলে যাবেন কুসুমপুর ছেড়ে ৷
মিতাকে আলাদা ঘরে শুতে দিলেন না মাজেদা বেগম। জুলেখাকেও আনতে দিলেন না এ ঘরে। বড় খাটের ওপর ঠাসাঠাসি করে শুয়ে রইলেন সবাই মিলে।
বেহুঁশ হয়ে ঘুমাচ্ছে মিতা। সুন্দর মুখটা ক্লান্ত লাগছে ৷ এই ক’মাসে অনেক শুকিয়ে গেছে মিতা। সত্যিই খুব কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা।
আহাদ সাহেবের বুকে মমতা উথলে উঠল ৷ মিতার মুখটা একটু একটু নড়ছে। হঠাৎ চোখ খুলে চাইল সে। কিন্ত আহাদ সাহেবকে দেখতে পেল বলে মনে হলো না।
বিছানা থেকে আলতো ভাবে নেমে পড়ল মিতা ৷ কাঠ হয়ে শুয়ে রইলেন আহাদ সাহেব।
বিছানা থেকে আলভাে ভাবে নেমে পড়ল মিতা ৷ কাঠ হয়ে শুয়ে রইলেন আহাদ সাহেব ৷
কোথায় যাচ্ছে মেয়েটা? সতর্কভাবে রুমের বাইরে বেরিয়ে এল মিতা। চুপি চুপি হাটছে নিজের ঘরের দিকে৷
ঘরে ঢুকে জুলেখাকে হাতে নিল সে। কান খাড়া করে রইলেন আহাদ সাহেব ৷ নিজেও সন্তর্পণে উঠে এসেছেন৷ পষ্ট মিতার দুর্বল গলা শোনা পেল, ‘তুমি চলে যাও। তোমার জন্যে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’
চমকে উঠলেন আহাদ সাহেব ৷ কী বলছে মেয়েটা? হঠাৎ দ্বিতীয় আরেকটা কণ্ঠ শুনে ঘাবড়ে গেলেন তিনি।
‘যাব না আমি। কিছুতেই না। সব কিছু দেখতে চাই আমি।’
“তুমি চলে যাও ৷ দোহাই তোমার। ‘
“কিচ্ছুতেই না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে তােমাকেও ছাড়ব না।’ হিংস্রভাবে হিসহিস করে উঠল মিহিকণ্ঠটা।
ধাক্কা দিয়ে দরেজ্যে খুলে মিতাৱ রুমে ঢুকে পড়লেন আহাদ সাহেব ৷
মেঝেতে জুলেখাকে রেখে তার সামনে স্থির বসে আছে মিতা পাতলা ঠোট দুটো রাগে হতাশায় মৃদু কাপছে।
ঘরে আর কেউ নেই।
‘কার সঙ্গে কথা বলছ?’
চমকে উঠল মিতা। বাপের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জুলেখার সঙ্গে।’
মেয়েকে আদর করে বুকে টেনে নিলেন আহাদ সাহেব। হয়তো ভুল শুনেছেন ৷ ‘জুলেখা একটা পুতুল মা। এত রাতে ওর সাথে কথা না বললেও ও ,রাগ করবে না।’
মিতা কোনও করা বলল না। শুধু বাপের বুকে মুথ ঘষতে লাগল ৷
সকালবেলা মিতার চেহারায় এ প্রসন্নতা লক্ষ করলেন আহাদ সাহেব।
“দেখেছ মিতাকে একটু খুশি খুশি লাগছে আজ।’
‘হ্যাঁ। সায় দিলেন মাজেদা বেগম৷ ‘মনমরা ভাবটা কেটে গেছে। ‘
হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এল মিতা। ‘এই পুতুলটা ভাল না, আব্বু। আমার সাথে শুধু ঝগড়া করে ৷’
‘তাই নাকি ? খুব পাজী তো ৷’
“পুড়িয়ে ফেলো ওটাকে।‘ পুতুলটাকে শেষ করে দেবার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না মাজেদা বেগম।
তাই করব।” বলেই হন হন করে রান্নাঘরের দিকে হাটতে লাগল মিতা।
স্বামীর দিকে চেয়ে মুচকি হাসলেন মাজেদা বেগম। কোলে হাত পা নাড়ছে অবােধ রীতা ৷
‘আপদ বিদেয় করাই ভাল।‘
হাবুর মা নাস্তা বানাচ্ছিল রান্নাঘরে ৷ মিতাকে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে গেল।
‘এইহানে কী আপামণি?’
‘জুলেখাকে পুড়িয়ে ফেলব।,’ গম্ভীরভাবে বলল মিতা ৷
‘হেইডাই ভালো। খুব খারাপ জিনিস এইডা।’
গনগনে আগুন বেরুচ্ছে বড় চুলার মুখ থেকে। একটু ইতস্তত করল মিতা। “তারপর জুলেখার মাথাটা ঢুকিয়ে দিল চুলার ভিতরে।
প্রচণ্ড উত্তাপে কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেল মাথাটা। মিতার মনে হলো ব্যথায় আর্তনাদ করছে জুলেখা। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সে গলে যাওয়া পুতুলটার দিকে ৷ খেয়াল করল না কখন একফাকে আগুনের একটা হালকা শিখা আলতাে ভাবে ছুয়ে পেল তার জর্জেটের জামাটাকে।
প্রথমে হাবুর মার চােখে পড়ল জামার ঝুলের কোনার ছোট্ট আগুনটা ৷
‘আগুন। ইয়া আল্লা। আগুন। আপা।’
লাফিয়ে এল বুড়ি মিতার দিকে ৷ কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। চমৎকার ডিজাইন করা জর্জেটের জামাটাকে মুহূর্তেয মধ্যে গ্রাস করল লেলিহান শিখা। ভয়ে আতঙ্কে মরণ চিৎকার জুড়ে দিল হাবুর মা।