ঘটনাটার দৃশ্যপট ১৮০০ সালের শেষের দিকে ।
_________________________________
জমিদার সুলতান মাহমুদ ।
ভারতবর্ষের কোন এক অজপাড়াঁগায়ের জমিদার ছিলেন তিনি ।
সাদা পাঞ্জাবী আর ধূতির সাথে কারুকার্য করা সুতির চাদর পড়াটা খুব পছন্দ করতেন তিনি । লেখালেখি করার অভ্যাস আছে টুকটাক । মাঝেমধ্যেই সময় পেলে নদীর তীরে চলে যেতেন কবিতা লিখতে ।
একদিনের কথা ।
কাগজ আর কলম নিয়ে নদীর তীরে গেলেন সুলতান মাহমুদ ।
বিকাল বেলা ।
আকাশ মেঘলা । একদম নির্জন নদীর তীর । মানুষজন নেই আশেপাশে ; যতদূর চোখ যায় শুধু ক্ষেত আর ক্ষেত । তবে ক্ষেতের মাঝখানে ছোট একটা কুড়েঁঘর আছে । ঘোড়াটাকে একপাশে ঘাস খাওয়াতে দিয়ে একমনে কবিতা লিখতেছিলেন তিনি । হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি শুরু হল । দ্রুত তিনি তার ঘোড়া নিয়ে কুড়েঁঘরের দিকে যেতে লাগলেন । ঘোড়াটাকে বাহিরে রেখে তিনি ঘরে ঢুকলেন । বৃষ্টির প্রকোপ আরও বেড়েছে । শোঁ শোঁ বাতাস বইছে । অন্ধকার নেমে আসছে চারদিকে । সুলতান মাহমুদ ঘরে ঢুকে দেখলেন কেউ নেই । ছোট একটা বিছানা পাতা আছে । ঘরের এককোণে একটা লন্ঠণ জ্বালানো । আর কিছুই নেই ঘরে ।
একটু অবাক হয়ে ভাবলেন,”ঘরে লনন্ঠন জ্বালানো কিন্তু কেউ নেই কেন আর আসার সময়ও তো কাউকে দেখি নি ।”
সাত পাঁচ ভেবে তিনি বিছানায় বসলেন । মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে তখনও ; কমার কোন লক্ষণই নেই ।
“বৃষ্টি একটু কমলেই ঘোড়া নিয়ে রওয়ানা দিবো বাড়িতে”,মনে মনে ভাবলেন সুলতান মাহমুদ ।
হঠাৎ কারও গোঙ্গানীর শব্দ ভেসে আসলো বাতাসে । শব্দটা শুনে রীতিমত অবাক হলেন তিনি । কেউ তো নেই আশেপাশে ; তাহলে শব্দ করলো কে ? চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার । লন্ঠের সামান্য আলো ছাড়া আর কোন আলো নেই । সুলতান মাহমুদ শব্দের উৎস খুঁজে পেলেন না । হঠাৎ দেখলেন লন্ঠণটা যে যে কোণে জ্বলছে সে কোণে ঘরের বেড়াতে একটা কালো ছায়া । ছায়াটা কোন এক মেয়ের । তার এলোমেলো চুলগুলো বুঝা যাচ্ছে । আৎকে উঠলেন সুলতান মাহমুদ । ছায়াটা কালো হলেও চোখ গুলো স্পষ্ট লাল দেখা যাচ্ছে । ছায়াটা উনার দিকে হাত বাড়ালো । ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন তিনি । একটুপর চোখ খুলে দেখলেন কালো ছায়াটা উধাও । কোথাও কিছু নেই ।
“নাহ্ , তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যেতে হবে ; জায়গাটা ভালো না”,মনে মনে ভাবলেন তিনি ।
বের হওয়ার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলেন দরজা বন্ধ । শত চেষ্টা করেও দরজা খুলতে পারলেন না । চিৎকার দিতে থাকলেন তিনি ।
হঠাৎ পিছন থেকে মেয়েকন্ঠে কে যেন বলল,
– “এত তাড়াতাড়ি কোথায় যাচ্ছেন জমিদার সাহেব ? আপনার সাথে কথা আছে আমার । জমিদার হয়েও উপযুক্ত বিচার করতে পারেন না আপনি ।”
সুলতান মাহমুদ পিছনে তাকিঁয়ে দেখলেন একদম কালো কুচকুচে একটা মেয়ে বিছানায় বসে আছে ।
– “কে..কে..কে তুমি ? এএএএ…ততত..ক্ষণণ তো তোমাকে দেখি নি !!”ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি ।
– “আমার ঘরে এসে আমাকেই জিজ্ঞাসা করছেন আমি কে ?” অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মেয়েটা ।
– “কি..কি..কি..ন্তু এতক্ষণ তো তুমি এখানে ছিলে না ? ভয়ে কাপঁছেন জমিদার ।
হঠাৎ নিমিষেই অদৃশ্য হয়ে গেল মেয়েটা । হাসি শোনা গেল ; অট্টহাসি । সুলতান মাহমুদ ঘরের বেড়ার দিকে তাকিঁয়ে দেখলেন কালো সেই ছায়াটা ঘরের বেড়াতে আবারও দেখা যাচ্ছে । হাসিটা ওখান থেকেই আসছে । আর দাড়িঁয়ে থাকতে পারলেন না জমিদার সাহেব । জ্ঞান হারালেন তিনি ।
সূর্যের আলোটা চোখে পড়তেই চোখ খুললেন সুলতান মাহমুদ ।
উঠে বসলেন । তাকিঁয়ে দেখলেন নদীর পাড়ে তিনি । ঘোড়াটা একটু দূরে ঘাস খাচ্ছে । কাগজ-কলমও তার পাশে পড়ে আছে । সকাল হয়েছে সবেমাত্র । তাহলে কি সেটা দুঃস্বপ্ন ছিল ? একজন জেলে নদীর তীরে জমিদারকে দেখে ছুটে আসলো ।
– “বড়বাবু, আপনি এখানে কি করছেন ? জিজ্ঞাসা করলো ।
– “কিছু না । এমনি বসে আছি । আচ্ছা ঐ কুড়েঁঘরটা কার ? তুমি জানো ?”
সুলতান মাহমুদ জিজ্ঞাসা করলো ।
– “জানি তো বড়বাবু । ওটা উত্তরপাড়ার রমিজের ঘর ।
– “কোথায় ওরা ? এখানে থাকে না ?”
– ” না বড়বাবু । থাকে না । কিছুদিন আগে রমিজ ওর বউকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরে ফেলেছে ; ওর বউ কালো ছিল বলে । ও আপনার কয়েদখানায় বন্দি আছে । তারপর থেকে এখানে আর থাকে না ।
-” ওহ্ , ঐ রমিজ । কিন্তু ওর বিরুদ্ধে উপযুক্ত সাক্ষী না পেয়ে আমি তো ভেবেছিলাম ওকে ছেড়ে দিবো ।”
আর কিছু না বলে সুলতান মাহমুদ ঘোড়া ছুটিয়ে জমিদার বাড়িতে চলে আসলেন ।
সেদিন বিকালেই রমিজের ফাঁসি কার্যকরের আদেশ দেন তিনি ।
সমাপ্ত.