ডক্টর সিম্পসনের ডায়রি
কেস স্টাডি A001809
আগেই বলে রাখি, এবারের ঘটনা কোন মানসিক রোগীর ফিরিস্তি নয়।
আর সবার মতো ডক্টর সিম্পসন নিজেও গল্প শুনতে এবং পড়তে ভালোবাসেন। তিনি তাঁর এক বন্ধু ফিলিপ মুরের সাথে প্রায়ই ই-মেইল চালাচালি করেন। কথায় কথায় তাঁকে একবার বলে দিয়েছিলেন যে “অস্বাভাবিক” কোন ঘটনা যদি তিনি শোনেন, তাহলে যেন তাঁকে জানান। তিনি সেগুলো নিয়ে ভাবনাচিন্তা করবেন। আজগুবি হোক, অবিশ্বাস্য হোক, অবাস্তব হোক, গাঁজাখুরি হোক, মিথ্যে হোক, রং চড়ানো হোক, লোকের মুখে শোনা হোক – কোন অসুবিধা নেই। ডক্টর সিম্পসন একটা গল্প পেলেই খুশি। তিনি আজগুবি জিনিসপত্র নিয়ে মাথা ঘামাতে ভালোবাসেন। কে জানে, হয়তো তাঁর পেশার কারণেই ব্যাপারটা হয়েছে। এতে তাঁর কোন লাভ হয় না, কিন্তু যতটুকু অবসর পান, সময়টা চমৎকারভাবে কেটে যায়। তিনি তাঁর সব বন্ধুকেই বলে রাখেন যে বিচিত্র কোন ঘটনা পেলে যেন তাঁকে জানাতে দেরী না করেন। ফলশ্রুতিতে তাঁর ভাণ্ডারে জমেছে অনেকগুলো গল্প, যেগুলোর কিছু সত্যি, কিছু মিথ্যা। তিনি সযত্নে সেগুলো রেখে দিয়েছেন, নিজের দিক থেকে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
ডক্টর সিম্পসন নিজেই ভুলে গিয়েছিলেন ব্যাপারটা, কিন্তু বন্ধুবর ফিলিপ মুরের একটা ই-মেইল পেয়ে মনে পড়লো। এতদিনে তিনি খবর পাঠিয়েছেন। গল্পটা ফিলিপ মুরের একজন পূর্বপুরুষের লেখা।
মুর লিখেছেন, তাঁদের বাড়ির একটা ঘরে অনেকদিনের পুরনো সংবাদপত্র, চিঠি আর কাগজপত্র ডাঁই হয়ে পড়ে ছিল, দুদিন আগে সেগুলো সাফসুতরো করতে গিয়ে তিনি একতাড়া কাগজ আবিষ্কার করেন। হাতে অর্থাৎ কলমের কালিতে সেটাতে কিছু লেখা ছিল। তিনি সাথে সাথে পড়তে বসে যান। আশ্চর্য হয়ে দেখেন যে সেটা একটা পাণ্ডুলিপি বিশেষ, গল্পের মতো করে একজন মানুষ একটি জায়গা আর কিছু ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। মানুষটি আর কেউ নন, ফিলিপ মুরের প্র প্র প্র-পিতামহ এডওয়ার্ড মুর। এতগুলো “প্র” এর কারণ যে সময়ে এই ঘটনা লেখা হয়েছে সেটা সপ্তদশ শতাব্দীর।
ফিলিপ মুর বুঝতে পারেন যে এই পাণ্ডুলিপি একটা মাস্টারপিস, শুধু ঘটনার জন্যই নয়, বয়সের জন্য। তিনশো বছর ধরে একটা জিনিস চাপা পড়ে ছিল, আর সেটা খুঁজে পেল মুর পরিবারেরই একজন উত্তরাধিকারী, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়েছে তাঁর। বন্ধুর ই-মেইলের কথা মনে পড়ে তাঁর, তিনি একটা কপি করে পাঠিয়ে দেন সিম্পসনের কাছে। এটাও বলে দেন যে তিনি এই পাণ্ডুলিপি থেকে একটা বই প্রকাশ করবার চিন্তাভাবনা করছেন। সিম্পসন তাঁর বন্ধুমানুষ, কাজেই ছাপার অক্ষরে বেরুবার আগেই তাঁকে পড়তে দেয়া যায়। বই প্রকাশের আগ পর্যন্ত ব্যাপারটা গোপন রাখার অনুরোধও জানালেন। শত হলেও পারিবারিক জিনিস।
শেষে ফিলিপ মুর লিখেছেন, আমার কাছে কিছু কিছু জায়গা খুবই অবিশ্বাস্য লেগেছে। তোমার কেমন লাগলো জানিয়ো।
ডক্টর সিম্পসনের কাছে একটা বাদামী খামে ভরা পাণ্ডুলিপির কপি এসে পৌঁছয় কয়েকদিনের মধ্যেই। গোপন রাখা তাঁর কাছে কোন সমস্যা নয়, তাঁর দরকার একটা লাগসই গল্প।
সেই বিকেল আর রাত কেটে গেল তাঁর পড়তে পড়তে। কৌচে হেলান দিয়ে তিনি যে কত ঘণ্টা কাটিয়ে দিলেন হিসাব নেই। তাঁর এই অভ্যেস আছে, একটা কিছু পেলে সেটা নিয়ে পড়ে থাকেন, শেষ না করে ছাড়েন না।
অনেক বড় পাণ্ডুলিপি ছিল ওটা, যেহেতু এটা একটা কপি, কাজেই ছেলেমানুষের পড়া মুখস্ত করার মতো লাল কালি দিয়ে তিনি পছন্দের জায়গাগুলো দাগিয়ে রেখেছেন, সময় পেলে আবারো খুঁটিয়ে পড়বেন। পড়তে পড়তে বোঝা গেছে এডওয়ার্ড মুরের লেখার হাত ভাল ছিল, কারণ বর্ণনা খুব প্রাঞ্জল। সেই সাথে খুব গুছিয়ে ঘটনাগুলোকে আলাদা করেছেন, সাবধানী মানুষের চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সবগুলো চ্যাপ্টারের আলাদা আলাদা নাম দিয়েছেন। সত্যি বলতে, নামগুলো দেখেই ইচ্ছে হয় নামের নিচ থেকে শুরু হওয়া ঘটনাগুলো পড়তে।
বেশ কয়েকটা চ্যাপ্টার দাগিয়েছেন ডক্টর সিম্পসন, তার মধ্যে একটি চ্যাপ্টারের নাম “জীবনীশক্তি সঞ্চারণ।”
ডক্টর সিম্পসন এই গল্পে এডওয়ার্ড মুরের সাথে ফিরে গিয়েছিলেন সপ্তদশ শতাব্দীতে; গায়ানা, ফ্রেঞ্চ গায়ানা, সুরিনাম এবং ব্রাজিল জুড়ে অবস্থিত গহীন জঙ্গলে। সাথে ছিল একটা মাত্র দোনলা বন্দুক, নামেমাত্র গোলাবারুদ। হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে তিনি ঘটনাগুলোর স্মৃতি বয়ে নিয়ে এসেছিলেন এখানে, সভ্য জগতে; লিখে রেখেছিলেন সযত্নে। তিনশো বছর চাপা পড়ে থাকার পর আবার বেরিয়ে এলো। ফিলিপ মুরের কপাল ভাল বলতে হবে।
ঘটনা উত্তমপুরুষে লেখা, এখানেও সেভাবেই লেখা হবে।
… … আমি এখানে এসেছি কয়েকদিন হয়। গায়ানার এক সীমান্তে। গভীর জঙ্গল, তা নিশ্চয়ই কাউকে বলে দিতে হবে না।
কোন গাছের মাথায় উঠে কেউ যদি উঁকি দেয়, তাহলে শুধু সবুজ একটা আস্তরণ দেখতে পাবে সে, দিগন্ত অবধি। একদিকে নয়, চারিদিকেই। এ থেকেই সহজে বোঝা যায় এই জঙ্গলের বিস্তৃতি।
আগের গল্পগুলোতে (গল্প নয়, সত্যি অভিজ্ঞতা) আমি বলেছি যে অভিযানগুলোতে আমার সাথে ছিল প্রাণের বন্ধু আইভান। একসাথে নৌকা বেয়েছি, মশার কামড় খেয়েছি, বুনো মোষের তাড়া খেয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছি। কিছুতেই আইভান আমার সঙ্গ ছাড়ে নি।
কিন্তু এবারের কথা ভিন্ন। কারণ আমরা যে সব জায়গাতে আগে ঘুরেছি, সেগুলো ম্যাপে ছিল। জানা ছিল কোথায় গেলে কী পাবো। সবগুলো রাস্তায় একবার না একবার সভ্য মানুষের পায়ের ছাপ পড়েছিলো। কিন্তু যখন আমি গায়ানা যাবার মতলব করতে লাগলাম, তখন প্রথমবারের মতো আইভান পিছিয়ে গেল।
বলল, তুমি যেতে পারো, আমি পিতৃদত্ত প্রাণটাকে অনেকবার বিপন্ন করেছি, আর নয়।
আমি ওকে লোভ দেখালাম, ভেবে দেখো আইভান, এই এলাকায় প্রথম পদক্ষেপ ফেলা সাদা চামড়ার, সভ্য মানুষ হবো আমরা। ইতিহাসে নাম উঠে যাবার বিরাট সম্ভাবনা আছে।
আইভান তাতেও রাজি হল না। সাফ বলে দিল, দরকার নেই আমার বিখ্যাত হয়ে।
শেষে ওর সাথে আমার একটা বেশ বড় ঝগড়া হয়ে গেল। কথা বলাবলি বন্ধ এমন অবস্থা।
বন্ধুর সাথে বনিবনা না হওয়াটা কোন কাজের কথা নয়। শেষে আইভানই প্রথম নরম হল। নরম হল মানে কিন্তু আমার সাথে যেতে রাজি হল, তা নয়। সে বলল, ভাই, তুমি অনেক সাহসী, সেটা আমি স্বীকার করি। কিন্তু এইবারটি আমাকে মাপ কর। পিতার কয়লার ব্যবসাটার হাল এবার না ধরলেই নয়।
আমিও আর কিছু বলি নি ওকে। সবাই তো আর আমার মতো ঘরছাড়া ভবঘুরে নয়, সবার একটা না একটা পিছুটান থাকে। কারো সংসার, কারো সন্তান, কারো পিতার কয়লার ব্যবসা। বুঝলাম যে এখন থেকে আমাকে নিজের পথ নিজেই দেখতে হবে। ঘুরে বেড়াতে হলে একাই যেতে হবে।
আমার হয়তো রাগ করবার কথা ছিল, কিন্তু কেন যেন আমি খুশি হয়ে উঠলাম। একা অ্যাডভেঞ্চার এর আগে কখনো হয় নি, এবার হবে। মন্দ কী? শুধু তাই নয়, আগের বারের চেয়েও নিজেকে সাহসী মনে হতে লাগলো।
আমি এক কথার মানুষ। যেটা বলি, করে ছাড়ি। কাজেই প্রতিকূল রাস্তা পাড়ি দিয়ে এখানে এসে পড়েছি আজ কুড়ি দিন।
এই কয়দিন হাতে কাগজকলম নিতে পারি নি, কারণ প্রথম সাত দিন তো কেটে গিয়েছিলো বন্দী দশায়! হ্যাঁ, মিথ্যে বলছি না, আইভানের অনেকগুলো ভয়ের কারণ ছিল রেড ইন্ডিয়ানরা। আমি ওদের হাতে ধরা পড়েছিলাম তিন হপ্তা আগে। খুলে বলি।
প্রথম প্রথম রাস্তা ভালোই ছিল। ঘন জঙ্গলে ঢোকার পর পথচলা দুষ্কর হয়ে পড়েছিলো। হাতের ধারালো আর লম্বা ফলাওয়ালা ছুরিটা দিয়ে ঝোপঝাড় কেটে পথ করে নিতে নিতে চলছিলাম, তখন আমার পাশের একটা রাবার গাছে সাঁ করে একটা তীর এসে বিঁধে গেল।
বুঝতে পারলাম “ওদের” এলাকায় এসে পড়েছি। বন্ধুক বাগিয়ে ধরা নেহায়েত বোকামি হবে, বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে। রেড ইন্ডিয়ানদের চলাফেরা বাঘের মতোই নিঃশব্দ। তার চেয়ে ওরা যেটা চায় সেটাই করতে দিই, অন্তত কিছু একটা উপায় বার করা যাবে আর পালাবার রাস্তা খোঁজার সময় পাওয়া যাবে। কাজেই আমি মাথার ওপর দু হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গেলাম, যেমনটা পুলিশের হাতে ধরা পড়লে চোর কিংবা ডাকাতেরা করে থাকে।
আমাকে কয়েক মুহূর্তেই চারদিক থেকে ঘিরে ধরল গাছের পাতা দিয়ে লজ্জা ঢাকা আর সারা শরীরে বিচিত্র উল্কি আঁকা জংলীর দল, বিচিত্র আওয়াজে একজন আরেকজনকে কী যেন বলতে লাগলো। বেশিরভাগ জংলীর হাতেই তীরধনুক, আর কয়েকজনের হাতে একটা নল, তাতে ফুঁ দিয়ে বিষাক্ত কাঠি ছুঁড়ে ওরা শিকার করে। মারণাস্ত্র বললে ভুল হবে না।
আমি কোন গাইগুঁই করছি না কিংবা পালানোর চেষ্টা করছি না বলে ওরা বোধহয় একটু চিন্তায় পড়লো, তারপর পরামর্শ করে আমাকে ধরে নিয়ে এলো ওদের আস্তানায়।
জঙ্গলের মধ্যে ফাঁকা একটা জায়গা, বোঝা যায় গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, তাতে কুঁড়েঘরের মতো অনেকগুলো ঘর লাগালাগি করে দাঁড় করানো। নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ, সবই আছে। কয়েক জায়গায় খোঁয়াড়ে শুয়োর চরছে, আর দুয়েকটা ছাগল বাঁধা আছে।
একটা আসবাবশুন্য ঘরে আমাকে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়া হল। বলাই বাহুল্য, আমার বন্দুক আর যৎসামান্য মালপত্র ওদের হাতে চলে গেছে আগেই।
জংলীদের কেউ আমাকে মারেনি, ভয় দেখায় নি, মৃদু আঁচে এবং অল্প তেলে ভাজি করে আমাকে খেয়ে ফেলবে এমনটাও মনে হয় নি। তবুও, প্রাণের মায়া একটু একটু যে হচ্ছিল না তা নয়।
যেকোনো দুর্ধর্ষ অভিযাত্রীর উদ্দেশ্যে বলে রাখছি, অভিযানের শুরুতে, কোন বিপদ না ঘটা পর্যন্ত আগ্রহ এবং উৎসাহের সীমা থাকে না। কিন্তু যখন সত্যিকারের বিপদ উঁকি দেয়, তখনই সর্বাগ্রে মনে হয় কেন এই পথে পা বাড়ালাম।
আক্ষেপ আমারও হচ্ছিল। ওরা হয়তো আমাকে মেরে ফেলবে। অপরিচিত এবং বন্দুকধারী একজন শ্বেতাঙ্গকে বাঁচিয়ে রাখার কোন কারণই নেই। তবুও আমি আশায় বুক বেঁধে সময় পার করতে লাগলাম। ছেড়ে দিলে তো বেঁচেই গেলাম, গল্প করতে পারবো, রেড ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছি। আর মেরে ফেললেও ততটা কান্নাকাটি করার কেউ নেই। আমি আর যাই হই, ভীতু নই। প্রাণের মায়া সাহসী লোকেরও থাকে, সেজন্য দোষ দেয়া যায় না।
সে রাতেই আমার সাথে দেখা করতে এলো বিটকেল দশাসই চেহারার এক জংলী। চেহারা দেখেই বলে দেয়া যায় যে ব্যাটা গোত্রের প্রধান গোছের কিছু একটা হয়ে থাকবে। মাথায় এক হাত উঁচু একটা পালক গোঁজা, জটা করে বাঁধা চুল। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইলো অনুচরের দল, আদেশ পেলেই বুঝি আমাকে কেঁচে ফেলতে বিলম্ব করবে না।
দলপতিটি বিকট গলায় আমাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করলো।
আমি নিজের চেহারায় যতটা সম্ভব নিরীহ ভাব ফুটিয়ে তুলে হাত পা নেড়ে ইশারায় বোঝাতে চাইলাম যে আমি মোটেও ক্ষতিকর কোন জীব নই, আমাকে ছেড়ে দিলেই সুড়সুড় করে চলে যাবো। ইশারা-ইঙ্গিত ব্যবহারের কারণ ওদের ভাষার এক বর্ণও আমি বুঝতে পারছিলাম না।
আমার হাত-পা সঞ্চালন দেখে কিছুক্ষণ সর্দারটি চোখ পাকিয়ে চেয়ে রইলো। আমি ঢোক গিললাম, ভাবলাম ধরে পিটুনি লাগাবে কীনা। কিন্তু কিছুই না বলে সে চলে গেল, তার সাঙ্গোপাঙ্গোদেরকে নিয়ে। মজার ব্যাপার হল, তার কিছুক্ষণ পরেই একটা ঝুড়িতে করে হাজির হল খাবার। ঝলসানো মাংস আর দুটো ফল। মন্দ নয়। খিদের মুখে গোগ্রাসে গিললাম। ওরা বোধহয় ধরে নিয়েছিল যে আমি খাবার চাইছি।
আরও ছ’দিন আমাকে আটকে রাখল ওরা, হয়তো আমার ভাবগতিক বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর একদিন দরজা খুলে দিয়ে চলে যাবার ইশারা করলো। আমার মালপত্র এক জায়গায় রাখা ছিল, সেগুলোও নিতে বলল।
আমার তখন ঝেড়ে দৌড় দেয়ার কথা, প্রথমেই ওদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবার কথা, কিন্তু হঠাৎ মনে হল, এদের সাথে কয়েকদিন থেকে আরও কিছু জানার চেষ্টা করি না কেন? ভাগ্যিস ভেবেছিলাম, নয়তো এই গল্পটা এভাবে লেখাই হতো না, আর আমিও বঞ্চিত হতাম এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা থেকে।
আমি এখানে কয়েকদিন থাকার ইচ্ছে জানাতে ওরাও রাজি হয়ে গেল। থাকতে হলে সবচেয়ে সুবিধে হয় যদি ওদের ভাষা জেনে ফেলি। আমি ভেবেছিলাম যে ওদের ভাষা বুঝি খুবই জটিল, কিন্তু একটা তরুণ বয়েসী জংলী যখন আমাকে শেখাতে শুরু করলো, তখন বুঝতে পারলাম যে ওদের ভাষায় শব্দসংখ্যা খুব কম আর সহজেই শিখে ফেলা যায়। তাই আমি তিনদিনেই একেবারে পাকা জংলী হয়ে উঠলাম, অন্তত ভাষার দিক দিয়ে।
মজাই লাগছিলো ওদের সাথে দিন কাটাতে। আমাকে বেশ খাতির করে ওরা, কে জানে কেন। আমার ভয় প্রথমেই কেটে গেছে, কারণ রেড ইন্ডিয়ানদের এই গোত্রটি মানুষখেকো নয়। এদের জাতভাইদের মানুষের মাংসে অরুচি নেই বটে, কিন্তু এরা বুনো জানোয়ার পেলেই খুশি। তাছাড়া ভেড়া আর ছাগল থেকে আসে দুধ। শুধু চাষবাস করে না তারা, শিকার এদের ঐতিহ্য এবং একমাত্র পেশা। তাই তো তীরধনুক না হলে এদের চলে না।
তবে বড্ড মশা। এইয়া বড় বড়, পুরুষ্টু সাইজের। একটা-দুটো নয়, ঝাঁকে ঝাঁকে, লাখে লাখে মশা। এক-একটা মশা বোধকরি এক পোয়া করে রক্ত খেতে পারে। এর মধ্যেই জংলীরা কীভাবে খালি গায়ে যৎসামান্য পাতা কোমরে জড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় জানি না। নিশ্চয়ই এদের চামড়া আমাদের চেয়ে কয়েক গুণ মোটা। আমি ব্যক্তিগতভাবে মশার যন্ত্রণায় খানিকটা ব্যতিব্যস্ত আছি। আর পোকামাকড়ের উৎপাত তো আছেই।
এরা আক্ষরিক অর্থেই জংলী। সভ্যতা কোনদিন চোখেও দেখে নি, তার ধারও ধারে না। একশো একটা কুসংস্কার আছে ওদের। রোগব্যাধি হয়ে, বুনো জানোয়ারের কবলে পড়ে মারা যাচ্ছে দলে দলে, কিন্তু ভাগ্যের ফের বলে মেনে নিয়েছে এটাকে। পূর্বপুরুষের সংস্কার ছেড়ে বেরুবার, বাইরের পৃথিবী দেখার কোন আগ্রহ এদের নেই, কোনদিন হবে বলে মনেও হয় না। সভ্য মানুষদের ওরা ঘৃণা করে না, ভয় পায়। কারণ এই দোনলা বন্দুকটা। এটা দিয়ে নাকি তারা জংলী মেরে বেড়ায়। আমি যখন বুঝিয়ে দিলাম যে এটা ওদের তীরধনুকের মতোই একটা সাধারণ অস্ত্র, শুধু কাজ করার কায়দাটা আলাদা, তখন ওরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেন। আমার কাগজকলম নামক “অদ্ভুত” জিনিসগুলো দিয়ে আঁকিবুঁকি করা (লেখার কথা বলছি) দেখেও ওরা যথেষ্ট অবাক হয়েছে।
যাকে নিয়ে এই গল্প, তার সাথে আমার পরিচয় হয় বন্দীদশা থেকে মুক্তির পরপরই। সে গোত্রের ওঝা, নাম মিডা। গোত্রপতি রার এর চেয়ে ওঝারই প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখলাম বেশি। কারণটা জানতে সময় লাগলো না। যেকোনো বিপদ আপদে ওঝাকেই ডাকতে হয় এদের। সাপে কাটা, ঝাড়ফুঁক থেকে যাবতীয় সিদ্ধান্তে। এই বুড়োও দোর্দণ্ড প্রতাপে ছড়ি ঘোরায় এই সরল জংলীদের ওপরে।
আমি এখন ওদের দলেরই একজন বলা চলে। ওরা আমাকে আর বাইরের কেউ বলে গণ্য করছে না। আমিও একে-ওকে জিজ্ঞেস করে যা জানার জেনে নিচ্ছি। ওঝাকে নিয়েও আমার জিজ্ঞাসার অন্ত নেই, জংলীরা আমার কৌতূহল মিটিয়ে গেল সানন্দে।
এই ওঝা, যার নাম মিডা, সে নাকি বিপুল অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। সে মৃত মানুষকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে। একজন মৃত মানুষের গায়ে হাত দিয়ে সে নাকি কয়েক মিনিট বসে থাকলেই আবার বেঁচে ওঠে মানুষটি। শুধু তাই নয়, যেকোনো রোগ একটা ফুঁ দিয়েই সারিয়ে দিতে পারে সে। সে মন্ত্র জানে সর্বরোগের আরোগ্যের, এবং সে পিশাচসিদ্ধ। তার সাথে লাগতে যাওয়া অথবা তাকে অখুশি করা মানেই নির্ঘাত মৃত্যু।
রেড ইন্ডিয়ানদের সব গোত্রেই নিজস্ব একজন করে ওঝা থাকে, দলের সবাই তাকে মান্য করে চলে। তার যেকোনো আদেশ সবাই মানতে বাধ্য, তার হুকুমের বাইরে যাওয়ার আদেশ নেই। দেবতার পুজো করার সময়, অনাবৃষ্টিতে করণীয়, শিকার কোন কোন সময় বন্ধ রাখতে হবে, বিশেষ বিশেষ তারা আকাশে উদিত হওয়ার কারণ কী, এসব গুরুতর বিষয়ে একমাত্র ওঝাই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। তার সাথে কেউ বেয়াদবি করলে গোত্রপতি মৃত্যুদণ্ড দিতে পারেন। তাছাড়া যেকোনো শিকার করা প্রাণীর সবচেয়ে ভাল অংশটি ওঝাকে দেয়া বাধ্যতামূলক।
আমি মৃত মানুষকে জীবিত করার ব্যাপারটা দেখার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠলাম। কিন্তু কেউ একজন না মরলে কী করে কৌতূহল মেটাবো? আমি তো আর বলতে পারি না, একজন মরে দেখাও তো! কাজেই অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই। মনে মনে ভাবছি, ওঝা হতে পারলে রাজার হালে জীবনটা পার করে দেয়া যেত।
মৃতকে জীবিত করার গপ্পোটা গাঁজাখুরি, সে ব্যাপারে আমি একেবারে নিশ্চিত। হয়তো যে লোকটা উঠে বসে, সে হয়তো আদৌ মারাই যায় নি। কিংবা ওঝার কোন কারসাজি আছে, যেটা অশিক্ষিত জংলীরা জানে না। তাছাড়া অন্ধ বিশ্বাস অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারে, কে না জানে? একজন মনীষী বলেছেন, ওষুধ হল এমন একটা জিনিস, যা মানুষকে খানিকক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে, এই ফাঁকে প্রকৃতি রোগ সারিয়ে দেয়। ওঝাও হয়তো জংলীদেরকে ঘোরের মধ্যে রাখে। তা না হয় হল, কিন্তু মৃতকে তো কোন ওষুধ জীবিত করে দেয় না। সেটাই তাই দেখতে চাইছি।
তবে এই এলাকায় ওঝার সম্মান নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। গোত্রের প্রতিটি মানুষ তাকে যমের মতো ভয় করে, সামনে পড়লে মাথা নুইয়ে সম্মান দেখায়, চোখ তুলে তার দিকে তাকায় না। এক কথায়, এই ওঝার ক্ষমতার প্রতি তাদের অগাধ বিশ্বাস। একটা উদাহরণ দিই। ধরা যাক, ওঝা গোত্রের কারো ওপর রুষ্ট হয়ে বলল, তুই অন্যায় করেছিস, দেবতার অভিশাপ আজ রাতেই তোর ওপর পড়বে, তুই মারা যাবি। সাথে সাথে এই কথাটি লোকটির ওপর এমন প্রভাব ফেলবে, লোকটা এত ভয় পাবে যে সত্যি সত্যি লোকটা মরে যাবে। এমন একটা ওঝাকে মান্য না করে উপায় আছে?
আমি জংলীদের দলটার সাথে বিষমাখা কাঠি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, মজা করে শিকার করছি, এমনকি একবার পাতার পোশাক পরতেও ছাড়ি নি (গা কুটকুট করে বলে একদিনেই বাদ দিয়েছি!) । দিনে শিকার করি, রাতে আমার অভিজ্ঞতাগুলো লিখে রাখি। খুব আনন্দে আর বৈচিত্র্যে ঠাসা দিন কাটাচ্ছিলাম, মোটেই একঘেয়েমী নেই। এখানে স্থায়ী আস্তানা গাড়ার চিন্তাও যে এক-আধবার মাথায় উঁকি দেয় নি তা নয়।
কিন্তু উনিশ দিনের মাথাতেই যে আমি চাক্ষুষ “জীবনীশক্তি সঞ্চারণ” দেখতে পাবো, ভাবতেও পারি নি।
আমরা সবাই পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছি। বেশ রাত অবধি আমার পাশে শুয়ে থাকা ছেলেটার কাছ থেকে ওদের ভাষায় গল্প শুনেছি। কিংবদন্তী, পূর্বপুরুষের বীরত্বের কাহিনী।
ছেলেটা ভোঁস ভোঁস করে নাক ডাকাচ্ছে। আমার ঘুম হচ্ছে ছাড়া- ছাড়া। একটু পর পর ঘুম ভেঙে যাচ্ছে নানা রাতচরা প্রাণীর ডাক শুনে। মাঝে মাঝে ভয় হচ্ছে, দরজায় এসে কোন বুনো শুয়োর কিংবা হায়েনা নখ ঘষছে কীনা।
এতক্ষণ জানোয়ারের ডাক ছাড়া অন্য কোন শব্দ ছিল না, কিন্তু সহসা একটা চিৎকার শুনতে পেলাম। মরণ-চিৎকার।
ঘরে ঘরে মশাল জ্বলে উঠলো। সবাই শোরগোল তুলে বেরিয়ে এলো। একটা কুঁড়েঘর থেকে আসছে চিৎকার। দলে দলে সবাই ছুটে গেল কুঁড়েঘরের দিকে।
কয়েক মিনিটেই ব্যাপারটা খোলাসা হল। মিচুকে সাপে কামড়েছে। বাহু থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে।
মিচু মধ্যবয়সী এক জংলী; বউ আর এক বাচ্চাকে নিয়ে থাকতো ঘরটাতে। সবাই গিয়ে যখন হাজির হল, তখন ঘরের কোণায় হিসহিস শব্দ শুনে দেখা গেল, হাতের কড়ে আঙুলের মতো সরু একটা সাপ পালিয়ে যাচ্ছে। ঘটনার হোতা ওটাই।
আমি জংলীদের মতো না হলেও সাপখোপ মোটামুটি চিনি। এই সবুজ রঙয়ের ছোট জাতের সাপটা দেখে যতটা না ভয়ংকর বলে মনে হয়, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক ভয়ংকর, মারাত্মক বিষাক্ত। দংশনের কিছুক্ষণের মধ্যে সঠিক চিকিৎসা না হলে নির্ঘাত মৃত্যু। এই বিজন জঙ্গলে সে সুযোগ কোথায়? আমি ধরেই নিলাম যে মিচু নামের জংলীটির শেষ ঘণ্টা বেজে গেছে। আমার কাছে সাপে কাটার কোন ওষুধও নেই। ক্ষতের একটু ওপরে কষে কাপড় বেঁধে দেয়া হয়েছে, কিন্তু বোধহয় দেরী হয়ে গেছে।
বিষের ক্রিয়ায় সারা শরীর নীল হয়ে যাচ্ছে মিচুর, দেহটা যন্ত্রণায় মোচড়াচ্ছে। সে হেঁড়ে গলায় চেঁচাচ্ছে, কারণ বিষক্রিয়ার মতো তার ভয়টাও তীব্র।
প্রতি বছরই ওদের কেউ না কেউ সাপের কামড়ে মারা যায়, গাছগাছড়া জাতীয় ছাড়া কোন ওষুধ ওদের কাছে নেই। আমিও যে কিছু একটা করে সাহায্য করবো সে ক্ষমতা নেই, তাই বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি। গোত্রপতি আর তার কয়েক চামচা মিলে চেষ্টা করে যাচ্ছে মিচুকে বাঁচানোর, দেবতার কাছে কাকুতিমিনতি জানাচ্ছে। বিশেষ কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না, কারণ মুখ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছে মিচুর। এক পাশে ভীত মুখে দাঁড়িয়ে আছে মিচুর বউ।
দেখতে দেখতে মিচুর চিৎকার থেমে গেল। দেবতার প্রতি সকল আহবানকে ব্যর্থ করে দিয়ে মিচুর দেহটা নিথর হয়ে গেল, থেমে গেল কাঁপুনি। মিচুর বউ গাগা চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, মাটিতে আছাড়ি পিছাড়ি করতে লাগলো, বাকি সবাই চুপ। আমি খানিকটা অবাক হয়ে ওদের ব্যাপারস্যাপার দেখছি, এরপর কী হয়। সন্দেহ দূর করতে অবশ্য ওর কব্জি টিপে নাড়ি দেখলাম, বুকে মাথা লাগিয়ে দেখলাম। না, প্রাণের কোন স্পন্দন নেই। নিশ্চিতভাবেই মারা গেছে মিচু।
ওঝা মিডাকে খবর দিতে লোক গেছিল আগেই। বাঁকা লাঠিতে ভর করে তিনি হাজির হলেন। সবাই সসম্ভ্রমে মাথা নত করলো। আমি বাইরের লোক হলেও আমার জন্যও একই নিয়ম, তাই আমিও একটু মাথা নোয়ালাম।
জমা হওয়া জংলীরা সরে দাঁড়িয়ে পথ করে দিয়েছে মিডাকে, শ্রদ্ধেয় ওঝা মশাইকে, মশালের আলো তার উল্কি মাখা মুখে পড়াতে বিচিত্র আর ভয়ংকর লাগছে। গোত্রপতি রারের চেয়েও জমকালো তার পোশাক, গলায় ঝুলছে বদখৎ চেহারার অনেকগুলো মালা, মাথায় গোঁজা অনেকগুলো পালক।
ওঝাকে দেখেই সবার প্রাণে যেন পানি ফিরে এসেছে, আমি ওদের চোখে যে গভীর বিশ্বাস দেখলাম সেটা বলার মতো নয়। যেন মিচু মারা গেছে এটা কোন ব্যাপারই না, এখুনি ওঝার স্পর্শে সে উঠে বসবে এবং পানি খেতে চাইবে।
ঘরটাতে অস্বস্তিকর নীরবতা। সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অনেক মানুষের নিঃশ্বাস ছোট্ট ঘরটার ভেতরকার বাতাস গুমোট আর গরম করে তুলেছে।
ওঝা মিডা নিথর মিচুর কপালে হাত রাখলেন। কীসের একটা হাড় নিয়ে এসেছিলেন সাথে করে, সেটা ওর সারা শরীরে বুলোতে লাগলেন আর কিম্ভূত সব মন্ত্র পড়তে লাগলেন। মন্ত্র প্রথমে ধীরে ধীরে পড়ছিলেন, তারপর দ্রুত হতে লাগলো। ক্রমে আর মন্ত্রের শব্দগুলো আলাদা করে শোনা গেল না, যেন একটানা একটা গুঞ্জন হয়ে যাচ্ছে।
মিডা এখন মন্ত্র পড়া থামিয়ে দিয়েছেন, শুধু মিচুর কপালে হাত রেখে বসে আছেন, আর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মিচুর খোলা আর ভয়ার্ত দুই চোখের দিকে। আমি খেয়াল করলাম, ওঝার চোখের পলক পড়ছে না। অনেকক্ষণ কেটে গেল, চোখের পলক এখনো পড়ছে না। আমি ব্যাপারটাতে একটু বিস্ময় বোধ করছি বৈকি। সাধারণ মানুষ পাঁচ মিনিট চোখের পাতা না ফেলে থাকতে পারে না। ওঝা তবে কি সত্যি সত্যি কিছু একটা করছেন?
ক্রমে ওঝার কপালে ঘাম দেখা দিলো। ভ্রূ পার হয়ে গাল বেয়ে নামতে লাগলো নোনা ঘামের স্রোত। তার চোখের পলক তখনও পড়ছে না। আমি একটা খটকা নিয়ে অপেক্ষা করছি।
যখন আমি ধরেই নিলাম যে ওঝার বুজরুকি এ যাত্রা আর কাজে আসছে না, তখনই আমাকে অবাক করে দিয়ে মিচুর শরীর নড়ে উঠলো।
আমার আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেছে। একটু আগেই দেখলাম মুখ দিয়ে ফেনা-টেনা বেরিয়ে মারা গেছে মিচু। তবে? আমি এতদিন সভ্য সমাজে থেকে যা শিখেছি আর জেনেছি, তার বাইরেও কি কিছু আছে?
হ্যাঁ, মিচুর খোলা চোখে আলো ফিরে এসেছে, পিটপিট করছে চোখ। তার একটা হাত মাটিতে পড়ে ছিল, সেই হাতটা সে মুঠো করল, খুলল। তারপর যেন খেয়াল হল তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ওঝা। সে ওঝার হাত জড়িয়ে ধরল।
কুঁড়েঘরটাতে রাতের আঁধার ফুঁড়ে দিয়ে একটা বিকট হর্ষধ্বনি উঠলো। সেই চিৎকার এতই তীব্র যে কয়েক মুহূর্তের জন্য রাতচরা জানোয়ারেরাও চুপ হয়ে গেল, আর অবাক হয়ে শুনল আনন্দধ্বনি।
সবাই মিচুর বেঁচে ওঠার ব্যাপারটাকে খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। যেন এটাই স্বাভাবিক, একজন মানুষ মরে যাবে, আর মহামান্য ওঝা তাকে বাঁচিয়ে তুলবেন, এমনটাই ঘটবে, আকছারই ঘটছে। কিন্তু আমি তো “সভ্য” মানুষ, আমি এত সহজে এতটা অস্বাভাবিক বিষয় মেনে নিই কী করে?
কুঁড়েঘরে তখন অন্য পরিবেশ, মিচু আর তার বউ তো বটেই, গোটা গোত্রের লোক উঠোনজুড়ে তাদের মহা শক্তিধর ওঝাকে বারবার মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করছে, গোত্রপতি রারও বাদ নেই। ওঝার মুখে একটা বেশ তাচ্ছিল্যের হাসি, যেন বাঁ হাতের কড়ে আঙুলের কাজ করেছেন একটা। বিপুল প্রশংসা বেশ হাসিমুখে উপভোগ করতে লাগলেন তিনি। আনন্দে গদগদ মিচু বলে দিয়েছে, আজকালের মধ্যেই একটা শুয়োর ধরে আনবে সে, পুরোটাই ওঝাকে দিয়ে দেবে।
“ওলা-ওলা” নামে যে ছেলেটা দিনের বেলায় রেড ইন্ডিয়ানদের ভাষা শেখাত আমায়, সে আমাকে নিচু গলায় বলল, বলেছিলাম না?
আমি জবাব দিলাম না। সভ্য সমাজে থেকে আমরা বড়ই সন্দেহপ্রবণ, এত সহজে কিছু বিশ্বাস করি না। নিশ্চিত প্রমাণ দরকার আমার।
*****
আমি এই ঘটনার পর থেকে ওঝার সাথে খাতির জমানোর চেষ্টা করি। এমনিতে গোত্রের সবাই ওঝার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকে, কারণ সম্মানিত লোকের বেশি একটা কাছে যেতে নেই। আমি তো শত হলেও বাইরের লোক, কাজেই কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য যখন মিডার ঘরে ধর্ণা দিতে লাগলাম, তখন কেউ আপত্তি করলো না।
আলাপ জমাতে গিয়ে জানতে পারলাম, ওঝা মিডার এই ক্ষমতা একদিনে আসে নি। তিনি নাকি বিশ বছর একা একা জঙ্গলের কোন অজ্ঞাত জায়গায় বসে প্রেতসাধনা করেছেন। তারপর তার ওপর এই ক্ষমতা “ভর” করেছে। সবাই এটা পারে না, যেমন কষ্টের, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তো ওঝার এত সম্মান।
আমি ওঝার ক্ষমতায় পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও এটা বুঝলাম যে ওঝা আর দশটা জংলীর চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান লোক। কারণ তার কথাবার্তার ভঙ্গি প্রায় একজন শিক্ষিত লোকের মতোই, যা দেখে তাকে আর সবার থেকে আলাদা করা যায়।
একদিন চোখকান বুজে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, আপনি ব্যাপারটা কীভাবে করেন, মহামান্য ওঝা? মানে, বাঁচিয়ে তোলার ব্যাপারটা?
প্রশ্ন শুনে আমার দিকে চোখ পাকিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মিডা। পলকহীন হলদেটে চোখজোড়া দেখে আমি খানিকটা ভড়কে গেলাম, ঢোক গিললাম।
পুরো এক মিনিট তাকিয়ে থেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, জানার এত আগ্রহ কেন, অচেনা মানুষ?
ওঝা লোকটা যেমন রহস্যময়, তেমনি আশ্চর্য তার কথা বলার ভঙ্গি।
আমি মাথা নুইয়ে গলার স্বর যতটা সম্ভব মিহি করে বললাম, আমাদের অর্থাৎ সাধারণ মানুষদের কৌতূহল একটু বেশি হয়ে থাকে।
তিনি বললেন, বেশি কৌতূহল তো ক্ষতিকর।
আমি আবারো বিনয়ে গলে গিয়ে বললাম, মহামান্য ওঝা, আপনি যদি দয়া করে বলতেন, তাহলে আমি বড়ই প্রীত হতাম।
তিনি অবশেষে মুখ খুললেন। বললেন, তুমি বাইরের জগতের মানুষ, তোমাকে খানিকটা বলতে বাধা নেই। যদিও তুমি পুরো ব্যাপারটি হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হবে না। আমি জীবনীশক্তি সঞ্চারণ করে আরেকজনকে বাঁচিয়ে তুলি।
জীবনীশক্তি সঞ্চারণ? সেটা আবার কী?
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, একজন মানুষের জীবনীশক্তি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে থাকে। জীবন যাপন করতে করতে প্রতি মুহূর্তে সে জীবনীশক্তি কমে আসতে থাকে। কমতে কমতে যখন নিঃশেষ হয়ে যায়, তখন সে অন্যলোকে যাত্রা করে, যাকে তোমরা বলে থাকো মৃত্যু। তারপর তার আত্মা পরিচিতজনদের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে। আমার মতো ক্ষমতাসম্পন্ন লোকেরা ছাড়া এই আত্মা কেউ দেখতে পায় না। এই মুহূর্তে তোমার পেছনে আমার প্রপিতামহের আত্মা বসে বসে শালপাতার হুঁকোয় ধূমপান করছেন।
আমি পেছনে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। গুল মারছে না তো ব্যাটা?
ওঝা বললেন, তোমার চোখে আমি অবিশ্বাস দেখতে পাচ্ছি, অচেনা মানুষ।
আমি সাথে সাথে বললাম, না না, আমি সমস্ত বিশ্বাস করছি, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। আপনার কথা মানেই হল বেদবাক্য।
মানুষের বিরাট দুর্বলতা হল, তারা প্রশংসায় খুব খুশি হয়, গলে যায়। মিডাও দেখলাম এর ব্যতিক্রম নন। তিনি নিজেই বলে উঠলেন, মিচুর ব্যাপারটা নিশ্চয়ই তোমাকে বেশ ধাঁধায় ফেলেছে। মিচুর জীবনীশক্তি শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আমি নিজের থেকে খানিকটা দিয়ে ওকে আবার বাঁচিয়ে তুলেছি। সবসময় এই পদ্ধতি কাজ করে না বলেই আমার গোত্রের সবাই বাঁচে না। কেউ কেউ বাঁচে। মিচু সেই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে একজন।
আমি বোকার মতো বলে বসলাম, আপনি যে অন্যকে জীবনীশক্তি দেন, আপনারটা তো কমে যাচ্ছে।
তিনি ঘর কাঁপিয়ে হো হো করে এত জোরে হেসে ফেললেন, যে ঘরের সামনের একটা গাছ থেকে একজোড়া ধাড়ী শকুন ভয় পেয়ে উড়ে চলে গেল, কয়েকটা পাতা গাছ থেকে খসে পড়লো, আর কৌতূহলী কয়েকজন জংলী তীরে বিষ মাখানো থামিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি খানিকটা লজ্জায় পড়ে গেলাম।
ওঝা হাসি থামিয়ে বললেন, তোমার মতো সাধারণ মানুষের এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভুলে যাচ্ছ, আমি প্রেতসাধক। ভয় ও ভীতির দেবতা “অলাং” এর কাছ থেকে আমি জীবনীশক্তি সঞ্চারণের কৌশল শিখেছি। প্রেতসাধনার মাধ্যমে আমি জীবনীশক্তি সংগ্রহ করি। তাই আমার ভাগটা কখনোই কমে না। আজ পর্যন্ত আমি অনেককে মৃত অবস্থা থেকে জীবিত করেছি, কিন্তু আমি এখনো আগের মতোই যৌবন ধরে রেখেছি।
আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, আপনি কি অমর, মহামান্য ওঝা?
তিনি এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হাসিমুখে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। কিন্তু এই শুকনো হাড় জিরজিরে বুড়ো মানুষটা নিজের জীবনীশক্তি সঞ্চারণ করে অন্যকে বাঁচিয়ে তুলছে, আমার ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না।
আমি অবিশ্বাস এবং খটকা নিয়ে দিন অতিবাহিত করতে লাগলাম। আমার চারপাশে যেসব জংলী রয়েছে, তাদের প্রত্যেকে মনেপ্রাণে ওঝার ক্ষমতায় বিশ্বাস করে, সে বিশ্বাসে বিন্দুমাত্র খাদ নেই। এজন্যই হয়তো লোকগুলো সুখে আছে। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যবর্তী জগতে বসবাস করা সত্যিই কষ্টকর।
আমার এমন দোলাচলে থাকার কারণ আছে বৈকি। আমি থাকতে থাকতেই আরও একজন মারা গেল, ওঝা তাকে বাঁচাতে পারলেন না। বললেন, বড় দেরী হয়ে গেছে, মানুষটির আত্মা প্রেতলোকে চলে গেছে, আর জীবনীশক্তি দিয়ে কোন লাভ নেই। সেটা অন্যরাও স্বচ্ছন্দে মেনে নিলো। মাটিতে একটা গর্ত খুঁড়ে রেড ইন্ডিয়ানদের রীতি আর আচার-অনুষ্ঠান পালন করে সমাহিত করা হল তাকে।
কিন্তু তার তিনদিন পর আমাকে ভাষা শেখানো সেই ছোকরা যখন বুনো শুয়োরের সাথে ধস্তাধস্তি করে গুরুতর আহত হল, তখন তাকে ঠিকই সারিয়ে তুললেন মিডা। বলা যায়, ওঝার সাফল্যের হার শতকরা পঞ্চাশ ভাগ, কেউ বাঁচে তো কেউ মরে। আমার সন্দেহও তাই কাটছে না।
এসব তো গেল রোজকারের ঘটনা। আসল ঘটনা তো অপেক্ষা করছিলো এরপরে। আমি জীবনে যেসব চমকপ্রদ আর আশ্চর্য ঘটনা দেখেছি, সেটা ঘটলো সেদিন।
নিশুতি রাত ছিল। সেদিন আমার ঘুম আসছিল না। ঘুম না এলে চারপাশের সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আর মৃদু শব্দ বড় জোরালো হয়ে দেখা দেয়। আমি তাই দূর থেকে ভেসে আসা বেবুন আর তাপিরের ডাক শুনছিলাম, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কানে এসে বাজছিল, ঠিক তখন মিচুকে সাপে কাটার সেই রাতটির মতো আবার শোরগোল উঠলো। কার আবার কী বিপদ ঘটল দেখতে ঝাঁপ খুলে বেরিয়ে পড়লাম। ততক্ষণে চারিদিকে অনেকগুলো আগুন জ্বলে উঠেছে, মশালের আলো। একজনের বিপদে এখানে সবাইকে আসতে হয়, এটাই নিয়ম। কারো ঘরে বসে থাকার অধিকার নেই।
এবার সাপ নয়, মাকড়সা। রেড ইন্ডিয়ানরা সাপ, মাকড়সা, এমনকি রাক্ষুসে জাতের পিঁপড়ের কাছেও অতি অসহায়। ভাগ্যের ওপর নিজেদেরকে সমর্পণ করে বসে না থেকে তাদের উপায় নেই। আজ রাতে এবু নামের এক বাচ্চা ছেলের ঘাড়ে কামড়েছে একটা প্রমাণ সাইজের মাকড়সা। মাকড়সাটা আমরা যেমন আকারের দেখে থাকি তেমন নয়, বিষাক্ত এই প্রাণীটি বয়স্ক মানুষের হাতের তেলোর সমান, ছড়ানো পাঁচটি আঙুল সহ।
মাকড়সাটাকে সাথে সাথেই পিষে মেরে ফেলা হল ঠিকই, কিন্তু বিষ ছড়িয়ে পড়ছে এবুর সারা শরীরে, নীল হয়ে যাচ্ছে শরীর। একটা মাকড়সার বিষ মানুষকে মেরে ফেলার চেয়েও বেশি ক্ষমতা রাখে, এই বিষ সাধারণ অবস্থায় রেড ইন্ডিয়ানরা শিকারের কাজে ব্যবহার করে, তীরের ফলায় লাগিয়ে।
গোত্রের সর্দার রার বাজখাঁই গলায় হুকুম দিলেন, ওঝাকে দয়া করে এখানে আসতে বল। দেরী যাতে না হয়, দৌড়ে যাও।
আর সব কুঁড়েঘর একসাথে পাশাপাশি তৈরি হলেও ওঝার ঘরটা বেশ বড় আর একটু দূরে। সেদিকে দৌড়ে গেল একদল লোক। এবার আমিও ওদের সাথে গেলাম। ওঝা লোকটি আমাকে বেশ পেয়ার করেন আজকাল, হয়তো আমাকে বেশ জ্ঞানী লোক ভাবেন। শত হলেও আমি শহর থেকে এসেছি, বন্দুক নিয়ে ঘুরেছি।
ওঝার কুঁড়েঘরের সামনে সবার আগে পৌঁছলাম আমি। ভেতরে একটা আলো জ্বলছে, মশালের আগুন ঘরের আঁধার সবটুকু দূর করতে পারে নি বলে ঘরের আনাচেকানাচে জমে আছে বিপজ্জনক অন্ধকার, সাপ আর মাকড়সার লুকিয়ে থাকার আদর্শ জায়গা।
আমি বাইরে থেকে ডেকে উঠলাম, ওঝা মশায়!
কোন সাড়া নেই। তবে কি ঘুমোচ্ছেন? রাতে ঘুমোয় সাধারণ মানুষ, তাঁর মতো ওঝার জন্য নিঝুম রজনী তো সাধনার সময়, জেগে থাকার সময়।
আমি আবার ডাকলাম। জবাব পেলাম না। দরজা ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম, অনুমতি না নিয়েই।
ঐ তো শুয়ে আছেন। কিন্তু পাতা আর নলখাগড়া দিয়ে বোনা তক্তপোষে না শুয়ে মাটিতে কেন?
আমি ভয়ে ভয়ে গায়ে হাত দিয়ে ডাকলাম। একজন জংলী আমাকে সতর্ক করলো, আমি কান দিলাম না। ওদিকে একজন মানুষ মারা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে তার “জীবনীশক্তি” দরকার।
গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দেয়া সত্ত্বেও নড়লেন না মিডা।
আমি কয়েকবার জোরে জোরে ধাক্কা দিয়েও যখন ঘুম ভাঙাতে পারলাম না, তখন তাঁকে চিত করলাম। সভয়ে পিছিয়ে এলাম সাথে সাথে। আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ানো ছ’জন রেড ইন্ডিয়ান ভীত চিৎকার করে উঠলো।
এখানে কোন মানুষ শুয়ে নেই, শুয়ে আছে একটি নরকঙ্কাল।
আমি সবই বুঝলাম। সবাইকে দিতে দিতে জীবনীশক্তি তাঁর শেষ হয়ে গিয়েছিলো। তাঁকে দেয়ার মতো কেউ তো নেই। তিনি যে অমর, কথাটা তবে মিথ্যে ছিল।
সে রাতে একসাথে দুটো কবর খোঁড়া হল। অন্ধকার বনভূমির এক চিলতে জায়গা আলো হয়ে রইলো শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের নিমিত্তে। এবু ছেলেটিও মারা গেছে, বাঁচানো যায় নি। তাকে সাধারণভাবে কবর দেয়া হলেও ওঝা মিডাকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে রাজকীয় কবর দেয়া হল। তাঁর প্রেতসাধনার উপকরণ, গাছগাছড়া, পোশাক ইত্যাদি সহ সারা শরীর বিচিত্র উল্কিতে চিত্রিত করে সমাহিত করা হল। তিনি যেন প্রেতলোকে গিয়েও এই গোত্রের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন এবং আগের মতোই তাঁর সাধনা চালিয়ে যেতে পারেন, সে চেষ্টার কোন ত্রুটি করা হল না।
*****
আমি তার তিনদিন পরেই চলে আসি। বিদায়ের সময় খানিকটা খারাপ লেগেছিল বৈকি। অনেকদিন ওদের সাথে একসাথে থেকেছি, সুখদুঃখ ভাগাভাগি করেছি, এক কথায় জংলী মানুষগুলোকে আপন করে নিয়েছিলাম। বিদায়ক্ষণে তাদের অনেকের চোখেও জল দেখেছি। কে জানে, হয়তো আবার ঘুরতে ঘুরতে ওদের কাছে ফিরে আসবো। আমাকে মুগ্ধ করেছে এই মানুষগুলোর সরলতা।
ওরা হয়তো আবারো কোন নতুন ওঝা খুঁজে নেবে। সেই ওঝা জীবনীশক্তি সঞ্চারণ করে বাঁচিয়ে তুলবে মৃত মানুষকে, গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব কাটিয়ে দেবে, সারিয়ে দেবে যেকোনো জটিল ব্যাধি, সব বিষয়ে সমাধান দেবে, জংলীদের অভিভাবক এবং মূর্তিমান ভরসা হবে, প্রেতসাধনা করে হবে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, যার সামনে দিয়ে হাঁটতেও সবাই ভয় পাবে। আমি বিশ্বাস করি কি করি না সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর।
ওদের একজন আমাকে জঙ্গলের কিনার পর্যন্ত পৌঁছে দিলো। তারপর দৌড়ে আড়াল হয়ে গেল ঘন গাছপালার পেছনে। যাবার আগে একবার পেছনে তাকাল, আমি দেখতে পেলাম, জংলীটির মুখে এক চিলতে হাসি।
ঝোলা আর বন্দুক নিয়ে আমি ফেরার পথ ধরলাম। তথাকথিত জীবনীশক্তি সঞ্চারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ওঝা মিডার কথা আমার সবসময় মনে থাকবে।
বিদায় বন্ধুরা। গায়ানার এই জঙ্গলে আবার কবে আসা হবে, আদৌ কখনো আসা হবে কীনা জানি না। হয়তো অভিযানের জন্য চলে যাবো অন্য কোথাও। দেখা হবে অন্য কোন সময়ে।
পুনশ্চঃ
মজার ব্যাপার হল, এই পুনশ্চ অংশে ডক্টর সিম্পসন কোন যৌক্তিক বিশ্লেষণ কিংবা ব্যাখ্যা না লিখে একটা বিখ্যাত নাটকের বিখ্যাত উক্তি লিখেছেন, “There are many things in heaven and earth.” অস্বাভাবিক ব্যাপারস্যাপার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে বোধহয় তাঁর নিজের মধ্যেও এসবে খানিকটা বিশ্বাস চলে এসেছে।
………………………………………………………..(সমাপ্ত) ………………………………………………….