ডঃ মাহবুব আসরারের ডায়রি
কেস স্টাডি ৪৮০৯
নামঃ আফজাল হোসেন
বয়সঃ ২৬
আজ আমার বিয়ে।
পাত্রী পানঘাটার মীর্জাবাড়ির মেয়ে। সচ্ছল পরিবার। পরিবারের একমাত্র মেয়ে, তিন ভাইয়ের আদরের বোন। বাসা থেকে পড়ে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে, তারপরই তার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন তার পিতামাতাসহ সবাই। নাম নূরুন্নাহার। ঘটক ছুটেছে দিকে দিকে। কয়েক দিনের মধ্যেই খবর নিয়ে ফিরেছে, একটা ভাল পাত্রের সন্ধান আছে। পাত্র অতি ভদ্র, অতি নম্র, শিক্ষিত, ভাল ছেলে, ইত্যাদি। এত গুণে গুণান্বিত পাত্রটি আমি নিজেই।
আমি চেয়েছিলাম আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে। “বি.এ. পাশ করা”, বিয়ে করার জন্য কোন যোগ্যতা বলে আমি মনে করি না। তাছাড়া পাত্রী গ্রামের মেয়ে, আবার আমার চেয়ে বেশ কয়েক বছরের ছোট। শহরের আলোবাতাস গায়ে লেগেছে বলেই হয়তো আমার খানিকটা অনীহা ছিল। ইচ্ছে ছিল, চাকরিবাকরি নিয়ে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তারপর বিয়ে করবো। কিন্তু আমার বাবা-মা আগেকার যুগের মানুষ, “শুভকাজ” দ্রুত সেরে ফেলাটা তাঁদের কাছে অত্যন্ত জরুরী।
তাঁদের কথার ওপর আমার কোন কথাই কখনো চলত না। এবারেও চলল না, মত আমাকে দিতেই হল। সবচেয়ে বেশি পীড়াপীড়ি করছিলেন আমার বাবা। তিনি বলছিলেন, বাপ রে! আমি বুড়ো হয়েছি, বড় শখ ছিল তোর বউ দেখে, নাতিপুতি দেখে মরবো। তুই না করিস না।
এরপর কি আর কথা চলে?
অতঃপর যথাসময়ে আমার বিয়ের বাজনা বেজে উঠলো।
*****
কন্যার পিতার বাড়িতেই বিয়ে পড়ানো হল, খাওয়াদাওয়া হল। অনেক দূরে আমার শ্বশুরবাড়ি, রেলগাড়িতে করে যেতে হয়। বিয়ে পড়িয়ে সেদিনই রেলে করে সবাই ফিরে এলো, কন্যাকে সাথে নিয়ে। আসবার আগে নূরুন্নাহারের পিতামাতা অনেক কান্নাকাটি করলেন। তার মা তো একটু পর পর মূর্ছা যাবার অবস্থা। আর তার পিতা আমার হাত ধরে বললেন, দেখো বাবা, ও আমার একমাত্র মেয়ে। সুখ দিতে না পারো, ওকে কষ্ট দিয়ো না।
আমার কাছে ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি বলেই মনে হচ্ছিল। এমন আয়োজন করে এসব আবেগের কথা বলার কোন মানে হয় না। তাছাড়া নূরুন্নাহারের ষণ্ডামার্কা তিন-তিনটে ভাই আছে, বোনের কিছু হলে আমার জীবন সংশয় হবার আশঙ্কা আছে। তবুও চুপ থাকলাম, হয়তো উনারা গ্রামের মানুষ বলে তাঁদের আবেগ প্রকাশ করার ভঙ্গি আলাদা। ভয়ে ভয়ে তাকালাম একটু দূরে দাঁড়ানো পাহাড়ের মতো লম্বা তিন ভাইয়ের দিকে। ষণ্ডামার্কা হলেও তাদের চেহারায় এখন খুশির ভাব। বোনের বিয়ে হয়েছে, খুশি হবারই কথা।
পুরো রাস্তা নূরুন্নাহার তার লাল শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদল। আমি বরাবর তার পাশে বসে ছিলাম, কিন্তু কোন কথা বললাম না। আহা বেচারি, বাপের বাড়ি ছেড়ে কোথাকার কোন অচেনা লোকের ঘর করতে আসছে, মন তো খারাপ হবেই। কাঁদুক, কেঁদে হালকা হোক। পরে সান্ত্বনা দেবো। সান্ত্বনা দেয়ার অনেক সময় আছে।
ট্রেনে ওঠার আগে একটা ব্যাপার ঘটেছে। সামান্য ঘটনা, তবুও আমাকে তা চিন্তায় ফেলেছে। এত ভিড়, এত ঝক্কির মধ্যে যখন আমরা অর্থাৎ বরপক্ষের লোকেরা কনেকে একটা ভাল জায়গায় বসানো নিয়ে ছোটাছুটি করছি, তখন কেউ একজন আমার কানে এসে বলল, জেনেশুনে এই বিপদ ঘাড়ে নিচ্ছ কেন বাবাজী?
আমাকে কেউ জীবনে “বাবাজী” জাতীয় অদ্ভুত সম্বোধন করে নি। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, একজন বুড়োমতোন মানুষ, আমি চিনি না। হয়তো লতায়-পাতায় আত্মীয় হবে। পারিবারিক উৎসবের সময় এমন দুঃসম্পর্কের অনেককেই দেখা যায়, অন্য সময় দেখা যায় না। উৎসব শেষ, তাঁরাও হাওয়ায় মিলিয়ে যান। আমি এই লোকটিকে সেসব আত্মীয়ের একজন ধরে নিয়েই বললাম, কী বিপদ বলুন তো?
ভদ্রলোক সময় বের করেছেন ভাল, আমাকে একা পেয়েছেন। তারপরও চারপাশে তাকিয়ে, গলা নামিয়ে বললেন, এই মেয়ের “দোষ” আছে। “দোষ” শব্দটিতে বেশ খানিকটা জোর দিলেন তিনি।
কোন্ মেয়ে?
তিনি গলার স্বর আরও নামিয়ে, একেবারে খাদে ফেলে বললেন, নূরুন্নাহার।
আমি উনার মুখের কাছ থেকে মুখ সরিয়ে নিলাম। পান আর কাঁচা সুপুরির বিটকেল গন্ধ আসছে তার মুখের ভেতর থেকে। বললাম, ও, আচ্ছা।
তার কথায় বিন্দুমাত্র আমল দিই নি, বলাই বাহুল্য। এমন অনেক লোক থাকে, বিয়ের সময় যাদের প্রধান কাজ থাকে “কানভাঙানি” দেয়া, এক পক্ষ সম্পর্কে আজেবাজে কথা অন্য পক্ষের কানে লাগানো, যাতে অশান্তি তৈরি হয়। এতে তারা কী পায় জানি না, বোধহয় তাদের কাছে এটা খুবই আনন্দের কাজ। এই বুড়োও তাহলে সেই দলের লোক। মজার ব্যাপার হল, এই কাজে অনেক ক্ষেত্রেই তারা সফল হয়। আমার কাজ হচ্ছে এখন এই বুড়োকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলাম, লোকটি বয়সে মুরুব্বী বলে কিছু বলছি না।
জানালা দিয়ে পানের পিক ফেলে লোকটি বলল, বিশ্বাস করলে না তো? দেখো, আমার কথা ফলবেই। মীর্জা সাহেব তাঁর মেয়েকে অনেকদিন ধরেই পাত্রস্থ করার চেষ্টা করছিলেন, কেন হচ্ছিল না, তা আজ রাতেই টের পাবে। আমি তোমার বাপের বয়সী, তোমার মঙ্গল চাই বলে জানিয়ে রাখলাম। কিছু হলে আমাকে দোষ দিও না যেন।
কী একটা কাজের কথা মনে পড়ে গেছে, এমন একটা ভাব করে লোকটি হঠাৎ করেই চলে গেল। মিশে গেল অনেক লোকের ভিড়ে।
আমি ভ্রূ কুঁচকে বসে আছি। লোকটি চলে যাবার সাথে সাথেই আমাকে ডেকে নিয়ে আরেক জায়গায় বসানো হল, নূরুন্নাহারের পাশে। সে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে, মুখের ভাব বোঝার উপায় নেই।
এই মেয়ের দোষ আছে? কী সেই দোষ? আমাকে কেউ তো এ ব্যাপারে কেউ কিছু বলে নি? মানুষের আবার দোষ থাকে নাকি? কুসংস্কার, সব কুসংস্কার। গ্রামদেশের লোকগুলো এখনো অন্ধকারে পড়ে আছে। হয়তো কোনদিন সে অস্বাভাবিক কিছু একটা করেছিল, কিংবা কোন অসুখ হয়েছিলো, তাতেই সবাই তিলকে তাল করেছে। আমরা ভালোমতো খোঁজখবর করেছি, মেয়ের কোন সমস্যা নেই। না শারীরিক, না মানসিক। ভাল ঘরের সুন্দরী মেয়ে পেয়েছেন বলেই তো বাবা-মা আমাকে এর সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য এতটা উতলা হয়েছেন।
আমি চিন্তিত মুখে চুপচাপ বসে ছিলাম, কাউকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করা হয় নি ঐ লোকটি কে। একবার ভাবলাম খোঁজখবর করি, কিন্তু একটা উড়ো লোকের উড়ো কথা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন মানেই হয় না বলে সেটাও করলাম না।
*****
বিকেল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। সারাদিন মেঘ করে ছিল, সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। সারারাতই হয়তো হবে। কখনো বৃষ্টি একেবারে ধরে আসছে, আবার মুষলধারে শুরু হচ্ছে। বিয়েশাদির দিনে বৃষ্টি একটা ভোগান্তির মতো। সন্ধ্যায় আমরা স্টেশনে পৌঁছেছি, তারপর বাড়ি পর্যন্ত আসতে আসতে সবাই কাকভেজা অবস্থা। ঠাণ্ডা লেগে যাবার ভয়ে সবাই কাপড় বদলেছি। নূরুন্নাহারের ওপর আগাগোড়া ছাতা ধরা ছিল বলে সে অবশ্য ভেজেনি। সে নতুন বউ, তার সুবিধে-অসুবিধের ওপর সবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। বিয়ের দিনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি কিন্তু বর নয়, কনে। কাজেই আমার পাজামায় কাদার ছিটে দেখেও কেউ কিছু বলল না, অথচ নূরুন্নাহারের থুতনি তুলে ধরে আমার মা সস্নেহে জিজ্ঞেস করলেন, পথে কোন অসুবিধে হয় নি তো, বৌমা? স্ত্রীর ওপর খানিকটা হলেও হিংসে হল বৈকি।
মুরুব্বীদের সালাম করা, মেয়েদের খুনসুটি, এসব চলল বেশ রাত পর্যন্ত। কী করে চলল তা আল্লাহ মালুম, গ্রামের মানুষগুলো একটা উৎসব করার সুযোগ পেয়ে এই ঝড়বৃষ্টির রাতেও আমাদের বাড়িতে ভেঙে পড়েছে, কমবয়সী মেয়েদের ভিড়ে ঘরে টেকাই দায়। হারিকেনের মৃদু আলোতেও তাদের উৎসাহের কমতি নেই, চেঁচামেচিতে, হাসাহাসির শব্দে কান পাতা যায় না। সারাদিনের পরিশ্রমে তখন আমি ক্লান্ত, লম্বা রেলযাত্রার ধাক্কায় দু’চোখ ভেঙে ঘুম আসছে। আজ রাতে বোধহয় ঘুমোনো কপালে নেই। ভাবলাম কিছুক্ষণের জন্য গা ঢাকা দিই, এসব হৈচৈ মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু চাইলেই তো আর করা চলে না। কাজেই আমাকে তাদের হৈ-হুল্লোড় শেষ না হওয়া পর্যন্ত শুকনো মুখে এক কোণে বসে থাকতে হল, আর সবার কথায় হাসি-হাসি মুখ করতে হল।
একটা সময় মেয়েরাই আমাকে ধরে নিয়ে গেল শোবার ঘরে। ফুলশয্যার ঘর, তারা সারাদিন ধরে সাজিয়েছে। মুরুব্বীরা কোথায়, জিজ্ঞেস করা হল না। একজন আমাকে ভেতরে ঠেলে দিয়েই দরজা টেনে দিলো, সাথে সাথে সবাই খিলখিল করে হাসি। এদেরকে বিশ্বাস নেই, বাইরে থেকে আড়ি পেতে না থাকলেই হয়। বিয়ের রাতে গ্রামদেশে বরকে অন্য মেয়ের সাথে একটা ঘরে আটকে রাখা, নানারকম বিচিত্র আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে “নিপীড়ন” করা – এসব কথা আগেই শুনেছিলাম, তাই ভয়ে ভয়ে ছিলাম।
আমি অবশ্য সাবধানী মানুষ, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাইরে উঁকি দিলাম। না, কেউ নেই, দুষ্টু মেয়ের দল নেমে গেছে নিচের তলায়। আমার মা কোথায় লাপাত্তা হলেন তাই ভাবছি। আশা করেছিলাম ঘরে ঢোকার আগে একবার তাঁর সাথে কথা বলে নেবো। তাঁর ছেলে আজ নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে, এমন সময় মাতৃ-আশীর্বাদ একান্ত কাম্য। কিন্তু সেটা আর হল না। কাউকে ডেকে দিতে বলবো, সেটা করতেও ইচ্ছে হচ্ছে না।
মেয়েদের দল এত কিছু করেছে, বিছানায় গোলাপ ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়েছে, গাঁদা ফুলের মালা দিয়ে চারিদিকের দেয়াল সাজিয়েছে, অথচ ঘরে একটা হারিকেন ছাড়া আর কিছু নেই। এটাই অবশ্য স্বাভাবিক, আমাদের এখানে গরমের দিনে ইলেক্ট্রিসিটি থাকে না; রাতবিরেতে হারিকেন, টর্চ আর মোমবাতিই ভরসা। মাঝে মাঝে দু-চার মিনিটের জন্য কারেন্ট এসে সবাইকে জানিয়ে দেয় শুধু, “আমি আছি, এখনো একেবারে চলে যাই নি।”
বাইরে থেকে শীতল বৃষ্টিভেজা বাতাস আসছে বলে হারিকেনের আগুনটা কাঁপছে। অন্ধকার দূর করতে পারছে না মোটেও।
আমি বিছানার দিকে এগিয়ে গেলাম, সেখানে গুটিসুটি মেরে বসে আছে আমার স্ত্রী, নূরুন্নাহার। বিশাল একটা ঘোমটা দেয়া, চেহারার কিয়দংশও দেখা যাচ্ছে না। শুধু চুড়ি দিয়ে ভরা হাত দুটো কোলের ওপর রাখা। এইবার কিছুক্ষণ কথা বলতে হবে ওর সাথে, নিজেকে ওর সাথে ঘনিষ্ঠ করে নিতে হবে। প্রথমেই জড়তা কাটাতে না পারলে পরবর্তীতে নাকি অসুবিধে হয়, অন্তত সিনেমা-টিনেমাগুলোতে তো তাই দেখেছি।
আমি ওর পাশে বসে বললাম, তুমি করে বললে আপত্তি নেই তো?
ঘোমটাটা ডানে-বাঁয়ে নড়ে জানালো, কোন আপত্তি নেই।
আমার সহসা কৌতুক বোধ হয়। হেসে ফেলে বললাম, এমন করে ঘোমটা দিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখলে কথা বলবো কী করে? ঘোমটাটা কষ্ট করে খুলবে?
কিছুক্ষণ কোন নড়াচড়া নেই। তারপর সে ধীরে ধীরে ঘোমটা সরিয়ে ফেললো মুখের ওপর থেকে।
আমার বুকটা ধক করে উঠলো। ঘোমটার নিচ থেকে যে মুখটা বেরিয়েছে, সেটা ঝলসানো বীভৎস একটা মুখ। তাতে এখানে-সেখানে লেগে আছে পোড়া মাংস।
আমি ছোট্ট একটা চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু সাথে সাথেই এক ঝলক বাতাস ঢুকল জানালা দিয়ে, আর আমি দেখতে পেলাম বীভৎস মুখটি নেই। সে জায়গায় অতি সাদাসিধে একটা মেয়ের মুখ। বিয়ের আগে পাওয়া একটা ছবিতে যেমনটা দেখেছি।
নূরুন্নাহার নিজেও বোধহয় ভয় পেয়েছে। মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলো, আপনার কী হয়েছে?
আমি অপ্রতিভ বোধ করলাম। বিব্রত খানিকটা। ছি ছি, কী দেখতে কী দেখেছি। মেয়েটা কী মনে করলো? পৃথিবীতে কোন স্বামী নতুন বউকে দেখে আমার মতো চেঁচিয়ে উঠেছে কীনা আমার জানা নেই।
আমি হড়বড় করে বিষয়টা চাপা দেয়ার জন্য বললাম, কিছু না, পায়ে কী যেন বিঁধেছে। বলে নিচু হলাম, পায়ে হাত বুলিয়ে নূরুন্নাহারকে আশ্বস্ত করলাম যে ওর চেহারা দেখে ভয় পাই নি, পায়ে সত্যিই কিছু একটা বিঁধেছে। বাসররাত শুরু হল একটা ছোট্ট প্রতারণা দিয়ে।
আমার বুকের ধুকপুক শব্দ কমে এলো ধীরে ধীরে। হারিকেনের আলো নিশ্চয়ই কোন কারসাজি করেছে আমার সাথে, তাই এমনটা দেখেছি, পাকা গোয়েন্দার মতো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাবার চেষ্টা করি আমি।
এবার নূরুন্নাহারের কাছে আরও খানিকটা সরে এলাম। হয়তো শহরে থেকে লেখাপড়া করেছি বলেই আমার লজ্জা, সংকোচ, জড়তা ইত্যাদি একটু কম, তাই ধীরে ধীরে কোলের ওপর রাখা নূরুন্নাহারের হাতের ওপর নিজের একটা হাত রাখলাম।
মেয়েটা লজ্জায় জড়সড় হয়ে গেল, কিন্তু হাত সরিয়ে নিলো না। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে ওর, বুঝতে পারলাম। খানিকটা শিহরণ বোধ করলাম আমিও।
খানিকক্ষণ পর হাতটা সরিয়ে নিলাম। কথাবার্তা বলতে হবে, সহজ হতে হবে, স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে। তাহলেই নূরুন্নাহারের লজ্জাটা কেটে যাবে। কিন্তু ওর হাতটা অস্বাভাবিক রকম ঠাণ্ডা, হাত ধরেই আমি চমকে গিয়েছিলাম। একটু আগেই ওকে দেখে যে আচরণটা করেছি, তার ওপর ওর হাত ধরে আবার চেঁচিয়ে ওঠাটা মোটেই শোভন হতো না, তাই বহু কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলাম।
আমি আলাপ জমাবার জন্য এটা-ওটা জিজ্ঞেস করা শুরু করলাম। বিয়েতে তুমি খুশি হয়েছ, নূরুন্নাহার?
সে কিছু বলল না, আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।
আমার বুকটা ভীষণ ধড়ফড় করছে। নূরুন্নাহারের জিভটা কুচকুচে কালো, আর দাঁতগুলো কুৎসিত। মনে হচ্ছিল একটা কিলবিলে জন্তু আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
সে এবার কথা বলে উঠলো। হাসিমুখেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? এমন করছেন কেন?
আমি আবার ওর মুখের দিকে তাকালাম। না, ওর হাসিটা তো স্বাভাবিক, সুন্দর একটা তরুণীর হাসি, মোটেই কুৎসিত নয়। তাহলে আমি কী দেখলাম?
হারিকেনটা এক পাশে রাখা, কাঁপা আলো নূরুন্নাহারের এক গালে পড়েছে, আরেক দিকে জমাট বাঁধা অন্ধকার বলে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। আমার মনে হল, ওর পেছনে জমে থাকা অন্ধকারে কী যেন একটা নড়ে উঠলো, আমার দিকে উঁকি দিয়েই আবার সরে গেল। আমি সেদিকে না তাকানোর ভান করে ওর দিকে চেয়ে বললাম, না, আমি ঠিকই আছি। তুমি আমাকে আপনি আপনি করে বলছ কেন? স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এত ব্যবধান থাকা ঠিক নয়। তুমিও আমাকে তুমি করে ডাকবে, ঠিক আছে? এতে লজ্জার কিছু নেই। গ্রামদেশে অবশ্য স্বামীকে আপনি করে ডাকার নিয়ম আছে, কিন্তু তুমি তো নতুন যুগের মেয়ে।
সে সায় দিলো। ঠিক আছে, তুমি করেই ডাকবো।
আমি অনুভব করলাম, আমার স্ত্রীর জড়তা কেটে যাচ্ছে, বেশ দ্রুত। কেটে গেলেই ভাল। ঘোমটা দেয়া কলাবতী বউদের দিন এখন আর নেই।
আমি নিশ্চয়ই অভিনয় করলে বেশ নাম করতাম, এতটা ভয় নিয়েও আমি নূরুন্নাহারের সাথে দিব্যি আমি স্বাভাবিক থাকার ভান করে গেলাম। সে কিছু বুঝতে পারছে কীনা জানি না।
এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কোন ডাকনাম নেই? নূরুন্নাহার নামটা বড্ড লম্বা।
সে মুখ টিপে হেসে বলল, আমাদের বাড়ির সবাই আমাকে “নাহার” বলে ডাকে।
আমি বললাম, তাহলে আমিও তাই ডাকবো। আপত্তি নেই তো?
নূরুন্নাহার মাথা নাড়ল।
আমরা আরও অনেকক্ষণ গল্প করলাম। বেশিরভাগ কথাই আমি বলছি, প্রশ্ন করছি, এটা-সেটা জেনে নেয়ার চেষ্টা করছি, আর সে মৃদুস্বরে জবাব দিচ্ছে। সটান বালিশ নিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়া একেবারেই অশোভন হতো।
সময়টা ধীরে কাটছিল, খুব ধীরে। হারিকেনে তেল নিশ্চয়ই কম ভরা হয়েছিলো, সেটার তেজ কমে এসেছে, আর কালি উঠছে খুব। আমার মন কোন এক অজানা কারণে বলছিল, তোমার এখন আলো দরকার, অনেক আলো। কিছুতেই হারিকেনটাকে নিভে যেতে দেয়া যাবে না। নিভে গেলেই সমূহ বিপদ ঘটবে। সাবধান।
এতকিছুর মধ্যেও আমি হাসিমুখ বজায় রেখে গল্প করতে লাগলাম। ছোট ছোট বিষয় নিয়ে গল্প। সেসব গল্পের কোন আগাও নেই, মাথাও নেই। বুকের ভেতর ভীষণ ভয় যেমন ছিলো, তেমনি হয়তো একটি নারীকে জীবনে প্রথমবার কাছে পাবার আনন্দও কাজ করছিলো। অনুভূতিটি বিচিত্র, সন্দেহ নেই।
একসময় যখন আবার আমার ঘুম পেয়ে গেল, তখন আমি বললাম, চল, ঘুমিয়ে পড়া যাক। কেমন? মাথায় তখনও ঘুরছে, এই মেয়ে স্বাভাবিক তো? নাকি সত্যিই ওর কোন দোষ আছে? কিছুক্ষণ আগে যা দেখেছি, তা কি বাস্তব নাকি বিভ্রম? বাইরের কেউ শুনলে আমার মানসিক স্থিরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু একবার নয়, পরপর দু’বার ব্যাপারটা ঘটেছে, খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে। একবার কুৎসিত একটা মুখ, আরেকবার মুখগহ্বর, কুচকুচে কালো জিভ।
নূরুন্নাহার মাথা কাত করে বলল, ঠিক আছে। শুয়ে পড়ি। মেয়েটি দোষ লাগা হোক আর যাই হোক, ভাল মেয়ে। আমি যা-ই বলি, তাতেই সে সায় দেয়। এমনটা পরবর্তীকালেও বজায় থাকলে হয়।
আমি আর আমার নবপরিণীতা স্ত্রী একজন আরেকজনের দিকে মুখ করে শুয়ে আছি। আমার চোখ বন্ধ। ঘুমোবার চেষ্টা করছি। ঘুম আসবে না, বলাই বাহুল্য। আমার অন্ধকারের প্রতি খানিকটা অনীহা আছে। শহরে মেসে আমার রুমে আমি একা থাকি, সেখানে রাতে বাতি জ্বালিয়েই ঘুমাই। অন্ধকারে অস্বস্তি হয়। এখানে অন্ধকার আছে বৈকি, কিন্তু জানালার একটা কপাট লাগে না বলে সেখান দিয়ে কিছুক্ষণ পর পর আলো আসছে। বজ্রপাতের আলো। ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠছে প্রতিটি বজ্রপাতের সাথে সাথে। জানালার কাছটা ধোঁয়াটে, ভিজে উঠেছে জানালার সন্নিহিত দেয়াল।
আমি বিকট শব্দে একটু পর পর চমকে চমকে উঠছিলাম আর তাকিয়ে দেখছিলাম, নূরুন্নাহার জেগে আছে কীনা। ওরও চোখ বন্ধ। ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই, বড় বড় গভীর নিঃশ্বাস পড়ছে। সারাদিনে ধকল তো কম যায় নি।
আমি যখন বজ্র-বিদ্যুতের আওয়াজে এবং আলোর ঝলকানিতে তৃতীয়বারের মতো চমকে উঠলাম, তখন চোখ খুলে দেখলাম, নূরুন্নাহারের চোখও খোলা, সে সোজা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, এক দৃষ্টিতে। চোখ দুটো নেশাখোরদের মতো লাল। লাল চোখের মধ্যে জ্বলজ্বলে মণি দুটো ভয়ংকর।
আমি শিউরে উঠলাম সে চোখের দৃষ্টি দেখে, চোখে কোন অভিব্যক্তি নেই, মরা মানুষের চোখ। আমার কলজে শুকিয়ে গেল। চিৎকার করে উঠতে যাবো, তখনই নূরুন্নাহার ভারী কণ্ঠে বলে উঠলো, চিৎকার করবে না, খবরদার। খুন করে ফেলবো। কোন আওয়াজ নয়।
গলার স্বর কোন নারীর নয়, বয়স্ক পুরুষ মানুষের কণ্ঠ। আমার চিৎকার গলার ভেতরেই রয়ে গেল, বাইরে বেরুলো না। বিয়ে করতে গিয়ে এ কোন বিপদে পড়লাম? আমি ওর দিক থেকে চোখ সরাচ্ছি না, সে যেমন চেয়ে আছে, আমিও চেয়ে আছি। স্নায়ু টানটান হয়ে আছে, শরীর ঘামছে, যদি সে আক্রমণ করে তাহলে যেন ঠেকাতে পারি। কিন্তু পারবো না, আমি কিছুই করতে পারবো না, লিখে দিতে পারি। সে যদি এখন আমার গলায় দাঁতও বসিয়ে দেয়, তাহলেও আমি হাত তুলে ঠেকাতে পারবো না, কারণ আমার আঙুলগুলো অসাড় হয়ে গেছে, কিছুক্ষণ থেকে ভয়ে নাকি শীতে জানি না, আমি হাত কিংবা পা, কোন আঙুলই নাড়াতে পারছি না।
নূরুন্নাহার আমাকে সেই ভারী কণ্ঠেই জিজ্ঞেস করলো, কেন দোষ লাগা একটা মেয়েকে বিয়ে করলে তুমি? কেন?
আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম, শেষ “কেন” টা ঘরের চারপাশ থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে, আমার কানে ফিসফিস করে ভয় ধরানো সুরে বলছে, “কেন? কেন? কেন?” বিজ্ঞানের ক্লাসে পড়েছিলাম যে প্রতিধ্বনি হবার জন্য প্রতিফলক পৃষ্ঠ বেশ খানিকটা দূরে থাকতে হয়, কিন্তু বিষম ভয়ের রাতগুলোতে বুঝি পদার্থবিদ্যার সব সূত্রই বিফল হয়ে যায়।
আমি নূরুন্নাহারের কথার জবাব দিলাম না, মনে মনে তখন দোয়া পড়ছি। হে আল্লাহ! রক্ষা কর! আজই কি আমার মরণ লিখে রেখেছিলে?
নূরুন্নাহার আমার দিকে ঝুঁকে এলো। তার কপাল আমার কপালের সাথে ঠেকে যাবার অবস্থা। আমি পিছিয়ে যাচ্ছি, সে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আর একটু হলেই আমি বিছানা থেকে পড়ে যাবো।
আমার মুখের ওপর অত্যন্ত গরম নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে নূরুন্নাহার বলল, আমার দোষ আছে। কী সেই দোষ, কেউ তোমাকে বলেছে? বলে নি তো, না? হা হা হা। নিজেই তো দেখতে পাচ্ছ।
মুখ হাঁ করে হাসছে সে, আমি দেখতে না চাইলেও চোখ বন্ধ করতে পারছি না, আমার ঠিক নাকের ওপর ঘুরপাক খাচ্ছে ওর কুচকুচে কালো জিহ্বা। মানুষ বীভৎস কিছু দেখতে না চাইলেও সেটার প্রতি বুঝি কোন অজানা কারণে তীব্র আকর্ষণ বোধ করে, তাই চোখ ফিরিয়ে নিতে পারে না। আমি তাই এক মুহূর্তেই দেখে নিলাম ওর মুখগহ্বরের ভেতরটা। ঢোক গিললাম, ওর দাঁত মানুষের দাঁতের মতো নয়, মাংসাশী প্রাণীর মতো সূঁচালো। মনে মনে ভাবলাম, এ স্ত্রী, না রাক্ষুসী!
নূরুন্নাহার এক হাত বাড়িয়ে আমার গলা চেপে ধরল, আরেক হাতে কপাল ঠেসে ধরল বালিশের সাথে। জীবনের ভয় আমার সারা শরীর-মনকে গ্রাস করলো। আমি ধরে নিলাম, আমার শেষ সময় উপস্থিত, আর আমি বাঁচবো না।
নূরুন্নাহার, অথবা কোন বীভৎস প্রেত এবার কানের কাছে মুখ এনে প্রলম্বিত বিকট চিৎকার করে উঠলো। আমার মনে হল, হাজার হাজার অতৃপ্ত আত্মা একসাথে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে, আজ তাদের রোষানলে পৃথিবী কেঁপে উঠবে।
কাতর গলায় আমি ডাকতে লাগলাম, মা, মা!
*****
আমার ওপর ঝুঁকে আছে নূরুন্নাহার। উদ্বিগ্ন দুটো বড় বড় কালো চোখ। আমার কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করছে, কী হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন? কী দেখে ভয় পেয়েছ?
আমি ভালোমতো লক্ষ করলাম। না, ওকে দেখে মোটেই ভয়ের কিছু বলে মনে হচ্ছে না। সহজ স্বাভাবিক এক তরুণী। সে আমাকে মোটেই বালিশের সাথে ঠেসে ধরেনি, গলা চেপে ধরেনি। তাহলে কি এতক্ষণ কল্পনা করছিলাম?
আমি বলছিলাম, বাদ দাও, নাহার। সারাদিন অনেক খাটুনি গেছে, তাই হয়তো মাথা গরম হয়ে দুঃস্বপ্ন দেখছি। আমি লক্ষ করলাম, আমার পিঠ ঘামে ভিজে সপসপে।
ও। নাহার আর কিছু না বলে আবার শুয়ে পড়লো। ঘুমিয়ে পড়লো বোধহয় সাথে সাথেই।
আমি ওর কাছ থেকে দূরে, বিছানার একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লাম। অন্য দিকে ফিরে, যাতে ওর চেহারা আর না দেখতে হয়। বাসর রাতে স্ত্রীর সাথে অন্তরঙ্গ হবার জন্য তার দিকে সারারাত চেয়ে থাকার কথা, মধুময় বিনিদ্র রজনী যাপনের কথা, কিন্তু আমার ব্যাপার তো ভিন্ন।
মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। আমি খেয়াল করলাম, ভীষণ শীত লাগছে। বৃষ্টি হয়েছে বলেই হয়তো ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে, কিন্তু বরফ পড়ার মতো ঠাণ্ডা তো পড়ে নি, বড়জোর গুমোট গরমটা কিছুক্ষণের জন্য চলে যাবার কথা। আমি শরীরটাকে আরও ছোট করে ফেললাম, কুণ্ডলী পাকিয়ে। আমার পিঠে হু হু করে আঘাত হানছে শীতল বাতাস। জানালা খোলা, কিন্তু বাতাস সরাসরি আমার পিঠের ওপর এসে লাগার কথা নয়। আমি চাদরের নিচে দরদর করে ঘামছি, অথচ আমার ভীষণ শীত লাগছে। এই হিম শীতলতার জন্ম বোধহয় এই পৃথিবীতে নয়, অন্য কোথাও। আমার নিঃশ্বাসের সাথে বেরুচ্ছে সাদা ধোঁয়া, অন্ধকারে কী করে দেখতে পাচ্ছি তা জানি না। হারিকেনটা কি নিভে গেছে, নাকি এখনো জ্বলছে? নূরুন্নাহার শুয়ে আছে, ঠিক আমার পেছনেই, ওর নখরসহ হাতটা কি লম্বা হয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে? আঁচড় কাটছে? নইলে পিঠে কীসের স্পর্শ টের পাচ্ছি?
ঘরে, বিছানার চারপাশে কী ঘুরছে এসব? মানুষের ছায়ার আকৃতি নিচ্ছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বললাম, হে আল্লাহপাক, এই রাতটা পার করে দাও।
*****
শুনেছি, বাসর রাত হয় একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে সুখের রাত। বাসররাতে নাকি মানুষ জীবনসঙ্গী কিংবা সঙ্গিনীর সাথে সারারাত গল্প করে কাটায়, ঘুমোয় না, আগামী দিনের সুখস্বপ্ন রচনা করে। কিন্তু এই রাতটি ছিল আমার জন্য অতি ভয়ংকর একটি রাত। আমি ঘুমোতে পারলাম না, কাটা কাটা দুঃস্বপ্ন দেখলাম, দেখতে লাগলাম যে আমার নতুন বউ সূঁচালো দাঁতের ফাঁক থেকে কুৎসিত কালো জিহ্বা বের করে আমাকে দংশন করতে আসছে, ওর ঠোঁট বেয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে ইত্যাদি। পেছনে ফিরে যে ওর গতিবিধি দেখবো, সে সাহসও হল না। নিজেকে অনেক সাহসী মানুষ ভাবতাম, খানিকটা অহংকারও বুঝি আমার ছিল। কিন্তু এই একটি রাত আমাকে একেবারে ভীতু বানিয়ে দিলো।
রাতটা ছিল বড় দীর্ঘ। নবদম্পতি চায়, বাসর রাত যেন শেষ না হয়। আমি পৃথিবীর প্রথম মানুষ, যে মনে-প্রাণে কামনা করছিল এই বাসর রাতের সমাপ্তি। যখন ভোর হল, তখন আমার মনে প্রথম যে প্রশ্নটি জাগল সেটা হল, এই মেয়ের সাথে সারাজীবন কী করে কাটাবো।
আমি বিজ্ঞান জানা মানুষ, লেখাপড়া করা, ডিগ্রী নেয়া মানুষ। কিন্তু আমার মনে সেদিন থেকে নূরুন্নাহারের “দোষের” ভয়টা পাকাপাকিভাবে শেকড় গেড়ে বসে গেল। পরদিন রাতের বেলায় আবার এই মেয়ের সাথে শুতে আসতে হবে, ভেবেই আমার বুক শুকিয়ে গেল।
*****
আমাকে অবশ্য আর এই ভয়ের মধ্যে কাটাতে হয় নি। নূরুন্নাহারকে দেখে আর ভয় পাই নি আমি, কিংবা সে আমাকে আর কোন নিশুতি রাতে অন্য কোন অমানুষিক ভয়ংকর রূপ ধারণ করে ভয় দেখায় নি।
বিয়ের আট মাসের মাথায় নূরুন্নাহার মারা যায়। ব্রেইনে টিউমার হয়েছিল। প্রথম প্রথম মাথাব্যথা করতো, সেটাকে আমল দেয় নি বলে খুব দ্রুত ক্যান্সার হয়ে যায়। শেষের দিকের দিনগুলোতে সে অবর্ণনীয় কষ্ট পেয়েছে। আমার মনে হয়েছে, সে মরে গিয়ে ভালোই হয়েছে, নিজেও যন্ত্রণা পেত, সেই সাথে আমিও। কারো যন্ত্রণা চেয়ে চেয়ে দেখার মতো কষ্টকর বিষয় কমই আছে।
সে আমাকে শেষ যে কথাটি বলেছিল, তা হল, “বিশ্বাস কর, আমার কোন দোষ নেই। দোহাই লাগে, তুমি আমাকে ভয় কোরো না, ঘৃণা কোরো না।” বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো সে।
আমিও নিজেকে বিশ্বাস করিয়ে নিয়েছিলাম, নূরুন্নাহারের কোন দোষ ছিল না। আমি যা দেখেছি, ভুল দেখেছি।
ওর মৃত্যুর পর আমি আর বিয়ে করিনি, অন্তত এখন পর্যন্ত। অবশ্য আমার পিতামাতা আবার পাত্রী দেখছেন। তাঁরা বলেন, নূরুন্নাহারের মৃত্যু একটা দুঃখজনক ঘটনা, তা সত্যি। তাই বলে একটা যুবক ছেলে স্ত্রীর শোকে বিহ্বল হয়ে একা একা জীবন পার করে দেবে, এটা ঠিক নয়, কাজের কথা নয়। তার চেয়ে বিয়ে-থা করে সংসারী হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। দুয়েক জায়গায় মেয়ে দেখাও হয়েছে। এবার তাঁরা হয়তো “দোষ-লাগা নয়”, এমন কোন মেয়ে খুঁজে বের করতে পারবেন।
সেই বাসররাতের কথা আমার এখনো মনে পড়ে। একে বাসর বলা উচিৎ, নাকি বিভীষিকা বললেই ভাল হবে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। প্রথমত নিজের বাসররাতের কথা কেউ ভোলে না, তার ওপর সেই রাতটি ছিল একেবারেই “অন্যরকম।”
এখনো কিছু কিছু রাতে বিছানায় একাকী থেকেও আমার মনে হয়, নূরুন্নাহার আমার পাশে শুয়ে আছে, আর চারপাশটা অস্বাভাবিক রকম শীতল হয়ে আসছে। আমি তখন একই সাথে দরদর করে ঘামতে থাকি এবং শীতে কাঁপতে থাকি। নিজের বুকের শব্দ বহুগুণে জোরালো হয়ে কানে আঘাত করে। অপেক্ষা করি রাতের সমাপ্তির। চোখ বন্ধ করে কেটে যায় নির্ঘুম রাত।
………………………………………………..(সমাপ্ত)………………………………………………….