শিল্পী প্রমোদ রায়ের নাম অনেকের কাছে সুপরিচিত। আমি উদীয়মান চিত্রকর ও ভাস্কর প্রমোদ রায়েব কথা বলছি। ছবি আঁকায় এবং মূর্তি গড়ায় তায় সমান খ্যাতি।
সে বাস করত নিমচাঁদ মল্লিক স্ট্রীটের একখানা ভাড়া বাডিতে। স্ত্রী ছাড়া তার পবিবারে আর কোন লোক নেই। বাড়িখানা ছোট হলেও তার কোন অসুবিধা হতো না। নীচের তলায় তার কারু-কক্ষ বা স্টুডিও।
তার দিনগুলি কেটে যাচ্ছিল দিব্যি নির্ভাবনায়, কিন্তু হঠাৎ হলো এক মুস্কিল। বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মন এক নোটিশ এসে হাজির এ বাড়ি ছেড়ে তাকে উঠে যেতে হবে।
কলকাতায় তখন ভাড়াবাড়ির একান্ত অভাব। পাড়ায় পাড়ায় উদ্বাস্তুদের ভিড়। মোটা টাকা সেলামী এবং দ্বিগুণ চতুর্গুণ ভাড়া দিতে চাইলেও খালি বাড়ি পাওয়া ভার হয়ে উঠেছিল। অধিকাংশ বাড়িওয়ালাই পুরনো ভাড়াটিয়া উঠে গেলে খুশি হয়, নতুন ভাড়াটিয়া বসিয়ে বেশি লাভ কববার লোভে।
প্রমোদ বাড়িওয়ালার দাবি সহজে মানতে বাজি হ’ল না। বাডিওয়ালা নালিশ করল।
মামল হল এবং মামলায় হেরে গেল প্রমোদই। বাড়ি ছাড়বার জন্য সে সময় পেল মাত্র একমাস!
ইতিমধ্যে ঘটতে লাগল অদ্ভুত সব কাণ্ড। প্রমোদের ঠিক পাশের বাড়িতে থাকত নরহরি দাস। মফস্বলের লোক, কলকাতায় বাস করত ব্যবসাসূত্রে। মাঝখানে একটা পাঁচিল টপকালে তাদের বাড়ির ছাদ থেকে অনায়াসে প্রমোদদের বাড়ির ছাদের উপরে এসে পড়া যেত।
নরহরির চেহারাখানি ছিল আদর্শ গদীওয়ালার মত—মোটাসোটা বেঁটেসেটে, কালো দেহ, চাঁদের মত গোলাকার মুখমণ্ডল; সাজগোজ তথৈবচ। সে পরম বৈষ্ণব, মাথায় চৈতনচুটকি, কপালে ও নাসিকায় তিলকমাটির চিহ্ন এবং কণ্ঠদেশে তিনসার তুলসীর মালা। অথচ তার অত্যন্ত দহরম-মহরম ছিল মহাশক্তি ভৈবব ভট্টচার্যের সঙ্গে। ভৈরবের চেহারা ছিল লম্বায-চওড়ায় দশাসই, হাস্য ছিল অট্টহাস্যের মত এবং বাক্য ছিল হুঙ্কারের মত। তান্ত্রিক ক্রিয়া ছিল তার পেশা। মদ্য আব মাংসই ছিল তার প্রধান পানীয় ও খাদ্য।
কিন্তু চেহারায় ও চরিত্রে আকাশ-পাতাল তফাত থাকলেও ভৈরব ও নবহরি দুজনেরই নেশা ছিল এক এবং সেটা হচ্ছে দাবা খেলা।
রোজ সন্ধ্যাবেলায় নলহরি তাম্বুল চর্বণ করতে করতে এবং ভৈরব তামাকু টানতে টানতে দাবাবোড়ের ছকের সামনে বসে খেলায় বিভোর হয়ে থাকত। সে সময়ে তাদের দেখলে লোকে বলাবলি কবত, “এও যখন সম্ভবপর, তখন বাঘে আর গরুতে মিলনই বা অসম্ভব হবে কেন?”
কিন্তু এমন মিলনেও বাগড়া পড়ল। আচম্বিতে মেনিনজাইটিস রোগে নবহরি হল গতাসু এবং সে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে দেশে চলে গেল তার পরিবারবর্গ। ভেঙে গেল সেখানকার দাবাবোডেব সান্ধ্য আসর।
নবহবির মহাপ্রস্থানে ভৈরব ভট্টাচার্য দুঃখ পেল বটে, কিন্তু পরম আনন্দলাভ করল তার বাড়িওয়ালা ক্ষেত্র বা ক্ষেতু মল্লিক।
নরহরি ভাড়া দিত মাসিক পঞ্চাশ টাকা। ক্ষেতু মল্লিক এখন জো পেয়ে দাবি করে বসল এককালীন একহাজার টাকা সেলামী এবং মাসিক দেড়শ টাকা ভাড়া। দিনকাল যা পডেছে, তার দাবি নিশ্চয় অপূর্ণ থাকত না। এমন কি, হবু ভাডাটিয়ারা আনাগোনাও শুরু করে দিল।
কিন্তু সহসা সংঘটিত হ’ল এক রোমাঞ্চকর ও অভূতপূর্ব ঘটনা। এক পূর্ণিমার রাত্রে পথ দিয়ে চলতে চলতে নরহরিদেব পবিত্যক্ত, তালাবন্ধ, খলিবাড়ির বারান্দার দিকে তাকিয়ে বদন চাটুয্যে দেখল এক বিসদৃশ দৃশ্য।
বারান্দার একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মুখ সর্বাঙ্গ সাদা কাপড়ে ঢাকা এক সন্দেহজনক মূর্তি।
বদন চেঁচিয়ে বললে, “কে? কে ওখানে দাঁড়িয়ে?”
কোন সাড়া নেই।
বদনের সঙ্গে ছিল টর্চ, সে টপ করে টর্চের চাবি টিপে আলো জ্বেলে যা দেখল, তা সম্ভবপরও নয়, যুক্তিসঙ্গতও নয়।
সে মূর্তি হচ্ছে নরহরি দাসের।
তার পেটের পিলে চমকে গেলেও নিজের চোখের ভ্রম ভেবে বদন চাটুয্যে আরো ভালো কবরে দেখবার চেষ্টা করল। উহু, মোটেই চোখের ভ্রম নয় ও মুখ অবিকল নবহরি দাসের। ভয়ে সাদা হয়ে গেল বদনের বদন, ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে কাঁপতে “আঁ’ বলে পাড়াকাঁপানো চীৎকার করে সে ঘন্টায় বিশ মাইল বেগে দৌড় মারল নিজের বাডিবর দিকে।
বলা বাহুল্য, খবরটা পাড়ার ঘরে ঘরে রটে যেতে দেরি লাগল না।
ক্ষেতু মল্লিক তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বললে, “বদনা ব্যাটা ভাংচি দিতে চায়। নবহরি ছিলেন পরম বৈষ্ণব মানুষ, তিনি এখন গোলকধামে বসে মনের সুখে বিশ্রাম করছেন, কোন দুঃখে আবার এই ছাই পৃথিবীতে ফিবে আসবেন?”
কিন্তু নবহরি যে এখনো সশরীরে বিবাজ করছে তার ঐ ভাড়া-বাড়িতেই, পাড়ার আরো কেউ কেউ তার অকাট্য চাক্ষুষ প্রমাণ পেল। তবে দিনের বেলায় তাকে দেখা যায় না এবং দিনেব বেলায় তাকে দেখবার আশাও কেউ করে না।
ফল দাঁডাল এই, প্রথমতঃ নরহরির বাড়িব সুমুখ দিযে লোকে রাত্রে পথ-চলাই ছেড়ে দিল। দ্বিতীযতঃ, হবু-ভাডাটিয়া ক্ষেতু মল্লিককে একেবারেই বয়কট করল বিনা ভাড়াতেও নরহরিব বাড়িতে বাস করবার মত লোকও আর পাওযা যাবে বলে মনে হয় না।
অবস্থা যখন এইরকম, ঠিক সেই সময়ে তান্ত্রিক ভট্টাচার্য এসে বাসনা প্রকাশ করল, ”ক্ষেতুবাবু, নরহরিদের বাড়িখানা আমি ভাড়া নিতে চাই।”
নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে না পেরে ক্ষেতু মল্লিক বলল, “তাই নাকি?”
“ক্ষেতুবাবু! আমি হচ্ছি তন্ত্রসিদ্ধ মানুষ, বৈষ্ণবের প্রেতাত্মা আমাকে দেখলেই ভয়ে পিছটান দেবার পথ পাবে না।” ক্ষেতু মল্লিক তাড়াতাড়ি বলল, “ঠিক বলেছ ভট্টাচার্য’ তোমার সঙ্গে আমিও একমত।”
“কিন্তু আমি হচ্ছি গরীব, মাসে ত্রিশ টাকার বেশি ভাড়া দেবার শক্তি আমার নেই।”
“বেশ, তাই।”
নরহরির বাড়িতে এসে জাকিযে বসল ভৈরব ভট্টাচার্য। সত্য-সত্যই মনে মনে তার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, বৈষ্ণবের প্রেতাত্মা কিছুতেই শাক্তের নিকটবর্তী হবার সাহস প্রকাশ করতে পারবে না।
যখন প্রথম দুই রাত্রির মধ্যে নরহরির চৈতন্যচুটকি পর্যন্ত দেখা গেল না। ভৈরব তখন পাডার বাড়িতে গিয়ে তন্ত্রের অপূর্বমহিমা সম্বন্ধে জোরগলায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে লাগল।
তারপরই এল অমাবস্যার রাত্রি। দোতলার একটি ঘরে পূজার উপকরণ নিয়ে আসনাসীন হল ভৈরব ভট্টাচার্য। নরহরির ভয়ে পথ নির্জন, কোথাও টু শব্দটি পর্যন্ত শোনা যায় না। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত, ঘরের ভিতরে জ্বলছে একটা হ্যারিকেন লণ্ঠনের টিমটিমে আলো।
ভৈরব একমনে দুই চক্ষু বুজে মন্ত্র জপ করছিল।
আচমকা একটা বিকৃত, অনুনাসিক কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “ভৈঁরঁব, এঁকচাঁল দাঁবা খেঁলবেঁ ভাঁয়াঁ?”
ভয়ঙ্কর চমকে গিয়ে ভৈরব চোখ খুলেই দেখে, ঘরের দরজার কাছে পা থেকে গলা পর্যন্ত ধবধবে সাদা কাপড়ে মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বয়ং নরহরি ছাড়া আর কেউ নয়। ভৈরবই সব চেয়ে বেশী চিনত নরহরিকে, তার চোখের ভ্রম হবার জো নেই।
তারপর আর কিছু নয়, বিরাট এক আর্তনাদ এবং ভৈরবের ভূমিতলে পতন ও মূৰ্চ্ছা।
ক্ষেতু মল্লিক হতাশ ভাবে স্থির করল, ঐ ভুতুড়ে বাড়িখানা ভেঙে ফেলে একেবারে নতুন বাড়ি তৈবি করবে।
কিন্তু হঠাৎ যখন শিল্পী প্রমোদ রায় এসে নরহরির বাড়িখানা ভাড়া নিতে চাইলে, তখন ক্ষেতু মল্লিকের চেয়ে বিস্মিত লোক পৃথিবীতে আর কেউ ছিল না বোধ হয়।
প্রমোদ বলল, “কলকাতায় খালি বাড়ি দুর্লভ, অথচ বাড়িওয়ালার হুকুমে আর এক হস্তার মধ্যেই আমাকে উঠে যেতে হবে। সুতরাং আমার অবস্থা বুঝতেই পারছেন তো?”
ক্ষেতু মল্লিক বলল, “বেশ বাবা, আমি বেশি ভাড়াও চাই না, তুমি মাসে পঁচিশটি টাকা দিও।”
“তাহলে এই পচিশ টাকা অগ্রিম নিয়ে তিন বছরের কড়ারে আমাকে চুক্তিপত্র লিখে দিন।”
“আচ্ছা।”
পাশের বাড়িতে উঠে যাবার জন্যে প্রমোদ নিজের ষ্টুডিয়ো’র ছবি ও প্রতিমূর্তিগুলোকে স্থানান্তরিত করবার ব্যবস্থা করেছে, এমন সময়ে তার স্ত্রী নমিতা এসে ভয়ে ভয়ে বললে, “ওগো নরহরিবাবুর বাড়িতে গিয়ে আমি থাকতে পারব না।”
“কেন ?”
“কেন তা কি তুমি জানো না?”
প্রমোদ হাসিমুখে নমিতার হাত ধ’রে ঘরের এককোণে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর একখানা সাদা চাদর একধারে সরিয়ে নিতেই দেখা গেল, একটা খড়ের কাঠামোর উপরে বসানো রয়েছে নরহরির রং-করা মাটি দিয়ে গড়া মুখমণ্ডল।
নমিতা হতভম্ব।
প্রমোদ বলল, “আমি হচ্ছি ভাস্কর, নরহরির মুখ আমি অনায়াসেই গড়তে পেরেছি। পাঁচিল টপকে পাশের বাড়িতে যাওয়াও আমার পক্ষে কঠিন হয় নি। আমাকে সাহায্য করেছে আবছা রাত মানুষের স্বাভাবিক ভয় আর কুসংস্কার।”
………………………………………….(সমাপ্ত)……………………………………….