বোলপুর শহর। ভবানী প্রেস। দুপুর দুটো নাগাদ। শ্রীনিকেতন রোডের ওপর ভবানী প্রেসের লম্বা একতলা ঘরখানায় খটখট করে ছাপাখানার কাজ চলছে। ঘরের একদিকে চেয়ারে বসে নিজের লেখার প্রুফ দেখছিল দীপক।
ঘরের এক কোণে কাঠের পার্টিশান ঘেরা একখানা ছোট্ট কামরা। তার দরজায় লেখা— সম্পাদকঃ বঙ্গবার্তা।
দুজন ভদ্রলোক এসে প্রেসের দরজার সামনে দাঁড়াল। দুজনেই ফুলপ্যান্ট শার্ট পরা। ফিটফট। একজন বেশ লম্বা-চওড়া। ময়লা রং।
দ্বিতীয় জনের রং ফর্সা। মাঝারি হাইট। ঢেউ খেলানো চুল। কাটা কাটা মুখে হাসি হাসি ভাব। দুজনেরই কাঁধে ঝুলছে একটা করে কিটব্যাগ। দশাসই লোকটির কাঁধে আবার একটা ক্যামেরা। দীপক তাদের এক নজরে দেখে বুঝল যে এরা বোলপুরের বাসিন্দা নয়। দুজনেই দীপকের বয়সি বা সামান্য বড় হতে পারে। এই বছর ত্রিশ হবে।
লোক দুটি ইতি-উতি চায়। লম্বাজন প্রেসের পিয়ন হারুকে জিগ্যেস করে, ‘আচ্ছা, এটা তো ভবানী প্রেস?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ’, জানায় হারু।
‘এখানেই তো সাপ্তাহিক বঙ্গবার্তা কাগজের অফিস?’
‘হ্যাঁ।’ হারু ঘাড় নাড়ে।
‘আচ্ছা কুঞ্জবিহারীবাবু আছেন?’
‘আছেন।’ হারু জানায়।
ফর্সা লোকটি বলে, ‘আমরা একবার দেখা করতে চাই। দরকার আছে।’
হারু ঢুকে যায় পার্টিশান ঘেরা কামরায়। ভবানী প্রেসের মালিক এবং বঙ্গবার্তা কাগজের সম্পাদক শ্ৰীকুঞ্জবিহারী মাইতির অফিস ঘর। একটু বাদে বেরিয়ে এসে হারু ডাকল, আসুন।
লোক দুটি ঢুকে যায় সুইংডোর ঠেলে কুঞ্জবাবুর কামরায়।
দীপক আড়চোখে লক্ষ করছিল লোক দুটিকে। কাস্টমার? প্রেসে ছাপানোর কাজে এসেছে নাকি? না, বঙ্গবার্তায় কোনো খবর ছাপাতে?
কুঞ্জবাবুর হেঁড়ে গড়া শোনা যাচ্ছে। তবে সব কথা বোঝা যাচ্ছে না। টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসে, নমস্কার। নমস্কার.ও আচ্ছা আচ্ছা…ও বেশ বেশ..হ্যাঁ, তারপর কি কচ্চে?.ওঃ অনেকদিন হল ….’
আগন্তুক দুজনের কথা কিন্তু কিছুই ধরা যায় না। তারা বেশ নিচু সুরে কথা বলে।
‘অ্যাঁ, ভেরি ভেরি ইন্টারেস্টিং। বলেন কি..হ্যাঁ হ্যাঁ শুনি’…বলতে বলতে কুঞ্জবিহারীর গমগমে গলা হঠাৎ খাদে নেমে যায়। দু’পক্ষে কিসব কথা চলে। মাঝে মাঝে কুঞ্জবাবুর গলা চড়লেও গোটা বাক্য বোঝা যায় না। প্রথমে কৌতুহলী হলেও পরে দীপক নিজের কাজে মন দেয়।
দু’কাপ চা গেল সম্পাদকের কামরায়। মিনিট দশেক বাদে দীপকের চটক ভাঙে কুঞ্জবাবুর হুংকারে, দীপক, দীপক, শুনে যাও। দীপক কাগজপত্র টেবিলে রেখে উঠে পড়ে। সম্পাদকের কামরায় ঢোকে।
কুঞ্জবিহারী মাইতি মাঝবয়সি, গাটাগোট্টা, মাঝারি লম্বা শ্যামবর্ণ পুরুষ। ভারিক্কি মুখে আশু মুখুজ্যে প্যাটার্নের পুরুষ্টু ঝোলা গোঁফ। মোটা ভুরু। পরনে যথারীতি ধুতি ও শার্ট। গোল গোল চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে। মনে হয় কোনও কারণে উত্তেজিত। তিনি বলে উঠলেন, ‘বস দীপক। আলাপ করিয়ে দিই। ভেরি ভেরি ইন্টারেস্টিং পার্টি।
সম্পাদকের টেবিলের সামনে বসেছিল সেই দুই ভদ্রলোক। দীপক পাশের দিকে একটা চেয়ারে বসে।
কুঞ্জবাবু লম্বা-চওড়া লোকটিকে দেখিয়ে বললেন, ‘ইনি হচ্ছেন শ্ৰীগোলকপতি দাস’ এবং ফর্সাজনকে দেখিয়ে বললেন, ‘এর নাম শ্রীঅলোকনাথ দত্ত। কলকাতা থেকে আসছেন। আর এ হচ্ছে দীপক রায়। বঙ্গবার্তার একজন রিপোর্টার। গ্রাজুয়েট। এই লাইনে ভেরি প্রমিসিং ইয়ংম্যান।
দীপক জোড়হাত করে নমস্কার জানায়। আগন্তুকরাও প্রতি-নমস্কার করে। কুঞ্জবিহারী বললেন, ‘এই অলোক দত্তর কাকা বন্ধু আমার বিশেষ পরিচিত। বন্ধুর কাছে আমার নাম-ঠিকানা জেনে এখানে এসেছেন। একটা দরকারে আমার হেল্প চান। ভেরি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। এদের একটা অদ্ভুত শখ আছে।
কুঞ্জবাবু হঠাৎ কথা থামিয়ে, গোঁফ ভুরু নাচিয়ে, চোখ ছোট করে, গলার স্বর নামিয়ে রহস্যময় হেসে বললেন, কি শখ জান? এদের শখ হচ্ছে ভূত খোঁজা।’
দীপক চমকে তাকায় দুই আগন্তুকের পানে। তারা মিটিমিটি হাসে।
কুঞ্জবাবু বলে চলেন, ‘হ্যাঁ শখটা অদ্ভুত। কি বল? সেই উদ্দেশেই আগমন। ভেদিয়ায় এক গ্রামে একটা পোড়োবাড়ির সন্ধান পেয়েছেন, সেটায় নাকি ভূত আছে। তাই পরখ করতে এসেছেন।
‘গ্রামটার ডিরেকশন নিয়ে এসেছেন। কিন্তু ভেদিয়া তো যাননি আগে। তাই আমার কাছে এসেছেন ভালো করে বুঝে নিতে। কি নাম জানি বললেন গ্রামটার?
‘নন্দনপুর।’ উত্তর যোগায় গোলকপতি।
‘হুঁ, নন্দনপুর। চেন গ্রামটা? তোমার তো প্রচুর জায়গায় ঘোরাঘুরি।’
‘নন্দনপুর?’ খানিক ভাবে দীপক। তারপর বলে, ‘হুঁ, ওই নামে একটা গ্রাম আছে বটে ভেদিয়ায়। অজয় নদের ধারে। স্টেশন থেকে মাইল চারেক দূরে।’
‘রাইট, নদীর ধারে। অজয় নদের ধারে। তাই বলেছে।’
গোলকপতি সায় দেয়, ওখানে নাকি একটা মস্ত বাড়ি আছে। রায়বাড়ি। পরিত্যক্ত। ফাঁকা পড়ে আছে বহুকাল। ওই অঞ্চলের জমিদারদের বাড়ি ছিল ওটা। বাড়িটা নাকি হস্টেড। ভূতুড়ে।
আমি নন্দনপুর গেছি একবার, দীপক জানায়, রায়বাড়ি দেখেছি দূর থেকে। বাড়িটা বিরাট। পোড়োবাড়ি মনে হয়েছিল। তবে ভূত আছে কিনা জানি না। মানে এ নিয়ে জিগ্যেস করিনি কাউকে। তা আপনারা জানলেন কি করে?’
কুঞ্জবিহারী আগন্তুকদের উৎসাহ দিলেন, ‘বলুন বলুন। দীপককে সব খুলে বসুন। ওর এ ব্যাপারে খুব এক্সপিরিয়েন্স।’ তিনি চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দেন। মুখে স্মিত হাসি।
সম্পাদকের কথাটা খচ্ করে কানে বাজল দীপকের। ওঁর রকম-সকম সুবিধের ঠেকল না। কুঞ্জবিহারী খটখটে মানুষ। এত বিগলিত ভাব দেখাবার কারণ? যা হোক সে অলোকনাথের কথায় মন দেয়—
‘আমাদের পাড়ার গগনেন্দ্র রায়ের কাছ থেকে এই বাড়িটার সন্ধান পেয়েছি। গগন রায়ের পূর্বপুরুষের ভিটে ওই বাড়ি। বহুকাল ফাঁকা পড়ে আছে। কেউ থাকে না। প্রায় পঁচাত্তর বছর।
দীপক ভুরু কুঁচকে বলে, ‘একটা প্রশ্ন করব?’
‘বিলক্ষণ, বিলক্ষণ। করবেন বৈকি, বলল আলোকনাথ।’
‘আপনাদের এই অদ্ভূত শখের কারণ? মানে ভূতের সন্ধান। এইরকম ভূত-প্রেতচর্চার ক্লাব আছে শুনেছি। আপনারা কি সেরকম কোনও ক্লাবের?’
‘আরে না না’, অলোক দত্ত বাধা দেয়, আমরা কোনও ভূত-প্ৰেত অনুসন্ধানী ক্লাবের মেম্বার নই! এটা স্রেফ আমাদের দুজনের শখ। দুজনে একই অফিসে চাকরি করি। অনেক দিনের ফ্রেন্ড। হঠাৎই শখটা গজাল।
‘হঠাৎ এই অদ্ভুত শখ!’ বিড়বিড় করে দীপক।
‘সে মশাই এক হিস্ট্রি’, অলোক দত্ত হাত-মুখ নেড়ে বলে, ‘একদিন অফিসে তক্ক হচ্ছিল টিফিনে— ভূত আছে কি নেই? বেশিরভাগই বলল যে আছে। কয়েকজন বলল, তাদের পরিচিত কেউ কেউ ভূত দেখেছে নিজের চোখে।
আমি আর গোলক বললাম—ভূত নেই। বিশ্বাস করি না ভূতে। তক্কাতক্কি হতে হতে বেট রাখা হল। আরও দু-একজন অবিশ্যি আমাদের সাপোর্ট করেছিল।
‘ভূতে বিশ্বাসীদের একজন বলল, যে দমদমে নাকি একটা মস্ত পোড়োবাড়ি আছে। বহু পুরোনো। লর্ড ক্লাইভের আমলের। বাড়িটায় রাতে কেউ থাকতে চায় না। কারণ নাকি সাহেব ভূতরা সেখানে পায়চারি করে রাতে। আমাদের ওই বাড়িতে রাত কাটাতে চ্যালেঞ্জ জানাল। আমরা অ্যাকসেপ্ট করলাম।
‘গেলাম সেই বাড়িতে। তবে আমি এবং গোলক ছাড়া ভূতে অবিশ্বাসীরা আর কেউ যায়নি শেষ অবধি। যা হোক থাকলাম সেখানে রাতে। নির্বিঘ্নেই কাটালাম। কিন্তু ভূতের দর্শন মিলল না।
‘সেই মশাই শুরু। বেশ নেশা ধরে গেল। ভূতুড়েবাড়ির খোঁজ পেলেই সেখানে গিয়ে রাত কাটাই। ভেদিয়ারটা হবে আমাদের আট নম্বর কেস।’
‘কিছু দেখেননি?’ প্রশ্নটা করেন কুঞ্জবিহারী।
‘‘নাঃ।’ মাথা নাড়ে অলোক দত্ত, ‘তবে ট্রাই করে যাচ্ছি।’
গোলকপতি বলে ওঠে, ‘দেখিনি বটে, তবে বলতে পারেন কিছু শুনেছি।’
‘কি রকম?’ কুঞ্জবিহারী খাড়া হয়ে বসেন।
এই অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু আওয়াজ। ওগুলো সত্যি সত্যি ভৌতিক আওয়াজ কিনা প্রমাণ হয়নি। অলোকনাথ দাবড়ে দেয় গোলকপতিকে।
‘তা বটে, তা বটে।’ মিনমিন করে গোলকপতি।
‘নন্দনপুরে রায়বাড়ি এদ্দিন ধরে খালি পড়ে আছে কেন?’ দীপক কৌতুহলী।
‘সে এক হিস্ট্রি মশাই’, জানায় অলোকনাথ, ওই গগন রায়ের কাছে শোনা।
‘প্রায় পঁচাত্তর বছর আগে রায়বাড়ি ছিল জমজমাট। একবার অন্নপ্রাশন হয় ওই বাড়ির একটি মেয়ের। বড় রায়কর্তার প্রথম নাতনি। খুব ধুমধাম হচ্ছে। অনেক লোকজন এসেছে বাড়িতে। সন্ধের সময় হঠাৎ কলেরা শুরু হল বাড়িতে। দু’দিনেই ওই বাড়িতে দশ-বারোজন মারা যায় ওলাউঠায়। ওই বংশের ছয়-সাতজন আর কাজের লোক মানে এই ঝি-চাকর-দারোয়ান জনা চার-পাঁচ। যার অন্নপ্রাশন সেই ছোট্ট মেয়েটিরও মৃত্যু হয়। আর মারা যান বড়কর্তা স্বয়ং। উৎসব বাড়িতে হাহাকার উঠল। গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছিল রোগ। মারা যায় কিছু গ্রামের অন্য লোক। বেশিরভাগ লোকই গ্রাম ছেড়ে পালায়। জানেন তো তখন এই মারাত্মক রোগের তেমন কোনও চিকিৎসাই ছিল না।
যা হোক এই দুর্ঘটনার কিছুদিন বাদে গ্রামের লোক আবার ফিরে আসে নিজের নিজের ভিটেয়। কিন্তু শোকার্ত রায়রা মাসখানেকের মধ্যে চিরকালের মতো ওই বাড়ি ত্যাগ করে। ওই বংশের কেউ আর কখনো ওই বাড়িতে রাত কাটায়নি। বাড়ির দামি দামি জিনিস যতটা পারে সঙ্গে নিয়ে যায়। কিছু বিক্রি করে। জমিদারির বেশির ভাগটাই বেচে দেয়।
একজন কেয়ারটেকার রেখেছিল। কিন্তু সেও নাকি রাতে থাকত না বাড়ির ভিতর। শেষে ও বাড়ি দেখাশুনা করারও কেউ রইল না। বাড়িটা নাকি একদম ভূতুড়ে হয়ে গেছে। হানাবাড়ি।
‘গগন রায় নিজে কখনো যায়নি নন্দনপুর। সে কলকাতাতেই জন্মেছে, বড় হয়েছে। এসব তার বাবার কাছে শোনা।’
‘ওখানে ভূতুড়ে কাণ্ড কি হয়?’ জানতে চান কুঞ্জবাবু।
অলোকনাথ বলল, ‘তা খুব বলতে পারেনি গগন। কি সব নাকি অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ হয়। কি সব নাকি দেখা যায়। আসলে এ নিয়ে ওর বাবা বিশেষ কিছু বলতে চাইতেন না।’
দীপক বলল, ‘বাঃ এত কথা তো জানতাম না। তাহলে সেদিন বাড়িটা একবার ঘুরে দেখে নিতাম।’
কুঞ্জবিহারী বললেন, ‘দীপক, এনাদের নন্দনপুরে
কিভাবে যেতে হয় বুঝিয়ে দাও ভালো করে। আর—আর—আমার একটা আইডিয়া এসেছে। যদি তুমিও ওদের সঙ্গে যাও মন্দ হয় না। রাতে থেকে যাবে একসঙ্গে। মানে রিপোর্টার হিসেবে। তোমাদের এক্সপিরিয়েন্স নিয়ে দারুণ একখানা স্টোরি হবে বঙ্গবার্তায়। হেডিং দেব—ভূতুড়ে বাড়িতে ভূতের খোঁজে। কি আপনাদের কোনও আপত্তি আছে, কাগজের কেউ গেলে?’
অলোকনাথ বলল, ‘না না, আপত্তির কি? ভালোই তো। দলে একজন বাড়বে।’
কুঞ্জবিহারীর এই প্যাচটাই আশঙ্কা করেছিল দীপক। তাকে এদের সঙ্গে ভিড়িয়ে দেবার মতলব। সে গুম মেরে যায়। কথা বলে না।
কুঞ্জবিহারী দীপকের রকম দেখে বললেন, ‘অবশ্য তোমার যদি কোনও ইয়ে থাকে, জোর করব না। দেখি আমিই না হয় যাব তাহলে।’
দীপকের মাথায় চড়াৎ করে রক্ত উঠে গেল। সদ্য পরিচিত লোকগুলির সামনে এমন ডাউন দেওয়া? ওই ইয়ের মানেটা যে কি—যে কেউ ধরতে পারবে। অর্থাৎ সম্পাদক বলতে চান যে দীপক সঙ্গে না গেলে বুঝতে হবে যে সে ভয় পাচ্ছে। ভূতের ভয়। তাই যেতে চাইছে না।
দীপক গম্ভীরভাবে জিগ্যেস করল অলোকনাথকে, ‘আপনারা কবে নন্দনপুর যেতে চান?’
‘আসছে কাল। আজ শুক্রবার। শনি-রবি ছুটি আছে অফিসে। কাল রায়বাড়িতে রাত কাটিয়ে, রবিবার কলকাতা ফিরব।’
‘ঠিক আছে, আমি যাব আপনাদের সঙ্গে।’ নেহাৎ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে জানায় দীপক।
কুঞ্জবাবু অমনি দীপকের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, ‘সাব্বাস! আমি জানতাম যে তুমি এমন চান্স ছাড়বে না। যাক, এদের সঙ্গে প্রোগ্রামটা ঠিক করে নাও। হ্যাঁ, আপনারা আজ কোথায় থাকছেন?’
আলোকনাথ বলল, ‘আমরা কোনও হোটেলে থাকব।’
কুঞ্জবাবু বললেন, ‘অলরাইট। দীপক ওঁদের বোলপুর নিবাসে নিয়ে যাও। আমার নাম করে ভালো ঘর দিতে বল।’
শনিবার। সকাল ন’টা নাগাদ ভেদিয়া স্টেশনে নামল তিনজন—দীপক, আলোকনাথ এবং গোলকপতি।
স্টেশন থেকে নন্দনপুর যেতে দুটো সাইকেল রিকশা ভাড়া করা হল। একটায় গোলকপতি। অন্যটায় আলোকনাথ ও দীপক।
আঁকাবঁকা মেঠো পথ ধরে যেতে যেতে রিকশাওলা জিগ্যেস করল দীপকদের, নন্দনপুরে কার কাছে যাবেন?’
‘শচীন কর্মকার’, জবাব দেয় অলোকনাথ।
নন্দনপুরে শচীন কর্মকারের নামে একটা চিঠি দিয়েছে গগন রায়। কলকাতায় একটা কাজে এসে গগনদের বাড়িতে এসেছিলেন শচীনবাবু। তখন সামান্য আলাপ হয় গগনের সঙ্গে।
‘শচীনদার কুটুম বুঝি?’ রিকশাওলার কৌতুহল।
‘না না, চেনা লোক। আসতে বলেছিলেন একটা কাজে।’ সামাল দেয় দীপক।
গ্রামের বাইরে থেকেই দীপকরা ভাড়া মিটিয়ে বিদায় দেয় রিকশা। তারপর হেঁটে গায়ে ঢোকে।
একটা বাচ্চা ছেলেকে জিগ্যেস করতেই একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে চলল শচীন কর্মকারের বাড়ি। দেখতে দেখতে পথে কচিকাঁচার দল জুটে যায় শহুরে বাবুদের পিছু পিছু।
শচীন কর্মকারের বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। ছোটখাটাে নিরীহদর্শন মানুষ। গগন রায়ের চিঠি পড়ে এবং পরিচয় পেয়ে খাতির করে বসালেন। চা-মুড়ি খাওয়ালেন।
গগনের চিঠিতে অলোকনাথ এবং গোলকপতির নন্দনপুরে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য লেখা ছিল না। অলোকনাথের মুখে তাদের আগমনের কারণটা জেনে বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন শচীনবাবু। ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, ‘এসব নিয়ে খোঁচাখুঁচি করা, তেনাদের ত্যক্ত করা কি উচিত হবে?’
অলোকনাথ তাড়াতাড়ি বোঝায়, ‘না না, আমরা কাউকে বিরক্ত করতে চাই না। আমরা যুক্তিবাদী। ভূত-প্রেত মানে তেনারা সত্যি সত্যি আছেন কিনা তার প্রমাণ খুঁজছি। দুঃখের বিষয় এ পর্যন্ত কিছু পাইনি। তাই এসেছি—’
‘প্রমাণ?’ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে জানান শচীন্দ্রনাথ, ‘এসব প্রমাণ কি সহজে মেলে? ভাগ্য চাই। আর এসব প্রমাণ সহ্য করার মতন মনের বলও থাকে না সবার।’
এবার গোলকপতি মোটা গলায় মন্তব্য ছাড়ে, ‘দেখুন, মনের জোর আমাদের নেহাৎ কম নয়। সত্যি তেমন প্রমাণ মিললে ভিরমি খাব না, একটু ভরসা রাখতে পারেন।’
কর্মকারমশাই পিটপিট করে গোলকপতির দশাসই চেহারাখানায় চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘তা বেশ। আমার যা বলার বললাম।’
দীপক এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। এবার বলে, ‘রায়বাড়িতে কি হয়? মানে কিছু দেখা-টেখা যায় কি? কেন লোকে থাকে না রাতে?’
কর্মকারমশাই বললেন, ‘বুড়ো কত্তার খড়মের আওয়াজ শুনেছে অনেকে। ওই বাড়ির ভিতর হেঁটে বেড়াচ্ছেন রাত্তিরে—খট্খট্ করে। রাতে ওই বাড়ির ছাদের কিনারে ছায়ামূর্তি দেখেছে কেউ কেউ। শোনা গেছে কান্নার আওয়াজ। যেন বাচ্চা কাঁদছে। আমি অবশ্য নিজে কিছু দেখিনি বা শুনিনি। আসলে ও বাড়ির ধারে-কাছে ঘেঁষি না সন্ধের পর। কি দরকার মশাই, অনাবশ্যক কৌতুহল মেটাতে গিয়ে কি বিপদে পড়ব?’
দীপক অলোকনাথ ও গোলকপতিকে বলল,‘ চলুন না, বাড়িটা একবার ঘুরে দেখে আসি।’
‘অফকোর্স।’ অলোকনাথরা উঠে পড়ে। শচীনবাবু পথ দেখিয়ে চলেন।
একপাল বাচ্চা ছেলে-মেয়ে পিছু নিল তাদের। গ্রামের অন্য বাড়ি থেকে বয়স্ক লোকেরাও উঁকিঝুঁকি মারে।
রায়বাড়ি নন্দনপুর গ্রামের অন্য বাড়িগুলির সীমানা থেকে বেশ খানিক তফাতে। একদম ফাঁকায়। বাড়িটা ঘিরে ছোট-বড় অনেক গাছ। ঝোপঝাড়। দূর থেকেই নজর পড়ে বাড়িটা।
রায়বাড়ি থেকে অজয় নদের কুল মাত্র শ’দুই গজ। আগে নাকি অজয় নদ ঢের দূরে ছিল।
জমিদার বাড়িই বটে। মস্ত বড়। দোতলা। দো মহলা। অট্টালিকা ঘিরে বিরাট এলাকা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিল অবশ্য বহু জায়গায় এখন ভাঙা। পাঁচিলের গা ঘেঁষে অনেকগুলো ঘর সারি সারি। ঘরগুলো কোনওটাই আস্ত নেই। ওগুলো ছিল কাছারিবাড়ি, অতিথিশালা, নাটমন্দির ইত্যাদি।
একটা প্রকাণ্ড জাম গাছ বাড়িটার প্রায় ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তার ডালপালা ঝুঁকে পড়েছে অট্টালিকার ছাদে। পলস্তরা খসে ইট বেরিয়ে পড়েছে প্রায় গোটা বাড়ির দেয়ালে। কয়েকটা অশখ গাছ জন্মেছে বাড়িটার গায়ে। অট্টালিকার পেছন দিকে একটা মজা পুকুর। একটা কুয়োও রয়েছে। তবে কুয়োর জল ঘোলাটে নোংরা।
কবাটহীন প্রকাণ্ড সদর দরজার হাঁ-এর ভিতরে ঢোকে চারজন। পিছু নেওয়া বাচ্চার দল কিন্তু বাড়ির ভিতরে ঢোকে না। বোধহয় সঙ্কোচে।
ঢুকেই চৌকো বাঁধানো মস্ত উঠোন। উঠোন অনেক জায়গাতেই খোবলানো। ইট-মাটি বেরিয়ে পড়েছে। উইয়ের ঢিবি উঠেছে। উঠোন ঘিরে উঁচু বারান্দা তিন দিকে। বারান্দা পেরিয়ে পরপর ঘর। দোতলাতেও একই রকম চওড়া বারান্দা আর ঘরের সারি। মোটা মোটা গোল গোল থাম দোতলার বারান্দার ভার কাঁধে নিয়ে আজও সটান খাড়া। দুই কোণ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়।
বাড়িটা যে অভিশপ্ত ঢুকেই যেন টের পাওয়া যায়। কেমন গা-ছমছম করে এই বিশাল নির্জন অট্টালিকার অন্দরে প্রবেশ করেই।
একতলার বারান্দা ধরে ওরা হাঁটতে লাগল। এই জনমানবহীন অট্টালিকার বাসিন্দা এখন অজস্র পায়রা, শালিক আর চামচিকে। আরও নিশ্চয় থাকে কিছু সরীসৃপ, কীটপতঙ্গ। তাদের সহজে চোখে পড়ে না।
সহসা জুতোর শব্দে বিরক্ত ভীতচকিত কিছু পায়রা, শালিক উড়তে লাগল ঘুলঘুলি আর কড়িবরগার আশ্রয় থেকে বেরিয়ে। সাঁ সাঁ করে এলোমেলো পাক খায় শূন্যে কয়েকটা চামচিকে। একতলার বেশিরভাগ ঘরের দরজা-জানলায় কবাট নেই। কোথাও কোথাও মাত্র কাঠের ফ্রেমের কিছু অংশ অবশিষ্ট রয়েছে। কোনও দরজা-জানলায় ভাঙা পাল্লার খানিক অংশ কোনও মতে ঝুলে আছে। নোংরা মেঝে। ছাদ ঝুলে ভর্তি। তবে থামের গায়ে, বারান্দার কার্নিশে, দেয়ালে কিছু অপূর্ব কারুকার্য এই অট্টালিকার অতীত সৌন্দর্যের সাক্ষ্য দিচ্ছে।
শচীন কর্মকার জানালেন, ‘এ বাড়ি যে কবে তৈরি হয়েছে গাঁয়ে কেউ আজ বলতে পারে না সঠিক। তবে সোয়া-শ বছরের পুরোনো তো বটেই।’
ঠিক সদর দরজার মুখ পেরিয়ে বায়ে দেখা গেল একটা মস্ত হলঘর। কর্মকারমশাই জানালেন যে, এটা নাকি ছিল বৈঠকখানা। গান-বাজনার আসরও বসত ওই ঘরে।
ঘরখানায় তখনো রয়েছে, প্রাচীন আমলের কয়েকটা বড় বড় চেয়ার। একটা গোল কাঠের টেবিল। দেয়ালে ঝুলছে একটা বড় ভাঙা আয়না এবং একটি মস্ত হাতে আঁকা ছবি। অয়েল পেন্টিং। রায়বংশের কারও প্রতিকৃতি। ছবির ওপর ধুলো-ময়লা জমেছে। বোঝা যায় এক রাশভারী মধ্যবয়স্ক পুরুষের বুক অবধি চেহারা।
কর্মকার বললেন, ‘শুনেছি ওটা বড়কর্তার ছবি। ওলাউঠায় মারা গেছলেন সেইবার।’
হলঘর থেকে বেরিয়ে গোলকপতি দেখাল, ‘ওরে ব্বাপ ওই দেখুন।’
সকলে দেখল, চত্বরের এক কোণে লম্বা একটা সাপের খোলস।
শচীনবাবু বললেন, ‘হুঁ পোড়োবাড়ি! খরিস সাপ বাসা বেঁধেছে। শুধু কি তেনাদের ভয়? এনাদের ভয়ও কম নয়। সাবধানে থাকবেন।’
দোতলায় ওঠা হল। বারান্দায় লোহার জাফরি লাগানো ঘের। কোমর সমান উঁচু জাফরিতে মরচে পড়েছে। নড়বড়ে। তবে নকশা চমৎকার।
দোতলার ঘরগুলোয় উকি মারে দীপকরা। নীচের তলার মতোই অবস্থা।
সিঁড়ি উঠে গেছে ছাদে। শচীনবাবু বারণ করলেন, উপরে যেতে। ভাঙা সিঁড়ি। তা বটে। দোতলার ছাদেও বড় বড় ফাটল ধরেছে। নেহাতই খুব পুরু দেয়াল, মজবুত করে বানানো বাড়ি, তাই এতকাল খাড়া রয়েছে, এত অবহেলা সত্ত্বেও।
সবাই নীচে নেমে এল।
‘এ বাড়িতে লোক ঢোকে’, দীপক মন্তব্য করে, ‘ওই দেখুন পোড়া বিড়ির টুকরো উঠোনে।
‘হুঁ’, শচীনবাবু জানান, দিনের বেলা বাগাল ছেলেগুলো ঢোকে হয়তো। কিন্তু রাতে?’ তিনি মাথা নাড়েন।
বাড়িটা দেখতে দেখতে দীপকের মনে একটা সন্দেহ জাগে। রাতে চোর-ডাকাত লুকিয়ে থাকার পক্ষে আদর্শ জায়গা। সে জিগ্যেস করে, ‘আপনাদের এদিকে চুরি-ডাকাতি কেমন হয়?’
‘তা হয় বৈকি’, জানান শচীনবাবু, চুরি-ডাকাতি আজকাল কোথায় না হয়। তবে আমাদের গায়ে ডাকাতি হয়নি বহুকাল। ছিচকে চুরি হয় মাঝে-মধ্যে। গাঁয়ে তেমন বড়লোক কে? সোনা-দানা কি আর মিলবে?’
একটা সরু প্যাসেজ দিয়ে দ্বিতীয় মহলে যাবার রাস্তা। সেদিকে একবার উকি দিল দীপকরা। বাড়ির ওই অংশের অবস্থা আরও খারাপ। আরও জরাজীর্ণ। আরও নোংরা।
দীপকরা ঠিক করল যে, প্রথম মহলেই কাটাবে রাত। কোথায় থাকা যায়, পরামর্শ করে তিনজনে।
শচীনবাবু শুকনো মুখে বললেন, ‘আপনারা কি সত্যি থাকবেন এখানে? মানে রাতে?’
‘নিশ্চয়ই।’ আলোকনাথের মন্তব্য।
‘ভয় হচ্ছে, কিছু দুর্ঘটনা ঘটলে লোকে আমায় দুষবে।’
‘না না, আপনাকে দোষ দেবে কেন? বলেন তো লিখে দিয়ে যাব।’ আলোকনাথ ভরসা দেয়।
শচীনবাবু হতাশভাবে মাথা নাড়েন। নীচের হলঘরটায় রাতে থাকা ঠিক হল। বড় বড় জানলার ফোকর দিয়ে ঘরখানা ভেসে যাচ্ছে দিনের আলোয়। দূরে দেখা যাচ্ছে অজয় নদের পাড়।
অলোকনাথ বলল শচীনবাবুকে, ‘একটি লোক জোগাড় করতে পারেন? ঘরখানা একটু ঝাটপাট দিয়ে সাফ করে দেবে। আর দুটো মাদুর বা চাটাই পেলে ভালো হয়। কখনো কখনো একটু গড়িয়ে নেব।’
‘ঠিক আছে, হয়ে যাবে।’ কর্মকারমশাই আশ্বাস দেন।
‘আহারটা কিন্তু আমার বাড়িতে করতে হবে।’
অলোকনাথরা প্রথমে আপত্তি জানায়, ‘পাউরুটি আছে আমাদের সঙ্গে। গ্রামে মুড়ি পাওয়া যাবে! তাতেই হবে।’
শচীনবাবু ক্ষুন্ন হয়ে বললেন, ‘সে কি, আপনারা অতিথি। গগনের বন্ধু। মুড়ি খেয়ে কাটাবেন? তা হয় না। সামান্য দুটো অন্ন যোগাতে পারব না?’
দীপকরা রাজি হয় অগত্যা। ‘বেশ দুপুরে আপনার কাছে খাচ্ছি। রাতে কিন্তু কোনও ব্যবস্থা করবেন না। পাউরুটি খাব। ভাত খেলে ঘুম আসবে।’
কর্মকারমশাই গেলেন নিজের বাড়িতে। দীপকরা তিনজনে গেল অজয় নদের তীরে বেড়াতে। বৈশাখ মাস। অজয় নদেতে তখন জল খুব কম। প্রশস্ত নদীগর্ভে বালির চড়া পড়েছে। ক্ষীণ একটা স্রোত বইছে এক ধার ঘেঁষে। জলের বুকে সবচেয়ে গভীরেও হাঁটু জলের বেশি নয়। মানুষজন গোরু-মোষ দিব্যি হেঁটে পার হচ্ছে নদী। ওপারে দেখা যাচ্ছে গাছ-গাছালিতে ঢাকা কয়েকটি গ্রাম।
বেলা এগারোটা নাগাদ, তিনজনে গ্রামে ফেরে।
শচীনবাবুর বাড়ি পৌছে দেখে যে রীতিমতো এক জটলা তার বাসার সামনে। শচীন কর্মকারও রয়েছেন তার মধ্যে। দীপকরা হাজির হতে ভিড়ে গুঞ্জন ওঠে। কর্মকারমশাই আহ্বান জানান দীপকদের, ‘একটু জিরিয়ে নিন। তারপর স্নানাহার করবেন।’
বাড়ির বাইরের দিকে একটা ছোট ঘরে বসেছে দীপকরা তক্তপোশে চেয়ারে। এক বৃদ্ধ এসে বসেন তাদের কাছে। বাইরের ভিড়টা তখন জানলা-দরজায় উপচে পড়ছে।
শচীনবাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘আমাদের মণ্ডলমশাই।’
বৃদ্ধ বার দুই গলা ঝেড়ে নিয়ে গম্ভীর সুরে বললেন, ‘হু শুনলাম সব। তা আপনারা কি সত্যি ওইবাড়িতে রাত কাটাবেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ’, সবিনয় নিবেদন করে গোলকপতি, ‘সেই উদ্দেশ্যেই যে এসেছি।’
‘ভিতরে না থেকে, বাড়িটার বাইরে মানে নাটমন্দিরের সামনে চত্বরে থাকলে হয় না?’ বৃদ্ধ বলেন।
‘আজ্ঞে না। ভিতরে থাকতেই যে চাই।’ অলোকনাথ দৃঢ়কণ্ঠে জানায়।
‘সাপখোপের ভয়ও তো আছে। পোড়োবাড়ি।’ বৃদ্ধ নিরস্ত করার চেষ্টা চালান।
‘আজ্ঞে আছে বৈকি। আমরা সতর্ক থাকব। লাঠি রাখব।’ গোলকপতি তার পেশিবহুল বাহু তুলে এমন ভঙ্গি করে যার অর্থ, শুধু সাপখোপ কেন, অশরীরীদের বিরুদ্ধেও তারা প্রস্তুত।
‘হুম্! আপনারা শহুরে মানুষ। তবু অনুরোধ করছি, একটিবার ভেবে দেখবেন।’
‘নিশ্চয়।’ আলোকনাথের বিনীত আশ্বাস।
বৃদ্ধ উঠে গেলেন।
ঘরের বাইরে দাওয়ায় তখন জোর আড্ডা বসে। জামা-জুতো খুলে বসে জিরিয়ে নিতে নিতে দীপকদের কানে আসে ভয়াবহ সব ভৌতিক ঘটনার বর্ণনা। রায়বাড়ি নিয়েও গল্প হচ্ছিল।
বিকেল বিকেল দীপকরা বেরিয়ে পড়ে রায়বাড়ির উদ্দেশে। তাড়াতাড়ি বেরোবার কারণ শচীনবাবুর বাসার সামনে তাদের জন্য সবসময় যে পরিমাণ ভিড় লেগে আছে সেটা গৃহকর্তার পক্ষে বিরক্তিকর হচ্ছে।
গ্রামের একটা দল কিন্তু তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলল। তাতে সব বয়সি মানুষ। শচীন কর্মকারও রয়েছেন।
অট্টালিকার বাইরে নাটমন্দিরের চাতালে বসল দীপকরা। অলোকনাথ ব্যাগ থেকে একটা টেপ-রেকর্ডার বের করে নতুন খালি ক্যাসেট ভরে। চালিয়ে পরীক্ষা করতে থাকে।
গোলকপতি তার ফ্ল্যাশ-বাল্ব লাগানো ক্যামেরা ঠিকঠাক করতে লাগল।
‘এসব কি করতে এনেছেন?’ জিগ্যেস করেছিল দীপক।
ওরা বলেছিল যে কোনও মূর্তির ছবি তোলার দরকার হয় যদি? কোনও অদ্ভুত শব্দ বা কণ্ঠস্বর শুনে রেকর্ড করে রাখা যায় যদি—তাই নিয়েছি।
দুজনের কাছে আরও দুটি জিনিস আছে গোপনে। দুটো বড় বড় ধারাল ছুরি। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে। দীপক একটা লাঠি এনেছে।
গ্রামের ভিড়টা কিছু দূরে দাঁড়িয়ে মহা কৌতুহলে দেখছে আগন্তুকদের কার্যকলাপ। দুজন বয়স্ক লোক বসে গেলেন চাতালের এককোণে ।
‘গান শুনবেন বুঝি?’ টেপ-রেকর্ডারটা দেখিয়ে এক ছোকরা প্রশ্ন করে।
‘হ্যাঁ, রাত জাগতে হবে যে!’ আলোকনাথ হেসে জানায়।
গ্রামের একটি ছেলে, মুখে সরা চাপা ছোট একটা মাটির কলসি কাধে হাজির হল। তার পিছনে আর একটি ছেলের হাতে একটা হ্যারিকেন ।
‘এগুলো কোথায় রাখব?’ জিগ্যেস করে তারা।
দীপক বলল, ‘নীচে হলঘরটায় রেখে এস ভাই। কলসিতে জল ভরে এনেছ তো?’
‘হ্যাঁ।’ মাথা নেড়ে ওরা ঢুকে যায় রায়বাড়ির ভিতর। একটু বাদে জিনিস দুটো রেখে বেরিয়ে আসে।
আইডিয়াটা দীপকের। অলোকনাথদের সঙ্গে একটা জলের বোতল আছে বটে। তবে এই গরমকালে তিনজনের এক বোতল জলে তেষ্টা মিটবে না। তাই কর্মকারমশাইকে কলসির ব্যবস্থা করতে বলেছিল। মোমবাতি ওদের সঙ্গে আছে। কিন্তু বাড়িটায় যা হাওয়া খেলে মোমবাতি নিবে যেতে পারে। তাই হ্যারিকেনের ব্যবস্থা কর্মকারমশাইয়ের কৃপায়।
দীপক ভাবল, আর একবার বাড়িটার ভেতর দেখে আসি। সে একাই ঢুকে যায় রায়বাড়িতে।
হলঘরে উঁকি দিয়ে দেখল, সব ব্যবস্থা করিয়ে রেখেছেন শচীনবাবু। ঘরটা খানিক সাফ হয়েছে। দুটো মাদুর বিছানো রয়েছে মেঝেতে। দরজার পাশে জলভরা কলসি এবং লণ্ঠনটা রাখা।
দীপক দোতলায় ওঠে। একটা ঘরে ঢুকে সে নদী দেখছে জানলা দিয়ে। হঠাৎ—খটু-খটু-খটু শব্দে চমকে যায়। ঠিক যেন খড়ম পায়ে চলার আওয়াজ। এমন দিনের বেলা! ছ্যাৎ করে ওঠে বুক।
ফের সেরকম শব্দ হয় দু’বার। শব্দটা যেন ঘরে অন্য জানলাটার কাছ থেকে আসছে। ওই জানলায় একখানা মাত্র খড়খড়ি দেওয়া পাল্লা ভাঙা অবস্থায় কোনওরকমে টিকে আছে আজও। দমকা বাতাস আসে। দীপক লক্ষ করে যে অমনি এক টুকরো ভাঙা ঝুলেপড়া কাঠ পাশে একটা কাঠের গায়ে দুলে দুলে আঘাত করে হাওয়ার ধাক্কায়। আওয়াজ হয়—খটু খট্।
ওঃ এই ব্যাপার। এই বুঝি খড়ম পায়ে বড়কর্তার পায়চারি করার রহস্য। এ বাড়িতে এমনি ভাঙাচোরা জানলা-দরজার পাল্লা অজস্র। হাওয়ার ধাক্কায় তারাই শব্দ করে নিশ্চয়। নিস্তব্ধ রাতে সে শব্দ স্পষ্ট শোনায়। লোকে ভাবে খড়ম পায়ে বড়কর্তার ভূত ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাসি পেল দীপকের। অলৌকিক রহস্যগুলো বেশিরভাগই এইভাবে সৃষ্টি হয়।
দীপক বাড়ি থেকে বেরিয়ে বসল অলোকনাথদের কাছে চাতালে। ওরা তখন ক্যামেরা, টেপরেকর্ডারের কাজ শেষ করে চুপচাপ বসে।
গ্রামের ভিড়টা ঠায় রয়েছে। গুজগুজ করছে নিজেদের মধ্যে। গোলকপতি ফিসফিস করে, ‘আচ্ছা জ্বালালে। লোকগুলো যে নড়ে না। কি রকম ড্যাবড্যাব করে দেখছে। এখানে একটু রেস্ট নিয়ে সন্ধের পর বাড়িটায় ঢুকব ভেবেছিলুম।
দীপক মুচকি হেসে বলল, ‘শেষ দেখা দেখে নিচ্ছে। কাল তো আর আমাদের জ্যান্তো দেখার আশা কম?’
গোলকপতি রাগে মুখ ভেটকায়। দিনের আলো ক্রমে নিভে আসে। ঝাঁকড়া গাছগুলোর ছায়া ঘিরে ধরছে বাড়িটাকে। বাতাসের বেগ আর শো শো আওয়াজ বাড়ছে। থমথমে হয়ে উঠছে চারপাশ।
দীপক রায়বাড়ির ছাদে ঝুঁকেপড়া গাছের ডালপালার নড়াচড়া দেখতে দেখতে ভাবে—ওই ছায়া, ওই আলো-আঁধারিকে ভুল করা অসম্ভব নয়। যেন রাতে কেউ দাঁড়িয়ে আছে ছাদে। চলাফেরা করছে কিনার ঘেষে।
গ্রামের বয়স্করা উসখুস করে এবার। শচীন কর্মকার উঠে পড়লেন, ‘তাহলে আমি চলি। একটু কাজ আছে বাসায়।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনাদের আর আটকাব না। কাল দেখা হবে।’ আলোকনাথ তৎক্ষণাৎ বিদায় জানায়।
আস্তে আস্তে বয়স্ক লোকেরা চলে যায়, কিন্তু ছেলে-ছোকরার দল তখনো নড়ে না। গোলকপতি সন্দিগ্ধভাবে বলল, ‘ছোড়াগুলো বাড়ির ভিতর অবধি পিছু নেবে না তো? তাহলে আর বড়কর্তার দর্শন পেয়েছি?’
‘দেখা যাক, দীপক উঠে পড়ে, চলুন বাড়ির ভিতরে গিয়ে একটু গড়িয়ে নিই।’ সঙ্গী দুজনও উঠে পড়ে। গ্রামের ছেলেরা কিন্তু বাড়ির ভিতরে ঢোকে না। আপাতত হলঘরে বসে না দীপকরা। ঘরের ভিতর খুব হাওয়া। তবু একটা বোটকা গন্ধ ভাসছে। ওরা বাইরে বারান্দায় খবরের কাগজ পেতে পা ছড়িয়ে বসে, থামে ঠেস দিয়ে।
হঠাৎ কোত্থেকে একটি লোক এসে সামনে দাঁড়াল। মানুষটি ছোটখাটো। রং কালো। মাঝবয়সি। পরনে খাটো ধুতি ও ফতুয়া। পা খালি। মুখে বিনয়ী লাজুক হাসি।
সে হাত কচলাতে কচলাতে মৃদু নরম সুরে বলল, ‘আজ্ঞে শুনলেম। তাই এলেম দেখতে।’
‘কি শুনলে?’ দীপক অবাক হয়ে বলে।
‘আজ্ঞে, আপনারা নাকি এখানে রাত কাটাবেন?’
‘হুঁ।’ আলোকনাথের সংক্ষিপ্ত জবাব।
‘তা বেশ। লোকটি ইতি-উতি চেয়ে হলঘরটা দেখিয়ে বলে, “ওই ঘরে থাকবেন বুঝি?’
‘হ্যাঁ।’
‘ঘরে বড়কত্তার ছবিখানা দেখেছেন?’ লোকটি আগ্রহ ভরে জিগ্যেস করে।
‘হুঁম।’ দায়সারা জবাব দেয় অলোকনাথ। বিরক্ত হচ্ছে। এ আপদ আবার কোত্থেকে জুটল?
‘ভারী মানী লোক ছিলেন বড়কত্তা। যেমন দাপট। আবার দান-ধ্যানও ছিল খুব। আহা ছারখার হয়ে গেল অমন সোনার সংসার।’ লোকটি নিজের মনেই বকে চলে।
দীপকরা নিস্পৃহভাবে বসে থাকে। সাড়া দেয় না।
লোকটি হঠাৎ বলল, ‘বাবু এ-বাড়ি আমায় ভীষণ টানে। এ-বাড়ির কত যে কাহিনি জানি। ফুরসৎ পেলেই বাড়িটা একবার ঘুরে দেখে নিই। বড়কত্তার ছবিটা দেখি। পেন্নাম জানাই।’
দীপকরা এবার বেশ অবাক হয়। দীপক বলে, ‘তুমি কি এখানেই থাক? এই গাঁয়ে?
‘আজ্ঞে।’ ঘাড় হেলায় লোকটি।
‘কি নাম তোমার?’
‘আজ্ঞে অভয়পদ হাজরা ’ বলেই লোকটি ব্যস্ত হয়ে বলল, যাই বড়কত্তার ছবিটা একবার দর্শন করে আসি। আলো কমে আসছে।’
অভয়পদ লঘু পায়ে ঢুকে যায় হলঘরে। দীপকরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। কত বিচিত্র মানুষ যে আছে! আজও রায়বাড়ির প্রাচীন গৌরব নিয়ে রোমন্থন করে।
খানিক বাদে ঘর থেকে বেরিয়ে ফের সামনে আসে অভয়পদ। মুখ উজ্জ্বল। বলে, ‘ওঃ, সাক্ষাৎ পুরুষসিংহ। কি দৃষ্টি! যেন বর্শাফলক। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন, কত্তা ভালো মানুষদের অপকার করেন না?
গোলকপতি রসিকতা করে, ‘অভয় তোমার তো খুব সাহস। সন্ধে হলে নাকি এ বাড়িতে কেউ টোকে না?’
অভয়পদ বিনীত হাস্যে নীরবে প্রশংসাটা হজম করে। তারপর বলে, ‘আজ্ঞে চলি এখন।’
সে হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে সুডুৎ করে বেরিয়ে গেল। সদর দিয়ে গেল না। গেল খিড়কি পথ দিয়ে। বাড়ির পিছন দিকে।
থামের আড়ালে একটা মোমবাতি জ্বেলে তিনজন চুপচাপ বসে থাকে বারান্দায়। কেন জানি না, কথাবার্তা কইতে ইচ্ছে করে না।
দিনের আলোর শেষ রেশটুকু মিলিয়ে যায়। মাথার ওপর আকাশে ফুটে ওঠে একটি দুটি করে তারা। হালকা জ্যোৎস্নার রুপোলি আভা স্পষ্ট হয়। বাড়ির পরিবেশ রীতিমতো ছমছমে হয়ে ওঠে। অদৃশ্য পায়রাগুলি ঝটপট করে। অন্ধকার চিরে শূন্যে পাক খায় চামচিকেরা। চাদের আলো আর বাড়ির নানা অংশের ছায়া জাল বোনে উঠোনে, দেয়ালের গায়ে।
সোঁ সোঁ করে ধেয়ে আসা বাতাস অট্টালিকার বুকে ঝাপিয়ে পড়ছিল। বাড়ির অজস্র ফাটল আর ফাঁক-ফোকরে হাওয়া ঢুকে শব্দ তোলে! মনে হয় যেন গোটা বাড়িখানা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে ঘন ঘন।
অন্ধকারের আড়াল থেকে কত বিচিত্র আওয়াজ ভেসে আসে। চ্যাঁ চ্যাঁ চ্যাঁ। তীক্ষ্ণ আওয়াজে তিনজন শিউরে ওঠে সহসা। ঠিক যেন মানবশিশুর কান্না। তারপরই দীপক হেসে বলে, শকুনের ছানার ডাক। আমি আগে শুনেছি। কাছে কোথাও বাসা আছে শকুনের। শুধু অনেক অজানা শব্দ নয়, অনেক অদৃশ্য নড়াচড়া টের পায় তারা। স্নায়ু টানটান। সজাগ তাদের চোখ, সতর্ক কান। অস্বস্তি বাড়ে। কেবলই অনুভব করে, অট্টালিকার কোণে কোণে জমাট আঁধার ফুঁড়ে কাদের চোখ যেন লক্ষ করছে তাদের।
ওরা উঠে পড়ে। এবার হলঘরে ঢোকে। হ্যারিকেনটা জ্বালে। মোমবাতিটাও জ্বলছে। তবে শিখাটা লাফাচ্ছে বাতাসে। যে কোনও সময়ে দপ করে শেষ নিশ্বাস ফেলবে।
রাতের খাওয়া সেরে নেয় দীপকরা। পাউরুটি-মাখন আর কলা। জল খায়। খানিক বাদে গোলকপতি বড় বড় হাই তুলতে লাগল। আড়মোড়া ভেঙে বলল, আঃ, ঘুম পাচ্ছে। সারাদিন রেস্ট হয়নি।’
সে মাদুরে চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়ে বলল, একটু ঘুমিয়ে নিই। ঘণ্টাখানেক বাদে ডেকে দিও। এখন তো মোটে আটটা ! তেনারা তো শুনেছি মাঝরাতের আগে দেখা দেন না।’
ব্যস, গোলকপতি ভোস ভোঁস করে ঘুমাতে লাগল। খানিক পরে অলোকনাথও শুয়ে পড়ল গোলকপতির পাশে। হাই তুলে বলল, ‘সত্যি খুব টায়ার্ড লাগছে। একটু গড়িয়ে নিই।”
একটু পরে দীপক দেখে অলোকনাথও ঘুমাচ্ছে। সে ভাবল, বাঃ, এরা তো আচ্ছা লোক। ভূত দেখতে এসে পোড়োবাড়িতে দিব্যি নিশ্চিন্তে ঘুম মারল। নার্ভ বটে।
দীপকেরও ক্লাস্তি বোধ হচ্ছিল। তবে তার রাত জাগা অভ্যেস আছে। খবরের কাগজে অনেক সময় কাজ করতে হয় রাত জেগে । সে চেয়ারখানা টেনে নিয়ে বসল খোলা জানলার সামনে। সঙ্গে ফ্লাস্কে চা আছে। মাঝরাতে খাওয়া যাবে আর ভোরবেলা।
হালকা চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছে বাইরে ধু-ধু মাঠ, নদীর উচু পাড়, কালো কালো ঝোপঝাড় গাছ। ভারী রহস্যময় প্রকৃতি। আকাশে অগুনতি টিপটিপ আলো জুলা তারা। খট্-খটু-খটু—সেই রকম কাঠে কাঠে ঠোক্কর লাগার শব্দ দোতলায়। যেন কেউ খড়ম পায়ে হাঁটছে।
বড়কর্তার ছবিখানার দিকে তাকাল দীপক। ঘরের স্বল্প আলোয় তার বড় বড় চোখের তীব্র দৃষ্টি যেন লক্ষ করছে দীপককে। গা ছমছম করে।
জল তেষ্টা পাচ্ছিল। দীপক উঠে জল খেল কলসি থেকে । বাতাসে গ্রীষ্ম দিনের গরম ভাপ আর নেই। নদীর দিক থেকে আসা হু-হু হাওয়ায় চমৎকার শীতল ভাব। মোলায়েম স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে গায়ে-মুখে। দীপকের ঢুলুনি আসতে থাকে। সে পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে।
দীপক চোখ মেলে চমকে খাড়া হয়ে বসল। মুখে সূর্যের আলো পড়ছে। সে চেয়ারে বসে। ঘাড়ে বেশ ব্যথা। তার মানে? ভোর হয়ে গেছে! রাত কাবার! সে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে গোটা রাত এই চেয়ারেই! দীপক ঘাড় ফিরিয়ে দেখে যে গোলকপতি এবং অলোকনাথ মেঝেতে মাদুরে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। দীপক তাড়াতাড়ি গিয়ে তাদের ঠেলা মারে, ও মশাই, উঠুন উঠুন। ভোর হয়ে গেছে।’
অলোকনাথ ধড়মড় করে উঠে বসে বলে, ‘অ্যাঁ সত্যি তো! ডাকেননি কেন?’
দীপক বলে, ‘ডাকব কি? আমিও যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’
গোলকপতি উঠতে চায় না। অলোকনাথের রাম ধাক্কা খেয়ে তার নিদ্রাসুখ ঘুচল। উঠে বসে, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে গোল গোল চোখে বলল, যাঃ, ভূত দেখা মিস হয়ে গেল যে। বড়কর্তা হয়তো ঘুরে গেছেন। অতিথিরা ঘুমোচ্ছে দেখে আর ডিসটার্ব করেননি। যাকগে চা দে। দেখি ফ্লাস্কটা।’
কিন্তু ফ্লাস্ক কৈ?
তারপরই আবিষ্কার হল যে শুধু ফ্লাস্কটা নয়, তাদের ক্যামেরা, টেপ-রেকর্ডারও নেই। মেঝেতে তাদের পাশেই রাখা ছিল। সব হাওয়া।
‘অ্যাঁ, আমার ঘড়ি?’ দীপক নিজের বাঁ হাতের কজি দেখে আঁতকায়।
দেখা গেল, বাকি দুজনেরও রিস্টওয়াচ নেই হাতে। কে সরাল? তিনজন বেরোয় তাড়াতাড়ি। আঁতিপাতি করে খুঁজতে থাকে গোটা বাড়ি। নাঃ কোথাও নেই তাদের জিনিস। বাড়ি যথারীতি জনমানবহীন।
ভাঙা পাঁচিলের কাছে এক দল গ্রামের লোক জড়ো হয়েছে সেই ভোরে। বোধহয় আগন্তুকদের খোঁজে বাড়িটায় ঢুকবে কিনা প্ল্যান করছিল। দীপকদের দেখে ছুটে আসে।
দীপকর তাদের দিকে দিকপাত না করে হস্তদন্ত হয়ে খুঁজতে থাকে। তিনজন তিনদিকে। একটু পরেই দীপকের ডাক শোনা যায়। বাড়ির পিছনে খিড়কির দিক থেকে, ও গোলকবাবু, ও অলোকবাবু, এদিকে আসুন। শীগগির।
গোলকপতি এবং অলোকনাথ ডাক লক্ষ করে ছোটে। তাদের পিছু নেয় গাঁয়ের লোক।
বাড়ির খিড়কি-দরজা থেকে সামান্য দূরে একটা দৃশ্য দেখে থমকে যায় সবাই।
সেই অভয়পদ মাটিতে পড়ে আছে। একদম বেহুঁশ। তার কাছে উবু হয়ে বসে দীপক একটা চটের থলি থেকে বের করছে ক্যামেরা। টেপ-রেকর্ডার ও ফ্লাস্কটা রয়েছে পাশে। মাটিতে।
‘একি! এ তো আমাদের জিনিসগুলো।’ গোলকপতি, আলোকনাথ সরবে চেঁচায়।
‘হুঁ।’ দীপক ঘাড় নেড়ে এবার থলি থেকে বের করে তাদের তিনটি রিস্টওয়াচ।
‘এখানে কি করে এল? কে আনল?’ উত্তেজিত গোলকপতির প্রশ্ন।
দীপক বলল, ‘জানি না তবে মনে হচ্ছে এরই কীর্তি।’ দীপক অভয়পদকে দেখায়।
‘আরে ঘেঁটু!’ কয়েকজন গাঁয়ের লোক অভয়পদকে দেখে অবাক হয়ে বলে ওঠে। অভয়পদর মুখে-চোখে খানিকক্ষণ জলের ঝাপটা দেবার পর সে চোখ মেলে। ফ্যালফ্যালে চাউনি। বসানো হয় তাকে৷ হঠাৎ সে একটা চিৎকার দিয়ে উঠে ছুটে পালাতে যায়। গাঁয়ের লোকেরা তাকে জাপটে ধরে। অভয়পদ বিকৃত কণ্ঠে হাউমাউ করতে থাকে। তাকে তখন নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের ভিতর। সে খানিক ধাতস্থ হলে ঘটনাটা জানা যায় একটু একটু করে। পরের সংখ্যা বঙ্গবার্তায় প্রকাশিত দীপকের রিপোর্ট থেকে কিছু কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি। পাঠক বুঝতে পারবেন আসল ব্যাপারটা কি ঘটেছিল।
অভয়পদর বাড়ি মোটেই নন্দনপুর নয়। সে থাকে অজয় নদের ওপারে। ও একজন দাগী চোর। অভয়পদ ওর আসল নাম নয়। ওর আসল নাম বংশীবদন। তবে ও ঘেঁটু নামেই পরিচিত।
সেদিন ঘেঁটু নন্দনপুরে গিয়েছিল একটা দরকারে। তখন আমাদের তিনজনকে দেখে। শোনে আমাদের উদ্দেশ্য। ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে নজর করে আমাদের দামি ক্যামেরা, টেপ-রেকর্ডার, ঘড়ি। অমনি মতলব খেলে যায় তার মাথায়। তখুনি চলে যায় পাশের গ্রামে তার এক স্যাঙ্গাতের বাসায়। সেখান থেকে জোগাড় করে ঘুমের ওষুধ। তারপর ফিরে আসে। সুযোগ মতো অন্যদের চোখ এড়িয়ে রায়বাড়িতে ঢুকে একা আলাপ জমায় আমাদের সঙ্গে। বড়কর্তার ছবি দেখার ছল করে হলঘরে ঢুকে সে কলসিতে আমাদের খাবার জলে মিশিয়ে দেয় ঘুমের ওষুধ…ওই জল খেয়েই আমরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি….
ঘেঁটু ওরফে অভয়পদ লুকিয়ে ছিল কাছেই। বাইরে একটা গাছে চড়ে নজর রেখেছিল হলঘরের ভিতর।
আমরা ঘুমিয়ে পড়তে সে খিড়কি দিয়ে ঢোকে। আমাদের ক্যামেরা ইত্যাদি দামি জিনিস হস্তগত করে।
ঘেঁটু খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে যখন পালাচ্ছে হঠাৎ নাকি দু’হাত মেলে তার পথ আগলে দাঁড়ায় মিশকালো এক বিশাল ছায়ামূর্তি। চাপা রক্তহিম করা গলায় সে হুংকার দেয়, এই ব্যাটা।
ঘেঁটু কাঠ হয়ে যায় ভয়ে। ছায়া দানব ঘড়ঘড়ে চাপা কণ্ঠে গর্জায়, রায়বাড়িতে চুরি করে পালাবি? কি ভেবেছিস? কেন, ভৈরব সর্দার কি নেই? শয়তান—’
বলতে বলতেই সেই ছায়ামূর্তি নাকি এক হাত বাড়িয়ে বরফশীতল বজ্রকঠিন মুঠিতে ঘেঁটুর চুলের গোছা পাকড়ে তুলে তাকে আছড়ে ফেলে দেয় মাটিতে। ঘেঁটু তখুনি জ্ঞান হারায়…….
নন্দনপুরের লোকেদের কাছে জানা গেছে যে ভৈরব সর্দার ছিল রায়বাড়ির এক দুর্ধর্ষ লেঠেল। প্রায় পঁচাত্তর বছর আগে সেই কলেরার মড়কে ভৈরবও মারা যায়।
ঘেঁটু এখনো সারেনি। মাঝে মাঝে পাগলের মতো করছে। চেঁচিয়ে উঠছে আতঙ্কে। অন্ধকারে কিছুতেই একা থাকতে চায় না। ডাক্তার বলেছে, ওর নার্ভে প্রচণ্ড শক্ লেগেছে। হয়তো ও সুস্থ হবে। তবে সময় লাগবে।
ঘেঁটুকে চুরির দায়ে আর পুলিশে দেওয়া হয়নি। কারণ এ-যাত্রা তার যথেষ্ট শাস্তি হয়েছে।
……………………………………………………(সমাপ্ত)……………………………………..