প্রেত ছায়া

প্রেত ছায়া

কাল রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে পুরনো ঘটনার কথাটা মনে পড়ে আবার যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। অনেকদিন বলা ঠিক হবে না, সত্তর দশকের শেষের দিকের ঘটনা হবে। তখন কলকাতা শহরে এত ভিড় ছিল না। আমরা তখন বাবার চাকরির সুবাদে মোমিনপুরে কাছে রিমাউন্ট রোডের পোর্টের কোয়াটার্সে থাকতাম। ব্রিটিশ আমলের পুরনো বিশাল বাড়ি। আমরা তখন একতলায় আর উল্টোদিকে চ্যাটার্জিদের ফ্ল্যাট। চ্যাটার্জিকাকুরা তিন ভাই, ভাইপোরা সব মিলিয়ে বিরাট সংসার। আমরা নিয়ম করে সন্ধেয় রোজ বাড়ির সামনের সিঁড়িতে বসে আড্ডা মারতাম। সে যুগে কলকাতায় রোজ নিয়ম করে লোডশেডিং হত আর আমরা হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশুনা করতাম। তবে গরমে ও মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে প্রায়শই আড্ডায় এসে চুপচাপ বসে যেতাম। ছোটো ক্লাসে পড়ি বলে বিশেষ চাপও ছিল না।

সেরকমই এক সন্ধ্যায় অনেকক্ষণ লোডশেডিং চলছে, রাত প্রায় দশটা তো হবেই। কোয়ার্টারের সামনে দিয়ে লোক চলাচল অনেক কমে গেছে। অন্ধকারে অনেকক্ষণ বসে থাকায় চোখ সয়ে গিয়ে সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। গান, গল্প চলছে প্রায় আট-দশজন মিলে। সামনে দিয়ে এক অচেনা বোধহয় অবাঙালি পুরুষ বেশ দ্রুতগতিতে যাচ্ছিল এদিক ওদিক না তাকিয়ে। হঠাৎ আমাদের সবার সামনে আসতে লোকটি চোখের নিমেষে উধাও হয়ে গেল। একজন দু’জন নয়, প্রায় দশজন মানুষের সামনে দিয়ে!

অতর্কিতে ব্যাপারটা হয়ে যাওয়ায় সবাই হতচকিত হয়ে গেছিল মুহূর্তের জন্য। সম্বিত ফিরল ছোটোকাকার গলায়, “একি হল রে?”

ব্যস, তারপরে তো হৈহৈ রৈরৈ কান্ড! আওয়াজ শুনে চ্যাটার্জি পরিবারের আরও কয়েকজন দাদাও তখন ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। ভূতের উপর আলোচনা ও গবেষণাও শুরু হয়ে গেল। এমনিতে কাঁটাপুকুর মর্গ কাছে হওয়াতে সারা দিনরাত ধরে সামনের রাস্তা দিয়ে মরা মানুষদের মিছিল চলত। কিন্তু এতগুলো লোকের সামনে দিয়ে একটা লোকের বেমালুম গায়েব হয়ে যাওয়া যেন ভূতের চ্যালেঞ্জ।

ঘটনা সেখানে শেষ হল না কিন্তু। আড্ডায় ভূতচর্চা বেড়ে গেল। এর মধ্যে কে যেন সিঁড়ির কোনায় একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রেখে গিয়েছিল। তার আলোয় অন্ধকারটা আরও কমে গেছিল। তখনও আড্ডা, হাসি, ভয় দেখানো, ঠাট্টা চলছে। হঠাৎ পরিষ্কার দেখলাম, বড়ো রাস্তার ডানদিকের থেকে কে একজন বেশ ধীরপায়ে চলে আসছে। তার কোমরের তলায় ফুলপ্যান্ট পরা পাদুটো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, কিন্তু উপরে ঘোর অন্ধকার, যেন শরীর বিহীন এক শরীর হেঁটে চলে যাচ্ছে। এদিকে যাকে বলে পিন ড্রপ সাইলেন্স। সবাই অবাক হয়ে সেই দৃশ্য দেখছে মাত্র কয়েক হাত দূর থেকে। হঠাৎই এক দাদা, “কে যায়?” বলে হ্যারিকেন হাতে তেড়ে গেলেন। কিন্তু কে কোথায়? আড্ডা সেদিনের মতো ভেঙে গেল।

আমার তখন দশ-এগারো বছর বয়েস হবে। ভয়ে সারারাত ঘুমোতে পারিনি। আজও মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়।

……………………………………………….(সমাপ্ত)…………………………………………..

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত