“সুস্থ জীবন” হাসপাতালের ২০৭ নাম্বার কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো হামিন। ভেতরে ঢুকে দেখলো ধবধবে সাদা চাদর বিছানো একটা বেডে শুয়ে আছে তারই এক সময়কার অন্তরঙ্গ বন্ধু, সলিল। কেবিনের ভেতর একজন নার্স সলিলের হাতে সুঁচ ফুটিয়ে ইঞ্জেকশন দিচ্ছিলো। দরজা ঠেলে হামিনকে ভেতরে ঢুকতে দেখে হাতের ইশারায় নার্সকে কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে বললো সলিল।
“আমি জানতাম, তুই আমাকে দেখতে আসবি।”
— কিভাবে জানতি? যেখানে তোর স্ত্রীই তোকে দেখতে এলো না।
“ও আসেনি, কারণ আমার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াবার মত মুখ নেই ওর।”
— তাই বুঝি? তাহলে আমার আছে বলছিস?
“সত্যি কথা বলতে কি, তোরও নেই। তবে সেটা বোঝার মত বিবেকও তোর নেই।”
হাহা করে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো হামিন। তারপর এটা যে হাসপাতাল, সেটা মনে পড়ায় নিজেকে সংযত করে নিলো।
“মরতে বসেছিস, তারপরও নীতিবাক্য বলাটা এখনও ছাড়তে পারিসনি। তা তোর কি মনে হয়, বিবেক না থাকলে তোকে কেন দেখতে এসেছি আমি?”
— আমার অসহায়ত্ব দেখতে, আমাকে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যেতে দেখতে। আমার মত প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে দেখতে। কফি খাবি?
“ঠিক ধরেছিস।” সলিলের কফি খাবার প্রস্তাবে কোন সাড়া না দিয়ে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো হামিন। “তোর মাথায় অনেক বুদ্ধি, সবকিছুই ধরে ফেলিস। শুধু নিজের বউয়ের পরকীয়াটা ধরতে পারিসনি।”
— সেটাও অনেক আগেই ধরতে পেরেছি, তারপরও বিভিন্নভাবে ওকে শোধরানোর সুযোগ দিয়ে গেছি আমি। আফসোস, ও শুধরাতে পারলো না।
“একটা সময় তুই আমার প্রাণের বন্ধু ছিলি। একটা সময় খুব ভালোবাসতাম আমি তোকে। আমার কোন ভাই নেই, নিজের ভাইয়ের মতই মনে হত তোকে।”
— সেই ভালোবাসার গাছটা ইউনিভার্সিটি লাইফেই শুকিয়ে মরে গেছে, তাই না?
“যেদিন হেলেন তোকে ওর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার কথা জানালো, আর তুই ওকে খুব রূঢ়ভাবে ফিরিয়ে দিলি।” সলিলের কথা কানে না তুলে একটানা বলে যায় হামিন।
— কাউকে ভালো না লাগলেও তার ভালোবাসা গ্রহণ করতে হবে? শুধু বন্ধুর বোন বলে? আর তুই যেমন আমাকে ভাইয়ের দৃষ্টিতে দেখতি, তেমনি আমিও হেলেনকে আপন বোনের দৃষ্টিতেই দেখতাম। ওর প্রতি আমার ভালোবাসাটা ছিলো আপন বোনের মতই।
“আমি মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম তুই ওকে আপন করে নে। তোর মত ব্রিলিয়্যান্ট, সৎ চরিত্রের মানুষের কাছে বোনটাকে আমার তুলে দিতে পারলে ভাই হিসেবে আমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারতাম। কিন্তু সেটা তুই হতে দিলি না। তোর কারণে আজ ও একটা ভুল মানুষের হাতে পড়ে দিনের পর দিন কষ্ট পাচ্ছে। বাকী জীবনটাও হয়তো এভাবেই কষ্ট পেয়ে যেতে হবে।”
— আমার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সেই ভুল মানুষটাকে ও নিজেই বেছে নিয়েছিলো, এখানে আমার কোন হাত নেই।
“এতই যখন জানিস, তাহলে এতদিন কিছু বুঝতে দিসনি কেন?”
— আমি তোকেও শোধরাবার সুযোগ দিয়েছি। আসলে তুই যেভাবে আমার ওপর থেকে তোর বন্ধুত্বের আচ্ছাদনটা সরিয়ে নিয়েছিলি, আমি সেভাবে পারিনি রে। হাজারহোক, আমার স্কুল জীবনের প্রথম বন্ধু তুই।
“প্রথম বন্ধু … ছোঃ। সেদিনটার কথা মনে করে দেখ, যেদিন আমাকে খুঁজতে গিয়ে আমার ফ্ল্যাটে আমারই বিছানায় তোর মিনাকে নগ্ন অবস্থায় দেখেছিলি। মনে করে দেখ। সেদিন কি তোর একবারও মনে হয়নি, দরজাটা খোলা পেয়েছিলি কেন? আমিই খুলে রেখেছিলাম …” সলিলকে উত্তেজিত করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যায় হামিন।
হুঁক..হুঁক… আহহু আহহু … হঠাৎ কাশির দমকে শরীরটা বিছানা থেকে লাফিয়ে ওঠে সলিলের। শেষের কথাগুলো বলে সলিলকে উত্তেজিত করতে পেরেছে ভেবে চোখ জোড়া চক চক করে ওঠে হামিনের।
কাশির দমক কিছুটা কমে আসার পর চেহারায় আবার সেই স্মিত ভাবটা ফিরে এলো সলিলের। একটু ঝুঁকে বিছানার নিচ থেকে একটা চিলিমচি বের করে তাতে এক দলা থুথু ফেললো সলিল। হামিনের তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই।
— অনেকক্ষণ হলো এসেছিস, কিছু অন্ততঃ খা। কফির পটে কফি রাখা আছে, ঢেলে নিয়ে খা। এই হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে দিয়েছে। বেশ ভালো কফি।
হামিন ভ্রু কুঁচকে সলিলের দিকে তাকালো। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার সলিল ওকে কফি খাবার জন্য জোরাজুরি করলো। ব্যাপারটা কি?
“আমার এখন কফি খেতে ইচ্ছে করছে না, তোকে দিবো?”
— নারে, তুই আসার একটু আগেই আমি একবার খেয়েছি।
“কেন, আরেকবার খা। এতক্ষণ তো বন্ধুত্বের অনেক বড় বড় বুলি কপচালি, বন্ধুর ছোট্ট এই কথাটি রাখ।”
সলিলকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মগে কফি ঢালতে আরম্ভ করলো হামিন। তারপর মগসহ হাতটা সলিলের দিকে বাড়িয়ে দিলো হামিন। নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বে হাত বাড়িয়ে কফির মগটা নিলো সলিল।
“কি হলো, জবাব দিলি না যে?”
— কোন কথার? ও আচ্ছা, দরজা খোলা থাকার ব্যাপারটা? আমি আগে থেকে সব জেনেশুনেই তোর ওখানে গিয়েছিলাম।
“সব জেনেশুনে গিয়েছিলি মানে কি?” নিজের মেজাজের ওপর হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারায় হামিন। “তাহলে কি এতদিন তুই আমাকে শুধু করুণা করে গিয়েছিস?”
— এটাকে ঠিক করুণা বলা যাবে না। বিয়ের কিছুদিন পরই আমি বুঝতে পারি মিনা আসলে আমাকে ভালোবাসে না। ওর বাবা-মা আর্থিক নিরাপত্তার জন্য আমার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন বলে রোবটের মত সংসার ধর্ম পালন করে যাচ্ছে। তুই ওর জীবনে আসার পর থেকেই ও জীবনটাকে উপভোগ করতে শুরু করেছে।
“তোর মন উদার জানতাম, কিন্তু এতটা উদার জানতাম না।” তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলো হামিন। ও লক্ষ্য করেছে, সলিল এখনও একবারের জন্যেও কফির মগে চুমুক দেয়নি।
— মেয়েটা খুব ভালো রে, ওকে কষ্ট দিস না। তোকে ও মন থেকে সত্যিই খুব ভালোবাসে। ওর ডায়েরী লেখার অভ্যাস আছে, সেই ডায়েরীটা আমি পড়ে দেখেছি।
“তোর মত আমি এত উদার নই রে আমি। কাজ শেষে ওকে আমি ছুঁড়ে ফেলে দিবো।”
অনেকক্ষণ কথা বলে গলাটা শুকিয়ে এসেছে হামিনের। ছোট টেবিলের ওপর রাখা পানির বোতলটা থেকে গ্লাসে কিছুটা পানি ঢেলে নিয়ে চুমুক দিলো হামিন।
“কিরে, এতক্ষণ হয়ে গেলো, কফির মগে একবারও চুমুক দিলি না যে? ঠান্ডা হয়ে যাবে তো!”
— হাহা… তুই কি ভেবেছিলি, কফিতে আমি কিছু মিশিয়ে রেখেছি? আমি জানতাম তুই সন্দেহপ্রবন একজন মানুষ। তোকে বার বার ইনসিস্ট করলে তুই সে জিনিসটা কখনই খাবি না। বোকা বিষ কফিতে নয়, পানিতে মেশানো ছিলো।
হামিনের মাথাটা হঠাৎ ঘুরতে শুরু করে। চোখের সামনে ধীরে ধীরে সবকিছু কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে আসছে। পেটে কি একটু ব্যথা শুরু হয়ে গেছে? উহ! পেট খামচে ধরে কেবিনের মেঝেতে বসে পড়লো হামিন।
“হারামজাদা, তাহলে প্রতিশোধটা তুই এভাবেই নিলি?” দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠলো হামিন।
— হাহাহা… শব্দ করে এক চোট হেসে নিলো সলিল। পেট ছেড়ে উঠে চেয়ারে বস। পানিতে বিষ মেশানো ছিলো না।
“আমার রীতিমত মাথা চক্কর দিচ্ছে, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে, পেট ব্যথায় ছিঁড়ে আসছে … আর তুই বলছিস বিষ মেশানো ছিলো না? মিথ্যুক!”
— পানিতে বিষ মেশানো আছে, এটুকু শুনে যে ব্যাপারগুলো তোর হয়েছে … সবই আসলে মানসিক। চেয়ারে একটু ধাতস্থ হয়ে বস, দেখবি এখনই সব ঠিক হয়ে যাবে।
আবারও কাশি চলে আসায় বিছানার নিচ থেকে চিলিমচিটা বের করে এক দলা থুথু ফেললো সলিল।
— এখন একটু ভালো লাগছে না? ভালো না লাগলে আরেকটু পানি খা।
ভয়ে ভয়ে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে খুব ছোট করে একটা চুমুক দিলো হামিন।
— চাইলে কফিও খেতে পারিস, এই দেখ আমি খাচ্ছি। বলে কফির মগে বেশ বড়সড় একটা চুমুক দিলো সলিল।
সলিলের কথা শুনে আরেকটা মগে কিছুটা কফি ঢেলে নিলো হামিন।
— শোন, তুই আমার পেছনে যে কাজগুলো করেছিস … সেটার জন্য আমি তোকে মেরে ফেলতে চাইলে অনেক আগেই মেরে ফেলতে পারতাম। আমার টাকা আছে, চাইলেই প্রফেশনাল কিলার হায়ার করতে পারি। তুই এমন কোন কেউকেটা নোস যে, তোর মৃত্যুতে হৈচৈ পড়ে যাবে। টাকা দিয়ে পুলিশের মুখও খুব সহজেই বন্ধ করে দেয়া যেতো।
“তাহলে…???
— আমি তোকে কখনই মেরে ফেলতে চাইনি। কারণ তুই ছিলি আমার স্কুল জীবনের প্রথম বন্ধু। আমি দিন দিন যত উপরে উঠেছি, আমার তত শত্রু সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্ধু বলতে আমি সবসময় তোকেই বুঝেছি।
— তুই আমার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে বার বার আমার পিঠে ছুরি মেরেছিস, আমি বুঝেও কখনও কিছু বলিনি। তুই মিনাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেছিস, আমি কিছু বলতে গিয়েও যখন দেখেছি মিনাও তোকে অনেক ভালোবাসে … তখন চুপ মেরে গেছি।
— তুই মিনাকে কখনও ছেড়ে যাস না, মেয়েটা তোকে সত্যিই অনেক ভালোবাসে। আর ওকে ছেড়ে গেলে কিছু পাবিও না, কারণ আমার সবকিছু আমি ওর নামে লিখে দিয়ে গেছি।
“সবকিছু লিখে দিয়ে গেছিস মানে? কেন তুই কোথায় চলে যাচ্ছিস?”
— ওপারে। তবে ওপারে চলে গেলেও তোর ওপর কিন্তু আমি ঠিকই নজর রাখবো।
বিছানার নিচ থেকে আবারও চিলিমচিটা নিয়ে তাতে এক দলা থুথু ফেললো সলিল। এবার চিলিমচির ভেতর তাকিয়ে দেখেছে হামিন। ভেতরটা রক্তমাখা থুথু দিয়ে ভরা।
“কিরে, তোর কি হলো … অ্যাই সলিল, তোর থুথুর সঙ্গে এত রক্ত বের হচ্ছে কেন?”
সলিল হামিনের মুখের দিকে তাকিয়ে স্মিত একটা হাসি দিলো।
— ফোনে তোর আসার কথা শুনে তখনই আমি বিষটা খেয়েছি। বিষটা পাকস্থলীতে গিয়ে কাজ শুরু করতে ঘন্টাখানেক সময় লাগে। সেই এগারোটার দিকে খেয়েছিলাম… বলে দেয়ালে ঝোলানো ঘড়িটার দিকে তাকালো সলিল।
— এখন তো বারোটা বেজে গেছে, তাই হয়তো বিষের রিয়্যাকশন শুরু হয়ে গেছে।
“অ্যাই সলিল, অ্যাই … ভাই আমার, এভাবে চলে যাস না। আমি নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারবো না। আমি তোর পতন দেখতে চেয়েছি, কিন্তু কখনও তোর মৃত্যু কামনা করিনি।” কাঁদতে কাঁদতে সলিলের মাথাটা নিজের কোলের ওপর টেনে নিলো হামিন।
— ছোটবেলা থেকে বন্ধু বলতে শুধু তোকেই জেনে এসেছি রে … জানি না বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখতে পেরেছি কিনা। নিজের অজান্তে তোর মনে দেয়া কষ্টগুলোর জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিস। হেলেনের কাছে না হয় ওপারে গিয়েই ক্ষমা চেয়ে নেবো।
— তোরা দু’জন ভালো থাকিস। প্রাণ প্রিয় বন্ধুর কোলে মাথা রেখে মরতে পারছি, এই সৌভাগ্য ক’জনের হয় … বল? একেকটা মানুষের কাছে একেকটা জিনিস বড়। কারও কাছে ভালোবাসা, কারও কাছে অর্থ-সম্পদ। আমার কাছে বন্ধুত্বের চাইতে বড় কিছু নেই। ভালো থাকিস…
হাসপাতালের ধবধবে সাদা বিছানায় সলিলের নিথর হয়ে যাওয়া মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছে হামিন। সলিলের মুখটার দিকে তাকিয়ে ওর এখনও কেন জানি মনে হচ্ছে, মরে যাবার পরও সলিলের চোখ দুটো ওর দিকে স্নেহময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ঠিক একজন বড় ভাই যেমন তার আবদার করা ছোট ভাইটার দিকে তাকিয়ে থাকে..!!