রূপনারায়ণ নদের বিরাট একটা চর।
নদীর বাঁধটা একটা বিরাট অজগরের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে দূর থেকে বহুদূরে। বাঁধের দুই ধারে , দু-পাশেই বট, অশ্বত্থ, জাম, তেঁতুল, শিরীষ, অর্জুন প্রভৃতি গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
বাঁধ থেকে নেমে খানিকটা এগিয়ে গেলেই গ্রামের সীমানা। প্রথমেই জেলেপাড়া। তার ডানদিকে বাগদিপাড়া, উত্তরদিকে বিভিন্ন জাতের লোক বাস করে। অপরদিকে রূপনারায়ণ নদ ঢেউ তুলে তরতর করে এগিয়ে চলেছে। বাঁধের ওপর দিয়ে প্রায় মাইলখানেক গেলেই রূপনারায়ণের প্রকাণ্ড চর। এই চরেই গাঁয়ের লোকেরা মড়া পোড়ায়।
আশপাশের প্রায় দশখানা গাঁয়ের মধ্যে ওই একটাই শ্মশান।
শ্মশানের কাছাকাছি অনেক নাম না জানা বড় বড় গাছ আর ঝোপঝাড়।
পাড়াগাঁয়ের শ্মশান যে কত ভয়ঙ্কর না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। শ্মশানের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আছে পোড়া কাঠ, আধপোড়া বাঁশ, ছেঁড়া কাঁথা, ছেঁড়া মাদুর, মড়ার হাড়, ভাঙা হাঁড়ি আর সরা।
যারা মড়া পোড়াতে পারে না, তারা মড়া মাটিতে পুঁতে দিয়ে যায়। তারপর সেইসব মড়া মাটির তলা থেকে টেনে বের করে শেয়াল, কুকুর আর শকুন মনের আনন্দে ছিঁড়ে খায়। কাছের ঝাঁকড়া শিরীষ গাছটায় একদল শকুন থাকে।
হঠাৎ একদিন একটা ব্যাপার ঘটল। বাগদিপাড়ার নগেন দলুই বউয়ের সাথে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে চলে যায়। প্রায় চারদিন কেটে গেল, সে আর বাড়ি ফেরে না দেখে, সবাই চিন্তায় পড়ল। যেখানে যত আত্মীয় ছিল, খোঁজ নেওয়া হল। কিন্তু কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না তার।
সেদিন সকালে জেলেপাড়ার কয়েকজন লোক ডিঙি ভাসিয়ে মাছ ধরতে ধরতে এসে পড়েছে শ্মশানের বেশ কাছাকাছি।
হঠাৎ তাদের নাকে দূর্গন্ধ এসে লাগল। আর সেইসঙ্গে শকুনের ডানা ঝাপটানির শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে তারা দেখল, নগেন দলুইয়ের পচা গলা মৃতদেহটা চরে এসে আটকে আছে। শকুনে খানিকটা ছিঁড়ে খেয়েছে। চোখ দুটোও শকুনে খুবলে নিয়েছে। শুধু চোখের গর্তদুটো আছে।
জেলেরা এই বীভৎস দৃশ্য দেখে বাগদিপাড়ায় গিয়ে সংবাদ দিল। সকলে সেখানে তখন ছুটে এসে দেখল। এত দূর্গন্ধ ছাড়ছে লাশটা যে দাঁড়ায় কার সাধ্যি। তখন সবাই নাকে কাপড় চাপা দিয়ে, মড়াটার পায়ে দড়ি বেঁধে, শ্মশানের ভেতর এনে মাটি চাপা দিয়ে চলে গেল। রাত্তির বেলা মাটির তলা থেকে নগেন দলুইয়ের মৃতদেহটা তুলে শেয়াল, কুকুরে খেয়ে ফেলল।
নগেন দলুইয়ের অবস্থা মোটামুটি ভালোই ছিল। তার দুটি ছেলে, তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা ভালোভাবেই বাপের শ্রাদ্ধ করল। জেলেপাড়া বাগদিপাড়ার অনেকেই নিমন্ত্রণ খেয়ে গেল।
এই ঘটনার পর প্রায় একমাস কেটে গেল। তারপর থেকেই নানারকম অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটতে লাগল। কখনও বাগদিপাড়া আবার কখনো জেলেপাড়া থেকে হাঁস মুরগী ছাগল চুরি যেতে লাগল।
একদিন নগেনের বউ রাত্রে একটা শব্দ শুনে বাইরে এসে দেখলে….তাদের আমগাছটার তলায়, কে যেন সাদা কাপড় গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভয় পেয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলে।
মায়ের চেঁচানি শুনে ছেলেরা হ্যারিকেন হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে চারদিক দেখল। কিন্তু কাউকেই দেখা গেল না। তখন তারা বলাবলি করতে লাগল, ” ওসব মনের ভুল, গাছের ছায়া দেখে মা ভয় পেয়েছে।”
রাত্রে বাঁধের ওপর আর শ্মশানেও একটা কঙ্কালকে ঘোরাফেরা করতে দেখে গাঁয়ের সবাই ভয় পেয়ে গেল। রাত্রে শ্মশানে মড়া নিয়ে আসা বন্ধ করে দিল সবাই। জেলেরা সারাদিন রূপনারায়ণে মাছ ধরে, সন্ধ্যা হলেই যে যার বাড়ি ফিরে আসতে লাগল। এমনকি বাঁধের ওপর দিয়েও লোক চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। সন্ধ্যে হলেই রাস্তা একেবারে ফাঁকা।
সেদিন রাখাল জেলের একটা বাছুর হারিয়ে গেল। সারাদিন খোঁজ করা হল কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না বাছুরটাকে। একদিন পর একজন লোক শ্মশানের দিকে এসে দেখল, রাখাল জেলের বাছুরটা মরে পড়ে আছে, তার আধখানা কে যেন চিবিয়ে খেয়েছে। বাকিটা পড়ে আছে একটা গাছের তলায়।
খবরটা শুনে রাখাল এসে দেখল ব্যাপারটা। কি করবে? তাই সে কিছু না বলে চলে গেল সেখান থেকে। মনে মনে সে বুঝল, নগেন দলুই ভূত হয়ে এইসব কান্ড করছে।
জেলেপাড়ার ফকির আর নিধিরাম একদিন দেখল, নগেনের বাড়ির দরজার কাছে একটা আবছা মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। সারাদেহ তার সাদা কাপড়ে ঢাকা। ওরা চোর ভেবে জিজ্ঞাসা করল, ” ওখানে কে রে?”
বলার সঙ্গে সঙ্গে আবছা মূর্তিটা ঘুরে দাঁড়াল। ওরা আশ্চর্য হয়ে দেখল, লোকটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। শুধু চোখদুটো যেন আগুনের গোলার মতো জ্বলছে। দেখতে দেখতে মূর্তিটা বিরাট লম্বা হয়ে গেল।
এই ব্যাপার দেখে ফকির আর নিধিরাম ভয় পেয়ে, ” ওরে বাবারে গেলুম রে!” বলে ছুটে পালাল প্রাণপণে।
সবার মুখে মুখে খবরটা জানাজানি হয়ে গেল। পাড়ার লোক ভয় পেয়ে সন্ধ্যে সাতটার পর নগেন দলুইয়ের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসা করাই বন্ধ করে দিল।
ফকির জেলে নগেনের ছেলেদুটোকে বললে, ” বাপু, ব্যাপার খুব সুবিধের নয়। তোদের বাপ মরে গিয়ে ভূত হয়েছে। তোরা ছেলেপুলে নিয়ে থাকিস, একটা কিছু ব্যবস্থা কর। তা না হলে কোনওদিন তোদেরও বিপদ হবে।”
নগেনের বড় ছেলেটা ভয় পেয়ে বলল, ” কি ব্যবস্থা করা যায় দেখি চাচা…. মা-ও একদিন দেখেছিল, আমরা তার কথা বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এখন দেখছি বিশ্বাস না করে উপায় নেই।”
নগেনের ছোট ছেলে বলল, ” আমিও সেদিন ভোরের দিকে বাইরে বেরিয়ে সাদা কাপড়ে ঢাকা একটা মূর্তি দেখেছিলাম, কিন্তু সবাই ভয় পাবে বলে কাউকে আর কিছু বলিনি।”
নিধিরাম সব শুনে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল। তারপর গম্ভীরভাবে বলল, ” এখানে তো তেমন ভূতের ওঝাও নেই। তবে শুনেছি মহেশপুরে একজন লোক আছে। সে নাকি ভূত ছাড়ায়, তোরা তার কাছে যা, সে কি বলে দ্যাখ।”
এই পরামর্শ দিয়ে ফকির আর নিধিরাম যে যার বাড়ি চলে গেল।
নগেনের বড় ছেলে তার ছোট ভাইকে বলল, ” মহেশপুর এখান থেকে প্রায় চার ক্রোশের ওপর। যেতে আসতে নয়-দশ ক্রোশ। আজকে তো আর যাওয়া সম্ভব নয়। কাল সকালেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। বিকেলে তাহলে ফিরে আসতে পারব। ” এইভাবে দু-ভাই যুক্তি করল।
সেদিন রাত্রেই ঘটনাটা ঘটল নগেনের বাড়িতে।
রাত্রে খাওয়া দাওয়া সেরে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
রাত তখন প্রায় দুটো -আড়াইটে হবে। হঠাৎ হাঁস মুরগীর ঘরে ঝটপটানি আর কোঁক কোঁক শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল নগেনের বউয়ের।
নগেনের বউ ভাবলে, বোধহয় হাঁস মুরগীর ঘরে শেয়াল ঢুকেছে। এই কথা মনে করে সে একটা হ্যারিকেন আর একটা লাঠি নিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
উঠোনে পা দিতেই সে দেখল, খুব লম্বা একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে উঠোনের মাঝখানে। তার লম্বা লম্বা লিকলিকে হাত দুটোয় দুটো মুরগী , আর সে মুরগী দুটো ছিঁড়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে নগেনের বউ আঁ আঁ করে চিৎকার দিয়ে উঠোনে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।
সেই শব্দ শুনে ছেলে আর ছেলের বৌ রা সব ছুটে এল হ্যারিকেন নিয়ে।
উঠোনের মাঝে মা’কে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে তাড়াতাড়ি জল পাখা নিয়ে এসে সবাই শুশ্রূষা করতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ সেবা শুশ্রূষা করার পর জ্ঞান ফিরে এল নগেনের বউয়ের।
ছেলেরা জিজ্ঞেস করল, ” কি হল মা? তুমি অজ্ঞান হয়ে গেলে কেন? ”
নগেনের বউ তখন হাঁফাতে হাঁফাতে দু এক কথায় ছেলেদের সব ব্যাপারটা বলে, উঠোনের যেখানে কঙ্কালটা দাঁড়িয়ে ছিল, সেই জায়গা ঈশারা করে দেখিয়ে দিল।
সবাই আলো হাতে নিয়ে উঠোনের মাঝখানে গিয়ে দেখল, চারিদিকে মুরগির পালক আর রক্ত ছড়ানো রয়েছে। কিন্তু ধারেকাছে কাউকেই দেখা গেল না।
ছোট ছেলে বলল, ” হয়ত শেয়াল ঢুকে মুরগী খেয়েছে। রাতের অন্ধকারে শেয়ালের চোখদুটো তো দপ দপ করে জ্বলে , মা হয়ত তাই দেখেই ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।”
ছেলেদের কথা শুনে নগেনের বউ বললে, ” তোরা আমার কথা বিশ্বাস করলি না! কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখেছি খুব লম্বা একটা মূর্তি উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। তার সারাদেহ সাদা কাপড়ে ঢাকা। মুখটাও দেখা যাচ্ছে না। চোখদুটো দপদপ করে জ্বলছে। তার লিকলিকে লম্বা হাত দুটোয় দুটো মুরগী…. সে মুরগীদুটো ছিঁড়ে খাচ্ছে।”
এইসব কথাবার্তা হচ্ছে নিজেদের মধ্যে। এমন সময় বাড়ির পেছন দিকে শোনা গেল একটা ভয়ঙ্কর হাসির শব্দ। সেই হাসি শুনলে বুক কাঁপে। সবাই চমকে উঠল। তারা বুঝতে পারল এটা একটা ভৌতিক কান্ড ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
ভয় পেয়ে সবাই ঘরে ঢুকে বসে রইল সকালের অপেক্ষায়।
পরদিন নগেনের বড় ছেলে সাইকেল নিয়ে চলে গেল সেই প্রায় চার ক্রোশ দূরের মহেশপুরের ওঝার বাড়িতে। কিন্তু মুশকিল হল, ওঝা তখন অসুস্থ। নগেনের ছেলে একে একে সবকথা বলল তাকে।
ওঝা সবকথা মন দিয়ে শুনে বলল, ” দ্যাখো বাবা, আমার বয়স হয়েছে। তাছাড়া, আজ এক সপ্তাহের ওপর আমি হাঁটতে পারছি না। একটু সুস্থ হলেই আমি গিয়ে সব ব্যবস্থা করে আসব। এখন বলো তোমাদের ঘরে মোট কতজন লোক? ”
নগেনের ছেলে বললে, ” সবসুদ্ধ আটজন।”
ওঝা বলল, ” আমি তোমায় আটটা তাবিজ দিচ্ছি। কালো সুতোয় বেঁধে হাতে বেঁধে রাখবে। আর গলাতেও বেঁধে রাখবে। আর এই চারটে পেরেক দিচ্ছি, তোমাদের ভিটের চার কোণে পুঁতে দিও। তাহলে সে আর তোমাদের বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে পারবে না।”
এই বলে ওঝা আটটা তাবিজ আর চারটে বড় বড় পেরেক তার হাতে দিল।
পেরেক আর তাবিজ নিয়ে নগেনের বড় ছেলে বিকেলের দিকে ফিরে এল। তারপর ওঝার কথামতো সকলকে মাদুলি পরানো হল, আর পেরেক পুঁতে দেওয়া হল।
সেদিন থেকে নগেন দলুইয়ের বাড়িতে ভূতের উপদ্রব কমে গেছে বটে, কিন্তু গ্রামে উপদ্রব বেড়ে গেল।
গাঁয়ের লোকের ঘর থেকে হাঁস মুরগী আর ছাগল প্রায়ই চুরি হতে লাগল। অন্ধকারে সেই ছায়ামূর্তিকেও দেখল অনেক লোক। তাছাড়া, কারও বাড়িতে গভীর রাতে ইঁট পড়তে থাকে দুমদাম করে। আবার কারও বাড়িতে গরুর হাড়, মোষের হাড়, মানুষের হাড় পড়তে থাকে। আবার কারও ঘরের চালে মড়া পোড়া কাঠ, বাঁশ পড়তে থাকে।
সারা গাঁয়ের লোক ভয়ে কাঠ হয়ে গেল। সন্ধ্যে হতে না হতেই যে যার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ভয়ে রাত কাটাতে লাগল। সন্ধ্যের পর অতবড় গ্রামটা যেন শ্মশানের মতো জনশূন্য মনে হয়।
সেদিন রাত্রে অনেক দূর থেকে একদল লোক একটা মড়া নিয়ে শ্মশানে এল পোড়াতে। লোকগুলো চিতা সাজিয়ে, মড়াটাকে তার ওপর তুলে আগুন দিল। তারপর শবযাত্রীরা একটু দূরে বসে আপন মনে তামাক টানতে লাগল।
এদিকে সেই অবসরে পাশের বটগাছ থেকে লম্বা হাত বাড়িয়ে নগেন মড়াটাকে চিতা থেকে তুলে নিয়ে গাছের ওপর বসে চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে লাগল।
তামাক খেয়ে লোকগুলো চিতার কাছে এসে দেখেই অবাক হয়ে গেল। শুধু চিতাটাই জ্বলছে, মড়ার পাত্তা নেই। লোকগুলো রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল। নদীতে তখন মালপত্র বোঝাই করা বেশ বড় একটা নৌকো বাঁধা ছিল। মাঝি বসে অপেক্ষা করছিল জোয়ারের আশায়। নৌকোর ছাদের ওপর হালের কাছে বসে মাঝি তামাক খাচ্ছিল।
অনেক আগেই সে ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিল; কিন্তু শবযাত্রীরা যখন ভয় পেয়ে ‘ বাঁচাও-বাঁচাও” বলে চেঁচাতে লাগল, আর নৌকোর আলো দেখে সেদিকে ছুটে গেল, তখন নৌকোর মাঝি চেঁচিয়ে বলল, ” ভয় পেয়ো না তোমরা। ওইখানে দাঁড়িয়ে থাকো, আমি যাচ্ছি।”
মাঝির কথা শুনে শবযাত্রীরা সেইখানে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগল।
নৌকোর মাঝিটি ছিল একজন বেশ নামকরা ভূতের ওঝা। সে একটা পুঁটলি হাতে নিয়ে আর এক হাতে হুঁকো নিয়ে নৌকো থেকে নেমে এল শ্মশানে।
লোকগুলোকে তখন মাঝি তার কাছে বসিয়ে বিড়বিড় করে কিসব মন্ত্র বলতে বলতে লোকগুলোর চারপাশে কি সব যেন ছড়িয়ে দিয়ে বসে হুঁকোয় দু একটা টান দিয়ে বলল, ” কোনও ভয় নেই তোমাদের। ভূতের বাবারও সাধ্য নেই যে আর তোমাদের কাছে আসে। আমি গণ্ডি দিয়ে দিয়েছি। যতক্ষণ তোমরা এই গন্ডীর মধ্যে থাকবে, ততক্ষণ তোমাদের ভূতে কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। তারপর সকাল হলে বাড়ি চলে যাবে। দিনের বেলা ভূত মানুষের কাছে আসে না।”
একজন জিজ্ঞাসা করল, ” মড়াটা তাহলে কোথায় গেল?”
মাঝি বলল, ” তাকে চিতা থেকে তুলে নিয়েছে।”
মাঝির কথা শুনে সবাই ভয় পেয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। কারও মুখে আর কথা নেই।
মাঝি বলল, ” হ্যাঁ, তাকে তুলে নিয়েছে।”
ওদের মধ্যে থেকে একজন যুবক বললে, ” আগুনের ভেতর থেকে মড়া তুলে নিল কি করে?”
মাঝি বললে, ” গাছের ওপর থেকে হাত বাড়িয়ে।”
মাঝির কথায় যুবকটি যেন একটু অবজ্ঞার হাসি হাসল।
তাই দেখে মাঝি বলল, ” বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? দেখতে চাও?”
যুবকটি বলল, ” বেশ দেখান, তাহলে বিশ্বাস করব।”
” বেশ, দেখলে অজ্ঞান হয়ে যাবে না তো?”
” এখন যখন হইনি, তখন আর হব না।”
” বেশ তাহলে এসো আমার সঙ্গে। ” এই কথা বলে মাঝি তাদের সঙ্গে নিয়ে বটগাছের ওপর ইশারা করে দেখিয়ে দিল….” ওই দ্যাখো। ”
সকলে দেখল, বটগাছের মগডালের ওপর বসে একটা বীভৎস কঙ্কাল তাদের সেই মড়াটাকে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে! কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য!
ভয় পেয়ে সবাই চোখে হাত চাপা দিয়ে মাঝির কাছে সরে এল।
মাঝি বললে, ” এবার বিশ্বাস হল তো? যাক তোমাদের কোনও ভয় নেই। ও গাছ থেকে নেমে আসতেও পারবে না। আর কোথাও যেতে পারবে না। আমি গাছটাকে গণ্ডি দিয়ে দিয়েছি।”
এই কথা বলে মাঝি হুঁকোটা রেখে, পুঁটলিটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ” তোমরা এখানে চুপচাপ বসে থাকো।”
মাঝিকে চলে যেতে দেখে লোকগুলো ভয়ে কাতরভাবে বলল, ” আপনি আমাদের এভাবে ফেলে রেখে যাবেন না, সকাল হলে তারপর না হয় যাবেন। দয়া করে সকাল পর্যন্ত আপনি অপেক্ষা করুন। ”
মাঝি হেসে বলল, ” ভয় নেই, আপনারা এখানে বসুন। আমি ওর পরিচয় নিয়ে আসছি। ”
মাঝি চলে গেল বটগাছের দিকে। লোকগুলো ভয়ে কাঠ হয়ে বসে রইল। স্পষ্ট শোনা যেতে লাগল,
মাঝি বলছে, ” কে তুই?”
” আমি নগেন দলুই”, ভূতটার খোনা গলা শোনা গেল।
” তোর বাড়ি কোথায়? ”
” বাঁধের ওপারে বাগদিপাড়ায়।”
” বাড়িতে তোর কে আছে?”
” আমার বউ, দুটো ছেলে,তাদের বউ, নাতি নাতনী। ”
” ঠিক আছে, তুই গাছেই বসে থাক। পালাবার চেষ্টা করলেই জ্বলে পুড়ে যাবি। আমি তোকে বেঁধে দিয়ে যাচ্ছি।”
মাঝি আবার লোকগুলোর কাছে ফিরে এল, বললে, ” সকাল হলেই আপনারা গাঁয়ে গিয়ে লোকজনকে ডেকে আনবেন।”
দেখতে দেখতে পূবদিক ফর্সা হয়ে এল। গাছে গাছে পাখি ডেকে উঠল। একটু পরে সকাল হল।
দুজন লোক গাঁয়ে গিয়ে এই সংবাদ দিল। গ্রাম থেকে বহুলোক এল দেখতে। নগেন দলুইয়ের ছেলেদুটোও এল।
সবাই এল বটগাছের নীচে।
গাছের ওপর তখন কিছুই দেখা যাচ্ছে না, শুধু একটা মড়া ঝুলছে দেখা গেল।
মাঝি বললে, ” মড়াটাকে ফেলে দে নগেন”।
সঙ্গে সঙ্গে দমাস করে মড়াটা মাটিতে পড়ে গেল।
সবাই দেখে তো অবাক! মড়ার খানিকটা মাংস কে যেন খুবলে খেয়েছে।
মাঝি বললে, ” নগেনের ভূতই মড়াটাকে চিতা থেকে তুলে গাছে নিয়ে গিয়ে বসে বসে খেয়েছে। দিনের বেলা তো ওদের দেখা যায় না। তা না হলে আমি দেখিয়ে দিতাম।”
মাঝি এবার বিড়বিড় করে কি সব মন্ত্র বলতেই, গাছের ওপর থেকে খনখনে গলায় নগেন বলল, ” এবার আমায় ছেড়ে দে।”
মাঝি বলল, ” তুই একেবারে এদেশ থেকে চলে যাবি।”
নাকিসুরে উত্তর এল, ” না যাব না। আমি এখানেই থাকব।”
” এখানে থাকবি কেন?”
” এখানে আমার বউ ছেলে রয়েছে। তাছাড়া বউটার জন্যেই আমি জলে ঝাঁপ দিয়ে মরেছি। ওকেও আমি ঘাড় মটকে শেষ করব।”
এই কথা শুনে নগেনের ছেলেরা ভয় পেয়ে মাঝিকে বলল, ” দয়া করে আপনি আমাদের রক্ষা করুন।”
মাঝি বললে, ” তোমাদের বাবা ভূত হয়ে কষ্ট পাচ্ছে। শুধু শুধু ওকে কষ্ট দিয়ে লাভ কি?”
নগেনের বড় ছেলেকে মাঝি বললে, ” তুমি গয়ায় গিয়ে ওর নামে পিন্ডি দাও, তাহলেই তোমার বাবা প্রেতযোনি থেকে উদ্ধার পাবে।”
তখন গাঁয়ের একজন বয়স্ক লোক বললে, ” এখন ওরা কি করবে? যদি আজ রাতেই কারোর ঘাড় মটকায় বা গ্রামবাসীদের ক্ষতি করে?”
মাঝি বললে, ” তা পারবে না। আমি গাছেত চারিদিকে গন্ডী দিয়ে যাচ্ছি। ও এই গাছ থেকে কোথাও যেতে পারবে না। সাতদিন এই গাছে ও বন্দী হয়ে থাকবে, তার মধ্যে পিন্ডি দেওয়া না হলে ও আবার গ্রামে গিয়ে উপদ্রব করবে।”
নগেনের ছেলে বলল, ” আমি আজই গয়া রওনা হচ্ছি।”
মাঝি বলল, ” তুই উদ্ধার হলে কি চিহ্ন রেখে যাবি বল?”
এবার কিন্তু কোনও উত্তর এল না, গাছের ওপর থেকে খোনা গলায় চেঁচিয়ে উঠল নগেনের ভূতটা, ” ওরে বাবারে….গেছিরে….জ্বলে মলুম রে।”
মাঝি বলল, ” কি চিহ্ন রেখে যাবি বল?”
নগেনের ভূত বললে, ” দাঁড়াও, দাঁড়াও বলছি।”
এই বলে, একটু থেমে, তারপর বললে, ” এই গাছের একটা মোটা ডাল ভেঙে দিয়ে যাব।”
মাঝি তখন লোকগুলোকে বলল, ” আপনারা মড়াটা নিয়ে গিয়ে এবার পুড়িয়ে দিন। ”
তারপর গ্রামবাসীদের দিকে ফিরে বলল, ” আপনারা ফিরে যান, আজ থেকে আর গাঁয়ে কোনও উপদ্রব করবে না নগেন।”
এই বলে মাঝি ফিরে গেল নৌকোয়।
শবযাত্রীরা আবার নতুন করে চিতা সাজিয়ে আধখাওয়া মড়াটাকে পুড়িয়ে যে যার ঘরে ফিরে গেল।
নগেনের বড়ছেলে রওনা হয়ে গেল গয়ায়। সে যেদিন নগেনের নামে গয়ায় পিন্ডি দিল, সেদিন দুপুরেই মড়মড় করে ভয়ঙ্কর শব্দে বটগাছের একটা ডাল ভেঙে পড়ল। অবাক হয়ে গ্রামবাসীরা দেখল সেই দৃশ্য।
সেদিন থেকে গাঁয়ে আর কোনও ভূতের উপদ্রব রইল না।