সবুজ রঙের দরোজা। অনেককাল আগের।
আট ফিট সাড়ে চার ফিট।
সত্যিকার দরোজা মনে হয়।
বাস্তবে, সত্যিকার না, আঁকানো ছবি।
রিয়েলিস্টিক পেইন্টিং।
এত রিয়েলিস্টিক ছবি আজকাল বাংলাদেশের আর্টিস্টরা আঁকেন না। দরোজার পেইন্টাররাও হয়তো আর আঁকবে না। এটা ক্লাস স্টাডি হিসেবে এঁকেছে। একাডেমিক ওয়ার্ক। ফাইন আর্ট ইনস্টিটিটিউটে পি পি কে ধরতে রেইড দিয়েছিল রেজা ইশতিয়াক। পি পি পড়াশোনা করে বাংলায়। প্রেম করে ফাইন আর্ট ইনস্টিটিউটের থার্ড ইয়ারের সুতপার সঙ্গে। সেই হিসেবে ওই এলাকায় তার অবস্থানের সম্ভাবনা আছে। ফাইন আর্ট ইনস্টিটিউটের বিখ্যাত ঘাসপুকুরের পাড়ে বসে থাকে তারা। কপোত-কপোতী। কপোতকে দরকার রেজা ইশতিয়াকের। ধরে ঠ্যাঙাবে।
এটা অক্টোবর মাসের এক বিকেলের ঘটনা।
মিষ্টি একটা রোদ যাই যাই বিকেল। অল্প অল্প ঠাণ্ডা হাওয়া আর আকাশজুড়ে কিউমুলাস মেঘ।
ফাইন আর্ট ইনস্টিটিউট ঘুরে পি পির সন্ধান পাওয়া গেল না। সুতপা বিবিকেও দেখা গেল না। রেজা ইশতিয়াক দেখল ইনস্টিটিউটের গ্যালারিতে এক্সিবিশন হচ্ছে।
ছাত্রদের অ্যানুয়াল এক্সিবিশন।
একাডেমিক কাজ বলে বেশির ভাগ কাজই রিয়েলিস্টিক। পেন্সিলের কিছু কাজ অসাধারণ। জলরঙের অনেক ছবি দেখেও মুগ্ধ হলো রেজা ইশতিয়াক। সব থেকে মুগ্ধ হলো ‘দরোজার ওপাশে’ পেইন্টিংটা দেখে। রিয়েল সাইজ দরোজা ওয়ালে আঁকা। তারপরও কীরকম একটা ‘ম্যাট’ ভাব আছে ছবিটায়। দর্শক কম গ্যালারিতে। রেজা ইশতিয়াক নীরবভাবে অনেকক্ষণ ধরে ছবিটা দেখল। আর্টিস্টের নাম সারন মুস্তাফী। বিএফএ শেষ বর্ষ।
ছবি বোঝে রেজা ইশতিয়াক। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে পারে পিকাসোর ‘ব্লু পিরিয়ড’ নিয়ে, ভ্যানগখের ‘নাইট ক্যাফে’,কামরুল হাসানের ‘তিন কন্যা’ নিয়ে।
তাকে টানল ‘দরোজার ওপাশে’।
অনেকদিন পর একটা পেইন্টিং তাকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করল।
এই ছেলেকে পাওয়া যাবে কোথায়? সারন মুস্তাফী?
ফাইন আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে বেরিয়ে সুতপাকে ফোন করল রেজা ইশতিয়াক। নাম্বার বিজি। ফোন করল পি পির নাম্বারে। নাম্বার বিজি! কুহু কূজন হচ্ছে তা হলে।
শাহজাহানের দোকানে বসে এক কাপ চা খেল রেজা ইশতিয়াক। একটা গোল্ডলিফ সিগারেট নিল। ধরিয়ে আবার ফোন করল। এবার আর নাম্বার বিজি হলো না। সুতপা ধরল, ‘রেজা ভাই! আপনি কোথায়?’
‘শাহজাহানের দোকানে বসে আছি,মহিলা। আপনি কোথায়?’
‘আমি তো বাসায়।’
‘আপনার কেষ্টঠাকুর?’
‘বলল তো আজিজ মার্কেটে আছে।’
‘ধন্যবাদ, মহিলা। আচ্ছা এখন একটা ইনফরমেশন দেন। আর্টিস্ট সারন মুস্তাফীর সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে? তার ফোন নাম্বারটা দিতে পারবেন?’
‘পারব। কেন, রেজা ভাই?’
‘আমি একটা ফোন করব শালাকে। শুয়োরের বাচ্চা।’
‘এমা! কী হয়েছে? রেজা ভাই?’
‘আপনি কি ‘দরোজার ওপাশে’ দেখেছেন?’
‘সারনদার পেইন্টিং? দেখেছি, কেন?’
‘এত সুন্দর ছবি আঁকে কেউ আর?’
এতক্ষণে হাসল সুতপা, ‘আপনার খুব পছন্দ হয়েছে?’
‘পছন্দ মানে আমি অবসেসড। মনে হচ্ছিল দরোজা খুলে দিলেই ঢুকে পড়া যাবে ভেতরে।’
‘সারনদাকে বলবেন কথাটা। আচ্ছা তার নাম্বারটা আমি এসএমএস করে দিচ্ছি আপনাকে।’
এসএমএস করে দিল সুতপা।
সিগারেটে তিনটা টান দিয়ে নাম্বার ডায়াল করল রেজা ইশতিয়াক।
কেউ ধরল।
বলল, ‘হ্যালো।’
রেজা ইশতিয়াক বলল, ‘সারন… বলছেন?’
‘আপনি কে?’
‘ভাই আমার নাম রেজা ইশতিয়াক।’
‘ও। কী?’
‘আমি ভাই আপনার পেইন্টিংটা দেখলাম। ‘দরোজার ওপাশে’। কী বলব? অসম্ভব ভাল লেগেছে। আপনি কি হোস্টেলে থাকেন?’
‘না, বাসায়।’
‘আমি মানে আপনার সঙ্গে একবার কথা বলতে চেয়েছিলাম।’
‘একবারই?’
হেসে ফেলল রেজা ইশতিয়াক।
সারন মুস্তাফী বলল, ‘আপনি এখন কোথায়?’
‘আমি ভাই আপনাদের ইনস্টিটিউটের সামনের ফুটপাথে। শাহজাহানের দোকানে বসে আছি।’
‘আপনি কি বৃষ্টির ফোঁটা প্রিন্ট করা একটা নীল টি-শার্ট পরে আছেন?’
‘জি, ভাই।’
‘সিগারেট টানছেন?’
‘জি, ভাই।’
‘তা হলে আপনাকে আমি দেখছি। আপনি কি আমাকে দেখছেন? এদিকে তাকান। দেয়ালের এদিকে।’
রেজা ইশতিয়াক তাকিয়ে দেখল ইনস্টিটিউটের দেয়ালের দিকে। আধা বাউল টাইপ এক ছেলে বসে আছে পা ঝুলিয়ে। ফোনে কথা বলছে। গেরুয়া রঙের ফতুয়া পরনে। এই সারন? সারন মুস্তাফী?
এই।
দেয়াল থেকে সে লাফ দিয়ে নামল।
রেজা ইশতিয়াক উঠে দাঁড়াল। চোখ দুটো উজ্জ্বল সারন মুস্তাফীর। দ্যুতিময় এবং বড় বড়।
হ্যান্ডশেক করে তারা বসল।
শাহজাহানকে আবার চা দিতে বলে কোন প্রকার ভূমিকা করল না, স্ট্রেইট কথা বলল রেজা ইশতিয়াক, ‘পেইন্টিংটা কি আপনি বিক্রি করবেন?’
‘কে কিনবে?’ উদাসীন দেখাল সারন মুস্তাফীকে।
‘কেউ কিনলে বিক্রি করবেন? আচ্ছা আপনি কী সিগারেট খান?’
‘গোল্ডলিফ।’
‘আমিও গোল্ডলিফ। শাহজাহানকে আরও দুটা গোল্ডলিফ।—জি, ভাই বলেন।’
সারন বলল, ‘মনে হয় তো—’
‘জি?’
‘বিক্রি করে দেব।’
‘কত টাকা হলে?’
‘আপনি কিনবেন? কত টাকা হলে কিনবেন?’
‘আমার টাকা থাকলে আমি আপনাকে দশ লাখ টাকা দিতাম।’ বলল রেজা ইশতিয়াক। বলে বিরতি নিয়ে সিগারেট ধরাল। সারন এর মধ্যে ধরিয়ে ফেলেছে। বুক ভরে একটা দম দিয়ে হাসল। বলল, ‘এত? এত লাগবে না। আপনি কত টাকা দিতে পারবেন?’
রেজা ইশতিয়াক বলল, ‘পঞ্চাশ হাজার।’
বড় বড় চোখ নির্লিপ্ত থাকল। সারন বলল, ‘ঠিক আছে। এক্সিবিশন কাল শেষ হয়ে যাবে, আপনি এসে নিয়ে যাবেন।’
পরদিন রেজা ইশতিয়াক ব্যাংক থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলল। রাত নয়টায় ‘দরোজার ওপাশে’র হস্তান্তর সম্পন্ন হলো। রাত দশটায় বাসায় ফিরল সে, রেজা ইশতিয়াক। ‘দরোজার ওপাশে’ কোথায় ঝোলাবে? না ঝুলিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখল। সেই থেকে তেমনি আছে পেইন্টিংটা। আরেক ঘরে যাবার দরোজা মনে হয়। মোমের আলোয় আরও বেশি মনে হচ্ছে। ইলেকট্রিসিটি গেছে বেশিক্ষণ হয়নি। দেড়-দুই ঘণ্টার আগে ফিরবে না। মোম জ্বেলে খাটে হেলান দিয়ে একা বসে আছে রেজা ইশতিয়াক। সারন মুস্তাফী-সংক্রান্ত স্মৃতি কম তার। মনে পড়ছে সেই কয়েকটা স্মৃতিই।
‘দরোজার ওপাশে’ কিনবার পরদিন সকালেই ফোন করেছিল
সুতপা, ‘রেজা ভাই!’
‘বলেন মহিলা।’
‘আপনি সারনদার পেইন্টিং কিনেছেন। পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে!’
‘কেন? মানে…’
‘রেজা ভাই, আপনি জানেন না, সারনদা ড্রাগ এডিক্ট! হেরোইন নেয়। পঞ্চাশ হাজার টাকা সে হেরোইন নিয়ে উড়িয়ে দেবে!’
‘কী বলেন, মহিলা?’
‘কেন, তাকে দেখে আপনি বোঝেননি?’
‘না, কিন্তু…’
সুতপার সঙ্গে কথা শেষ করেই সারন মুস্তাফীকে ফোন করেছিল রেজা ইশতিয়াক। অনেকবার ডায়াল করেও পায়নি। ফোনের ডিসপ্লেতে নানারকম হতাশাব্যঞ্জক লেখা দেখেছে—ইউজার বিজি, ফেইলড, নেটওয়ার্ক বিজি, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আশ্চর্য! এটা কী করে সম্ভব? ছেলেটাকে একবারও অসুস্থ, এডিক্ট মনে হয়নি রেজা ইশতিয়াকের। এই রকম একটা ছেলে! এ কেন ড্রাগ এডিক্ট হবে?—নাকি সুতপা ইয়ার্কি করল? ড্রাগ এডিক্ট একটা ছেলেকে চেহারা দেখে বোঝা যাবে না? কথাবার্তায় বোঝা যাবে না?
কিন্তু সে রকম কোনও কিছুই মনে হয়নি রেজা ইশতিয়াকের।
কথাবার্তায় কোনরকম অসংগতি সে ধরতে পারেনি।
‘জীবনানন্দ দাশের একটা কবিতা আছে—’ বলেছিল রেজা ইশতিয়াক।
কথা শেষ করতে পারেনি। সারন বলল, ‘সুবিনয় মুস্তাফী?’
রেজা ইশতিয়াক বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘প্রপিতামহ।’ সারন বলল।
‘কার? আপনার?’
সারন বলল, ‘হ্যাঁ।’
তার সঙ্গে কবিতার একটা চরিত্রের প্রপৌত্র কথা বলেছে!
জীবনানন্দ দাশের কবিতার!
আশ্চর্য!
‘সুবিনয় মুস্তাফী জীবনানন্দ দাশের পোলাপান কালের বন্ধু ছিলেন।’
সারন বলল, ‘জীবনানন্দ দাশের ডাকনাম ছিল মিলু। জীবনানন্দের ভাই অশোকানন্দ। তার ডাকনাম ছিল ভ্যাবলু!’
এসব কি অসংগত কথাবার্তা?
‘সুবিনয় মুস্তাফীর পুত্র হিরন্ময় মুস্তাফী। তার পুত্র অশোক মুস্তাফী। আমি অশোক মুস্তাফীর পুত্র।’
অসংগতি কী আছে এই কথায়?
তবে—
চিন্তিত হয়েছিল রেজা ইশতিয়াক।
সুতপাকে ফোন করেছিল সে।
‘মহিলা আপনি কোথায়?’
‘ইনস্টিটিউটে।’
‘ক্লাসে?’
‘আউটডোর ক্লাস।’
‘পি পি বস কি উপস্থিত হয়েছে?’
‘এখনও না।’
‘এখনও না।’
‘আচ্ছা মহিলা, কাজের কথা বলি। সারন ছেলেটা কি সিরিয়াসলি এডিক্ট?’
‘হ্যাঁ, রেজা ভাই।’
শীত পড়ে গেছে তারপর। ফাইন আর্ট ইনস্টিটিউটে এর মধ্যে কয়েকবার গেছে রেজা ইশতিয়াক। পি পি, সুতপার সঙ্গে দেখা হয়েছে। সারনের সঙ্গে দেখা হয়নি। সে নাকি গেছে পাহাড়ি এলাকায়। শীতকাল পাহাড়ে কাটিয়ে ফিরবে।
ফেরেনি আর।
আর কোনদিন, কখনও ফিরবে না।
জীবনানন্দ দাশের কবিতার আরেকটা চরিত্র হয়ে গেছে সারন মুস্তাফী। মৃত চরিত্র। মরে গেছে ড্রাগ করতে করতে। মৃতদের নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছিলেন জীবনানন্দ। সারন মুস্তাফী মরেছে জোছনায়। এবং কুয়াশায়। তার লাশ কাল ঢাকায় আসবে।
জানাজা হবে ফাইন আর্ট ইনস্টিটিউটে।—সন্ধ্যায় ফোন করেছিল সুতপা। এসব বলেছে। রেজা ইশতিয়াক তখন আজিজ মার্কেটের ‘তক্ষশীলা’য় ছিল। ‘তক্ষশীলা’র বইয়ের র্যাক দেখছিল। নীরদ মজুমদারের ‘পুনশ্চ পায়ী’র রিপ্রিন্ট বেরিয়েছে বলে শুনেছে। পেলে কিনত। প্রথম এডিশনটা ছিল তার কাছে। কোনো এক মার্ক টোয়েন মেরে দিয়েছে। সুতপার ফোন পেয়ে আর ‘পুনশ্চ পায়ী’ খোঁজা হলো না। রেজা ইশতিয়াক কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে থাকল। তারপর বাসায় ফিরে এসেছে। একটু আগে ফোন করেছিল মুনা।
‘তুমি কী করো?’
‘বসে আছি। ইলেকট্রিসিটি নাই।’
‘কতক্ষণ ধরে?’
‘এই তো।
‘তুমি কি ‘লাবণ্যপ্রভা’ দেখো?’
‘হুঁ।’
‘লারা মেয়েটাকে তোমার কেমন মনে হয়? লারা লোটাস?’
‘হুঁ।’
‘অ্যাই তোমার কী হয়েছে?’
‘কিছু না।’
‘কিছু না বললে তো হবে না। তোমার কি মন খারাপ?’
‘হুঁ।’
‘কী হয়েছে?’
‘সারন মুস্তাফী মরে গেছে।’
‘সারন মুস্তাফী। তোমার ‘দরোজার ওপাশে’র আর্টিস্ট?’
‘হুঁ।’
‘কী করে? না থাক। তুমি মনে হয় খুবই আপসেট। আমি পরে আবার ফোন করব, হ্যাঁ। রাখি এখন।’
মুনা বোঝে রেজা ইশতিয়াককে।
অ্যাডের স্ক্রিপ্ট লেখে রেজা ইশতিয়াক। মুনা ব্যাংকার। অ্যাডমেকিং-এর সূত্রে পরিচয় দু’জনের। সেই পরিচয় থেকে এতদূর। তারা বিয়ে করবে সামনের এপ্রিলে।
মুনা আবার ফোন করবে।
রেজা ইশতিয়াক একটা সিগারেট ধরাল।
শীত পড়েছে এই কয়েকদিন ধরে। রাতে জানালা খোলা রাখা যায় না। কুয়াশা আর ঠাণ্ডার দাপটে। রেজা ইশতিয়াক ট্রাউজারস, একটা টি-শার্ট, একটা ফুলশার্ট আর একটা ফুলহাতা সোয়েটার পরে বসে আছে। সে একটু শীতকাতুরে আছে। সিগারেট টানতে টানতে সে মোমবাতির আলো দেখল। মোম অর্ধেক হয়ে গেছে এর মধ্যেই। আর মোম আছে ঘরে? প্যাকেট থাকার কথা ফ্রিজের ওপরে। থাক এখন! আগে এই মোম শেষ হোক।
কতক্ষণ পুড়ে একটা মোম মরে?
মোমের মতো আয়ু মানুষের।
সুইসাইড করল সারন মুস্তাফী?
এ ছাড়া কী আর!
সারন মুস্তাফীর নাম্বার তার ফোনের ফোনবুকে সেইভ করা আছে। ফোন করল রেজা ইশতিয়াক। একবার, দুবার, কয়েকবার।
কে ধরবে?
রেজা ইশতিয়াক সিগারেটে টান দিতে গিয়ে দেখল সিগারেট নিভে বসে আছে কখন! শীতকালের একটা মেজর সমস্যা। সিগারেট ‘ড্যাম’ মেরে যায়।
সে কি আরেকটা সিগারেট ধরাবে?
না।
ঝিম মেরে বসে থাকল গুটিয়েসুটিয়ে।
মুনা ফোন করছে না কেন?
‘দরোজার ওপাশে’ মুনারও পছন্দ।
দরোজার ওপাশে!
দরোজার ওপাশে কী?
পেইন্টিংটা দেখল রেজা ইশতিয়াক।
মোমের ম্লান আলো দরোজায় পড়েছে।
দরোজার সবুজ রং কেমন একটা অন্যরকম সবুজ দেখাচ্ছে।
‘রেজা ভাই!’
কে ডাকল?
নাকি ডাকেনি?
‘ও, রেজা ভাই!’
না, ডাকছে!
কে ডাকছে? কোত্থেকে ডাকছে?
এদিক-ওদিক তাকাল রেজা ইশতিয়াক । কাকে দেখবে বা কী দেখবে? কিছুই দেখল না।
‘রেজা ভাই! ও, রেজা ভাই!’
রেজা ইশতিয়াক বলল, ‘কে?’
‘রেজা ভাই, আমি। আমি সারন।’
কী? সারন? সারন মুস্তাফী?
রেজা ইশতিয়াকের মনে হলো তার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে?
সারন মুস্তাফী তাকে কোত্থেকে ডাকবে? কী করে?
কিন্তু আবার।
কোথাও থেকে ডাকল সারন মুস্তাফী, ‘রেজা ভাই!’
কানে আঙুল দিল রেজা ইশতিয়াক। ভুল শুনছে সে! অবশ্যই ভুল!
না, ভুল নয়।
আবার ডাকল সারন মুস্তাফী, ‘রেজা ভাই, শুনছেন?’
রেজা ইশতিয়াক বলল, ‘আপনি কোথায়?’
‘দরোজার এপাশে।’
‘কী?’
‘দরোজার এপাশে, রেজা ভাই। দরোজাটা একটু খুলে দিন না!’
রেজা ইশতিয়াক বলল, ‘দরোজার ওপাশে?’
‘এই দরোজার এপাশে, রেজা ভাই।’
কোন্ দরোজা?
…আরে লেখাটা কীসের? ক্যালিগ্রাফি : ‘ এক্সিবিশনের দিন।’ এটা কোত্থেকে এল পেইন্টিংয়ে? দেখা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে না।
…কিন্তু সারন কি এই পেইন্টিং-এর দরোজার কথা বলছে?
এই দরোজা রেজা ইশতিয়াক কী করে খুলবে? তার মানে হলো, সে কি সম্মোহিত হয়ে পড়েছে? সম্মোহিত মানুষের মতো সে উঠল। পেইন্টিং-এর দরোজার শিকল আটকানো। মনে হচ্ছে ছবিটা থ্রি ডি। দরোজার কপাট , সবুজ রং, শিকল।
‘ও, রেজা ভাই!’
এখন মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি দরোজার ওপাশে আছে সারন মুস্তাফী।
সবুজ দরোজা আটকানো শিকলে হাত দিল রেজা ইশতিয়াক এবং শিকল খুলে দিল! পেইন্টিং-এর দরোজার শিকল!
নিঃশব্দে খুলে গেল দরোজা।
রেজা ইশতিয়াক ভাবল, তার মগজের কিছু একটা অংশ জমে বরফ হয়ে গেছে মনে হয়। সে কিছু চিন্তা করতে পারছে না।
দরোজার ওপাশে কোনও ঘর না, একটা প্যাসেজ। সারন মুস্তাফীকে দেখা গেল না। কিন্তু আবার সে ডাকল, ‘রেজা ভাই!’
নিশির ডাকের মতো শোনাল ডাকটা। নিশিতে পেয়েছে এ রকম দেখাল ঘোরগ্রস্ত রেজা ইশতিয়াককে। সবুজ দরোজার চৌকাঠ পেরিয়ে ঢুকে পড়ল সে। সারন ডাকল প্যাসেজের অন্যপ্রান্ত থেকে, ‘রেজা ভাই!’
কতক্ষণ হাঁটল রেজা ইশতিয়াক?
এক মিনিট? দেড় মিনিট?
প্যাসেজ ধরে হাঁটল।
প্যাসেজ শেষ হয়েছে আরেকটা দরোজায়।
এই দরোজার রং-ও সবুজ। বিবর্ণ সবুজ।
দরোজা ভেজানো।
কোত্থেকে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া এসে দরোজার একটা পাট খুলে দিয়ে গেল।—এই দরোজার ওপাশে ঘর। পঁচিশ ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে ঘরে? রেজা ইশতিয়াক ঘরের খানিকটা দেখল। কাগজপত্র ক্যানভাস রং আর সিগারেটের ফিল্টার।—ছড়ানো ফ্লোরময়। এটা সারন মুস্তাফীর ঘর?
রেজা ইশতিয়াক ডাকল, ‘সারন!’
‘রেজা ভাই!’
ঘরে ঢুকল রেজা ইশতিয়াক।
পুরনো একটা ক্যাম্প খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে সারন। সারন মুস্তাফী। রেজা ইশতিয়াক বড় বড় চোখ দুটো দেখল। চোখের মণি আশ্চর্য নীল হয়ে আছে সারন মুস্তাফীর।…না সবুজ।…না হলুদ।…না কমলা…
‘আপনার কাছে সিগারেট আছে, রেজা ভাই?’
এখন চোখের মণি ফ্লুরোসেন্ট রেড।
‘রেজা ভাই!’ বলে হাসল সারন মুস্তাফী। নিঃশব্দ হাসল, সিগারেট।’
এখন চোখের মণি পার্পল।
সম্বিত ফিরল রেজা ইশতিয়াকের?
মগজের ঠাণ্ডা কিছুটা কমল?
সে চিন্তা করল, কী হচ্ছে? সে এই ঘরে কেন?
সারন মুস্তাফী বলল, ‘দেন না একটা সিগারেট টানি।’
সিগারেটের প্যাকেট আছে পকেটে।
কী করবে রেজা ইশতিয়াক?
ঘুরে একটা দৌড় দিল সে।
এছাড়া আর কী করবে? এক দৌড়ে ঘর, প্যাসেজ পেরিয়ে পেইন্টিং-এর দরোজার কাছে এসে থামল। দম নিল। দরোজা ভেজানো? না। সে ধাক্কা দিল দরোজার কপাটে। দরোজা খুলল না। অথচ ভেতর থেকে আটকানো হয়নি। তা হলে? তা হলে কী? দরোজার ওপাশ থেকে কেউ দরোজার শিকল তুলে দিয়েছে? কে?
ঠাণ্ডা লাগল রেজা ইশতিয়াকের। এমন ঠাণ্ডা, মনে হলো তার সমস্ত রক্তকণিকা জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে। দরোজা ধরে সে টানল, ধাক্কাল।
অনড় থাকল সবুজ পুরানো দরোজা।
কে এই কাজটা করল?
মোবাইল ফোন আছে না ট্রাউজারসের পকেটে? এতক্ষণে মনে পড়ল এবং ফোনটা বের করল রেজা ইশতিয়াক। কিন্তু ফোনের ডিসপ্লে ‘সাদা’ হয়ে আছে। ফোন ডেড। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও ডিসপ্লেতে একটা অক্ষর দেখা গেল না। অথচ চার্জ ফুরানোর কথা নয়। ব্যাটারি ডাউন হওয়ার কথা না। সেটটা সে আট-নয়দিন হলো নিয়েছে। তা হলে?—সারন কি আছে দরোজার ওপাশে? মনে হলো রেজা ইশতিয়াকের। সারন মুস্তাফী?
রেজা ইশতিয়াক ডাকল, ‘সারন!’
‘রেজা ভাই!’ উত্তর দিল সারন। দরোজার ওপাশ থেকে উত্তর দিল, তা হলে? প্যাসেজের শেষ প্রান্তের ঘরে কাকে দেখে এল রেজা ইশতিয়াক?
সারন বলল, ‘ও, রেজা ভাই!’
রেজা ইশতিয়াক বলল ‘সারন। দরজাটা একটু খুলে দেবেন প্লিজ!’
‘না, রেজা ভাই, খুলব না।’
এই কথা বলে সারন কি হাসল?
চাপা গলায় হাসল।
রেজা ইশতিয়াক আবার ডাকল, ‘সারন!’
‘সরি, রেজা ভাই!’ সারন বলল। অসম্ভব ঠাণ্ডা একটা অপার্থিব গলা বলল।
রক্তকণিকা এবং নিউরনে ঠাণ্ডা, রেজা ইশতিয়াক বন্ধ সবুজ দরোজা দেখল। তা হলে আটকা পড়ে গেছে সে? দরোজার এপাশে? সারন মুস্তাফী দরোজা খুলবে না।…তা হলে এখন?
পায়ের শব্দ।
স্লো মোশনে ঘুরল রেজা ইশতিয়াক। সারনকে দেখল। প্যাসেজে, অদূরে। তা হলে দরোজার ওপাশে কে? দরোজা কে আটকে দিয়েছে?
অল্পদূরে এখন সারন মুস্তাফী। রেজা ইশতিয়াক তাকে দেখছে। দেখছে। দেখছে।
কথা বলল সারন মুস্তাফী। অসম্ভব ঠাণ্ডা একটা করুণ, কাতর, অপার্থিব গলা ফিসফিস করে বলল, ‘রেজা ভাই, সিগারেট দিলেন না!’
………………………………………….(সমাপ্ত)………………………………………..