সেদিন, তখন বোধহয় রাত্রি ন’টা, জানালায় দাঁড়িয়ে বাইরের অঝোরে ঝরতে থাকা রিমঝিম বৃষ্টি দেখছি। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার, নিচ্ছিদ্র রাত। এরই মধ্যে হঠাৎ চোখে পড়ল জিনিসটা। বাইরের দরোজাটা কেমন যেন নড়ছে না? হ্যাঁ, ওই তো ধীরে ধীরে খুলে গেল পাল্লা দুটো। কে এল রে বাবা, এখন আবার! চারদিকে অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি, এর মধ্যে…, ওহ,… ওর কথা তো মনেই নেই, হয়তো হানিফ এসেছে। নাহ্, এই ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা গেল না দেখছি।
ওই তো হানিফই, কিন্তু টলছে কেন ও?
তাড়াতাড়ি বাইরে এলাম আমি। কিন্তু কই? কেউ তো নেই এখানে! চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। বাগানের মধ্যে আলকাতরার মতো অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। তবে কি এত সব ভুল দেখলাম আমি!
ঘরে ফিরে আসছি। এরই মধ্যে ভিজে প্রায় জবজবে অবস্থা। বারান্দায় উঠতেই দেখি বড় আম্মা বেরিয়ে এসেছেন। আমাকে দেখেই প্রশ্ন করলেন, ‘কি রে, হানিফ এসেছে?’
‘কই, না তো!’ অবাক হয়ে জবাব দিলাম।
আমার কথায় যেন বিস্মিত হলেন বড় আম্মা।
‘সে কি! তাহলে আমাদের দরোজায় টোকা মেরে গেল কে? তুই?’
‘উঁহু,’ ফের মাথা ঝাঁকালাম আমি।
‘কিন্তু, কিন্তু আমার মনে হলো যেন হানিফ এসে করুণ স্বরে ডাকছে আমাকে।’
‘আমারও তো মনে হয়েছিল ও বাইরের দরোজা খুলে এগিয়ে আসছে,’ তাজ্জাব কণ্ঠে বললাম আমি। ‘কিন্তু বাগানে বেরিয়ে দেখি কেউ নেই।’
আমার কথা শুনে চিন্তা বেড়ে গেল বড় আম্মার। তাঁকে সান্ত্বনা দেয়ার সুরে বোঝালাম, হয়তো হানিফ কোথাও বৃষ্টি-বাদলের জন্য আটকে পড়েছে। বৃষ্টি থামলেই চলে আসবে। আর আমরা যেসব দেখেছি অথবা শুনেছি, সেসব মনের ভুল।
কক্সবাজারে অবস্থিত এই প্রকাণ্ড বাগানবাড়িটি আমার নানুর একান্তই নিজস্ব। মনের মতো করে এখানকার গোলাপ বাগিচাটি সাজিয়ে তুলেছেন তিনি। বছরে একবার ঘুরতে আসি আমরা। এবারে এসেছি আমি, বড় আম্মা আর তাঁর ছেলে হানিফ। প্রায় মাসখানেক রয়েছি। এই সামনের হপ্তা নাগাদ চলে যাবার কথাবার্তা চলছে।
একটু দুরন্ত প্রকৃতির ছেলে হানিফ। মারমুখী। বড় ছোট, কারও কথাই কানে তোলে না। নিজে যা বুঝবে, তাই করবে। ওর জন্য ভীষণ অশান্তির মধ্যে দিয়ে দিন কাটে বড় আম্মার। আজ এর সঙ্গে, কাল ওর সঙ্গে মারামারি লেগেই আছে। আমিও আর বুঝিয়ে পারি না।
বৃষ্টির ছন্দনৃত্য দেখার সৌভাগ্য সে রাতে মাথায় উঠল। রাত বেড়েই চলেছে, চারদিকে গিজগিজ করছে ভেজা ভেজা অন্ধকার। অথচ এখনও হানিফের ফেরার নাম নেই। তবে কি এখানে এসেও কারও সাথে হাতাহাতি করে বসল? নাহ্, আজকের দিনটা ওর সাথে থাকা উচিত ছিল আমার।
মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। এর মধ্যে ওকে কোথায় খুঁজতে বেরোব? এদিকে বড় আম্মা, নানু, নানী সকলেরই শোচনীয় অবস্থা। উপায় না দেখে মালিকেই পাঠিয়ে দিলাম। যত দূরে এবং যেখানে যেখানে পারা যায় খোঁজ করে চিন্তিত মুখে বাড়ি ফিরে এল সে। কোথাও পাওয়া যায়নি হানিফকে।
পরদিন সকালে হানিফের খোঁজে লেগে গেল সবাই। এদিক-সেদিক খুঁজে বেড়ালাম আমিও। যদি কোথাও পাওয়া যায় হানিফকে। কিন্তু সকলের শ্রমই বৃথা। কোথাও পাওয়া গেল না ওকে। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে একটা জলজ্যান্ত আস্ত মানুষ।
সেদিন রাতেও যা ঘটল তা আগের রাতেরই পুনরাবৃত্তি।
বৃষ্টি ভেজা রাত। বসে আছি। এমন সময় দেখলাম, বাইরের দরোজা নড়েচড়ে খুলে গেল। অস্পষ্ট একটা ছায়ামূর্তি যেন টলতে টলতে ঢুকে পড়ল ভিতরে। উঠে দাঁড়তে যাব আমি, ঠিক তখনি গোলাপ বাগিচায় ঢুকে অন্ধকারে মিশে গেল মূর্তিটা।
মিনিট দশেক পরেই আমাকে চমকে দিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে ঘরে ঢুকলেন বড় আম্মা। ‘কি রে, হানিফ কোথায়?’
তাঁর কথা শুনে বিষম খাবার উপক্রম হলো যেন আমার। চোখ গোল গোল করে বললাম, ‘তার মানে?’
‘সে কি! হানিফ এ ঘরে আসেনি?’ বড় আম্মার চোখ বিস্ফারিত।
‘কই না তো।’ জবাব দিলাম আমি।
‘কিন্তু ও যে আমার দরোজায় টোকা দিয়ে বলে গেল, ‘‘মা জলদি এসো, আমি মিনহাজের ঘরে আ…আছি।’’’ গলা কাঁপছে বড় আম্মার।
গোটা ব্যাপারটাই ভীষণভাবে তোলপাড় করে গেল আমাকে। কি হতে পারে এ ঘটনার ব্যাখ্যা? শোনার ভুল? কিন্তু আমিও তো বড় আম্মার মতোই আজ যা দেখেছি সেটা গতকালেরই পুনরাবৃত্তি…।
এসব যখন ভাবছি তখন রাত বারোটা। ঘুম আসছে না। দুশ্চিন্তায় শুধু এদিক-ওদিক করছি। ঠিক এমনি সময় অনুভব করলাম ঠাণ্ডা একটা স্পর্শ যেন আমার নিজস্ব অস্তিত্বটাকে ক্রমশ গ্রাস করে চলেছে। ঠেলে নিয়ে যেতে চাইছে আমাকে। কি ঘটতে চলেছে বুঝতে পারছি আমি, কিন্তু বাধা দেবার এতটুকু শক্তি আমার নেই।
হাঁটছি। ধীর পায়ে দরোজা খুলে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। চারদিকে একবার সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম সন্তর্পণে।
প্রায় মাইলখানেক চলে এসেছি আমি। গাঢ় আঁধার চারদিকে। হঠাৎ মনে হলো, কারা যেন চেঁচামেচি করছে। একটু ভাল করে শুনতেই বুঝতে পারলাম চেঁচামেচি নয়, জঘন্য বিকৃত সুরে গান ধরেছে উপজাতীয় অসভ্যগুলো। কেউ কেউ হাততালি দিচ্ছে, নাচছে। আশ্চর্য! আমি ওদের এত কাছে দাঁড়িয়েছি অথচ ফিরেই তাকাচ্ছে না এদিকে। নিশ্চয় গাঁজার নেশায় উন্মত্ত হয়ে করছে এসব।
কিন্তু এ কি! আমি এখানে দাঁড়িয়ে কেন? এখন আর পিঠের সেই শীতল স্পর্শটা নেই। যেন গায়েব হয়ে গেছে। অন্ধকার বন-জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি। শিরশির করে উঠল শরীর। খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে গেল মাথার চুল।
ফিরে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছি। এমন সময়ই চোখে পড়ল কুয়োটা। কিন্তু সেই মুহূর্তে ওসব পাত্তা দেয়ার সময় নেই আমার। ছুটে পালাতে পারলে বাঁচি। হঠাৎ অনুভব করলাম, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক তাই, আমার পিঠের সেই শীতল স্পর্শ। যেন বাড়ির দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে চাইছে আমাকে।
পরদিন সকালে উঠে, সতেজ হয়েই ফের ছুটলাম গত রাতের সেই জায়গাটায়। বিশেষ করে ওই কুয়োটা যেন বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকছিল আমাকে। স্থির হয়ে বসতে পারছিলাম না কিছুতেই।
কুয়োটার কাছে আসতেই চোখে পড়ল একটা লোককে। ঝুঁকে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে। বুড়ো, উপজাতীয় লোকটার বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি। একে চিনি আমি। নাম কুফুয়া। এরই এক ছেলেকে বাগিচায় ফুল তোলার অপরাধে বেধড়ক পিটিয়েছিল হানিফ।
পায়ের শব্দ পেতেই ঘুরে তাকাল বুড়ো। চমকে উঠলাম আমি। কি ব্যাপার, অমনভাবে চেয়ে রয়েছে কেন বুড়োটা? উফ্ঃ! কি জঘন্য দৃষ্টি! যেন, যেন আমার বুক চিরে কলিজার ভিতর বাসা বাঁধার চেষ্টা করছে কুফুয়া। ওর চোখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন হয়ে গেলাম আমি। ঝিমঝিম করছে মাথাটা। বমিবমি লাগছে। হার্টবিট বেড়ে গেছে। হাঁসফাঁস করছে বুক। বেশিক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না আমি। পড়ে গেলাম মাটিতে।
‘অ্যাই মিনহাজ, আমি এখানে!’
আচমকা একটা মিনমিনে কণ্ঠস্বর চমকে দিল আমাকে। কে যেন কথা বলল মনে হলো! চোখ তুলে তাকাতেই দেখি উপজাতীয় শকুনটা এখনও তীব্র দৃষ্টিতে ঝাঁঝরা করে চলেছে আমাকে। আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভা ঝরছে যেন সেই ক্রূর দৃষ্টিতে।
কিন্তু কেউ নাম নিয়েছে আমার। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। গলাটা চিনতে পেরেছি আমি। হানিফের গলা। ওই একমাত্র পুরো নামে ডাকে আমাকে, অন্যরা সকলেই মিনু বলে ডাকে।
আস্তে আস্তে পা ফেললাম আমি। কুয়োটা যেন একটা অদৃশ্য আকর্ষণে এগিয়ে নিয়ে চলেছে আমাকে তার দিকে। প্রাণপণ দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ আমি। পারছি না কিছুতেই। এগিয়েই চলেছি।
এসে দাঁড়ালাম কুয়োটার সামনে। কে যেন জোর করে নিচু করে দিল আমার ঘাড়টা। সম্মোহনী শক্তি? স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম যা কিছু ঘটছে সবই আমার অনিচ্ছায়। বাইরের কোন অশুভ শক্তি ভিতরে জাঁকিয়ে বসেছে আমার।
কিন্তু নিচের দিকে চোখ পড়তেই কেমন যেন সন্দেহ আমার। মনে হচ্ছে, কিছু একটা ভাসছে পানির ভিতর। অন্ধকারে সঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ঝাপসা লাগছে।
মন্থর গতিতে কুয়োর ভিতরে পাশেই ঝুলে থাকা একটা বালতি নামিয়ে দিলাম আমি। আর ঠিক পরক্ষণেই যেটা উঠে এল বালতির ভিতর সেটা আর অন্য কিছু নয়, একটা কাটা রোমশ হাত। বালতিটাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে নির্জীব অঙ্গটা। দেখেই আঁতকে উঠলাম আমি। হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে যেন ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইল বাইরে। ব্যাপারটা যদি বাস্তবই হয়ে থাকে তবে ওটা আর কারও নয়, স্বয়ং হানিফেরই হাত। কনুই থেকে কেটে নেয়া একটা রক্তাক্ত অংশ মাত্র।
সাঁৎ করে ঘুরে তাকালাম আমি। কিন্তু কোত্থাও চোখে পড়ল না উপজাতীয় কুফুয়াকে। বুঝতে পারলাম, ছেলেকে মারার প্রতিশোধ নিয়েছে বুড়ো। একে একে হানিফের প্রতিটি অঙ্গ কেটে কেটে ফেলে দিয়েছে পানির ভিতর। আর এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছে ওই বিষাক্ত চোখ দুটো। সম্মোহনী শক্তি আছে তার। হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক তাই। প্রতিশোধ নিয়েছে বুড়ো, ছেলেকে মারার চরম প্রতিশোধ।
……………………………………………(সমাপ্ত)…………………………………