পোল্যান্ডের টাটরা পর্বতমালার কোলে, একটি গাঁয়ে বাস করত এক বনপাল। তার সঙ্গে থাকত তার স্ত্রী এবং দুই ছেলেমেয়ে। চারজনের সংসার নিয়ে বেশ সুখেই ছিল বনপাল। সন্তানদেরকে সে পাগলের মতো ভালবাসত।
গরমের সময় ছেলেমেয়েরা তাদের দুই কামরার কাঠের কুটিরের সামনে খেলা করত। তাদের মা জানালার ধারে বসে উল বুনত কিংবা সেলাই করত। আর তাদের বাবা যেত বিশাল পাইনের জঙ্গলে কাজ করতে। প্রকাণ্ড পর্বতশ্রেণীর পুব থেকে উত্তর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এ সবুজ গহীন অরণ্য।
গ্রীষ্মের পরে এবারে একটু তাড়াতাড়িই যেন হামলা চালাল শীত। ছোট হয়ে এল দিন। অন্ধকার গ্রাস করল দিনগুলোকে। শোঁ শোঁ শব্দে বইতে লাগল হাড় কাঁপানো বাতাস, তুষারে ঢেকে গেল ওদের বাড়ি, জমিন ও গাছপালা।
প্রথমে পুকুর তারপর নদীর পানি জমে বরফ হয়ে গেল। আর সেই সঙ্গে বেড়ে চলল ঠাণ্ডা। সঙ্গে অনবরত তুষারপাত তো রয়েছেই। একদিন জঙ্গল থেকে ভেসে এল দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানো নেকড়ের ডাক। দিনে সংক্ষিপ্ত আলোয় বাইরের কাজ সারতে লাগল পুরুষেরা। বনপাল কিংবা গাঁয়ের অন্য কেউ একা একা বনে ঢুকতে সাহস পেত না। সন্ধ্যার আগেই তারা ফিরে আসে বাড়িতে, দরোজা-জানালা শক্তভাবে বন্ধ করে বসে থাকে ঘরে।
শীতের কামড় বাড়ছে, সেই সঙ্গে বেড়ে চলছে শিকারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়া ক্ষুধার্ত নেকড়ের পালের ডাক। খরগোশ, চলাফেরায় অসমর্থ বুড়ো ভল্লুক, শেয়াল কিংবা আহত কোন হরিণ তাদের শিকারের প্রধান লক্ষ্য। তবে এসব শিকার না মিললে তারা গাঁয়ে ঢোকারও সাহস করে। ভোরের প্রথম ম্লান আলোয় গ্রামবাসী বরফের গায়ে নেকড়ের পায়ের ছাপ ফুটে থাকতে দেখে। তারা দ্রুত সেলার কিংবা বাইরের ঘরে গিয়ে খোঁজ নেয় গৃহপালিত শূকর, হাঁস ও মুরগিগুলোর সংখ্যা গেছে কিনা।
প্রতি বছরই দীর্ঘ শীত থুত্থুড়ে বুড়ো কিংবা অল্প বয়েসী কোনও বাচ্চাকে কেড়ে নেয়।
বসন্ত আসি আসি করছে, এমন একদিনে, মেয়েটির বয়স তখন নয়, ছেলেটির সাত, তাদের মা অসুস্থ হয়ে পড়ল এবং মারা গেল।
‘এখন আমাদের কী হবে?’ স্ত্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষে বাড়ি ফিরে বিলাপ করে উঠল বনপাল।
‘আমি তোমার থলেতে খানিকটা রুটি আর ছাগলের দুধের পনির ভরে দিয়েছি,’ বলল ছোট মেয়েটি। ‘কুড়োলটা নিয়ে জঙ্গলে যাও। আগে যেভাবে কাজ করছিলে সেভাবে করে যাও।’ আমি আর আমার ভাই মিলে তোমার সেবা করব, ঘরবাড়ির যত্ন নেব, দেখে রাখব হাঁস-মুরগিগুলোকে।’
এতটুকুন বাচ্চা এসব কাজ করতে পারবে কিনা, সে ব্যাপারে সন্দিহান বনপাল। তবু মেয়ের কথামতো কাজ করল সে। বুকে পাথর চেপে সে জঙ্গলে গেল, কাজ শেষে শোকাকুল হৃদয়ে ফিরে এল বাড়িতে। দরোজা খুলেই মেঝে চমৎকারভাবে ঝাঁট দেয়া, পরিপাটি করে পেতে রাখা হয়েছে বিছানা, লোহার কড়াইয়ে টগবগ ফুটছে সুপ। সে তার বাচ্চাদের বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল।
‘তোমাদের মা’র অভাব জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত অনুভব করব আমি,’ বলল বনপাল। ‘তবে আমরা একসঙ্গে থাকলে আশা করি খুব বেশি কষ্ট আমাদের হবে না।’
‘মা’র জন্য আমার খুব কষ্ট হয়,’ রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে বড় বোনকে বলল ছোট ভাই। ‘আমার কি সবসময় এ রকম কষ্ট হতে থাকবে?’
‘এক সময় কষ্টটা কমে যাবে,’ ভাইকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল বোন।
মা হারানোর বেদনা প্রকটভাবে বিঁধছিল দু’ভাইবোনের বুকে, তবে বাড়িতে এবং মাঠে দু’জনকেই কঠোর পরিশ্রম করতে হয় বলে আস্তে আস্তে শোকের মাত্রাটা কখন কমে আসছিল ওরা নিজেরাও টের পাচ্ছিল না। আগের মতো আর তীক্ষ্ণভাবে মায়ের অনুপস্থিতি ওরা অনুভব করে না।
শীতকালের জন্য ওরা ওদের মা’র মতোই প্রস্তুতি নিল। শাকপাতা, বেরী, মাশরুম ইত্যাদি জোগাড় করে রাখল, নিজেদের ভাগের মাংস শুকিয়ে রাখল লবণ দিয়ে। শীতের সময় তেমন শিকার নাও মিলতে পারে—এ আশঙ্কায় গ্রামবাসীদের কয়েকজন উদ্যোগী হয়ে কয়েকটি পশুপাখি জবাই করে পড়শীদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছে।
গাঁয়ের পুকুর থেকে শেষ কার্প মাছটি ধরা হলো, জমাট বাঁধার আগেই নদী থেকে তুলে আনা হলো শেষ ট্রাউট মাছটি। আবার হাড় কাঁপানো বাতাস ধেয়ে এল উত্তর থেকে, সঙ্গে ঘূর্ণায়মান তুষার। ক্ষুধার্ত নেকড়ের দল রাতের বেলা ক্রমে এগিয়ে আসতে লাগল গাঁয়ের দিকে খিদের জ্বালায়।
এক সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেল বনপালের। গাঁয়ের ধর্মযাজক মিটিং ডেকেছিলেন অভিভাবকহীন একটি পরিবারকে কে দেখাশোনা করবে তার ব্যবস্থা নিতে। বনপাল ঘরে ঢুকে দেখে তার ছেলেমেয়েরা রান্নাঘরের চুল্লির সামনে খড়ের মাদুরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। সে বাচ্চাদের গায়ে কম্বল টেনে দিল। তারপর নিঃশব্দে ঢুকল নিজের ঘরে। বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়ল।
হঠাৎ একটা অস্বস্তি নিয়ে ঘুম ভেঙে গেল বনপালের। উঠে বসল বিছানায়। বুঝতে পারছে না ঘরে এত আলো এল কোত্থেকে। ভারী কাঠের দরোজায় খিল এঁটে দিলেও সে ছোট্ট জানালাটির খড়খড়ি নামাতে ভুলে গেছে। খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে। থৈ থৈ আলোয় ভাসছে ঘর।
বনপাল জানালা দিয়ে চাঁদের দিকে তাকাল। তার মনে হচ্ছে এত বড় এবং সুন্দর চাঁদ সে জীবনে দেখেনি। হঠাৎ আলোর রশ্মি বাধা পেল। প্রকাণ্ড একটা মাথা উদয় হয়েছে জানালার সামনে, জোছনা ঢুকতে পারছে না। রোমশ, সাদা মাথাটা বিশালদেহী কোন জানোয়ারের। লাল জ্বলজ্বলে একজোড়া চোখ, সে প্রথমে একটি থাবা রাখল জানালার গরাদে, তারপর অপরটি। বনপালের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে বুঝতে পেরে জানোয়ারটা মাথা পেছন দিকে হেলিয়ে মৃদু গলায় হাঁক ছাড়ল।
‘নেকড়ে!’ আঁতকে উঠল বনপাল। লাফ মেরে নেমে এল বিছানা থেকে, দ্রুত পরে নিল জামাকাপড়, পায়ে গলাল বুটজুতো, তারপর একহাতে লণ্ঠন, অপর হাতে বন্দুক নিয়ে পা বাড়াল রান্নাঘরে। দরোজার ভারী হুড়কো খুলতে যাচ্ছে, শব্দে জেগে গেল তার মেয়ে।
‘কী হয়েছে, বাবা?’ ঘুম ঘুম চোখে জানতে চাইল সে।
‘নেকড়ে। বিরাট সাদা একটা নেকড়ে। আমি বাইরে যাচ্ছি ওটাকে গুলি করে মারব। তুমি দরোজা বন্ধ করে দাও, মা।’
‘বাবা, এত রাতে তোমাকে একা বাইরে যেতে দেব না,’ কেঁদে উঠল ছোট মেয়েটি। কিন্তু তার বাবা তার নিষেধ মানল না। সে লণ্ঠন হাতে চিৎকার করতে করতে ছুটল। ঢুকে পড়ল বনভূমিতে। দূর থেকে ভেসে এল নেকড়ের ভৌতিক ডাক। গা ছমছম করে উঠল ছোট মেয়েটির।
দরোজার হুড়কো লাগিয়ে দিল সে। তারপর রান্নাঘরের জানালার খড়খড়ি তুলে চাঁদনী রাতটাকে দেখল ভয়ে ভয়ে। জানালার সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার সাহস হলো না তার। ফিরে এল বিছানায়।
বাবার অপেক্ষায় বসে রইল।
জঙ্গলের অনেক ভেতরে চলে এসেছে বনপাল। এদিকে পাইন গাছের শাখায় জমাট বেঁধে রয়েছে তুষার, জমিনের বরফের গায়ে ফুটে আছে সাদা নেকড়ের পায়ের ছাপ। এতক্ষণ চাঁদের আলোয় পরিষ্কার চেনা যাচ্ছিল পদচিহ্ন কিন্তু অরণ্যের গভীরে, বরফ মোড়া গাছের ঘন ডাল জড়াজড়ি করে চাঁদোয়া তৈরি করে জোছনার প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করে রেখেছে। ফলে বনপালের এখন শুধু লণ্ঠনই ভরসা।
নেকড়েটাকে দেখে রীতিমতো মুগ্ধ বনপাল। এত সুন্দর এবং এমন ধবধবে সাদা নেকড়ে জীবনে দেখেনি সে। ওটাকে আবার চোখে পড়লেই গুলি করবে। জানোয়ারটা নিশ্চয় দলনেতা।
দলনেতা ?
দাঁড়িয়ে পড়ল বনপাল।
সে এসব কী করছে? রাতের বেলা, বাচ্চাগুলোকে বাড়িতে একা রেখে সে বেরিয়েছে নেকড়ে শিকারে। এটা পাগলামি ছাড়া আর কী?
ঝট করে ঘুরল বনপাল, ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে, আকুল আর্তনাদ ভেসে এল কানে।
‘বাঁচাও! বাঁচাও! আমাকে কেউ রক্ষা করো।’
‘কে?’ চেঁচাল বনরক্ষক। ‘কোথায় তুমি?’
‘আমি এখানে। আপনার কাছেই। দয়া করে আমাকে বাঁচান।’
‘হাতের লণ্ঠনটি উঁচু করে ধরতেই একটি নারীমূর্তি দেখতে পেল বনপাল। গাছের পাশে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। গায়ে ফারের পোশাক।
‘নেকড়ে-নেকড়ের দল সারারাত আমার পিছু নিয়েছে। আমাকে বাগে পেলে আর ছাড়বে না। আমাকে বাঁচান, বনপাল। আমাকে রক্ষা করার কেউ নেই। নেকড়ের দল হামলা করলে আমি কিছুই করতে পারব না।’
বিস্মিত বনপাল ক্রন্দনরত নারীটিকে দেখছে। তারপর তাকাল চারপাশে। কান পাতল। সাদা নেকড়েটাকে দেখতে পাচ্ছে না কোথাও, তার সাঁড়া-শব্দও নেই। বনপালের ভয়ে পালিয়ে গেছে?
‘আমার সঙ্গে আসুন,’ গম্ভীর গলায় বলল বনপাল। ‘জঙ্গল থেকে যত তাড়াতাড়ি বেরুনো যায় ততই মঙ্গল।’ মহিলার হাত ধরে সে ফিরে চলল। মহিলা প্রায় হাঁটতেই পারছে না। বনপালের শরীরের সঙ্গে সে একরকম ঝুলে থাকল।
বাড়ির দরোজায় এসে হাঁক ছাড়ল বনপাল। ‘বাচ্চারা, দরোজা খোলো। আমার সঙ্গে একজন অতিথি আছে।’
কাঠের ভারি হুড়কো টেনে নামানোর শব্দ হলো। খুলে গেল দরোজা। মহিলাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল বনপাল।
ক্লান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে আগুনের সামনে ধপ করে বসে পড়ল নারী। প্রথমে ফারের কোট খুলল সে, তারপর ফারের হ্যাট। গলানো সোনার মতো চুল ছড়িয়ে পড়ল তার কোমর পর্যন্ত।
এদিকে ছোট ছেলেটির ঘুম ভেঙে গেছে। সে দামী পোশাক পরা মহিলার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। তারপর সাহস করে হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল ঝকঝকে সোনালি কেশরাজি।
‘তুমি কি রাজকুমারী?’ মহিলার গাউনে হাত ছোঁয়াল ছেলেটি।
হাসল মহিলা। হাত বাড়িয়ে দিল ছেলেটির দিকে। ছেলেটি দ্বিধা করছে দেখে সামনে ঝুঁকে ওকে কোলে তুলে নিল সে, হালকা চুম্বন করল কপালে।
‘এরা আপনার বাচ্চা?’ বনপালের দিকে ফিরল স্বর্ণকেশী। ‘খুব সুন্দর শিশু।’ মেয়েটির দিকে একটি হাত বাড়িয়ে দিল সে। কিন্তু ছোট মেয়েটি ভয় পেয়ে সরে গেল দূরে, কাছে ঘেঁষল না।
‘তুমি কি রাজকুমারী? পুনরাবৃত্তি করল ছোট ছেলেটি। মাথা নেড়ে করুণ হাসল নারীটি।
‘পাশের ঘরে আপনার জন্য বিছানা করা হয়েছে,’ জানাল বনপাল। ‘আমি এ ঘরের মেঝেতে বাচ্চাদের নিয়ে শোব। আপনার এখানে কোনও ভয় নেই।’
‘আমি তেমন ক্লান্ত নই,’ বলল নারী। ‘আগুনের পাশে বসে থাকত ভালই লাগছে। বাচ্চারা ঘুমাক। আপনি ইচ্ছে করলে কিছুক্ষণ আমাকে সঙ্গ দিতে পারেন।’
ছেলেটি একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল কিন্তু মেয়েটির চোখে ঘুম নেই। সে চোখ বুজে রইল। শুনল বাবা মহিলার সঙ্গে কথা বলছে।
‘আপনার জন্য কিছু করার থাকলে জানাবেন। বলেছেন আপনি রাজকুমারী নন, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে আপনার জন্ম অভিজাত কোন বংশে। গরিবের এ ঘরে আপনার নিশ্চয় কষ্ট হচ্ছে।’
‘আপনি ঠিকই ধরেছেন, আমার জন্ম ধনী বাবার ঘরে। কিন্তু প্রাসাদে বিত্তবৈভবের মাঝে থাকলেও মানসিক শান্তি কোনোদিন পাইনি।
‘আমার বাবা তাঁর এক বয়সী বন্ধুর সঙ্গে আমাকে বিয়ে দেয়ার মতলব করেছিলেন। লোকটাকে আমার মোটেই পছন্দ হয়নি। বাবাকে অনেক অনুনয় করেছিলাম বিয়েটা ভেঙে দেয়ার জন্য। কিন্তু আমার কথা কানে তোলেননি তিনি। শেষে আমার হবু বরকে টাকা এবং গহনার লোভ দেখাই। বলি আমাকে যেন আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে সে দিয়ে আসে। সেই আত্মীয় আমার বাবার চেয়ে অনেক ভাল।
‘আমার প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল বুড়ো। আমরা রাতের বেলা যাত্রা শুরু করলাম। কিন্তু তুষারঝড়ে হারিয়ে ফেললাম পথ। আমাদের গায়ের গন্ধ পেয়ে পিছু নিল একপাল নেকড়ে। ওরা জানত আমাদের ঘোড়াগুলো বেশি দূরে যেতে পারবে না। রাস্তায় মরে পড়ে থাকবে। একটা ঘোড়া যখন হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে, আমার হবু বর আমাকে জলদি পালিয়ে যেতে বলল। সে ঠেকিয়ে রাখবে নেকড়ের দলকে। কিন্তু আমি পালিয়ে যেতে চাইনি। এমন সময় বাকি ঘোড়াটাও হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। আমাদেরকে বহন করা স্লেজটা ডিগবাজি খেল। আমার সমস্ত টাকা পয়সা, গহনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল। আমি ধাক্কার চোটে ছিটকে পড়লাম একটা গাছে, বাড়ি খেয়ে জ্ঞান হারালাম।
জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখি আমি মাটিতে পড়ে আছি। একা। আমার বর সম্ভবত পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দূরাগত নেকড়ের ডাক শুনে আমার মনে হচ্ছিল… আমার মনে হচ্ছিল… শিউরে উঠল সে। ‘আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম।’
‘এখন বিছানায় যান। ঘুমিয়ে পড়ুন,’ বলল বনপাল। আজ রাতে আর কিছু করতে পারব না। তবে আপনার যতদিন ইচ্ছে এ বাড়িতে থাকুন। এখানে আপনার নিরাপত্তার অভাব হবে না।’
সে রাতে সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পরেও ছোট মেয়েটি অনেকক্ষণ জেগে রইল। কেন ভয় করছে জানে না।
পরদিন সকালে বনপাল সেই জায়গায় গেল যেখানে গত রাতে মেয়েটির সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। খুঁজে বেড়াল হতভাগ্য বর এবং ঘোড়ার মৃতদেহ। কিন্তু ভারি বরফের তলায় চাপা পড়েছে সমস্ত চিহ্ন। জঙ্গলের মধ্যে খোলা একটি জায়গায় এসে নেকড়ে এবং মানুষের পায়ের ছাপ চোখে পড়ল। বরফের গায়ে কুৎসিত বাদামি দাগ। গত রাতেও এ চিহ্নের রং হয়তো লাল ছিল।
‘নেকড়ের পাল আপনার বরকে খেয়ে ফেলেছে আর ডাকাতরা আপনার মালপত্র চুরি করে নিয়ে গেছে।’ ফিরে এসে নতুন অতিথিকে খবর দিল বনপাল।
শুনে কেঁদে উঠল মহিলা।
‘হায়রে! এখন আমার কাছে টাকা-পয়সা কিছু নেই। কী করে আমি যাব?’ কাঁদতে কাঁদতে বলল সে, ‘এখন আমার কী হবে?’
‘গরম আসা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে থাকুন। তারপর যেখানে যেতে মন চায়, যাবেন। আমরা আপনাকে সাহায্য করব,’ বলল বনপাল। ছোট ছেলেটি জড়িয়ে ধরল মহিলাকে কিন্তু তার বোন মুখ ঘুরিয়ে রাখল। সে বুঝতে পারছে না যে বুড়ো লোকটি এই মহিলাকে বাঁচাতে গিয়ে নেকড়ের শিকার হয়েছে তার জন্য মহিলা এক ফোঁটাও চোখের পানি ফেলল না, কাঁদল শুধু টাকা-পয়সার শোকে।
মহিলা থেকে গেল পরিবারটির সঙ্গে। দিনের বেলা সে রান্না করে, ঘরটর ঝাঁট দেয়, খেলা করে দুটোর সঙ্গে। ছোট ছেলেটি তাকে পছন্দ করে কিন্তু ছোট মেয়েটি তাকে ভয় পায়। সে নীরবে লক্ষ করে তার বাবা বাইরে থেকে ফিরে এলে মহিলা বাবার পায়ের কাছে বসে গাঁয়ের গল্প শোনে। বাবা সোৎসাহে মহিলাকে নিজের কাজের কথা, পড়শীদের গল্প শোনায়। বলার ভঙ্গিতে একটা গদগদ ভাব থাকে। যেন গল্প শুনিয়ে খুশি করতে চাইছে সুন্দরী মহিলাকে।
বসন্ত এল। গলতে শুরু করল বরফ। মহিলা আবার কান্নাকাটি শুরু করে দিল।
‘এখানে কত সুখে ছিলাম আমি,’ বলল সে, ‘এখন আপনাদেরকে ছেড়ে চলে যেতে হবে এ দুঃখে বুকটা আমার ফেটে যাচ্ছে। আমার ইচ্ছে করছে না আপনাদেরকে ছেড়ে যেতে। আপনারা তিনজন এখন আমার আত্মার আত্মীয়ের চেয়েও বেশি।’
‘তা হলে আমাদের সঙ্গে সারা জীবনের জন্য থেকে যাও,’ অনুনয় করল বনপাল। ‘আমি তোমাকে বিয়ে করব। তুমি আমার সন্তানদের মা হবে।’
মেয়েটি লক্ষ করল তার বাবা এই মহিলার রূপে এমনই মজেছে, এক বছরও হয়নি তার মা’র কথা একদম ভুলে গেছে। মহিলাকে এখন আরও ডর লাগছে।
পরদিন বনপাল মহিলাকে নিয়ে গেল পাশের গাঁয়ে, প্রীস্টের কাছে। বিয়ে করবে। কিন্তু বৃদ্ধ প্রীস্ট এমন অসুস্থ, বিছানা থেকে ওঠার জো নেই। আরেকজন প্রীস্টের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ওদের। সে ওদের বিয়ে পড়িয়ে দিতে রাজি হলো।
অপূর্ব সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে নিজের কুটিরে ফিরে এল বনপাল। নতুন মা পেয়ে বনপালের ছেলে খুব খুশি। কিন্তু মেয়েটি মোটেই খুশি হলো না। ভয় ও অস্বস্তি তাকে ঘিরে থাকল।
বিয়ের পরপরই নতুন বউ-এর চেহারা পাল্টে গেল। স্বামী বাড়ি না থাকলে সে কচি ছেলেমেয়ে দুটোকে সারাদিনের জন্য মাঠে পাঠিয়ে দেয় কাজ করতে। আর ওদের বাবা বাড়ি ফেরার পরে ওদের সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে।
‘চলো, বাবাকে বলে দিই আমাদের নতুন মা আমাদের সঙ্গে কী রকম দুর্ব্যবহার করছেন,’ একদিন বোনকে বলল ভাই। ওদেরকে প্রায়ই কিছু খেতে না দিয়ে কাজে পাঠায় মহিলা।
‘এখনই কিছু বলার দরকার নেই। একটু ধৈর্য ধরো,’ পরামর্শ দিল বড় বোন। ভাইয়ের হাতে বাসি রুটির একটা টুকরো দিল। এ টুকরোটা ওদের মা শুয়োরের খোঁয়াড়ে ছুঁড়ে মেরেছিল শুয়োরদের খেতে দিতে। মেয়েটি ওটা কুড়িয়ে নিয়ে এসেছে।
একরাতে, সেদিন পূর্ণিমার চাঁদ ঝলমল করছে আকাশে, একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল মেয়েটির। দেখল ওদের সৎমা খালি পায়ে, গায়ে শুধু একটা সাদা নাইট গাউন, খুলে ফেলল দরোজা। তারপর বেরিয়ে পড়ল ঘর ছেড়ে। গাঁয়ের নির্জন রাস্তা দিয়ে হাঁটা দিল।
মেয়েটি ঘুম ভেঙে উঠে বসেছিল, আবার কাঁপতে কাঁপতে শুয়ে পড়ল। ভোর হওয়ার ঠিক আগে আগে ফিরে এল সৎমা। মেয়েটি দেখল মহিলার হাতে এবং সাদা নাইটগাউনে লাল দাগ। দাগগুলো নির্ঘাত রক্তের। আতংকিত হয়ে সে লক্ষ করল মহিলা নাইট গাউন খুলে ওটা চুল্লির আগুনে পুড়িয়ে ফেলল। তারপর ধুয়ে নিল হাত। হাত ধোয়া গামলার পানি ফেলে দিল বাইরে। শেষে স্বামীর পাশে এসে শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে গেল একটু পরেই।
মাসখানেক পরে, আবার আরেক পূর্ণিমার রাতে সৎমা আবার বেরিয়ে পড়ল কুটির থেকে। তবে এবারে ছোট মেয়েটি পিছু নিল তার। গতকাল শুনেছে এক পরিবারের একটি মেয়ে মারা গেছে। চার হপ্তা আগে আরেকটি মেয়ে করুণ মৃত্যুবরণ করেছে।
ছায়ার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ছোট মেয়েটি নিস্তব্ধ রাস্তা দিয়ে দ্রুত কদমে চলতে লাগল; সৎমা গির্জার কবরস্থানে পৌঁছে গেছে,
প্রকাণ্ড এক খণ্ড কালো মেঘ গ্রাস করল চাঁদ, আঁধারে ঢেলে দিল প্রকৃতি। কয়েক মুহূর্ত পরে আবার যখন কালো মেঘের অন্তরাল থেকে উঁকি দিল চাঁদ, মেয়েটি দেখল তার সৎমার চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সৎমা, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড সাদা একটি নেকড়ে।
খানিকক্ষণ নিশ্চল রইল নেকড়ে, তারপর নাক উঁচিয়ে বাতাসে কীসের গন্ধ শুঁকল, এরপর এক লাফে পার হলো গোরস্তানের নিচু দেয়াল, ছুটে গেল সদ্য খোঁড়া একটা কবরের দিকে। থাবা দিয়ে কবরের মাটি খুঁড়তে লাগল।
ভীত, আতংকিত মেয়েটি কাঁপতে কাঁপতে ঘুরে দাঁড়াল, ছুট দিল বাড়ি অভিমুখে, ঘরে এসে সটান শুয়ে পড়ল বিছানায়। সে রাতে ঘুমের ভান করে জেগে রইল সে। ভোরের আলো ফুটবার খানিক আগে তার সৎমা ফিরে এল বাড়ি, গায়ের সাদা গাউন এবং হাতে যথারীতি লেগে রয়েছে রক্ত। সে রক্তমাখা গাউন পুড়িয়ে ফেলল, পানির গামলায় ধুয়ে নিল হাত।
ভাইকে ঘটনাটা বললে সে হেসে উঠল।
‘তুমি আসলে দুঃস্বপ্ন দেখেছ,’ মাঠে কাজ করতে করতে বলল ভাই। ‘আমাদের নতুন মা’র সাকুল্যে নাইট গাউন আছেই একটা। সে ওটা পোড়াতে যাবে কেন? আর ওই গাউনটা সে রোদে শুকোতে দিয়েছে। ওই দ্যাখ।’
মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। তাকাল বাড়ির দিকে। সত্যি, রশিতে সাদা গাউনটা শুকোচ্ছে। এটা কী করে সম্ভব হলো বুঝতে পারছে না সে।
‘গাঁয়ের আবার কেউ যদি মারা যায়, আর তার পরের দিন যদি পূর্ণিমা হয়, সেদিন তোমাকে দেখাব সৎমা কী করে,’ বলল মেয়েটি।
‘আমি জেগে থাকার চেষ্টা করব,’ বলল ভাই। ‘কিন্তু সারাদিন এত পরিশ্রম করি যে রাতে বিছানায় শুলেই ঘুমে জড়িয়ে যায় চোখ। ঠিক সময়ে আমাকে জাগিয়ে দিও।’
মেয়েটি উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল গাঁয়ে আবার কার মৃত্যু-সংবাদ শুনতে হয়। গাঁয়ের কেউ অসুস্থ নেই জেনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। মৃত্যু খবরও শুনল না সে। আজ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারব, পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবল মেয়েটি। সে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু দরোজা খোলার শব্দে জেগে গেল। দেখল তার সৎমা ঘর থেকে বেরুচ্ছে। ‘উঠে পড়ো! উঠে পড়ো!’ ভাইয়ের হাত ধরে ঠেলা দিল বোন। কিন্তু নাক ডাকিয়ে ঘুমাতে লাগল সারাদিনের পরিশ্রম-ক্লান্ত ভাই।
অগত্যা মেয়েটি একাই বেরিয়ে পড়ল। জনশূন্য রাস্তায় গাছপালার আড়াল নিয়ে এগুতে লাগল সে। কিছুক্ষণ পরে সৎমাকে দেখতে পেল। মহিলা গির্জার গোরস্তানের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে।
এবারে আর মেঘ ঢেকে দিল না চাঁদ।
মেয়েটি দেখতে পেল সৎমা টান মেরে ছিঁড়ে ফেলছে নাইট গাউন এবং সঙ্গে সঙ্গে একটি প্রকাণ্ড সাদা নেকড়েয় রূপান্তর ঘটল তার। মেয়েটি চিৎকার দিল ভয়ে, পিছু হটল দেয়ালে। নেকড়েটা ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েটার ওপর।
চিৎকার শুনে গির্জার তত্ত্বাবধায়ক জানালা খুলে তাকাল। ‘নেকড়ে!’ আর্তনাদ করল সে। ‘একটা বিরাট সাদা নেকড়ে একটা বাচ্চাকে হামলা করেছে।’ হাতের কাছে রাখা গুলিভরা বন্দুকটা ঝট করে তুলে নিল সে। নেকড়ে ততক্ষণে মেয়েটিকে ফেলে দিয়ে নাইট গাউনটা দুই সারি দাঁতের মাঝখানে কামড়ে ধরে গ্রামের দিকে ছুট লাগিয়েছে।
‘ওটা বনপালের মেয়ে,’ বলল তত্ত্বাবধায়কের বউ। ‘মেয়েটাকে বোধহয় নিশিতে পেয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে এদিকে এসে নেকড়ের কবলে পড়েছে।’ একটু বিরতি দিল সে। ‘ওর বাবাকে কী করে খবরটা দেব?’
মৃত মেয়েটিকে নিজেদের কুটিরে নিয়ে এল তারা। কামড়ের ক্ষতগুলো পরিষ্কার করল। গায়ে সাদা একটা পোশাক পরাল। আড়াআড়িভাবে রাখা দু’হাতের পাঞ্জার ফাঁকে বুনো একটি সাদা ফুল গুঁজে দিল।
পরদিন কবর দেয়া হলো মেয়েটিকে। সৎমা সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে মরাকান্না জুড়ে দিল। বনপালের চেয়েও বেশি কাঁদল সে। তবে তার দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বনপালের ছেলে।
সাতদিন বাদে সে গির্জার বিপরীত দিকের কামারশালায় ঢুকল। কামার তখন কাজে ব্যস্ত। ‘আমি জানি আপনি গাঁয়ের সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ,’ কামারকে বলল ছেলেটি। ‘সে জন্য আপনার কাছে বুদ্ধি নিতে এসেছি। শুনেছি শয়তানের শক্তি নাকি আপনাকে সাংঘাতিক ভয় করে।’
‘তোমাকে কী বুদ্ধি দেব আমি?’ জিজ্ঞেস করল কামার।
জিজ্ঞেস করল কামার।
‘দিন দুই আগে আমি একটি স্বপ্ন দেখেছি,’ বলল ছেলেটি।
‘দেখলাম আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে আর আমার বোন একটা প্রকাণ্ড ওয়্যারউলফের পিছু নিয়েছে। মায়া নেকড়েটা আমার বোনকে মেরে ফেলল। আর তা দেখে চিৎকার দিয়ে আমার ঘুম ভেঙে গেল।
‘গত রাতে আবার একটি স্বপ্ন দেখেছি আমি। আবার দেখলাম পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে আকাশে। ওয়্যারউলফটা ক্ষুধার্ত হয়ে গির্জার গোরস্তানে এসে আমার বোনের কবর খুঁড়ে তাকে খেয়ে ফেলল।’
‘স্বপ্নের কথা তোমার বাবাকে বলেছ?’ জিজ্ঞেস করল কামার।
‘বাবা আমার কথা বিশ্বাস করবে না।’
‘আর প্রীস্ট?’
‘উনি বুড়ো এবং অসুস্থ। আমার কথা তিনি বুঝতে পারবেন না।’
‘আমি অনেকদিন ধরে জানি এ গাঁয়ে একটা মন্দ-শক্তি বাস করে।’ ধীর গলায় বলল কামার। ‘কিন্তু একটু আগেও সেই শয়তানটার পরিচয় জানতাম না। তুমি আমার কাছে এসে ভালই করেছ।
‘তোমার বাড়ি ফিরে যাও। চেহারাটা শোকাতুর করে রাখবে। আবার যেদিন পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে, জঙ্গলে গিয়ে তোমার বাবাকে তোমার সঙ্গে আসতে বলবে। বলবে তোমার বোনের জন্য আমরা একটি ধর্মীয় অনষ্ঠান করব। তোমার বাবাকে কিছুতেই বাড়ি যেতে দেবে না।’
‘আপনি কি আমার বোনকে রক্ষা করতে পারবেন?’
‘কথা দিচ্ছি শুধু তোমার বোনই নয়, আরও অনেককেই আমি রক্ষা করব।’
কামারশালায় যাকে পেল তাদের কাছ থেকে রুপোর মুদ্রা, রুপোর বোতল কিংবা রুপোর বগলস চেয়ে নিল কামার। সবাই কারণটা জানে। তাই আগ্রহ নিয়েই জিনিসগুলো কামারকে দিল তারা। রুপোর এই জিনিসগুলো গলিয়ে একটি সিলভার বুলেট বা রুপোর গুলি তৈরি করল কামার।
পরবর্তী পূর্ণিমা রাতের আগের দিন কামারশালায় হাজির হয়ে গেল গাঁয়ের সকল পুরুষ। তাদের সঙ্গে যোগ দিল বনপাল এবং তাদের ছেলেও। নীরবে তারা খাওয়া-দাওয়া করল। তারপর নিঃশব্দে গুনতে লাগল অপেক্ষার প্রহর।
ঘণ্টা দুই পরে একটি নারীকে রাস্তা ধরে ছুটে আসতে দেখল তারা। হাওয়ায় উড়ছে তার ঝলমলে সোনালি কেশ, মাঝে মাঝেই ঢেকে দিচ্ছে অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানা, তার নগ্ন পা এত হালকাভাবে স্পর্শ করছে জমিন, দেখে মনে হয় সে দৌড়াচ্ছে না, উড়ে বেড়াচ্ছে মাটির ওপর দিয়ে।
বনপাল নারীমূর্তিটির কাছে ছুটে যেতে চাইছিল। তাকে বাধা দিল সঙ্গীরা।
‘দাঁড়াও,’ বিড়বিড় করল তারা। ‘দাঁড়াও এবং দেখো কী হয়।’
নারীটি পৌঁছে গেছে গোরস্তানের সামনে। দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর টান মেরে ছিঁড়ে ফেলল পরনের নাইট গাউন। পরমুহূর্তে দেখা গেল তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে বিশালকায় একটি সাদা নেকড়ে, মুখ উঁচু করে বাতাসে গন্ধ শুঁকল সে, তারপর এক লাফে পার হলো কবরস্থানের নিচু দেয়াল। পা বাড়াল বনপালের ছোট মেয়েটির কবরের দিকে। সাতাশ দিন আগে কবর দেয়া হয়েছে মেয়েটিকে।
‘এখন?’ শান্ত গলায় জানতে চাইল পুরুষরা।
‘এখন,’ সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল কামার। কাঁধ বরাবর তুলল বন্দুক, সতর্কতার সঙ্গে স্থির করল লক্ষ্য, গুলি চালাল। সাদা রোমশ চামড়া ভেদ করে জানোয়ারটার হৃৎপিণ্ডে ঢুকে গেল সিলভারের বুলেট।
লাফ মেরে মাথা তুলল ওয়্যারউলফ, শেষবারের মতো যন্ত্রণাকাতর সুরে ডেকে উঠল, তারপর গড়িয়ে পড়ে গেল মাটিতে। গাঁয়ের লোকেরা তার কাছে যাওয়ার আগেই নিভে গেল তার প্রাণবায়ু।
‘এমন কিছু ঘটার কথা কল্পনাও করিনি,’ বলল বনপাল। ‘সুন্দরী মেয়েটিকে আমার মনে হয়েছিল কোনও ভাগ্যহতা। আশ্রয় চেয়েছিল বলে ওকে আমার বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম। জানতাম না ও একটা পিশাচী।’
গ্রাম থেকে দূরে একটি নির্জন জায়গায় ওয়্যারউলফটিকে কবর দেয়া হলো। কবরের ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো মস্ত একটি পাথর। ছেলেকে নিয়ে বহুদূরের এক গাঁয়ে চলে গেল বনপাল, যেখানে কেউ জানবে না এক ওয়্যারউলফ তার সুখের সংসারটাকে তছনছ করে দিয়েছে।
…………………………………………………..(সমাপ্ত)……………………………………………..