শেষ অবধি পথের দেখা মিলল। মরুভূমিতে অকস্মাৎ মরূদ্যান মিলে যাওয়ার মতো একটা চমকপ্রদ ঘটনা যেন। আনন্দে লাফাতে ইচ্ছে হলো শাওনের। ও ধরেই নিয়েছিল রাতটা বনের ভেতরেই কাটাতে হবে। আর তা যদি হতো, দুর্ভোগ্যের কোন শেষ থাকত না। হয়তো জীবন নিয়েও আশংকা দেখা দিত। যেন একটা জীবন্ত দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে এল ও।
শিকারে বেরিয়েছিল শাওন। একা নয়, সাথে দুই মামাতো ভাইও ছিল। এতক্ষণে ওরা নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরে গেছে। আর বাড়িতে শুরু হয়েছে মহা হুলুস্থূল। বড় মামা অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে পড়েন। শাওন কল্পনায় স্পষ্ট দেখতে পেল সদলবলে লাঠিসোটা নিয়ে ওকে খুঁজতে বেরিয়েছেন বড় মামা। এখান থেকে উজানতলি কতদূর কে জানে?
ইতিমধ্যে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। পুব আকাশে আষাঢ়ী পূর্ণিমার চাঁদ। চারদিকে খা-খা জোছনা। পথঘাট দিব্যি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আশেপাশে কোন বাড়িঘর নেই। দূরে অবশ্যি ক’টা আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে। বন্দুকটা কাঁধে ঝুলিয়ে ওদিকেই এগোল ও।
যেতে যেতে নিজেকে আরেকবার ভর্ৎসনা করল শাওন। মামারা সবাই আজ ওদের শিকারে বেরোতে বারণ করেছিলেন। বর্ষাকাল শিকারের জন্যে নয়। এ সময় সাপ-খোপের ভয় থাকে বনে। জন্তু-জানোয়ার পানির ভয়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে আশ্রয় নেয় উঁচু শুকনো জায়গাগুলোতে। কিন্তু মামাতো ভাইয়েরা ওকে ফিসফিস করে বলল, আষাঢ় মাসই হচ্ছে বনমোরগ ধরার আসল সময়। বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হয়ে থাকে ওরা। গাছের ডাল, মাটির ঢিবি এসব জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমোয়।
এক রকম পালিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল ওরা। তিনজনের সাথেই পয়েন্ট টুটু বোর। উজানতলি থেকে মাইল চারেক দূরে এক পাহাড়ের ওপর বন। পাহাড়টা তেমন উঁচু নয়, তবে গাছ-গাছালি একটু ঘন। বনে ঢুকে একটা গাছকে চিহ্নিত করে তিনজন তিনদিকে চলে যায়। কথা ছিল ঠিক দু’ঘণ্টা পর চিহ্নিত গাছতলে এসে মিলবে ওরা। কিন্তু একটা বড়সড় মোরগের পেছনে ছুটতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলে সে। তারপর অনেক ভোগান্তির পর এই বেরিয়ে আসা। বড়দের নিষেধ না শুনে সত্যিই একটা বিরাট বোকামি করে ফেলেছে ও।
মিনিট বিশেক পর আলোর বিন্দুগুলো বৃত্তে রূপ নিল। আরো মিনিট দশেক পর একটা ছোটখাটো বাজারে এসে পৌঁছাল শাওন। ক’টা মুদি দোকান আর খুপরি মতো একটা হোটেল নিয়ে বাজারটা। হোটেলে ঢুকেই শাওন টের পেল পেটে ভীষণ খিদে। শরীরটাও খুব ক্লান্ত। তা তো হবেই। চার-পাঁচবার বিশ্রাম নেয়া বাদে সেই দুপুর থেকে সন্ধ্যে অবধি পথের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে বেরিয়েছে ও। বুনো কাঁটার আঁচড় খেয়ে কেডস জোড়া ক্ষত-বিক্ষত। জিনসের প্যান্টটারও নিচের দিকে কয়েক জায়গায় সুতো ছিঁড়ে গেছে।
হোটেলে আর কোনও খদ্দের নেই। কোনো বয়-বেয়ারাও দেখা যাচ্ছে না। খুব সম্ভব মালিক নিজেই সবকিছু। ঝাঁপ ফেলতে যাচ্ছিল সে, শাওনকে দেখে আবার হাঁড়ির কাছে ফিরে গেছে। এরই মধ্যে এক জগ পানি রেখে গেছে টেবিলে। মুখ-হাত ধোয়ার পর ক্লান্তি অর্ধেক কমে গেল শাওনের। বাঁশপাতা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়ার পর অনেকটা সজীব মনে হলো নিজেকে। বিল মিটিয়ে দিতে দিতে হোটেলঅলাকে শুধোল, ‘উজানতলি এখান থেকে কতদূর?’
‘তা মাইল দশেক তো অইবোই।’
‘এখান থেকে যাবো কি করে?’
‘দিন থাকলে রিকশা পাইতেন। এই রাইত কইরা হাঁটন ছাড়া উপায় নাই। বড় সড়ক ধইরা সিদা হাঁইটা যাইবেন। তয় রাইত কইরা না যাওনডাই ভালা।’
‘কেন?’ ভুরু কোঁচকাল শাওন। ‘ডাকাত-লুটেরার উপদ্রব আছে নাকি?’
‘জ্বে না, উপরদবডা অন্য এক জিনিসের। রাইত কইরা কওনডা ঠিক অইব না।’
শাওন অনুমান করল হিংস্র জন্তুর ভয় দেখাচ্ছে সে। তাজা কার্তুজ ভরা আগ্নেয়াস্ত্র থাকতে জন্তু-জানোয়ার আসবে ওর সামনে? ফুঃ!
হোটেলঅলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে রওনা দিল শাওন।
চাঁদ এখন অনেকটা ওপরে। অকৃপণ মায়াবী আলো ছড়িয়ে চলেছে নিশিরানীর বুকে। প্রশস্ত কাঁচামাটির সড়কের দু’ধারে, হালকা ঝোপঝাড়ে ঝিঁঝি পোকার ডাক। এখানে-ওখানে জোনাকির ঝাঁক আঁধার ফুটো করে জ্বলছে। সকালের দিকে বৃষ্টি হয়েছিল। এখন একরত্তি মেঘও নেই। তবে যে কোনো মুহূর্তেই আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যেতে পারে। বর্ষার মেঘকে একটুও বিশ্বাস নেই। বাতাস বইছে থেমে থেমে। ভেজা বাতাসে কেমন একটা অচেনা গন্ধ।
হঠাৎ শাওনের মনে হয় কে যেন পিছু পিছু আসছে। ঘাড়ের ওপর অস্বস্তিকর অনুভূতি। গান থামিয়ে থমকে দাঁড়ায় ও। ধীরে ধীরে পেছন ফেরে।
একটা লোক খুব দ্রুতগতিতে হেঁটে আসছে। বন্দুকটা কাঁধ থেকে নামিয়ে হাতে নেয় ও। ততক্ষণে লোকটা কাছে এসে পড়েছে। এসেই একগাল হাসি, ‘ভাইজান, যাইবেন কই?’
‘উজানতলি।’
‘আমিও ওদিকেই যামু। ভালই অইল। একজন সাথী পাইয়া গেলাম।’
শাওনও মনে মনে খুশি। দশ মাইল পথ, কম দূর তো নয়, একজন সঙ্গী পেলে কথায় কথায় একঘেয়েমিটা কাটানো যাবে। তাছাড়া ডরভয় বলেও কিছু থাকবে না।
যেতে যেতে শাওন লোকটার আপাদমস্তক ভাল করে দেখে নিল। লোকটা মাঝারি গড়নের, গায়ের রঙ কালোই হবে—জোছনার আলোয় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। রোগা স্বাস্থ্য, চেহারায় কেমন বোকা-বোকা একটা ভাব। কণ্ঠস্বরে নিখাদ আন্তরিকতা। কালো একটা হাফ শার্ট গায়ে দিয়েছে সে, পরনে লুঙ্গি। পায়ে চপ্পল গোছের কিছু একটা হবে।
শাওন জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নামটা কি, ভাই?’
‘গরিবের নাম শুইনা কি করবেন, ভাইজান?’ ছন্নছাড়া দুঃখী মানুষের মতো হাসল সে। ‘আমার খবর শুইনা অযথা মেজাজ খারাপ অইবো। তার চাইতে আপনের খবর কন। শহরের মানুষ অইল খবরের জাহাজ।’
শাওন হাসল, ‘আমি শহরের মানুষ—বুঝলেন কি করে?’
‘ভাইজানে যে কি কয়! এইরকম জামাজুতা পইরা কান্ধে বন্দুক ঝুলাইয়া আর কে রাস্তা দিয়া হাঁটবে? আমার মতন গেরাইম্যা ভূত?’
শাওন অন্য কথা জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি করেন কি?’
‘তেমন কিছু না। আউলা বাউলা প্রাণী। বন-জঙ্গলে ঘুইরা বেড়াই।’
‘মানে?’
‘আমি একজন গায়েন।’
‘তাহলে তো ভালই হলো। গান শুনতে শুনতে যাওয়া যাবে। শোনান না একটা গান।’
‘আমার গান আপনের ভাল লাগবে না,’ কেমন শীতল আর উদাস শোনাল তার কণ্ঠ। আন্ধার জীবনের গান কারোরই ভাল লাগে না।’
গায়েনের কথা শেষ হতে না হতেই অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটল। রাস্তার ধারে এক জায়গায় গাছ-গাছালির ঘন সন্নিবেশ থেকে একসঙ্গে অনেকগুলো নিশাচর পাখি ডেকে উঠলো আচম্বিতে। যেন পাথর-রাত্রির গায়ে তীক্ষ্ণ দাঁতঅলা একসারি করাত ঝাঁপিয়ে পড়ল। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল শাওনের। গায়েনের মাঝে কোন ভাবান্তর নেই। যেন পাখিগুলোর ভয়াল ডাক কানেই যায়নি তার। উদাস হয়ে কী ভাবছে সে-ই জানে।
মিনিট পাঁচেক নিঃশব্দেই হাঁটল ওরা। তারপর হঠাৎ করেই গান শুরু করে দিল গায়েন। ভাঙা ভাঙা কর্কশ কণ্ঠ। খানিক আগের সেই মোলায়েম কণ্ঠের সাথে একটুও মিল নেই। গানের মর্মার্থ ভাব মেশানো। মানুষ আঁধারকে ভয় করে, ঘৃণা করে, অসুন্দর বলে ধিক্কার দেয়, তবু সেই আঁধারকেই ভালবাসে গায়েন। তার বেসুরো গান শুনে কিনা জানি না, কতগুলো বাদুড় ওড়াউড়ি করতে লাগল মাথার ওপর দিয়ে। ভীষণ রাগ হলো শাওনের। নিজের ওপরেই। কেন সে লোকটাকে গান গাইতে বলেছিল।
মাঝপথে আচমকা গান থামিয়ে দিল গায়েন। শাওনের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘তাড়াতাড়ি দোয়া পড়েন, ভাইজান। সামনে নিমতলি শ্মশান!’
শ্মশানকে ভয় পায় না শাওন। কিন্তু গায়েনের কথার ঢঙেই গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল। সঙ্গী ভাল, তবে ভীতু সঙ্গী ভাল নয়—খুব ভাল করেই উপলব্ধি করল ও।
ওরা এখন শ্মশান পেরোচ্ছে। বাঁ দিকে রাস্তা থেকে অল্প এগোলেই শ্মশান। তাকাবো না তাকাবো না করেও শেষমেশ শ্মশানের দিকে তাকাল শাওন। একটা ডোবার ধারে চার-পাঁচটা উঁচু নিমগাছ, গাছ আর ডোবার মাঝখানে প্রশস্ত জমিটুকুতে মরা পোড়ানো হয়। ভয় পাবার মতো কিছুই নেই ওখানে।
গায়েনকে শাওন বলল, ‘শ্মশানটা ভাল করে দেখে নিন। আপনার ভয়টা কেটে যাবে।’
গায়েন শ্মশানের দিকে তাকানোর আগেই পেছন থেকে দ্রুত এগিয়ে আসার হৈচৈ শুনে হকচকিয়ে গেল। শাওনও থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরল। পরক্ষণে দুটো শেয়াল তীব্র বেগে পাশ কাটাল ওকে। তারপরই দশ-বারোজন মানুষ লাঠি আর বল্লম নিয়ে হাজির। শাওন ভাবল ডাকাত। বুক শুকিয়ে এল ওর। এতগুলো ডাকাতের সাথে একটা বন্দুক দিয়ে কি করবে?
শাওনের ধারণা ভুল প্রমাণ করে বল্লম হাতে মাঝবয়েসী এক লোক ওকে শুধোল, ‘কুটুমের বাড়ি কই গো?’
‘বাড়ি শহরে। উজানতলিতে মামার বাড়ি যাচ্ছি।’
‘এই রাত্রিবেলায় যাওন তো ঠিক অইব না। এই রাস্তাটা ভালা না। বিপদ অইতে পারে। আপনে আমাগো লগে চলেন। রাইতটা কাটাইয়া সকালে রওনা দিবেন।’
‘ধন্যবাদ। রাতেই ওখানে পৌঁছতে হবে আমাকে। সবাই চিন্তা করছে। শিকারে বেরিয়ে বনের ভেতর পথ হারিয়েছিলাম।’
‘কিন্তু কুটুম, একা একা—’
‘একা কোথায়?’ লোকটাকে কথা শেষ করতে দিল না শাওন। ‘এক গায়েন আছে আমার সঙ্গে।’
‘কই সে লোক?’
পেছন ফিরে শাওন দেখে গায়েন নেই। নিশ্চয়ই ভয়ে দৌড় দিয়েছে। ও বলল, ‘লোকটা একটু ভীরু প্রকৃতির। আপনাদের দেখে আড়ালে কোথাও গা ঢাকা দিয়েছে। মনে করেছে ডাকাত। আপনারা চলে গেলেই আবার বেরিয়ে আসবে।’
‘ও, আইচ্ছা,’ একটু যেন মন খারাপ হলো লোকটার। ‘তাইলে আমরা যাই গো, কুটুম। ভালয় ভালয় য্যান বাড়ি ফিরতে পারেন।’
লোকগুলো চলে গেল। কিন্তু গায়েনের ফিরে আসার কোন লক্ষণই নেই। মিনিট কয়েক অপেক্ষা করে আবার রওনা হলো শাওন। যেতে যেতে বেশ ক’বার ‘গায়েন’ ‘গায়েন’ বলে চেঁচাল। কোনো সাড়া মিলল না।
সামনের তেরাস্তার মোড়ে বটগাছের তলে পাওয়া গেল গায়েনকে। শাওনের জন্যে অপেক্ষা করছিল। শাওন তাকে দেখেই ভর্ৎসনা করল, ‘আপনি একটা আস্ত ভীতুর ডিম। কতগুলো মানুষ শেয়াল তাড়াতে তাড়াতে এসেছে, আর তা দেখেই আপনি দৌড়ে পালালেন!’
অন্ধকার থেকে চাঁদের আলোতে বেরিয়ে এল গায়েন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘ভয় কি আর সাধে পাইছি? আপনে যদি জানতেন সেই কথা, তাইলে আপনেও দৌড়াইতেন।’
‘সেই কথাটা শুনি।’
‘এই রাইত কইরা বলাটা—’
‘কিচ্ছু হবে না বলুন।’ জেদি কণ্ঠ শাওনের।
‘সবাই কয় একটা পিশাচ নাকি আছে এইদিকে। রাইতে এই পথে ঘোরাঘুরি করে। তার সারা শরীরভর্তি চোখ। যে তারে দেখে সে ভয়ে মইরা যায়।’
হো হো করে হেসে উঠল শাওন। ‘এটা একটা গুজব ছাড়া কিছুই না।’
‘জ্বে না, গুজব না। এই দ্যাখেন।’
গায়ের শার্টটা খুলে ফেলল সে। শাওন চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখল তার গা-ভর্তি অসংখ্য চোখ। সবগুলোই পিট পিট করছে।
(সমাপ্ত)