মেয়েটিকে যেদিন প্রথম দেখলাম, সেদিনই বুঝেছি ওর মধ্যে কিছু একটা ভজঘট না থেকে পারে না। একটা কিছু গণ্ডগোল আছে নিশ্চয়ই।
আমাদের ক্লাসে পড়ে ও, নতুন ভর্তি হয়েছে। নাম মিনারা।
অদ্ভুত নাম। সেকেলে। এমন নাম আগে কখনও শুনিনি আমরা। আমাদের মতে প্রথম ভজঘট হচ্ছে ওর নামটা।
শুধু নাম নয়, মেয়েটার পোশাক, চাল-চলন, সব সেকেলে। রুচি বলে কিছু নেই। রোজ এক ট্রেনে করে স্কুলে আসে। একই রঙের ফিতে দিয়ে চুল বাঁধে। চুল আঁচড়ায় একই স্টাইলে। কোন স্টাইল নেই।
চলছে চলুক ধরনের ভাব।
মিনারা যেদিন প্রথম স্কুলে এল, আমি আর অভি তখন শাহেদা ম্যাডামের ক্লাসে। উনি আমাদের বাংলা ম্যাডাম।
ওকে বই-খাতা নিয়ে ইতস্তত পায়ে ক্লাসে ঢুকতে দেখে আমার দিকে তাকাল অভি। মুখ টিপে হেসে বলল, ‘ওই যে, নতুন মক্কেল এল বোধ হয়। আহা, কি সুবোধ বালিকা।’
ওর বলার কায়দা দেখে না হেসে পারিনি আমি। সত্যি, একেবারে সুবোধ মেয়েটির মতো করছিল মিনারা। যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। ম্যাডামের টেবিলের পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল ও মাথা নিচু করে। ম্যাডাম প্রশ্ন করলে দুয়েক শব্দে উত্তর দেয়, অথবা মাথা ঝোলায়। এদিকে ক্লাসের সবাই চুপ করে ওকে দেখছে।
যেন সেটা বুঝতে পেরেই খানিক পরপর চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠতে লাগল মিনারার। একসময় ম্যাডাম-ছাত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হলো। ক্লাসের সবার উদ্দেশে ম্যাডাম ঘোষণা করলেন, ‘এ হচ্ছে মিনারা। তোমাদের নতুন সহপাঠী। এর সাথে মিলেমিশে চলবে তোমরা। ঠিক আছে?’
ক্লাসের সবাই একযোগে হুংকার ছাড়ল, ‘জ্বি আপা!’
‘গুড! মিনারা, বসে পড়ো।’
বইপত্র দু’হাতে বুকের কাছে ধরে মাথা নিচু করে এগিয়ে গেল মেয়েটি। ফার্স্ট বেঞ্চের আরেক মেয়ে, রোশনি, সরে বসে ওকে জায়গা করে দিল।
আমি আর অভি তাকিয়ে থাকলাম মিনারার দিকে। চোস্ত পাজামা আর ফ্যাকাসে নীল রঙের কামিজ পরে এসেছে ও। একই রঙের ফিতে দিয়ে টানটান করে চুল বাঁধা। চুলের টানে কপালের চামড়াও টান হয়ে আছে। সাদা ওড়না। সব মিলিয়ে দেখতে অদ্ভুত লাগছিল। মনে হয়েছে ত্রিশ বছরের পুরানো বাংলা ছায়াছবির কোন শিশুশিল্পী পর্দা থেকে নেমে এসেছে বুঝি।
মেয়েটা বুঝতে পেরেছিল যে ওকে দেখে মুখ টিপে হাসছি আমরা। লজ্জায় তাই মাথা নিচু করে বসেই থাকল প্রথম দিন।
‘ওর ঠোঁট ওরকম বিচ্ছিরি কালো কেন রে।’ ফিসফিস করে বলল অভি। ‘দেখ না ভাল করে।’ দেখলাম। সত্যিই কালো। ‘বোধ হয় কালো লিপস্টিক মেখেছে।’
‘হ্যাহ্! কালো লিপস্টিক মেখেছে! যা মুখে আসে বলে বসলেই হলো। তোর যেমন ‘ঘাড়ে বুদ্ধি।’
‘হতে পারে না?’ আমি বললাম।
কিছুক্ষণ চুপ করে মিনারাকে পর্যবেক্ষণ করল অভি। তারপর মুদ্রাদোষের মতো নিজের প্রিয় ডায়লগটা ভেড়ে বসল।, ‘কি সাংঘাতিক!’
‘এর মধ্যে সাংঘাতিকের কি দেখলি তুই?’
জবাব না দিয়ে বলল, ‘ওর গায়ের চামড়া কেমন ফ্যাকাসে দেখেছিস? মনে হয় সূর্যের আলোয় তেমন বের হয় না।’
পরদিন টিফিনের সময় সামনের মাঠে বসে গল্প করছি আমরা চার বন্ধু। আমি, অভি, ইমতিয়াজ আর ফুয়াদ। আমাদের বন্ধুত্ব কিন্তু অনেক দিনের—অনেক অনেক প্রাচীন। গল্পের ফাঁকে একটা আপেল লোফালুফি করছি চার বন্ধু।
কথায় কথায় মিনারার প্রসঙ্গ উঠল। ‘তোরা খেয়াল করেছিস মেয়েটাকে?’ অভি বলল ইমতিয়াজ আর ফুয়াদের উদ্দেশে।
‘করেছি,’ ইমতিয়াজ মাথা দোলাল।
‘কি সাংঘাতিক না?’
‘হ্যাঁ। চেহারা বেশ ফ্যাকাসে। তার ওপর ঠোঁটে কালো লিপস্টিক মেখে চেহারার যা অবস্থা করে রাখে, বাজে লাগে দেখতে।’
‘ওটা লিপস্টিক না বোধ হয়,’ ফুয়াদ বলল। ‘ওর ঠোঁটের রঙই মনে হয় কালো। অনেকের হয় ওরকম, দেখেছি আমি।’
‘ওরা থাকে কোথায়, জানিস?’ আমি বললাম আপেলটা অভির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে। ‘বাসা কোথায় ওদের?’
‘আমি জানি,’ ফুয়াদ বলল।
‘কোথায়?’ একযোগে প্রশ্ন করলাম আমরা তিনজন।
‘গোড়ানে। নন্দীপাড়ার শেষ মাথায়, ব্রিজটার ওপারে পুরানো এক বিল্ডিঙে।’
‘ওটা তো অনেক পুরানো বিল্ডিং।’ অভি বলল বিস্মিত কণ্ঠে। ‘ওখানে তো পুরানো বিল্ডিং একটাই আছে। পাশে বড় এক বাগান—’
‘হ্যাঁ, ওটাতেই থাকে ওরা।’
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল অন্য তিনজন। সবাই জানে ও বাড়িটা অনেক পুরানো, খালি পড়ে ছিল বহু বছর। বনের ধারে ওরকম এক বাড়িতে মেয়েটা থাকে, ভাবতে কেমন যেন লাগে। ‘ওর বাবা কী করেন?’ ইমতিয়াজ বলল।
‘জানি না। ওনাকে দেখিনি। মেয়েটার মাকেও না। কাল বিকেলে ওদের বাসার সামনে দিয়ে এসেছি আমি। দেখি ও একা দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। আর কেউ নেই। ’
‘হয়তো বাইরে গিয়েছিলেন ওনারা,’ যুক্তি দাঁড় করার চেষ্টা করলাম আমি।
‘কি জানি!’ শ্রাগ করল ফুয়াদ।
অনেকক্ষণ চুপ থেকে অভিও কাঁধ ঝাঁকাল। ‘কী সাংঘাতিক! ও রকম এক বাড়িতে মানুষ থাকে, ভাবাই যায় না। ভূতের বাড়ির মতো লাগে ওটাকে।’
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মিনারা। একা। মাথায় একটা বুদ্ধি এল। উঠে পড়লাম চট করে। ওকে ডেকে আনছি আমি।’
‘কেন!’ বিস্মিত হলো অভি।
‘এমনিই। পরিচিত হতে।’
‘যা নিয়ে আয়,’ উৎসাহ জোগাল ইমতিয়াজ। ‘দেখা যাক, ওর সম্পর্কে নতুন কিছু জানা যায় কিনা।’
আমাকে ওর দিকে এগোতে দেখে দ্বিধা ফুটল মেয়েটার চেহারায়। আমার মতলব বুঝে কেটে পড়ার চেষ্টা করছিল, সুযোগ দিলাম না। সোজা ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ‘কী করছ, মিনারা?’
‘অ্যাঁ? না, কিছু না।’
‘আমরা কয়েক বন্ধু বসে গল্প করছি। তুমিও এসো।’
‘কেন?’ একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে থাকল ও। ভয় ধরে গেল ওর চোখ দেখে। মনে হলো মানুষের চোখ নয় ওগুলো, ভূতের চোখ।
‘এমনিই,’ আমতা আমতা করে বললাম। ‘তুমি নতুন এলে, এখনও আমাদের সবার সাথে পরিচয় হয়নি, তাই ভাবলাম একসাথে লাঞ্চ খেতে খেতে—’
‘কিন্তু আমি দুপুরে কিছু খাই না। তাছাড়া এখন সময়ও নেই আমার।’
দ্রুত আরেক দিকে চলে গেল মিনারা। আমি হতাশ হয়ে ফিরে এলাম।
মেয়েটা ভ্যাম্পায়ার, আমার মুখ থেকে ঘটনা শুনে অনেক গবেষণার পর সিদ্ধান্তে পৌঁছল ওরা তিনজন। ‘নিশ্চয়ই তাই।’
ভ্যাম্পায়ারের প্রতি যথেষ্ট দুর্বলতা আছে আমাদের। রীতিমতো অনুরাগী আমরা ওই জিনিসের। ‘ভ্যাম্পায়ার না হয়েই যায় না এ মেয়েটা,’ অভি বলে উঠল। ‘দুপুরে খায় না, এ কোন কথা হলো? তাছাড়া ওর ফ্যাকাসে গায়ের রঙ, চাল-চলন, সেকেলে স্টাইল, সবই কেমন সন্দেহজনক।’
কয়েকদিন পরের কথা।
রাত ন’টা। মিনারাদের বাড়ির কাছে ঘাপটি মেরে বসে আছি আমরা চার বন্ধু। বাড়িটার সামনে বারো ফুট চওড়া খাওয়া-খাওয়া রাস্তা, তার এপাশে বড় কয়েকটা গাছ, ওগুলোর আড়ালে। পথের পাশে বৈদ্যুতিক আলোর খুঁটি আছে, কিন্তু বাতি নেই—অন্ধকার। কাজেই কারও চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ও নেই আমাদের। নিশ্চিত মনে বসে আছি, ফিসফিস করে কথা বলছি। নজর বাড়িটার ওপর।
মেয়েটার ব্যাপারে জানতে হবে, পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হবে। কিন্তু গত কয়েকদিন চেষ্টা করেও সে সুযোগ বের করতে পারিনি আমরা। তাই শেষ পর্যন্ত ওর ওপর গোয়েন্দাগিরির সিদ্ধান্ত নিয়েছি সবাই মিলে।
রাত বাড়ছে। বাড়ির ভেতরে কারও সাড়া নেই। আলোও জ্বলছে না কোন রুমে। এক সময় চাঁদ উঠল। বাড়িটার ভৌতিক কাঠামো পরিষ্কার ফুটে উঠল চোখের সামনে। বড় বড় গাছ বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে।
‘ওরা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে,’ এক সময় হতাশ হয়ে বলল ইমতিয়াজ। ‘নইলে এতক্ষণেও কারও সাড়া নেই কেন? একটা আলোও নেই অত বড় বাড়িতে।’
‘ও জেগে আছে,’ আমি বললাম অন্ধকার জানালার দিকে তাকিয়ে। ‘অন্ধকারে বসে আছে।’
‘কী সাংঘাতিক!’
ফুয়াদ নড়ে উঠল। ‘আমিও আজ স্কুলে কথা বলতে গিয়েছিলাম ওর সাথে। পাত্তাই দিল না। পাশ ফিরে এমনভাবে চলে গেল, যেন দেখেইনি আমাকে। হিলওয়ালা জুতো পরেছিল ও, অথচ হাঁটার সময় একটুও শব্দ হতে শুনিনি।’
‘এই বাড়িতে মানুষ থাকে কী করে?’ অভি বলল। ‘কেমন গ্রামের মতো জায়গা। চারদিকে ধানের ক্ষেত আর বন-জঙ্গল।’
‘এমন জায়গাতেই তো নিরিবিলিতে থাকা যায়,’ আমি বললাম। ‘এ রকম জায়গা ভ্যাম্পায়ারদের পছন্দ।’
খিকখিক করে হেসে উঠল অন্যরা।
একটা জানালায় নড়াচড়া দেখে সোজা হয়ে বসলাম আমি। ‘কে যেন নড়ছে ওটার কাছে। চল, দেখে আসি।’
পা টিপে রাস্তা পার হলাম আমরা। চারদিকে অদ্ভুত নীরবতা, বাতাসে গাছের ডাল নড়ার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। নির্দিষ্ট জানালাটার কাছে এসে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালাম আমরা।
‘তোরা ঠেলে ওপরে তোল আমাকে,’ ফিসফিস করে বললাম। ‘ভেতরে কে আছে দেখি।’ তাই করল অভি, ফুয়াদ আর ইমতিয়াজ। অভি সতর্ক করল, ‘দেখিস, ও তোকে দেখে না ফেলে যেন।’
‘আচ্ছা।’
ওরা ঠেলে তুলল আমাকে যতদূর সম্ভব, আমি পুরানো আমলের ইটের উইন্ডোসিল আঁকড়ে ধরে ধুলোজোড়া কাঁচের ভেতর দিয়ে ভেতরে তাকালাম।
রুমটা বেশ বড়। চাঁদের আলোয় ভেতরটা মোটামুটি দেখা যায়। এক সেট সাধারণ সোফা, একটা টেবিল আর দুটো কাঠের চেয়ার দেখলাম রুমের মধ্যে। পুরানো স্টাইলের, সেকেলে। এক মাথায় একটা ড্রেসিং টেবিল—ওটাও তাই।
হঠাৎ করে মিনারাকে রুমে ঢুকতে দেখে এত চমকে উঠলাম আমি যে, আরেকটু হলে উল্টে পড়েই যাচ্ছিলাম। অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে ফিসফিস করে বললাম, ‘ওই তো মিনারা! অন্ধকারে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।’
‘আয়নায় ওর ছায়া পড়েছে কিনা দেখ,’ ফুয়াদ বলল একই গলায়।
চোখ কুঁচকে ভাল করে তাকালাম। কিছুই বোঝা গেল না। আবার তাকালাম। জানি, আয়নায় ভ্যাম্পায়ারদের প্রতিবিম্ব পড়ে না, সেটাই বোঝার চেষ্টা করলাম। কাজ হলো না।
‘দেখতে পাচ্ছি না,’ অবশেষে হতাশ হয়ে বললাম আমি। ‘এত অন্ধকার, কিছু বোঝার উপায় নেই।’ হঠাৎ করে ঘুরে তাকাল মিনারা। মনে হলো সোজা আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে এল আমার। হাত-পা অসাড় হয়ে এল। কোনমতে চিঁ চিঁ করে বললাম, ‘জলদি নামা আমাকে। ও দেখে ফেলেছে।’
পেশীতে ঢিল দিল ওরা, মাটিতে পা রেখে হাঁপাতে লাগলাম আমি।
‘মেয়েটা দেখে ফেলেছে তোকে?’ প্রশ্ন করল ইমতিয়াজ।
‘জানি না।’
‘ঠিক আছে,’ অভি বলল, ‘আজ চল, আরেক দিন আবার আসব।’
কয়েক দিন পর আবার এলাম আমরা মিনারার সত্যিকারের পরিচয় উদঘাটন করতে। সেদিনও চাঁদ ছিল আকাশে। তবে আলো প্রথম দিনের মতো জোরালো নয়, একটু ফ্যাকাসে। মোটামুটি দেখা যায়। ওপর তলার এক জানালায় কমলা রঙের ডিম লাইটের আভা দেখলাম আমরা। পর্দা টানা আছে জানালার।
চার বন্ধু সাবধানে এগিয়ে গেলাম। ওপরে তাকাতে পর্দার গায়ে মিনারার ছায়া দেখতে পেলাম। পায়চারী করছে ও।
‘ওই তো মিনারা!’ উত্তেজিত, তবে চাপা গলায় বলে উঠল অভি। ‘একা। আজও ওর বাবা-মা কাউকে দেখছি না।’
‘বাপ-মা নেই বোধহয় ওর,’ ইমতিয়াজ মন্তব্য করল।
‘ওর বয়স কত হবে?’ আমি বললাম। ‘একশো বছর, নাকি দুশো?’
‘দেখে কিন্তু অতটা মনে হয় না,’ ফুয়াদ বলল।
খিকখিক করে হেসে উঠলাম সবাই। কিন্তু আচমকা আলোটা নিভে যাওয়ায় থেমে ওপরে তাকালাম। অন্ধকার।
‘শুয়ে পড়েছে বোধহয়,’ অভি বলল। ‘কিসে ঘুমায় ও? কফিনে?’
‘নিশ্চয়ই!’ জোর দিয়ে বললাম আমি। ‘ ভ্যাম্পায়াররা কফিনেই ঘুমায়। ওটাই ওদের বিছানা।’
খানিক নীরবতা।
‘আমি ওর কফিনটা দেখতে চাই,’ বললাম আমি।
‘কী করে দেখা যায়?’
‘পাগল হয়েছিস নাকি?’ অভি ধমকে উঠল। ‘দোতলায় উঠবি কী করে?’
জবাব না দিয়ে কাছের বড় একটা গাছের দিকে তাকালাম আমি। জানালায় এতক্ষণ আলো দেখা গেছে, ওটা তার অল্প দূরে। কাণ্ড থেকে মোটা একটা ডাল এগিয়ে গেছে জানালাটার দিকে। ওটায় দাঁড়ানো সম্ভব হলে রুমের ভেতরটা দেখা যাবে হয়তো।
‘দোতলায় না, ওই ডালে উঠে দেখব।’
আমার জবাব শুনে আঁতকে উঠল সবাই। ফুয়াদ বলল, ‘পড়ে হাত-পা ভাঙবি শেষ পর্যন্ত।’
‘ভাঙুক। তবু দেখতে হবে।’
কেউ আর আপত্তি করল না। মিনারা আসলে কী, সবাই জানতে চায়। একটা নিচু ডাল ধরে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে গাছে উঠে পড়লাম আমি। খসখসে কাণ্ড বেয়ে আরও খানিকটা উঠে সেই ডালে পা রাখলাম। নিচে তাকিয়ে অভি, ফুয়াদ ও ইমতিয়াজকে হাঁ করে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। গাছ ঘেরাও করে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারেও ওদের চেহারায় উদ্বেগ পরিস্কার দেখতে পেলাম।
সামনে তাকিয়ে হতাশ হলাম আমি। নিচ থেকে যা মনে হয়েছিল, এখন দেখছি তা ঠিক নয় ডালে দাঁড়িয়েও ভেতরে দেখতে পাচ্ছি না আমি। তার মানে আরও ওপরে উঠতে হবে।
তাই সই। সবলে গুঁড়ি আঁকড়ে ধরে একটু একটু করে আরও খানিকটা উঠলাম। হ্যাঁ, এবার হয়েছে।
ঘুরে জানালার দিকে তাকালাম।
পরক্ষণে পিলে চমকে উঠল, আঁতকে উঠলাম সশব্দে।
পর্দা সরিয়ে সরাসরি আমার দিকেই তাকিয়ে আছে মিনারা। চাঁদের আলোয় মুখটা চকচক করছে ওর। দু’চোখ ধকধক করে জ্বলছে। অন্ধকারেও ওর চেহারা নির্বিকার, একটা পেশীও কাঁপছে না মুখের।
এতই আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম যে চেষ্টা করেও চেঁচাতেও পারলাম না। স্বরই বের হলো না গলা দিয়ে।
হাত-পা অসাড় হয়ে এল, আলগা হয়ে গেল হাতের বাঁধন। সড়সড় করে পিছলে নামতে শুরু করলাম আমি। গাছের খসখসে, শুকনো বাকলে ঘষা লেগে বুকের ছাল-চামড়া যাওয়ার জোগাড় হলো।
অনেক কষ্টে নিজেকে থামালাম। চার হাত-পায়ে গাছ আঁকড়ে ধরে ঝুলে থাকলাম। ‘ও দেখে ফেলেছে!’ ফিসফিস করে সঙ্গীদের বললাম।
‘মিনারা—’
‘নেমে আয় তাড়াতাড়ি!’
অভির ধমক খেয়ে হুঁশ হলো। কোনমতে নেমে এলাম গাছ থেকে। কিন্তু আমি মাটিতে পা রাখার আগেই ওরা তিনজন ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুট লাগিয়েছে। পালাচ্ছে।
‘অ্যাই, দাঁড়া!’ কর্কশ ভাষায় চেঁচিয়ে বললাম। ‘আমি আসছি।’
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে।
দড়াম করে দরোজা খোলার শব্দে ঘুরে তাকিয়ে জমে গেলাম বরফের মতো। মিনারা দাঁড়িয়ে আছে নিচের বারান্দায়। দু’হাত কোমরে। আমার সাথে চোখাচোখি হতে চেঁচিয়ে উঠল ও, ‘কেন আমার পেছনে লেগেছো তোমরা! ভেবেছ আমি কিছু টের পাইনি! নিজেদের খুব চালাক মনে করো?’
জবাব দেব কি, ভয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। ওদিকে ওরা তিনজনও থেমে পড়েছে। ওদের দেখে ফেলেছে মেয়েটা, এই অবস্থায় পালিয়ে যাওয়ার অর্থ হবে ওর আগুনে ঘি ঢালা। হয়তো কাল স্কুলে গিয়ে নালিশ করে যা-তা কাণ্ড ঘটিয়ে বসবে, এই ভেবে পালাচ্ছে না। আপোস করার কথা ভাবছে বোধহয়।
হাবার মতো মিনারার মুঠো পাকানো দু’হাতের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। পা উঠছে না, জবান বন্ধ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাছের মাথা দোলানোর শব্দ শুনছি।
তারপর; কি করে যে ব্যাপারটা ঘটল, নিজেও জানি না, ফস করে বলে বসলাম, ‘হ্যাঁ, আমরা তোমার নজর রাখছি।’
‘কেন?’ চোখ কুঁচকে উঠল মেয়েটার।
‘তুমি-তুমি ভ্যা- ভ্যাম্পায়ার কিনা জানতে চাই আমরা।’
জবাব দিল না ও। দাঁড়িয়ে আছে বজ্রাহতের মতো। সাহস পেয়ে অভি, ইমতিয়াজ ও ফুয়াদ গুটিগুটি পায়ে ফিরে এল। সবার নজর সেঁটে আছে মিনারার মুখের ওপর।
কথা বলছে না ও। নড়ছে না। একদম স্থির। হাত দুটো কেবল ঘনঘন মুঠো পাকাচ্ছে আর খুলছে। বাতাসে শনশন আওয়াজ তুলছে গাছের পাতা। জংলা ঝোপ হুটোপুটি করছে তার সাথে। নির্মল খেলায় মেতে উঠেছে।
চাঁদ মুহূর্তের জন্য মেঘে ঢাকা পড়ায় আঁধার হয়ে গেল মিনারার মুখটা, তারপরই আবার চকচক করে উঠল। ওকে হাসতে দেখে আহাম্মক হয়ে গেলাম আমি। ঝকঝকে দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসছে মেয়েটা। ‘কি, হাসছ যে!’ বললাম আমি। বারান্দা থেকে নেমে এল মেয়েটা। আমার চার হাতের মধ্যে এসে দাঁড়াল। ‘কী করে বুঝলে আমি ভ্যাম্পায়ার?’ বলল নিচু গলায়।
চমকে উঠলাম আমি। ‘তার মানে—তার মানে—তুমি সত্যি—?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওরে মা! বলে কি? চোখ চড়ক গাছ হয়ে গেল আমার, অভি, ফুয়াদ, ইমতিয়াজ ওদেরও। পায়ে পায়ে ফিরে এল ওরা।
‘সত্যি?’ আবার বললাম আমি। বিশ্বাস করতে ভরসা হয় না।
মাথা দোলাল মিনারা। ‘বললাম তো।’
‘তাহলে তোমার রক্ত শুষে নেয়ার দাঁত দুটো দেখাও।’
‘না, তোমারটা আগে দেখাও।’
মুহূর্তের জন্য দ্বিধা করলাম। তারপর হাসির ভঙ্গিতে প্রসারিত করলাম ঠোঁট, মাড়ির ভেতরের কোন শক্তির চাপে সরসর করে ইঞ্চিখানেক বেরিয়ে এল দুই শ্বদন্ত, ড্রাকুলার মতো।
ঠিক দেখলাম কিনা জানি না, তবে মনে হলো থমকে গেল মিনারা। চোখের পাতা কেঁপে উঠল ওর। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আমার তিন বন্ধুকে দেখল। ওরা একইভাবে নিজেদের শ্বদন্ত দেখাল। ‘এবার তোমার পালা,’ হেসে বললাম আমি। ‘দেখাও।’
কিন্তু আমাদের অবাক করে চেঁচিয়ে উঠল মিনারা। দ্রুত পিছাতে গিয়ে উল্টে পড়ার ব্যবস্থা করল। চেহারা ভয়ে আতঙ্কে নীল।
‘আমি-আমি আসলে ঠাট্টা করছিলাম তোমাদের সাথে,’ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল ও। পিছিয়ে যাচ্ছে এক পা এক পা করে। ‘তোমরা যা, আমি তা নই। বিশ্বাস করো। আমি—’
এত হতাশ হলাম যে কি আর বলব!
মেয়েটাকে নিয়ে বড় আশা ছিল, ভেবেছি এতদিনে দলে আরেকজনকে পেলাম, গেল সব মাটি হয়ে।
কিন্তু এত সহজে হাল ছাড়তে রাজি নই আমি। বন্ধুদের ইঙ্গিত করে ওর দিকে এগোলাম, ওরাও চেপে এল। চারদিক থেকে ঘিরে ধরলাম আমরা মিনারাকে।
একটু পর পিছিয়ে এলাম সবাই দু’পা করে। মাটিতে পড়ে থাকা অজ্ঞান মেয়েটার দিকে। তাকিয়ে থাকলাম জ্বলজ্বলে আশা নিয়ে।
জানি, একটু পর জ্ঞান ফিরবে ওর—মিনারা রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে।
আমাদের দলের সদস্য সংখ্যা পাঁচে গিয়ে দাঁড়াবে।
…………………………………………(সমাপ্ত)………………………………………..