.নাকতলার ফ্ল্যাটটা মাস ছয়েক হলো কিনেছে রবিন ! ওদের আদি বাড়ী বর্ধমানের রসুলপুরে ! বিয়ের আগে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করতো ! এক বছর আগে রুমিকে বিয়ে করার পরই …কলকাতায় ফ্ল্যাটের জন্যে উঠেপড়ে লাগতে হলো ! কেননা …রুমি , নাকতলার কাছেই এক নামি স্কুলের …নাম করা টিচার ! রবিনের শ্বশুর বাড়ি ভবানীপুরে ! রুমির পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলো না , রসুলপুর থেকে নাকতলায় শিক্ষকতা করা !
প্রথমে ও ভেবেছিলো , চাকরিটা ছেড়ে দেবার কথা …কিন্তু রবিন জানে , এই বাজারে এরকম কুড়ি হাজারী চাকরির কি দাম ? ওদের সোশ্যাল ম্যারেজ ! সেই বাবা মাকে রাজি করিয়ে এই ফ্ল্যাটটা কিনলো ! ও একটা বেসরকারি ভালো কোম্পানির সেলস ম্যানেজার ! ..চেনা শোনার সুবাদে মোটামুটি ঠিক দামে পেয়ে গেলো !
চারতলায় দু কামরার ফ্ল্যাট …দুই বুড়ো বুড়ি থাকতো ! ছেলে এসে ওদের আমেদাবাদে নিয়ে চলে গেলো ! গৃহ প্রবেশ করে …নতুন সংসার পাতলো ! দুজনেই খুশি …যাতায়াতের সময় আর পরিশ্রম অনেক বাঁচলো ! রুমি , শুধু শিক্ষিতা নয়, সুন্দরী . …রুচিশীলা…মিশুকে ! তাই , ফ্ল্যাটের অন্যান্য বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ জমতে দেরি হলো না !
ওদের চারতলাটাই টপ ফ্লোর ..আলো, হাওয়া বাতাস তাই বেশী ! …দুজনেই আনন্দে মশগুল , তাছাড়া বাপের বাড়ী কাছে হওয়াতে প্রায়ই নেমন্তন্ন লেগেই আছে !
একটা দুবেলার কাজের লোক রেখেছে ! রবিন সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ , ভাত খেয়ে বেরিয়ে যায়…ফেরে আটটার পর ! রুমির স্কুল সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে চারটে ! …ওকে সন্ধ্যেটুকু একা কাটাতে হয়..l …কখনো টিভি দেখে….আবার কখনো এক ফালি বারান্দায় , রাস্তার লোক দেখে ! মাঝে মাঝে মা , বাবা , শ্বশুর , শ্বাশুড়ির সাথে ফোনে গল্প করে !
কাজের দিদি দীপা আসে , সকালে সাত টার সময় ! রুমিকে রান্নার সাহায্যের জন্যে ! …এরপর , দাদাবাবু বেরিয়ে গেলে …ঘরদোর পরিষ্কার , বাসন মাজা ইত্যাদি ! দিপাকে পেয়েও রুমি খুশি . …কতোই বা বয়স হবে ? বড়োজোর …পঁয়ত্রিশ , খুব হাসি খুশি…চটপটে !
….সুন্দর…স্বাভাবিক…আনন্দে চলা ছোট্ট সংসারটার হঠাৎ তাল কাটলো …! ….সেদিন রুমি তৈরী হচ্ছে স্কুল যাবার জন্যে , ফর্সা শরীরে পিঙ্ক কালারের শাড়িটা ..সত্যি ওকে আরও সুন্দরী করে তুলেছে…! দীপা ন্যাতা বালতি হাতে ঘর মুছছিলো !
” কি সুন্দর লাগছে তোমায় গো ..” রুমির গালে লালের ছোপ ধরলো ” আমার মনে হয় — এই ঘরের বদনামটা বোধ হয় এবার কাটলো ” ! চুল বাঁধার জন্যে হাতে বিনুনি ধরা অবস্থায় তাকালো !
” …কি বলছো …বদনাম ? ..কিসের বদনাম ? ”
ও ঘরে ন্যাতা চালাতে চালাতে বললো ” ও বাদ দাও দিকিনি …নানা জনের নানা কথা ”
” তুমি আধা কথা বোলো না তো ? ..এই ফ্ল্যাটের কোন বদনাম আছে নাকি ? ” প্রশ্নের গলা !
জোরে হাত চালালো ” তুমি এখন স্কুলে যাওতো বাপু ! …সে অনেক কথা , দেরি হয়ে যাবে ! …সন্ধ্যে বেলা ফেরো…বলবো খন ” রুমি ঘড়ির দিকে তাকালো …সাড়ে নটা বেজে গেছে ! ..রুমি ফেরার আগেই , দীপা চলে আসবে ! ডুপ্লিকেট চাবি দেওয়া থাকে ! তারপর যায় সন্ধ্যের পর!
….কথা না বাড়িয়ে …ব্যাগ হাতে নিয়ে ও ফ্ল্যাটের নিচে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো ! …একটাই খারাপ , লিফ্ট নেই ! …অটো ধরে স্কুলের পথে চললো …l ছোট্ট কথাটা মাথায় পাক খেতে শুরু করেছে ….ব – দ – না – ম .. ! কি ধরণের বদনাম ? …রবিন কেনার সময় নিশ্চয়ই , খোঁজ খবর নিয়েছিল …কই কিছু জানলে , ও কি কিনতো ? …তাছাড়া দুই বয়স্ক দম্পতি থাকতো …ওরাও তো বছর খানেক ছিল ?….এই ক মাসে আশপাশের প্রতিবেশীরাওতো কেউ কিছু বলেনি ? প্রশ্নের পর প্রশ্ন ওর মাথাটাকে গ্রাস করতে শুরু করে দিলো !
হঠাৎ খেয়াল পড়লো স্কুল পেরিয়ে যাচ্ছে !….অটোকে থামিয়ে নেমে পড়লো ! …অফিস ঘরে ঢুকে …অন্যান্য টিচারদের শাড়ি আর রূপের প্রশংসা শুনে , মাথা থেকে ছোট্ট …বদনাম শব্দটা কে যেন রাবার দিয়ে মুছে দিলো ! …তখনও হাসিখুশি রুমি কি জানতো …এই শব্দটা তার জীবনে কি অভিশাপ আনতে চলেছে ??
**************
….স্কুল থেকে বাড়ী ফেরার পথে …রুমির চোখের সামনে পুরোনো সিনেমাটা চালু হয়ে গেলো ! ও জানে , ইতিমধ্যে দিপাদি এসে গেছে …l কলিং বেল বাজাতেই , সাবান মাখা হাতে দরজা খুলে দিলো ! কিছুক্ষনের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে টেবিলে এলো ! দীপা ..ওর চা আর বিস্কুট এনে দিলো ! নিজেও এক কাপ চা নিয়ে ..টুলে বসলো !
” তোমার বদনামের গল্পটা এবার শুরু করো ” চা য়ে মৃদু চুমুক দিলো !
” বাদ দাও দিকিনি ..ওসব উড়ো কথা ” রুমির মুখে কৌতূহল !
” আমি সকাল থেকেই অপেক্ষা করছি ….কেননা , যেহেতু এখানে আমাদের বাস করতে হবে ” সুড়ুক করে দীপা চা টানলো !
” তোমাদের এই ফেলাটটা নাকি অলুক্ষুনে ! বেশিদিন কেউ বাস করতে পারে না ” অন্যদিকে তাকিয়ে বললো !
” কেন ? …বুড়ো বুড়ির আগেও কেউ ছিল নাকি ? ” সন্দেহের গলা l
” হ্যা গো , ওর আগে আরো একজনারা ছিল ! মাস আষ্টেক …” তার মানে, ওদের নিয়ে তিনটে পরিবার ..চা ঠান্ডা হতে শুরু করলো !
” তারা কেন গেলো ?
” লোকটার বৌটাকে ….তোমাদের শোবার ঘরে একদিন কে যেন ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো ! ”
” সে তো , হোঁচট খেয়েও পড়তে পারে …অমনি অলুক্ষুনে ফ্ল্যাট হয়ে গেলো ” দীপা খালি কাপটা মেঝেতে রেখে বললো
” তুমি চা খেয়ে নাও , ঠান্ডা হয়ে গেলো যে..” ও উঠে দাঁড়ালো l ঠান্ডা চা টাই গলায় ঢেলে দিলো ! ..রুমিও ওর সঙ্গে রান্নাঘরে এলো !
” আর কি ঘটেছিলো ? ” জানার শেষ এখনো হয় নি l
” দ্যাখো দিদিমনি , তোমরা লেখাপড়া জানা লোক..এসব গপ্পো কথায় কান দিও না …আগেই বলেছি ! ..সত্যি যদি কিছু থাকতো , এ ক মাসে তোমরা টের পেতে না ? ” আটা মাখতে বসলো ! কথাটা ঠিক বলেছে ! কই সকালে , এসব কথা শোনার আগে …এসব বাজে চিন্তাতো তার মাথায় ছিল না ! রুমি ছুরি দিয়ে আলু কাটতে লাগলো !
” দীপা দি , তুমি এসব কথা জানলে কোথা থেকে ? ” মিষ্টি গলা !
” বাঃ , জানবো না কেন ? ওদের কাছেতো শেফালী কাজ করতো ….আমার পাশেই থাকে ! ” ওর নিস্পৃহ কণ্ঠ !
” শেফালী আর কি বলেছে ? ” কৌতূহল ফোটালো গলায় ! আরও খবর জানার জন্যে রুমির মাথাটা খোঁচাচ্ছে !
” আর তেমন কিছু না …বৌটা তারপর থেকেই ভুলভাল বকা…উল্টোপাল্টা কাজকম্মো শুরু করলো “!
” আহা একটু খুলেই বলো না ..” দীপার আটা মাখা শেষ ! রুমির মনে একটা সুপ্ত উত্তেজনা !
” তুমি , এই ভর সন্ধ্যে বেলায় ওসব কথা শুনোনা ! আমি চলে গেলে ….তোমায় একা থাকতে হবে ! দাদাবাবু তো সেই রাত্রে ফিরবে ! ”
” ফিরুক , আমিও খুব সাহসী ” জেদ চেপে গেছে ! এসব কথা যতই আমরা মুখে বলি …গাঁজাখুরি , কিন্তু শুনতে সব সময় আগ্রহী ! দীপা ভাবছে , বলবে কি বলবে না ? রুমি তাড়া লাগলো ! গ্যাসে চাটু বসিয়ে দিলো ! দীপা রুটি বেলতে লাগলো !
” বউটা ..সকাল সন্ধ্যে এই তোমাদের বাথরুমে থাকতো ” এমন ভাবে কথাটা বললো, যেন মনে হলো এই মুহুর্তে ও বাথরুমেই রয়েছে !
” …খালি গায়ে জল ঢালতো আর বলতো ….সারা গা জ্বলে যাচ্ছে… l ওর বর ডাক্তার দেখালো ! বছর দশেক বিয়ে হয়েছিল …কোনো ছেলেপিলে ছিল না ! ওদের বাড়ী ছিল মুর্শিদাবাদে l ব্যবসার জন্যে এখানে ফেলাট কিনেছিলো ! ” একটানে বললো ! রুমির কান খাড়া !
” …একদিন খেটে খুটে দাদা ফিরে দেখে …রান্নাবান্না কিচ্ছু হয় নি , বৌ …..তোমার ওই শোবার ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে , অন্ধকারে ঝুঁকে পড়ে কি দেখছে ! রাগের গলায় খেতে চাইতে ….হনহন করে রান্নাঘরে গিয়ে এক বাটী কাঁচা মাংস এনে টেবিলে ঠকাস করে বসিয়ে দিলো ! …বললে .বিশ্বাস করবেনা দিদিমনি , শেফালী চাক্ষুস দেখেছে ! ” দম নেবার জন্যে একটু থামলো !
রুটি করা শেষ ! কড়া বসিয়ে দিলো দীপা , তরকারি বানানোর জন্যে !
এই ঘরেই কান্ডগুলো ঘটেছে …রুমির মনের মধ্যে একটা বিশ্রী অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে !
“….তারপর? ”
” তারপর ? ” দীপার মুখেও ভয়ের চিহ্ন ! ” সবাইকে অবাক করে দিয়ে , বউটা ওই কাঁচা মাংস তুলে …চিবিয়ে খেতে লাগলো ” রুমির সারা শরীর কিরকম গুলিয়ে উঠলো…. l
” …এক মাসের মাথায় এই ঘরদোর ওই বুড়োবুড়িকে বেচে…দেশে চলে গেলো ! ” …….
…….রান্না বান্না সেরে , কৌটোয় নিজের খাবার নিয়ে যাবার সময় বললো ” দ্যাখো , যদি মনে করো …দাদাবাবু না আসা পর্যন্ত থাকতে পারি ” — রুমি মুখে সাহস আনলো !
” না না , তুমি যাও…বরং কাল বোলো বুড়োবুড়িরা কেন উঠে গেলো ? ” ও চলে গেলো !
হঠাৎ , রুমির বড়ো একা লাগলো…..শোবার ঘরে যেতে গিয়েও ….দাঁড়িয়ে গেলো ! তবে কি অবচেতন মন তাকে দূর্বল করে দিচ্ছে ? …দীপার কথাটা কানের মধ্যে ইনিয়ে বিনিয়ে গান গাইতে লাগলো ….এই ফ্ল্যাট টা অলুক্ষুনে …..! ….রবিনের আসতে এখনো ঘন্টা খানেক দেরী ! ….টিভি টা চালাবে ? ……আচ্ছা , এতো কথা …রবিন কেনার আগে কেন জানতে পারলো না ? বয়স্ক দম্পতিরাও ফ্ল্যাট বিক্রি করেছে ….সেখানেও নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে ? …আমরা আবার কি ঘটনার সম্মুখীন হবো ?
রুমির মাথা ক্রমশ উত্তেজিত হতে শুরু করলো…আগামী অজানা বিপদের আশংকায় শরীরে ভয় বাসা বাঁধতে শুরু করলো..l ……এই সময় কিছুদিন আগেকার একটা ঘটনা , আচমকা মনে পড়ে গেলো ! …চোখ মুখে আতঙ্ক চেপে বসলো ll
….এখানে আসার কিছুদিন বাদে …স্নান সেরে রুমি যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে , সিঁথিতে সিঁদুর পড়ছে …তখনি হাত ফস্কে কৌটোটা মাটিতে পড়ে যায় ! ..মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছিলো ! ..রবিনই সান্তনা দিলো , …হাত ফস্কে কত কি পড়ে যায় ! এতে মন খারাপ করার কিছু নেই !
এখন যেন মনে হচ্ছে ….ওটা একটা সাবধান বাণী ছিল ! সন্দেহের পোকা একবার মাথায় ঢুকলে তা বের করা সহজ সাধ্য নয় ! …ও মনটাকে অন্য দিকে ঘোরাবার জন্যে , ডাইনিং রুমে রাখা টিভিটা চালালো ! চোখ টিভি র দিকে থাকলেও , মাথায় কিন্তু দীপার কথাগুলো ক্রমাগত ঘুরপাক খেয়ে চলেছে ! ..কতক্ষন এভাবে বসেছিল মনে নেই ….হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে চমকে উঠলো ! ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই …সাড়ে আট টা …প্রায় দেড় ঘন্টা টিভির সামনে বসে , কিন্তু কিছুই দেখেনি !
রবিন ঢুকলো ” কি ব্যাপার ? ..নিশ্চয়ই দারুন কোন সিরিয়াল , তিনবার বেল বাজাবার পর …” কথা শেষ করলো না !
রাত্রে খাওয়ার পাট চুকিয়ে যখন শোবার ঘরে ওরা এলো …তখন সাড়ে দশ টা ! রবিন লক্ষ্য করেছে , রুমি আজ একটু নিস্প্রান …কথায় কথায় হাসি , ঠাট্টা তা আজ অনুপস্থিত !
একটা সিগারেট ধরিয়ে ও বারান্দায় এলো ! রুমি ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখের পরিচর্যা করছিলো ! রবিনকে কথাগুলো বলবে কি না ভাবছে ! পায়ে পায়ে ও বারান্দায় এলো ! ” আমাদের এই ফ্ল্যাট টা নিয়ে কিছু কথা শুনলাম ….” শান্ত গলায় বললো ! ওর দিকে তাকালো রবিন মুখে প্রশ্ন নিয়ে !
এরপর সব কথা শুনে , সিগারেটটা নিভিয়ে বললো ” ওই জন্যে বলি ….ছাইপাঁশ ভূতের সিরিয়ালগুলো দেখো না ” ওরা ঘরে ঢুকলো ” …তাছাড়া তোমার মতো শিক্ষিতা মেয়ে যদি এইসব আষাঢ়ে গল্প বিশ্বাস করে ? তাহলে ছাত্রীদের কি শিক্ষা দেবে ? ..লোকের কাছে বললেও হাসির খোরাক ..” এরপর টানা পাঁচ মিনিট জ্ঞান দেবার পর ও থামলো ! ..রুমিও কিছুটা হালকা বোধ করলো ! …কথাগুলো খারাপ কিছু বলেনি …যুক্তি দিয়ে বলেছে ! ….এরপর দুজনেই ঘুমের সাগরে ঝাঁপ দিলো !
….মাঝ রাতে একটা বাজে স্বপ্ন দেখে রুমির ঘুমটা ভেঙে গেলো ! মোবাইলটা বালিশের তলা থেকে বার করে সময় দেখলো …একটা ! …ঘামে কপাল ভিজে গেছে ..! গলাও শুকিয়ে কাঠ ! ও উঠে বসলো ! পাশের লোক অঘোরে ঘুমোচ্ছে …..ঘরে রাতের নীল আবছা আলো …! খাট থেকে নেমে , ডাইনিং টেবিলে রাখা জলের বোতল টা নিতে গিয়ে দীপার কথাটা মনে পড়লো ! এই টেবিলে বসে বউটা কাঁচা মাংস চিবিয়ে খাচ্ছে !
…ও শোবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গেলো ! কেননা আধো অন্ধকারে ভালোই দেখতে পাচ্ছে …..টেবিলের কোনের চেয়ারে , একটা লোক মাথা নিচু করে বসে আছে …! আতঙ্কে ওর গলা চিরে এটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো ! …রবিন ধড়পড় করে উঠে দেখে …দরজার কাছে বউ হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছে ..! তাড়াতাড়ি টিউবটা জ্বালিয়ে , ওর হালকা শরীরটা পাঁজা কোলা করে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো !
দেখলো , ওর চোখ বন্ধ ..ফর্সা মুখটা ঘামে ভিজে …মুখটাতে ভয়ের রেখা …বড়ো বড়ো শ্বাস পড়ছে ! ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জল নিয়ে এসে …জলের ঝাপ্টা দিতে , রুমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো ! খানিকটা জল খেয়ে একটু ভালো বোধ হলো ! ” কি হয়েছিল ? ” রবিনের উদ্বিগ্ন গলা !
সত্যি কথাটা বলতে গিয়েও . ….ঢোঁক গিললো ! …কেননা এখুনি শুরু হবে জ্ঞানের ফোয়ারা ! ….” মাথাটা অল্প ঘুরে গেছিলো ” !
সকালে যথারীতি দৈনন্দিন কাজকর্ম শুরু হলো ! দীপা কাজে এলো ! …টেবিলে খেতে বসে রবিন মুখ খুললো ” কালকে বলতে ভুলে গেছি….অফিসের কাজে পরশু দুদিনের জন্যে আমাকে কটক যেতে হবে ..” রুমির রাতের ছবিটা মনে পড়লো ! ভয় এর চিহ্ন মুখে দেখা দিলো !
তাই দেখে ও বললো ” বাবাঃ…তুমি এমন মুখ করছো , যেন আমি জীবনের মতো চলে যাচ্ছি ! ”
” না…তা নয়..” আমতা আমতা করলো ! ” একা একা ভালো লাগে না…তাহলে আমিও মায়ের ওখানে কাটিয়ে আসি ” l
” বুঝেছি , তোমার মনের ভয় এখনও কাটেনি ” দীপা থাকায় , রবিন কথা না বাড়িয়ে অফিস চলে গেলো ! …রুমিকেও এবার স্কুলে যাবার জন্যে তৈরী হতে হবে !
রুমির মাথাটা ভার হয়ে আছে ! কালকের রাত্রের ওই লোকটাকে ….সবসময় চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে ! রান্নাঘরে এসে দীপাকে বললো ” বুড়ো বুড়িরা কেন চলে গেলো ? ” সরাসরি প্রশ্ন !
” …তুমি আর কিছু শুনতে চেও না ! …মুখটা এমনিতেই শুকনো লাগছে ! আমার বলাটাই ভুল হয়েছে ! দাদাবাবুও বলছিলো …..ভয় টয় নিয়ে !” রাতের বাসন গুলো মাজছিলো l রুমিও বুঝতে পারছে না , কি যেন একটা টানছে ….সব কথা জানার জন্যে !
” স্নানে যাবো , ধানাই পানাই ছেড়ে বলো ! সব শুনে একটা সিদ্ধান্ত নোব l ” একটু বোধয় কড়া ভাষা হয়ে গেলো !
একটু অবাক চোখে দীপা দেখলো রুমিকে ” আমিই তো কাজ করতাম …জানিনা কেন এতো জেদ চেপেছে , ঐসব অলুক্ষুনে কথা শোনার ? …উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে রইলো পরবর্তী কথা শোনার জন্যে !
অগত্যা দীপা মুখ খুললো ” বুড়িমাও দেখেছে , মিস্ত্রিটাকে …..”
” …মি – স্ত্রী ” ?
” …এই বাড়ী হবার সময়, তোমাদের শোবার ঘরের ওই জানলা গলে…নীচে পড়ে মারা যায়…” ! ….কথাটা রুমির মনের প্রশ্নটার উত্তর দিয়ে দিলো !
” ….সেই থেকেই ওর আনাগোনা এখেনে…দিনের আলোতে বড়ো একটা দেখা যায়না …কিন্তু রাত বিরেতে ” ও ঢোঁক গিললো ! রুমি তার মানে ওর ছায়া শরীরটাকে দেখেছে !
” বুড়িমা বেশ কয়েক বার দেখেছে …আমাকে বলেছে , বিশ্বাস করো দিদিমনি…আমি পাঁচকান করিনি , তুমি আমার বোনের মতো…একা সন্ধ্যেতে থাকো , তাই ভাবলাম জানিয়ে রাখি ” ! রুমি বুঝতে পারছে স্কুলে যেতে দেরী হয়ে যাবে !
” চলে গেলো ঐজন্যে ? ”
” বুড়ো বাবা বিশ্বাস করতো না …একদিন রাতে বাথরুমে ঢুকে দেখে …শাওয়ারের তলায় মাথা থ্যাঁৎলানো একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে…সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়লো ! সকালেই ফোন পেয়ে… ছেলে বউ এসে নিয়ে গেলো ” ! হাতের কাজ সারা ! ” সত্যি বলছি….
কানাঘুষোতেও যদি জানতে পারতাম , এই বাড়ি কেউ কিনছে? বারণ করতাম…অবশ্যি আমাদের মতো ছোট মানুষদের কথা কে শুনবে ? ”
” তুমি আমার ভাত টা দাও…স্নান করে আসছি..” বলেই মনে পড়লো….শাওয়ারের নীচে…..! বেসিনে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে বললো ” স্নান করার সময় হবে না ”
ক্রমশ ফ্ল্যাটের গন্ডী ছোট হয়ে আসছে ….বুঝতে পারছে রুমি…..কিন্তু ও তখনও বুঝতে পারেনি , ওর অলক্ষ্যে কি ভয়াবহ ঘটনার জাল অশুভ শক্তি বুনে চলেছে ……ll
***************
….স্কুল থেকে ফিরে রুমি মন ঠিক করে ফেললো…রবিন যায় যাক , ও একা এখানেই থাকবে ! না হলে , ভীতুর ডিম…কুসংস্কারাচ্ছন্ন , কত কি শুনতে হবে ! তাছাড়া ওদের যখন এখানেই থাকতে হবে …কত বাপের বাড়ী যাবে ? ..পরীক্ষার খাতা দেখাও বাকি ! মনে এই জোর টা আনতেই , মাথাটা হালকা লাগলো ! গুন্ গুন্ করে গানের সুরও বেরিয়ে পড়লো !
দীপা চা করে এনে বললো ” দাদাবাবু , থাকবে না …তুমি একা থাকতে পারবে ? ”
ও কি ওকে কমজোর করে দিতে চাইছে ? ” পারবো ” জোর দিয়ে বললো ” খাতা দেখা অনেক বাকি …এখন মায়ের ওখানে গেলে চলবে না ”
…সন্ধ্যের পর সব কাজ করে ও চলে গেলো ! ডাইনিং টেবিলে ডাঁই করে খাতা রেখে , ও চশমাটা পড়লো ! লিখতে পড়তে দরকার লাগে ! …মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো…রবিন বলে , চশমা পড়লে নাকি ওকে কিউট লাগে ! মন দিয়েই খাতা দেখছিলো !
হঠাৎ ….শোবারঘর থেকে একটা ….ঝন ঝন আওয়াজে চমকে উঠলো ! কারো যেন হাত থেকে লোহার কিছু জিনিস পড়ে গেলো ! ব্যস্ত পায়ে ঘরে এসে আলোটা অন করলো ! …বিস্ফারিত চোখে দেখলো….খাটের সামনেই মিস্ত্রিদের কাজ করার …সিমেন্ট বালি মাখানো..একটা কননিক পড়ে আছে !
মনের সব জোর এক ফুঁয়ে নিভে গেলো…হাত পা কাঁপা শুরু হয়ে গেছে ! অতি বড়ো সাহসী লোকও ভিরমি খাবে , রুমিতো কোন ছাড়…l
….পরক্ষনেই , খাটের তলা থেকে একটা কালো সরু লম্বা হাত বেরিয়ে এসে…কোননিক টাকে স্যাঁৎ করে খাটের নিচে টেনে নিলো ! …এর বেশী দেখার ক্ষমতা রুমির হার্ট সহ্য করতে পারলো না ….l
একটা অমানুষিক তীব্র আর্তনাদ গলা চিরে বেরিয়ে এলো ! ও ছুটে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে…পাশের ঘরের চৈতালিদের দরজার কাছে মাথা ঘুরে পড়ে গেলো l
…….রবিন ফোন পেয়ে , ট্যাক্সি ধরে আধ ঘন্টার মধ্যে হাজির ! …ওর ঘরে বেশ কয়েকজন প্রতিবেশী তখনও রয়েছে ! রুমি চোখ বুজে খাটে শুয়ে ! ওদের মুখেই শুনলো , শরীর খারাপের কথা ! ..রুমি ইতিমধ্যে নিজেকে একটু সামলেছে ! ওরা চলে যেতে রবিন বললো ” সকালেই ..বললাম , ঐসব অত্যধিক চিন্তার ফলেই …এই কান্ড ! …কালকেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো ”
আতংকিত গলায় রবিনকে সব বললো ! রবিনের মুখে একটা চাপা রাগ দেখা দিলো !
” যত নষ্টের গোড়া ওই দীপাটা…তোমার মাথাটা ওই খাচ্ছে…” অফিসের জামা প্যান্ট বদলাতে লাগলো !
” …জানিনা ওর কি মতলব ? ” — রুমি জানতো ও একথাই বলবে ! রাত্রে …রুমি কিছু খেলো না …খুব গা গুলোচ্ছে ! শুয়ে শুয়ে শুধু …. চোখে খেলা করছে ওই সব নারকীয় দৃশ্য ….!! পাশে রবিন শান্তিতে ঘুমোচ্ছে ..ও এভাবে কতদিন জেগে কাটাবে ?? …রাগও আসছে ! ট্যুরে চলে গেলে …আর একা থাকা সম্ভব ? মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাবে ! সত্যি এই অবস্থায় যে না পড়েছে , তাকে বোঝানো যাবে না !
ঘরে জোরালো লাইটটা জ্বলছে…বারণ সত্ত্বেও বন্ধ করতে দেয় নি ! ঘড়ি সময় ঘোষণা করছে রাত দুটো ! ওর মনে হচ্ছে ….খাটটা অল্প অল্প নড়ছে ! নিচু হয়ে একবার দেখবে নাকি ? ..মন সায় দিচ্ছে না ! এইসময় ড্রেসিং টেবিলটার দিকে চোখ পড়লো ! …ওদের ড্রেসিং টেবিলটা এমন ভাবে বসানো …..আয়না দিয়ে খাটের নিচের বেশ খানিকটা অংশ দেখা যায় ! ..পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে , একটা রোগা মতো কালো লোক …মাথা নিচু করে বসে আছে !
….বেতস পাতার মতো ওর শরীর কাঁপছে ….মুখ দিয়ে কথার পরিবর্তে গোঙানি বেরোলো… l ভগবানের নাম করে শরীরের সব শক্তি দিয়ে , রবিনের চুলের গোছা ধরে টানলো !
” …কি হলো ? ” ঘুম চোখে উঠে বসলো ” তোমাকেও ভুতে ধরেছে নাকি ? মাঝ রাতে চুল ধরে টানছো ? ” ….কিন্তু বৌয়ের মুখ দেখে ওর কথা আটকে গেলো ! …রক্তহীন নীলচে মুখে শুধু আতঙ্ক খেলা করছে !
” খা —খাটে র তলায় দেখো কে বসে আছে !!” একটা সুপ্ত ভয় রোবিনকেও প্রথম ছুঁলো..l ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে …..বিলকুল ফাঁকা ….কেউ কোত্থাও নেই ! ভয়ের স্থানে রাগ চলে এলো !
” কই…কেউ নেই ! প্লিজ রুমি , তুমি আমার মাথাটাও খারাপ করার চেষ্টা করো না ! ”
” আমি তোমায় পাগল বানাচ্ছি ? ..আমার এই অবস্থা দেখেও , সহানুভূতির জায়গায় রাগ দেখাচ্ছো ? কাল সকালেই মায়ের ওখানে চলে যাবো ” …চোখে ভয়ের জায়গায় এলো কান্না ! ……একটা দূরত্ব তৈরী হচ্ছে , দুজনের মধ্যে ! দুজনের মনেই চলেছে চিন্তা …কিভাবে আবার আগের দিনে ফিরে আসা যায়…চুপ করে পাশাপাশি দুটো মন জেগে জেগে ভেবে চলেছে ! শেষে দুজনের মনেই একটা নাম ভেসে উঠলো ঈ- শ্ব- র !
……রবিন চিন্তার মধ্যে আনতে পারেনি , সব কিছু গাঁজাখুরি বা আষাঢ়ে নয়…রুমীর কথা যদি একটুও বিশ্বাস করতো , তাহলে এই গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেত …..l
….সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রবিন বললো ” আজ অফিস যাবো না আর কালকে কটক যাওয়া ক্যানসেল ” রুমি অবাক চোখে তাকালো !
” তার মানে ? ”
” মানে ..আমার একমাত্র সুন্দরী বউ ছেড়ে এই অবস্থায় , কোথাও যাবার প্রশ্নই নেই ” রসিকতার স্বর ! “বরং , বেরিয়ে একটু খোঁজ খবর নিয়ে আসি ….দীপার কথা কতটা সত্যি ? ”
ও বেরিয়ে যাবার সাথে সাথেই , দীপা কাজ করতে ঢুকলো ! ” তোমার নাকি কাল মাথা ঘুরে গেছিলো ? ” তার মানে …সারা ফ্ল্যাটে কথাটা ছড়িয়ে পড়েছে ! ভাগ্যিস , মুখ ফস্কে আসল কথাগুলো বেরিয়ে পড়ে নি ? তাহলে আর দেখতে হতো না !
” শোনো ..ময়দা মাখো , দাদাবাবু কাজে যায়নি …আর আমিও আজ স্কুলে যাবো না ! একটু জলখাবার করতে হবে ! ” ….গত কালের স্মৃতি একটু ফ্যাকাশে ! স্বাভাবিক হচ্ছে রুমি…রবিনের পাশে থাকার জন্যে !
…ঘন্টা খানেক পরে রবিন ঢুকলো , দীপা থাকায় এসব কথা কিছু হলো না ! তবে রুমি লক্ষ্য করলো …ওর মুখটা বেশ গম্ভীর ! দীপা চলে যাবার পরই রবিন মুখ খুললো ” ও মিথ্যে বলে নি , এই চারতলার ঘর থেকেই একটা মিস্ত্রি , জানলা গলে নিচে পড়ে মারা যায়..আর ওটা আমাদের শোবার ঘরের জানলাটাই …” রুমির মুখে পুরোনো ভয়টা ফিরে আসতে শুরু করলো ! সেটা দেখে রবিন বলে উঠলো ” তাবলে , এটা ভাবার কারণ নেই…সে ভূত হয়ে ভয় দেখাচ্ছে ! ”
দুপুরে একটু ঘুমিয়ে রুমির নিজেকে অল্প সুস্থ লাগছিলো ! ওরা দুজনে বিকালে বারান্দায় বসে চা খেলো ! দীপাও যথারীতি কাজ করে সন্ধ্যে নাগাদ চলে গেলো !
…..রাত্রে টিউব টা বন্ধ করে. …নাইট ল্যাম্পটা জ্বেলে দিলো রবিন ! বাধা দিতে গিয়েও , চুপ করে রইলো …” তুমি ঘুমোও…ভয় নেই , আমি পাশে আছি ! ” মিষ্টি করে বললো ! বুঝলো না…বরের আস্বাসে না দুর্বলতার কারণে ও ঘুমিয়ে পড়লো ! রবিন দেখলো রুমির নিশ্বাস গভীর হচ্ছে ! যাক , উদ্ভট চিন্তা মনে হয় মাথা থেকে কিছুটা বেরিয়েছে ! ওরও তন্দ্রা মতো এসেছিলো…হঠাৎ , খুট করে একটা হালকা শব্দে ….চোখ চাইলো ! শব্দটা মাথার দিকের বন্ধ অভিশপ্ত জানলাটা থেকেই এলো ! …তবে কি রুমির থেকে সন্দেহের ভূত টা ওর মাথায় চাপলো ? উঠে বসে দেখলো …আধো অন্ধকারে , জানলার পাল্লা দুটো ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে ! ..চার তলার ওপর জানলা ? চোরের ব্যাপারই হতে পারে না ..l তাহলে ? …ও সন্তর্পনে খাট থেকে নেমে খোলা জানলার দিকে এগিয়ে গেলো ! …..গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে চার ধার দেখতে চেষ্টা করলো !
…এইসময় তীব্র একটা চিৎকারে ওর হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠলো ! পিছন দিকে তাকিয়ে দেখে , রুমি খাটের ওপর বসে তার দিকে তাকিয়ে … ! রুমি লক্ষ্য করেনি যে , ও খাটে নেই….ভেবেছে ওই মরা মিস্ত্রিটা জানলায় দাঁড়িয়ে ! ” তু — তুমি , জানলা খুলে এই রাত্রে কি দেখছো ? ” কাঁপা গলা ! কি উত্তর দেবে , ভেবে পাচ্ছে না রবিন ! আসল কথা বললে ….আরো আতঙ্কিত হয়ে পড়বে !
” রাস্তায় একটা চেঁচামেচি কানে এলো….” ভাঙা গলা ! ঘড়িতে পৌনে বারোটা ! ….জানলা ভালো করে বন্ধ করে বললো ” ..শুয়ে পড়ো ” ! কাঁপা হাতে একটা সিগারেট ধরাতে গেলো….সেই সময় পাশের ঘরে একটা …গোঙ্গানির শব্দ পেলো দুজনেই ! …ঠোঁটে ধরা সিগারেট টা মাটিতে পড়ে গেলো ! ও বুঝতে পারছে …স্নায়ুগুলো বিদ্রোহ ঘোষণা করছে ! রুমির ফর্সা মুখ ভয়ে নীলচে আকার ধারণ করলো l রবিন জোর করে নিজেকে সংযত করলো ” দেখে আসছি ”
” ন..না — আমিও যাবো ” ….আলমারির পাশ থেকে হকি স্টিক টা হাতে তুলে নিল রবিন ! যদি কোন চোর ফোর ঢুকে থাকে …তাহলে এটা কাজে লাগবে ! কিন্তু ভাবনাটা নিজের কাছেই হাস্যকর লাগছে ! পাশের ঘরটা অন্ধকার …ডাইনিংয়ের কিছুটা আলো পড়েছে !
” তুমি ঢুকো না ..” মিনমিনে কণ্ঠ ! রবিনও দোনামোনা করছে ! …কিন্তু ঘরে ঢুকে আলোটা না জ্বালালে বোঝাও যাবে না ! …শক্ত হাতে স্টিকটা ধরে ঘরে ঢুকেই আলোর সুইচে হাত দিল ! …..আলো জ্বললো না …l
….. আবছা আলোয় নজরে পড়লো…সরু ডিভানটা , কালো ছায়ার মতো কে বসে আছে ! …ও ছিটকে বাইরে বেরিয়ে এলো !
” কি হলো ? আলো জ্বালালে না কেন ? ” হিস্ট্রিয়া রোগীর মতো গলা !
” ….জ্বলছে না…” ওর মুখে ভয় লুটোপুটি খাচ্ছে !
” আমি টর্চটা আনছি …” কথা ভেঙ্গে যাচ্ছে রবিনের ! তাই দেখে রুমি তোতলালো l
” চৈতালিদের ডাকো…” রবিন দরজা খুলতে গিয়েও থমকে গেল….এখুনি সারা ফ্ল্যাট রাষ্ট্র হবে ! যদি এখানে সত্যি কিছু থেকে থাকে তখন হাজার চেষ্টা করলেও এই ফ্ল্যাট বিক্রী করতে পারবে না… l
” কি হলো ? দাঁড়ালে কেন ? অধৈর্য হয়ে উঠছে ও ! গয়ের রোমকূপ গুলো খাড়া হয়ে গেছে ! কোন উত্তর না দিয়ে শোবার ঘর থেকে টর্চটা এনে ডিভানের ওপর আলো ফেললো ! …অসম্ভব !!! চোখের সামনে একি দেখছে ? ? যেন কোন ভয়ঙ্কর হরর ফিল্মের দৃশ্য !
……একটা রোগা কালো মতো লোক ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে আছে….মাথাটা ফেটে চৌচির ….লাল রক্তের আল্পনা সারা মুখ জুড়ে …!!! অকল্পনীয় , ভাষায় প্রকাশ করা কষ্টসাধ্য ! ওরা দুজনেই থর থর করে কাঁপছে ! কি করা উচিত ? ..সেই ছোট্ট কথাটাও মাথা থেকে উধাও ! লোকটা টলমল করে উঠে দাঁড়াতেই …..মাথায় একটা বিপদ ঘণ্টি বাজলো ! ওরা হাতে হাত জড়িয়ে দু পা পিছিয়ে ডাইনিংয়ে এলো….কাঠের পুতুলের মতো l
….রক্তাক্ত শরীরটা টানতে টানতে ও বাইরে এসে ওদের দিকে তাকালো…..ওঃ কি নির্মম চাউনি ! যেন জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওদের পুড়িয়ে ছাই করে দেবে ! ওরা যেন মোমের পুতুলে পরিণত হয়ে গেছে…l ওর আগুনে দৃষ্টিতে একটু বাদেই গলে যাবে…l
ও দাঁড়িয়ে ছিল বড়জোর এক মিনিট…ওদের কাছে সেটা অনন্তকাল লাগছিলো ! ….এবার সেই রক্তে চোবানো মূর্তি শোবার ঘরের জানালাটার কাছে যেতেই ….জানালাটার পাল্লা দুটো খুলে গেলো ! তারপর গ্রিলের ভেতর দিয়েই আশ্চর্য জনক উপায়ে নিচে লাফ দিলো !…..ধপাস করে একটা শব্দ উঠলো , পরক্ষনেই রক্ত হিম করা এক অন্তিম আর্তনাদ ওদের চারপাশে নাচতে থাকলো !…..দাঁড়াবার সামর্থ ওরা হারিয়ে ফেললো ….মেঝেতে আশ্রয় নিলো !!
…..ভোরের জন্যে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল…দুজনেই এখন একই পথের পথিক ! …দরকারি কিছু জিনিস পত্র একটা সুটকেসে নিয়ে নিয়েছে …ওদের গন্তব্য স্থল আপাতত , রুমির বাবার ওখানে ! ঘরে তালা লাগিয়ে নিচে নেমে …ট্যাক্সি ধরলো ! ….একবারের জন্যেও ফিরেও তাকালো না….অভিশপ্ত ফ্ল্যাট টার দিকে ll
…………………………………………..{ সমাপ্ত }………………………………………….