প্ল্যানচেট নিয়ে লিখতে গিয়ে একটা জিনিস বুঝেছি..এগুলো বিতর্কের বিষয় l কেননা কেউ বলবে আষাঢ়ে গল্প..বুজরুকি ..আবার কেউ বলবে…থাকলেও থাকতে পারে l অন্ধকার আছে বলেই আলোর কদর l তেমনি অশুভ শক্তির বিনাশের জন্যেই শুভ শক্তির আরাধনা l হোম ..আরতি..যোজ্ঞ….ঈশ্বরের আরাধনা একদিকে , অন্য দিকে কালা জাদু. ..ডান বিদ্যা. ..বান মারা..ইত্যাদি .. l
আমার অনুরোধ…পাঠক পাঠিকার কাছে, নিছক গল্প হিসেবেই পড়বেন l
আমার জীবনের আর এক অভিজ্ঞতার ঘটনা বলতে চলেছি l যা বুদ্ধি দিয়ে আজও সমাধান করতে পারিনি l
বাবা কাজ করতো এক মাড়োয়ারি ফার্মে l আমাদের সংসার বলতে..মা আর আমরা দু ভাই , দাদু কয়েক বছর আগেই মারা গেছেন l ইদানীং বাবার শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না l আমি সবে বি .কম পাস করেছি..শুরু করেছি চাকরির জন্যে দরখাস্ত ছাড়া.. l ভাই ক্লাস এইটে পড়ে l এক আধটা
টিউশানি করে আমি নিজের হাত খরচটা চালাই l মা ছিল খুব বুঝদার …কত টাকাই বা মাইনে পেত বাবা ! কিন্তু মা হাসি মুখে ওই কটা টাকা দিয়েই সংসার সামলাতো l কি করে যে চালাতো ? এখন সংসার চালাতে গিয়ে অবাক হয়ে যাই ! তবে আমাদের চাহিদাগুল সীমিত ছিল l
………….সেই বিশেষ দিনটা আজও আমার মনে আছে, শুক্রবার …!! বাবার অফিসের দুজন কলিগ দুপুর বেলা..অসুস্থ বাবাকে আম্ব্যুলেন্সে করে বাড়ি নিয়ে এলো.. l চল্লিশ বছর আগে পাড়ায় ওই গাড়ী ঢোকা মানে…লোকের ভিড় ভেঙে পড়া l স্ট্রেচারে করে নামিয়ে বাবাকে বিছানায় শোয়ানো হলো.. l আমাদের সবার মুখে প্রশ্ন..?? এক কলিগ বললেন ” সন্দীপদার যে ক্যান্সার হয়েছে..আপনাদের জানায় নি…আমাদেরও জানাতে দেননি …..আজ কাজ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যান..অফিসের ডাক্তার মাস তিনেক আগেই বলেছিলেন …..কিন্তু পয়সার জন্যে কোনো চিকিৎসা করেননি …আজকে ডাক্তার জানিয়ে দিলেন..লাস্ট স্টেজ ..আর বড়জোর মাস খানেক ” ..l
কথা গুলো গরম সীসের মতো কানে ঢুকতে লাগলো ! সেই সময় এই রোগের চিকিৎসার অত উন্নতি হয় নি l সবাই মারণ রোগ বলেই জানতো ….! এই প্রথম মাকে ভেঙে পড়তে দেখলাম…!! আমিও খুব অসহায় বোধ করতে লাগলাম l ..বাবা এরপর যে কদিন বেঁচে ছিল..মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না…,, সেই অস্থির চাউনি …দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রনা সহ্য করা…বুঝতে পারতাম আমরা , মানুষটা আমাদের ভবিষ্যতের কথাই ভেবে চলেছে….! দেড় মাসের মাথায় বাবা মারা গেলো.. l অফিস থেকে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিলো…যা দিয়ে কোনোরকমে শ্রাদ্ধ শান্তির কাজটুকু মিটবে ….তারপর?? মাথায় আমাদের আকাশ ভেঙ্গে পড়লো..!!!!!
বাবা মারা যাবার একমাসের মধ্যে ..ভগবান বোধ হয়, একটু মুখ তুলে চাইলেন l একটা নামী কোম্পানী থেকে ইন্টারভিউয়ের জন্যে চিঠি এলো ! আগামী আঠারো তারিখে সমস্ত অরিজিনাল সার্টিফিকেট নিয়ে ওদের অফিসে বেলা দশটার মধ্যে হাজির হতে হবে l অনেকদিন বাদে মনটা একটু হালকা লাগলো l মা কে বলতে…হাতজোড় করে মা….ঠাকুরের উদ্দেশে প্রণাম জানালো.. l খুশিতে ওদের মুখে হাসি ফুটলো…মনে হলো আমি চাকরিটা পেয়েই গেছি !
আমাদের সব দরকারি কাগজপত্র …বাবার আলমারী তে থাকতো l মাকে বললাম ” আলমারীর চাবিটা দাও…আমার ফাইল টা বার করবো..”, ……বাবার স্বভাব ছিলো সব গুছিয়ে রাখা l …আলমারী খুলে আমার হলুদ ফাইলটা চোখে পড়লো না !! পুরো আলমারিটা ঘেঁটে ফেললাম ….ওরাও আমার সঙ্গে হাত লাগলো , সব আছে..শুধু হলুদ রঙের ফাইলটাই উধাও ….!!
কপালে ঘাম জমে উঠেছে …! মায়ের উদ্বিগ্ন গলা ” এখানেই রেখে ছিলিস তো ? ” …..” তার মানে ? ওই ফাইল আমি কোনোদিন নিজের কাছে রেখেছি ? …বাবাই সব যত্ন করে রেখে দিতো ..” l
…মনে পড়লো..শেষবার যখন সার্টিফিকেটগুলো চেয়ে ছিলাম….বাবা বলেছিলো ” একেবারে ত্রিশ কপি করিয়ে নে….তাহলে বারবার দোকানে ছুটতে হবে না ” l সেই থেকে আর দরকার পড়েনি l কিন্তু ফাইলটা গেলো কোথায় ??….এদিকে আজ চোদ্দ তারিখ ….মাত্র তিনদিনে বোর্ড বা ইউনিভার্সিটি থেকে বার করা সম্ভব ?? ঘরে তিনটে প্রাণী চুপচাপ দাঁড়িয়ে…!! ইস ! এতো বড়ো সুযোগটা হাত ছাড়া হয়ে যাবে l তাছাড়া যদি আসল সার্টিফিকেট বার করতে না পারি ?? ..আমার ভবিষ্যতের সাথে সংসারটাও ভেসে যাবে…!!
মা ঠাকুরের কাছে মাথা ঠুকতে শুরু করেছে.. l মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম ” এতো জলদি ভেঙে পড়োনা…একটা কিছু উপায় করবো ” , কিন্তু আমি নিজেই জানিনা কি উপায় ?? আমাকে এখন একটু একা থাকার দরকার…যদি ঠান্ডা মাথায় কিছু মনে পড়ে.. ভাইকে স্কুলে পাঠিয়ে দিলাম…চান করে দুমুঠো খেয়ে নিলাম … মা নিজের ঘরে গিয়ে শুলো …কিছুই মুখে তুললো না…l
বিছানায় শুয়ে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে চিন্তায় ডুবে গেলাম…বাবাও অন্তিম সময়ে কামনা করেছিল …আমার একটা চাকরী..! হঠাৎ শরীরে একটা অস্বস্তি শুরু হলো..! কি রকম যেন শরীরটা লাগছে.. l মাথাটা ভার হয়ে আসছে…হাত পা গুলো অবশ অবশ লাগছে ! চোখের পাতাগুলো ভারী ভারী লাগছে l এ আবার কি উপসর্গ ! অত্যধিক চিন্তার ফল নাকি? কানের কাছে কে যেন ফিসফিস করে উঠলো…!!
ঘাড় ঘুরিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না l তবে মা কি এসেছিলো? গলাটা শুকিয়ে গেছে…উঠে বসলাম , নাকে একটা কটু গন্ধ এসে লাগলো.. l একটা পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি l জোর করে উঠে দাঁড়ালাম , মায়ের ঘরের দিকে গিয়ে দেখি..ঘুমোচ্ছে l রান্নাঘরে এসে দেখলাম.. ..নাঃ এখানে তো পোড়া গন্ধ নেই…l জল খেতে একটু সুস্থ লাগলো l মা ঘরে এসে দাঁড়ালো ” কিছু বলবি ? ঘরে গিয়েছিলি ? ” ” না একটা পোড়া গন্ধ পেলাম ! ”
” পোড়া গন্ধ ! ” মায়ের মুখে এক অজানা ভয়, !! কিসব বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলো l
আমরা দু ভাই এক ঘরে শুই l রাত্রে খেয়েদেয়ে ছাদে এলাম …..l গুমোট গরম পড়েছে..! চিন্তা যে মানুষকে পাগল করে দিতে পারে, তা এখন হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছি l পায়চারী করতে করতে…ফাইল টার কথাই ভাবছি …..কাল পনেরো তারিখ…কি করবো ? হাতে আর তিনটে দিন..! সমাধানের কোনো রাস্তা এখনো চোখে পড়ছে না… l
….হঠাৎ এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগলো…আরামের বদলে শরীরে অন্য রকম একটা অনুভূতি হতে শুরু করলো….! দুপুরের মতোই হাত পা ভার হতে লাগলো…! অন্ধকারের মধ্যেও ছাদের আলসের কাছটায় চোখ আটকে গেলো..! একটা হালকা ধোঁয়ার কুন্ডলী…পাক খাচ্ছে..! বুঝতে পারছি আমি ভুল দেখা শুরু করেছি.. l মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিলাম. …কুণ্ডলীটা একটা আকার নিতে শুরু করেছে …!! মন থেকে কে যেন সতর্ক করলো..এখানে থাকা ঠিক নয়..! নীচে নেমে এলাম, বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে দেখি..মা..শুয়ে পড়েছে..ঘরের আলো নেভানো l নিজের ঘরে এসে দেখি ভাইও ঘুমের মধ্যে l ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারো …l নীল আলোটা জ্বালিয়ে …চোখ বন্ধ করলাম l
….কানের কাছে ফিসফিস কথার আওয়াজে ..ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ওর ঘুমন্ত মুখ চোখে পড়লো ! কেন আমার এইরকম হচ্ছে বুঝতে পারছি না..l মনে হচ্ছে কেউ কিছু বলতে চাইছে…..এই প্রথম ভয় পেতে শুরু করলাম l ভয় ভয় চোখে ঘরের চারধারে তাকাই…জানলার কাছে সেই ধোঁয়ার কুন্ডলী …ছাদ থেকে এখানেও চলে এসেছে… ! আমার সারা শরীর ভয়ে হিম হয়ে যাচ্ছে..! এই সময় ভগবানের কথা মনে এলো l পৈতে হাতে নিয়ে একমনে গায়েত্রী জপ করতে লাগলাম..!
সারা শরীর থেকে সেই বিশ্রী অনুভুতিটা ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকলো ….ধোঁয়ার মেঘও পাতলা হতে লাগলো…দু চোখে সারা রাজ্যের ঘুম নেমে এলো..l ঘুমের মধ্যেই স্বপ্ন দেখলাম…..বাবা আমার হলুদ ফাইলটা হাতে করে অফিস যাচ্ছে… ! অফিসে ঢুকে কোনে রাখা একটা নীল আলমারির মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলো ….!!
সকালে ঘুম ভাঙতেই ….রাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়লো..l ..”মা…আ….” ডাক পারলাম..” শোনো এখনই বেরোবো ..বাবার অফিস যাবো..মনে হয় ফাইলটা পেয়ে যাবো “, মা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে l
বাবার অফিসের লোকরা আমায় চিনতো .” দেখুন, বাবা একটা আমার সার্টিফিকেটের ফাইল এখানে ফেলে গেসলো …” ,কোনের নীল আলমারিটা খুলতেই …….দেখতে পেলাম সেই হারানিধিকে…সযত্নে বগলে চেপে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম… l চোখে জল এসে গেলো…মৃত বাবার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালাম l
এবার বুঝতে পারছি বাবা…তুমি অনেক চেষ্টা করছিলে ..তোমার ওই ছায়ার শরীর নিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করার…!! আমি ই ভয়ে সরে এসেছি..তুমি যেখানেই থাকো, ভালো থেকো বাবা…. l কান্না রুখতে পারছি না…রুমালটা বার করলাম l
আজকেও ভাবি….স্বপ্ন…আত্মা..পরলোক …সবই কি কল্পনা? তাহলে ঈশ্বরকে আমরা কিসের ভিত্তিতে ডাকি ? মনে হয় এর একটাই উত্তর…. .বিশ্বাস ||
………………………………………(সমাপ্ত)……………………………………….