ভূতে ধরা

ভূতে ধরা

ভূতে ধরা…বিষয়টা বিতর্কিত , এখনকার চিকিৎসা শাস্ত্রে ..হিস্টিরিয়া…মৃগী …ইত্যাদি নামে অবিহিত l এই রকম ঘটনা আপনি অনেক পড়ে বা শুনে থাকবেন l একটাই কথা..বাস্তবের সাথে মেলাতে বসবেন না ! আপনারা অনুরোধ করেন , একেবারে পুরো ঘটনাটা লেখার জন্যে…না হলে ছন্দপতন হয় …! তাই পুরো গল্পটা একসাথে দিলাম ! কেমন লাগলো জানাবেন !
বেশিদিনের কথা নয়, বছর দশেক আগেকার.. l আমি এই বিষয়ে ঘোরতর অবিশ্বাসী ছিলাম l কিন্তু ভাবতে পারিনি …এইরকম একটা ভৌতিক ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়বো l আমাদের বাড়ীতে দিপালী নামে একজন বউ মানুষ কাজ করতো l ছিপছিপে চেহারার ওর বয়স পঁয়ত্রিশ …চল্লিশ হবে l ওর একটাই ছেলে কাবলু ….বর অনিল রিক্সা চালাতো l মাঝে মাঝে কাবলুও মায়ের সাথে আসতো…জলখাবারে দিপালী কে রুটি ..মিষ্টি দেওয়া হতো …সেই লোভে l ওর বয়স কতই বা হবে ? বড়ো জোর এগারো ! রোগা,কালো..ছেলেটা খুবই শান্ত প্রকৃতির l
পুজোর আগে একদিন অফিস থেকে বাড়ী এসে শুনলাম …দিপালী কাজে আসেনি l বউ রীতা বললো ” একটা খবরও পাঠায় নি…দুবেলার কাজ একা হাতে করা” l আমাদের এক ছেলে , ব্যাঙ্গালোরে পড়ে..l
” শোনো , কাল সকালে অফিস যাবার পথে…ওর বাড়ীতে একটা খবর নিয়ে যাবে ” চা দিতে দিতে বললো l
” দাঁড়াও..একদিনে উতলা হয়ে পড়লে, জ্বর জ্বালাও হতে পারে..” l
” যাকে কাজ করতে হয় , সেই বোঝে ..” ওর কথায় রাগের আভাষ l কথা আর বাড়ালাম না.. l টিভি দেখতে বসে গেলাম l
সকালে একটু আগেই বেরোলাম ..কেননা ওদের বাড়ী শহরের শেষ প্রান্তে l দু একবার এসেছি..এই রকম খোঁজ খবর নিতে l ওদের এই বস্তী এলাকাটায় বেশী উন্নতি হয় নি l গ্রাম্য পরিবেশই রয়ে গেছে ! বেশ কয়েকটা পুকুর …ঝোপ ঝাড়..কাঁচা রাস্তা..আলোটাও এখনো আসেনি..সবে রাস্তায় ল্যাম্প পোস্ট বসাবার কাজ শুরু হয়েছে l
ওদের বাড়ীর সামনে এলাম l দীপালীর বর অনিল বেরিয়ে এলো , চোখে মুখে উৎকণ্ঠা..,! ” কী ব্যাপার ? কারো অসুখ বিসুখ নাকি ?” প্রশ্ন করলাম l
” না..দাদা, ছেলেটা কাল স্কুলে গেছলো…বিকেল পর্যন্ত ফিরছে না দেখে…খোঁজ খবর শুরু করি..কিন্তু পাওয়া যায় না..” l
” সে কি ! তারপর !!”
” ..এই ভোরের দিকে খুঁজে পেয়েছি..! ” একটু দূরে বড়ো ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছটার দিকে আঙ্গুল তুলে বললো ” ওই গাছটার নীচে শুয়ে ছিল ” l দিপালীও বেরিয়ে এলো l ওর চোখে জল..,! ” দাদাবাবু , কি হবে! …সারা রাত আমরা কত খুঁজেছি …এদিকে ওই অলুক্ষুনে গাছটার নীচে..” কান্নায় ভেঙে পড়লো l
” আরে..এতে এতো কাঁদবার কি হলো ? ” সান্তনার গলা ” ছেলে মানুষ কি খেয়ালে পথ ভুলে চলে গেছে..” নিজের কথাতেই বাস্তবতার অভাব …স্কুল থেকে একজন ক্লাস ফোরের ছেলে চলে গেলেও , বাড়ী আসতে পারবে না ? ক্ষিধে …তেষ্টাতেও তো আসবে….!
￰ঘড়ির দিকে তাকালাম…” এখন কিরকম আছে ? কিছু বলেছে …কেন গেলো ? ”
” না…চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে..” কান্না ভেজা গলা ” মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কিসব বকছে …গায়েও জ্বর.. ”
পকেট থেকে দুশো টাকা বার করে অনিলের হাতে দিলাম l ” এটা রাখো..ডাক্তার দেখাও …অফিস থেকে ফেরার পথে খোঁজ নিয়ে যাবো..” সাইকেলে চাপলাম l
ট্রেনে উঠে , বাড়ীতে জানিয়ে দিলাম ফোন করে l অফিসে কাজের চাপে ব্যাপারটা ভুলে গেলাম …মনে পড়লো ফেরার সময়.. l
সন্ধ্যের দিকে অফিস ফেরতা ওদের বাড়ী এলাম l চার পাঁচজন লোক বাইরে দাঁড়িয়ে..তবে কি ছেলেটার বাড়াবাড়ি কিছু হলো ? দিপালীর কান্নার আওয়াজ শুনে ভেতরে ঢুকলাম l শুনলাম …ডাক্তার দেখানো হয়েছে..বিকেলের দিকে কাবলু ঘুমোচ্ছিলো , ওর বাবা রিক্সা নিয়ে ভাড়া খাটতে গেছিলো..দিপালীও গা ধুতে বাথরুমে…ঘরে এসে দেখে…ছেলে নেই ! দরজা খোলা !
পাশাপাশি ঘর থেকে লোক জুটিয়ে ওরা যাচ্ছে সেই তেঁতুল তলায়…ওদের ধারণা, ওখানেই কাবলুকে পাওয়া যাবে.. l সঙ্গে দুটো টর্চ আর একটা হারিকেন নিয়ে এসেছে l
” দাঁড়াও…আমিও যাবো ” বাড়ীতে জানিয়ে দিলাম l সন্ধ্যে অনেক্ষন হয়ে গেছে l চারিদিকে অন্ধকার ছাইছে…! পুকুর পাড় ধরে আমরা পাঁচজন এগোলাম গাছটার দিকে..! চারিদিকে ঝোপঝাড় , বড়ো বড়ো ঘাসের মেলা l সাপখোপেরও ভয় আছে..কি রকম একটা পচা পচা গন্ধ , নাকে লাগছে l হারিকেন আর টর্চের আলোয়…অল্প জায়গা আলোকিত হচ্ছে l আমরা ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছটার কাছে এসে পৌঁছলাম l
……..গুঁড়ির কাছে টর্চের আলোয় ছেলেটাকে দেখতে পেলাম ! উবু হয়ে বসে , ঘাড় উঁচু করে গাছটার ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে l ওর বাবার ডাকে মুখ ঘুরিয়ে দেখেই …গাছটাতে ক্ষিপ্র গতিতে চড়তে শুরু করলো ! আমার বুকটা এক অজানা আশঙ্কায় ছ্যাঁৎ করে উঠলো ! কাবলু ওই জ্বর গায়ে …এই অন্ধকারে সরসর করে গাছে উঠছে কি করে ?? এক অপার্থিব দৃশ্য ! ওদের ভয়ার্ত গলা ” ওকে ভূতে ধরেছে…” !!
আমি এক মুহূর্তে নিজের মন শক্ত করলাম l ছেলেটা যে গতিতে উঠছে….তাতে এখনই আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাবে.. l এক লাফে গিয়ে ওর পা টা চেপে ধরলাম l ও আমার দিকে তাকালো…টর্চের ক্ষীণ আলোয় ওর মুখটা দেখে …প্রচন্ড ভয় পেলাম …l জীবনে এরকম ভয়ঙ্কর, কুৎসিত মুখ দেখিনি… l এটা ওই ছোট্ট ছেলেটা ? মেলাতে পারছিলাম না !!!
চোখ দুটো টকটকে লাল…আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচোচ্ছে ….মুখ দিয়ে একটা জান্তব গড়গড় আওয়াজ ছাড়ছে..l ইংরেজী একটা ভূতের সিনেমা দেখেছিলাম…কালো একটা নেকড়ে রাতে ভূত হয়ে যেত ..l মনে হচ্ছে ওই নেকড়ের মুখটাই দেখছি.. l
বাকীরাও এসে টানাটানি করে ওকে নামানো হলো l কি অস্বাভাবিক শক্তি ওর ঐটুকু শরীরে.. !! কোন রকমে চ্যাংদোলা করে ওই জঙ্গল ডিঙিয়ে কি ভাবে যে ওর বাড়ীতে নিয়ে এসেছিলাম …এখন চিন্তার অতীত l
বাড়ীতে এনে বিছানার সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধতে হলো…কেননা আক্রোশে দাঁত..নখ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে l মনে হচ্ছে যে কোন সময়ে দড়ি ছিঁড়ে ফেলবে l একটানা নারকীয় কণ্ঠে কি যেন বলছে…l যা আমাদের কারো বোধগম্য নয়. !
ডাক্তার বাবুর ফোন নম্বর আমার কাছেই ছিল l উনি শুনে বললেন , এক্ষুনি হাসপাতালে ভর্তি করান l ওর বাবা রিক্সা বার করলো.. l দুজন দুদিকে চেপে ধরে হাসপাতালের দিকে চললো l আমিও সাইকেল নিয়ে ওদের পিছু নিলাম.. l ঘড়িতে তখন আটটা বেজে গেছে l
ওরা রোগীর অবস্থা দেখে প্রথমেই ঘুমের ইঞ্জেক্সন দিয়ে..স্যালাইন চালালো l রাতের জন্যে একটা আয়া ঠিক করে বাড়ী ফিরলাম যখন..তখন দশটা বেজে গেছে.. l বাড়ীতে সব ঘটনাটাই বললাম… l রীতার মুখটা ভয়ে এতটুকু হয়ে গেছে.. l রাতে আমার পাশ ঘেঁষে শুলো l আমার কিন্তু সারারাত ঘুম হলো না… l
….এপাশ ওপাশ করছি..এতো পরিশ্রমের পরও কেন ঘুম আসছে না..বুঝতে পারছি না.. !! ভোরের দিকে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম l সকাল সাতটার আগেই ঘুম ভেঙে গেলো l শরীরে ব্যাথা অনুভব করলাম l পরিশ্রমের ফল.. l রীতাকে ডেকে বললাম ” আজ অফিস যাবো না..” ওর মুখটা থমথমে হলো l
…..” কেন আবার হাসপাতাল ছুটবে ? ” মুখ ঝামটা দিলো ” যা শুনলাম..তাতে ওদের বলো, ওঝা টোঝা ..দেখাক ..” ওর কথায় হাসলাম l
” বিংশ শতাব্দীর দরজায় দাঁড়িয়ে..এসব বলো না..লোকে পাগোল বলবে ” আমার হাসিতে সেই বিশ্বাস যোগ্যতা ছিলো না…গতকালের ঘটনা দেখার পর l
কিন্তু ….তখনও জানতাম না…যেটুকু অবিশ্বাস এখনো আমার মনে আছে…তা একদিনের মধ্যেই পরিবর্তন হয়ে যাবে l

সকালে হাসপাতালে এলাম l রাতের আয়া পয়সার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে l দিপালীরাও এসেছে..ওদের চোখে আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা l আয়ার কাছে গিয়ে টাকা মেটালাম … l বয়স্কা আয়া কিছু বলতে চাইছে মনে হলো l
” কিছু বলবে ” ? একটু কিন্তু করে, চারপাশ তাকিয়ে ,আস্তে আস্তে বললো ” আমার মনে হয়…ওকে কিছুতে ধরেছে..”
” হঠাৎ..এরকম মনে হওয়ার কারণ..” চোখে কৌতুহল ! ফিসফিসিয়ে ও বললো ” রাত্রে ছেলেটা ঘুমের ঘোরে…কথা বলছিলো, ওর কথার স্বর শুনে..মনে হচ্ছিলো দুটো মানুষ একসাথে কথা বলছে ! মানেও বুঝতে পারছিলাম না…” ! ওর চোখে ভয় খেলা করছে l
” একটা কথা বুঝতে পারলাম …যা বারবার বলছিলো…আমি ওকে ছাড়বো না…তেঁতুল গাছেই আমরা থাকবো ” l ……আমার মনে এবার ধারণা জন্মালো …এটা মনে হয় কোন অতীন্দ্রিয় ব্যাপার ! কেননা আমরা কেউই আয়াকে তেঁতুল গাছের কথা বলিনি.. l ￰দিপালীর সাথে ওর পাড়ার কয়েকজন এসেছিলো, নীচু গলায় কিসব বলাবলি করছিলো l আমি কাছে যেতেই থেমে গেলো l অনিল হাত কচলে বললো ” দাদা, আমরা ওকে আজকেই এখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবো ” আমার চোখে প্রশ্ন ! দীপালিও গলা মেলালো ” সবাই বলছে..কাবলুকে ঝাড় ফুঁক করা দরকার ”
আমিও দোটানায় পড়ে গেছি l সেদিনই বিকালে ছেলেকে ছুটি করিয়ে নিয়ে গেলো l জ্বর টাও কমে গেছিলো ..ভুল বকাও বন্ধ.. l
পরদিন শুনলাম..ওরা ছেলেকে নিয়ে হরিপালের দিকে কোন মাজারে যাবে…সেখানে নাকি এক পীরবাবা থাকে, এইসব ভূত প্রেত ছাড়ানোর ….তেলপোড়া..জলপোড়া..কবজ দেয় ! আমারও মনে একটা কৌতূহল দানা বেঁধেছে l এসব চাক্ষুস দেখার ! রীতার বারণ কানে না তুলে…খবর দিলাম আমিও যাবো l
অফিস কামাই করেই ওদের সঙ্গে চললাম l হরিপাল স্টেশন থেকে অটো করে প্রায় আধ ঘন্টা যাবার পর….কালীগ্রাম বলে একটা জায়গায় নামলাম l লোকবসতি বেশী নেই..আধা গ্রাম.. l ছেলেটার বাবা,মা.আমি আর ওর মামা…মোট পাঁচজন l কাবলু দিব্যি ভালো…কোনোরকম অস্বাভাবিকতা নেই..l এরপর শুরু করলাম হাঁটা…l কখনো পুকুর পাড় ধরে আবার কখনো বা আলুক্ষেত ধরে পথ… l শেষ আর হয় না…মনে মনে ভাবছি না এলেই ভালো হতো.. l
অবশেষে পৌঁছলাম …সেই মাজারে ! বেড়া ঘেরা…খানিকটা জমি…চারিধারে সবুজ ধানক্ষেত …তার মাঝে দু তিনটে ছোট ছোট ঘর…টালির চাল দেওয়া..! ঘর গুলোর কাছাকাছি বড়ো বড়ো একটা নিম আর একটা শিমুল গাছ..জায়গাটা ছায়া করে রেখেছে.. l
সাদা দাড়িওয়ালা পীরবাবার গলায় অগুনতি হার…আঙুলে গোটা পাঁচেক পাথর বসানো আংটি l ওনার এক সাগরেদকেও দেখলাম l মনে হয় বাবার দেখভাল করে , l মনে হয় ওর মামা আগেই বলে রেখেছিলো , কেননা যেতেই কাবলুকে একটা গোল কাটা জায়গায় ..সাগরেদটি বসিয়ে দিলো l ছেলেটা এতক্ষন ভালোই ছিল..এবার উশখুশ করতে লাগলো l আমি বেড়ার ধারেই দাঁড়িয়ে রইলাম l কাবলুর সামনে পীরবাবা হাঁটু গেড়ে নামাজ পড়ার ভঙ্গিতে বসে….সবাইকে চমকে দিয়ে বিকট চেঁচিয়ে বললো “আমার চোখের দিকে তাকা….” কাবলু মাটির দিকেই তাকিয়ে রইলো l আবার ধমক! ছেলেটা ধীরে ধীরে ওর দিকে তাকালো.. l সভয়ে দেখলাম…রাত্রে দেখা সেই রক্তচক্ষু ….ফিরে এসেছে l
ওর শরীরে একটা পরিবর্তন ঘটতে শুরু হয়েছে l বাবা হাত নেড়ে ওদের সরে যেতে ইঙ্গিত করলো l সন্দেহ ভরা চোখে ক্রিয়াকলাপ দেখছি..!
” তুই কে ? ” বাবার বাজখাঁই গলা ! ” একে ধরেছিস কেন ? ” কোন উত্তর না পেয়ে…সাদা গুঁড়ো মতো কি একটা পেতলের বাটি থেকে নিয়ে, ওর মাথায় ছিটিয়ে দিলো l ও শরীরটাকে মোচড়াতে শুরু করলো l গলা দিয়ে সেই জান্তব স্বরে গরগর করতে লাগলো ! আমার জীবনে নতুন এক অভিজ্ঞতা … !!
হঠাৎ..ছিলে কাটা ধনুকের মতো কাবলু দাঁড়িয়ে উঠলো..!! সঙ্গে সঙ্গে বাবা…চামরটা হাতে নিয়ে বললো ” এখানে বোস…পালাবার চেষ্টা করে লাভ নেই, তোকে ঘিরে দিয়েছি l ” ….কাবলু দাঁত কিড়মিড় করতে করতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসলো l
ঘড়ির দিকে তাকালাম..বেলা বারোটা বাজতে চললো….l পীরবাবা দীপালিদের দিকে না তাকিয়েই বললো
” একদম নীচু শ্রেণীর আত্মা…শরীরে গেড়ে বসেছে..সময় লাগবে ছাড়াতে ” l ওদের মুখে আতঙ্ক !
আবার শুরু করলো একই রকম জেরা …l ওর শরীরে ও মুখে খেলা করে চলেছে…একই ভয় ধরানো ভঙ্গি l
” শীগগির বল…কোথেকে একে ধরলি ” এবার মুখ থেকে মেয়েলী কণ্ঠে কে যেন বলে উঠলো .. “তেঁতুল তলায় ও দুপুরে গেছিলো..”
” কি ক্ষতি করেছে তোর ? ”
” ….ও গাছতলায় পেচ্ছাপ করেছে…” ও কুটিল হেসে বললো ” আমি ছাড়বো না….যতই বলিস..” এই বলে গ্যাঁজলার মতো খানিকটা থুথু ছিটিয়ে দিলো l তাড়াতাড়ি মুখ সরিয়ে নিলো বাবা l
ফকিরের মুখটা শক্ত হয়ে উঠলো l ছোট একটা বোতল থেকে খানিকটা তেল ঢেলে ওর কপালে লেপে দিলো.. !!! উঃ …চোখের সামনে ছেলেটা কাটা ছাগলের মতো ছটপট করতে শুরু করলো l আমি চোখের সামনে এই দৃশ্য সহ্য করতে পারছিলাম না… l কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার…এতো লাফালাফি কিন্তু সবই ওই কেটে দেওয়া গণ্ডীর মধ্য !!
পীরবাবার একটানা প্রশ্ন কানে আসছে ” তুই ওকে ছাড়বি কি না বল ” …প্রশ্নের সাথে সাথে কাবলুর বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটছে ….মুখের…স্বরের ..স্বভাবের l কখনো..শেয়ালের মতো দাঁত বার করে খ্যাঁক খ্যাঁক করছে, কখনো বুক কাঁপানো ￰হিঃহিঃ হাসি…আবার কখনও বা হাউ হাউ করে কান্না… l এভাবে বেশ কিছুক্ষন চলার পর…ও আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়তে লাগলো l একটু বাদেই মাটিতে শুয়ে পড়ে চোখ বুজলো .. l
হঠাৎ করে সব নিশ্চুপ হয়ে গেলো…একটা ঠান্ডা বাতাস উঠলো…বাতাসের সুরে কে যেন ইনিয়ে বিনিয়ে কেঁদে চলেছে… !!!
পীরবাবার শান্ত কণ্ঠ সাগরেদের দিকে তাকিয়ে , ” ….ছেলেটাকে ওই ডান দিকের ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দে..আজকের রাতটা তোমরা এখানে কাটাও ….শেষ চেষ্টা রাত্রে করবো…” !!
এবার ফকির আমার দিকে তাকালো, কি মর্মভেদী চাউনি…যেন আমার ভেতরটা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে ….l
” কিছু অবিশ্বাসী আর সন্দেহ বাতিক লোকের জন্যে ….পুরো কাজটা করা গেলো না…” বুঝতে পারছি প্রতিটি কথা আমার উদ্দেশ্যে বলা l কিন্তু বলতে পারলাম না , আগে সন্দেহ থাকলেও …এখন কিছুটা কেটেছে l
” তুই এখান থেকে চলে যা….নাহলে আমার মন ঠিকভাবে কাজ করবে না..” হাতে চামর দুলিয়ে বললো l
” ঈশ্বরে বিশ্বাস আছে বলেই …ঈশ্বর আছে মনে হয় ! তোর বিশ্বাসের আধারটা একটু বাড়িয়ে দি..” আমার দিকে এক পা এগিয়ে এলো ” নিম গাছটার দিকে তাকা….” ভয়ের চোখে তাকালাম… l অনুভব করলাম…যে বাতাস উঠেছে…..তাতে শুধু নিমগাছটার পাতাগুলো কাঁপছে..বাকী সব গাছের পাতা স্থির…নিস্পন্দন.. !! এ কি করে সম্ভব ? …চোখে কি ভুল দেখছি ! কাপালিকের মতো বাবার হাসি কানে আসছে… l
” বেটা…ভালো ভাবে নিমের ওই সরু ডালটার দিকে তাকিয়ে দেখ…সন্দেহ চলে যাবে …”
এবার আমার সারা শরীর বেতস পাতার মতো কাঁপতে লাগলো… l এক পলকের জন্যে দেখলাম …একটা ছায়া ছায়া শরীর …নিমডালে বসে আছে l
” দেখেছিস এখনও ছেড়ে যায়নি…” কথাটা বলে পীরবাবা নিজের ঘরে ঢুকে গেলো l আর এখানে থাকা ঠিক হবে না l এরপরআমিও ওদের জানিয়ে বাড়ীর পথ ধরলাম!
দিপালী এখনও আমাদের বাড়ী কাজ করে l কাবলু ভালো হয়ে গেছে l পীরবাবার কথামতো তেঁতুল গাছের একটা মোটা ডাল কাটতে হয়েছিল…একটা তাবিজ এখনো কাবলুর গলায় ঝোলে !!
কৌতুহল চাপতে না পেরে .. …দিপালীকে সেই রাত্রের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম…আমি চলে আসার পরবর্তী ঘটনা….আমাদের দুজনকে বলেছিলো.. l বিস্ফারিত চোখে শুনেছিলাম !
*** *** ***
সেদিন রাতে দিপালীর দেখা ভূত ছাড়ানোর ঘটনা, ওর কথায় লিখলে…বোঝার মুশকিল হতে পারে বলে, আমি একটু ঝাড়াই বাছাই করে দিচ্ছি l
আমি আর আমার স্ত্রী (, রীতা ) একমনে শুনতে লাগলাম ওর সেদিনের ভয়াভয় অভিজ্ঞতার কথা…. !!

…. . . বেলা গড়িয়ে যেতে বসলো.. l পীরবাবার সহকারী রফিক , তিনটে ছোট জায়গা করে. …চালে ডালে ফোটানো নিয়ে এলো আমাদের জন্যে l ছেলেটাও সকাল থেকে কিছু খায়নি…. l
” ওকে এখান থেকে একটু দোব ? ” দিপালীর গলা l
” খবরদার…” হাঁ হাঁ করে উঠলো রফিক ” ওকে এখন খেতে দেওয়া মানে…প্রেতটার শক্তি বাড়ানো ..” এরপর কিছু বলা যায় না l
সূর্য্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়লো ! চারধার জুড়ে আঁধারের কালো ছায়া ঘিরছে…!! কাবলু তখনো চোখ বুজে পড়ে l যেন শরীরে প্রাণের ছোঁয়া নেই l একটা ছোট কুপি জ্বালিয়ে ঘরে দিয়ে গেলো রফিক l দিপালীরাও চুপচাপ বসে প্রহর গুনে চলেছে..l অশুভ শক্তির আগমনের প্রতীক্ষায় ….l বাবাকে তারপর থেকেই একবারের জন্যেও দেখা যায়নি l ওর ভাই ঘড়ি দেখলো ….রাত নটা বাজে l
খোলা দরজা দিয়ে উঠোনের কালো চত্বর ….দূরে জোনাকির মেলা l এই সময় , রফিক একটা মশালের মতো নিয়ে এসে …গোল কাটা দাগের পাশে মাটিতে গুঁজে দিল l আগুনের দপদপে আলোয় একটা ভূতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হলো l এবার ও ঘরের দিকে এগিয়ে এসে বললো ..
” তোমরা আমার সঙ্গে ছেলেটাকে ধরাধরি করে..ওই গোল কাটা জায়গাটায় নিয়ে চলো l ” অনিল আর ওর শালা পা দুটো …রফিক হাত দুটো ধরে সবে চৌকাঠটার কাছে গেছে….,” ওরে বাপ রে…মেরে ফেললো ” রফিকের গলার তীব্র আর্তনাদে ..ওরা ভয়ার্ত চোখে দেখলো…ছেলেটা ওর কব্জিটা সরু সরু সুঁচালো দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছে, ! দাঁতের ফাঁক দিয়ে নামছে লাল রক্তের ধারা.. l রফিক দাওয়াতেই কাবলুকে ছেড়ে দিয়ে হাত ধরে বসে পড়েছে ! বাকিরাও ওই পৈশাচিক কান্ড দেখে থর থর করে কাঁপছে !
এই ফাঁকে ছেলেটা হায়নার মতো হামাগুড়ি দিয়ে ক্ষিপ্র গতিতেঅন্ধকারে নিমগাছটার দিকে চলেছে…..
****** ******* *******
দিপালী দম নেবার জন্যে একটু থামলো l ওর চোখে মুখে এখনো আতঙ্কের ছায়া…..l আমরা একমনে ওর কথা শুনে চলেছি…!!
” তারপর ?? ” রীতার কাঁপা গলা l বুঝতে পারছি …..রীতাও ভয় পাচ্ছে l কিন্তু শোনাটাও ছাড়তে চাইছে না l শুরু করলো দিপালী….
দমকা হাওয়ার মতো বেরিয়ে এলো পীরবাবা…এক লহমায় ব্যাপারটা বুঝে , ঘর থেকে একটা পাঁচ সেলের টর্চ আর চামরটা নিয়ে আমাদের কাছে ছুটে এলো l রফিকের রক্তাত্ব হাতের দিকে না তাকিয়ে আদেশের সুরে বললো ” জলদি কাঠের ছোট মইটা নিয়ে আয়….একবার হাতের নাগালের বাইরে চলে গেলে..ছেলেটাকে বাঁচানো যাবে না..! ”
ও ওই হাত নিয়েই মই আনতে ছুটলো ….l ততক্ষনে বাবা টর্চ হাতে নিম গাছটার দিকে এগিয়ে গেছে l সবাই দেখলো…..গাছটার নীচের ডালে বসে ও হাসছে….ঠোঁটের কোণ বেয়ে রক্ত ঝরছে ..l মইটা গাছটার সঙ্গে লাগিয়ে ….ওটা বেয়ে তরতর করে উঠেগেলো সিদ্ধ বাবা , ছেলেটার সামনা সামনি হলো l ওরা অবাক হয়ে গেলো, বাবার ওই ক্ষিপ্রতা দেখে… l
টর্চের জোরালো আলোয় ছেলের মুখ দেখে ওরা ভয়ে চমকে উঠলো…কে ওটা ? ….কাবলু ? ….না ….একদলা কালো মাংস ….. !! পীরবাবার উচ্চস্বরে মন্ত্র পাঠ শুরু হয়েছে…যার একবর্ণও ওদের মাথায় ঢুকছে না…. l রফিকও কব্জিতে একটা ন্যাকড়া জড়িয়ে হারিকেন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে l
দিপালী একটু থামলো……আঁচল দিয়ে মুখটা মুছলো l আমি বললাম ” ওকে একটু জল দাও “l জল খেয়ে ও বললো …
” বিশ্বাস করবেন না দাদা…..অসীম ক্ষ্যামতা দেখলাম বাবার ! মন্তরের জোরে ছেলেটারে গাছ থেকে নামায়ে …..উই সেই গোল থানে নে গেলো…” !!
…….তারপর শুরু হলো রাতভোর নারকীয় লীলা খেলা.. l নেহাৎ ধারে কাছে জন মনিষ্যি নেই…! আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে মানুষে আর বিদেহী আত্মার শক্তি প্রদর্শন !! অবশেষে সেই কাল রাত্রির শেষ হতে চললো l ক্রমশ নিস্তেজ হতে শুরু করলো প্রেত শক্তি !
ঘর্মাক্ত শরীরে শক্তিধর বাবার কণ্ঠস্বর ” এবার বল…তুই যাবি বুঝবো কি করে ? ”
ছেলেটার গলা থেকে স্বর আর বেরোচ্ছে না…অতি কষ্টে বললো ” তুইই বল..” !
বাবার মুখে এতক্ষনে হাসির রেখা দেখা গেলো l একটা জল ভর্তি মাটির জালা রাখা ছিলো l ওটা আঙ্গুল দেখিয়ে বললো ” দাঁতে করে বেড়ার ধারে নিয়ে গিয়ে ওই জালাটা ভেঙে ফেললে …বুঝবো তুই ওকে ছেড়ে গেছিস l তোর উদ্ধারের ব্যবস্থাও আমি করবো ” l
কাবলু ওই ক্ষীণ শরীরে টলমল পায়ে জালাটার দিকে এগিয়ে গেলো l
শেষ পর্যায়ে দিপালীর গলা ” বিশ্বাস করবেন না বৌদি… আমার ওই ছোট্ট কাবলু …জলভর্তি ভারী জালাটা দাঁতে করে ধরে বেড়ার কাছে নিয়ে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো l অবাক চোখে দেখলাম …জালাটা ভেঙে চৌচির হবার সাথে সাথে ..একটা কাল ধোঁয়ার কুন্ডলী আকাশের দিকে উড়ে গেলো ! বাবা হেসে বললো …যা …মা, তোর ছেলেকে নিয়ে যা…ও একদম ভালো হয়ে গেছে…” দিপালী দাঁড়িয়ে উঠলো.. l ” সব থেকে আশ্চয্যির ব্যাপার…বাবা খরচ বাবদ শুধু একশো এক টাকা নিলো ” ও বাবার উদ্দেশ্যে প্রণাম করলো l
রীতার গলা ” তোর দাদারতো সবেতেই সন্দেহ…নাজানি বাবা, আবার না কিছু অভিশাপ দেয় ” l
” না.. না বৌদি …সে ভয় করবেন না…উনি সেরকম নন…” l দিপালী যাবারজন্যে পা বাড়ালো… l
আমার দিকে ফিরে রীতা বললো ” তোমার এবার শিক্ষা হয়েছে তো ? সবেতে তর্ক …কি ভগবান…কি শয়তান ..! …কিছু একটা আছে….যা আমরা কখনো কখনো উপলব্ধি করতে পারি… l ”

 

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত