শুভ এক সরকারি ব্যাংকের অফিসার ! ওর বদলির খবরটা এলো ! আদ্রাতে পোস্টিং ছিল ! ওদের বাড়ি বাঁকুড়া থেকে যাতায়াত করতে পারতো ! বদলির খবরটা পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেলো ! কলকাতার বড়ো বাজারে পোস্টিং …সাতদিনের মধ্যে জয়েন করতে হবে !
কবিতার সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে , বছর তিনেক ! মায়ের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও , ওরা বাচ্চাকাচ্ছা এখনই চায়নি ! বাঁকুড়ার শহর থেকে একটু দূরে গ্রামাঞ্চলের দিকে ওদের মাঝ বয়সী বড়ো দোতলা বাড়ি ! বাড়িটা বাবা আর কাকার নামে ! বাবা বছর দশেক হলো মারা যাওয়াতে মায়ের নামে করে দেওয়া হয় !
শুভ আর তার মায়ের সংসারে ….মা নিজেই দেখেশুনে , বাঁকুড়ারই মেয়ে কবিতাকে , শুভর বৌ করে নিয়ে এলো ! সেইজন্যে মায়ের ওপর কবিতার একটা আলাদা টান !
শুভ মায়ের পছন্দেই মত দিয়েছিলো ! কেননা বাবা মারা যাবার পর , দুজনেই দুজনকে নিয়ে স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ , সব কিছু দেখতো ! বাড়ির নিচের তলায় কাকা ,এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার পরিবার ! ওপর তলায় ওরা ! সম্পর্কও ভালো কাকা কাকিমার সাথে !
কবিতাও এই সংসারে এসে দুদিনেই মানিয়ে নিয়েছে ! কবিতার রূপ গুণ দেখে , শুভ মায়ের প্রশংসা করে মনে মনে ! দোতলায় বড়ো বড়ো তিনটে শোবার ঘর, বাথরুম রান্নাঘর , বিরাট দালান …ওদের তিনজনের পক্ষে মেলা জায়গা ! কাকারও একই ভাগ ! বাড়ির পাশে বড়ো পুকুরটারও দুটো অংশ ! দাদু নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবকিছু করেছিল !
শুভ রাত্রে অফিস থেকে ফিরে খেতে বসে , বদলির খবরটা দিলো ! মা ছন্দা দেবী তরকারি দিতে দিতে বললো
” তুই কি খবর দিচ্ছিস শুভ ? ” মায়ের চোখ কপালে !
” চেষ্টা করেও আটকানো গেলো না ” রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে ও বললো ! ” কলকাতার বড়ো বাজার ব্রাঞ্চে পোস্টিং দিয়েছে ! ” — কবিতা বললো ,
” ভালোই হলো , মায়ের অনেকদিনের শখ কালীঘাট , দক্ষিনেশ্বর , বেলুড়মঠ দেখার ….এবার সব সাধ মিটবে ”
” মাথায় থাক আমার ওসব সাধ ” মাংসের বাটিটা শুভর দিকে এগিয়ে দেয় ! ” শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে আমি কোত্থাও যাচ্ছি না ” !
” তার মানে ? তুমি এখানে একলা থাকবে নাকি ?” শুভ অবাক হয় ! ” বেশ ! তাহলে তোমার বৌমাও এখানে থাক ”
” থাম দিকিনি ! তোকে ওখানে রান্না করে খাওয়াবে কে ? নিজের হাতে তোকে কোনদিন কিছু করতে দিয়েছি আমি ? ” ছন্দা দেবীর গলায় কান্না জড়ায় ! ” …আর তোকেই যখন ছেড়ে থাকতে হবে ! ” আর কথা বেরোয় না !
শুভ জানে , মা দোটানায় পড়ে গেছে ! বাবার স্মৃতি একদিকে আর ও একদিকে…কাউকে ছাড়তে পারছে না ! বেশির ভাগ মায়েরই এই দশা হয় !
ওরা যাবার আগে, রান্নার লোক সনকাকে ঠিক করলো ! কাকা – কাকিমাও বললো , আমরাতো রয়েছি ! আর কলকাতা , তিন চার ঘন্টায় চলে আসা যায় !
যাবার দিন, সে এক কান্ড ! মা আর ছেলেকে দেখলে মনে হচ্ছে , চিরদিনের জন্যে ছাড়াছাড়ি হতে চলেছে ! দুজনে জড়িয়ে ধরে কি কান্না ! কবিতার চোখেও জল !
ওরা বাড়ি থেকে বেরোলো, কাকার ছেলে রাজাও চললো স্টেশনে তুলে দেবার জন্যে l….তখন কি শুভ বা কবিতা ভাবতে পেরেছিলো ? এই বদলীটাই ওদের জীবনে কালো দিন হিসেবে লেখা হয়ে থাকবে ,ll
কলকাতায় এসে কবিতার ভালোই লাগলো l শুভ ব্যাংকের যে টু রুমের কোয়ার্টারটা পেয়েছে , খুব একটা খারাপ নয় l দিন কয়েক ওদের মনটা খারাপই ছিল l কবিতা জানে, শুভর মনটা খুবই খারাপ l তবু প্রতিদিন রাত্রে ওরা ছন্দা দেবীর সঙ্গে ফোনে কথাবার্তা বলে !
ওদের এখানে আসার এক মাসের মধ্যেই , রাত্রে সেই অশুভ ফোনটা এলো l শুতে যাবার আগে ফোন ধরলো শুভ… l কাকার গলা ভেসে এলো , মা দোতলার সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে একদম নিচে পড়েছে ! অবস্থা খুবই আশঙ্কা জনক l
” কি বলছো কি ? এইতো খানিক আগে কথা বললুম…” ওর চোখে অন্ধকার ! কবিতা বুঝতে পারছে কিছু একটা অঘটন ঘটেছে l কাকা বলে চলেছে..সনকা রান্নাঘরে ছিল , ফোন নিয়ে কথা বলতে বলতে নিচে নামার সময় — এই কান্ড ঘটে ! সনকাই দৌড়ে এসে আমাদের খবর দেয় l
” এখন কি অবস্থা ? ” শুভর কথা ভেঙে যাচ্ছে ,l
” নার্সিং হোম থেকে ফোন করছি l ” কাকা একটু থামলো l মনে হলো গুছিয়ে নিচ্ছে কতখানি বলা ঠিক হবে ? মায়ের মুখটা শুভর চোখের সামনে ভেসে উঠলো l ইস, তার সঙ্গেই কথা বলতে বলতে এই দুর্ঘটনা ঘটলো l
” শোন, তুই চেষ্টা কর যাতে কালকে আসতে পারিস l” শুভ ,ক্যাশ কি হোল্ড করছে , তাছাড়া কাল ব্রাঞ্চ ইন্সপেকশন হবে….রিজিওনাল অফিস থেকে l — চুলোয় যাক, যা হোক একটা ব্যবস্থা করে …কবিতাকে নিয়ে বাঁকুড়া যেতে রাত হয়ে যাবে !
” আমি যত শিঘ্রী পারি আসছি, তুমি শুধু বলো,– মা এখন কি অবস্থায় আছে ? প্লিজ কিছু লুকিও না l ” মনে হচ্ছে ও কেঁদে ফেলবে ! — কবিতা কথা শুনে বুঝছে মায়ের কিছু একটা হয়েছে l
” ডাক্তারের কথা অনুযায়ী….পাঁজরে হাড় ভেঙেছে , মাথাটাতেও বড়ো চোট পেয়েছে l ” পাশ থেকে কেউ কিছু বলাতে কাকা চুপ করে গেলো ” তুই তো জানিস, বৌদি কি রকম তোকে চোখে হারায় ! যত তাড়াতাড়ি পারিস আয় “!
ফোনটার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে এক মিনিট তাকিয়ে কবিতাকে সব বললো ! কবিতার চোখেও জল এসে গেলো ! কতবার মাকে বলা হলো এখানে চলে আসার জন্যে , তাহলে এই দুর্ঘটনা ঘটতো না ! ….বিধির বিধান কেউ কোনদিন খন্ডাতে পারে ?
শুভ ঘড়িতে দেখলো…রাত এগারোটা বাজে l ম্যানেজার বক্সীকে সব জানালো ও l সকালে চাবি নিয়ে ব্রাঞ্চে আসতে বললেন, তারপর ছুটির বন্দোবস্ত করে দেবেন !
পরের দিন রাত্রে ওরা বাঁকুড়া পৌঁছলো , স্টেশন থেকে সোজা নার্সিং হোমে l মাকে দেখে দুজনের চোখের জল সামলানো গেলো না l ভিজিটিং আওয়ার পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বিশেষ অনুমতি ছিল ,l ছন্দা দেবীর সারা শরীর ব্যান্ডেজ আর প্লাস্টারে বাঁধা l মনে হচ্ছে একটা মমিকে শুইয়ে রাখা হয়েছে ! শুধু মুখটুকু খোলা l ডাক্তার লাহিড়ী শুভর জন্যে ওয়েট করছিলেন l
” দেখুন মিস্টার ব্যানার্জী ” শুভর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন ” পেশেন্টের যা কন্ডিশন , কলকাতা নিয়ে গিয়ে কোন লাভ হবে না l ….দেহের বেশির ভাগ হাড় ভেঙে গেছে l সব থেকে চোট পেয়েছে মাথায়, ব্লাড ক্লড হয়ে গেছে l কণ্ঠ নালিও ড্যামেজ হয়েছে l আমার মনে হয় , বড়জোর আজকের রাত টা..” l
শুভ আর কবিতা ডাক্তারের শেষ বাণী শুনলো l কতই বা বয়স হবে ছন্দা দেবীর ? কাকিমা শুভর পিঠে হাত রাখলো l
” তোরা দিদির পাশে গিয়ে একটু বোস l শেষ দেখাটা দেখে নিক ” চোখে আঁচল চাপা দিলো l — শুভর মাথাটা একদম ধোঁয়াশা হয়ে গেছে l চোখের সামনে কি ঘটছে যেন বোধগম্য হচ্ছে না !
ও পায়ে পায়ে মায়ের খাটের সামনে এগিয়ে গেলো l ওকে দেখে ছন্দা দেবীর চোখ দুটো কাঁপলো l ঠোঁট দুটোও থরথর করে কেঁপে উঠলো l মুখ দিয়ে একটা গোঙানির শব্দ বেরিয়ে এলো… l মনে হচ্ছে ওকে কিছু বলতে চাইছে l
…শুভ ওর মুখটা মায়ের মুখের কাছে নিয়ে এসে বললো ..” তুমি কি কিছু বলবে ? ” কান্নার ডেলাটা গিললো .. l দুটো চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে মায়ের l মনের ভেতর কি হচ্ছে কে জানে ? শুভর ডাক্তারের কথা মনে পড়লো…কণ্ঠনালী ভেঙে গেছে ! …কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও বলতে পারবে না l কত কষ্ট পাচ্ছে মা l
হঠাৎ ওর কানে মায়ের ফিসফিসানি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ” আমি এবার যাই মানিক …তোর বাবা এসে দাঁড়িয়ে আছে ! এবার তুই আমায় বিদায় দে সোনা …নাহলে তোর জন্যে এখানে আটকা পড়ে থাকতে হবে…” কথা গুলো ওর কান দিয়ে ঢুকে মাথায় ধাক্কা দিলো l
মাথাটা তুলে অবাক বিস্ময়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালো….চোখ দুটো ততক্ষনে স্থির হয়ে গেছে l নার্স ডাক্তারকে খবর দেওয়াতে , নাড়ি দেখে বললেন……এক্সপায়ার l
এবার শুভর গলা চিরে …দুঃখ , কান্না , হারানোর ব্যাথা মিলেমিশে একটা চিৎকার বেরিয়ে এলো “না…..আমাকে ছেড়ে তুমি কোথাও যেতে পারবে না ” মায়ের মৃতদেহটা দুহাতে আঁকড়ে ধরে বাচ্ছা ছেলের মতো কান্নায় ভেঙে পড়লো l
মায়ের মৃতদেহ নিয়ে যখন শ্মশানে এলো, তখন সকাল হয়ে গেছে l মায়ের খাটের কাছে একা শুভ বসে , বাকিরা অন্যান্য কাজে ব্যস্ত l ছন্দা দেবীর প্রাণটা মনে হয় , চোখ দিয়েই বেরিয়েছিল ! তাই চোখ দুটো আধ খোলা ! ওর মনে হচ্ছে , মা যেন এখনো তাকে দেখছে l
ও লক্ষ্য করলো …ডানদিকে হেললে , মায়ের চোখ ওর দিকে…বাঁ দিকে হেললেও তাই. l এটা কি ওর মনের ভুল ?
দাহ সেরে বাড়িতে ঢুকে…এই প্রথম অনুভব করলো, মা নেই….বাড়ির সর্বত্র তার চিহ্ন উপস্থিত , শুধু মানুষটাই নেই ! মনটা হাহাকার করে উঠলো l
সন্ধ্যের দিকে ওরা দুজন একটু ফাঁকা হলো l গতকাল রাত থেকে তাদের ওপর দিয়ে চলেছে…মানসিক , ারীরিক বিপর্যয় l আচমকা আসা এই দুর্ঘটনা ওদের দুজনকে একদম কমজোরি করে দিয়েছে l কাছা গলায় শুভ দালানের চেয়ারে বসেছিল l মায়ের শেষ ফিসফিসানি কণ্ঠস্বর এখনও ওর দুকানে বাজছে….আমায় যাবার অনুমতি দে সোনা…তোর বাবা দাঁড়িয়ে আছে !
….সত্যি কি মা কথাগুলো বলেছিলো ? না , ওর মনের বিভ্রম ? কবিতা এসে ওর পাশে বসলো l কোরা লাল পেড়ে শাড়ি ওর শরীরে l ভেবে পাচ্ছে না, কিভাবে স্বামীকে সান্তনা দেবে ? — ওর ভাইও এসেছিলো l কাল বাবা মা আসবে l ও জানে — একমাত্র সময়ই হলো মোক্ষম ওষুধ ! মনটাকে ঘোরাবার জন্যে বললো…
” তুমি একটু শুলে না কেন ? ” — ও কোন উত্তর না দিয়ে শুধু মাথা ঝাঁকালো l এই সময় রান্নার বউ , সনকা এসে বললো…
” তোমাদের একটু করে চা করে দোব ? ” দুজনেই খেতে রাজি হলো ! ও রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো l চারিদিকে সন্ধ্যের আঁধার নামছে l পুরো বাড়ি নিশ্চুপ ! নিচে কাকাদেরও কোন সাড়া শব্দ নেই…হঠাৎ তীব্র ভয়ার্ত গলার চিৎকারে ওরা চমকে উঠলো !
হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে এলো সনকা l ওরা দেখলো ওর লালচে মুখে হাজার ভয়ের ছাপ ! রীতিমতো কাঁপছে l
” কি হয়েছে ? ” ওদের মুখে চিন্তার রেখা l
রান্না ঘরের দিকে বড়ো বড়ো চোখ মেলে বললো ” ..বড়ো মা , রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে আছে ” কবিতার মেরুদন্ড বেয়ে একটা হিম শীতল স্রোত বয়ে গেলো ! মা কে , সনকা বড়ো মা বলে ডাকতো ! ওর চিৎকার শুনে কাকারাও ওপরে উঠে এসেছে l
” কি আজে বাজে বলছো তুমি ? ” শুভর গলায় রাগের ছাপ l
” বিশ্বাস করো দাদাবাবু , এতটুকু বানিয়ে বলতেছি না ! পুকুর ধারের জানালাটার গরাদ ধরে , আমার দিকে তাকায়ে ছিল ” ও জোর দিয়ে বললো l
ওরা সবাই রান্নাঘরে এলো…কোথায় কি ? বিলকুল সব ফাঁকা ! সনকার চোখে মুখে তখনও ভয় বর্তমান ! …কাকিমা মুখ খুললো.. ,” ও তোর চোখের ভুল ! একি অপঘাতে মরা ? তাছাড়া ঠাকুর মশাই পাঁজি দেখে বলে গেল…দিদিভাই কোন দোষ পাইনি ” l
সনকার মুখ ফ্যাকাশে…মনে হচ্ছে এদের কোন কথাই ওর কানে ঢুকছে না l ও ভয়চকিত গলায় বললো ” আমাকে কেউ একটু বাড়ি পৌঁছে দেবে ? ” কাকার ছেলে রাজা এগিয়ে এলো l
” তুমি তো শুনেছি , ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছো ! এই সন্ধ্যে বেলা থেকেই ভূত দেখতে শুরু করেছো ? ” মায়ের সন্মন্ধে এইসব কথা সহ্য করতে পারলো না l
” প্লিস স্টপ , তোমরা এসব কথা থামাও l ভালো লাগছে না শুনতে ” — সবাই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো l — রাজা বললো ” আমি যাচ্ছি ” l
যাবার আগে কাকিমা নিচু গলায় সনকাকে বললো ” তুই সকালের দিকটা করে আয় , ওরাতো হবিষ্যি করছে…টুকিটাকি কাজ একটু করে দিস এই কটা দিন l আর এসব কথা পাঁচকান করিস না ” ও ঘাড় নেড়ে চলে গেলো l
” তোদের চা আমি নিচ থেকে করে পাঠিয়ে দিচ্ছি ” ওরা দুজন ঘরে এসে বসলো l কবিতা জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকালো l ….ওর মন বলছে, সনকা মিথ্যে বলছে না ! তার প্রমাণ ওর চোখ মুখের ভাষা ! তাছাড়া খামোকা মিথ্যে বলেই বা ওর লাভ কি ??
….সন্ধ্যে বেলা ওই ঘটনা ঘটে যাবার পর, সবাই চুপচাপ হয়ে গেছে l যে যার মনে বিভিন্ন চিন্তা করে চলেছে l
রাত্রে দুজনে শুয়ে পড়েছে l কাল থেকে আবার নেমন্তন্ন করার কাজ শুরু করতে হবে ! …শুভ মন থেকে বাজে চিন্তা গুলো তাড়াবার চেষ্টা করে চলেছে l ও কবিতার দিকে তাকিয়ে বুঝলো, ঘুমিয়ে পড়েছে l
কিন্তু কেন ওর চোখে ঘুম নেই ? সনকার কথাটা, কবিতা মনে হয় কিছুটা বিশ্বাস করেছে ! ওর চোখ মুখ দেখে মনে হলো l কই শুভ তো কিছু দেখলো না ? মা তো প্রাণের থেকেও তাকে ভালোবাসে ? তবে কি…ও অনুমতি দেয়নি বলে , মা যেতে পারছে না ?? প্রশ্নটা ওর মাথায় হঠাৎ ঘুরপাক খেতে শুরু করলো ….l বুঝলো ঘুম হবে না !
বিছানা ছেড়ে উঠলো l রাত বারোটা বাজতে চললো ! পায়ে পায়ে বারান্দায় বেরিয়ে এসে দাঁড়ালো l গাছপালার মাঝখান দিয়ে…পুকুরটার কালো জল চোখে পড়ছে l এইসময় সুন্দর একটা ধূপের গন্ধ নাকে এসে লাগলো l পিছন ফিরে মায়ের ঘরটার দিকে দেখলো l দরজাটা খোলা…একটা নীলচে ছোট আলো জ্বলছে l মায়ের ছবিটা টেবিলের ওপর বসানো …সামনে প্রদীপটা দপদপ করে জ্বলছে ! ছোট একটা পেতলের থালায় দুটো মিষ্টি আর জল রাখা l
সন্ধ্যের সময় কবিতা এসব করে গেছে l এবার মনে নতুন চিন্তার উদয় হলো…তাই যদি হয় ? ছ ঘন্টা বাদে ধূপের গন্ধ ও পাবে ? মায়ের ঘরটা হঠাৎ ওকে আকর্ষণ করতে লাগলো !
আধো অন্ধকারে এসে ঢুকলো মায়ের ঘরে l …পুরোনো কত কথা ভিড় করে এলো, চোখ ছলছল করে উঠলো l ছবিই দিকে তাকিয়ে রইলো…. l খুট করে একটা শব্দে বর্তমানে ফিরে এলো l এদিক ওদিক তাকালো…নতুন করে ধূপের গন্ধটা পেলো !
….কানের পাশে মায়ের সেই না ভোলা মিষ্টি স্বর…” সোনা , অনেক রাত হয়েছে…শুয়ে পড় ” l চমকে উঠলো …
” মা…তুমি !! ” ওর গায়ের রোমকূপগুলো খাড়া হয়ে গেছে l — কোন উত্তর পেলো না l …কানে এলো , বাগান থেকে অন্ধকারে ভেসে আসা তক্ষকের ডাক !
ঘরে ফিরে আসতেই কবিতার ঘুম জড়ানো গলার আওয়াজ পেলো ” এতো রাত্তিরে কোথায় গেছিলে ? ”
” মায়েররে ”
” তার মানে ? ” ওর বুকটা এক অজানা আশংকায় দুলে উঠলো ! ” …সারাদিন পরিশ্রম , চিন্তা , তারওপর এই রাত দুপুরে না ঘুমিয়ে…” কথা শেষ করলো না l
” সনকার কথা মনে হয় ঠিক ! ….মা আমাদের ছেড়ে এখনও যেতে পারেনি… “l কবিতা উঠে বসলো l
” ও রকম লাগে….সারাক্ষন চিন্তা করছো ” শুভ প্রথম দিন থেকে…একটু আগের ঘটনা পর্যন্ত বললো l একটা অচেনা এগিয়ে আসা বিপদ , কবিতার মনের মধ্যে বাসা বাঁধলো l
শুভ শুয়ে বললো ” তোমার সনকার ঘটনাটা কি মনে হয় ? ”
” কি বলি বলতো ” ও শুভর মাথায় হাত রাখে l ” তবে ও কিছু একটা দেখেছে…কেননা ওর চোখ মুখ সে কথা জানান দিচ্ছিলো ! ”
” তবে কি মা…আমার অনুমতির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে ? ” — অস্ফুস্ট কণ্ঠ ! ” শ্রাদ্ধ শান্তির পরেও কি আত্মা ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে যেতে পারে না ? ” যেন নিজেকেই প্রশ্ন করছে l
কবিতা মৃদু স্বরে বললো ” কি জানি ? তবে আজকাল এই ধ্যান ধারণা অনেকটা বদলে গেছে l শ্রাদ্ধ বাড়িতে সেই শ্রদ্ধা , দুঃখ , সমবেদনা কোথায় ? সেখানেও শুরু হয়েছে দেখাবার প্রতিযোগিতা l মানুষটা বেঁচে থাকতে যে সন্মান পায়না…মরার পর কত আদিখ্যেতা দেখায় l
আস্তে আস্তে ওদের চোখে ঘুম নেমে আসে l ….
কিন্তু , সকালে যখন সনকা এসে তার রাত্রের ঘটনা বললো…তখন ওরা আর সেইভাবে প্রতিবাদ করতে পারলো না…..ll
…..আজ কাকার সঙ্গে পাড়ার কয়েকটা বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে যেতে হবে l সকালেই সনকা এসেছে, ওদের দুজনকে চা করে দিলো l ওরা দেখলো এখনো ও ভয়ে সিঁটিয়ে আছে ! চা দিতে এসে ও দাঁড়ালো l
” দাদাবাবু, একটা কথা ছিল ” শুভ ওর মুখের দিকে তাকালো l সনকার অবস্থা বিশেষ ভালো নয় l বর জোগাড়ের কাজ করে, আর একটা ছেলে..সে সারাদিন জুয়া, নেশা ভাঙ করে বেড়ায় l
” — আপনারা তো এসব মিটলেই কলকাতা চলে যাবেন ..l তাছাড়া রান্নার কাজ এখন হচ্ছে না , হবিষ্যি চলছে l তাই বলছিলাম কি, আমারে ছুটি দে দ্যান l একটা নোতুন কাজ পেয়েছি…কাল থেকে সেখানে করবো l ”
কবিতা বললো ” বুঝেছি , তোমার মন থেকে এখনও কালকের ঘটনা দূর হয়নি..l ” ও চুপ করে রইলো ! শুভ বললো..
” তুমি যেতে চাইলে , আমরা আটকাবো না l তবে মায়ের কাজটা মিটে গেলে…যেতে পারতে l ” — কি একটা বলতে গিয়েও ও ঢোঁক গিললো l কবিতার চোখ এড়ালো না…. l
” তুমি আর কিছু বলতে চাও ? — বলতে পারো l ” ওর চোখে ভয়ের আভাস দেখা দিলো l
” তোমরা বিশ্বাস করবে কি না জানিনা…বড়োমার হাত থেকে বাড়িতে গিয়েও নিস্তার নেই ! জানিনা কেন উনি আমার পিছনে ছায়ার মতো লেগে আছেন ? আমি কি ক্ষেতি করেছি ? ” সনকার মুখে আতঙ্কের কালি l শুভর চোখে প্রশ্ন l
” কি বলতে চাইছো…খুলে বলো l ” ও এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো…
” রাতে গিয়ে শুতে যাবার সময়…আমাদের ঘরের পোষা বেড়ালটাকে , দাওয়ায় দুটি ভাত খেতে দিয়েছি l হঠাৎ দেখি, বিড়ালটা দর্মা ঘেরা রান্নাঘরটার দিকে তাকিয়ে..মুখ থেকে একটা গড়গড় শব্দ বার করছে ওই অন্ধকারে l ওর গায়ের সব লোম খাড়া হয়ে গেছে ! লেজটা ফুলে উঠেছে….l ” ও আঁচল দিয়ে মুখ মুছলো l শুভ চায়ে ঘনঘন চুমুক দিচ্ছে l কবিতার চোখে মুখে আগ্রহ l
” একে সাঁঝের বেলায় ওই ঘটনা ঘটেছে ..শুনেছিলাম , কুকুর বেড়াল …নাকি ওদের উপস্থিতি বুঝতে পারে, দেখতে পায় l ভয়ে ভয়ে রান্না ঘরের দিকে তাকাতেই…আমার গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাবার যোগাড় l ” কথা বলতে গিয়ে ও হাঁফাচ্ছে…l
” …কি দেখলে ?? ” — দুজনেই বলে উঠলো l
” …দরমার বেড়া তে পিঠ ঠেস দিয়ে বড়ো মা দাঁড়িয়ে আছে l সারা শরীরে ব্যান্ডেজ বাঁধা ! চোখদুটো থেকে রাগের হলকা বেরোচ্ছে l আমি দু পা ফেলে কোনোরকমে ঘরে ঢুকে, দড়াম করে দরজা দিয়ে দি l …বাইরে থেকে কানে আসে , বেড়ালটার মিউ মিউ করে কান্নার আওয়াজ !” শুভ গম্ভীর স্বরে বললো…
” তুমি কাল একবার এসে এ কদিনের কাজের পয়সা নিয়ে যেও ” — সনকা আর কোন কথা না বলে চলে গেলো…. l মনে হলো পালিয়ে বাঁচলো l কাকা নিচ থেকে শুভকে ডাকলো , নিমন্ত্রণ করতে বেরোবে l
ওপর তলাটা একদম খালি…শুধু কবিতা l বিকালে ওর বাবা মা আসবে… l ও ধীর পায়ে ছন্দা দেবীর ঘরে ঢুকলো l শাশুড়ির ছবির দিকে তাকালো…ওদের এখানকার কাজ মিটিয়ে যেতে এখনও দিন দশেক বাকি l শুভ অফিসে জানিয়ে দিয়ে ছুটিটা বাড়িয়েছে l শুভ, সনকা — মায়ের উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারছে ! কিন্তু কই ? সে তো একদিনও পারলো না ? ওকেও মা খুব ভালোবাসতো l
মায়ের ছবির সামনে দেওয়া মিষ্টির থালাটা পরিষ্কার করতে গিয়ে , এক সেকেন্ডের জন্যে হৃৎপিণ্ডটা বন্ধ হয়ে গিয়ে , দ্রুত চলতে শুরু করলো l থালায় দুটো সন্দেশের মধ্যে , মাত্র আধখানা পড়ে আছে ! নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলো , নিশ্চয়ই জানলা দিয়ে কোন কাক বা পাখি এসে খেয়ে গেছে ! পরক্ষনেই মাথায় প্রশ্ন জাগলো…তাই যদি হয় , আশে পাশে একটু টুকরো বা গুঁড়ো ও পড়ে থাকবে ? কিন্তু জলের গ্লাস টার ওপর নজর যেতেই , ওর বুদ্ধি শুদ্ধি তালগোল পাকিয়ে গেলো ! — গ্লাস টা সম্পূর্ণ খালি !!
…এইসময় জানলা দিয়ে এক ঝলক শীতল হাওয়া এসে ওর সারা শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিলো l …কবিতার মনের সন্দেহটা বাস্তবে পরিণত করলো, মায়ের ছবিটা l ও সভয়ে দেখলো , সন্দেশের গুঁড়ো মায়ের ঠোঁটে লেগে রয়েছে ,!
ওর পা দুটো অবশ হয়ে আসছে…এটা মস্তিস্ক জানান দিলো l এখান থেকে চলে যেতে হবে, এই মনস্থ করে ঘোরবার মুহূর্তে — পিঠে একটা ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেলো…… ll
……চট করে কবিতা মাথাটা ঘোরালো …সামনে ওর মা, বাবা দাঁড়িয়ে আছে l
” কি রে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলি কেন ? ” ও নিজেকে সামলে নেয় l
“তো– তোমরা ? ..বিকালে আসার কথা ছিল তো ? ”
” চলে এলাম l জামাই কোথায় ? ” কবিতা ওদেরকে নিজের ঘরে নিয়ে আসে l এসব কথা আর ভাঙে না l কথাবার্তা বলে, শুভর সঙ্গে দেখা করে ওরা বেলায় চলে যায় l
…তারপর দিন থেকে , সত্যি সত্যি সনকা আর এলো না …l শ্রাদ্ধের দিনও এগিয়ে এলো l এই কদিনে শুভও একটু স্বাভাবিক হয়েছে l কবিতা নিজের মনে ভাবে, …মা কি তবে চলে গেলো ? কেননা শুভও এই ব্যাপারে আর কোন আলোচনা করে নি l
সেদিন ঘাট কাজ…সকাল থেকে পাড়ার যে পুকুরে সকলে ঘাটের কাজ করে, সেখানেই ওরা যায় l কয়েকজন আত্মীয় স্বজনও এসে উপস্থিত হয়েছে l ..কাজ সেরে বাড়িতে আসতে বেশ বেলা হয়ে যায় l
…সন্ধ্যেবেলা ওরা ওপরে বসে , ছন্দা দেবীর কথাই আলোচনা করছিলো l কবিতার বাবা , মা , ভাই, কাকা সবাই রয়েছে l এইসময় কাকার ছেলে রাজা , সনকার বর কে নিয়ে ওপরে এলো ! শুভ কবিতার মুখে জিজ্ঞাসার চিহ্ন.. l
মুখ কাঁচুমাচু করে ও বললো ” দাদাবাবু , আপনার সাথে গোপনে একটু কথা আছে ” দুজনেই বুঝলো সনকা ওর াজের পয়সা নিতে পাঠিয়েছে l ওরা ওকে নিয়ে বারান্দার কাছে এলো l ন্যাড়া মাথা শুভ বললো..
” আমি হিসেব করেই রেখেছি…ওর কাজের টাকা ”
ও জিভ কাটলো…” টাকা নিতে আসিনি l ” কবিতা জিজ্ঞেস করলো…
” ও কোথায় এখন কাজ করছে ? ”
” কাজ ? ….এখান থেকে যাবার পরেই, বৌটা একদম বদলে গেছে গো বৌদি ” ওদের মনে পুরোনো স্মৃতি জাগতে শুরু করলো l ” খাওয়া দাওয়া একরকম ছেড়ে দিয়েছে l এলো চুলে রান্নার ঘরের সামনে বসে, কখনো খিলখিল করে হাসে আবার কখনো চুল ছিঁড়ে কাঁদে …” ওরা ভাবছে ও কি পাগল হয়ে গেলো নাকি ?
” ক্ষনে ক্ষনে শুধোয়, বড়মার ছেরাদ্ধ কবে ? ..একটুকুন আগে এই কাগজটা আমার হাতে দে বললো …শুধু দাদাবাবুর হাতে আড়ালে দেবে ! আমি মুখু সুখু মানুষ…” ছেঁড়া পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বার করে দিলো l ওরা দুজনেই কাগজটার ওপর ঝুঁকে পড়লো l আঁকাবাঁকা অক্ষরে পেন্সিলে লেখা কয়েকটা লাইন l শুভ বিড়বিড় করে পড়তে লাগলো l
…..” দাদাবাবু গো…এ লেকা যকন পড়বে , তকন আমি চলে গেচি অদিশ্য জগতে l পাপ বাপকেও ছাড়ে না l ছেলেটার ধার মেটাতে গিয়ে বড়ো মার গয়নার বাকসো থিকে — গয়না চুরি করেছিলুম l ঠিক ধরে ফেললো l কাকাকে জানাবার জন্যি সিড়ি দিয়ে নিচে নামার সময়, পেছন থেকে ঠেলা দিয়ে ফেলে দিলুম l যাতে ধরা না পড়ি l যেন বড়ো মা বেঁচে না থাকে , কাল হলো সেটাই l তারপর থেকে বিশ্বেস করো এক মিনিটও ঘুমোই নি l দিনরাত উনি আমার চোখের সামনে দাঁড়ায়ে…ওইরকম বিভৎস চাউনি আর সহ্যি করতে পারছি না…এ লেখা যকন লিখছি তখনো আমার চোখের সামনে উনি দাঁড়িয়ে আছে l পারো তো এই অভাগিটাকে মাপ করে, একটা সদগতি কোরোগো দাদাবাবু l
চিঠি পড়া শেষ করেই…শুভ ওদের নিয়ে ছুটলো সনকার বাড়ি l বাড়ির সামনে লোকের জটলা …কয়েকজন পুকুর থেকে বালতি করে জল নিয়ে ওর দরমা ঘেরা বাড়িটায় ছুঁড়ছে l …শুভ আর কবিতা অবাক চোখে দেখলো…সন্ধ্যের অন্ধকারে লাল আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলছে….ছেলে অন্ত প্রাণ …আর এক মায়ের জীবন্ত শরীর……ll
…………………………………………………….(সমাপ্ত)………………………………………………….