কিশোর বয়সের কিছু বিপদ আছে। উঠতে-বসতে তাদের ধমক খেতে হয় বড়দের কাছে। সবসময় ভেতরটা তাদের ফেটে পড়ে কৌতূহলে, কিন্তু বেশি কৌতূহল দেখাতে গেলেই ‘পড়াশোনা সব গেল’ বলে হাঁ হাঁ করে ওঠে বড়রা; কিংবা নিদেনপক্ষে চোখ গোল গোল করে ‘এই ছোঁড়া, বেশি প্যাট প্যাট করিস না তো!’ কিশোরেরা বুঝতে পারে অনেক কিছুই, কিন্তু সেটা বলতে গেলেই ঝামেলা। এই তো আজই বলতে গিয়ে একটা ধমক খেল দেবাশীষ।
সে গয়েশপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর একজন ছাত্র। বেশ ভাল ছাত্র হিসেবে ভালবাসে সে ক্রিকেট খেলা দেখতে, আবৃত্তি করতে আর গল্পের বই পড়তে। বিশেষ করে, ভূতের গল্প। বইয়ে ভূতেদের নানা রকম কাহিনী পড়ে সে মনোযোগ দিয়ে, কারও মুখে ভূতের গল্প শুনলেও শুনতে শুনতে তার চোখ হয়ে যায় বড় বড়। এই ভূতের গল্প শোনার লোভেই সে সুযোগ পেলেই যায় তার রঞ্জিতদার কাছে। রঞ্জিত বসাকপাড়ায় তাদের কটা বাড়ির পরেই থাকে। সে-ও গয়েশপুর উচ্চ বিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিল, বর্তমানে মেডিকেল শেষ বর্ষে পড়ছে। তুখোড় ছাত্র, তাই যতক্ষণ তার সঙ্গে থাকছে, সে যে ছেলেই থাকুক, বসাকপাড়ার সব বাবা-মার কাছে তার সাত খুন মাফ। মাঝেসাঝে ছুটি কাটাতে বাড়ি আসে রঞ্জিত, আর তার আসার সংবাদ পেলেই দেবাশীষ ছুটে যায় তার বাড়িতে।
দেবাশীষদের বয়সের ছেলেকে প্রশ্রয় দেয় না প্রায় কেউই। বয়ঃসন্ধিক্ষণের দৈহিক এবং মানসিক পরিবর্তনটাকে বড়রা কেন যেন মেনে নিতেই পারে না। তারা ভুলে যায় যে এরকম সময় একদিন তাদেরও পেরিয়ে আসতে হয়েছে।
আজ সকালে উঠেই সে শুনেছে রঞ্জিতদা এসেছে। তাই স্কুল ছুটির পর বাড়িতে বই-খাতা রেখেই ছুটে গেল সে রঞ্জিতের কাছে। তাকে মুড়ি দিয়ে নিজেও মুড়ি চিবোতে চিবোতে রঞ্জিতও শুরু করল ভূতের গল্প। গল্পের এক পর্যায়ে সে বলল, ‘তিনটে অস্ত্রের কাছে ভূতেরা কাবু।’
‘কী কী অস্ত্র, রঞ্জিতদা?’
‘আগুন, বেত আর লোহা।’ রঞ্জিত জবাব দিল।
‘কেন?’ আবার প্রশ্ন দেবাশীষের।
‘আগুনকে ভয় করে তারা নিজেরাই আগুনের তৈরি বলে।’
‘আর?’
‘বেতকে ভয় করে বেতের বাড়ি তারা এড়াতে পারে না বলে।’
‘ঠিক বুঝলাম না।’
‘ভূতেরা তো অদৃশ্য হয়ে থাকতে পারে। এই ধর, তোর পাশে বসেই একটা ভূত মুড়ি খাচ্ছে, তুই টেরও পাবি না।’
চমকে উঠে দেবাশীষ তাকাল তার মুড়ির থালার দিকে, আর তার এই ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল রঞ্জিত।
‘আরে না রে,’ বলল সে। ‘আজকাল ভূতেদের রুচিও খুব বেড়েছে। সেকেলে ভূতের মতো তারা আর মুড়ি-টুড়ি খায় না, মাংসের চপ হলে তবু কথা ছিল।’
রঞ্জিতের এই পরিবেশ তরল করে ফেলাটা দেবাশীষের ঠিক পছন্দ হলো না। গম্ভীর মুখে সে বলল, ‘বেতকে কেন ভয় করে, সেটা কিন্তু বললে না তুমি।’
‘বেশ,’ যেন বুঝিয়ে বলার জন্যই নড়েচড়ে বসল রঞ্জিত। ‘ধর, তুই একা একা রাতে বাড়ি ফিরছিস, এমন সময় একটা ভূত তোর নাকে একটা ঘুষি মারল। তুই তো লাফিয়ে উঠবি ‘‘আঁউ’’ করে, কিন্তু ভূতটাকে পাল্টা আঘাত করার কোনও সুযোগ তোর নেই। যাকে চোখেই দেখতে পাচ্ছিস না, তাকে মারবি কিভাবে? আমার কথা বুঝতে পারছিস?’
মাথা হেলাল দেবাশীষ, বুঝতে পেরেছে।
‘কিন্তু সে সময় যদি তোর হাতে একটা বেত থাকে, আর সেই বেত যদি চালাস সাঁই করে, তাহলে বাড়ি খেয়ে ভূতটাই লাফিয়ে উঠবে ‘‘আঁউ’’ করে। অবশ্য সেই চিৎকার তুই শুনতে পাবি না। ভূতেদের চিৎকার শুনতে পায় না মানুষ।’
এবার দেবাশীষও মজা পেতে শুরু করেছে। মুখ হাসি হাসি করে বলল, ‘আর লোহা ভয় পায় কেন?’
‘ওই, ভয় পায় আর কি,’ বিড়বিড় করতে লাগল রঞ্জিত।
‘তার মানে, এটা তুমি জানো না।’
‘এই ছোঁড়া তো বেজায় প্যাট প্যাট করে,’ ধমকে উঠল রঞ্জিত।
হঠাৎ ধমক খেয়ে অবাক হলেও কিছুটা লজ্জাও পেল দেবাশীষ। এভাবে রঞ্জিতদাকে বলাটা তার বোধহয় ঠিক হয়নি।
একটা সত্যি ভূত দেখার দেবাশীষের খুব শখ। ভয় পাক আর না-ই পাক, খুবই ইচ্ছে তার, অন্তত একটা ভূত যেন তাকে দেখা দেয়।
ভূত সম্বন্ধে তার এই কৌতূহল নিয়ে পলি, তিথিরাও হাসাহাসি করে। তাদের গ্রাম আর স্কুল নদীর এপার আর ওপার। ছোট যমুনার পশ্চিমপাশে তাদের গ্রাম বসাকপাড়া আর পুবপাশে গয়েশপুর উচ্চ বিদ্যালয়। ছোট যমুনার ওপর ছোট একটা সেতু। সেই সেতু পেরিয়ে সে, পলি আর তিথি বসাকপাড়া থেকে একসঙ্গে পড়তে যায় স্কুলে। ছুটির পর আবার ফিরেও আসে একসঙ্গেই।
এই তো গত সপ্তাহেই স্কুলের পথে এগোতে এগোতে টিপ্পনী কাটল পলি, ‘জানিস দেবা, গত রাতে আমি একটা ভূত দেখেছি। ঠিক তোর মতো সাদা একটা শার্ট আর নেভি ব্লু একটা প্যান্ট পরেছিল।’
‘ভূতদের নিয়ে অত ঠাট্টা নয় বুঝলি,’ বলল দেবাশীষ বসাক মুখ কালো করে, ‘যেদিন জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে নাকে চিমটি কাটবে, সেদিন বুঝবি মজা।’
‘তিথি, বুড়ো খোকার কথা শুনেছিস?’ খিলখিল করে হাসতে লাগল পলি। ‘সবসময় তো ভূত ভূত করিস, চিমটি যদি কাটে তোকেই কাটবে, যে ফর্সা নাক তোর, ভূতের চিমটি খেয়ে একেবারে লাল টকটকে হয়ে যাবে!’
ততক্ষণে খুকখুক করে হাসতে শুরু করেছে তিথিও। বলল, ‘বাবার কাছে শুনেছি, ভূত নাকি নানা জাতের আছে। তাদের মধ্যে একটা জাত হলো—সুড়সুড়ি ভূত। সুযোগ পেলেই মানুষের পায়ের তলায় সুড়সুড়ি দেয়। চন্দনের তো ভূত দেখার খুব শখ, আমার মনে হয় দেখা দিলে একটা সুড়সুড়ি ভূতই দেখা দেবে ওকে। ও যখন পড়তে বসবে, পায়ের তলায় সুড়সুড়ি দিয়ে বিরক্ত করবে।’
এবার হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল তিথি আর পলি। ওদিকে রাগে গা জ্বলে গেল দেবাশীষের। মুখে কিছু বলল না সে, কিন্তু গজরাতে লাগল ভেতরে ভেতরে, ‘একটা ভূতের দেখা আগে পেয়ে নিই, তাহলে বজ্জাতগুলো আর হাসার সুযোগ পাবে না।’
প্রথম সাময়িক পরীক্ষার পরপরই ঘোর বর্ষা নামল। তাদের ক্ল্যাসেরই বসাকপাড়ার একটা ছেলে, শুভ একদিন ফিসফিস করে বলল, ‘এই দেবা, মাছ ধরতে যাবি? খুব মাছ হচ্ছে ত্রিমোহনীর খাঁড়িতে।’
গয়েশপুর গ্রামের পাশেই বিশাল ঘুকসি বিল। গয়েশপুর থেকে শুরু হয়ে ষোলো-সতেরো মাইল পেরিয়ে সোজা চলে গেছে ভারতে। শুকনো সময়ে বিলটায় খুব একটা পানি থাকে না। কিন্তু ফুঁসে ওঠে বর্ষায়। বিলের পুব-দক্ষিণ কোণায় একটা খাঁড়ি এসে মিলেছে ছোট যমুনার সঙ্গে। খাঁড়িটা একরকম শুকনোই থাকে, কিন্তু বর্ষার সময় সেদিক দিয়ে তোড়ে পানি এসে পড়ে ছোট যমুনায়। এই জায়গাটা থেকে খানিকটা সামনেই ছোট যমুনা বয়ে গেছে তিন দিকে। তিনটে মোহনা এসে মিলিত হবার ফলে সেখানকার নাম—ত্রিমোহনী।
কিশোরেরা প্রায় সবসময়েই কৌতূহলে টগবগ করে ফোটে, শুভর কথা শোনামাত্র তাই লাফিয়ে উঠল দেবাশীষ। ‘কবে যাবি?’
‘আজ রাতেই চল না।’
মাছ ধরার খুব একটা অভ্যাস নেই দেবাশীষের। কেবল কোঁচ দিয়ে একটু-আধটু মাছ গাঁথতে পারে। কিন্তু সে ওসব নিয়ে মাথা ঘামাল না। তার কাছে মাছ ধরাটা খুব বড় বিষয় নয়। একটা অ্যাডভেঞ্চার করা যাবে, সেটা আসল কথা। তাই বলল, ‘চল, কখন যাবি?’
‘তুই তৈরি হয়ে থাকিস,’ বলল শুভ। ‘ঠিক রাত এগারোটায় শেয়াল ডাকবে তোর জানালার কাছে, বেরিয়ে আসবি সঙ্গে সঙ্গে।’
রাতে মাছ ধরার ব্যাপারটা এমনই উত্তেজনা জাগাল দেবাশীষের মনে যে, মুখে কোনও জবাবই দিতে পারল না সে, সায় দিল কেবল মাথা হেলিয়ে।
শুভ চলে যাবার পর একটা কথা ভেবে সামান্য অস্বস্তি বোধ করল দেবাশীষ। আজ রাত অমাবস্যার রাত। পরক্ষণেই চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলল সে। সঙ্গে শুভ থাকবে, সে তো আর একা যাচ্ছে না।
সারাদিন চুপিচুপি প্রস্তুতি নিল সে। তার বাবা বৈদ্যনাথ বসাক খুব মেজাজী মানুষ। এমনিতে ভালই থাকেন, তবে রেগে গেলে একেবারে অগ্নিমূর্তি। যা-ই হোক, মাছ ধরার এই চরম উত্তেজনা দমন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে ভাগ্য একদিক দিয়ে সুপ্রসন্ন তার, আজ বিকেলে রঞ্জিতদা আসবে। অবস্থা বেগতিক দেখলে সে সোজা গিয়ে উঠবে রঞ্জিতদার বাড়িতে, তারপর রঞ্জিতদা-ই সব সামলাবে। এদিকে আবহাওয়াও খুব ভাল। ক’দিনের অবিরাম বর্ষণের পর গতকাল থেকে আকাশ একদম পরিষ্কার।
কোঁচের শিকগুলো র্যাদা দিয়ে ধীরে ধীরে ঘষে ডগার সব মরচে তুলে ফেলল সে। একটা বেত জোগাড় করে রাখল আর লণ্ঠন বাবারটাই নেবে বলে স্থির করল।
ভূতের বিরুদ্ধে কার্যকরী তিনটে অস্ত্রই নেয়া যাচ্ছে দেখে মনে মনে খুশি হলো দেবাশীষ। ১) বেত, ২) লণ্ঠনের আগুন আর ৩) কোঁচের শিক তো লোহারই তৈরি।
সারাদিনের ছটফটানির শেষে সন্ধ্যে নামল গাঢ় হয়ে। সময় যতই এগোল, রাত হলো নিকষ। খুব মনোযোগী ছাত্র সে, কিন্তু আজ কোন পড়াই তার মাথায় ঢুকল না। জানালার পাশে বসে রইল দেবাশীষ উৎকর্ণ হয়ে। গ্রামের রাত। নয়টা বাজতেই তাদের বাড়ি একেবারে নিশুতি হয়ে গেল। দশটা বাজতে আশপাশেও আর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। সাড়ে দশটার পর থেকে একেবারে অস্থির হয়ে উঠল দেবাশীষ। খুট করে একটা শব্দ হলেই, কিংবা একটা ঝিঁঝি পোকা ডাকলেই চমকে চমকে উঠতে লাগল সে।
বাজল রাত এগারোটা। কিন্তু কই, শিয়াল তো ডাকে না!
সোয়া এগারোটা বাজতে মনে মনে শুভকে গালি দিতে লাগল সে। একেকটা মিনিট কাটতে লাগল একেকটা বছরের মতো। এগারোটা বিশ-একুশ-বাইশ-তেইশ আর তখনই—
হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া হুয়া হুয়া।
থপাস করে বইটা বন্ধ করেই লাফ দিয়ে উঠে পড়ল দেবাশীষ। হাসি পেল তার। শুভটা পারেও, কে বলবে যে একটা মানুষ শেয়ালের ডাক নকল করছে।
ঘরের এক কোণ থেকে লণ্ঠন, দেয়াশলাই, বেত আর খাটের নিচে লুকিয়ে রাখা কোঁচটা নিয়ে, ঘরে শেকল তুলে দিয়ে, চুপিসারে বেরিয়ে এল সে বাড়ির বাইরে।
কয়েক ধাপ এগোতেই অন্ধকারে মিশে থাকা শুভ বলল, ‘চন্দন?’
‘হু,’ জবাব দিল সে শুভর মতোই চাপা স্বরে।
‘চল।’
বসাকপাড়া ঘিরে থাকা নিবিড় বাঁশবন পেরিয়ে দু’বালক এগোতে লাগল নদী অভিমুখে। হাঁটতে হাঁটতেই লণ্ঠনটা ধরিয়ে নিল দেবাশীষ। আর তাই দেখে প্রায় ধমকে উঠল শুভ, ‘লণ্ঠন আবার কী হবে?’
‘লণ্ঠন নেব না, বলিস কী রে?’ অবাক হলো দেবাশীষ। ‘অন্ধকারে হোঁচট খেলে তখন?’
‘হোঁচট খাবি না ছাই হবে,’ গজগজ করতে লাগল শুভ, ‘এ তো চেনা রাস্তা।’
ছোট যমুনার তীরে এসে উঠে পড়ল তারা গয়েশপুরের আবদুল মাঝির ডিঙিতে। গাঢ় কালো স্রোত বয়ে চলেছে কলকল করে। তবে চিন্তার কিছু নেই। শুভ পাকা মাঝি। কাজ চালানোর মতো বৈঠা সে নিজেও ধরতে পারে।
ডিঙি এগোতে আবার গজগজ করতে লাগল শুভ, ‘তোর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, যুদ্ধে যাচ্ছিস। লণ্ঠন, বেত, কোঁচ, নেয়ার মতো আর কিছু ছিল না?’
আবারও অবাক হলো দেবাশীষ। ‘বা রে, সাপ-টাপ কত কী থাকতে পারে, তাই বেত নিলাম। আর কোঁচ নেব না, তাহলে মাছ ধরব কী দিয়ে?’
‘আমি কিচ্ছু নেইনি,’ বলল শুভ। ‘খাঁড়ি দিয়ে যেখানে মাছ নামে, সেখানে তো পানি এক হাঁটুর চেয়েও কম। ওই পানিতে হাত দিয়েই মাছ ধরা যায়।’
‘তুই সব সময় মাছ ধরিস। তোর কথা আলাদা। আমি কোঁচ ছাড়া মাছ ধরতে পারি না।’
ডিঙি গিয়ে ভিড়ল ওপারে। তীরের ওপর ডিঙি বেশ খানিকটা টেনে তুলে রওনা দিল শুভ, পেছনে পেছনে দেবাশীষ।
আট-দশ ধাপ যেতেই জোর একটা বাতাস উঠল। দপদপ করতে লাগল লণ্ঠনটা। সেটা কোনরকমে সামলে সামনে তাকাতেই আঁতকে উঠল দেবাশীষ। শুভ নেই!
‘শুভ, শুভ!’ ভাঙা শুকনো গলায় ডাকতে লাগল সে। আবার জোর একটা বাতাস বইল, দপ করে উঠেই নিবে গেল লণ্ঠনটা। আকাশের দিকে তাকাল দেবাশীষ। দিগন্ত বিস্তৃত ডানা মেলে যেন ঝুলে আছে প্রকাণ্ড এক কালো বাদুড়। যেকোন সময় ছোঁ মেরে নেমে আসবে নিচে। বেশ কয়েকটা দেয়াশলাইয়ের কাঠি নষ্ট করার পর লণ্ঠনটা ধরিয়ে আবার শুকনো গলায় ডাকল সে, ‘শুভ, শুভ!’
‘এই তো আমি,’ কথা ভেসে এল পেছন দিক থেকে, ‘এত চেঁচাচ্ছিস কেন?’
‘তুই তো সামনে ছিলি, পেছনে গেলি কখন?’
‘পায়ে শামুক ফুটেছে।’
আবার এগোতে লাগল দু’বন্ধু। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা এসে পৌঁছল খাঁড়ির ধারে। ডানপাশে বর্ষার বিশাল ঘুকসি বিল। গাঢ় অন্ধকারে তার জলরাশিকে মনে হচ্ছে, উপুড় হয়ে আছে যেন প্রাগৈতিহাসিক কোন নাম না জানা অতিকায় দানব।
বিল থেকে খাঁড়ি দিয়ে তোড়ে পানি নামছে ছোট যমুনায়। লণ্ঠনটা নামিয়ে রাখার পরপরই কোঁচে মাঝারি একটা শোল গেঁথে উল্লসিত হয়ে উঠল দেবাশীষ। ‘এই শুভ, তুই নাকি খালি হাতেই মাছ ধরবি, নাম না পানিতে।’
‘নামব,’ জবাব ভেসে এল ফ্যাঁসফেঁসে গলায়। সামান্য অবাক হলো দেবাশীষ, শুভর গলা তো এরকম নয়। কিছু একটা বলতে চাইল সে, আর ঠিক তখনই আবার বয়ে গেল দমকা বাতাস। দপদপ করতে করতে আবার নিবে গেল লণ্ঠন। গাঢ় অন্ধকারে চোখ কিছুটা সয়ে আসতেই তাকাল সে পাশে। শুভ নেই! তাড়াহুড়ো করে পকেট থেকে বের করতে গিয়ে, হাত ফসকে দেয়াশলাইটা পড়ে গেল পানিতে।
এই সময় খনখন করে হেসে উঠল কে যেন। এটা তো শুভর হাসি নয়! সড়সড় করে মাথার সব চুল দাঁড়িয়ে গেল দেবাশীষের। হঠাৎ উথাল-পাথাল হতে লাগল খাঁড়ির পানি। পানি তোলপাড় করছে বিরাট কোন মাছ, খুব সম্ভব বোয়াল। ঘুকসি বিল যখন কানায় কানায় ভরে যায় পানিতে, বিরাট সব বোয়াল যেন এসে উপস্থিত হয় কোত্থেকে।
অন্ধকারেই শুকনো গলায় ডাকল দেবাশীষ, ‘শুভ, এই শুভ!’ কোন সাড়া নেই।
আবার কে যেন হাসল খনখনে সেই হাসি। সামনের মাছটা এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। খুব বড় হবার কারণে মাছটা কি আটকে গেছে খাঁড়ির অগভীর পানিতে, হাঁচড়ে-পাঁচড়ে তাই নামতে চাইছে নদীতে?
মাথার ভেতরে ঝলকে ঝলকে চিন্তা বয়ে গেল দেবাশীষের। খুব করে মনে পড়তে লাগল বাবা-মার কথা। যত রাগী মানুষই হোন বাবা, সবরকম বিপদে কেমন আগলে থাকেন তাদের সবাইকে।
বুকের গহীনে দেবাশীষ যেন স্পষ্ট শুনতে পেল বাবার স্বর, ‘চন্দন, ঘাবড়ে যাস না, বাবা। সামনে ভীষণ বিপদ। মাথা ঠাণ্ডা রাখ, বাবা।’
আর এই সময়েই একটা জিনিস লক্ষ করে কেঁপে উঠল দেবাশীষের অন্তরাত্মা। মাছটা নদীতে নামার চেষ্টা করছে না। একবার এগোচ্ছে ওটা, আবার পিছিয়ে ফিরে আসছে তার কাছে।
বুকের ভেতরে বসে আবার যেন সাহস জোগাল বাবা। ঝট করে কোঁচ তুলল সে মাথার ওপরে। কিন্তু এতবড় মাছের বিপক্ষে এই কোঁচ নিতান্তই হাস্যকর। মাছটা এখন তার একেবারেই মুখোমুখি, যেন যে কোন মুহূর্তে লাফিয়ে উঠবে তীরে।
সর্বশক্তি দিয়ে কোঁচ চালাল দেবাশীষ। থ্যাচ করে ভোঁতা একটা শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে পানির ভেতর থেকে ভেসে এলো রক্ত হিম করা এক আর্তনাদ। ছটফট করতে লাগল মাছটা। কোঁচ প্রায় ভাঙার জোগাড়। তবু ঠেসে ধরে রইল দেবাশীষ।
ক্রমে কমে এল ছটফটানি, আর্তনাদ পরিণত হলো গোঙানিতে, তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল একসময়। রাত আবার সেই আগের মতোই গাঢ়, কালো, নিঃশব্দ।
ছুটতে লাগল দেবাশীষ। এক হাতে তার নেবানো লণ্ঠন, আরেক হাতে তার নেবানো লণ্ঠন, আরেক হাতে কোঁচ। কোঁচের ডগায় কোন মাছ গেঁথে নেই। তবু বেশ ভারী ঠেকছে, নিকষ অন্ধকারে সে ঠিক ঠাহর করতে পারল না।
ডিঙিটা এক ধাক্কায় পানিতে নামিয়েই বৈঠা চালাল সে প্রাণপণে। প্রয়োজন খুব বড়মাপের শিক্ষক। মুহূর্তে মাঝারি থেকে দেবাশীষকে সে রূপান্তরিত করে ফেলল পাকা মাঝিতে। নদী পার হতেই বৈঠাটা রেখে কোঁচ আর লণ্ঠন তুলে নিল দেবাশীষ। তারপরই ছুটল পড়িমরি করে। ডিঙিটা যে পাক খেতে খেতে চলে গেল নদীর মাঝখানে, লক্ষ করল না।
বাড়ি যাবার সাহস পেল না সে। তাই গেল তার রঞ্জিতদার বাড়ি। চাপা গলায় ডাকল, ‘‘রঞ্জিতদা, রঞ্জিতদা।’
রঞ্জিতের ঘুম খুব পাতলা। বলল, ‘কে রে?’
‘আমি, দেবাশীষ।’
‘চন্দন?’
‘হু।’
এবার তড়াক করে বিছানা ছেড়ে, বাড়ির বাইরে এসে রঞ্জিত বলল, ‘কী ব্যাপার রে, এত রাতে?’
‘মাছ ধরতে গিয়েছিলাম।’
তাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল রঞ্জিত। তারপর তার হাত থেকে কোঁচ আর লণ্ঠনটা নিয়ে, উঠোনের এক কোণে রেখে নিয়ে গেল তাকে ঘরের ভেতরে।
‘কার সঙ্গে মাছ ধরতে গিয়েছিলি?’
‘শুভর সঙ্গে।’
‘কার সঙ্গে বললি?’ মুহূর্তে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল রঞ্জিতের স্বর।
‘শুভর সঙ্গে,’ বলল সে আবার। ‘দেখো না রঞ্জিতদা, অন্ধকারে আমাকে একা ফেলে পালিয়ে এসেছে শয়তানটা।
কিন্তু রঞ্জিত এখন গভীর চিন্তায় মগ্ন। বিড়বিড় করে বলল, ‘হুঁ, এজন্যই বজ্জাতটা জ্বরের মধ্যেও ‘‘আমার কাজ আছে, আমার কাজ আছে’’ করছিল।’ মিনিট চারেক পর দেবাশীষকে রঞ্জিত নিয়ে গেল ঘরের আরেক পাশে। কোণে টিম টিম করে জ্বলা লণ্ঠনটার আলো বাড়িয়ে তুলে ধরল ওপরে।
নিজের চোখকে যেন দেবাশীষ বিশ্বাস করতে পারল না। খাটের ওপর শুয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে শুভ। মাথায় জলপট্টি।
‘গত রাতে আমি বাড়ি আসার ঘণ্টাখানেক পরেই একটা অঙ্ক বুঝে নিতে এল শুভ। অঙ্কটা বোঝাতে বোঝাতে হঠাৎ গা কাঁপিয়ে জ্বর এল ওর। দেখতে দেখতে সে জ্বর বেড়ে গেল খুব। এবার আমি সঙ্গে করে কোন ওষুধ আনিনি, তাই ননীবাবুকে ডেকে ওকে ওষুধ খাওয়ালাম। সংবাদ পাঠালাম ওদের বাড়িতে। ও-র বাবা-মা এল। কিন্তু আমি ওকে যেতে দিতে চাইলাম না। মাথায় পানি ঢেলে জলপট্টি দিতে দিতে মা-ও বলল, ‘‘আজ ছেলেটা এখানেই থাক।’’ শেষমেষ জ্বর কমতে, এই তো কিছুক্ষণ আগে, চলে গেল ওর বাবা-মা। তারপর আমি ঘুমাতে না ঘুমাতেই এসে ডাক দিলি তুই।’
শুনতে শুনতে মাথার চুল আবার দাঁড়িয়ে গেল দেবাশীষের। ‘এবার বুঝতে পেরেছিস?’ বলল রঞ্জিত। মুখে কথা ফুটল না, কেবল ওপর নিচে মাথা দোলাল সে। বুঝতে কিছুই আর বাকি নেই তার।
থরথর করে কাঁপতে থাকা ছেলেটাকে বুকে টেনে নিল রঞ্জিত। প্রচণ্ড আতঙ্কের পর এই পরম স্নেহের পরশ পেয়ে ফোঁপাতে লাগল দেবাশীষ। মিনমিন করে বলল, ‘বাবা খুব রাগ করবেন, তাঁকে না বলে গেছি।’
‘আচ্ছা আচ্ছা, সে দেখা যাবে,’ একটা গামছা এগিয়ে দিল রঞ্জিত। ‘এখন গা-মাথা মুছে শুবি চল।’
গা মাথা মুছল দেবাশীষ, তারপর পরল রঞ্জিতেরই একটা শার্ট আর লুঙ্গি। কেবল শুতে যাবে সে, এমন সময় রঞ্জিত বলল, ‘একটু বাইরে চলতো।’
শুভর কপালে আলতো করে একটা হাত ছুঁইয়ে সে বলল, ‘না, আর জ্বর নেই।’ তারপর লণ্ঠন হাতে বেরিয়ে এল উঠোনে, পেছনে পেছনে দেবাশীষ।
উঠোনের এককোণে পড়ে আছে দেবাশীষের কালিমাখা নেবানো লণ্ঠন, কিন্তু তার পাশে পড়ে থাকা কোঁচটার দিকে তাকাতেই বিস্ফারিত হয়ে গেল দুজনের চোখ।
কোঁচের শিকগুলোর ডগায় গেঁথে আছে কঙ্কালের আস্ত একটা মুণ্ডু!
…………………………………………………….(সমাপ্ত)…………………………………………………….