সুমনের গল্প লেখার ইচ্ছে হতো না, যদি না আকাশ মেঘলা থাকত, ঘরের ভেতর আধো আলো আধো অন্ধকার ভাবটা না থাকত। সুমনের কানে ওয়াকম্যান লাগানো। লেখার আগে টেবিলটি সাফ সুতরো করে নিয়েছে, ইচ্ছে তার জম্পেশ গল্প লিখবে সে আজ।
একটা সমস্যা অবশ্য রয়ে গেছে। সুমনের কল্পনাশক্তি খুব প্রখর নয়। অনেক ভাবাভাবি করেও কিছু একটা দাঁড় করাতে পারে না। ওর গল্পগুলো তাই মাঝপথেই থেমে যায়। সুমনের তাই আজকের ইচ্ছে, গল্প নয়, কিছু সত্যি কাহিনী সে শোনাবে পাঠককে। আর এভাবেই শুরু হলো গপ্প।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিচার্স কোয়ার্টারে এক বাড়িতে ভূত আছে তিনটি। একটি বাচ্চা, দুটো বড়।
১৮ই মার্চ, ২০০১।
গভীর রাত। প্রফেসর সাহেব পড়াশোনা করছেন স্টাডিতে। টেবিলের ওপাশে জানালার পর্দা সামান্য উঠানো। বাড়িতে অন্য দুজন মানুষ, স্ত্রী এবং কন্যা ঘুমাচ্ছে। চারদিক চুপচাপ। আত্মনিমগ্ন প্রফেসর। হঠাৎ শুনতে পেলেন শব্দটি। টকটক। কে যেন জানালার কাচে টোকা দিচ্ছে। চমকে তাকালেন প্রফেসর।
পর্দা তোলা জানালার ওপাশে হাসি হাসিমুখে তাকিয়ে আছে একটি দশ-বারো বছরের ছেলে। ‘টিকেট লাগবে স্যার, টিকেট?’ ছেলেটির প্রশ্ন। পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু থেকে মনোযোগ এখনও কাটেনি মাস্টার সাহেবের। আবার প্রশ্ন, ‘লাগবে স্যার, টিকেট?’
সচেতন হলেন শিক্ষক। এত রাতে, জানালার ওপাশে, কে এই ছেলেটি? চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, ‘কে? কে?’ ততক্ষণে উধাও হয়ে গেছে আগন্তুক। অত রাতে তিনি আর কাউকে জাগালেন না। ভাবলেন, চোর-ছ্যাঁচড় কেউ হবে। রসিকতা করেছে। মনে তবুও খটকা রয়ে গেল, রাত দুটোর সময় কেন?
২০ই মার্চ, ২০০১।
দুদিন পরের ঘটনা। এবারও মাস্টার সাহেবের পালা। রাত গভীর হচ্ছে। তিনি বসে আছেন স্টাডিতে। তিনি যেখানে বসেন সেখান থেকে ডাইনিং স্পেস স্পষ্ট দেখা যায়। ক্লাসের নোট তৈরি করছেন শিক্ষক।
হঠাৎ চোখের কোণে দেখতে পেলেন কেউ একজন যেন ডাইনিং স্পেসে এসে দাঁড়াল। টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে পানি ঢালল গ্লাসে। প্রথমটায় ভেবেছিলেন বাড়িরই লোকজন কেউ হবে। হঠাৎ মনে হলো, স্ত্রী এবং কন্যা ছাড়া আর কেউ তো নেই বাড়িতে। ‘কে? কে?’ চেঁচিয়ে উঠলেন টিচার। উধাও হয়ে গেল আগন্তুক।
২১ মার্চ, ২০০১।
তৃতীয় ঘটনা স্ত্রী এবং কন্যাকে নিয়ে। দুপুরে ভাতঘুমে আয়েশ করে শুয়ে আছেন গৃহকর্ত্রী। ঘুম লাগি লাগি চোখে। হঠাৎ মেয়ে এসে পাশে দাঁড়াল। বলল, ‘আম্মু, ওঠো তো, জলদি ওঠো,’ আঙুল ধরে টানাটানি করছে সে। বিরক্তি নিয়ে পাশ ফিরলেন মা। আবার হাতের আঙুল ধরল মেয়ে, ‘ওঠো না, একটু ওঠো দেখবে।’ মেয়ের পীড়াপীড়িতে উঠলেন মা, বললেন, ‘চল কি দেখাবি, চল।’
মায়ের ডান হাতের মধ্যমা ধরে আছে মেয়ে। পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে মেয়ের সঙ্গে চললেন মা। মেইন গেটের কাছে এলেন, তাকালেন বাইরে। কোথাও কিছু নেই। কষে বকা দেয়ার জন্য তাকালেন মেয়ের দিকে। নেই মেয়ে। অথচ হাতের যেন স্পর্শ লেগে রয়েছে তার। আচমকা মনে পড়ল মায়ের, মেয়ের তো এখন বাসায় থাকার কথা নয়। সে তো রয়েছে স্কুলে। আঙুল ধরে দরোজা পর্যন্ত টেনে আনল কে?
এই তিনটি রহস্যের পুরোটা আজও কিনারা হয়নি। তবে শুনেছে, ওই বাড়িতে নাকি কোন একটি ছেলে কবে আত্মহত্যা করেছে। ছোট ভূতটির না হয় জবাব পাওয়া গেল, কিন্তু অন্যজন কে?
এ তো গেল সাম্প্রতিক ভূতের গল্প। এ রকম আরেকটি ঘটনা শুনেছে বাবার কাছে।
বহু বছর আগের কথা। বাবাদের বাড়ির কাছে ছিল একটি কবরস্থান, সামান্য দূরে শ্মশান ঘাট। জায়গাটি নাকি খারাপ। নানা ঘটনা ঘটে ওখানে। দিনে-রাতে যে কোন সময় পাশ দিয়ে যেতে গা ছমছম করে। কবরস্থানের পাশ দিয়ে রাস্তা গেছে করিমপুর। যদু মিয়া সে গ্রামের বাসিন্দা। বাজারে তরকারি বিক্রি করে। যদু মিয়ার তিন ছেলে। ছোটটিকে ভর্তি করিয়েছে মাদ্রাসায়। আলেম বানাবে। হঠাৎ একদিন শোনা গেল, যদু মিয়ার ছোট ছেলে হালিমকে পাওয়া যাচ্ছে না।
বেশ কয়েকদিন ধরে ওর জ্বর ছিল। মাদ্রাসায়ও যেত না। শুয়ে থাকত বাড়িতে, বিছানায়। নাই, নাই। হালিম কোথাও নাই। ধারেপাশে সব জায়গায় খোঁজা হলো। না, নেই সে। শোকে-দুঃখে পাথর হয়ে গেলে বাবা-মা।
হঠাৎ একরাতে হাঁটুরেরা বাড়ি ফেরার পথে দেখতে পেল, কবরস্থানের দেয়ালের উপর কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। আকৃতি বোঝা যায় না, তবে অন্ধকারেও আন্দাজ করা যায় সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। বুকে ঝাড়ফুঁক দিয়ে সাহস করে এগিয়ে গেল দু’একজন।
কে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে? না, যদু মিয়ার ছেলে হালিম। স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আছে, চোখ দুটো লাল, মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই, কোথা থেকে এল সে এখানে? এতদিন কোথায় ছিল? কোন জবাব নেই। ধরাধরি করে ওকে বাড়ি নিয়ে এল সবাই। তিনদিন পরে স্বাভাবিক হলো সে। কোথায় ছিল সে এতদিন? প্রশ্ন করলে একটাই জবাব দেয় সে, পরীরা এসে ওকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। কোথায়? সে জানে না। কেন তারা ওকে কবরস্থানে নামিয়ে দিয়ে গেছে, তাও সে জানে না।
এ গল্পটি সত্তরের দশকের। বলেছেন সুমনের চাচা। প্রথম গল্পটির টিচারস কোয়ার্টারের। এবারের গল্পটি ছাত্র হলের। গল্পটি এ রকম—মহসিন হলেন তিনশ চৌদ্দ নম্বর রুমে, থাকে গোবেচারা গোছের ছাত্র শাহনূর। কিছুদিন হলো শাহনূর খুব মনমরা হয়ে থাকে। এমনিতেই কথাবার্তা বলে কম, ইদানীং আর কথাই বলছে না। বন্ধুরা পীড়াপীড়ি শুরু করল, কি হয়েছে তার? বলতে হবে। শাহনূর জবাব দেয় না, শুধু বলে, ‘তোরা বিশ্বাস করবি না।’
‘কি এমন কথা যা বিশ্বাস করা যাবে না?’ বন্ধুদের প্রশ্ন।
‘আমার ঘরে পরী আসে।’
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল বন্ধুরা।
‘আমি তো আগেই বলেছি, বিশ্বাস হবে না।’ বলল শাহনূর।
‘দেখাতে পারবি?’ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল বন্ধুরা।
‘পারব,’ বলল শাহনূর। ‘বৃহস্পতিবার রাতে এগারোটার পর আসিস।’
বৃহস্পতিবার রাত। হল এলাকা আস্তে আস্তে চুপচাপ হয়ে
গেল। ঘরে ঘরে বাতি নিভে গেছে। তিনশ চৌদ্দ নম্বর রুমে শুধু জেগে আছে পাঁচটি ছেলে।
হঠাৎ করে যেন দমকা হাওয়া শুরু হলো। ঘরের পর্দা নড়তে লাগল বিষম জোরে। সুগন্ধিতে ভরে যায় রুম। হঠাৎ দেখা গেল, ঘরের মধ্যে হাজির হয়েছে অপূর্ব সুন্দরী অথচ খুদে আকৃতির এক পরী। সবাইকে সম্ভাষণ জানাল পরী, সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর, বিস্মিত সবার চোখের সামনে শাহনূরের কোলে এসে বসল পরী। ট্রান্সপারেন্ট পরীর দেহ ধরা যায় না, অথচ আছে। নানা প্রশ্ন করল সবাই পরীকে। উৎসাহী কেউ কেউ জানতে চাইল, সামনের পরীক্ষার ফল কি হবে? পরী জবাব দিল, শাহনূর বাদে সবাই পাস করবে, এমনকি একজন ফার্স্টক্লাসও পাবে।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তিন মাস পরে পরীক্ষার ফলাফল পরীটি ঠিক যেভাবে বলেছিল সেভাবেই হলো। তবে ওই ঘটনার পর পরীটিকে আর দেখেনি শাহনূর।
ব্যাংকক থেকে ফিরে এসে পরের গল্পটি শুনিয়েছিলেন সুমনের বাবা। তাঁকে শুনিয়েছেন মতিন আঙ্কেল। তিনি এখন ওখানেই ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। ঘটনাটি অবশ্য এই বাংলাদেশেরই। টিকাটুলীর।
উনিশ ঊনসত্তরের কথা। মতিন আঙ্কেলরা থাকেন টিকাটুলীতে। তাঁর বন্ধু শফিক। পাশাপাশি বাড়ি। শফিকের মা নেই। বাবা আছেন। সরকারী চাকুরী করেন। মফস্বলে পোস্টিং। ছুটির দিনে
বাড়িতে আসেন। শফিক বাড়িতে একা থাকে। পুরানো কাজের বুয়া আছে, সে-ই রান্নাবান্না করে দেয়। রাতে চলে যায়। আর তাছাড়া মতিন আঙ্কেলের মতো বন্ধুরা তো রয়েছেই। একসঙ্গে পড়াশোনা করে। মাঝে মাঝে মতিন আঙ্কেল শফিকদের বাড়িতেও রয়ে যায়, রাত বেশি হলে।
ইদানীং শফিককে বেশ উদ্ভ্রান্তের মতো দেখায়। চোখগুলো লাল হয়ে থাকে। বন্ধুদেরকে এড়িয়ে চলে। মতিনের সন্দেহ হলো, শফিকের হয়তো কোন অসুখবিসুখ করেছে। একদিন তাই সুযোগমতো প্রশ্ন করল শফিককে, ‘কিরে তোর কি কোন অসুখ করেছে? চোখমুখ ওরকম দেখায় কেন? রাতে ঘুমটুম হয়?’
ফ্যাকাসে হয়ে গেল শফিক জাপটে ধরল মতিনের হাত, বলল, ‘ও আমাকে নিয়ে যেতে চায়।’
‘কে? কে তোকে নিয়ে যেতে চায়?’ রহস্যের গন্ধ পেল মতিন।
শফিক কি গোপনে গোপনে প্রেম করছে?
‘কোথায় থাকে সে? কোথায় নিয়ে যেতে চায়?’ প্রশ্ন মতিনের।
‘জানি না, বলে দূর কোন দেশে।’
‘মেয়েটাকে দেখাবি তো? ঠ্যাং ভেঙে দেব।’ বলল মতিন, ‘নিশ্চয় বিহারি হবে?’
‘না না, মানুষ তো নয়। পরী। দিনে আসে না, আসে রাতে।’ বলল শফিক। ‘আজ রাতে আসবে। তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।’
মতিন ঠিক বুঝতে পারছে না, শফিক কি সত্যি কথা বলছে, না পাগলের প্রলাপ বকছে।
মতিন তার মা-বাবাকে রাজি করাল, আজ রাতে সে শফিকের বাড়িতে পড়াশোনা করবে, আজ আর ফিরবে না।
শফিকের বাড়িটি টিনের। ঘরের মেঝে মাটির। বেড়ার দরোজা, জানালা। বাড়ির সামনে ছোট্ট উঠোনে কামরাঙ্গা আর লেবু গাছের ঝাড়। এলাকার সব বাড়িতে এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। শফিকদের বাড়িতেও আসেনি। হারিকেন জ্বালিয়ে লেখাপড়া করে সে।
মতিন এসেছে। দু’বন্ধু বসে আছে পড়ার টেবিলে। উত্তেজিত মতিন। হঠাৎ শুরু হলো দমকা হাওয়া। দরোজা তখনও ভেজানো হয়নি, হাওয়ার তোড়ে দুলে দুলে উঠছে দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডার, মাঝেমধ্যেই নিভু নিভু হয়ে যাচ্ছে হারিকেনের সলতে। এক সময় থেমে গেল হাওয়া।
‘এসেছো, তুমি এসেছো।’ লাজুক ভঙ্গিতে বলল শফিক কারো উদ্দেশ্যে।
বিস্মিত মতিন, ধারেপাশে ওরা দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই।
‘কাকে বলছিস?’ প্রশ্ন করল মতিন।
‘এই যে একে।’ শফিক ওর পাশে অদৃশ্য কারো দিকে ইঙ্গিত করল।
শফিকের এই আচরণ ও মুডে চিন্তিত হলো মতিন। ‘না, আমি যাব না।’ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল শফিক।
‘কোথায় যাবি না তুই?’ প্রশ্ন করল মতিন।
‘না, যাব না। ছাড়।’ নিজের হাতটা টানছে শফিক।
হঠাৎ যেন ধস্তাধস্তি হলো ঘরের ভেতর। মনে হচ্ছে কেউ যেন শফিককে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দরোজার দিকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় মতিন। ‘আমাকে বাঁচা মতিন!’ চিৎকার করে উঠল শফিক।
ওকে জাপটে ধরতে চাইল মতিন। কে যেন ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল ওকে। শূন্যে উঠে যাচ্ছে শফিক। নিজের অজান্তেই পা জাপটে ধরল মতিন। উড়ে যাচ্ছে শফিক। ধরে রাখতে পারছে না মতিন। ছিটকে বেরিয়ে গেল শফিকের পা। পারল না মতিন ধরে রাখতে। বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে শফিক।
হঠাৎ শোনা গেল প্রচণ্ড এক শব্দ। মনে হলো পাশের বাড়ির টিনের ছাদে কিছু একটা জিনিস সশব্দে পড়ল। ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এল মতিন। পাশের বাড়ির টিনের ছাদে উবু হয়ে পড়ে আছে শফিক। মুহূর্তের মধ্যে শূন্যে তুলে কেউ যেন আছড়ে ফেলেছে শফিককে। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে তার।
বিকট শব্দ শুনে আশপাশের বাড়ি থেকে ছুটে এসেছে লোকজন। ধরাধরি করে টিন থেকে নামানো হলো শফিককে। ওর মুখে কোন কথা নেই। চোখ-মুখ উদ্ভ্রান্ত। কোন ব্যাখ্যাও সে দিতে পারছে না। কেন যে টিনের ছাদে উঠেছিল, ব্যথাই বা পেল কিভাবে। এ ঘটনার পূর্ব ইতিহাস মতিন জানলেও কাউকে সে বলতে পারল না আসলে কিভাবে ঘটল ঘটনাটি।
মতিন আঙ্কেল এই রহস্যের কোন কিনারা করতে পারেননি। পারার মতো কোন যুক্তি তো আসলে তার কাছে নেই।
…………………………………………….(সমাপ্ত)………………………………………..