বনগ্রামের বাসা

বনগ্রামের বাসা

মতিন যখন অনেক কষ্টে জগন্নাথ কলেজে অনার্স পড়ার একটা সুযোগ পেয়ে গেল, তখন থাকার জায়গা নিয়ে পড়ল সমস্যায়। দু’চারদিন এক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়ের বাসায় থাকার পর ক্লাসেরই এক বন্ধু পুরানো ঢাকার বনগ্রামের দিকে এই বাসাটা ঠিক করে দিল।

বাসাটায় ওঠার পর প্রথম দিকে মতিনের মন খারাপ হয়ে গেছিল। বিহারিদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি। অনেক পুরানো বাড়ি। একেবারে ঘিঞ্জি। এক চিলতে উঠান। উঠানের পিছন দিকে একটা ঘর। জায়গায়-জায়গায় পলেস্তারা খসে বেরিয়ে পড়েছে পুরানো দিনের ছোট ছোট লাল ইট। দরোজাটার কাঠ বেশ ভারী, তবে নিচের দিকে ভাঙা। ফলে বাইরে দরোজার নিচ দিয়ে আলো আসে। জানালা একটা ঘুলঘুলির মতো ছোট ফাঁক মাত্র। শিকগুলো ভাঙা। কপাটের নাম-গন্ধ নেই। বাড়ির অন্যদিকে বাড়িঅলা থাকে। বাড়িওয়ালাদের পরিবারটাও অদ্ভুত। পরিবারের ছোট ছেলেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিদ্যায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে পাস করেছিল। এখন কোন এক কারণে পাগল। কারণটা মতিনের কাছে অজ্ঞাত। আর বড় ছেলে এ মহল্লার মাস্তান।

ছোট ছেলেটা শুধু মূর্তির মতো দোতলার রেলিং ধরে দূরে কোন এক অস্তপারে দৃষ্টি মেলে নীরবে তাকিয়ে থাকে। নিচ থেকে বাড়িওয়ালাদের রেলিংয়ের এককোণা দেখা যায়, মতিন মাঝেমধ্যে উঁকি দিয়ে দেখে, ছোট ছেলেটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ন্যাড়ামাথা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। শূন্য দৃষ্টি। খালি গা। অন্য সময় যাই হোক, বিকেলে ঘুম থেকে উঠলে মতিন উপরের দিকে তাকালেই ছোট ছেলেটাকে দেখতে পায়। হঠাৎ কখনও বা চোখ নামিয়ে মতিনের দিকে তাকায়। চোখে সেই শূন্য দৃষ্টি। একটা ঠাণ্ডা ভয়ের স্রোত মতিনের শিরদাঁড়া বেয়ে নিচের দিকে নেমে যায়। এই দিকটা এত নীরব! বাড়িওয়ালাদের নিচতলাটায় একটা জুতোর কারখানা। রাস্তার দিকে দরোজা। মাঝেমধ্যে অল্পবয়েসী কারিগররা বিড়ি ফুঁকতে পিছনের দরোজা দিয়ে চিলতে উঠানে এসে দাঁড়ায়। কখনওবা উঠানের এককোণে আধা কাঁচা পায়খানায় গিয়ে প্রসাব করে। তবে বেশিরভাগ সময়ই পিছন দিকের দরোজাটা বন্ধ থাকে। একেবারে নীরব এই কোণাটা। অথচ জুতোর কারখানার কারিগররা সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি হৈ হৈ করে কাজ করে চলেছে। রাস্তার দিকে শুধু জুতোর কারখানার দেয়াল ঘেঁষে সরু একটা গলি ভেতরে ঢোকার জন্য। মাঝে বাড়িওয়ালাদের দোতলার সিঁড়ি। গলির শেষটা এসে মিশেছে মতিনের ঘরের সামনের চিলতে উঠানে। তিনদিকে দেয়াল। মতিনের ঘরের সামনে তিন-চার হাত দূরে পুরানো দিনের প্রশস্ত দেয়াল সাত ফুট পর্যন্ত উঠে গেছে। দেয়ালের উপর দিয়ে দূরের বড় বিল্ডিংগুলো দেখা যায়। আর দেখা যায় আকাশের গায়ে এলোমেলো সাজানো টিভির এন্টেনা। মতিনের এ বাসাটা একদম ভাল লাগে না। কিন্তু কী করা, ঢাকা শহরে বাসা পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তাছাড়া যাচ্ছে কোনরকমে, এই ঢের।

রান্না করে দিয়ে যায় বুয়া। প্রায় একমাস হলো সে এখানে এসেছে, এরই মধ্যে সে বুঝে গেছে, আর যাইহোক বুয়াটা রান্না করে চমৎকার। বয়স প্রায় পঞ্চান্ন-ষাট বছর। তিন কুলে কেউ নেই। কয়েকদিন ভিক্ষা করেও দিন চালিয়েছে বলে কথায় কথায় জানিয়েছে।

থাকে কোন এক বস্তিতে। দু’বেলা রান্না করে দিয়ে যায়। একদম ভোরে আর শেষ বেলায়, দুপুরের পরে। একটু পরেই বুয়া আসবে। বয়স বেশি বলে মতিন ওঁকে নানী বলে ডাকে। মতিন খেয়ে-দেয়ে একটা ফটোস্ট্যাট করা নোট উল্টাচ্ছিল। একটু পর বিভূতি আসার কথা। তারপর দু’জনে মিলে বেরুবে। বিভূতির আগেই বুয়া এসে গেল।

কী রান্না করবে? মতিন নোটের উপর চোখ রেখেই বলে।

ডিম, ডাইল।

বেগুন এনেছি, বেগুন ভাজি করো।

আচ্ছা। বুয়ার সংক্ষিপ্ত উত্তর।

মতিন লক্ষ্য করেছে, এই বুয়াটা চুপচাপ কাজ করে যায় সত্য, তবে মাঝেমধ্যে আড়চোখে মতিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। এটাই মতিনের কাছে অস্বস্তি লাগে। বুয়ার সেই চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক মনে হয় না মতিনের। কেমন ঘোর লাগা দৃষ্টি। অবশ্য মাঝেমধ্যে এ রকম হয়। সবসময় নয়। এছাড়া আর কোনো অস্বাভাবিকতা খুঁজে পায়নি মতিন।

বুয়া রান্না করতে লেগে যায়। তেমন কোন আয়োজন তো নয়। শুধু ডিম আর ডাল। তাও সকালের রান্না করা ডাল আছে। শুধু ডিম রান্না করতে হবে। ডিম সিদ্ধ বসিয়ে দিল। তারপর গিয়ে দাঁড়াল বাইরে। এই ঘরটাতে যে ঘুলঘুলির মতো একটুখানি জানালা রয়েছে, তা দিয়েও বাড়িওয়ালাদের ছাদের কোণটা দেখা যায়। মতিন জানালা দিয়ে ছাদের দিকে তাকাল। বাইরে থেকে কেমন একটা বাতাস কাটার শিষের মতো শব্দ শোনা যাচ্ছিল। মতিন অবাক হয়ে দেখল, উপরে বাড়িওয়ালাদের পাগল ছেলেটা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। ব্যাপার কী? এই দিনের বেলা ভয় পেল কী দেখে? মতিন হাতের নোটটা ঝট করে রেখে চকি থেকে নেমে দাঁড়ায় বাইরেটা দেখার জন্য। বাইরে তো এদিকটায় কেউ নেই! বুয়া হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে ঘরের ভেতরে এসে ঢোকে।

বাইরে কেউ ছিল? বুয়াকে জিজ্ঞেস করে মতিন।

নাহ্।

মতিন বাইরে এসে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখল, কোথায় কেউ নেই। বাড়িওয়ালার ছেলেটাও উধাও। সামনের জুতোর কারখানার হাতে টানা কাটার মেশিনের একটানা ঘটর ঘটর শব্দ। মতিন আবার এসে নোটটা চোখের সামনে তুলে ধরে। কিন্তু এবার চোখ রাখে বুয়ার দিকে। বুয়াকে আজ অস্বাভাবিক লাগছে। মতিন কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করে, কি নানী, কি হলো?

বুয়া ঘুরে তাকাল। চোখ জ্বল জ্বল করছে। বলল, কী হইবো? কিছু না।

মতিন তবু হাল ছাড়ে না, কিছু নিশ্চয় হয়েছে—

বুয়া এবার রাগে গলা চড়িয়ে বলে উঠল, এই দ্যাখেন, এই বলে ডান হাতের তর্জনীটা তুলে ধরল, আঙুলটার উপরের কড়াটা কেটে প্রায় নখসহ আঙুলটা ন্যাড়া হয়ে গেছে, টপটপ রক্ত ঝরছে।

মতিন চকি থেকে লাফিয়ে নামল, আহা! কেমন করে হলো?

বুয়া শাসনের গলায় বলল, আপনার ব্যস্ত হওয়ার দরকার দরকার নাই।

মতিন দেখল, বুয়া ঝটপট কাপড় দিয়ে আঙুল ব্যান্ডেজ করে ফেলল। প্রচুর যন্ত্রণা হওয়ার কথা। কিন্তু বুয়ার মুখ দেখে তেমন কিছু মনে হলো না। এমন সময় বিভূতি এল।

বিভূতি ঘরে ঢুকেই বলল, ঘরটা এমন মনে হচ্ছে কেন?

কেন? কেমন? মতিন জানতে চায়।

কেমন বলতে পারছি না। বিভূতির অবাক উত্তর।

বিভূতি আবার বলতে থাকে, কেন জানি না, আমার ভয় ভয়ই লাগে তোর এখানে আসলে। বিশেষ করে তোদের ওই উপরের পাগলটার জন্য—কেমন ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে থাকে!

কিছুক্ষণ পর ওরা বেরিয়ে গেল। এক বন্ধুর বাসায় যাবে ক্লাসের নোটের জন্য।
রাতে ঘটল অদ্ভুত এক ঘটনা। মতিন খাওয়া-দাওয়া শেষ করে পড়বে বলে বই খুলে বসেছে। অমনি দরোজায় টোকা পড়ল। মতিন খানিকটা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করে, কে?

কোনো জবাব শোনা গেল না।

রাত কত হবে? বেশি হলে এগারোটা। জুতোর কারখানাটা বন্ধ হয়েছে অনেকক্ষণ। টুকটাক কথা শোনা যাচ্ছে এখনও। দেয়ালের ওপাশের বাড়িঘরের টিভি থেকে সিনেমার গানের সুর ভেসে আসছে। চারদিকে হৈ চৈ কোলাহল। শুধু এই এক চিলতে উঠানই অসম্ভব নীরব। দরোজায় আবারও টুকটুক। খুব আস্তে কেউ টোকা দিচ্ছে দরোজায়। মতিন কী করবে, ভেবে পেল না। তারপর বুকে সাহস সঞ্চয় করে গলায় খানিকটা জোর দিয়ে বলে উঠল, কে এত রাতে?

আমি।

আমি কে? মতিন এবার রাগত গলায় জিজ্ঞেস করে।

আমি ভাই—বুয়া।

মতিন অবাক হয়ে যায়। এত রাতে বুয়া কেন?

মতিনের চোখে বুয়ার সেই রক্তঝরা কাটা আঙুলটা ভেসে উঠল। মতিন কেমন একটা অশরীরী ভয় অনুভব করে। অবশ্য তেমন কিছু হলে চিৎকার দিলেই বাড়িওয়ালারা শুনতে পাবে। বাড়িওয়ালার বড় ছেলে বলে রেখেছে, কোন অসুবিধা হলে জানাতে। আর তাছাড়া দশ গজ গলি পেরোলেই জমজমাট বড় রাস্তা। হাজার মানুষের কোলাহল। তেমন কিছু দেখলে দরোজা খুলে এক দৌড়ে রাস্তায় গিয়ে উঠলেই হবে।

মতিন বলল, এত রাতে কী?

আমার ছেলে আসবে এখানে।

ছেলে!

জ্বী, একটু দরোজা খোলেন, বসি। আসলে দেখা কইরা চইলা যামু।

মতিন ধাঁধায় পড়ে যায়। সে দরোজা না খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। বলে দেয়, নানী দরোজা খোলা যাবে না।

খোল ভাই।

নাহ্। মতিন দৃঢ়। দরোজা খুলবেই না। ঢাকা শহরে কত কী ঘটে যাচ্ছে।

বুয়ার গলা কেমন হতাশ শোনায়, আচ্ছা বাইরেই বসি।

অনেকক্ষণ কোন সাড়া শব্দ নেই। মতিন অনেকক্ষণ পড়াশোনা করল। রাতও হলো অনেক। হঠাৎ বুয়ার কথা মনে পড়ল। কে জানে, এখনো বাইরে বসে আছে কি না! সে আবার ডাকল, নানী! সাড়া নেই। সে ঘরের লাইট জ্বেলে রেখেই দরোজা খুলল। কেউ কোথাও নেই। চারদিকে তাকিয়ে বাথরুমে গেল সে। আসার সময়ও দেখল কেউ নেই।

চারদিক সুনসান। শুধু শুধু ভয় পাওয়া। ঘরে ঢুকে মতিনের আফসোস হয়, বুড়া মানুষটাকে সে বাইরে বসিয়ে রেখেছিল। কি জানি হয়তো বেচারির ছেলে কোন অপরাধের আসামি। রাতে গোপনে মা’র সঙ্গে দেখা করতে আসে।… ও বাবা, প্রায় একটা বেজে গেছে! মতিন লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। বুয়া বোধহয় চলে গেছে।

তারপর আরেকটা অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে গেল। এমন কোনদিন হয়নি। গত একমাস হলো সে এখানে এসেছে। ক্লাসে গিয়েছে, টিউশনিতে গিয়েছে, ঠিকমতো ঘুমও হয়েছে। কিন্তু আজ, আজকের রাতটা যেন একটু অন্যরকম। কেমন একটা অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে গেল। গলাটাও শুকিয়ে কাঠ। পানি খেতে হবে। মতিন চকি থেকে নামতে যাবে, এ সময় কানে আসে, ফিসফিস কথা বলার শব্দ।

মতিন চকির উপর বসেই কাঠ হয়ে গেল। কথা শোনা যাচ্ছে বাড়িওয়ালাদের ছাদ থেকে। সে ঘুলঘুলির মতো জানালাটা দিয়ে উপরের দিকে উঁকি দিল। যা দেখল তাতে মতিনের জ্ঞান হারাবার জোগাড়। অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল, কাজের বুয়া ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে বাড়িওয়ালাদের সেই পাগল ছেলেটা। চোখ দুটো হায়েনার মতো জ্বলছে। যেন দুটো হলদেটে লাইট বসানো। কিন্তু দুজনে যা বলছে, তা আরো ভয়ঙ্কর। মতিন কান পাততেই স্পষ্ট ভেসে আসে কথাগুলো।

মা, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। গলার স্বর কেমন ফ্যাসফেসে। অনেক দূর থেকে আসা।

কেন, তুই ফাঁসি দিয়ে মরতে গেলি বাপ?

উপায় ছিল না, মা। তুমিও তো বিষ খাইলা?

তুই চলে গেলি—আমি কি নিয়া থাকব? গত পূর্ণিমায় তো আইলি না বাপ?

মা, অনেক কষ্ট করে এখানে আসতে হয়। পাগলের মাথা তো, অনেক সময় অর আত্মায় ভর করতে পারি না।

আমিও বাপ, ঐ কাজে বুড়িটার অবস্থাও ভাল না। কোনদিন হুট করে চলে আসবে আমাদের জগতে। বুড়ির গলায় রক্ত জল করা এক ধরনের শাসানী।

মতিন এক মুহূর্ত ভাবে। সর্বনাশ, এরা তবে কেউ জীবিত নয়! দুজনের মধ্যে দুটো মৃত মানুষের আত্মা ভর করেছে! বুয়াকে তার নিয়তিই এত রাত্রে এখানে টেনে নিয়ে এসেছে। সে বিছানা থেকে খালি গায়ে নেমে সন্তপর্ণে দরোজার ছিটকিনিটা খুলল, এখান থেকে বড় রাস্তায় যাবে। ঘামে ভিজে গেছে সমস্ত শরীর। পা পাথরের মতো ভারী। দরোজা খুলে সাঁই করে খালি গায়ে খালি পায়ে দৌড় দিল গলি পেরিয়ে যাওয়ার জন্য।

মতিন বাড়িওয়ালাদের দোতলার সিঁড়ির ঘরটা পার হওয়ার সময় শুনতে পেল, পাগলটা বলছে, নতুন ছোঁড়া টের পেয়ে গেছে।

হ্যাঁ, বাপ। মেরে ফেলতে হবে ওকে—

মতিন এক দৌড়ে রাস্তায় নেমে আসে। রাস্তার এমাথা ওমাথা একেবারে ফাঁকা। মতিন সোজা পুব দিকে দৌড় দিল। খানিকটা দৌড়ে একটা বারান্দার দেয়ালের সাথে সেঁটে রইল। মাথা একটু ঝুঁকে এক পলক তাকাল।

পাগল আর বুয়া যেন বাতাসে ভর করে রাস্তার ও মাথা থেকে আসছে। পাগলটার চোখ বাতির মতো জ্বলছে। মতিন ঝট করে মাথা ভেতরে নিয়ে এল। সামনে দিয়ে ওরা চলে যাচ্ছে। বুয়া হিংস্র গলায় বলছে, কোথায় যাবে?

রাস্তার বাতির আলোতে দুটো মানুষকে আরো ভৌতিক লাগছে। দুজনে প্রায় নিঃশব্দে, দ্রুত রাস্তার পুব দিকের মাথায় এগিয়ে চলল। ও মাথায় যেতেই মতিন বারান্দা থেকে নেমে রাস্তার পশ্চিম দিকে দৌড় দিল। খানিকটা দৌড়ে পিছন ফিরে তাকাল। দেখতে পেয়েছে পাগল আর বুয়া, বাতাসে ভর করে দ্রুত এগিয়ে আসছে। কোথাও রাস্তার একটা কুকুর কেঁদে উঠল। মতিন রাস্তার মাথায় ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় মারল। মোড়ের কাছে পৌঁছুতেই দুজন লোক জাপটে ধরে ফেলল ওকে। মতিন শুধু বলতে পারল, আমাকে বাঁচান।

লোক দুটো রাতের পাহারাওয়ালা। হাতে বাঁশের লাঠি। একটা লোক জিজ্ঞেস করল,

কী হয়েছে?

ঐ যে রাস্তার পুব দিকে আঙুল তুলে দেখাল মতিন। তারপর পাহারাওয়ালাদের হাতেই নেতিয়ে পড়ল।

পাহারাওয়ালারা তাকিয়ে দেখল, একটা বুড়া মহিলা আর এক যুবক রাস্তার মাঝামাঝি জায়গায় ঢুকে পড়েছে।

তালেব আলি বলল, দেখলি, ওই হারামজাদা।

অনেক দিন তো ছিল না। বলল সঙ্গী মিয়াচাঁন।

আবার আসছে।

তালেব আলি আর মিয়াচাঁন অনেকদিন থেকে এই গলিতে পাহারা দেয়। তারা এই গলির অন্ধিসন্ধি জানে। বারো নম্বর বাড়ির জানালায় অনেক রাত্রে যে আগুন জ্বলতে দেখা যায়, সেটা অনেকের মতো এরাও দেখেছে অনেকবার। সেটা না হয় কারণ ছিল যে, ওই বাড়ির একটা বউ শরীরে আগুন জ্বালিয়ে মরেছে। কিন্তু এরা রাতে কেন বেরোয়? কোনদিন সামনে পড়েনি। পড়লে মজা দেখিয়ে দিত। তালেব আলি আর মিয়াচাঁন মতিনকে রাস্তার একপাশে শুইয়ে দিল। মতিনের জ্ঞান ফিরে এল কিছুক্ষণ পর। সে ওদের ঘটনাটা বলতে চাইল। ওরা বাধা দিয়ে বলল, ঠিক আছে, সব জানি।

তা এখন কোথায় যাবেন? তালেব আলি জিজ্ঞাসা করে।

আমাকে একটু এই মহল্লার ২০/৩ নং বাসায় পৌঁছে দিন।

বাসাটা এখান থেকে দূরে নয়। ওখানে বিভূতিসহ আরও কয়েকজন ছেলে মেস করে থাকে। তালেব আলি আর মিয়াচাঁন মতিনকে বিভূতিদের বাসায় পৌঁছে দেয়। এত রাতে মতিনকে খালি গায়ে দেখে সবাই অবাক। সবাই বুঝে নেয় খুব একটা বিপদ গেছে ওর ওপর দিয়ে। ধরে নেয়, ছিনতাইকারীরা ওর সব কিছু নিয়ে গেছে। বিছানায় শুয়ে শুধু বিভূতির কাছে মতিন সত্যি কথাটা জানায়। বিভূতি সব শুনে বলে, সত্যি নাকি? ঢাকা শহরেও ঘটে এসব। মতিন চুপ করে থাকে।

পরদিন সকালে মতিন বিভূতিকে নিয়ে বনগ্রামের বাসায় যায়। ঘরে তালা। চাবি একটি বুয়ার কাছে, একটি মতিনের কাছে থাকে। মতিন ঘরের তালা খুলল। কোথাও কোন অস্বাভাবিকতা নেই। সকালে এসে বুয়া ডাল ভাত ডিম ভাজি রেঁধে রেখে গেছে!

বিভূতি বলল, চল, অনেক হয়েছে। আমার ওখানে ডাবলিং করে থাকব। দুজনে বিছানাপত্র গোছাতে লেগে যায়। বাড়িওয়ালাকে একমাসের অগ্রিম ভাড়া দিয়ে গেলেই চলবে।

এই ঘটনার দশ বছর পর মতিন আবার বনগ্রামের বাসাটার খবর নিতে আসে। কোথাও পুরানো দালান বাড়িটার চিহ্নমাত্র নেই। সেখানে ঝকঝকে একটা ছ’তলা বিল্ডিং। বারান্দায় মেলা কাপড়চোপড় আর বাহারি ফুলের টব দেখেই বোঝা যায়, এখানে পয়সাওয়ালা লোকেরাই ভাড়া থাকে। বাড়ির দারোয়ান তাকে দেখে চিনে ফেলে, আপনি স্যার! সেই যে রাত্রে রাস্তায় দৌড় দিছিলেন না?

মতিন তাকিয়ে দেখে, তালেব আলি বুড়ো হয়ে গেছে দ্রুত আর সব রাতজাগা মানুষের মতো।

আগের বাড়িওয়ালা কই? মতিন জানতে চায়।

সে স্যার কবে লাপাত্তা। বিক্রিবাট্টা করে কোথায় গেছে, কে জানে।

পাগল ছেলেটা?

সে তো স্যার কবে মইরা গেছে।

কাজের বুয়া?

কাজের বুয়া! কি জানি? জানি না স্যার।

মতিন তালেব মিয়ার হাতে একটা পাঁচশ টাকার নোট দিয়ে বেরিয়ে আসে। তালেব মিয়ার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না। মতিন ভাবে, একদিন এই বুড়ো দারোয়ানটা তার জীবন বাঁচিয়েছিল। মতিন দ্রুত হাঁটা শুরু করে। আজ রাতেই তার নিউইয়র্কের ফিরতি ফ্লাইট।

…………………………………….(সমাপ্ত)………………………………………

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত