চারদিক নিস্বব্ধ কোনো কোলাহল নেই।রাতের আঁধারে আকাশে মেঘেরা খেলা করছে।রোড লাইটের আলোতে শহরের ফাঁকা রাস্তাগুলো দেখা যাচ্ছে।কয়েকটা কুকুর মাঝে মাঝে চিৎকার করে এদিক-সেদিক দৌড়ে যাচ্ছে।মনে হয় কিছু দেখেছে, তাই এমন করছে।একটা বাসা থেকে কুরআন তিলাওয়াতের মধুর ধ্বনি ভেসে আসছে।
.
রাতের আঁধারে ফারাহ রহমান ফজরের নামাজ পড়ে মধুর সুরে কোরআন তিলাওয়াত করছেন।কুরআন তিলাওয়াত শেষ করে, স্বামীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।মনের মাঝে একটা শীতল বাসায় বয়ে যায়।তারপর স্বামীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে মসজিদে পাঠিয়ে দেন।
•
পূর্ব আকাশে সূর্য ওঠে।পৃথিবীটা নতুন রুপে সাজতে শুরু করে।ফারাহ রহমান মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসার জন্য তাড়াহুড়ো করে তৈরি করছেন।তারপর মা-মেয়ে স্কুলে যেতে থাকে।নূরাহ ছোট ছোট পা ফেলে মায়ের সাথে হাটছে আর এটা-সেটা দেখছে।হঠাৎ নূরাহ একটা ছবির পোস্টার দেখে থমকে দাঁড়ায়।সে মন দিয়ে পোস্টারের ছবিটাকে দেখতে থাকে।
.
এটা একটা সিনেমার ছবির পোস্টার।ছবিটাতে কয়েকটা মেয়ে অর্ধনগ্ন পোশাক পড়ে আছে।ছবিটাতে মেয়েরা এমন পোশাক কেন পড়েছে? নূরাহ কারণ খুঁজে পায় না।এই মেয়ে গুলোর সাথে আরও ছেলে, পুরুষ ও মহিলা কেন আছে? সে বুঝতে পারছে না।তার মনের মাঝে একটার পর একটা প্রশ্ন জাগতেই থাকে।
.
ফারাহ রহমান কয়েক পা এগিয়ে যাওয়ার পর দেখেন উনার মেয়ে সাথে নেই।উনি পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখেন নূরাহ এক দৃষ্টিতে পোস্টারের দিকে তাকিয়ে আছে।উনি পোস্টরের ছবিটার দিকে তাকাতেই লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলেন। মেয়ের কাছে এসে বলেন
•
– নূরাহ মামনি তুমি এখানে কি করছ?
– মা! ঐ পোস্টরের ছবি গুলো দেখছিলাম।মা! দেখ ঐ মেয়ে গুলোর কোনো লজ্জা-সরম নেই, তারা কেমন কাপড় পড়েছে।
.
– হ্যাঁ, মা ওদের লজ্জা-সরম নেই।কিন্তু তুমি এগুলো কেন দেখছ? তোমার গুনাহ হচ্ছে না?
.
– মা আমার ভুল হয়ে গেছে।হঠাৎ চোখের সামনে চলে আসে।তাই আমার মনে ছিল না।আমাকে মাফ করে দাও! আমি আর এসবের দিকে তাকাব না।
.
– ঠিক আছে কথাটা মনে রেখো!
– মা! আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবে না?
.
– আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা চায়লে নিশ্চয় ক্ষমা করে দিবেন।এখন তাড়াতাড়ি স্কুলে চল ক্লাসের দেরী হয়ে যাচ্ছে।
.
– ইস আমার তো মনেই ছিল না, আমি যে স্কুলে যাচ্ছিলাম! চল-চল তাড়াতাড়ি চল।
.
তারপর নূরাহ হাটিহাটি পা-পা করে মায়ের সাথে স্কুলে যেতে থাকে।ফারাহ রহমান চিন্তার সাগরে ভাসতে থাকেন।কারণ নূরাহর মনে যদি একবার ঐসব কাপড়ের প্রভাব ফেলে! তখন তিনি কি করবেন? কিভাবে তাকে বুঝাবেন? আরও নানা রকমের চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠছেন।
•
ফারাহ রহমানের সুখের পরিবার।তিনি স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে সুখেই দিন কাটাচ্ছেন।কিন্তু বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার জন্য উনাকে মাঝে মাঝে বিভিন্ন সমস্যায় পরতে হয়।যেমনটা আজকে একবার ভোগতে হয়েছে।প্রতিবার নামাজ শেষে মুনাজাতে দোয়া করেন ধীরে ধীরে যেন সমাজ ব্যবস্থাটা পাল্টে যায়।এবং একটা সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা যেন সৃষ্টি হয়।ফারাহ রহমান অপেক্ষায় আছেন এই দিনটা দেখার জন্য।কিন্তু কোনদিন দেখতে পারবেন কিনা তিনি জানেন না।
.
শেষ বিকেলের আলোতে তাওহীদ রহমান পত্রিকা পড়ছেন।ফারাহ রহমান দুই কাপ চা নিয়ে স্বামীর পাশে বসেন।দুই জন চুপচাপ চা খেয়ে যাচ্ছেন।আর শেষ বিকেলের আলোতে উড়ে যাওয়া পাখি গুলোকে দেখছেন।একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফারাহ রহমান বলেন
.
– জানেন আজকে নূরাহকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সময় কি হয়েছে?
মুচকি হেসে উনি বলেন
– না বললে কিভাবে জানব?
.
তারপর মিসেস রহমান সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলেন।সম্পূর্ণ ঘটনা শোনার পর তাওহীদ রহমান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।উনি কি বলবেন বুঝতে পারছেন না।কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন
.
– দিন দিন আমাদের বিবেক লোপ পাচ্ছে।আমাদের মন মানসিকতা লোপ পাচ্ছে।এবং আমরা যে একটা ইসলামিক দেশে বাস করছি সেটাও ভুলে যাচ্ছি।
.
– ঠিক বলেছেন।আর বর্তমান সময়ের অনেক মেয়ে বা মহিলাদের পোশাক-আশাক এর জন্য যারা পর্দা মেনে চলে।তাদের তো প্রতিটা সময় লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে।মেয়েটাকে নিয়ে আমার খুব ভয় হয়, কিভাবে বড় করব? কিভাবে সুন্দর একটা জীবন দিব?
.
– ভয় তো আমারও হয়।প্রতিদিন অপহরণ, ধর্ষণ আরও কত নানা রকমের খবরা-খবর বের হয়।খবর গুলো শুনে খুব ভয় করে, হৃদয়টা খুব কাঁদে।জানি না, কখন এসব বন্ধ হবে।
.
তারপর দু’জন চুপ হয়ে যায়।কিছুক্ষণ পর আবার তাওহীদ রহমান বলেন
.
– তুমি নাটক বা সিনেমার কথা বললে না? এই সব আমাদের দেশে অনেক আগে থেকেই চলে আসছে।এবং মনে হয় কখনও বন্ধ হবে না।
.
– মানলাম আগে থেকে চলে আসছে, তারা এখন আর বন্ধ করতে পারবে না।তাই বলে এরকম পোশাক-আশাক পড়ে অভিনয় করতে হবে? ভাল পোশাক পড়ে কি অভিনয় করা যায় না?
.
– এই কথাটা তো আমারও।তারা অনেকে মনে করে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পোশাক উন্নত করলেই ব্যবসা সফল হবে! কিন্তু গল্প ভাল না হলে এসব পড়ে অভিনয় করলেই কি ব্যবসা সফল হবে? আর গল্প ভাল হলেই কি এসব পোশাক পড়তে হবে? আমার বোঝে আসে না।
.
– ঠিক বলেছেন।যারা পর্দা মেনে জীবন-যাপন করছে, তাদের কথা একবার ভাবছে? বর্তমান সময়ের ছেলে-মেয়েদের মন মানসিকতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে একবার চিন্তা করছে?
.
আবার দুজন চুপ হয়ে যায়।দূরের আকাশ থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসে।নামাজ আদায় করতে দুজনেই ওঠে পড়ে।বিষন্ন মনে অযু করতে বাথরুমে চলে যায়।
•
কয়েকদিন পর
•
মা-মেয়ে তৈরি হয়ে স্কুলে যেতে থাকে।আজ আবার অন্য একটা পোস্টারের ছবি নূরাহর চোখে পড়ে।মেয়েটাকে তার এতো ভালো লাগে, সে বলে বোঝাতে পারবে না।এক পলকে ওকে দেখতেই থাকে।ফারাহ রহমান কিছুদূর যাওয়ার পর পিছনে ফিরে দেখেন উনার মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন
.
– নূরাহ মামনি তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন?
– মা! দেখ একটা মেয়ে গেঞ্জি ও প্যান্ট পড়ে মোবাইল হাতে নিয়ে কিভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
একটু রাগি সুরে বলেন
– নূরাহ! তুমি আজকেও ওদের দিকে তাকিয়েছ?
অপরাধী সুরে নূরাহ বলে
– মা! আমি ইচ্ছা করে তাকায়নি; আমার চোখে ঐ ছবিটা পড়ে যায়।
.
– উফ! তোমাকে নিয়ে আমি পারিনা, তুমি সব সময় ঐসব চিন্তা নিয়ে থাক তাই না?
কান্না সুরে নূরাহ বলে
– না মা! তুমি আমাকে ভুল বুঝছ।
– ঠিক আছে, এখন চল ক্লাসের দেরী হয়ে যাচ্ছে।
– আচ্ছা মা তারা এমন কাপড় কেন পড়েছে? আর কেনই বা এমন করে পোস্টার লাগিয়েছে?
– এমন কাপড় কেন পড়েছে, আমি কি করে বলব! আমি তো জানি না।আর তারা প্রচারের জন্য লাগিয়েছে।
.
– কিন্তু মা! এসব কাপড় না পড়ে তারা কি ভাল কাপড় পড়ে অভিনয় করতে পারে না?
– হ্যাঁ মা! ভাল কাপড় তো পড়াই যায়।কিন্তু মামনি! আমাদের এসব চিন্তায় তাদের কিছু আসবে না, আবার তাদের কিছু যাবে না।এখন তাড়াতাড়ি স্কুলে চল।
– অভিমানে নূরাহ মায়ের সাথে চুপচাপ হাটতে থাকে।
•
মেয়েকে স্কুলে দিয়ে ফারাহ রহমান উদাস মনে হাটছেন।বার বার মেয়ের কথা গুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।একটা ছোট মেয়ে হয়ে যদি তার মাথায় এই চিন্তা-ভাবনা গুলো আসে! আর যারা এসবের সাথে জরিত তাদের মাথায় কেন এই চিন্তা-ভাবনা গুলো আসে না? আর কেনই বা তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করে না? উনি হাটছেন আর ভাবছেন।এবং একটা নতুন সুন্দর দিনের অপেক্ষা করছেন।কিন্তু এই দিনটা কখনও আসবে কিনা? ফারাহ রহমান জানেন না।
গল্পের বিষয়:
ভৌতিক