সেই রাত সেই সময়

সেই রাত সেই সময়

নিউইর্য়ক থেকে যে প্রধান পথটা (এক নম্বর সড়ক) বেরিয়ে এসেছে, বাণ্টিমোরের বারো মাইল দূরে আর একটা গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সড়কের সঙ্গে তার ক্রসিং হয়েছে। এ ক্রসিংটা খুবই বিপজ্জনক। এখানে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনা এড়াবার জন্য পথচারীদের জন্য মাটির তলা দিয়ে একটা ‘সাবওয়ে’ তৈরি করার কথা অনেক দিন থেকেই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এটা পরিকল্পনার স্তরেই রয়েছে। সরকারী লাল ফিতের বাঁধন কেটে এখনও পরিকল্পনাটার বাস্তবে রূপায়িত হবার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

শনিবারের রাত। ডাক্তার একারমল এক গ্রাম্য ক্লাব থেকে গাড়ি করে ফিরছিলেন। ক্লাবে একটা নাচের আসর ছিল। ডাক্তার নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ক্রসিংটার কাছে এসে গাড়ির গতি কমিয়ে দিলেন ডাক্তার।

একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হলেন ডাক্তার; এত রাতে নির্জন পথে একলা একটি মেয়ে! তার পরনে ইভনিং গাউন। মেয়েটি গাড়ি থামাবার ইশারা করছে। ও নিশ্চয়ই কোন বিপদে পড়েছে! বোধহয় কোন পার্টিতে গিয়ে সময়ের হিসাব রাখতে পারেনি। এখন যানবাহন বন্ধ যাওয়ায় বাড়ি ফিরতে পারছে না।

গাড়ি থামালেন ডাক্তার। বললেন :

—‘আপনি পিছনের সিটে বসুন। সামনে—আমার পাশে—গলফ খেলবার সাজসরঞ্জাম রয়েছে, এখানে আর বসার জায়গা নেই।’

মেয়েটি গাড়িতে উঠল। ডাক্তার গাড়ি ছেড়ে দিলেন।

—‘এত রাতে আপনি এখানে কি করছিলেন? আপনার মতো এক তরুণীর পক্ষে এত রাতে একলা পথে থাকা কি খুব নিরাপদ?’

—‘সে এক বিরাট কাহিনী,’ মেয়েটির কণ্ঠস্বর মিষ্টি কিন্তু তীক্ষ্ণ, অনেকটা স্লেজ গাড়ির ঘণ্টাধ্বনির মতো।

—‘দয়া করে আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিন। সেখানে গিয়ে আমি আপনাকে সব কথা খুলে বলব।’ মেয়েটির গলার স্বরে আকুলতা।

—‘আপনার ঠিকানা?’

—‘ঠিকানা? ঠিকানা হলো… নং নর্থ চার্লস স্ট্রিট। মনে হয় আপনার নিজের পথ থেকে খুব দূরে যেতে হবে না।’

—‘ঠিক আছে। জায়গাটা আমার একেবারে অচেনা নয়।’ ডাক্তার বললেন।

মেয়েটির শঙ্কাতুর মুখে কৃতজ্ঞতার ছাপ ফুটে উঠল।

গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলেন ডাক্তার একারমল। এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে। মেয়েটির বাড়ির ডাক্তারের নিজের বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ওকে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব ঘাড়ে চাপায় বাড়ি
ডাক্তারের আরো মিনিট দশেক বেশি সময় লাগবে। যাক, কি আর করা যাবে। বিপন্ন মেয়েটিকে সাহায্য করা তো একটা নৈতিক ও সামাজিক কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।

নর্থ চার্লস স্ট্রিটে ঢুকে গাড়ির গতি কমিয়ে দিলেন ডাক্তার। এবার দুপাশের বাড়ির নম্বরগুলি দেখতে দেখতে যেতে হবে। বেশি দূর যেতে হলো না। একটু এগোতেই মেয়েটি যে নম্বরের কথা বলেছিল, সেই নম্বরের বাড়িখানা পেয়ে গেলেন ডাক্তার। গাড়ি থামালেন।

—‘এই যে, আমরা এসে গিয়েছি,’ ডাক্তার পিছনের দিকে মুখ ফেরালেন।

কি আশ্চর্য! পিছনের আসন একদম ফাঁকা। কেউ নেই সেখানে।

—‘একি অদ্ভুত ব্যাপার?’ আপনমনেই বললেন ডাক্তার, ‘মেয়েটা নিশ্চয়ই গাড়ি থেকে পড়ে যায়নি।….কর্পূরের মতো উবেও যেতে পারে না।

তবে কি রাস্তায় ঢুকে গাড়ির গতি যখন কমিয়ে দিলাম তখনই ও নেমে গেল? কিন্তু তাই বা নামবে কেন? গাড়ি নিয়ে তো ওর বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলাম।’

গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটির দিকে এগোলেন ডাক্তার। সদর দরোজা বন্ধ। ভিতরে কোন আলোও দেখা যাচ্ছে না। বাড়িখানা নিঝুম…নিস্তব্ধ! পোড়োবাড়ি নাকি। কিন্তু না, তাও তো মনে হচ্ছে না।

হতবুদ্ধি ডাক্তার কলিংবেল টিপলেন। এ রকম অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনে আর কখনও হয়নি। কোন সাড়া নেই। বাড়িতে কোন লোকজন নেই নাকি! আবার বেল টিপলেন ডাক্তার। এ রহস্যের মীমাংসা না করে তিনি যেতে পারছেন না।

শেষ পর্যন্ত দরোজা খুলল। একজন লোক চৌকাঠের ওপাশ থেকে ডাক্তারের দিকে তাকালেন। লোকটি বৃদ্ধ, তার মাথার চুল ধূসর। চোখ চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ।

—‘কাকে চাইছেন?’ ক্লান্ত গলায় বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন।

—‘দেখুন, একটা অদ্ভুত ব্যাপার,’ ডাক্তার বললেন, ‘একটি অল্পবয়সী মেয়ে আমার গাড়িতে উঠেছিল। সে এই বাড়ির ঠিকানাই দিয়েছিল। আমি তাকে নিয়ে এলাম, কিন্তু এখন দেখছি…’

—‘সে আর গাড়িতে নেই, এই তো?’ বৃদ্ধ প্রশ্নের সুরে বললেন।

—‘হ্যাঁ, ঠিক তাই।’

—‘মেয়েটি কোথায় আপনার গাড়িতে উঠেছিল?’

—‘দুটো হাইওয়ে ক্রসিং-এ।’ ডাক্তার উত্তর দিলেন।

—‘জানি,’ ক্লান্ত স্বরে বৃদ্ধ বললেন, ‘এই নিয়ে তিনবার হলো। ও আমারই মেয়ে। তিন বছর আগে ঐ ক্রসিং-এর কাছে এক মোটর দুর্ঘটনায় ও মারা যায়। আজ ওর মৃত্যুর তারিখ। প্রতি মৃত্যুর তারিখেই ও বাড়ি ফিরে আসতে চায়, কিন্তু পারে না। ওর আগের দুটি মৃত্যুদিনেও একই ঘটনা ঘটেছিল।’

বৃদ্ধের গলার স্বর কেঁপে উঠল। চোখের কোণে টলমল করে উঠল অশ্রুবিন্দু।

বিমূঢ় ডাক্তার গাড়ির দিকে পা বাড়ালেন।

………………………………………(সমাপ্ত)……………………………………..

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত