গ ল্পের শুরুতে পাইকডাঙা গ্রামের কথা সামান্য বলে নেওয়া দরকার। ইংরেজ আমলের আগে বাংলায় পাইক বলতে বোঝাত বিশেষ এক পদাতিক বাহিনীর সৈনিক। এক হাতে মস্ত বেতের ঢাল,অন্য হাতে সড়কি নয়ত রামদা নিয়ে খালি পায়ে রে-রে করে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ত শত্রুর উপর। বড়ো-বড়ো রণপা চেপে মাঠ-ঘাট ভেঙে দ্রুত পৌঁছে যেতে পারত রণক্ষেত্রে। অথচ এরা লড়াই করত নিতান্তই খালি পায়ে। তবু জল-কাদায় দেশ বাংলায় এ ব্যাপারে জুড়ি ছিল না তাদের। খাস মোগল বাহিনীও রীতিমতো সমীহ করত। পরবর্তী কালে পাইকদের অনেকে বন্দুক চালাতেও রীতিমতো দক্ষ হয়ে উঠেছিল। বাংলার বারো ভুঁইয়াদের শক্তির প্রধান উৎসই ছিল এই পাইক বাহিনী।
পাইকডাঙা গ্রামের প্রাচীন মানুষ যারা, তাদের কাছে শোনা যায়, একসময় তাদের পূর্বপুরুষ নাকি প্রতাপাদিত্যর পাইক বাহিনীতে কাজ করত। প্রতাপাদিত্যর পতনের পরে তাদের কয়েকজন এসে ঠাঁই নেয় এই পাইকডাঙায়। সেই থেকে গ্রামের ওই নাম। যে মানুষটি তাদের এই গ্রামে নিয়ে এসেছিলেন, সেই হারাই ঢালি ছিলেন প্রতাপাদিত্যের এক পাইক দলের সর্দার। দু”হাতে লম্বা মোটা বাঁশের লাঠি আর সড়কি নিয়ে তিনি নাকি পঞ্চাশ জনের সঙ্গে টক্কর দিতে পারতেন। সড়কি ছুঁড়ে ফুঁড়ে দিতে পারতেন একশো হাত দূরের প্রতিপক্ষকে। স্বয়ং প্রতাপাদিত্যও খাতির করতেন তাঁকে। ক্রমে চাষবাস বা অন্য কাজে ভিড়ে পড়লেও পাইকডাঙার মানুষের তাই খানিকটা প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল। সামান্য চাষি-মজুর মানুষ হলেও কাউকে তেমন পরোয়া করত না। গ্রামের রাবণ সর্দারকে তো খোদ জমিদারবাবুও খাতির করতেন। নদীর নতুন চর দখল বা অন্য ব্যাপারে কাছারিতে হামেশাই তার ডাক পড়ত। এই সময়ই ঘটল ব্যাপারটা। তবে পাইকডাঙায় নয়, পাশে হাজিপুর গ্রামে।
তখন ইংরেজ আমল। হঠাৎ কোম্পানির ফরমান নিয়ে হাজিপুরে এসে জাঁকিয়ে বসল দুই নীলকর সাহেব। বড়ো সাহেব ওয়াটসন, আর তার সহকারী জন। সে সময় দেশ ছেড়ে যে সব ইংরেজ এদেশে আসত,
তাদের বেশির ভাগেরই মূল উদ্দেশ্য ছিল অতি অল্প সময়ে দু”পয়সা কামিয়ে নিয়ে দেশে পাড়ি জমানো। ওয়াটসন এদেশে এসেছিল কোম্পানির ছোটোখাটো এক চাকরি নিয়ে। বছরকয়েক সেই কাজ করার পর তার বোধোদয় হল, কোম্পানির কাজে মাইনে বড়ো কম। তার চাইতে নীল চাষে লাভ অনেক বেশি। অথচ পেটে বিদ্যের তেমন দরকার হয় না। এর মধ্যে এক জুতসই সঙ্গীও জুটে গেল। জন নামে এক ছোকরা। অতি অল্পবয়সে বখে যাওয়া জনের বাড়ি ম্যাঞ্চেস্টারে। এক মার-দাঙ্গায় জড়িয়ে কিছুদিন জেলও খেটেছে। তারপর জেল থেকে খালাস হয়ে পাড়ি জমিয়েছে এদেশে। ছোকরার সঙ্গে ওয়াটসনের আলাপ কলকাতায়। দু”জনে জমে যেতে এরপর আর দেরি হয়নি। করিতকর্মা ওয়াটসন অনেক খোঁজখবর নিয়েই নীলকুঠি খুলেছিল হাজিপুরে। গ্রামে বা আশেপাশে বেশির ভাগই চাষাভুসো শ্রেণির মানুষ। এদেশে কাজ করতে এসে ওয়াটসন বুঝেছিল, এই গরিব মানুষগুলোর উপরেই জুলুম করে সবচেয়ে সহজ।
হাজিপুরে নীলকুঠি খুলেই সাহেব ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিলেন, মহামান্য কোম্পানির হুকুম, বিঘে পিছু ছ”কাঠা জমিতে সবাইকে নীল চাষ করতে হবে। সে নীল কিনে নেবেন সাহেব। চাষের আগে সেই বাবদ মহানুভব সাহেব অগ্রিম কিছু টাকা অর্থাৎ “দাদন” দেবেন চাষিদের।
নীল চাষ এদিকে নতুন। ব্যাপারটা আগে তাই জানা ছিল না হাজিপুরের মানুষের। গোড়ায় তাই সন্দেহ হয়নি। কিন্তু বছর ঘুরতেই বুঝতে আর বাকি রইল না কিছু। নামেই দাদন, তাতে চাষের খরচটুকুও ওঠে না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলাই সার হয়। তার উপর নীল বিক্রির সময় যে দাম ধরা হয় তাতে দাদনের টাকা কেটে হাতে কানাকড়িও জোটে না। প্রতিবাদ করলেই বিশ ঘা শ্যামচাঁদ। অর্থাৎ চাবুকের বাড়ি। নয়তো সাহেবের বুটজুতোর লাথি।
এদেশে গোলামি করার লোকের অভাব নেই। ততদিনে ওয়াটসন সাহেবের নীল কুঠিতে নানা কাজে শামিল হয়ে গেছে বেশ কিছু মানুষ। তাদের কেউ-কেউ তেজে সাহেবেরও উপরে। সাহেব ধরে আনতে বললে তারা বেধে নিয়ে আসে। বিশ ঘা শ্যামচাঁদের হুকুম হলে লাগিয়ে দেয় চল্লিশ ঘা। গ্রাম জুড়ে তাই শুরু হল হাহাকার।
হাজিপুর পাইকডাঙার মতো নয়। অনেক বড়ো আর বর্ধিষ্ণু গ্রাম। খোদ জমিদারও বাস করেন এই গ্রামে। উপায় না দেখে গ্রামের কয়েকজন প্রবীণ ব্যাক্তি কিছু একটা বিহিতের জন্য একদিন এসে হাজির হলেন তাঁর কাছে।
জমিদার হরিহর চৌধুরী দাপুটে জমিদার। তাঁর হুকুমে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়। কিন্তু খাস বিলেতের সাহেবদের কাছে একেবারেই যে কেঁচো,
তা গ্রামের সাধারণ মানুষের জানার কথা নয়। তাই মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে তাঁদের বিদেয় করলেও কার্যক্ষেত্রে কিছুই করলেন না। বরং খবরটা কানে গেল সাহেবরা গোঁসা না হয়, তাই সেই দন্ডেই নায়েবকে ডেকে নীলকুঠির দুই সাহেবকে নেমন্তন্ন করে খানাপিনার আয়োজন করতে বলে দিলেন।
ব্যাপার বুঝতে হাজিপুরের প্রজাদের বেশি সময় লাগেনি। জমিদারের কাছে গিয়ে বিহিত তো কিছু হলই না, বরং বিপদ আরও বাড়ল। দিনকয়েকের মধ্যেই নীলকুঠির দেওয়ান পেয়দা নিয়ে সারা গ্রামে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিয়ে গেল, ছয় নয়,
এবছর থেকে বিঘে প্রতি পুরো দশ কাঠা জমিতে নীল চাষ করতে হবে। সাহেবের হুকুম।
আগেই বলেছি,বর্ধিষ্ণু গ্রাম হাজিপুর। অনেক শিক্ষিত মানুষও বাস করেন। তবু প্রতিকারের কোনোও উপায় কারও মাথায় এল না। মানসম্মান নিয়ে প্রাণে বাঁচতে অনেকেই যখন গ্রাম ছাড়ার কথাও ভাবতে শুরু করেছে, তখনই হঠাৎ এক ঘটনায় বদলে গেল সব।
হাজিপুরে কুঠি বানালেও ওয়াটসন সাহেব শুধু ওই একটা গ্রাম নিয়ে পড়ে থাকতে আসেননি। ওই সময় একদিন তিনি দেওয়ান হরনাথ রায়কে ডেকে পাঠিয়ে পাশে খেলাতপুর আর পাইকডাঙা গ্রামেও দাদন ধরাতে হুকুম করলেন। হরনাথের কায়ক্লেশে দিন চলত। এখন নীলকুঠি দেওয়ান হয়ে দিন পালটে গেছে। সাহেবের ফরমান শুনে খানিক ইতস্তত করে বললেন, “হুজুর ওই পাইকডাঙা গ্রামটা বাদ রাখলে ভাল-”
“হোয়াট!”
দেওয়ান হরনাথ রায়ের মুখের কথা শেষ হবার আগেই সাহেব যেভাবে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, তাতে গলা দিয়ে আর উত্তর
জোগাল না তাঁর। কোনওমতে একটা সেলাম ঠুকে পালিয়ে বাঁচলেন।
নীলকুঠি চালাতে হলে অনেক দিকে নজর রাখতে হয়। ওয়াটসন সাহেবেরও ব্যবস্থায় কোনও খামতি ছিল না। এর দিনকয়েক পরেই যে খবর কানে এল, তাতে কপাল ভাঁজ না পড়ে উপায় ছিল না। কুঠির দেওয়ানকে তক্ষুনি ডেকে পাঠিয়ে বললেন, “ইহা কী শুনিটেছি দেওয়ান!”
পাইকডাঙার চাষিরা কেউ নীলের দাদন নিতে আপত্তি করেনি। খুশি মনেই টাকা গুনে নিয়েছে। কিন্তু ব্যাপার হল,
এখনও কুঠি থেকে বীজ নিতে আসেনি। চাষ শুরু করার কোনও উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। বরং গ্রামের লাঠি খেলার আখড়ায় দেখা যাচ্ছে বড়োদেরও। কসরত হচ্ছে সড়কি আর রামদা নিয়েও। খবরটা হরনাথের কানেও পৌঁছেছে। হাত কচলে বলল, “হুজুর ওই জন্যই পাইকডাঙায় দাদন ধরাতে মানা করেছিলাম। আসলে ওটা ডাকাতের গাঁ।”
“ড্যাকোইট!” ওয়াটসন সাহেব হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, “দেন দে হ্যাভ টু ইমপ্রিজনড।
সবকো জেলে বন্ধ করিয়া দিব।”
“সেটাই ভাল হুজুর।” সাহেবের কথায় হরনাথ সায় দিয়ে বললেন বটে, কিন্তু ভরসা পেলেন না। দু’চারজনকে জেলে পুরে যে পাইকডাঙার মানুষকে দমানো যাবে না, তা তিনি বেশ জানেন। তার উপর খবর, পাইকডাঙার আসল চাঁই রাবণ সর্দার দিন কয়েক ধরে বেপাত্তা। কোনও খোঁজ নেই। পুলিশ ধরবে কাকে?
যথারীতি ওয়াটসন সাহেবের হুমকিতে নড়েচড়ে উঠল সদরের পুলিশ দপ্তর। পাইকডাঙায় ধরপাকড় হল। চালান দেওয়া হল ফাটকে। চাঁই রাবণ সর্দারের খোঁজ অবশ্য পাওয়া গেল না। সব শুনে ওয়াটসন সাহেব তার খোঁজে জমিদারের কাছারিতে নজর রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু নিরাশ হতে হয়েছে। লোকটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তার উপর খবর, ধরপাকড়ের কারণে গোটা পাইকডাঙা ফুঁসছে। তাই তিনি নিজেও সাবধান হয়েছেন। একা বেরোন না কোথাও।
তবু এক সন্ধেয় ব্যাপারটা ঘটে গেল। জরুরি এক কাজে ওয়াটসন সাহেবকে সেদিন সদরে যেতে হবে। বের হতে গিয়ে দেখলেন তাঁর ঘোড়াটা মোটেই সুস্থ নেই। ঝিমোচ্ছে। কুঠিতে জনেরও একটা ঘোড়া আছে। গোড়ায় ওয়াটসন সাহেব ঠিক করেছিলেন জনের ঘোড়া নিয়েই বের হবেন। কিন্তু জন জানাল, কাছের এক কশাড় জঙ্গলে আজ তার শূকর শিকারে যাবার কথা। ব্যবস্থাও হয়ে রয়েছে। তার ঘোড়া আজ না নিলেই ভাল হয়। জনের আপত্তি দেখে ওয়াটসন তাই অন্য ব্যবস্থা করলেন। সদরে এভাবে তিনি আগেও অনেকবার গেছেন। মাইল কয়েক দূরে নদীর ঘাট। সেখান থেকে নৌকো পাওয়া যায়। সাহেব তাই চার বেহারার এক পালকির ব্যবস্থা করে সেই পথ ধরলেন। সঙ্গে চলল লাঠি-সড়কি হাতে জবরদস্ত দু’জন লাঠিয়াল পেয়াদা।
নৌকোয় যাওয়া-আসা । সদরে কাজ সেরে ফিরতে ওয়াটসনের সেদিন সন্ধে পার হয়ে সামান্য রাত হয়ে গিয়েছিল। জনকে বলে রেখেছিলেন, বিকেলে ঘাটে ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করতে। কিন্তু দেখা গেল, সে আসেনি। এদিকে সকালের পালকি পাওয়া গেল না। বায়না পেয়ে সবাই অন্য গ্রামে গেছে। অগত্যা সঙ্গী দুই পেয়াদা নিয়ে ওয়াটসন হাঁটাপথেই রওনা হয়ে পড়লেন। পথ মানে মাঠের আল। তবে জোৎস্না রাত। আকাশে ফুটফুটে চাঁদ। তাই অনেকটাই ভরসা পেলেন তিনি। সামনে পিছনে অস্ত্র হাতে দু’জন পেয়াদা। মাঝে ওয়াটসন সাহেব। অতিরিক্ত সর্তকতা হিসেবে কোমরের পিস্তলটা হাতে নিয়ে নিয়েছেন। দ্রুত পা চালিয়ে সবাই তখন প্রায় নীলকুঠির কাছে এসে পড়েছে। সামনে নদীর এক মরা খাত। বর্ষার সামান্য জল হলেও সারা বছর শুকনো খটখটে। পাশেই প্রাচীন এক শশ্মান। তারপর বড়ো একটা ফাঁকা মাঠ। লোকের মুখে সে মাঠের নাম এখন কুঠিবাড়ির মাঠ। সেই মাঠের শেষে নীলকুঠি।
ওয়াটসন সাহেব দুই লাঠিয়াল পেয়াদা নিয়ে সবে সেই মরা নদীর খাত পার হয়ে শশ্মানে পা দিয়েছেন, হঠাৎ কাছেই তারস্বরে গোটাকয়েক ফেউ
ডেকে উঠল। শেয়ালের ডাক গ্রামের মানুষের কাছে অজানা নয়। তবু আচমকা সেই শব্দে সাহেবের দুই পেয়াদা মুহুর্তের জন্য হলেও সামান্য কেঁপে উঠেছিল। জায়গাটার বিশেষ সুনাম নেই। ভূত-প্রেতের আস্তানা। অজান্তেই মুখে রাম নাম বের হয়ে এল দুই পালোয়ানের। তারপর সামলে উঠে সড়কি বাগিয়ে হেঁকে উঠতে যাবে, তার আগেই অন্ধকারে মাথায় প্রচন্ড আঘাতে দু’জনেই লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। তারপর কিছুই আর মনে নেই তাদের।
দিনভর শিকার শেষে খানাপিনার পর জন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বেহুঁশ হয়ে। সেই ঘুম ভাঙতে যখন বড়ো সাহেব ওয়াটসনের কথা মনে পড়ল, তখন সন্ধে পার হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বের হতে যাবেন,
পিছনে মাঠের দিক থেকে হঠাৎ গুলির শব্দ ভেসে এল। ওয়াটসন সাহেবের পিস্তলের আওয়াজ চিনতে ভুল হল না তাঁর। লোকজন নিয়ে তক্ষুনি তিনি ছুটলেন মাঠের দিকে। হাতে গোটা কয়েক মশাল নিয়ে সবাই যখন শশ্মানের কাছে এসে পৌঁছোল, ওয়াটসন সাহেবের সঙ্গী দুই পেয়াদার তখনও জ্ঞান ফেরেনি। হাতের সড়কি হাতেই ধরা। মুখ থুবড়ে মড়ার মতো পড়ে আছে। অদূরে ওয়াটসন সাহেবের কাটা মুন্ডু। রক্তে থিক্থিক্ করছে
চারপাশ।
নীলকুঠির সাহেব খুন! হইচই হয়েছিল কম নয়। থানার দারোগা, সদর থেকে বড়োসাহেব, ছুটে এলেন সবাই। ওয়াটসন সাহেবের রক্ষী দুই পেয়াদাকে ধরে চালান দেওয়া হল সদরে। ধরপাকড় হল। কিন্তু কোনও কিনারা হল না। ওয়াটসন সাহেবের ধড়েরও কোনও হদিশ মিলল না।
তবে নীলকুঠি চলল আগের মতোই। ওয়াটসনের হঠাৎ এই মৃত্যুতে, বলতে নেই,
বরং কিছু সুবিধাই হল জনের। আগে মাথার উপর ওয়াটসন ছিল। এখন নিজেই সর্বেসর্বা। তবে সাবধান হলেন এবার। ঘোড়া ছাড়া আর বের হন না। বেরোলেও ফিরে আসেন সন্ধের আগেই। তার আরও একটা কারণ, ইতিমধ্যে চাউর হয়ে গেছে ওয়াটসন সাহেবের ভূত নাকি সন্ধের পরে মাঝে মধ্যেই ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ায় কুঠিবাড়ির মাঠে। গায়েব হয়ে যাওয়া ধড়ের কোন হদিশ মেলেনি। সৎকারও হয়নি। সাহেব তাই নাকি ভূত হয়ে ঘুরে বেড়ান।
গোড়ার দিকে গুজবে মোটেই গা করননি জন। কিন্তু তারপর আর ফেলতে পারলেন না। গ্রামের অনেকে তো বটেই,এমনকী নীলকুঠির জনা কয়েক কর্মচারীরও নজরে পড়ল ব্যাপারটা। গভীর রাতে কখনও ঘোড়ায় চড়ে এক সাহেব বেগে ছুটে যাচ্ছে কুঠিবাড়ির মাঠ দিয়ে। ভয়ে কয়েকজন তো কাজ ছেড়েই পালাল। স্বভাবে বেপরোয়া হলেও জনের আবার ভূতের ভয় খুব। তার উপর সেদিন তারই গাফিলতির কারণে আপঘাতে মরতে হয়েছে ওয়াটসনকে। সময়মতো ঘুম ভাঙলে ঘোড়া নিয়ে ঠিক সময় হাজির হওয়া যেত নদীর ঘাটে। এভাবে মরতে হত না তাঁকে। রাতে জন তাই কুঠির বাইরে বের হওয়াই ছেড়ে দিলেন।
তবু একদিন সামান্য ব্যাতিক্রম হয়ে গেল। দাদন ধরাতে জন সেদিন পেয়াদা নিয়ে পাশের এক গ্রামে গিয়েছিলেন। কাজ শেষ হতে খেয়াল হল ইতিমধ্যে বিকেল পার হয়ে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। দেখে আর দেরি না করে ঘোড়া হাঁকিয়ে রওনা হয়ে পড়লেন সেই দন্ডেই। সঙ্গের লোকজন পিছনে পড়ে রইল। শ্মশান পার হয়ে যখন নীলকুঠির মাঠে এসে পড়লেন, সন্ধের অন্ধকার তখন ঘন হয়ে উঠেছে। অজান্তেই বুকটা ঢিপঢিপ করে উঠল জনের। কোনও দিকে দৃক্পাত না করে আরও দ্রুত ঘোড়া ছোটালেন। ইচ্ছে এক দমে পৌঁছে যাবেন নীল কুঠির চৌহুদ্দির ভিতর। কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল এক ভয়ানক ব্যাপার। বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে জন তখন মাঠের প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন। মাঠের মাঝে এক জায়গায় কিছু বুনো গাছের জটলা। হঠাৎ সেই গাছের আড়াল থেকে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ তুলে হুড়মুড়িয়ে বের হয়ে এল এক ঘোড়সওয়ার মূর্তি। একেবারে জনের ঘোড়ার সামনে। সংঘর্ষ এড়াবার জন্য লাগাম টানল জন। নিমেষে হাত চলে গেল কোমরে পিস্তলের দিকে। ততক্ষণে উলটো দিকের সেই ঘোড়সওয়ার মূর্তির সামনে একেবারে মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে সারা শরীর হিম হয়ে গেল জনের। সামনে ঘোড়ার পিঠে আর কেউ নয়,খোদ ওয়াটসন। সেই মাথা ভরতি ঝাঁকড়া লম্বা চুল। মোটা এক জোড়া গোঁফ। সেই পোশাক। কটমট করে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। দু’চোখে যেন আগুন ছুটছে। জনের হাতের পিস্তল হাতেই ধরা রইল। দারুণ আতঙ্কে তাঁর সারা শরীর তখন হিম হয়ে গেছে। স্থির হয়ে গেছে চোখের পলক। কিন্তু সে কয়েক সেকেন্ড মাত্র। তারপরেই দারুণ আতঙ্কে কাঠ হয়ে জন ঘোড়া থেকে ঘুরে পড়ে গেলেন মাটিতে।
জনের ঘোড়া অল্প পরেই একা ফিরে এল কুঠির আস্তাবলে। পিঠে সাহেব নেই। তাই দেখে কুঠির সবাই বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে ছুটল তাঁর খোঁজে। ছোটো সাহেবের হদিশ পেতে তাদের দেরি হয়নি। আগাছার সেই জঙ্গলের পাশে চিৎপাত হয়ে পড়ে আছেন তিনি। জ্ঞান না ফিরলেও শ্বাস বইছে। ধরাধরি করে সাহেবকে এরপর নিয়ে আসা হল কুঠিতে। খানিক বাদে তাঁর জ্ঞান ফিরল বটে, কিন্তু রীতিমতো ভুল বকতে শুরু করলেন। রাতটা অপেক্ষা করে পরদিনই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল সদরে। সেখানে তাঁর সুস্থ হয়ে উঠতে লেগে গিয়েছিল প্রায় দিন সাতেক। আর তারপরেই সোজা পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। আর কোনও দিন নীলকুঠিতে ফেরেননি।
শোনা যায়, এরপর হাজিপুরের নীলকুঠি বেচে দেবার বিস্তর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু খদ্দের মেলেনি। সুতরাং হাজিপুরের নীলকুঠি উঠেই গেল তারপর। কিন্তু ওয়াটসন সাহেবের ভূতের গল্পটা রয়ে গেল। সাহেবের স্বভাব নাকি মরার পরেও যায়নি। এখনও তিনি পোড়ো ভাঙা নীলকুঠির কয়েদখানায় দিনদুপুরে শ্যামচাঁদ হাতে হম্বিতম্বি করেন। আর রাত হলেই ঘোড়ায় চেপে টহল দিয়ে বেড়ান কুঠিবাড়ির মাঠে।
………………………………………………… (সমাপ্ত) ……………………………………………