মাঝরাতের ফাঁকাছাদ

মাঝরাতের ফাঁকাছাদ

আজ যেন বাড়িতে তোর মুখ না দেখি হতচ্ছাড়া ছেলে। নাহলে তোর-ই একদিন কি আমার-ই একদিন।

সুজয় – হ্যাঁ যাও যাও আমিও থাকতে চাইনা।

সুজয়ের মা – মুখেমুখে তর্ক। বটি-টা কোথায়। আজ তোকে শেষ করে ফেলবো। সুজয় এবার দৌঁড় দেয়। গল্প শুরু এখান দিয়েই। সুজয় বাড়ি থেকে দৌঁড় দিয়ে সোজা বনের দিকে চলে যায়। মাধ্যমিক পাশের পর সুজয়ের মা সুজয়-কে ফোন কিনে দিয়েছে। প্রথম প্রথম ফোন পেয়ে সুজয় খুব খুশি ছিলো। কিন্তু সমস্যা-টা শুরু হলো একাদশ শ্রেণীর টিউশন ব্যাচ থেকে ওখানে বেশ কিছু মেয়ের সাথে সুজয়ের আলাপ হয়। সমস্যা-টা শুরু হয় সেখান দিয়েই। যে টিউশন ব্যাচে সুজয় পড়তে যেত ওখানে পড়াতো খুব কম এজন্য বেশীরভাগ দিন পড়া বন্ধ থাকতো। আবার হঠাৎ হঠাৎ পড়তে ডাকতো। তো যেদিন সুজয় পড়তে যেতোনা সেদিন সুজয় ওই মেয়েদের থেকে ফোনে পড়া জেনে নিতো।

পাড়ার বেশ কিছু লোক এই ব্যাপার তাকে বাড়িয়ে গুছিয়ে সুজয়ের মায়ের কানে তোলে। ব্যস তারপর থেকেই ঝামেলার শুরু।
সুজয় বারবার মা-কে এটাই বুঝিয়ে পারেনা যে প্রেমিকা আলাদা জিনিস, বান্ধবী আলাদস জিনিস। যাইহোক সুজয়। ভাবলো আজ আর বাড়ি-ই যাবোনা। তাই অচেনা পথে পায়ের পর পা ফেলে দৌঁড়ে চললো। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। কিন্তু সুজয় জেদ ধরে বসে আছে যে আজ সে বাড়ি ফিরবেনা। কিন্তু অজানা পথ, দু-ধারে বাঁশবন দেখে সুজয়ের আর সাহস হলোনা সামনের দিকে এগোনোর। সুজয় এবার বাড়ির দিকে এগোনো শুরু করে। মনের মধ্যে তখনো রাগ ভরতি ছিলো সুজয়ের। কিন্তু মনের ভয়ের কাছে সেই রাগ অনেক ছোটো হয়ে গেলো। সুজয় রাত ৮.০০ টার মধ্যে বাড়ির এলাকার মধ্যে চলে আসে কিন্তু সে বাড়ি ঢুকতে ভয় পায়। শীতের রাত বড়ো জ্বালা। ধীরেধীরে সময়ের কাঁটা এগোতে থাকে। আশেপাশের মাঠ দিয়ে শেয়ালের ডাক..দূরে ওই দূরে কোথায় যেন কুকুর কাঁদছে..একসময় সুজয় বাড়ির সামনে গিয়ে ” মা ” বলে বেশ কয়েক-টা ডাক দেয়। তারপর আর ডাকার সাহস হলোনা সুজয়ের। এরপর সুজয় ঘরে যাবার অন্য মাধ্যম আবিষ্কার করে ফেলে। সুজয় পাঁচিল টপকে বাড়ির ভেতরে ঢুকে সোজা বাড়ির পেছনে চলে যায়। সামনেই বাথরুম। ওই বাথরুমের ভাঙা দেওয়াল বেয়ে পেয়ারা গাছে ঝাঁপ দিয়ে উঠে পড়লো। তারপর ওই গাছ বেয়ে ছাদে চলে গেলো। এইবার আর সুজয়-কে পাইকে। সুজয় জানে সকালে বাবা আসবে। তারপর বাবা-কে বুঝিয়ে মায়ের মাথা ঠাণ্ডা করে দেবে। কিন্তু সুজয় ছাদে পৌঁছে চমকে যায়। সুজয়ের পাশের বাড়িটা ঠিক সুজয়ের বাড়ির থেকে চারহাত দূরে। সুজয় দেখে যে ওই ছাদে ঈশান-দা বসে আছে। হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট। আর তারপাশে একগোছা দড়ি ও একটা গিটার। তারপর

সুজয় – আরে ঈশান-দা তুমি? এতো রাতে কি করছো ঘুমায় গিয়ে নাহলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে তো?

ঈশান – আর শরীর। জীবন বড়ো অদ্ভুত-রে সুজয়….বড়ো অদ্ভুত।

সুজয় – কি হয়েছে তোমার ঈশান-দা।

ঈশান – ( ঈশান-দা গিটার-টা হাতে নিয়ে )

” আঁধো রাত, নিশির ডাক। ঈশান আজ নরকে যাক ”

তারপর-ই গিটার-টা বাজানো শুরু করলো।

আঁধো আঁধো রাত, নিশির ডাক…. ঈশান আজ নরকে যাক…. তোর ওই বোবার ডাকে ঘুম ভাঙে আমার, একটা প্রেম সম্পর্ক জোরে, একটা মেয়ে স্বপ্নে ঘোরে।

আঁধো আঁধো রাত,
নিশির ডাক..ঈশান আজ নরকে যাক…..
ভাঙবো আজ আমি আমার নিজের হাতের স্বপ্ন গুলো…..তোর আর আমার সুখের মুহুর্ত গুলো ওগুলো কি নাটক ছিলো….আমার মধ্যে কি কমতি ছিলো একোটু খুলে বলতো।

” চেয়ে দেখবি তুই আমাকে আমি পৌঁছে গেছি নরকের দেশে….
তখন তুই থাকতে পারবিনা আমকে ভালো না বেসে ”

আঁধো আঁধো রাত,
নিশির ডাক।

গিটার-টা বাজানো বন্ধ করলো ঈশান-দা। প্রচণ্ড কাশছে ঈশান-দা। সুজয় দৌঁড়ে ঘরে চলে গেলো জল আনার জন্য। তখন আর সুজয়ের মনে কোনো ভয় কাজ করছেনা। সুজয় রান্নাঘর থেকে একগেলাস জল এসে ছাদে এসে চিৎকার করে উঠলো সুজয়। সুজয়ের ওই চিৎকার শুনে সারা পাড়া জেগে উঠলো আর বাদ পড়লোনা সুজয়ের মায়ের-ও।

ঈশান যে কিনা এতক্ষণ গান গেয়ে সুজয়-কে মুগ্ধ করলো সে কিনা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে আর পাশে রাখা আছে জ্বলন্ত সিগারেট ও সেই গিটার-টা। ভাবুন তো নিজের চোখে কারুর মৃত্যু দেখে কিভাবে ঠিক থাকা যায়। সুজয় ও নিজেকে সামলাত্র পারিনি। সুজয় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো।

পরেরদিন দুপুরে সুজয়ের জ্ঞান ফেরে। সেইদিন সুজয়ের মন একটুও ভালো ছিলোনা। ওইদিন থেকেই সুজয়ের মনে একটা পরিবর্তন আসে। সুজয় খাওয়া দাওয়া ধীরেধীরে কমিয়ে দেয়। যে ছেলে মোবাইলে সারাদিন কথা বলতো মোবাইল টেপা বন্ধ করে দেয়। সুজয় একটা বিরাট বড়ো আঘাত পেয়েছিলো। এক সপ্তাহের মধ্যে সুজয় অনেক-টাই পরিবর্তন হয়ে যায়। কেউ এই সুজয়-কে আগের সুজয়ের সাথে মেলাতে পারেনা। তো ঈশানের মৃত্যুর একমাস পর সুজয়ের সাথে ভৌতিক কাণ্ড কার্যকালাপ ঘটতে থাকে। মাঝরাতে ছাদের উপর কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে, আবার কোনো কোনোদিন গিটার বাজানোর শব্দ রোজ রাতের পরিচিত হয়ে যায়। প্রথম প্রথম সুজয় একটু ভয় পেতো..কিন্তু এখন আর সে ভয় পায়না। একদিন গভীর রাতে যখন বাড়ির সবাই গভীর নিদ্রায় জর্জরিত সেইসময় সুজয় সাহস করে ছাদে যায় কিন্তু কাউকে সে দেখতে পায়না। পরপর তিন-দিন গভীর রাতে সুজয় ছাদে যায়। চতুর্থ দিনের দিন সুজয় ছাদের রহস্য সমাধান করে ফেলে। সুজয় দেখলো সমস্যা-টা তাদের বাড়ির ছাদেনা। ঈশান-দার বাড়ির ছাদে। ঈশান-দা কালো জামা, কালো পেন্ট পরে বসে আছে….হাতে একটা চিঠি।

সুজয় যেকিনা এককালে এতো ভীতু ছিলো সে আজ কোনো ভয় পেলোনা ঈশান-কে দেখে।

সুজয় – কেন করলে এইরকম ঈশান-দা।

ঈশান চুপ করে রয়েছে।

সুজয় – বলো কেন নিজের প্রাণ দিয়ে দিলে….তোমার বাবা-মায়ের কি খারাপ অবস্থা তুমি জানো?

ঈশান – ভালোবাসা বুঝিস?

সুজয় – তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও আগে।

ঈশান – একটা চাকরীর জন্য ও আমাকে ছেড়ে চলে গেলো…..আমি তাতে বিন্দুমাত্র দুঃখ প্রকাশ করিনি। কিন্তু জানিস ওর বিয়ে হয়ে যাবার পর কলেজে ও ফাইনাল পরীক্ষার আগে শেষবারের জন্য ওর বর-কে নিয়ে এসেছিলো। আবার সেই পরীক্ষায় দেখা হবে। এইজন্য ওর সব বান্ধবী-রা ছবি তুলছিলো ওকে দেখে খুশি হয়ে ওর সামনে গেলাম কিন্তু ও আমাকে না চেনার ভান করলো। সব ঠিক ছিলো শেষে যখন আমি ওকে বললাম – নিজের বন্ধুকে এইভাবে ভুলে গেছিস? এই পরিচয় দিলি বন্ধুত্বের।

তখন ওর স্বামী আমাকে প্রচুর মারধর করে কিন্তু ও সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও প্রতিবাদ করলোনা। এবার বল আমার বেঁচে থেকে কি লাভ। এতদিন যে আমি ওর সাথে ছিলাম ও কিভাবে সব কিছু ভুলে যেতে পারলো। এইবলে ঈশান – দা উঠে দাঁড়ালো।

কেউ কারুর নয়রে এই দুনিয়া-তে নিজের মা-বাবা ছাড়া সবাই স্বার্থপর। যেটা আমি মৃত্যুর পর উপলব্ধি করলাম। ভোর হতে চললো আমি আশি কেমন? তুই ভালো থাকিস।

এইবলে ঈশান-দা হাওয়ার উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে কুয়াশা ভরা ভোররাতে মিলিয়ে গেলো। ওইদিনকার পর আর সুজয় রাতে ছাদের উপর থেকে আর কারুর পায়ের শব্দ শোনেনি। শুনতে পারেনি সেই গিটারের গান।

একটা ছেলে যেকিনা একটা মেয়েকে অন্ধের মতন ভালোবাসে, সেই মেয়েটা কিভাবে ছেলেটার ভালোবাসা ভুলে যেতে পারে।

…………………………………………………..  (সমাপ্ত)  …………………………………………………..

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত