চৌধুরী সাহেব খুব মজা করে গল্প করতে পারেন। প্রথমে হাড়কেপ্পন একজন মানুষ নিয়ে একটা গল্প বললেন। শুনে সবাই এত জোরে হাসা শুরু করে দিল যে পাশের ঘর থেকে সবাই ছুটে এলো ব্যাপার কী দেখার জন্যে। গল্পটি ভালো, চৌধুরী সাহেবের বলার ভঙ্গিটি আরও ভালো। উৎসাহ পেয়ে চৌধুরী সাহেব আরেকটা গল্প বললেন-এটা পাগলের গল্প। এ গল্পটা আরও হিট হয়ে গেল। বাড়াবাড়ি করার অভ্যাস, এরকম একজন হাসতে হাসতে পেটে হাত দিয়ে একেবারে মাটিতে শুয়ে পড়ল। চৌধুরী সাহেব সাবধানী লোক, হাসির গল্প বলার ব্যাপারেও ঝুঁকি নেন না। এরপর থেকে বাকি সময়টা পাগলের গল্পের মাঝেই থেকে গেলেন।
গল্পগুলি ভারি মজার, কিন্তু এত মজার গল্প শুনেও একজনকে দেখলাম মুখ ভারি করে বসে রইলেন। শুধু যে বসে রইলেন তা-ই নয়, শেষের দিকে একটু বিরক্ত ভঙ্গিতে উঠে গেলেন। রসিকতাবোধ নেই, এরকম মানুষ নিয়ে ভারি মুশকিল!
আমরা এসেছি এক বিত্তবান বন্ধুর বিবাহবার্ষিকীতে, সেখানে নানারকম আয়োজন। খাবার শেষে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছি, তখন সেই গোমড়ামুখের মানুষটার সাথে আবার দেখা হলো। এক কোনায় বসে একটা কাগজ পড়ছেন, তখনও গোমড়ামুখে। ভালো খাওয়া হলে আমার মেজাজও ভালো থাকে, লোকজনের সাথে তখন বেশ গায়ে পড়ে আলাপ জমিয়ে দিই। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ভদ্রলোকের পাশে বসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, আমার নাম জাফর ইকবাল-
লোকটা বেশ অনিচ্ছার সাথে হাত বের করে আমার সাথে মিলিয়ে বললেন, বেশ, বেশ।
সাধারণত এরকম সময়ে নিজের নাম বলে পরিচয় করার কথা। বোঝাই যাচ্ছে গোমড়ামুখের মানুষটা এই সাধারণ ভদ্রতাটুকুও দেখাতে রাজি নন। মেজাজটা একটু খারাপ হলো এবং আমি মনে মনে তাঁর সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে ফেললাম। দরাজ হাসির ভঙ্গি করে বললাম, চৌধুরী সাহেব বেশ জোক বলছিলেন, কী বলেন?
হুঁ।
আপনি দেখলাম মাঝখানে উঠে গেলেন, জোক-ফোক ভালো লাগে না বুঝি?
লাগে। একশব্দে উত্তর দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হলেন না, আমার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে আবার তাঁর কাগজে মন দিলেন। মহা অভদ্র মানুষ!
জোকগুলি আগে শুনেছেন মনে হলো, একেবারে দেখি হাসলেন না─
ভদ্রলোক এবারে আস্তে আস্তে কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে চশমা খুলে আমার দিকে তাকালেন। খানিকক্ষণ আমাকে খুব ভালো করে লক্ষ করে বললেন, আপনারা যাদেরকে পাগল বলেন, সেটা তাদের একধরনের অসুস্থতার লক্ষণ। মানসিক অসুস্থতা। মানুষের অসুস্থ অবস্থা নিয়ে হাসি-তামাশা হয় না।
মহা সিরিয়াস মানুষ মনে হচ্ছে। আমি চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বললাম, সবকিছু এত সিরিয়াসলি নিলে তো মুশকিল। একটা হালকা জোক─
ধনুষ্টংকার হয়ে যখন মানুষ মারা যায়, মৃত্যুর আগে তার সারা শরীর যন্ত্রণায় ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে যায়, সেটা নিয়ে একটা সিক জোক আছে, শুনতে চান?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, না, মানে, ইয়ে─
আপনার পরিবার-পরিজনের কারও যদি মানসিক অসুস্থতা থাকে─ আমি দুঃখিত, পাগল শব্দটা আমি ব্যবহার করতে পারি না, তাহলে আপনি ওই জোকগুলো শুনে হাসতে পারতেন না।
ভদ্রলোক এবারে আবার আমার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে চশমাটি পরলেন, তারপর পকেট থেকে আস্তে আস্তে কাগজটা বের করে আবার পড়া শুরু করলেন। ইঙ্গিতটি অত্যন্ত স্পষ্ট তুমি এখন বিদায় হও।
আমার একটা ভালো গুণ আছে, সম্ভবত এই গুণটার জন্যেই আমি এই সংসারে টিকে যাব। গুণটা হচ্ছে, সত্যি কথা স্বীকার করে নেওয়া। নিজের গোঁ বজায় রাখার জন্যে আমি খামোখা তর্ক করে যাই না। সময়বিশেষে সেজন্যে আমি দশজনের সামনে গাধা প্রমাণিত হই, কিন্তু তবুও আমি সবসময়ই খাঁটি কথা মেনে নিই। খানিকক্ষণ চুপ করে ব্যাপারটা একটু ভেবে এবারেও আমি তা-ই করলাম। বললাম, আপনি সত্যি কথা বলেছেন। আমি কখনোই ব্যাপারটা এভাবে দেখি নি। অত্যন্ত স্পষ্ট ব্যাপার, কিন্তু ব্যাপারটা এভাবে দেখি নি। অত্যন্ত স্পষ্ট ব্যাপার, কিন্তু ব্যাপারটা কেন জানি আমার চোখে পড়ে নি। খুব লজ্জা লাগছে ব্যাপারটা চিন্তা করে।
আমার কথা শুনে ভদ্রলোক একেবারে হকচকিয়ে গেলেন। তিনি মোটেও আমার কাছে এরকম একটা উত্তর আশা করেন নি─ ভেবেছিলাম ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে একটা বাজে তর্ক শুরু করে দেব। সহৃদয়ভাবে হেসে বললেন, আপনার লজ্জার কিছু নেই। এটাই স্বাভাবিক।
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, কৌতূহলটা ক্ষমা করে দেবেন প্লিজ, আপনার পরিবার-পরিজনের মধ্যে কেউ কি আছে, যে মানসিকভাবে অসুস্থ?
না, আমার পরিবারে কেউ নেই। আমি একজন ডাক্তার, মানসিক রোগের ডাক্তার। আমি অসংখ্য মানুষকে চিনি যারা মানসিকভাবে অসুস্থ। ভদ্রলোক এবারে তাঁর হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে বললেন, আমার নাম মইনুল হাসান।
সেই থেকে মইনুল হাসানের সাথে আমার পরিচয়। আমি পরিচয়টা চেষ্টা-চরিত্র করে ঘনিষ্ঠতার পর্যায়ে নিয়ে গেছি। নিজের কোনো প্রয়োজন নেই, কিন্তু সব মানুষের একটা অসুস্থ কৌতূহল থাকে, আমারও আছে। মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার মস্তিষ্ক, যে-সমস্ত দুর্ভাগা মানুষের সেটা থেকেও তার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নেই, তাদের নিয়ে আমার কৌতূহল, তারা কী করে, কেন করে, জানার আগ্রহ। অবসর সময়ে তাঁর কাছে তাদের নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি। কোনো কোনোটা বেশ মজার, কিন্তু বেশিরভাগই কষ্টের গল্প। একটা গল্প ছিল অস্বাভাবিক গল্প, মইনুল হাসান প্রথমে সেটা বলতেই চান নি। অনেক খোশামুদি করে শুনতে হয়েছে। গল্পটা এরকম, তাঁর ভাষাতেই বলা যাক।
আমাদের দেশে মানসিক রোগের চিকিৎসা হয় শুধু বড়লোকদের। গরিব লোকজন এখনও মানসিক অসুস্থতাকে তাবিজ-কবজ, পীর-ফকির দিয়ে চিকিৎসা করিয়ে থাকে। তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসাই করতে পারে না, মানসিক রোগের চিকিৎসা করবে কীভাবে? সে কারণে আমার সমস্ত রোগীই বড়লোক। কাজেই যেদিন জামাল চৌধুরী নামে নামে একজন খুব অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী আমার ক্লিনিকে এলেন, আমি খুব অবাক হলাম না। ভদ্রলোক ঠিক কীভাবে শুরু করবেন বুঝতে পারছিলেন না। এটি নতু্ন কিছু নয়, পৃথিবীর কোথাও মানসিক ব্যাধিকে সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে বিচার করা হয় না।
খানিকক্ষণ এটা-সেটা নিয়ে আলাপ করে ভদ্রলোক বললেন, আমি আপনার কাছে একটা সমস্যা নিয়ে এসেছি।
বলুন।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে, সে ব্যাপারটা আসলে একটা সমস্যা কি না সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না।
তবুও বলুন।
ব্যাপারটা আমার স্ত্রীকে নিয়ে।
আমি চুপ করে থেকে ভদ্রলোককে কথা বলতে দিলাম। ভদ্রলোক একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, আমাদের একটা মেয়ে তিন মাস আগে সুইসাইড করেছে।
আমি একটা ধাক্কা খেলাম। কতইবা বয়স ভদ্রলোকের, তাঁর মেয়ে আর কত বড় হবে? এই বয়সে সুইসাইড।
মেয়েটা বড় অভিমানী ছিল সত্যি, কিন্তু একেবারে সুইসাইড করে ফেলবে সেটা আমি কখনো ভাবি নি।
কেন করেছিল জানেন?
খুব তুচ্ছ একটা বিষয়ে। মায়ের সাথে খাবার নিয়ে মন কষাকষি। এই বয়সে যা হয়। কিন্তু নীরা─ আমার মেয়ের নাম নীরা, একেবারে সুইসাইড করে ফেলল।
আমি খুব দুঃখিত জামাল সাহেব। কীভাবে সুইসাইড করেছিল?
ভদ্রলোক একটু যেন শিউরে উঠলেন। বললেন, শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। আমি বাইরে ছিলাম, খবর পেয়ে কোনোরকমে প্লেনের টিকেট জোগাড় করে পাগলের মতো ছুটে এসেছি। সারা রাস্তা মনে মনে বলেছি, হে খোদা, মেয়েটাকে মেয়েটাকে বাঁচিয়ে দাও। হাসপাতালে গিয়ে যখন তাকে দেখলাম-এর আগে আমি কখনো পুড়ে-যাওয়া মানুষ দেখি নি-তখন বললাম, হায় খোদা, জীবনে যদি কোনো পুণ্য করে থাকি, তার বিনিময়ে তোমার কাছে একটা জিনিস চাই, তুমি আমার মেয়েকে বাঁচিয়ে রেখো না। খোদা আমার কথা শুনল, মেয়েটা সে রাতেই মারা গেল।
ভদ্রলোক একটু একটু কাঁপতে লাগলেন। অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বললেন, একেবারে ফুলের মতো ছিল আমার মেয়েটি, মাত্র তেরো বছর বয়স-
আমি বললাম, জামাল সাহেব, আপনার মেয়ের কথা থাক, আপনি আবার নতুন করে কষ্ট পাচ্ছেন। আপনার স্ত্রীর কথা বলুন।
জামাল সাহেব খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমার স্ত্রী খুব সুন্দরী মহিলা। লেখাপড়া জানা ভালো ঘরের মেয়ে। সতেরো বছর হলো বিয়ে হয়েছে, কিন্তু একটা আশ্চর্য জিনিস কি জানেন? আমার এখনও মনে হয়, আমি আমার স্ত্রীকে ঠিক বুঝতে পারি না।
বুঝতে পারেন না! আরেকটু ব্যাখ্যা করুন।
ব্যাখ্যা করার কিছু নেই, আমার মনে হয় বন্যার-আমার স্ত্রীর নাম বন্যা, বন্যার মনের ভিতরে রয়েছে একটা দেয়াল। দেয়ালের অন্য পাশে তার নিজের জগৎ। সেখানে আমার ঢোকার অধিকার নেই।
আপনি কি বৈবাহিক জীবনে নিজেকে অসুখী মনে করেন?
অসুখী? জামাল সাহেবকে একটু বিভ্রান্ত দেখা গেল, অসুখী কি বলব? ঝগড়াঝাঁটি মন কষাকষি সেসব কিছু নেই, কিন্তু দুজন যে খুব অন্তরঙ্গ সেরকমও নয়। সে হিসেবে বলা যায় যে আমি হয়তো একটু অসুখীই। কিন্তু সেভাবে হিসেব করলে মনে হয় অনেকেই অসুখী। আমার সমস্যা সেটা নয়। আমার সমস্যাটা হচ্ছে অন্য জায়গায়। জামাল সাহেব একটু ইতস্তত করে থেমে গেলেন।
আমি বললাম, বলুন।
আমার কেন জানি মনে হয় আমার মেয়ে নীরা যে মারা গেছে সেজন্যে বন্যার দুঃখটুঃখ বেশি হয় নি।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, এটা তো আপনি একটা খুব গুরুতর কথা বললেন জামাল সাহেব!
হ্যাঁ, আমি বলছি। আমার আরেকটা ছেলে খুব ছেলেবেলায় মারা গিয়েছিল। আমি তখন দেশের বাইরে ছিলাম, ফিরে আসতে আসতে কবর দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। এখন আমার মনে হয়, তখনও বন্যার খুব বেশি দুঃখ হয় নি। তখন বুঝতে পারি নি, ভেবেছিলাম, একেকজন মানুষের শোক প্রকাশের ভঙ্গি একেক রকম।
আপনার ছেলে কীভাবে মারা গিয়েছিল?
পানিতে ডুবে। বাসায় শখ করে বাথটাব লাগিয়েছিলাম, সেটাই সর্বনাশ হলো।
এখন আপনার আর কয়জন ছেলেমেয়ে?
আর একজন─ ছেলে। দশ বছর বয়স, ক্লাস ফাইভে পড়ে। জামাল সাহেব খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কদিন থেকে মনে হচ্ছে, আমার স্ত্রীর ভিতরে কোনো একধরনের অস্বাভাবিক ব্যাপার আছে।
অস্বাভাবিক?
হ্যাঁ। মানসিক দিক দিয়ে অস্বাভাবিক। আপনার কাছে আমি এসেছি সে জন্যে। আপনি কি আমার স্ত্রীকে একটু দেখবেন? দেখে কি বলবেন সে পুরোপুরি সুস্থ কি না?
দেখব। আমার কাজই এটা।
কিন্তু আমার একটা ছোট অনুরোধ আছে। বন্যাকে আমি আপনার ক্লিনিকে আনতে পারব না, সে কিছু একটা সন্দেহ করবে। আপনাকে আমার বাসায় যেতে হবে। ডাক্তার হিসেবে নয়, আমার বন্ধু হিসেবে। আমার অনেক টাকা, কিন্তু আপনাকে এই অনুরোধ আমি টাকার জোরে করছি না। আপনাকে অনুরোধ করছি একটা দুঃখী মানুষ হিসেবে। আমার মনে এতটুকু শান্তি নেই─
আমি বাধা দিয়ে বললাম, জামাল সাহেব, অস্থির হবেন না। আমি এমন কিছু ব্যস্ত মানুষ নই, সময় করে আপনার বাসায় যেতে আমার কোনোই অসুবিধে হবে না।
শুনে জামাল সাহেব খুব আশ্বস্ত হলেন।
আমি পরের সপ্তাহেই সময় করে জামাল সাহেবের বাসায় গেলাম। জামাল সাহেবের সাথে কথা বলে গিয়েছিলাম, জানতাম তিনি থাকবেন না। গিয়ে দেখি তাঁর স্ত্রীও নেই। আমি হয়তো চলেই আসতাম, কিন্তু তাঁদের দশ বছরের ছেলেটার সাথে দেখা হয়ে গেল।
ছেলেটাকে দেখে আমার বুকটা ধক করে উঠল। আমি মানুষের মন নিয়ে কাজ করি, তাই মানুষের চেহারা দেখে কখনো কখনো মন সম্পর্কে খানিকটা আঁচ করতে পারি। আমার মনে হলো এই ছেলেটা একটা মহাবিপর্যয়ের মাঝে আছে, চোখে-মুখে তার ছায়া । ঠিক গুলি খাবার আগে বনের পশু শিকারির দিকে যেভাবে তাকায়, চোখের দৃষ্টি অনেকটা সেরকম।
ছেলেটার নাম টিপু, সে প্রথমে আমার সাথে বিশেষ কথা বলতে চাইল না। কিন্তু আমি বিশেষজ্ঞ মানুষ, কীভাবে মানুষের মনের কথা বের করতে হয় জানি। বড়দের বেলায় ব্যাপারটি সহজ, ছোটদের বেলায় একটু কঠিন। একজন মানুষকে প্রথমবার দেখেই বাচ্চারা তার সম্পর্কে সঠিক একটা ধারণা করে ফেলতে পারে। আমি মানুষটা একেবারে খারাপ না, তাছাড়া আমি সত্যি তাকে সাহায্য করতে চাইছিলাম, তাই শেষ পর্যন্ত সে আমার সাথে আস্তে আস্তে কথা বলতে শুরু করল।
ঠিক এরকম সময়ে তার মা এসে হাজির হলো, আর ছেলেটা তার মাকে দেখে কেমন যেন মিইয়ে গেল। আমার সামনে থেকে আস্তে আস্তে উঠে চলে গেল ভিতরে।
জামাল সাহেবের কথা সত্যি, তাঁর স্ত্রী অস্বাভাবিক সুন্দরী। দেখে মনেই হয় না তার তেরো বছরের একটা মেয়ে ছিল। বয়স আন্দাজ করতে বললে কিছুতেই কুড়ি কিংবা বাইশের বেশি কেউ বলবে না। মেয়েটি আমাকে দেখে অবাক হলো কি না বোঝা গেল না। আমি আমার পরিচয় দিলাম। মেয়েটি সোফায় বসে আমার দিকে তাকাল আর সাথে সাথে কেন জানি আমার শরীরটা কাঁটা দিয়ে উঠল। চোখ দুটি যেন মানুষের নয়, যেন কোনো এক অশরীরী প্রাণীর। আমার মনে হলো এই চোখ দুটি আমার শরীরের প্রতিটি কোষ খুলে খুলে দেখে নিচ্ছে। মনে হলো এর কাছে আমার আর কিছু গোপন নেই, কোনো কিছু আর তার কাছে অজানা নেই।
মেয়েটি একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, আমার নাম বন্যা। আপনি বসুন, জামাল এক্ষুনি এসে পড়বে। মঙ্গলবার সে একটু ক্লাবে যায়।
আমি বললাম, আমার কোনো তাড়াহুড়ো নেই। আমি অপেক্ষা করতে পারব।
দুজন খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। মোটামুটি অস্বস্তিকর অবস্থা। আমি তখন ভাবলাম, অপেক্ষা না করে যে কাজে এসেছি সেটা শুরু করে দিই, দেখি জামাল সাহেবের কথা সত্যি কি না। বললাম, আসলে আমি একটু কাজে এসেছি। ঠিক কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা প্রশ্ন করতে চাই।
বন্যা আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে উদ্ধত স্বরে বলল, নীরা কেন আত্মহত্যা করল জানতে চান?
হ্যাঁ। আমি একেবারে থতমত খেয়ে গেলাম। আমতা-আমতা করে বললাম, আমাকে ওয়ার্ল্ড হেলথ থেকে উন্নতশীল দেশে তরুণু-তরুণীদের অস্বাভাবিক আত্মহত্যার হারের ওপর একটা আর্টিকেল লিখতে বলেছে।
কথাটি পুরোপুরি মিথ্যা নয়, আমাকে সত্যিই ওয়ার্ল্ড হেলথ থেকে এ ধরনের একটা জিনিস লিখতে বলেছে, তবে বিষয়বস্তু আরও ব্যাপক, উন্নতশীল দেশের মানুষের মানসিক সমস্যার ধারা। আমি আমার কথাকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, বন্যা আমাকে মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বলল, আত্মহত্যা করা একটা রোগ, এর কোনো কারণ নেই।
আত্মহত্যা করাকে রোগ বলতে চাইলে বলতে পারেন, কিন্তু এর কোনো কারণ নেই সেটা তো হতে পারে না। তাছাড়া সব রোগেরই কোনো-না-কোনো লক্ষণ থাকে, আমি জানতে চাইছি আপনারা নীরার মাঝে কোনো লক্ষণ দেখেছিলেন কি না।
বন্যা আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল আর অবিশ্বাস্য ব্যাপার, আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না, আমার চোখ সরিয়ে নিতে হলো।
বন্যা কাঁটাকাঁটা স্বরে বলল, সব রোগের লক্ষণ সবাই বুঝতে পারে না। সে জন্যে দরকার এক্সপার্ট, বিশেষজ্ঞ।
আমার কেন জানি সোজাসুজি তার দিকে তাকানোর সাহস হলো না; নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম, কিন্তু আপনি তো মা─
বন্যা হঠাৎ আশ্চর্য শুষ্কস্বরে হেসে উঠল। আমি চমকে তার দিকে তাকালাম, মনে হলো হাসি থামালেই তার সুন্দর দাঁতের ভিতর থেকে সাপের মতো একটা লকলকে জিব বের হয়ে আসবে। আশ্চর্য অস্বস্তিকর অনুভূতি!
বন্যা কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, মুখে হালকা একটা হাসি। প্রথম দেখে মনে হচ্ছিল মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী। এখন আর সুন্দরী মনে হচ্ছে না, দেখতে কেমন জানি ভয়ংকর মনে হচ্ছে।
এর পর আর আলাপ জমে উঠতে পারল না। আমি আর জামাল সাহেবের জন্যে অপেক্ষা না করেই বিদায় নিয়ে চলে এলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামছি, হঠাৎ অন্ধকার থেকে শিশুকণ্ঠে কে যেন বলল, শোনেন একটু।
আমি দাঁড়ালাম। টিপু-। জামাল সাহেবের দশ বছরের ছেলেটা অন্ধকার থেকে বের হয়ে এলো। জিজ্ঞেস করলাম, কী টিপু, কী ব্যাপার?
না, কিছু না। বলে সে দাঁড়িয়ে রইল, চলে গেল না।
কিছু বলবে টিপু?
নাহ্। তবু সে দাঁড়িয়ে রইল।
বলো। কিছু যদি বলতে চাও। বাসার ভিতরে আসব?
না না না─ হঠাৎ সে খুব ব্যস্ত হয়ে উঠল, বাসার ভিতরে না।
ঠিক আছে, তাহলে এখানেই বলো।
আপু আমাকে একটা জিনিস বলেছে।
কী বলছে?
আপু বলেছে, আপু সুইসাইড করে নি। মা আপুকে মেরে ফেলেছে।
অন্ধকার থাকায় আমার আর কষ্ট করে মুখের বিস্মিত ভাবটা আড়াল করতে হলো না। শুধু গলার স্বরটা স্বাভাবিক করে বললাম, তোমাকে কে বলেছে এটা?
আপু।
কিন্তু তোমার আপু তো নেই। কেমন করে বলল?
রাত্রিবেলা আপু আমার কাছে আসে।
ও
জামাল সাহেবের স্ত্রীর কথা জানি না, কিন্তু এই বাচ্চাটিকে এই মুহূর্তে সাহায্য না করলে তার সর্বনাশ হয়ে যাবে। প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে বোনের মৃত্যুতে, কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ব্যাপারটা। মাকে কোনো একটা কারণে পছন্দ করে না, তাই নিজের অবচেতন মনে পুরো দোষটি তাকে দিয়েছে। ব্যাপারটি একটু বিপজ্জনকও বটে। যদি বাইরের লোকজন শোনে, জামাল সাহেব আর তাঁর স্ত্রী ঝামেলায় পড়তে পারেন। বাচ্চাটি সত্য এবং কল্পনার মাঝে পার্থক্যটা ধরতে পারছে না। আমি এই মুহূর্তে তাকে নতুন কিছু না বলে তার কথা শুনে যাওয়াই ঠিক করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, তোমার আপু কি প্রতি রাতেই তোমার কাছে আসে?
না, সব রাতে না, মাঝে মাঝে।
তোমার কি ভয় লাগে?
এখন লাগে না। আমার মাকে বেশি ভয় লাগে।
তোমার আপু আর কিছু বলেছে?
আপু বলেছে, তার দুই হাত দড়ি দিয়ে বেঁধে মা তার শরীরে কেরোসিন ঢেলেছে। তারপর একটা ম্যাচের কাঠি দিয়ে চুলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কী অবলীলায় কত বড় একটা বীভৎস কথা বলে ফেলল ছেলেটা! টিপু আবার ফিসফিস করে বলল, অনেক কষ্ট হয়েছে আপুর। আপু যখন অজ্ঞান হয়ে গেছে , মা তখন তার হাত থেকে দড়ি খুলেছে।
আর কিছু বলেছে তোমার আপু?
হ্যাঁ। বলেছে, আমাদের একটা ছোট ভাই ছিল-মা তাকেও পানিতে ডুবিয়ে মেরেছে। আপুর সাথে আমার ভাইও মাঝে মাঝে আমার সাথে দেখা করতে আসে। যেদিন মা থাকে না, শুধু সেদিন আসে। মাকে সে খুব ভয় পায়।
আর কী বলেছে তোমার আপু?
আপু বলেছে মা এখন আমাকে মারবে। নয় বছর পরে পরে মারার কথা, কিন্তু মা আমাকে আগেই মারবে।
কেন?
কারণ আমি সব জেনে গেছি, সে জন্যে।
তোমার মা তো জানে না যে তুমি জেনে গেছ।
মা চোখের দিকে তাকালেই সব জেনে যায়। সে জন্যে আমি চোখের দিকে তাকাই না। কিন্তু মা প্রত্যেক রাতে ঘুমানোর আগে বলে, আমার চোখের দিকে তাকা। তখন মায়ের চোখের দিকে তাকাতে হয়। মা জানে যে আপু আমার কাছে আসে। সে জন্যে মা আমাকে আগেই মেরে ফেলবে।
আমার কিন্তু মনে হয় না সেটা সত্যিই হবে। আমার মনে হয়-
হবে। টিপু জোর দিয়ে বলল, অমাবস্যার রাতে মা বাবাকে একটা কাজে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেবে। তখন একটা লোক আসবে আমাদের বাসায়, তার একটা চোখ কানা। তখন দুইজন মিলে লুসিফারকে ডাকবে-
লুসিফার! সেটা কে?
শয়তান। শয়তানটাকে মা লুসিফার ডাকে। মা শয়তানের কাছে নিজেকে বিক্রি করেছে। মা যখন আমাদের এক-একজনকে মেরে ফেলে, শয়তান তাকে একটা করে ক্ষমতা দেয়। মায়ের এখন অনেক ক্ষমতা-আমাকে যখন মারবে তখন মায়ের এত ক্ষমতা হবে যে আর কেউ মাকে কিছু করতে পারবে না।
এগুলো তুমি কেমন করে জানলে?
আপু বলেছে।
তুমি কোনো বইটই পড়েছ এগুলোর ওপরে?
না ─ আমি বইটই পড়ি না।
তোমার আব্বাকে বলেছ এসব?
না।
কেন?
বলে কি হবে? আব্বা কিছু করতে পারে না। আব্বাকে মা সব সময় কোথাও পাঠিয়ে দেবে।
টিপু হঠাৎ আমাকে বলল, আমাকে নিয়ে যাবেন আপনার সাথে?
আমার সাথে? আমি থতমত খেয়ে গেলাম।
হ্যাঁ। আপনার বাসায়? তাহলে মা আমাকে মেরে ফেলতে পারবে না।
আমি টিপুর মাথায় হাত রেখে বললাম, যদি দরকার হয় আমি তোমাকে নিয়ে যাব।
অবশ্যই নিয়ে যাব। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, কেউ তোমাকে মারতে পারবে না। আমি তোমাকে বাঁচাব।
টিপু আস্তে আস্তে বলল, আপু বলেছে, আমাকে কেউ নেবে না। আমাকে এখানেই থাকতে হবে। মা এখানেই আমাকে মারবে। আপু বলেছে, মরে যাবার সময় অনেক কষ্ট, কিন্তু মরে যাবার পর নাকি কষ্ট নেই। ভালোই নাকি।
তুমি ভয় পেয়ো না তোমাকে কেউ মারতে পারবে না।
আপু বলেছে বেশি করে রসুন খেতে।
রসুন?
হ্যাঁ। বেশি করে রসুন খেলে নাকি লুসিফার কাছে আসতে পারে না। এই যে আমি রসুন খাচ্ছি। ছেলেটা মুখ হাঁ করল আর ভক করে কাঁচা রসুনের গন্ধ এসে লাগল নাকে।
তা-ই বলেছে?
হ্যাঁ। আর বলেছে একটা বাঁশের কঞ্চি দুই পাশে পুড়িয়ে সাথে রাখতে।
কঞ্চি?
হ্যাঁ।
রেখেছ তুমি?
হ্যাঁ। এই যে─ টিপু শার্টের নিচ থেকে বিঘতখানেক লম্বা একটা বাঁশের কঞ্চি বের করল, দুপাশে একটু একটু করে পুড়িয়ে রেখেছে। বলল, এটা সাথে রাখলে লুসিফার আসতে পারবে না।
তুমি ভয় পেয়ো না, তোমার কিছু হবে না।
এই অমাবস্যাতেই মা ─
আমি তার আগেই তোমার একটা ব্যবস্থা করব।
সত্যি? টিপু জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকাল।
হ্যাঁ। আমি টিপুর হাত শক্ত করে ধরে বললাম, তোমাকে আমি কথা দিলাম। তোমার আপু যদি আসে, তাহলে তাকেও বোলো যে তোমার আর ভয় নেই। আমি তোমাকে বাঁচাব।
বলব। টিপু প্রথমবার একটু হাসল, বলল, আপু শুনে খুব খুশি হবে।
টিপুর কথা শুনে আমার বুকটা প্রায় ভেঙে গেল।
বাসায় আসতে আমার হঠাৎ মনে হলো, এমন কি হতে পারে যে টিপু যা বলেছে তা সত্যি? বন্যা সত্যিই একটা পিশাচিনী? সত্যিই সে তার দুই ছেলেমেয়েকে মেরে এখন তার আরেকটা ছেলেকে মারার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে? আমি মাথা থেকে জোর করে চিন্তাটা সরিয়ে দিলাম। আমি একজন ডাক্তার, ভূতের ওঝা নই। টিপু অসুস্থ, তাকে সাহায্য করতে হবে। সে কল্পনা আর বাস্তবের মাঝে পার্থক্যটা ধরতে পারছে না। এই অসুখের নাম স্ত্রিতজোফ্রেনিয়া। মানসিক অসুখগুলির মাঝে সবচেয়ে খারাপ অসুখ এটি।
পরদিন ভোরবেলাতেই জামাল সাহেব হাজির হলেন। তাঁর স্ত্রীর সম্পর্কে জানতে চান। ভদ্রমহিলাকে দেখে একটা অশুভ ভাব হয় এই কথাটি আমি তাঁকে মুখ ফুটে বলতে পারলাম না দুটি কারণে। প্রথমত, -গত রাতে তাকে দেখে আমি কেমন একটু ভয় পেয়েছিলাম, দিনের আলোতে সেটা চিন্তা করে এখন আমার নিজেরই লজ্জা লাগছে। দ্বিতীয়ত, আমি একজন ডাক্তার, আমাকে একজন মানুষকে যুক্তিতর্ক দিয়ে বিচার করতে হবে, মনের ভাব দিয়ে বিচার করলে চলবে না। আমি বললাম যে তাঁর স্ত্রীকে আরেকবার দীর্ঘ সময়ের জন্যে না দেখে আমি কিছু বলতে চাই না। গত রাতে তিনি আমাকে সহজভাবে নিতে পারেন নি, আলাপ-আলোচনায় তিক্ততা এসে গিয়েছিল।
শুনে জামাল সাহেব কেমন জানি বিবর্ণ হয়ে গেলেন, বললেন, তার মানে আপনি আমার সন্দেহটি অমূলক বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। সত্য কথাটি বলা একটু পিছিয়ে দিচ্ছেন।
আমি বললাম, আপনার স্ত্রীর সমস্যা থেকে কিন্তু আপনার ছেলের সমস্যা অনেক গুরুতর।
জামাল সাহেব চমকে উঠলেন, কেন, কী হয়েছে টিপুর?
আমি জামাল সাহেবকে গত রাতে টিপুর সাথে দীর্ঘ আলোচনার কথা বললাম, কী নিয়ে কথা হয়েছে তার খুঁটিনাটি বলে আরও মন-খারাপ না করিয়ে দিয়ে সোজাসুজি বললাম, আপনার ছেলেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসার এই পরিবেশ থেকে সরিয়ে নিতে হবে। এমন জায়গায় নিতে হবে যেখানে তার বোনের কোনো স্মৃতি নেই। প্রথম প্রথম সম্ভবত তার মা থেকেও সরিয়ে নেওয়া ভালো। কোনো একটা কারণে এই মুহূর্তে সে তার মাকে সহ্য করতে পারছে না।
জামাল সাহেব দীর্ঘ সময় চুপ করে বসে রইলেন। আমি তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আপনারা সবাই যে পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে গিয়েছেন, তার পর এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আরেকটু সময় কেটে যেতে দিন, সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
জামাল সাহেব কোনো কথা না বলে দীর্ঘ সময় বিবর্ণ মুখে বসে রইলেন।
চলে যাবার আগে জামাল সাহেবকে জিজ্ঞেস করে আমি কয়েকটা জিনিস জেনে নিলাম।
সেগুলি হচ্ছে, তার ছেলে আর মেয়ে মারা যাওয়ার সঠিক দিন তারিখ। ওই দুই দিনই তিনি শহরের বাইরে ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর একটা ব্যবসা তিনি দেখাশোনা করেন, সেটার কাজে মাঝে মাঝে বাইরে যেতে হয়। তাঁর মেয়ের দুর্ঘটনার পর হাসপাতালে যে ডাক্তার দেখেছে, তার নামটিও আমি জেনে নিলাম। তারপর আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, এক চোখ নষ্ট এরকম মানুষ তাঁদের বাসায় আসে কি না। এই প্রশ্নটা শুনে তিনি একটু অবাক হলেন। যখন তিনি শহরের বাইরে যান, তখন তাঁর স্ত্রীর খুব বিশ্বাসী একজন মানুষ এসে তাদের বাসায় থাকে। লোকটির নাম সোলায়মান এবং সত্যিই তার একটি চোখ নষ্ট। টিপু এই লোকটিকে অপছন্দ করে কি না জিজ্ঞেস করলে জামাল সাহেব ঠিক উত্তর দিতে পারলেন না, শুধু বললেন তাকে ভয় পাওয়া বিচিত্র নয়, কারণ সোলায়মানের নষ্ট চোখটি নাকি খুবই বিসদৃশ।
জামাল সাহেব চলে যাবার পর আমি মোটামুটি একটা অবৈজ্ঞানিক কাজ করলাম।
অনেক খুঁজেপেতে একটা বাংলা পঞ্জিকা বের করে জামাল সাহেবের ছেলে আর মেয়ের মৃত্যুতারিখ দুটি পরীক্ষা করে দেখলাম। মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে দেখব টিপুর কথা ভুল, তারিখ দুটি অমাবস্যা নয়। কিন্তু আমি হতবাক হয়ে গেলাম, কারণ দেখলাম সত্যি সত্যি সে তারিখ দুটি হচ্ছে অমাবস্যা।
নিজেকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে এটা একটা কাকতালীয় ব্যাপার, সন্দেহপ্রবণ টিপু কোনোভাবে সেটা লক্ষ করেছে। তবুও ব্যাপারটা মনের ভিতরে খচখচ করতে লাগল, কোনদিন অমাবস্যা কোনদিন পূর্ণিমা বের করা সহজ ব্যাপার নয়, দশ বছরের বাচ্চার জন্যে তো নয়ই।
ক্লিনিকে বেশি কাজ ছিল না বলে দুপুর বেলা বের হয়ে মেডিকেল কলেজে হাজির হলাম। কিছু পুরানো বন্ধুবান্ধব আছে তাদের সাথে দেখা হবে, তা ছাড়া ইচ্ছে আছে জামাল সাহেবের মেয়েকে যে চিকিৎসা করেছে, কাজী আলমগীর, তার সাথে একটু কথা বলে আসা। বন্ধুবান্ধবকে পেলাম না, কিন্তু ড. আলমগীরকে খুঁজে বের করে ফেললাম। কমবয়সী একজন ইর্ন্টানি ক্যান্টিনে বসে চায়ের সাথে সিগারেট খাচ্ছে, ডাক্তারি মতে সিগারেট খাওয়ার জন্যে যেটা নাকি সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর। সামনে বসে পরিচয় দিয়ে আমি তাকে বললাম যে, নীরার দুর্ঘটনার ব্যাপারে আমি তাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। আমি খুব অবাক হলাম যখন দেখলাম তার বেশ খানিকক্ষণ লাগল নীরার কথা মনে করতে, প্রতিদিন নাকি এত অসংখ্য বিচিত্র রকমের দুর্ঘনার কেস আসে যে পুড়ে মরার ব্যাপারটি তার তুলনায় কিছুই না।
যখন শেষ পর্যন্ত সে মনে করতে পারল, আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি নীরার ব্যাপারটিতে অস্বাভাবিক কিছু দেখেছিলেন?
তেরো বছরের একটা বাচ্চার পুড়ে মরে যাওয়াটি যদি অস্বাভাবিক মনে না করেন, তাহলে না, দেখি নি।
কিছুই না?
না। চোখ-মুখ কুঁচকে খানিকক্ষণ সে মনে করার চেষ্টা করল। তারপর বলল, না, কিছু মনে করতে পারছি না। কেন?
শরীরের কোনো জায়গা বেশি পুড়েছে, কোনো জায়গা কম পুড়েছে-এরকম কিছু?
মনে নেই।
হাত? হাতের কব্জি?
ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল কাজী আলমগীর, হ্যাঁ, হাতের কব্জির কাছে পোড়ে নি, আমার মনে পড়েছে এখন। একটু অবাক হয়েছিলাম তখন। আপনি জানলেন কেমন করে?
আমি জানি না, তাই তো আপনাকে জিজ্ঞেস করছি।
কিন্তু আন্দাজ করলেন কেমন করে?
করি নি, এমনি বের হয়ে গেছে।
কাজী আলমগীর চোখ সরু করে বলল, আপনি আসলে পুলিশের লোক? মেয়েটাকে আসলে মার্ডার করেছে? হাত বেঁধে শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে-তাই না?
আমি জানি না।
কাজী আলমগীর আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল।
মেডিকেল কলেজ থেকে যখন বের হলাম তখন আকাশ কালো করে মেঘ করেছে। আমি অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে থাকি। সব হিসেব গোলমাল হয়ে গেছে। টিপু যে কয়টি কথা বলেছে তার একটিও আমি এখনও ভুল প্রমাণ করতে পারি নি। তাতে কিছু প্রমাণ হয় না, কিন্তু তবু মনের ভিতরে কী যেন খচখচ করতে থাকে। অন্য মনস্কভাবে হেঁটে হেঁটে আমি ব্রিটিশ কাউন্সিলে এসে হাজির হলাম। শয়তানের উপাসনার ওপরে এখানে কোনো বই আছে কি না কে জানে!
রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুম আসছিল না, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলাম। অবেলায় শয়তানের উপাসনার ওপরে এত কিছু পড়ে এসেছি যে মাথাটা মনে হয় একটু গরম হয়ে আছে। টিপুর কথা আবার সত্যি প্রমাণিত হয়েছে, শয়তানের আরেক নাম সত্যিই লুসিফার। যারা শয়তানের উপাসনা করে, তারা পৃথিবীর যা কিছু ভালো, তার বিরুদ্ধে কাজ করে যায়। জীবিত প্রাণীকে উৎসর্গ করে তাদের শক্তি বাড়ানো হয়। উপাসনায় যখন উপরের স্তরে ওঠে, তখন তারা মানুষকে উৎসর্গ করা শুরু করে। সত্যিই কি বন্যা শয়তানের উপাসক? সত্যিই কি সে নিজের হাতে একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে মেরেছে? সত্যিই এখন পরের অমাবস্যার রাতে টিপুকে মারবে? অমাবস্যাটা কবে?
আমি বিছানা থেকে উঠে পড়ার ঘরে এলাম। সেখানে বাংলা মাসের একটা ক্যালেন্ডার আছে, অমাবস্যা পূর্ণিমার কথা সেখানে লেখা থাকার কথা। সত্যিই লেখা আছে। আমি কেমন জানি একটা অস্বস তি নিয়ে আবিষ্কার করলাম আজ অমাবস্যার রাত। পড়ার ঘরে খানিকক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আমি শোবার ঘরে ফিরে এলাম। ঘরের ভিতরে অন্ধকার, আমি ঢুকতেই মনে হলো কে যেন সরে গেল একপাশে। আমি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, কে?
মনে হলো ফিসফিস করে একটা মেয়ের গলার স্বরে কে যেন বলল, টিপুকে কিন্তু ওরা মেরে ফেলবে!
আমি কোনমতে গিয়ে লাইটের সুইচ টিপে দিলাম। ঘরে কেউ নেই।
আমার শরীর তখনও অল্প অল্প কাঁপছে। আসেত্ম আসেত্ম গিয়ে বিছানায় বসলাম আমি। এ রকম একটা জিনিস কেন শুনলাম? মনের ভুল? তাহলে আমার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? নাকি আমার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছে নীরা?
মিনিট পাঁচেক চুপ করে বসে থেকে আমি জামাল সাহেবের বাসায় টেলিফোন করলাম। দশটা রিং হয়ে গেল, তবুও কেউ টেলিফোন ধরল না।
টেলিফোনটা রেখে আমি তখন আমার কাপড় পরা শুরু করলাম। টিপুকে কথা দিয়েছিলাম তাকে আমি বাঁচাব। আমি কখনো ভাবি নি সত্যিই তাকে কেউ মারবে, ওটা ছিল একটা কথার কথা, কিন্তু এখন কেন জানি মনে হচ্ছে টিপুর কথাই হয়তো সত্যি হবে। আসলেই তাকে কেউ হয়তো মেরে ফেলতে চাইছে। আমি টিপুকে কথা দিয়েছিলাম তাকে বাঁচাব, তাকে বাঁচাতেই হবে। কীভাবে জানি না, কিন্তু বাঁচাতে হবে।
বের হবার আগে আমি আবার টেলিফোন করলাম, এবারে সাথে সাথে একজন টেলিফোন ধরল। শুষ্ক পুরম্নষ মানুষের কণ্ঠস্বর।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি জামাল সাহেবের বাসা?
সাহেব বাসায় নাই।
কখন আসবেন?
কালকে।
আপনি কে কথা বলছেন?
আমার নাম সোলায়মান।
আমি নিজের অজামেত্মই কেমন জানি শিউরে উঠলাম। অমাবস্যার রাতে জামাল সাহেবকে শহরের বাইরে পাঠিয়ে একচোখ-নষ্ট সোলায়মানকে ডেকে আনা হয়েছে, ঠিক যেরকম টিপু বলেছিল। আমি বললাম, টিপুর সাথে একটু কথা বলতে পারি?
কে?
জামাল সাহেবের ছেলে, টিপু।
অন্যপাশ থেকে দীর্ঘ সময় কোনো কথা শোনা গেল না। আমি বললাম, হ্যালো! কোনো উত্তর শোনা গেল না। সোলায়মান টেলিফোন রেখে দিয়েছে।
আমি বাসা থেকে বের হলাম দশ মিনিট পরে। রান্নাঘরে কোথায় রসুন রাখা হয় আমার জানা ছিল না। খুঁজে বের করতে একটু সময় লাগল। এক টুকরো মুখে দিয়ে দেখলাম জঘন্য গন্ধ! একসময় মাছ ধরার শখ ছিল, কুমিল্লা থেকে একটা ভালো ছিপ জোগাড় করেছিলাম, সেটা থেকে বিঘতখানেক করে গোটা চারেক টুকরো কেটে গ্যাসের চুলায় দুপাশে পুড়িয়ে নিয়েছি। টিপু বলেছিল, এরকম জিনিস সাথে রাখলে লুসিফার কাছে কাছে আসতে পারবে না। আমি নিজে বিশ্বাস করি না, কিন্তু টিপু করে, তাকে সাহস দেবার জন্যে কাজে লাগতে পারে। ঠিক ঘর থেকে বের হবার আগে কী মনে করে আমার এক ভাগ্নেকে ফোন করে দিলাম। সে পেশাদার গুণ্ডা। ভালো রকমের গুণ্ডাই হবে, কারণ শুনেছি সব রাজনৈতিক দলই নাকি পয়সাকড়ি দিয়ে তাকে হাতে রাখে। তাকে বললাম, কালাম, যদি দুই ঘণ্টার মাঝে তোকে ফোন না করি তুই একটা বাসায় আসবি-
সে বলল, মামা কী ব্যাপার? আমি এখনই আসি।
আমি বললাম, না। এখন না। যদি তোকে ফোন না করি তাহলে আসবি।
মামা তুমি বলো কী হয়েছে, লাশ ফেলে দেব।
আমি বললাম, লাশ ফেলতে হবে না। ঠিকানাটা লিখে রাখ।
সে ঠিকানাটা লিখে রাখল।
জামাল সাহেবের বাসাটা অনেকটা জায়গা নিয়ে। বাসার চারপাশে বড় বড় গাছ চারিদিক থেকে আড়াল করে রেখেছে। সব দরজা-জানালা বন্ধ, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কেউ আছে কি নেই। আমি কয়েক মুহূর্ত বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে দরজায় ধাক্কা দিলাম। দরজাটা সাথে সাথে খুলে গেল, মনে হলো কেউ যেন দরজার পাশেই আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। দরজার ওপাশে আবছা অন্ধকারে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, নিশ্চয়ই সোলায়মান। বলল, আসেন, ভেতরে আসেন।
আমার বুকটা কেন জানি ধক করে উঠল। বললাম, না, ভিতরে আসব না। আমি এসেছি টিপুকে নিতে, জামাল সাহেব আমাকে বলেছিলেন-
লোকটা আমার কথার মাঝখানে দরজা বন্ধ করে দিল।
আমি আবার দরজা ধাক্কা দিলাম, আবার দরজা খুলে দিয়ে আবছা অন্ধকারে লোকটা দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম, আমি ডাক্তার মইনুল হাসান, টিপুর ডাক্তার। জামাল সাহেব বলে গিয়েছিলেন-
ভিতরে আসেন।
আমার নিজেকে কেমন জানি অসহায় মনে হলো, কেন জানি মনে হলো মস্ত একটা ফাঁদে আটকা পড়ে যাচ্ছি। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমি ভিতরে ঢুকলাম, সাথে সাথে লোকটা দড়াম করে পেছনে হেসে দরজাটা বন্ধ করে দিল। আমার মনে হলো কে যেন নারীকন্ঠে ভেতরে হা হা হা করে অট্টহাসি করে উঠেছে। মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠল হঠাৎ, দেয়াল ধরে কোনোমতে সামলে নিলাম নিজেকে। ঢোঁক গিলে জিজ্ঞেস করলাম, টিপু কোথায়?
পাশের একটা ঘর থেকে বন্যার গলার স্বর শুনতে পেলাম, এদিকে আসুন।
আমি পর্দা সরিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
ঘরে লাল রঙের একটা আলো জ্বলছে, অল্প আলো, ভালো করে সবকিছু দেখা যায় না। ঘরের মাঝখানে বড় একটা টেবিলের ওপর টিপু লম্বা হয়ে শুয়ে থরথর করে কাঁপছে। তার গায়ে কোন কাপড় নেই, সারা শরীরে কোনো একধরনের তৈলাক্ত জিনিস মাখানো। তার মাথার এবং পায়ের কাছে দুটি বড় পাত্র থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ধোঁয়ার কটু গন্ধে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা। টেবিলের অন্যপাশে বন্যা বসে আছে। মাথার চুলগুলি চূড়ার মতো করে বাঁধা। শরীরে পাতলা ফিনফিনে একটা কাপড়, সেটার ভিতর দিয়ে তার সুগঠিত শরীরের পুরোটাই দেখা যাচ্ছে, সেটা নিয়ে তার কোনোরকম জড়তা আছে বলে মনে হলো না। ঘরের দেয়ালে বিচিত্র নানারকম ছবি। চারপাশে রাজ্যের জিনিসপত্র ছড়ানো, আবছা আলোতে কোনটা কী বোঝার উপায় নেই।
ঘরের ভিতর আশ্চর্য রকমের শীতল। ভয়ংকর অশুভ একটা পরিবেশ। আমি নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিয়ে বললাম, এখানে কী হচ্ছে?
আপনি তো ভালো করেই জানেন।
আমি টিপুর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম, আমি টিপুকে নিতে এসেছি।
বন্যা খিলখিল করে হেসে উঠল, যেন ভারি একটা মজার কথা বলেছি। আমি বললাম, জামাল সাহেব আমাকে বলেছিলেন।
আপনি নিতে চাইলে নেবেন। কিন্তু এখনই না। টিপুর আত্মাটা আমার দরকার। লুসিফারকে কথা দিয়েছি আমি। লুসিফার আসবে এক্ষুনি। ওর আত্মাটা আগে নিয়ে নিই, তারপর ওকে নিয়ে যাবেন আপনি।
আশ্চর্য একটা আতঙ্ক আস্তে আস্তে আমাকে গ্রাস করে নিতে থাকে। কী বলছে এই রাক্ষসী!
আপনি বসুন। লুসিফারকে দেখবেন আপনি। কয়জনের সৌভাগ্য হয় লুসিফারকে নিজের চোখে দেখার! বসুন।
আমি অসহায়ভাবে বসতে গিয়ে হঠাৎ বুঝতে পারলাম বন্যা আমাকে সম্মোহন করার চেষ্টা করছে। এখন যদি আমি বসে পড়ি, তাহলে আমি হেরে যাব। মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্যে আমার মাঝে মাঝে রোগীদের সম্মোহন করতে হয়। এ জিনিসটার সাথে আমি পরিচিত। জোর করে দাঁড়িয়ে থেকে বললাম, আমি টিপুকে নিয়ে যাব। তারপর এগিয়ে গিয়ে আমি টিপুকে স্পর্শ করলাম, সাথে সাথে বন্যা চিলের মতো তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে উঠল, খবরদার, ওকে ধরবি না। মুহূর্তে ভদ্রতার সমস্ত খোলস ফেলে দিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় আমাকে একটা গালি দিল সে।
আমি টিপুর হাত ধরে বললাম, আমি পুলিশকে খবর দিয়ে এসেছি। তারা আসছে।
বন্যা আবার খলখল করে হেসে উঠল, খুব ভুল করেছিস আহাম্মকের বাচ্চা, খুব ভুল করেছিস।
কেন?
পুলিশ এসে দেখবে তুই টিপুকে খুন করেছিস, তুই তুই তুই─ জন্মের মতো তুই শেষ হয়ে গেলি।
কেন? সেটা কেন দেখবে?
কারণ তুই খুন করবি, সেজন্যে দেখবে। আমি তোকে যা বলব তুই তা-ই করবি আহাম্মকের বাচ্চা। সবাই করে। টিপুর বাবা চৌদ্দ বছর ধরে করে আসছে।
বেশ!
তুই জানিস আমার ক্ষমতা? এই দ্যাখ─ বন্যা ঘরের দেয়ালের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই দেয়াল থেকে একটা ছবি সশব্দে নিচে পড়ে গেল।
আমি চমকে উঠলেও মুখের ভাব স্বাভাবিক রেখে হাসার ভঙ্গি করে বললাম, আমি এর থেকে অনেক ভালো ম্যাজিক দেখেছি। জুয়েল আইচ মানুষ কেটে জোড়া দিয়ে দেয়।
আহাম্মকের বাচ্চা, এটা ম্যাজিক না।
এটা কী?
তুই খুব ভালো করে জানিস এটা কী।
আমি ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করি না।
বন্যা মনে হলো খানিকক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ঠিক আছে, এবারে তাহলে নিজের চোখে দ্যাখ। তারপর দেখি তুই বিশ্বাস না করে পারিস কি না!
আমার ভিতরে কেমন জানি একটা রোখ চেপে গেল।
কী করছি না জেনেই হঠাৎ আমি টিপুকে দুই হাতে টেনে তুলে আমার বুকে চেপে ধরে বললাম, ডাকো তোমার লুসিফারকে, বলো আমার কাছ থেকে টিপুকে নিয়ে যেতে। দেখি তার কত বড় সাহস-
আমার হঠাৎ মনে হলো সত্যিই কেউ আমার কাছ থেকে টিপুকে নিয়ে যেতে পারবে না।
টিপু আস্তে আস্তে চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়ে বিকারগ্রস্তের মতো ফিসফিস করে বলল, নীরা আপু সবাইকে নিয়ে এসেছে। লুসিফার আর ঢুকতে পারবে না। খানিকক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে সে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার শরীরে যেটা মাখানো হয়েছে সেটার ভিতরে কোনো একধরনের মাদকদ্রব্য আছে, সেটা লোমকূপ দিয়ে শরীরে ঢুকে তাকে নেশাগ্রস্ত করে ফেলছে, তার শরীর আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসছে।
বন্যা তীব্র চোখে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
তারপর হঠাৎ লাফিয়ে দাঁড়িয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় কী উচ্চারণ করতে করতে ধূপের মতো একটা জিনিস আগুনের মাঝে ছেড়ে দেয়। দপ করে একটা আগুনের শিখা জ্বলে উঠে আবার নিভে যায়, কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া বের হতে থাকে, ঝাঁজালো গন্ধে হঠাৎ সারা ঘর ভরে যায়। বন্যা দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ওপরের দিকে তাকিয়ে সারা শরীর ঝাঁকিয়ে চিৎকার করে কাকে যেন ডাকতে থাকে, আয় আয় আয় রে─ আয় আয় আয় রে─
একচক্ষু সোলায়মান বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে তালে তালে মাথা ঝাঁকাতে থাকে, আমি আতঙ্কের সাথে লক্ষ করলাম, তার হাতে একটা লম্বা রামদা। সেটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে
উঠে দাঁড়ায়, তালে তালে নাচতে থাকে, লাফাতে থাকে। টিপু হঠাৎ শক্ত করে আমার হাত ধরে চোখ খুলে ফিসফিস করে বলল, পারবে না, আসতে পারবে না─
কে আসতে পারবে না?
লুসিফার।
কেন?
আপনার জন্যে। আপনি ঠিক জিনিস করেছেন।
কী করেছি?
আপনি মায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। ঠিক জিনিস করেছেন। লুসিফার ব্যবহার করবে মাকে, আপু ব্যবহার করবে আপনাকে। আপু এখন চিৎকার করে সবাইকে ডাকছে, আর যত ভালো ভালো আত্মা আছে সবাই এসে আমাদের ঘিরে দাঁড়াচ্ছে। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ আত্মা। লুসিফার কিছু করতে পারবে না। কিছু করতে পারবে না। টিপু লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিতে থাকে, জ্বলজ্বলে চোখে তাকায়, তার মুখের কোণে আমি প্রথমবার একটু হাসি দেখতে পেলাম। আমি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, তোমার জন্যে আমি রসুন আর কঞ্চি পুড়িয়ে এনেছি।
সত্যি? কোথায়?
এই যে-আমি বের করে তার হাতে দিলাম। সে একটু রসুন মুখে পুরে কঞ্চির টুকরোটা শক্ত করে ধরে রাখল। আমি দেখতে পেলাম তার মনের জোর হঠাৎ করে একশো গুণ বেড়ে গেছে।
বন্যা বিকারগ্রস্ত মানুষের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে চিৎকার করতে থাকে, তার সুগঠিত দেহ একধরনের আদিম হিংস্রতায় থরথর করে কেঁপে ওঠে। সোলায়মান হাতে রামদা নিয়ে লাফাতে থাকে, আর হঠাৎ সারা ঘর থরথর করে কেঁপে ওঠে, মনে হয় সত্যিই বুঝি ঘরে কিছু একটা এসেছে। যা ইচ্ছে হয় আসুক, কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে কেউ আমার হাত থেকে এই শিশুটিকে নিয়ে যেতে পারবে ন। টিপুকে শক্ত করে ধরে আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকি।
বন্যার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে, সারা মুখে কষ্ট আর পরিশ্রমের একটা ছাপ, তার সাথে অবিশ্বাসের চিহ্ন। সত্যিই কি সে হেরে যাচ্ছে? সত্যিই কি হাজার হাজার আত্মা এসে ঘিরে রেখেছে আমাদের?
টিপু হঠাৎ আমাকে আঁকড়ে ধরে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে ছটফট করে উঠে বলল,
এখন এখন─
এখন কী?
শেষ করে দিন─
কী শেষ করে দেব?
লুসিফারকে।
লুসিফারকে?
হ্যাঁ।
কেমন করে?
হাত তুলে বলেন, বললেই হবে─ বলেন─ বলেন-
কী করতে হবে আমি জানি না, লুসিফার নামক জিনিসটি কোথায় তাও জানি না। তবু টিপুর কথামতো অনিশ্চিতভাবে হাত তুলে আমি বন্যার দিকে নির্দেশ করতেই একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল, বন্যার মুখের কথা আটকে গেল, অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে থাকল। আমি আস্তে আস্তে বললাম, তুমি জন্মের মতো শেষ হয়ে গেছ বন্যা।
আর সাথে সাথে সত্যি সত্যি বন্যা হাঁটু ভেঙে নিচে পড়ে যায়। সত্যিই সে জন্মের মতো শেষ হয়ে গেছে?
সোলায়মান হাতে রামদা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিদেহী প্রেতাত্মার আক্রমণ হয়তো সহ্য করা যায়, কিন্তু এই দুর্বৃত্ত যদি রামদা নিয়ে ছুটে আসে? আমি সতর্ক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি─ কিন্তু তার দরকার ছিল না─ বন্যাকে দেখে সে রামদা নিচে ফেলে দিয়ে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। শয়তানের উপাসনায় নিশ্চয় নানা স্তর আছে, ক্ষমতার প্রকারভেদ আছে। এ মুহূর্তে আমি সম্ভবত ক্ষমতার তুঙ্গে বসে আছি, অঙ্গুলিহেলনে হয়তো অর্ধ পৃথিবী ধূলিসাৎ করে দিতে পারি, আমার বিরাগভাজন হবে সে সাহস কার আছে?
এমন সময় দরজায় ঘা পড়ল। তারপর ভাগ্নের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম, মামা─ ও মামা─
দুই ঘণ্টা হয় নি, আগেই চলে এসেছে। উত্তর দেবার আগেই ভাগ্নে লাথি দিয়ে দরজার ছিটকিনি ভেঙে ঢুকে পড়ল। ধৈর্য নামক বস্তুটি তার শরীরে বিন্দুমাত্র নেই। কখনো ছিলও না।
মইনুল হাসানের গল্প এখানেই শেষ। জিজ্ঞেস করে আর যেসব তথ্য পাওয়া গেছে সেগুলি এরকম :
বন্যার বিরুদ্ধে কোর্টে কেস কখনো তোলা হয় নি, কোনো প্রমাণ নেই, কেস দাঁড় করানো যায় না। জামাল সাহেবকে ছেড়ে সে আমেরিকায় চলে গেছে, শয়তানের উপাসনার জন্যে আমেরিকার ওপরে নাকি দেশ নেই, খুনখারাবি সহ্য করে না সত্যি, কিন্তু প্রকাশ্যে শয়তানের উপাসনা উপাসনা করতে সে দেশে নাকি বাধা নেই। জামাল সাহেব সেই থেকে তাঁর ছেলে টিপুকে একা একা বড় করেছেন। টিপু এখন অনেক বড় হয়েছে, কলেজে যাবে। মইনুল হাসানের সাথে যোগাযোগ রেখেছে। মাঝে-মাঝেই দেখা করতে আসে।
সোলায়মানের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। আছে নিশ্চয়ই কোথাও! হয়তো অন্য কোনো পিশাচিনী খুঁজে বের করেছে।
……………………………………… (সমাপ্ত) …………………………………………