ছেলেটাকে দেখে খুব অবাক লাগল অনামিকার। ম্যানহোলের ভেতর থেকে শরীরটা বুক অব্দি বার করে ওর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। সারা গায়ে নোংরা ময়লা-পাঁক মাখানো, সন্ধ্যার আবছা আলোতে কুচকুচে কালো লাগছে ওকে। আর সেই কালোর মধ্যে সাদাটে চোখগুলো কেমন জ্বলজ্বল করছে। কর্পোরেশন থেকে মাঝে মাঝে এরকম অল্পবয়সী ছেলেছোকরাদের দিয়ে ম্যানহোল পরিষ্কার করানো হয়, সেটা জানে অনামিকা। তবে ওর আশেপাশে তো আরো কেউ থাকার কথা। যাইহোক। ছেলেটার থেকে চোখ সরিয়ে রাস্তাটা পেরিয়ে এল অনামিকা। রিপোর্টটা পুরোপুরি শেষ করতে গিয়ে আজ সাতটা বেজে গেল, নইলে অন্যদিন ছ’টা নাগাদ বেরিয়ে পড়ে ও। ডালহৌসির অফিসপাড়া এরই মধ্যে বেশ নির্জন হয়ে পড়েছে। রাস্তার ওপার থেকে ফের তাকাতেই অনামিকা দেখল, ছেলেটারও মুখ ঘুরিয়ে আবার সোজাসুজি চেয়ে আছে ওর দিকে। ওর চোখে চোখ পড়তেই অনামিকার বুকটা একটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল যেন, চোখ সরিয়ে নিল তাড়াতাড়ি। কিরকম একটা জিঘাংসা ভরা দৃষ্টি ছেলেটার চোখে! দ্রুতপায়ে মোড়ের মাথায় এসে দাঁড়াল অনামিকা। একটা সাদা রঙের ‘নো রিফিউজাল’ ট্যাক্সি খালি যাচ্ছিল, সেটাকে দাঁড় করাল হাত দেখিয়ে।
“— টালিগঞ্জ।”
“— মিটারের ওপর আর পঞ্চাশটা টাকা বেশি দেবেন দিদি।”
অন্যদিন হলে হয়তো ও দোনামনা করত খানিক, কিন্তু আজকে “ঠিক আছে” বলে চেপে বসল ট্যাক্সিটাতে। গতি বাড়িয়ে যখন মোড় পেরিয়ে যাচ্ছে ট্যাক্সিটা, অনামিকা পেছনের কাঁচ দিয়ে একবার তাকিয়ে দেখল ম্যানহোলটার দিকে। দূর থেকে ভালো বোঝা গেল না, তবু ওর মনে হল যেন ছেলেটার দৃষ্টি একচুলও সরেনি ওর থেকে।
.
ট্যাক্সির জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে ছিল অনামিকা। কিন্তু আসলে দেখছিল না কিছুই। ওর মনে বারবার ফিরে আসছে ওই সাদাটে চোখদুটোর স্মৃতি। কি অদ্ভুত, যেন মণি নেই কোনো। অথচ কি জ্বলজ্বলে! মনটাকে সরাতে মোবাইলের স্ক্রীনে চোখ রাখল ও। ফেসবুক ভর্তি লোকের ছদ্ম সুখের ছবি। আগে এসব দেখে ঈর্ষা হত, এখন করুণা হয়। নিজেকে সুখী দেখানোর কি আপ্রাণ প্রয়াস! অনামিকা জানে, এই হাসি হাসি মুখোশ গুলোর আড়ালে যে মুখ গুলো লুকিয়ে আছে সেগুলো আসলে কত সংকীর্ণ, হিংসুটে, বিমর্ষ, ভয়ার্ত… ভয়ার্ত…
…হঠাৎ ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল, কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটছে যেন! এটা কোন জায়গা? রাস্তায় আর গাড়ি কই? ওর ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে কেন? সামনে একটা খোলা ম্যানহোল!
“— পাশ কাটিয়ে চলুন না দাদা—” – ড্রাইভারকে বলল ও।
ড্রাইভার মুখ ফেরাল। এ কি বিভীষিকা! এ তো ড্রাইভার নয়! এ তো সেই ছেলেটা! সারা গায়ে কালো পাঁক– সাদা চোখ দুটো জ্বলছে… কিলবিলে সাপের মত আঙুলগুলো স্টিয়ারিংটাকে পাকে পাকে জড়িয়ে আছে… হঠাৎ অনামিকার মনে হল, ও আর ট্যাক্সির মধ্যে নেই… ওর চারপাশে কিরকম অন্ধকার দেওয়াল… মাথার অনেক উপরে একটুকরো গোলাকার আকাশ… পায়ের নীচে নোংরা ময়লা জল- পাঁক- বিকট পচা গন্ধ…কোন অলৌকিক বীভৎসতায় ও এসে পড়েছে একটা ম্যানহোলের ভেতরে! ছেলেটাকে এবার দেখতে পেল একদম সামনেই… মুখে কিরকম বিকৃত একটা আওয়াজ করছে… যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ওর… চোখ দুটো দপদপ করে জ্বলছে…
.
“— দিদি? ও দিদি! কি হল আপনার?”
সম্বিত ফিরল অনামিকার। দেখলো ড্রাইভার অবাক হয়ে চেয়ে আছে ওর দিকে। ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে আছে এক্সাইডের সিগন্যালে।
“— শরীর খারাপ লাগছে নাকি? মুখ দিয়ে কিরকম শব্দ করছিলেন! জল খাবেন?”
বোতলটা এগিয়ে দিল ড্রাইভার। ড্রাইভারের আঙুল গুলো কিরকম… লম্বা লম্বা… ব্যাঁকানো…
উফ্! পাগল হয়ে যাবে অনামিকা! তাড়াতাড়ি ট্যাক্সির দরজা খুললো ও, এটিএম থেকে তোলা একটা নতুন দুশো টাকার নোট ড্রাইভারের দিকে প্রায় ছুঁড়ে দিয়ে দ্রুত নেমে গেল।
“— কোথায় যাচ্ছেন? ও দিদি? ও দিদি? আরে চেঞ্জটা তো নিয়ে যান!”
ড্রাইভারের দিকে না তাকিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে অনামিকা দ্রুতপায়ে চলে এল রবীন্দ্র সদন মেট্রোর গেটে, তারপর সিঁড়ি দিয়ে সোজা নীচে নেমে গেল। গলা শুকিয়ে গেছে ওর; ‘পানীয় জল’ লেখা বেসিনটা ধরে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল ও।
আজকে এসব কি হচ্ছে ওর সঙ্গে? ওর খাবারে কি কেউ কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল? এইসব বিভীষিকা কেন দেখছে ও? ডাক্তার দেখাতে হবে নাকি?
সোঁ সোঁ শব্দ করতে করতে ‘কবি সুভাষ’ লেখা একটা ট্রেন আসছে। জল খেয়ে, চোখে মুখে জল দিয়ে অনামিকা এগুলো ট্রেনটার দিকে। কামরায় ভিড় বেশ ভালোই, দাঁড়িয়ে যেতে হবে ওকে। ভিড়ভাট্টা এমনিতে একেবারেই পছন্দ করে না ও। কিন্তু আজ যেন এই ভিড়- ঠেলাঠেলিই প্রিয় হয়ে উঠেছে ওর, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে এত মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে। রডে হেলান দিয়ে দাঁড়াল অনামিকা। পর পর স্টেশন আসছে– নেতাজী ভবন– যতীন দাস পার্ক– স্টেশনগুলো আলো ঝলমলে, তারপরই আলো- আঁধারিতে ভরা সুড়ঙ্গে ঢুকে যাচ্ছে ট্রেন– জানলার কাঁচে একবার আলো– একবার অন্ধকার–একবার আলো–একবার অন্ধকার– এর মধ্যে এক- একবার একটা মুখ ফুটে উঠছে কি কাঁচের ওপর? অন্ধকারে দু’ জোড়া সাদা চোখ? বড় হচ্ছে ক্রমশ!
.
“— পরবর্তী স্টেশন মহানায়ক উত্তমকুমার, টালিগঞ্জ এলাকার জন্য—”
আবার কিসব ভাবছিল ও! তাড়াতাড়ি ট্রেন থেকে নেমে আসে অনামিকা। নিজের মন কি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে? খালি এসবই ভাবছে তখন থেকে? এমন হলে তো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে হবে। ওদের পাড়াতেই ডক্টর মজুমদারের চেম্বার। হাই- হ্যালোর সম্পর্কও আছে অনামিকার সঙ্গে। নাহয় ওনাকেই একবার বলে দেখবে, ভাবল ও। আপাততঃ বাড়ি গিয়ে ধাতস্থ হওয়া যাক।
টালিগঞ্জ মেট্রো থেকে ওদের ফ্ল্যাট হাঁটা দূরত্বে। মিনিট দশেক লাগে খুব বেশী হলে। অনামিকা একবার ভাবল রিকশা নেবে একটা, পরে ভাবল, না থাক, যদি আবার ট্যাক্সির মত অবস্থা হয়? তার থেকে হেঁটেই যাওয়াই ভাল।
দেশপ্রাণ শাসমল রোড পেরিয়ে ওদের পাড়ার গলিটাতে ঢুকে পড়ল অনামিকা। ষ্ট্রীট লাইটগুলোর বেশ কয়েকটা খারাপ হয়ে পড়ে আছে। লোকজন তেমন নেই রাস্তায়। সাড়ে আটটার মধ্যে এত ফাঁকা তো হয়ে যায় না! আইপিএল দেখছে নাকি সবাই? ভাবল ও। না, একজন আছে, দাঁড়িয়ে আছে খানিকটা আগে। বেঁটেমত একটা লোক। একটু জোরেই পা চালাল অনামিকা। লোকটা কালো রঙের একটা জামা পড়ে আছে… না তো! ওর গায়ের রঙই কালো… লোক নয়, এটা একটা ছেলে! আতঙ্কে দম বন্ধ হয়ে এল ওর। ছেলেটা আস্তে আস্তে ঘাড় ঘোরাচ্ছে ওর দিকে… বুকের মধ্যে দমাদ্দম হাতুড়ি পিটছে অনামিকার। হঠাৎ জোরে হাওয়া দিল একবার, আর ছেলেটা যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল। অনামিকা ভালো করে চেয়ে দেখল, ছেলে নয়,একটা বাঁশের খুঁটি, তার গায়ে একটা কাপড় শুকোতে দিয়েছে কেউ। সেটাকেই ও দূর থেকে মানুষ বলে ভেবেছে। দৃষ্টিবিভ্রম! আশ্বস্ত হয়ে জায়গাটা পেরিয়ে এল অনামিকা। বাঁশের খুঁটিটা ঢোকানো আছে একটা খোলা ম্যানহোলের মধ্যে। হয়তো কাজ করতে করতে অসমাপ্ত রেখে চলে গিয়েছে কেউ, আবার আসবে আগামীকাল। ফের ম্যানহোল! ভাবল অনামিকা। যাইহোক, ওদের অ্যাপার্টমেন্টটার আলো দেখা যাচ্ছে। সুহাস এসে গেছে তার মানে। অনামিকা আধমিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেল। লিফটে চড়তে গিয়ে আজ কেমন ভয় লাগল ওর, সিঁড়ি দিয়েই উঠে এল ওদের তিনতলার ফ্ল্যাটে। কলিংবেলটা দ্রুত টিপল কয়েকবার। দরজা খুলে দিল সুহাস।
.
তাড়াতাড়ি ফ্রিজ থেকে জলের বোতলটা বার করল অনামিকা, ঢকঢক প্রায় আধ বোতল জল শেষ করে তারপর হাঁফ ছাড়ল।
“— উফ্! দিন গেল বটে একটা।” – সুহাসকে বলল ও।
সুহাস কোনো উত্তর দিল না।
অনামিকা ভালো করে তাকিয়ে দেখল সুহাসের দিকে। এমনিতে তো বাড়ি ফেরা মাত্রই সুহাস কথার ঝাঁপি নিয়ে বসে, সারাদিন অফিসে যা হয় তার খুঁটিনাটি বিবরণ না দেওয়া অবধি ওর শান্তি থাকে না। কিন্তু আজ ওকে চিন্তাকুল দেখাচ্ছে। নিজের মনে কি যেন ভাবছে ও।
“— কি হয়েছে? এত টেন্সড কেন?”
“— আর বোলো না। আজ বিরাট কেলো হয়েছে একটা। মৌলালির ওখানে একটা লেবার ম্যানহোলে নেমেছিল পরিষ্কার করতে, গ্যাসে দম বন্ধ হয়ে আর উঠতে পারেনি, ভেতরেই মরে গেছে। এই কাজটা আমার আন্ডারেই ছিল। সব প্রোটেকশন নেওয়া হয়েছিল, তবু কিকরে যে হল— সাহেবের কাছে ফালতু ঝাড় খেলাম—”
সুহাস কলকাতা কর্পোরেশনের একজন এগজিকিউটিভ এঞ্জিনিয়ার।
“— সব প্রোটেকশন নেওয়া হয়েছিল?” — ধরা গলায় জিজ্ঞাসা করল অনামিকা।
“—হ্যাঁ, মানে, ঐ যেমন হয় আরকি— ” আমতা আমতা করতে থাকে সুহাস।
“— লেবারটার বয়েস কত ছিল?”
“— বেশি নয়, একেবারেই অল্পবয়েস— আরে, কি হল তোমার?”
অনামিকা উত্তর দিল না কোনো। ভয়াবহ আতঙ্কে ওর মুখ সাদা হয়ে গেছে। ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, সুহাসের পেছনদিকে, ফ্ল্যাটের জানালায় ধীরে ধীরে মূর্তিমান বিভীষিকার মত ফুটে উঠছে একটা মুখাবয়ব। মুখ বেয়ে কালো পাঁক ঝরে পড়ছে, শুধু দপদপিয়ে জ্বলছে সাদা, মণিহীন চোখ দুটো– সেই চোখে আদিম জিঘাংসা।
………………………………………… (সমাপ্ত) ……………………………………………..