পোড়ো ভূতের বাড়ীর কথা অনেকেই শুনেছেন …ছবিও দেখেছেন ! কিন্তু ঢুকেছেন কি ? কলেজে পড়ার সময় থেকেই এইসব অতিন্দ্রীয় বিষয়ে আমার কৌতুহল ছিল l কোন জায়গা থেকে খবর পেলেই , ছুটতাম l তবে বেশীর ভাগ সময় বিফল হতাম ! আজ থেকে চল্লিশ..পঁয়তাল্লিশ বছর আগেও, পরিবেশের জন্যে হোক…বা আমাদের মনের বিষাক্ত পরিবর্তন না হওয়ার জন্যেই হোক, সুকুমার চিত্ত বজায় ছিল l
যেমন…নষ্ট চন্দ্র , সে আর এক অনুভূতি ! রাত্রে কার বাড়ীতে…ডাবের কাঁদি নামানো, আম চুরি , কাঁঠাল …খেজুর রস …চুরি..কি না করেছি ! মাঝে মাঝে বকুনিও জুটতো l সেই সময় আমাদের বন্ধুদের মধ্যে আলোচনার বিষয় ছিল…নিশির ডাক , আলেয়া , ভুলো ভূত..আরো কত কি ….!! এখন এসব কথা বা ঘটনা শুনলে…ছেলে মেয়েরা বলবে….কল্পনা , গাঁজাখুরি , অবাস্তব ..l
যাক..অন্য কথায় চলে না গিয়ে , ভূতের বাড়ীর ঘটনাটা বলি l তবে হ্যাঁ…একটাই অনুরোধ , মাঝে মাঝে জিরিয়ে নেবার জন্যে বা ঘটনাটা গুছিয়ে নেবার জন্যে..একটু সময় আমাকে দিতে হবে l কি রাজী ? …বেশ, শুরু করছি , সেন বাড়ীর সে… l
সমীর, আমি আর বাপ্পা – এই তিনজনেই ভূতের বাড়ী দেখা ও থাকার বিষয়ে বেশী উৎসাহী ছিলাম l শীত সবে পড়তে শুরু করেছে.. l এই সময় সমীর খবর নিয়ে এলো……মেমারী স্টেশন থেকে ভ্যান রিক্সায় গিয়ে অমরপুর , সেখান থেকে পায়ে হেঁটে…সেন পাড়ায় গিয়ে, সেন বাড়ী ! সেটা নাকি…ভূতের বাড়ী l অনেকেই নাকি অনেক কিছু দেখেছে l বাড়ীটা বছর দশেক ধরে…পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে l একজন বুড়ো চাকর…বাড়ীর বাইরে আগাছার জঙ্গলের বাগানের মধ্যে একটা ছোট্ট ঘরে বাস করে l
প্রতি বারই যাবার আগে..এইসব কাহিনী শুনি, গিয়ে ….মশা আর পিঁপড়ের কামড় খেয়ে ফিরে আসতে হয় l
” এবারেও আবার সে রকম হবে না তো ? ” বাপ্পার নিরুৎসাহর ভঙ্গী l
” না রে…..” জোর গলায় বললো সমীর ” একেবারে ঘোড়ার মুখের খবর ! আছেই আছে ” l
” তাহলে আর দেরী কিসের ? ” আমার উৎসাহী গলা l ” বাড়ীতে বন্ধুর বোনের বিয়ের নাম করে..পরশু বেরিয়ে পড়ি ” l কথা ফাইনাল হয়ে গেলো l কাল কে কিছু কেনাকাটা সেরে নোব..যেমন , কার্বলিক অ্যাসিড , (সাপের জন্যে.) মোমবাতি, কিছু বিসকুট , বাপুজী কেক, টর্চ আর একটা শতরঞ্জি l এছাড়া…তাস এক প্যাকেট…আর আমার ক্যামেরা l যদি শিকে ছেঁড়ে..একটা ছবি ! নাহলে অন্তত ভূতের বাড়ীর ছবি একটা তুলে আনবো l
বিয়ে বাড়ীর নাম করে…বুধ বার বেলা এগারোটা নাগাদ তিন বন্ধুতে বেরিয়ে পড়লাম l কলেজ জীবন…রক্ত টগবগ করে ফুটছে l তখন মেমারী যাবার জন্যে বর্ধমান লোকাল খুব কম থাকতো l সাড়ে এগারোটার ট্রেন ধরে মেমারী এলাম l সেন পাড়ায় যখন পৌঁছলাম, তখন একটা বেজে গেছে l জায়গাটা পুরোপুরি গ্রাম l একটা মুদিখানার দোকানে জিজ্ঞেস করাতে…এমনভাবে তাকালো, যেন আমাদের শেষ দেখা দেখছে !
সেন বাড়ীটা ….গ্রামের শেষ প্রান্তে l কোন এক সময়ে বিরাট লোহার গেট ছিল…এখন সেই জায়গাটা, বড়ো হাঁ করে আছে l গেট দিয়ে আগাছার ঝোপ ঝাড় মাড়িয়ে একটু গেলে বাড়ীটা ! দোতলা বাড়ীটার গা থেকে পলেস্তারা সব খসে গেছে.. l জায়গায় জায়গায় বট আর অশত্থের ঝুড়ি বীর বিক্রমে আকাশের দিকে মাথা ঠেলে উঠেছে l জানলা, দরজা সবই ভাঙা …কিছু আবার লোপাট l
অনেকটা জায়গা জুড়ে বাগান…সরি , এককালে ছিল l এখন বড়ো বড়ো গাছগুলোই রয়ে গেছে l আম, জাম , জামরুল,নারকোল,আর কিছু সুপুরি গাছ….অযত্নে পড়ে আছে l গ্রামের কাঁচা রাস্তা এই বাড়ীতেই এসে শেষ হয়ে গেছে l বাড়ীর পেছন জলা জমি…কচুরি পানার ছড়াছড়ি !
নজর পড়লো..বাগানের কোনায় কাঁঠাল গাছটার পাশে…একটা ছোট ঘর l তার মানে, ওখানেই কেয়ার – টেকার কাম দরোয়ান কাম চাকরটা থাকে l আমরা তিনজনেই বেশ খানিকটা ডাকাডাকি করার পর…একজন বুড়ো গোছের লোক ঘর থেকে বেরিয়ে এলো l বুঝলাম চোখে কম দেখে কেননা চোখের ওপর হাত রেখে আমাদের দিকে তাকালো l
…..” বন্ধুর বোনের বিয়েতে এসেছিলাম, অমরপুরে, থাকার জায়গার খুব অভাব…তাই ঘুরতে ঘুরতে এখানে আসা…যদি আজকের রাত টা একটু ব্যবস্থা করে দিতে পারেন..” অনুনয়ের সুরে বললাম l
আমাদের তিনজনকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত জরিপ করলো l তারপর ভাঙা গলায় বললো ” এখেনে রাত না কাটানোই ভালো..” l যা বাবাঃ…এতো ভাগিয়ে দিচ্ছে !
বাপ্পা আসরে নামলো ” আমাদের কোন অসুবিধে হবে না…একটা রাতের মামলা..” পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বার করলো l বুড়োটার চোখ এক মিনিটের জন্যে চকচক করে উঠলো ! পরক্ষনেই চোখের আলো নিভে এলো l কি যেন বলতে গিয়েও …ঢোঁক গিলে নিলো l
” আপনি কিছু একটা বলতে চাইছেন..” সমীর বললো l
“… তোমরা আজকালকার ছেলে , এসব কথা বিশ্বাস করবে না…ভাববে বুড়োর প্রলাপ ” l আমার অবচেতন মন একটা অন্য গন্ধ পেতে শুরু করলো l
….” আপনি নিঃসংকোচে বলতে পারেন..” আমার মার্জিত গলা ” যদি , কথা শুনে মনে হয়….আপনাকে জোরাজোরি করবো না……”
” একটু জল খাওয়াতে পারেন ? ” বাপ্পার গলা
” ভেতরে এসে বোস..জল দিতেচি ” ওই ছোট ঘরে ঢুকে ভাঙা তক্তপোশটায় বসলাম l জানলা দিয়ে বাড়ীটা চোখে পড়ছে… l দুটো বাজছে…রোদ্দুরের তেজ , এর মধ্যে কমতে শুরু করে দিয়েছে l একটা অদ্ভুত জিনিস নজরে পড়ছে…এতো গাছপালা , ঝোপ ঝাড়, কিন্তু একটাও পাখির দেখা নেই ! নিদেন পক্ষে একটা কাকও নেই… l
” এটা একটা ভূতের বাড়ী…” ভাঙা টুলটায় বসে বুড়ো ওরফে মহিম কথাটা বললো ! ” …এখানকার সবাই জানে.. l জানিনা কে তোমাদের পাঠিয়েছে ? মনে হয়, তোমরা এখানকার নয়….এই বাড়ীর ত্রিসীমানায় কেউ আসে না… l” আমরা আসতে আসতে লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছি l জানিনা অভীষ্ট সিদ্ধ হবে কি না ?
এরপরে যা শুনলাম ….অবশেষে যা চাক্ষুস করলাম , ভূতের বাড়ীর শখ আমাদের মিটে গেছলো l
….” দেখো বাবা, তোমাদের ভালোর জন্যেই বলছি , টাকার লোভ থাকলে… l ” কথাটা শেষ করলো না…বুড়ো ওরফে মহিম l ….” ওই যে, একতলার ঘরটা দেখছো…এখনো যেটা অক্ষত আছে , ওটাই সেন বাড়ীর সে থাকে ! ”
এমন ভাবে কথাটা বললো , যে মনে হলো এক টুকরো বরফ বুকে কে রাখলো !
” …আমার তিন কুলে কেউ নেই…তাও যে কজন দূর সম্পর্কের ছিল….ভাইপো কমলের ওই ঘটনা ঘটার পর…তাও গেছে l সবাই আমাকেই দায়ী করে l ” ওকে বাধা দিলাম না..কেননা ঘটনার খেই হারিয়ে ফেলবে l
” …আমি এই বাড়ীতে আছি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে…এই সেন বাড়ীর বিরাট অবস্থা ছিল l এদের নামেই পাড়ার নাম l তিন ভাই তাদের পরিবার নিয়ে একসঙ্গে থাকতো l ছোট বাবু..বিয়ে থা করেনি l ওর শখ ছিল বাগানের , আর বাড়িটাকে প্রাণের থেকেও বেশী ভালোবাসতো l আমাকে , ছোট বাবুই নিয়ে এসেছিলো…মেদিনীপুর থেকে l বাগানের কাজে সাহায্য ছাড়াও…দারোয়ানের কাজটাও করতাম l এই ঘরটা বাবু বানিয়ে দিয়েছিলো থাকার জন্যে l আমিও বিয়ে করিনি l একটু বিরতি… দম নেবার জন্যে l
ওর চোখে পুরোনো দিনের ছবি ! ” সেদিন ছিল…কাল বৈশাখীর রাত ! মহাপ্রলয় শুরু হলো সন্ধ্যে থেকেই ! সে কি ভীষণ ঝড়…বড়ো বড়ো গাছপালা গুলো মাথা নীচু করে ধাক্কা সামলাচ্ছে ! তার সঙ্গে শুরু হয়েছে শিলা বৃষ্টি…এই বড়ো বড়ো পাথর কালো মেঘ ফুঁড়ে নামছে …l মহিম ভালো বর্ণনা করতে পারে l মনে হচ্ছে চোখের সামনে আমরাও সেই প্রলয় দেখছি.. l
” এই ঘরে বসে..একমনে ঠাকুর কে ডাকছি…চারিদিকে গাছ , কাঁঠাল গাছটার মোটা মোটা ডালগুলো আমার ঘরের ছাদটাতে আছড়াচ্ছে..l বাইরে দু একটা সুপারি গাছ ভেঙে পড়লো.. l এইসময় সব শব্দকে ছাপিয়ে …বিকট এক আর্তনাদ….কানে পৌঁছলো l কান খাড়া করে…ছোট বাবুর সেই অমানুষিক চীৎকার..কানের ভেতর ঢুকে গেলো l জল ঝড় উপেক্ষা করে..ওই বারান্দা দিয়ে দৌড়ে …বাবুর জানলার কাছে গেলাম.. l ”
আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে লাগলাম l ওর দুচোখে ভয়ের ছায়া l “….জানলা দিয়ে দেখলাম…ঘরের ভারী ঝাড় বাতিটা ভেঙে ছোটবাবুর মাথায় পড়ে….মাথাটা দেহ থেকে আলাদা করে দিয়েছে ! ওহ , কি বীভৎস দৃশ্য ! যেন ছাগল বলি হয়েছে ! বাড়ীর সবাই ওই…রক্তের সাগরের মাঝে….বোবার মতো দাঁড়িয়ে ! মুন্ডুটা এখনো তাকিয়ে রয়েছে… l ” দুহাতে চোখে হাত চাপা দিলো l
আমরা একদম চুপ মেরে গেছি l ও আবার শুরু হলো l ” ….সকালে পুলিশ এলো, বাবুদের নামডাক ছিলো…ওদের কাজকর্ম করে , দাহ করার অনুমতি দিয়ে গেলো…এর কিছুদিন বাদ থেকেই শুরু হলো…ছোট বাবুর আনাগোনা..”
“…আনাগোনা..?” বাপ্পার উৎকণ্ঠার স্বর !
” হ্যাঁ…আনাচে – কানাচে ওনাকে সন্ধ্যের পর থেকেই দেখা যেতে লাগলো ! বড়ো বৌদির ছিল…হার্টের রোগ ! ওই সব ভূতুড়ে কান্ড কারখানা ওর শরীরের ওপর গভীর চাপ ফেললো l বড়ো বাবু বাড়ী ছাড়ার কথা ভাবতে শুরু করলো l হোম , যজ্ঞ , তান্ত্রিক , কত কি করা হলো.. l কোন লাভ হলো না.. l অবশেষে মেজবাবুও …একমত হলো বাড়ী ছাড়ার…যেদিন , মেজো বাবু নিজের চক্ষে দেখলেন….ছোট ভাইয়ের ওই ভয়ঙ্কর রূপ…” !
” কি দেখলেন ? ” আমরা এক সঙ্গেই বলে উঠলাম l
….মহিম একটু দম নিলো..” গরমকাল …আকাশে বাতাসে উত্তাপের ছোঁয়া ! মেজো বাবুর ঘরে ঘুম আসছিলো না.. l শেষে ঘরে থাকতে না পেরে…এগারোটা নাগাদ , বালিশ ..মাদুর নিয়ে ছাদে গেলো শুতে l মেজো বৌদি পই পই করে বারণ করলো.. l ছোট ঠাকুরপোর আত্মার ব্যাপারটা জানো তো ? …কে শোনে কার কথা..? হেসে বলেছিলো….” ওসব তোমাদের মনের দুর্বলতা ” !
….ছাদে ফুটফুটে ….চাঁদেরআলো, মিষ্টি মৃদু বাতাস..অচিরেই মেজো বাবুর চোখে তন্দ্রা মতো এসে গেছলো.. l হঠাৎ…কানে একটা অস্পষ্ট পায়ের আওয়াজে , তন্দ্রা ছুটে গেলো…ভাবলো …মেজো বৌ বোধহয় এসেছে l
…ঘাড় উঁচু করতেই চোখে পড়লো…..ছাদের পাঁচিল ধরে , চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে আছে…সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা মুণ্ডহীন একটা দেহ ! গলার কাছে লাল রঙের একদলা কাঁচা মাংস থক থক করছে… l এই দৃশ্য যে কোন মানুষই সহ্য করতে পারবে না… !!
পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে , দু তিনটে সিঁড়ির ধাপ টপকে নীচে এসে , অজ্ঞান হয়ে গেলো l
….বুড়ো মহিম থামলো… l আমি ঘড়ির দিকে দেখলাম…চারটে বেজে গেছে l শীতের সন্ধ্যা গুটি গুটি পায়ে নেমে আসছে… l ওর গলা কানে এলো !
” এর সাত দিনের মাথায়…সবাই বাড়িটাকে ছেড়ে , ওদের বাগবাজারের বাড়িতে চলে গেলো l পুরো বাড়ীর দেখা শোনার ভার, আমার হাতেই দিয়ে গেলো l প্রথম প্রথম প্রতি মাসে একবার করে এসে টাকা পত্তর দিয়ে যেত l তারপর ক্রমশ আসা কমতে শুরু করলো… l বাড়িটা বেচার চেষ্টা করেছিল ! কিন্তু …ততদিনে রটে গেছে.. …ভূ-তে-র বাড়ী ! টাকার পরিমান কমতে ও অনিয়মিত হতে লাগলো l ফলে…বাড়ী সারাই…গাছপালা পরিষ্কার কি করে হবে ? এই ভাবে বছর পাঁচেকের মধ্যে…সেন বাড়ী , পোড়ো …ভূতের বাড়ীতে পরিণত হলো ” ! চুপ করলো মহিম l
হঠাৎ.. একটা প্যাঁচার কর্কশ ডাকে, চমকে উঠলাম l এই প্রথম….পাখি জাতীয় কিছুর ডাক শুনতে পেলাম ! ভাবলাম….সত্যি প্যাঁচা তো ?? জানলা দিয়ে সেন বাড়ি চোখে পড়ছে….সন্ধ্যে আরও একটু এগিয়ে এসেছে… l গাছপালা গুলো চুপ চাপ দাঁড়িয়ে..যেন কারো আসার প্রতীক্ষা করছে l …একটা অস্পষ্ট কুয়াশা , পেছনের জলা জমি থেকে উঠে এসে…বাড়িটাকে ঘিরেছে..তবে কি তাঁর আসার আয়োজন সম্পূর্ণ করছে ? আমাদের মনোবাঞ্ছা কি পূরণ হতে চলেছে ? সত্যি কি তাঁরা আছে ? অনেক প্রশ্ন আমাদের মনে জাগছে ! বুড়ো উঠে একটা হারিকেন জ্বালালো l
” আপনি কোনোদিন কিছু দেখেন নি ? ” আমি সরাসরি প্রশ্নটা করলাম l
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো ” তোমাকে যেমন দেখছি তার থেকেও …পরিষ্কার দেখি l ”
” বাড়ীর মায়াটাই কাল হয়েছে ওনার…এতোদিনেও ওই জন্যে মুক্তি পেলো না….যক্ষ হয়ে সারা বাড়ী ঘুরে বেড়ায় ” দুঃখের স্বর l আমরা এবার নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম…মন স্থির করতে পারছি না…এরপর কি করবো ? ও তো থাকতে দেবে না…. ! বাপ্পা ইশারায় বললো, আরও একটু সময় কাটাই …অন্ধকার নামলে যদি কিছু দেখা যায় ?
আমি বললাম ” আপনার ভাইপো …কমলের কি হয়েছিল ? ও পাগল হলো কি করে ? ”
বিষাদের হাসি ওর ঠোঁটে …” তোমরা খুবই গল্প প্রিয়..সাহসীও খুব…এই ভর সন্ধ্যে বেলা..অপদেবতাদের কথা শুনছো ! তাও একেবারে …ভূতের বাড়ীতে বসে ? ”
” আপনিও খুব সাহসী…এই রকম ঘটনা জেনে…এইরকম জায়গায় বছরের পর বছর রয়েছেন …”
” আমার কোথাও যাবার জায়গা নেই বাবা ” করুন গলা l ” কিছু পয়সা …মাঝে সাঝে সেনবাবুদের ছেলেরা পাঠায়…তাই পড়ে আছি ” l
” আপনি ভাইপো কমলের কথা বলুন..” সমীর খেই ধরিয়ে দিলো l
….যেভাবে হোক…সময় কাটাতে হবে l এখন ভাবি ….সময় না কাটিয়ে ….চলে এলেই ভালো হতো l
….”..আমার দূর সম্পর্কের ভাইপো কমল, একদিন এই বাড়ীতে এসে হাজির l দুদিন থাকবে..আমি তো ভয়ে শিউরে উঠলাম l আমার না হয়…গা সওয়া হয়ে গেছে ! তা ছাড়া ছোট বাবুর ছায়ার শরীরের সাথে আমার কখনও ঠোকাঠুকি হয় নি ! দুজনেই দুজনকে সযত্নে এড়িয়ে গেছি ! ” আমরা ওর কথা গিলছি l বলার ভঙ্গিমায় , যেন চোখের সামনে ঘটনা গুলো দেখতে পাচ্ছি l
“….প্রথমদিন এই ঘরেই রাত কাটালো , পরের দিন কি পেঁচোতে ধরলো…বলে কি না , তালা খুলে ওই ঘরটা…দেখে এসেছে ! ও ঘরে কি সুন্দর খাট , বিছানা, মশারী আছে…ওখানেই রাতে শোবে..l অনেক বোঝালাম …ছোটবাবু রাতে আসে…তুই ওর রূপ সহ্য করতে পারবি না.. l তোমাদের মতোই বয়স…সব কিছুতেই তাচ্ছিল্য ..l কোন কথা কানে না তুলে…রাতে শুতে গেলো ওই অপয়া ঘরে ! ভগবানকে ডাকলাম…আজকের দিনটা যেন ..সে না আসে…l” অল্প কাশলো বুড়ো …সত্যি এক টানা বলছে l
” রাত্রে ঘুম আসছে না…মনের মধ্যে একটা বিপদ ঘন্টি বেজেই চলেছে ! আচমকা বিকট হাসির শব্দে…কানে যেন তালা ধরে গেলো l হারিকেন হাতে ছুটলাম… l ”
” কি দেখলেন ?” আমার উৎকণ্ঠা
” ….কমল খাটে শুয়ে কড়ি কাঠের দিকে চেয়ে…পাগলের মতো হেসে চলেছে..দম ফাটানো হাসি..সে হাসি শুনলে…যে কোন সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়বে l ”
” তারপর ? ” আমাদের মনেও সাহসের ঘাটতি শুরু হচ্ছে !
” অমন জোয়ান ছেলেটা…বদ্ধ পাগোল হয়ে গেলো ” ওর মুখে গ্লানি ! ”
” দেখো বাবারা, পয়সার লোভ থাকলে…এতো পুরোনো কথা তোমাদের বলতাম না… l বাইরে তাকিয়ে দেখো…সন্ধ্যে হয়ে গেছে l …অনেকক্ষন এসেছো , কিছু তোমাদের মুখে দিতে পারিনি l …এবার তোমরা এসো l বিয়ে বাড়ীতে একটা রাত কষ্ট করে , ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যেও…. ” l টুল ছেড়ে দাঁড়ালো l অগত্যা , আমাদেরও দাঁড়াতে হলো l
এতোখানি এসে…এতো সময় নষ্ট করে…সে আছে জেনেও , না দেখে ফিরে যেতে মন চাইছিলো না ! ওদের একই মনোভাব l আমি শেষ চেষ্টা করলাম l
“..মহিম কাকা, ” কণ্ঠে মধু ঝরালাম..” আপনার কথামতো , আমরা ফিরে যাবো…ছোট বাবুর এতো কথা শোনার পর , ঘরটা একটি বারের জন্যে দেখতে চাই l দয়া করে না বলবেন না..” !
মিনিট দুয়েক কি ভাবলো ও ! তারপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললো ” কাকা বলে ডাকলে যখন….বেশ , এসো আমার সঙ্গে ..” হারিকেনটা হাতে তুলে নিলো l বাপ্পাও তাই দেখে , চটপট ব্যাগ থেকে টর্চটা বার করলো l
বাইরে এলাম l মনের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা টের পাচ্ছি ! ঘন অন্ধকার সেন বাড়ী জুড়ে নেমে গেছে ! ওর পিছু পিছু অন্ধকার সাঁতরে আমরা ভাঙা চোরা বারান্দায় পা রাখলাম l আমাদের সম্মিলিত আলোর জোরে ..পরিষ্কার সব কিছু দেখা যাচ্ছে l দরজায় দুটো কড়া দড়ি দিয়ে বাঁধা l ….ক্যাঁচ কোঁচ শব্দে ভাঙা পাল্লাটা খুললো !
…বড় ঘর , একপাশে একটা পুরোনো আমলের উঁচু পালঙ্ক …সেটাতে পরিপাটি করে বিছানা পাতা , নকশা কাটা বালিশ , পালঙ্কে কাঠের ছোতরীতে মশারী ! মনে হচ্ছে ঘরে নিয়মিত কেউ বাস করে ! মেঝেটাও মসৃন ….পরিষ্কার !
কৌতূহল বশতঃ প্রথমেই ঘাড় উঁচু করে…কড়ি কাঠের দিকে তাকালাম , যেখানে ঝাড় লণ্ঠনটা টাঙানো ছিল l বাপ্পার টর্চের আলোয় দেখলাম….কড়িকাঠ থেকে একটা লোহার চেন ঝুলছে…..এবং ঘরে হাওয়া না থাকা সত্ত্বেও , অল্প অল্প দুলছে ! গায়ের মধ্যে একটা শিরশিরানি অনুভব করলাম l মনে হচ্ছে একনাগাড়ে শোনা ওর গল্পটাই ….সাহস কমিয়ে দিয়েছে l
….এবার নাকে একটা মিষ্টি আতরের গন্ধ ভেসে এলো.. l ” একটা সুন্দর আতরের গন্ধ পাচ্ছি ” ! আবিষ্ট মুখে বললাম l
ওরাও নাক টেনে সহমত হলো l
” ওটা ছোট বাবুর আতরের গন্ধ…খুব সৌখিন মানুষ ছিলেন তো..” মহিমের ভাঙা গলা l
“…কিন্তু, ওটা আসছে কোত্থেকে ? ” সমীরের কাঁপা কণ্ঠ l
” কেন ? ওনার গা থেকে..” কথাটা আমাদের মনে কাঁপুনি ধরিয়ে দিলো l
সাহস সঞ্চয় করে বললাম ” উনি কোথায় ? ”
ও সরু আঙ্গুল তুললো …ঘরের কোনার দিকে ” ওই তো ….ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন..” l
আমাদের চোখে পড়লো….কোনে দেওয়াল ঠেসান দিয়ে একটা মুন্ডু হীন দেহ দাঁড়িয়ে….এক অতীব নারকীয় দৃশ্য , যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়… l
পা দুটো ক্রমশ শক্তি হারাচ্ছে ….হঠাৎ, মহিম…হারিকেনটা ছুঁড়ে দিয়ে…ছোট বাবুর একেবারে পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো ! …হারিকেনের আলো নিভে গেলো…শুধু টর্চের আলোয় দেখলাম…মহিমের মুখে বিষাক্ত হাসি..চোখ দুটোর জায়গায়….শুধু মাত্র কালো দুটো গর্ত !
আমাদের স্নায়ু গুলো এক লহমায় শিথিল হয়ে গেলো ! মুখ দিয়ে চিৎকারের বদলে গোঙানী বেরোলো l ওই হাড় হিম করা দৃশ্য…অতি বড়ো সাহসীকেও পাগল করে দেবে…l
…..বুঝতে পারছি…একটা অতল অন্ধকার গহ্বরে প্রবেশ করছি…..টর্চের আলো উধাও হয়ে গেলো…শুধু অন্ধকার… অন্ধকার ….অন্ধকার…চারিদিকে বিরাজ করতে লাগলো l
*** *** ***
জলের ঝাপটায়…..জ্ঞান ফিরলো…. শুন – লাম…যেখানে ঠিকানা জিগ্যেস করেছিলাম…ওই মুদিখানার লোকটির কি রকম সন্দেহ হয় , …রাত্রে আমাদের ফিরতে না দেখে …l পাড়ার লোক জন জুটিয়ে …..সকালে এখানে এসেছে l কেননা রাত্রে এই বাড়ীতে কেউ আসতে রাজী হয় নি l তার মানে সারা রাত্রি আমরা এই ঘরে পড়ে ছিলাম… !!
তাকিয়ে দেখি..ভাঙা চোরা ঘরটায়…কোথায় পালঙ্ক ?…কোথায় বিছানা..মশারী ? অবাক হয়ে দেখি ! বিলকুল ফাঁকা.. l সব থেকে….যে কথাটা আমাদের সাহসী মনটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে চুরচুর করে দিলো…..তাহলো , মাস তিনেক আগে মহিমের মরা দেহ এই ঘর থেকেই উদ্ধার করা হয়েছে….
…..ওরাই আমাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে গিয়েছিলো l আমাদের মুখে কথা ছিল না…একটাই ভাবনা কুরে কুরে খাচ্ছিলো , ……….সেটা হলো , গল্পের নামটা পরিবর্তন করে…..রাখবো , — সেন বাড়ীর সে ও মহিম.. ll
……………………………………..(সমাপ্ত)………………………………