মিঠাই

মিঠাই

পরমার হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেলো । ঘুম ধরা চোখে তড়াক করে লাফ মেরে বিছানায় উঠে বসলো । অনুভব করলো পাতলা নাইটিটা ঘামে ভিজে গায়ের সাথে একেবারে জড়িয়ে গেছে । মনে মনে ইলেকট্রিক সাপ্লাইকে খান কতক গালাগাল দিয়ে নিলো । পরক্ষণেই মনে পড়লো সুইচ বোর্ডে তো ইন্ডিকেটরটা জ্বলছে । তাহলে তো কারেন্ট যায়নি । তাহলে ফ্যানটা বন্ধ করলো কে ? আনমনে সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকাতেই দেখলো ওটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে । চোখ চলে গেলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ড্রেসিং টেবিলের দিকে । ওটার ঠিক পাশেই একটা আবছা ছায়া মূর্তি মেঝেতে হাটু দুটো মুড়ে তার ওপরে মাথাটা গুঁজে বসে আছে ।

শরীরের ভিতরে ৪৪০ ভোল্টের বিদ্যুৎ খেলে গেলো । ধুকপুকানি বেড়ে গেলো কয়েকশো গুণ । সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো । চিৎকার করে ডাকতে গেলো রুমাকে। রুমা ২৪ ঘন্টা ওর সাথেই থাকে , পরিচারিকা । কিন্তু গলা দিয়ে ফ্যাসফ্যাসে শব্দ ছাড়া কিছুটা হাওয়া বেরিয়ে গেলো । পরমা ওদিকে দেখতে চাইছে না কিন্তু বার বার চোখটা চলে যাচ্ছে সেদিকে । ধড়ফড় করে উঠে দরজার দিকে দৌড়ালো । প্রাণপনে টানাটানি করতে থাকলো । কিন্তু খুলতে পারলো না । অসহায় পরমা কি করবে বুঝতে পারছে না ।

মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে মাথাটা নড়ছে । হ্যাঁ ঠিকই । নড়ছে তো । হঠাৎ মনে পড়লো সুইচ বোর্ডটা তো দরজার পাশেই । সব কটা সুইচ এক সাথে অন করে দিলো । কিন্তু কোনো কাজ হলো না । ঘরের অন্ধকার পরিবেশের কোনো পরিবর্তন হলো না । শুধুমাত্র ইন্ডিকেটরের লাল আলোটা তীক্ষ্ণ হয়ে অন্ধকারটা যেন চোখ সওয়া হয়ে গেছে । এখন অনেকটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে চারিদিকটা । ড্রেসিং টেবিলের পাশে বসে থাকা ছায়ামূর্তিটা এখন আর শুধু ছায়া হয়ে নেই, ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে । মুখটাও তুলে ফেলেছে । একটা মেয়ে । বাচ্চা মেয়ে । ফ্রক পরে আছে । বুকের কাছে কাপড়ের কালো ফুলটা দেখেই সব মনে পড়ে গেলো পরমার । ওটা কালো ফুল নয়, লাল । অল্প আলোতে ওটা নিজের রং পাল্টে কালো রূপ ধারণ করেছে । শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আসলো শীতল স্রোত ।

মুখটা ঢাকা পড়েছে অনতি লম্বা যত্নহীন চুলে । চুলের ভিতর দিয়ে মেয়েটা পরমার দিকে দেখছে মনে হচ্ছে । বাইরের সদ্য শুরু হওয়া কালবৈশাখীতে পর্দা উড়লো । পাশের কাঠের উঁচু টুল থেকে ফুলদানিটা মেঝেতে পড়ে গিয়ে একটা ধাতব শব্দ তুললো । পাশেই কোথাও যেন একটা বাজে পড়লো । সেই আলোতে মেয়েটার চুল ঢাকা মুখ আর চুলের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতে থাকা ঘোলাটে চোখ দুটো পরিষ্কার দেখলো পরমা ।

সেদিনও তো এমনি ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিলো । দাদা বৌদির সুখের সংসার কিছুতেই সহ্য করতে পারতো না ডিভোর্সি পরমা । বাবা মা অনেক আগেই গত হয়েছেন । মৈনাকের সাথে ডিভোর্স হওয়ার পর থেকে দাদার কাছেই থাকতো । মাঝে মধ্যে দাদা বৌদি যখন অন্তরঙ্গ হতো পরমার মনটা হিংসায় ভরে উঠতো । মৈনাক আর নিজের অশান্তি ভরা সংসারের সাথে বার বার দাদা বৌদির গোছানো সংসারটাকে গুলিয়ে ফেলতো ।

ছুতোনাতায় বৌদির সাথে পায়ে পা বাঁধিয়ে ঝগড়া করতো । কথায় কথায় দাদার কাছে বৌদির নামে নালিশ করতো । একটা সময় সেটা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায় । বোনের নালিশের পর নালিশে একটা সময় সরল সাধাসিধে দাদার মনটাকে বিষিয়ে দেয় । বৌদির সাথে দাদার অশান্তি শুরু হয় । পরমা আড়াল থেকে সেসব দেখে মনে মনে হাসতে থাকে । এভাবেই দিন কাটতে থাকে ।

একদিন সকালে বৌদি ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে ঢোকার পর পরমা দাদার ঘরে যায় । দেখে মিঠাই একা খাটে শুয়ে আছে আর দাদা মেঝেতে । মিঠাই হলো পরমার সাত বছরের ভাইঝি । ক্লাস থ্রি তে পড়ে । দাদাকে এ অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখে ওর মুখে একটা বাঁকা হাসি খেলে যায় । তার মানে কাল রাতে ওদের দরজায় কান পেতে পরম যা যা শুনেছে তা সত্যি । দাদা বৌদির সম্পর্কটা প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে । কিছু না বলেই বেরিয়ে আসলো ঘর থেকে ।

একদিন বোনকে কিনে দেওয়া ডায়মন্ড রিংটা দেখে বৌদির সাথে দাদার অশান্তি পৌঁছালো চরম পর্যায়ে । বৌদির যুক্তিপূর্ণ বাক্যবাণে দাদার মেজাজ সপ্তমে চড়লো । পাশের টেবিলে পড়ে থাকা পেপারওয়েটটা দিয়ে সপাটে মারলো বৌদির মাথায় । মাথায় হাত দিয়ে বৌদি শুয়ে পড়লো বিছানায় । রক্তে ভেসে গেলো । বৌদির মুখ চিরকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছিল দাদা । দরজার পাশ থেকে সবটাই লক্ষ করেছিল পরমা । ধীরে ধীরে অজানা এক আনন্দ নিয়ে পা বাড়িয়েছিল নিজের ঘরের দিকে । বাইরে তখন প্রবল বেগে ঝড় সঙ্গে বৃষ্টি । মিঠাই পড়তে গেছিল পাশের ফ্ল্যাটে ম্যাডামের কাছে । ফ্ল্যাটের এই এক সুবিধা, পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন জানতেই পারে না এ ফ্ল্যাটে কি হচ্ছে ।

একটু পরেই কলিং বেলটা বেজে উঠেছিল । পরমা দরজাটা খুলতেই মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে ওকে ধাক্কা মেরে মিঠাই ঢুকে পড়েছিল ঘরে । পর মুহূর্তেই প্রচন্ড আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে দৌড়ে এসে পিসিকে জড়িয়ে ধরে ছিল পিসিকে । তার পর কাঁদতে কাঁদতে ওর হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল বেডরুমে । দুজন মিলে আবিষ্কার করেছিল বৌদির নিষ্প্রাণ দেহটা বিছানায় পড়েছিল । দাদার শান্ত শরীরটা ঝুলছিল সিলিং ফ্যান থেকে । পাশে পড়েছিল কাঠের টুলটা । টুলটা বিছানার উপরেই পড়েছিল বলে পরমা কোনো শব্দ পায়নি । দাদা শেষ বাঁচার চেষ্টাটা করেছিল দু-পা দিয়ে দু-পায়ের সাহায্য নিয়ে । ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল বাঁ পায়ের পাতাটাকে ।

দাদা হয়তো রাগ কমার পর অনুভব করেছিল যে কি ভুল ও করে ফেলেছে । অনুশোচনায়, নিজেকে ক্ষমা করতে না পারার ভাবনায় নিজেকেও শেষ করে দিয়েছিলো । ছোট্ট মিঠাইকে দেখে পরমার মনে এক নৃশংস ভাবনা খেলে যায় । মুহূর্তের মধ্যে ওর চোখ দুটো লোভে চকচক করে ওঠে । মনে মনে ভাবে মিঠাই যদি না থাকে তাহলে এ সব তো তার । সব সম্পত্তির মালকিন ও নিজে । কিন্তু কি করে ?

মিঠাইকে নিয়ে ডাইনিংএ এসে ফ্রিজটা খুলে ঢকঢক করে খানিকটা ঠান্ডা জল গলায় ঢেলে নিলো । হাত ধরে আবার নিয়ে গেলো বেডরুমে । নিজের দিকে ফেরালো মিঠাইকে । তারপর ওর হাতের দুটো বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চেপে ধরলো মিঠাইয়ের নরম গলাটা । বাচ্চা মেয়েটা নিজে বাঁচার সব চেষ্টাই করেছিল কিন্তু কিছুই করতে পারে নি । পিসির দুটো কব্জি চেপে ধরেছিল মৃত্যু যন্ত্রনায় । ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ দুটো দিয়ে যেন পিসিকে অনুরোধ করছিল ওকে ছেড়ে দিতে । কিন্তু লোভী পিসি সেদিন কোনো অনুরোধই মন থেকে মেনে নেয়নি । মায়ের পাশে মিঠাইকে শুইয়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফোন করে পুলিশ কে ।

পুলিশ আসলে পরমা বয়ান দেয় যে দাদা অবসাদে ভুগছিল তাই বৌদি ও মেয়েকে মেরে নিজে আত্মহত্যা করেছিল । ওকেও যে মারার চেষ্টা করে নি তা নয় কিন্তু ও নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে । পরে পরিবেশ ঠান্ডা হলে ঘর থেকে বেরিয়ে সবাইকে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করে ।

এসব ভাবতে ভাবতে পরমা খেয়াল করেনি কখন যেন মিঠাই ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে । পরমা হাত জোড় করে মিঠাইয়ের কাছে নিজের প্রাণ ভিক্ষা চাইছে । মিঠাই এগোচ্ছে ওর দিকে আর পরমা এক পা এক পা করে পিছিয়ে যাচ্ছে । পা টা খাটে আটকে ও চিৎ হয়ে পড়ে গেলো বিছানার উপরে । এমনিতেই বুক ধুকপুক অনেক গুণ বেশিই ছিল কিন্তু এবার যা দেখলো তাতে ওর প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠলো । সিলিং ফ্যান থেকে দাদার দেহটা ঝুলছে । কিন্তু দাদা যেন মিটি মিটি হাসছে ওর দিকে চেয়ে । উঠতে গেলো কিন্তু উঠতে পারলো না । দাদার পায়ে বুকে ধাক্কা খেয়ে আবার শুয়ে পড়লো ।

দাদার পায়ের ফাঁক দিয়ে চোখ চলে গেলো সামনের দিকে । এতক্ষণ মিঠাই একা ছিল কিন্তু মিঠাইয়ের পিছনে ওটা আবার কে ? বৌদি মনে হচ্ছে না ? হ্যাঁ , বৌদিই তো । সারা মুখটা রক্তে মাখামাখি । বাইরের বিদ্যুতের ঝলকানিতে বার বার মুখ গুলো পরিষ্কার হয়ে উঠছে । গলাটা একদম শুকিয়ে গেছে । ঢোক গিলতেও পারছে না । হঠাৎ করে কপালের পাশটায় তীব্র একটা আঘাত অনুভব করলো, তার পরেই যন্ত্রনা । হাত দিয়ে দেখলো গরম রক্ত বেরোচ্ছে ।

যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে খেয়ালি করে নি যে মিঠাই ওর পশে এসে বসেছে । ওর হাত দুটো উঠে আসছে পরমার গলার দিকে । হাতের বুড়ো আঙ্গুল দুটো চেপে বসেছে ওর গলায় । যন্ত্রনা সহ্যের সীমার বাঁধ ভাঙছে । চোখের সামনেটা সাদা হয়ে আসছে । খিলখিল করে হেসে উঠলো মিঠাই । দম নিতে পারছে না ।

পর দিন সকালে অনেক ডাকাডাকির পর রুমা যখন মালকিনের কোনো সাড়া পেলো না তখন পাশের ফ্ল্যাটে খবর দিলো । সবাই এসে দরজা খুলে মৃতা পরমাকে ঝুলন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করলো । সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছে নিথর দেহ টা ।

…………………………………….  (সমাপ্ত)  …………………………………..

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত