অভিশপ্ত ২

অভিশপ্ত ২

‘কালো বিড়াল দেখাটা অশুভ,’ বলল নাজিয়া ।
বিরক্ত চোখে ওর দিকে তাকালাম। হনিমুনে নির্জন ডাক বাংলোতে বেড়াতে এসেছি।

এখন এসব কালো বিড়াল নিয়ে পড়ে থাকার কী মানে! আর কালো বিড়াল কুসংস্কার হবে কেন? কিছুক্ষণ আগে নাজিয়া নাকি ডাক বাংলোর সামনে দুটো কালো বিড়াল ঘুরতে দেখেছে। ভাগ্য ভাল, তখন আমি পাশে ছিলাম না, নইলে দৌড়ে গিয়ে ওদের পাছায় লাথি মারতাম।

সত্যিকার অর্থে নাজিয়াকে আমার একদম অপছন্দ। পছন্দ করার মত মেয়েই নয় নাজিয়া। ব্যবহার ভাল, কিন্তু দেখতে কুৎসিত। তবে নাজিয়ার বাবা খুবই বড়লোক। ঢাকায় পাঁচ-পাঁচটা বাড়ির মালিক। সব শুনে আমার লোভী বাবার চোখ চকচক করতে লাগল। বিয়েটার ব্যাপারে একদমই রাজি ছিলাম না। যাকে নিয়ে সারাজীবন থাকব, তাকেই যদি পছন্দ না হয়, তা হলে সে বিয়ের কী মানে? কিন্তু বাবার চাপে আমাকে বিয়ে করতে হলো।

এ লোকটিকে ছোটবেলা থেকেই আমি খুব ভয় পাই। যাকে ভাল লাগে না, তার বাকি বিষয়গুলো আমাদের মন কেন যেন মেনে নিতে পারে না। নাজিয়ার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে কালো বিড়াল নিয়ে হয়তো এতটা বিরক্ত হতাম না। শত হলেও হানিমুনে এসেছি।

আমি পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। অল্প কয়েক বছরে বেশ কিছু প্রজেক্টে কাজ করে ভাল নাম করে ফেলেছি। নাজিয়ার বাবা কীভাবে যেন আমার খোঁজ পেয়েছিল। পাত্র হিসেবে আমি যে বেশ সজ্জন, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কোনও নেশা করি না। চা খাই, তাও মাঝে-মাঝে। নারীঘটিত সমস্যা থেকে পাঁচশ হাত দূরে। মাসে ইনকাম লাখ টাকার ওপরে। সব মিলিয়েই হয়তো নাজিয়ার বাবার আমাকে পছন্দ হয়েছিল, আর পুড়েছিল আমার কপাল। ইঞ্জিনিয়ারিং কাজে একবার তিন দিনের জন্যে এসে তখনই ডাক বাংলোটা চোখে পড়েছিল আমার। নিরিবিলিতে সময় কাটানোর জন্য উপযুক্ত জায়গা। আসলে আমি এসেছি ইঞ্জিনিয়ারিঙের কিছু বিষয় নিয়ে ভাবতে। হানিমুন-টানিমুন লোক দেখানো। বাপটা এ জায়গাতেও জোর খাটিয়েছে। নইলে নাজিয়াকে রেখেই আসতাম।

সারাদিন বসে-বসে কাজের প্ল্যানিং করছি। সামনে বড় কিছু কাজ পাওয়ার কথা। সেগুলো পেলে বহু টাকা পাব। নাজিয়া মুন্ধচোখে আমার কাজ দেখছিল। আমি দেখতে বেশ সুদৰ্শন। ও নিশ্চয় খুশি এ ব্যাপারে। দীর্ঘশ্বাস এলেও চেপে গেলাম। সবই কপাল। বিকেলের দিকে কাজ একটু বন্ধ রাখলাম। মাথা জ্যাম হয়ে গেছে। একটু আশপাশে ঘুরতে যাওয়ার দরকার, তা হলে কেটে যাবে জ্যামটা। একা যেতে পারলেই ভাল হত, কিন্তু সদ্য বিবাহিত নতুন বউকে এভাবে রেখে যাওয়া ভাল দেখায় না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওকে সঙ্গে নিতে হলো।

ফিরে এসে ডাক বাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল নাজিয়া। আমি একটু সামনে এগিয়ে গিয়েছিলাম। তখনই কালো বিড়াল দুটোকে দেখেছে নাজিয়া। রুমে গিয়ে জামাকাপড় চেঞ্জ করে হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। প্রচণ্ড মাথা-ব্যথা শুরু হয়েছে। এখন একটু ঘুমানো খুবই দরকার। নাজিয়াকে দেখে খারাপ হচ্ছে মেজাজটা। হায়, আল্লাহ্, শেষপর্যন্ত এমন একটা কানিকে আমার কপালে ঝুলিয়ে দিলে! একটু পরেই ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

ঘুমানোর কিছুক্ষণ পর কেন যেন আবছাভাবে মনে হলো আমাকে ধাক্কাচ্ছে কেউ । হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসলাম। নাজিয়া ভয়াৰ্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম ওকে দেখে একটু মায়া হলে আমার।

‘কী হয়েছে?’

‘ওই কালো বিড়াল দুটো ঘরের চারপাশে ঘুরছিল।’

এবার ভয়ানক বিরক্ত হলাম। ঘরের মধ্যে কালো বিড়াল আসবে কীভাবে? আমার ক্ষীণ সন্দেহ হলো, নাজিয়া কি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য এসব নাটক বানাচ্ছে? বিয়ের পরেই ও বুঝে গেছে, আমি ওকে পছন্দ করি না। না বোঝারও কিছু নেই। বিয়ে হয়েছে আমাদের একমাস, আমার নির্বিকারভাব ওর চোখে পড়ারই কথা। মেয়েরা বুঝতে পারে কে তাকে পছন্দ করে না। যদি অভিনয় জানতাম, তা হলে ভাল হত। আমি অভিনয় একেবারেই করতে পারি না। একটু ধমকের সুরেই বললাম, ‘রুমের ভেতর কালো বিড়াল আসবে কোথা থেকে? আর যদি আসেও, তো কোথায় গেল?’

‘তোমাকে যখন ধাক্কাচ্ছি, তখন দেখলাম কেমন যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।’

‘কালো বিড়াল কী বাতাস যে অদৃশ্য হয়ে যাবে? প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছে। এখন আমি আরও ঘুমাব,’ এই বলে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন ডাক বাংলোর পাশের রুমের রজত সাহেব আমার কাছে এলেন। প্রথম দিনই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। ভদ্রলোক পেশায় একজন ফটোগ্রাফার। এখানে নাকি প্রকৃতির কিছু ছবি তুলবেন।

‘ভাই, এই ডাক বাংলো সম্পর্কে কিছু শুনেছেন?’

‘কী শুনব?’ স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলাম।

‘এখানে দুটো আত্মা থাকে। যারা সাধারণত কালো বিড়াল হয়ে ঘুরে বেড়ায়।’

আত্মা-টাত্মার ব্যাপারে বিশ্বাস করি না। কিন্তু কালো বিড়াল প্রসঙ্গ আসতে কৌতূহলী হলাম। কারণ যতদূর জানি, মিথ্যা বলার মেয়ে নয় নাজিয়া। নিশ্চয়ই ওখানে কোনও ব্যাপার আছে।

‘ভাই, পুরো ব্যাপারটা খুলে বলেন।’

এই ডাক বাংলোটা অভিশপ্ত। এখানে অনেক আগে জনসন দম্পতি থাকত। জানা যায়, এরা মানুষ হিসেবে ভালই ছিল। সবার সঙ্গেই চম‌ৎকার সম্পর্ক। কিন্তু ওরা বিড়াল পছন্দ করত না। যদি কোনও বিড়াল ওদের বাসায় আসত, তবে বাগে পেলে পিটিয়ে মেরে ফেলত, নইলে ধরে জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মারত। লোকজন তাদের পছন্দ করলেও এ নিষ্ঠুরতা দেখে অবাক হত। বিড়াল একটা সামান্য প্ৰাণী, হয়তো খাবারের সন্ধানেই ঘরে ঢুকত। এভাবে অনেক বিড়াল মেরে ফেলে ওরা। একদিন কীভাবে যেন একরাতে এই ডাক বাংলোতে আগুন লাগল। জীবন্ত অবস্থায় পুড়ে কয়লা হয়ে গেল জনসন দম্পতি। তখনও পর্যন্ত এ জায়গার মায়া তারা ছাড়তে পারেনি। ওরা মারা যাওয়ার পর আবারও এখানে গড়ে তোলা হলো নতুন ডাক বাংলো। যেটাতে আমরা আছি। শুনেছি, মৃত্যুর পর কালো বিড়াল হয়ে এ বাড়িতে ঘুরে বেড়ায় জনসন দম্পতির আত্মা। তবে কখনও মানুষের কোনও ক্ষতি করেছে বলে জানা যায়নি।’

‘আপনি এসব আজগুবি বিষয় বিশ্বাস করেন?’

‘নিজের চোখে দেখা না পর্যন্ত আমি কিছুই বিশ্বাস করি না।’

‘আমিও…’

‘তবে, ভাই, আপনার এখান থেকে মনে হয় চলে যাওয়াই ভাল।’

‘কেন? এ কথা কেন বলছেন?’

‘ভাই, এখানে আত্ম-টাত্মা আছে নাকি তা জানি না, কিন্তু সদ্যবিবাহিত মেয়েদের এরা সাধারণত বিরক্ত করে। আপনাদের দেখলেই বোঝা যায় নিউ কাপল। আপনাদের না থাকাই মঙ্গল। যদি কিছু হয়ে যায়, দেখা যাবে সারাজীবন আফসোস করতে হবে।’

কিছু বললাম না। নাজিয়া যে বিড়াল দুটোর কথা বলছে, এখন মনে হচ্ছে তা মিথ্যে নয়। হয়তো দেখা যাবে বিড়াল দুটোই ওই-ই শুধুমাত্র দেখতে পায়।

পরদিন দুপুরের দিকে একটু ঝিমুনি এল। শুয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে টের পেলাম, কে যেন চেপে ধরেছে আমার গলা। চোখ মেলতেই দেখি নাজিয়া। পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে কালো বিড়াল দুটি। আমি ধাক্কা দিয়ে নাজিয়াকে সরিয়ে দিলাম। আর বেশিক্ষণ ওভাবে চললে আমি হয়তো মারাই যেতাম। ঠিক তখনই খেয়াল করলাম, অদৃশ্য হয়ে গেল কালো বিড়াল দুটি। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এখন আর মনে কোনও সন্দেহ নেই। আত্মা দুটি আমাদের বিপদে ফেলতে চাইছে! হয়তো সদ্যবিবাহিত মানুষদের ওপরেই ওদের রাগ!

অজ্ঞান হয়ে গেছে নাজিয়া। ওর মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরালাম। আর অর্ডার দিলাম, তখনই যেন গোছগাছ করে ফেলে। এ অভিশপ্ত বাংলোতে আর এক মুহূৰ্তও নয়। কোন্ কুক্ষণে যে এ বাংলোর খোঁজ পেয়েছিলাম। এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি পালানো যায়, ততই মঙ্গল। বেঁচে থাকতে জীবনে আর কখনওই এই ডাক বাংলোতে আসব না। যাওয়ার আগে অবশ্য একবার রজত সাহেবের সঙ্গে দেখা করব। আসলে এসব জায়গায় কেউই নিরাপদ নয়।

রজত সাহেবের রুমে ধাক্কা দিতেই খুলে গেল দরজাটা। ভিতরে তাকাতেই আঁতকে উঠলাম। বিছানায় পড়ে আছেন রজত সাহেব। কে বা কারা যেন আঁচড়ে দিয়েছে তার সারা মুখ। গাল-কপাল ক্ষত-বিক্ষত। গলায় দাগ দেখেই বুঝলাম, তাকে হত্যা করা হয়েছে গলা টিপে।

রুমে ফিরতেই নাজিয়াকে আর দেখতে পেলাম না। সব জায়গায় চেক করলাম, কিন্তু কোথাও নেই। ওয়াশরুমেও নেই।

কী ভয়ঙ্কর কথা! নাজিয়ার বাবা যদি এসব জানতে পারে, আস্ত রাখবে না আমাকে। খুবই প্রভাবশালী লোক সে। আমাকে কুকুরের মত গুলি করে মারবে।

হঠাৎ পাশের রুম থেকে শুনতে পেলাম নাজিয়ার চি‌ৎকার। নিরাপত্তার জন্যে আমার সঙ্গে সবসময় পিস্তল থাকে। ওটা হাতে ওদিকের রুমে গিয়ে দেখলাম, মানুষ আকৃতির দুটো জীব। হাত-পা, বডিসহ মানুষের মত, কিন্তু মুখ দুটো বিড়ালের। সারা গায়ে ঘন রোম। আমাকে দেখে একটু থমকে গেল। আমি ঠাণ্ডা মাথায় পর পর কয়েকটা গুলি করলাম মনুষ্যরূপী বিড়াল দুটিকে। ওরা ছিটকে পড়ল। কোলে তুলে নিলাম নাজিয়াকে। তখনও প্রাণ হারায়নি।

এরপর সব জিনিসের মায়া ত্যাগ করে একে নিয়ে পালিয়ে এলাম। জামাকাপড়-ব্যাগের দাম কোনওভাবেই জীবনের চেয়ে বেশি নয়।

সেদিন অল্পের জন্যই প্রাণ বেঁচেছিল আমাদের। নাজিয়াকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম নিজের জীবনের স্বার্থেই। নাজিয়াও তা বুঝতে পেরেছিল। ধীরে-ধীরে ও-ও কেমন আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। স্বামীর অবহেলা কোনও মেয়েই সহ্য করতে পারে না। ও যতই দূরে সরে যাচ্ছিল, ততই যেন আকৰ্ষিত হচ্ছিলাম। কারণ আমি ততদিনে বুঝতে পেরেছি, কোনও মেয়ের রূপই চূড়ান্ত কথা নয়, গুণই আসল। নাজিয়ার গুণের শেষ নেই। দূরে সরে গেলও ও যে আমাকে ভালবাসত, তা বুঝতাম। আমি বাসায় না আসা পর্যন্ত ও খেত না। যেদিন কাজের চাপে বাসায় ফিরতাম না, খাবারই খেত না। মা ওকে শত চেষ্টা করেও খাওয়াতে পারত না। অফিসের কর্মচারীকে ফোন করে জানত, দুপুরে খেয়েছি নাকি। একদিন আমার প্রচণ্ড জ্বর। সারারাত পাশে জেগে বসে রইল। আসলে ওর সব ব্যস্ততা আমাকে ঘিরেই। সুন্দরী কোনও মেয়ে হলে ও হয়তো নিজেকে নিয়েই বেশি মেতে থাকত। আমার বাবা মেয়ে চিনতে যে ভুল করেননি, তা বুঝতে পেরেছি। একদিন হঠাৎ নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে ফেললাম, ‘আই লাভ ইউ!’

ভীতা কপোতীর মত কাঁপতে লাগল ও। শুধু মৃদুস্বরে একবার বলল, ‘মি, টু!’

………………………………………..  (সমাপ্ত)  ……………………………………….

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত