মাঘ মাস। শীতের রাত। পৌনে এগারোটা বাজে।
মোবারক হোসেন বসার ঘরের চৌকির উপর আসন করে বসে দোকানের হিসেবের খাতা-পত্ৰ মিলিয়ে দেখছেন। তিনি গায়ে একটা পাতলা কম্বল জড়িয়ে নিয়েছেন।
কয়েক দিন ধরে ভয়াবহ শীত পড়ছে। গায়ে কম্বল জড়িয়েও শীত যেন ঠিক মানছে না।
মোবারক হোসেনের স্ত্রী আম্বিয়া বেগম শুতে যাবার আগে এসে বললেন, ‘তোমার ভাত বেড়ে রেখেছি। খেয়ে নিয়ো।’
মোবারক হোসেন নুয়ে-নুয়ে হিসেবের খাতা-পত্র দেখারত অবস্থায়ই মাখা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’
আম্বিয়া বেগম চলে যাবার পর মোবারক হোসেন আবার এক মনে হিসেব-পত্র দেখতে থাকলেন। হঠাৎ শুনতে পেলেন কে যেন জোরে-জোরে দরজার কড়া নাড়ছে।
অস্থির ভঙ্গিতে দরজার কড়া নেড়েই যাচ্ছে।
মোবারক হোসেন এক মুহূর্ত ভুরু কুঁচকে ভাবলেন, এত রাতে আবার কে এল! এরপর তিনি উঠে গিয়ে দরজা খুললেন।
দরজা খুলে দেখেন, দরজার সামনে বয়স্ক একজন তোক দাঁড়ানো। লোকটার পরনে নোংরা ন্যাকড়ার মত পাঞ্জাবি আর তেমনই রং জ্বলা চেক লুঙ্গি। রোগা হাড় জিরজিরে শরীর। ভাঙা গাল। মুখ ভৰ্তি খোঁচা-খোঁচা সাদা দাড়ি। দাড়িয়ে রয়েছে কুঁজোদের মত বাঁকা হয়ে। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে। বুকের সঙ্গে আগলে চেপে ধরা কাপড়ের একটা পোঁটলা। মুখখানা শুকনো ফ্যাকাসে। চোখ দুটো ভেজা।
মোবারক হোসেন বিরক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী চাই? ’
লোকটা মোবারক হোসেনের সামনে হাত জোড় করে, ধরা গলায় বলল, ‘বাবাবাজি, খুব খিদা পাইছে। দুই দিন ধইরা কিছু খাই নাই। মেহেরবানি কইরা আমারে কিছু খাইতে দেন।’
মোবারক হোসেন ধমকে উঠলেন, ‘এত রাতে খাবার দেব কোথ্থেকে?’
সঙ্গে-সঙ্গে লোকটা ভেউ-ভেউ করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে-কাঁদতে মোবারক হোসেনের সামনে উপুড় হয়ে বসে, মোবারক হোসেনের পা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বাবাবাজি, এটু দয়া করেন যা কিছু একটা খাইতে দেন!’
মোবারক হোসেনের মন গলল। তিনি নরম গলায় বললেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, আগে পা ছাড়ুন। দেখি কী খেতে দেয়া যায়। আসুন, ঘরের ভিতরে আসুন-শীতে বাইরে দাঁড়ানো যাচ্ছে না।’
লোকটা মোবারক হোসেনের পা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, চোখের পানি মুছতে-মুছতে মোবারক হোসেনের পিছু পিছু ঘরের ভিতরে ঢুকল।
মোবারক হোসেন লোকটাকে বসার ঘরের চৌকির উপর বসার ইশারা করে ভিতরে চলে গেলেন।
মোবারক হোসেন ভেবেছিলেন লোকটাকে মুড়ি, মুড়কি, নাড়ু বা বিস্কিট এই জাতীয় কোনও শুকনো খাবার খেতে দেবেন। কিন্তু খুঁজে দেখলেন মুড়ির টিন, মুড়কি-নাড়ু-বিস্কিটের বয়াম, সব একেবারে খালি। তাঁর জন্য বেড়ে রাখা ভাত ছাড়া লোকটাকে খেতে দেবার মত ঘরে আর কিছুই নেই। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁর জন্য রাখা ভাতই লোকটাকে খেতে দেবেন। তিনি না হয় এক রাত না খেয়েই থাকলেন।
মোৰাৱক হোসেন লোকটার জন্য ভাত নিয়ে এসেছেন। ভাত, নতুন আলু দিয়ে রান্না করা মুরগির সালুন আর ডাল চচ্চড়ি।
লোকটাকে চৌকির উপরই খেতে বসিয়েছেন। লোকটা কোনওক্রমে হাতটা ধুয়েই খাওয়ার জন্য একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল। হাভাতের মত নাকে-মুখে গোগ্রাসে গিলতে লাগল।
লোকটার খাওয়া দেখে মোবারক হোসেনের খুব মায়া লাগল। আহারে! বেচারার কী খিদেই না লেগেছে!
মোবারক হোসেন দরদমাখা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার বাড়ি কোথায়?’
লোকটা মুখ ভর্তি ভাত নিয়ে বলল, ‘চহুতপুর।’
মোবারক হোসেন অবাক গলায় বললেন, চহুতপুর তো এখান থেকে অনেক দূরে! এত রাতে অত দূর যাবেন কীভাবে?’
লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘জানি না, বাবাজি’
‘আপনার নাম কী? আপনি কী করেন?’
‘আমার নাম দুদু মিয়া। আমি একজন গাছি। শীতকালে খেজুর গাছের রস কাটি।’
‘এই বয়সেও গাছে উঠতে পারেন?’
লোকটা থমকে খাওয়া থামিয়ে, অসহায় চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘না, বাবাজি! কয়েক বছর আগে গাছ থেইক্যা পইড়া কোমরে ব্যতা পাই। হেই থেইক্যা আর গাছে উঠি না।’
মোবারক হোসেন লক্ষ করলেন, খাওয়ার সময়ও লোকটা সঙ্গে থাকা পোঁটলাটা বাম হাতে আগলে বুকের সঙ্গে চেপে রেখেছে। কে জানে কী আছে ওই পোঁটলার মধ্যে।
লোকটার খাওয়া শেষ। সে ভাতের থালার মধ্যেই হাত ধুয়ে ফেলল। নিজের লুঙ্গির খুঁট দিয়ে মুখ-হাত মুছতে-মুছতে তৃপ্তির একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘বাবাজি, অনেক শুকরিয়া! আল্লাহ আফনের আয়ু দশগুণ বাড়াইয়া দেউক!’
লোকটা দু’হাতে পোঁটলাটাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে উঠে দাঁড়াল চলে যাবার জন্য। তাই দেখে মোবারক হোসেন বললেন, ‘বাইরে তো অনেক ঠাণ্ডা! এত রাতে, এই শীতের মধ্যে-অত দূর আপনার বাড়ি যাবেন কীভাবে?! তারচেয়ে আজকের রাতটা আপনি আমার বাড়িতেই কাটিয়ে দিন। একটা বালিশ আর কম্বল এনে দিচ্ছি, এই চৌকির উপরই শুয়ে পড়ুন। কাল সকালে উঠে চলে যাবেন।’
কথাটা শুনে মুহুর্তে লোকটার চোখ ভিজে উঠল। চোখের পানি মুছতে-মুছতে আনন্দ বিগলিত গলায় বলল, ‘বাবাজি, আফনের মত ভাল মানুষ এহনও দুনিয়ায় আছে বইল্যাই দুনিয়া টিইক্যা আছে!’
মোবারক হোসেন বালিশ আর কম্বল এনে দিলেন। লোকটা পোঁটলাটাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল।
সকালে ঘুম ভাঙার পর মোবারক হোসেন প্রথমেই বসার ঘরে এলেন লোকটার খোঁজ নিতে। এসে দেখেন লোকটা নেই। মোবারক হোসেনের মনটা একটু খারাপ হলো। যাওয়ার সময় লোকটা তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়েও গেল না!
গতরাতে লোকটাকে ঘুমানোর জন্য দেয়া বালিশ-কম্বল আলুথালু অবস্থায় চৌকির উপর পড়ে রয়েছে। আরে! চৌকির উপরে তো লোকটার পোঁটলাটাও পড়ে রয়েছে। ভুলে পোঁটলাটা ফেলে রেখেই চলে গেছে। অথচ সারাক্ষণই পোঁটলাটাকে কত সযত্নে নিজের বুকের সঙ্গে আগলে রেখেছিল। নিশ্চয়ই ওই পোঁটলার মধ্যে লোকটার গুরুত্বপূর্ণ কিছু রয়েছে। বয়স্ক মানুষ! পোঁটলাটা নিতে আবার এত দূর পথ পাড়ি দিয়ে আসবে। তারচেয়ে মোবারক হোসেন নিজে গিয়ে পোঁটলাটা লোকটার হাতে পৌঁছে দিয়ে এলে কেমন হয়? তার মোটর বাইক আছে। মোটর বাইকে চেপে চহুতপুর যেতে-আসতে ঘন্টাখানিকের বেশি সময় লাগবে বলে তো মনে হয় না।
মোবারক হোসেন মোটর বাইকে চেপে চহুতপুর এসে পৌছেছেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দুদু মিয়ার বাড়িটা পেয়েছেন। বাড়ি না বলে ছোট্ট একটা ঝুপড়ি কুঁড়ে ঘর বলা ভাল। ঘরের সামনে এক চিলতে উঠান।
উঠান ভর্তি অনেক লোকজন। মোবারক হোসেন উঠানের এক পাশে মোটর বাইকটা দাঁড় করিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। মধ্যবয়স্ক একজন লোককে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা দুদু মিয়ার বাড়ি না? যে খেজুর গাছের রস কাটত?’
মধ্যবয়স্ক ভদ্ৰলোক বললেন, ‘জী, এটা দুদু মিয়ার বাড়ি। আপনি কে? আপনাকে তো চিনলাম না!’
‘আমি নয়কান্দা থেকে এসেছি। হাতের পোঁটলাটা সামনে তুলে ধরে বললেন, ‘দুদু মিয়া আজ ভোরে ভুলে তাঁর এই পোঁটলাটা আমার বাড়িতে ফেলে এসেছেন। তাই এটা ফেরত দিতে এসেছি।’
মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক গলার স্বর কিছুটা উঁচু করে বললেন, ‘ভাইজান, আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না! একটু খোলসা করে বলেন তো। দুদু মিয়া আজ ভোরে আপনার বাড়িতে…মানে?’
মোবারক হোসেন বললেন, ‘আজ ভোরে নয়, তিনি আমার বাড়িতে গিয়েছিলেন গতরাতে এগারোটা-সোয়া এগারোটার দিকে। খুবই ক্ষুধার্ত ছিলেন। আমার কাছে খাবার চান। আমি তাকে ভাত খাওয়াই। এরপর আমার বাড়িতেই রাতটা কাটিয়ে যেতে বলি। সকালে উঠে… ’
সব শোনার পর বিস্ময়ে মধ্যবয়স্ক লোকটার চোখ কপালে উঠল। বিস্ময়ে বুজে আসা গলায় তিনি কোনওক্রমে বললেন, ‘তা কী করে সম্ভব!? দুদু মিয়া তো গতকাল সন্ধ্যা রাতেই মারা গেছেন! রাত এগারোটা-সোয়া এগারোটায় তিনি আপনার বাড়িতে যাবেন কীভাবে?’
মোবারক হোসেন সাংঘাতিক অবাক হওয়া গলায় বলে উঠলেন, ‘কী বলছেন! দুদু মিয়া গতকাল সন্ধ্যা রাতে মারা গেছেন?! তা হলে আমার বাড়িতে কে রাত কাটিয়ে গেল?’
‘হ্যাঁ! বিশ্বাস না হলে ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে দেখেন, এখনও তাঁর লাশ ঘরের মধ্যে পড়ে রয়েছে। আমরা এখন পর্যন্ত তাঁর দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করতে পারিনি। লোকটা খুবই গরিব। তিন কুলে তাঁর কেউ নেই। কয়েক বছর আগে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে কোমরে ব্যথা পান। সেই থেকে বিছানায়ই পড়ে ছিলেন। লোকের বাড়ি থেকে দয়া করে কেউ কিছু খেতে দিয়ে গেলে, তাই খেয়ে থাকতেন। শেষ পর্যন্ত বোধহয় না খেতে পেয়েই মারা গেছেন। এই গ্রামের প্রায় সবাই-ই অত্যন্ত দরিদ্র। এখন মৃত্যুর পরও লোকটার কাফনের টাকা জোগাড় করতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। তাই তো কাল সন্ধ্যায় মারা গেছেন অথচ এখন পর্যন্ত দাফন-কাফনের ব্যবস্থা হয়নি।’
মোবারক হোসেন এবং মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকের কথাবার্তা শুনে এমুহূর্তে উপস্থিত অন্যান্যরাও এসে তাঁদের ঘিরে দাঁড়িয়েছে।
মোবারক হোসেনের মনে সন্দেহ জাগল, এই দুদু মিয়া হয়তো সেই দুদু মিয়া নয় যে গতরাতে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। তিনি ভুল করে অন্য কোনও দুদু মিয়ার বাড়িতে এসে পড়েছেন।
সন্দেহকে বিশ্বাসে রূপ দিতে মোবারক হোসেন লাশটাকে দেখার জন্য ঘরের ভিতরে উঁকি মারলেন। ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা লাশটাকে এক নজর দেখেই তাঁর মাথায় চক্কর মেরে উঠল। আশ্চর্য! এই দুদু মিয়া তো সেই দুদু মিয়াই। সেই হাড় জিরজিরে চেহারা! মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। পরনে ন্যাকড়ার মত পাঞ্জাবি আর রং জ্বলা চেক লুঙ্গি!
মোবারক হোসেন মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলেন। তার আগেই পাশে থাকা অন্যরা তাঁকে ধরে ফেলেন।
চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে এবং পানি খাইয়ে মোবারক হোসেনকে কিছুটা সুস্থির করে তোলা হলো। এবার সবাই তাঁর হাতে ধরা পোঁটলার দিকে তাকিয়ে কৌতূহলী গলায় বলাবলি করতে লাগল, ‘আচ্ছা, ওই পোঁটলার মধ্যে কী আছে-খুলে দেখতে হয়।’
পোঁটলা খুলে দেখা গেল, ওটার ভিতরে কাফনের কাপড় আর আতর-লোবান-কপূর-আগরবাতি…অর্থাৎ একজন মৃত ব্যক্তিকে দাফন-কাফন করার জন্য যা-যা প্রয়োজন, সেসব।
………………………………………… (সমাপ্ত) ……………………………………….