প্রতি বুধবার শ্রীনগর বিক্রমপুর হাসপাতাল থেকে ঢাকা ফেরার পথে সিরাজদিখানের কলেজ গেটের মোড়ে রাস্তার বাম পাশে জামগাছের সাথে টানানো সাইনবোর্ডটা আমার চোখে পড়ে।
‘কুচিয়ামোড়া হইতে সৈয়দপুর
দূরত্ব ৫ কিলোমিটার
সৌজন্যে নবাব চেয়ারম্যান।’
প্রতি বুধবার বললাম এই জন্য যে, এই দিনে আমি দুপুরের দিকে ঢাকা থেকে শ্রীনগর চলে যাই। তাঁতিবাজারের মোড় থেকে মাওয়াগামী স্বাধীন এক্সপ্রেস কিংবা আরাম বাসে উঠলে শ্রীনগর ফেরিঘাটে পৌঁছতে লাগে মাত্র চল্লিশ কি পঁয়তাল্লিশ মিনিট। ওখান থেকে রিকশায় উঠলে মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। ঝুমুর সিনেমা হলের সাথে ডা. দীলিপ মণ্ডলের গড়া বিক্রমপুর হাসপাতাল। যদিও হাসপাতালটি ডা. দীলিপ মণ্ডলের গড়া, কিন্তু সেটা সার্বক্ষণিক দেখা-শোনা করে তার দুঃসম্পর্কের ভাই সনাতন মণ্ডল। আমি গত ছ’মাস ধরে ডা. দীলিপের অনুরোধে ওখানে গিয়ে রোগী দেখছি।
বুধবার ঠিক বিকাল তিনটা থেকে রোগী দেখা শুরু করি । সন্ধ্যা ছ’টার মধ্যে রোগী দেখা শেষ করে আবার রওনা দিই ঢাকার উদ্দেশে। শ্রীনগর যাবার পথে সাইনবোর্ডটা তেমন নজরে পড়ে না, কারণ যাবার সময় ওটা থাকে ডান দিকে। কিন্তু ফেরার সময় ওটা ভীষণভাবে চোখে পড়ে। আমি খুব আকর্ষণ বোধ করি। খুব ইচ্ছে জাগে ওই পাঁচ কিলোমিটার রাস্তাটা ঘুরে দেখতে।
‘কুচিয়ামোড়া হইতে সৈয়দপুর।
দূরত্ব ৫ কিলোমিটার
সৌজন্যে নবাব চেয়ারম্যান।’
খুব সাদামাঠাভাবে লেখা সাইনবোর্ডটি, আর দশটা সাইনবোর্ডের মতই। সোজা ঢাকার দিকে চলে গেছে পিচ ঢালা পথ। আর ঠিক বাঁ দিকে চলে গেছে লাল ইট বিছানো রাস্তা। ওটাই নির্দেশিত সৈয়দপুরের পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা। রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বিস্তৃত খাল। খালটার নাম আমার জানা হয়নি কখনও। রাস্তার ওপর থেকেই বোঝা যায় খালের পানি বেশ স্বচ্ছ। মৃদু বাতাসে ঢেউ খেলে যায় পানিতে। খুব সুন্দর দৃশ্য। কিন্তু ওসব কিছুই নয়, সাইনবোর্ডের লেখা আমাকে টানে। বুঝতে পারি এই লাল ইট বিছানো রাস্তাটা সৈয়দপুর যাবার রাস্তা, আর কলেজ গেটের মোড়ের এই জায়গাটির নাম কুচিয়ামোড়া। অনেকদিন ভেবেছি, একদিন বেশ সকাল-সকাল ফিরব, তারপর নেমে পড়ব এখানে। ইট বিছানো রাস্তা দিয়ে হাঁটব, দেখব সামনে কী আছে। সামনে কি আসলেই কিছু আছে?
কোন প্রাচীন ভবন?
কোন ধ্বংসস্তূপ?
অথবা দর্শনীয় কিছু?
মনে হয় না।
যদি সেরকম কিছু থাকত, বিজ্ঞাপন দেয়া থাকত বিশাল করে। স্যর জগদীশ চন্দ্র বসুর বাড়িটাকে যে পিকনিক স্পট করা হয়েছে সেটার বিজ্ঞাপন মাইলের পর মাইল জুড়ে দেয়া হয়েছে। একটু পরপর চোখে পড়ে ভূঁইয়া মেডিক্যাল কলেজের বিজ্ঞাপন। প্রতিদিন সেসব পথে প্রচুর মানুষ যাচ্ছে আর আসছে।
কিন্তু ‘কুচিয়ামোড়া হইতে সৈয়দপুর/দূরত্ব ৫ কিলোমিটার/সৌজন্যে নবাব চেয়ারম্যান’ নিতান্তই একটা সাইনবোর্ড। ওই বাঁয়ে মোড় নেয়া ইট বিছানো রাস্তায় আমি কোন গাড়ি তো দূরের কথা, রিকশা-ভ্যানও যেতে দেখি না। এমনকি কাউকে কখনও হেঁটে যেতেও দেখিনি। হয়তো একটা সাধারণ, খুবই সাধারণ গ্রাম হবে ওটা। হয়তো নবাব নামের কোন এক চেয়ারম্যান, কিংবা তার নামে কেউ একজন কোন একদিন লাগিয়েছিল এই সাইনবোর্ড, জায়গাটা চেনার জন্য, কিন্তু কাউকে আমি ওই সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতেও দেখিনি, যেমনটি আমি আগ্রহভরে তাকিয়ে থাকি। আমাকে খুব টানে ওটা। নিজের মনে নিজেই হেসে উঠি, আমাকেই শুধু টানে?
কিন্তু কখনওই আমার নামা হয় না ওখানে। কারণ বাস ওখানে থামে না। বাস থামে আরও সামনে গিয়ে, নিমতলী বাজারের কাছে।
প্রথম দু’সপ্তাহ আমি শ্রীনগরে প্রাইভেট কারে করে গিয়েছিলাম। তাই শুনে আমার এক অনুজ ডাক্তার বলল, ‘ভাই, এসব রাস্তায় প্রাইভেট কার নিয়ে যাবেন না। কখন কী দুর্ঘটনা ঘটে!’
আমি তার কথা গ্রাহ্য করিনি। কিন্তু চোখের সামনে একই দিনে তিনটি অ্যাকসিডেন্ট দেখার পর আমি প্রাইভেট কার ছেড়ে দিয়ে বাস ধরি।
এভাবে দেড়টি বছর কেটে যায়।
আমার চেম্বার জমজমাট হয়ে ওঠে।
এখন ফিরতে-ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়।
একদিন সনাতন মণ্ডল আমাকে বলল, ‘স্যর, আপনি আরও একটা দিন আমাদের সময় দেন।’
আমি বললাম, ‘সেটা সম্ভব নয়, সনাতন বাবু। ঢাকায় আমার চেম্বার আছে।’
সনাতন নাছোড়বান্দা, বলল, ‘স্যর, এখানে একদিনে আপনার যে ইনকাম হবে, ঢাকাতে পুরো সপ্তাহেও সেটা হবে না।’
আমি বললাম, ‘সনাতন বাবু, আপনি জানেন আমি কখনও টাকার পেছনে ঘুরি না। আমি চেম্বার করি হচ্ছে… ’
সনাতন আমার কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘জানি, স্যর, মানুষের সেবার জন্য। তবু বাজিয়ে দেখলাম। মানুষ বাজাতে আমার ভাল লাগে।’
আমি বললাম, কিন্তু আমাকে বাজাতে আসবেন না। একেবারে সারকামসিশন করে ছেড়ে দেব।’
সনাতন বলল, ‘ছি-ছিহ্, স্যর, মাইণ্ড করলেন! আপনার সাথে একটু মজাও করা যায় না। ঠিক আছে, বসার দরকার নেই। তবে বলেছি এজন্য যে, রোগীদের অনেক উপকার হয়। এদিকটায় কোন অর্থোপেডিক ডাক্তার নেই। ঢাকায় গিয়ে ডাক্তার দেখাবে সে সঙ্গতিও এদের নেই। আপনি যদি আরেকটা দিন বসতে না চান, আমি তো জোর করতে পারি না, স্যর।’
আমি তাকালাম লোকটার দিকে। শুকনো, পাতলা শরীর। মাথায় বিশাল টাক। ধূর্ত চোখ।
‘দেখি, ভেবে দেখব।’ আমি বললাম।
সনাতন বলল, ‘শনিবার আসেন। ওই দিন তো শুনেছি আপনি ফ্রি থাকেন। বারোটার আগেই চলে আসবেন। এখানে এসে বিশ্রাম নেবেন। তারপর দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে রোগী দেখা শুরু করবেন। সন্ধ্যার আগেই আশা করি একশ’ রোগী দেখা শেষ করতে পারবেন।’
আমি বললাম, “ঠিক আছে, আমি আসব। এখন যাই। নেক্সট শনিবার তাহলে দেখা হবে। কাউকে বলুন ফেরিঘাট পর্যন্ত একটা রিকশা ঠিক করে দিতে।’
‘রিকশা রেডি আছে, স্যর। আগেই ডেকে রেখেছি। ভাড়া দেয়া লাগবে না। ভাড়া দেয়া আছে। আপনি, স্যর, রিকশায় গিয়ে উঠুন, ফার্মেসির ছেলেটা আপনার ব্যাগ রিকশায় তুলে দিয়ে আসবে।’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা, চলি তাহলে। বাই।’
আমি রুম থেকে বেরিয়ে দরজার পাশে জুতো পরছি, শুনি পেছনে সনাতন চাপা স্বরে হাসছে, আর বলছে, ‘আমি শালা মানুষ বাজাই। মানুষ বাজানোই আমার কাম। আসবে না আবার? একশ’ রোগী। চারশ’ টাকা কইরা দিলে একদিনেই চল্লিশ হাজার টাকা পকেটে।’
ভেবেছিলাম আমি শনিবার যাব না। কিন্তু গেলাম না, টাকার লোভে নয়। সত্যিকার অর্থে আমি গরীব রোগীদের সেবাদানের জন্যই গেলাম। আমি কখনও কোন্ রোগী আমাকে কত ভিজিট দিল সেটা খেয়াল করি না। পেশাগত জীবনের শুরু থেকেই মানুষকে সেবা প্রদান আমার কাছে পরম কর্তব্য বলে মনে হয়।
শনিবার কাঁটায়-কাঁটায় ঠিক বারোটায় আমি বিক্রমপুর হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম। সনাতন অভ্যর্থনা জানাল আমাকে।
‘আসেন, স্যর। খুব খুশি হয়েছি আপনি এসেছেন। একজন রোগীকেও বসিয়ে রেখেছি আপনার জন্য। সে প্রাইভেট টক করতে চায় আপনার সাথে। ফাজিল রোগী। আমাকে কিছু বলতে চায় না। তবে পীড়াপীড়ি করতে বলল, গোপন রোগ। আমি বললাম, স্যর তো অর্থোপেডিক ডাক্তার। ফাজিলটা চোখ টিপে বলল, “স্যর গোপন রোগের চিকিৎসা জানে, পেপারে তার লেখা পড়ি।” আমি, স্যর, ভিজিট আটশ’ টাকা কইছি। সে রাজি হইছে। আপনি যেন, স্যর, কম নিয়েন না। স্যর, বোঝেনই তো, কম ভিজিট মানে সস্তা ডাক্তার। আমাদের হাসপাতালের একটা আলাদা দাম আছে।’
‘আচ্ছা, আপনি রোগী পাঠান। ভিজিটের বিষয়টা আমি দেখব। কিন্তু আপনি না বলেছিলেন একশ’টা রোগী হবে?’
সনাতন বলল, ‘রোগীরা আসবে দুইটার পর থেকে। আপনি এই রোগীটা দেখার পর কাঁচা আমের শরবত খেয়ে একটু বিশ্রাম নেন। ভাগ্যকুল রোড থেকে কাচ্চি বিরিয়ানি আনাচ্ছি। দারুণ স্বাদ। দুই প্লেট একবারেই খাওয়া যায়। আপনি চেম্বারে বসুন, স্যর। আমি আবুলটাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
আমি বললাম, ‘আবুল কে?’
‘ওই রোগীটা। মাথায় ছিট আছে, তাই আবুল বললাম। সরি, স্যর। তবে কথা বললেই বুঝবেন। যদিও আমাকে কিছু বলে নাই, তবু এক নজর দেখলেই বুঝতে পারি। স্যরের হয়তো মনে আছে, মানুষ বাজানোই… ’
‘ওকে পাঠিয়ে দিন,’ একটু চড়া গলায় বললাম আমি।
লোকটার চেহারায় বিশেষত্ব কিছু নেই। রুমে ঢুকে আমার সামনের চেয়ারের হাতল ধরে দাঁড়াল। আমি তাকে বসতে বললাম। সে রুমের চারদিকে চোখ বুলিয়ে মৃদু স্বরে বলল, ‘ধন্যবাদ, স্যর, তবে আশা করছি আমাদের কথা আর কেউ শুনবে না।’
‘না, শুনবে না।’ আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম।
‘ওই সনাতন হারামজাদাকে উঁকি মারতে নিষেধ করেন, আমি কিন্তু ওর কলজে চিবিয়ে খাব।’
‘সনাতন বাবু,’ আমি জোর গলায় বললাম, ‘আপনি দরজার পাশ থেকে চলে যান।
বাইরে থেকে দরজায় মৃদু লাথি মারল সনাতন।
আমি লোকটিকে বললাম, ‘বসুন এবার। কী নাম আপনার বয়স কত?’
লোকটি চেয়ার ধরে দাঁড়িয়েই থাকল। বলল, ‘আমার নাম? কী হবে আমার নাম দিয়ে? মানুষ তো প্রতিনিয়ত তার নাম বদলাতে পারে, এবং বদলাচ্ছে। আর বয়স? কে বলতে পারে তার আসল বয়স কত?’
সনাতনের কথা আমার মনে পড়ল-‘মাথায় ছিট আছে।’ আমি একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বললাম, ‘ডাক্তারের কাছে এসে প্রথমে নাম আর বয়স বলতে হয়।’
লোকটা ঘোঁৎ করে শব্দ করল।
‘মাফ করবেন, স্যর। আমি আসলে নাম বলতে চাইনি এ কারণে যে, আমাকে আপনি চেনেন না। আমি যে কোন একটা নাম বলতেই পারি, এবং আপনিও সেটা বিশ্বাস করতে বাধ্য। কিন্তু আপনি যদি আমাকে চিনতেন, কিংবা আমার কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র থাকত, তাহলে অবশ্যই আমি আমার আসল নাম বলতাম। কারণ সেখানে লুকোচুরির কোন সুযোগ থাকত না। আর বয়সের কথা বলছেন? সত্যি বলছি, আমি আমার বয়স ভুলে গেছি। স্যর, সনাতন কিন্তু আবার এসে দরজায় কান পাতছে। আপনি যদি অনুমতি দেন, আমি ওর কলজেটা ছিঁড়ে এনে খেতে পারি। কলজে চেনেন, স্যর? মেডিকেল পরিভাষায় এর নাম হার্ট। মানে হৃৎপিণ্ড।’
‘বাদ দিন, রসিকতার সুরে বললাম আমি। ‘সনাতন হচ্ছে তালপাতার সেপাই। ছোটখাট শুকনো মানুষ। ওর কলিজাও হবে এই এট্টুখানি, মুরগির কলিজার মত। খেয়ে মজা পাবেন না। তারচেয়ে আপনি বসুন। ধীরে-সুস্থে বলুন আপনার সমস্যাটা কী।’
‘হুম, খেয়ে মজা পাব না।’ মাথা নেড়ে বলল লোকটা। ‘নইলে কসম খেয়ে ফেলতাম। ওর মাংস খেয়েও স্বাদ পাব না। সেই সকাল থেকে বসে আছি। খুব খিদে পেয়েছে।’
ওর কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যে আমি এটাকে আর রসিকতা ভাবতে পারলাম না। ‘আপনি এসব কী বলছেন?’
লোকটা হেসে উঠল। এই প্রথম লক্ষ করলাম তার দাঁতগুলো গাছের শেকড়ের মত। আমার শরীর শিরশির করে উঠল।
‘ভয় পাবেন না, স্যর, আপনার কোন ক্ষতি আমি করব না। শুধু এই অভিশপ্ত জীবন থেকে আপনি আমাকে মুক্তি দিন।’ খুব নরম শোনাল লোকটার কণ্ঠ।
অস্বীকার করব না, আমি খুব অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। কী বলছে সে? আফ্রিকার কিছু উপজাতি রয়েছে তারা নরমাংসভোজী। মাঝে-মাঝে পত্রিকায় দু’একটি ঘটনার কথা পড়ি। কিন্তু সে সব বিদেশে। বাংলাদেশে একবার পড়েছিলাম খলিলুল্লাহ নামের এক লোক মৃত মানুষের কলিজা খেত কবর খুঁড়ে। আর এখন, আমার সামনের এই লোকটা নরমাংসভোজী ভাবতেই মনের অজান্তে কেঁপে উঠলাম।
‘এটাই কি আপনার গোপন রোগ? এটি বলার জন্যই সকাল থেকে বসে আছেন? এর চিকিৎসা তো আমি করতে পারব না। এটি আপনার সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার। মেন্টাল ডেভিয়েশন। আপনার উচিত ছিল একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো। তার কাছে যাওয়া।’ আমি কিছুটা নার্ভাস গলায় বললাম।
‘না।’ কঠিন গলায় বলল লোকটা।
‘কী-না?’
‘এটি আমার গোপন রোগ নয়।’ লোকটি চেয়ার সরিয়ে আরেকটু সামনে এল। তার শরীর থেকে মাটির গন্ধ ভেসে এল।
‘এটি আমার গোপন রোগ নয়,’ পুনরাবৃত্তি করল সে। আপনি জীবিকা নির্বাহ করেন। আপনার প্রয়োজনীয় খাবার খেয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কী খান আপনি? ভাত, সবজি, মাছ, মাংস, ডাল? মাংস বলতে আমি গরু, খাসি বা মুরগির মাংস বুঝিয়েছি। সবই তেল, মশলা দিয়ে চমকার রান্না করা!’
আমি মৃদু মাথা নাড়লাম। ‘গরুর মাংসটা আমি বেশি পছন্দ করি।’
লোকটা আরেক পা এগোল। ‘কিন্তু নিয়তি আমার জন্য মানুষের মাংস নির্ধারণ করেছে, স্যর। সেই কোন্ আমল থেকে কোন কবরের মধ্যে আপনি কোন লাশের ছিটেফোঁটাও দেখবেন না, সব আমি খেয়ে সাবাড় করেছি।’ একটু থামল সে। হাঁপাল। তারপর মৃদুস্বরে বলল, ‘কুচিয়ামোড়া থেকে সৈয়দপুর পর্যন্ত।’
আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ঘাম ছুটল।
লোকটা বলল, ‘নামটা আপনার খুব পরিচিত, জানি, স্যর। তৃষ্ণার্ত চোখে আপনি ওই সাইন বোর্ডটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা। আমি ওখানকার কবরগুলোর কথা বলছি। ওই কবরের মানুষগুলোই আমার খাদ্য। কোন দোষ নেই আমার। এটা নিয়তি নির্ধারিত। কিন্তু এখন আর আমার ভাল লাগে না।’
আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। ফিসফিস করে বললাম, ‘কী চান আপনি? এখানে কেন এসেছেন?’
‘ভয় পাবেন না, স্যর,’ লোকটি বলল। ‘আমি আপনার কোন ক্ষতি করব না। আমি এসেছি আপনাকে নিতে। খুব ভাল লাগবে জায়গাটা। কেউ বিরক্ত করবে না আপনাকে। গত দু’শ বছরে আমাকে কেউ বিরক্ত করেনি।’
আমি ফ্যালফ্যাল করে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। লোকটা আরও এক পা এগোল। এবার তার শরীরের তীব্র গন্ধ পাচ্ছি আমি। কচুরিপানা পচে গেলে, যেমন গন্ধ হয়, তেমনি গন্ধ।
‘বেয়াদবি নেবেন না, স্যর,’ বলল সে। ‘চেয়ারে বসতে বলেছিলেন, বসিনি। আসলে বসার অবস্থা নেই আমার। শেষ কবে চেয়ারে বসেছি, মনেও নেই। শেষ দু’শ বছর তো দাঁড়িয়েই আছি। কী বলব, শরীর বলতে আমার আর কিছুই নেই। পুরোটাই এখন গাছ।’
আমার চোখের সামনে সে তার পরনের পোশাক টেনে ছিঁড়ল।
‘এদিকে তাকান, স্যর। দেখুন আমাকে।’
আমি অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে রইলাম।
‘হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখুন!’
মন্ত্রমুগ্ধের মত আমি হাত বাড়ালাম। সে বলল, ‘এখন, কী নাম আমার? জানি না আমি এই বৃক্ষের কী নাম? শুধু জানি সে মানুষের মাংস খায়। কলজে খায়। এমন কোন কবর নেই যার মাটি খুঁড়ে সে লাশ খায়নি। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকলে এবং আমার কথা জানতে পারলে নাম দিতেন আমার অচিনবৃক্ষ। আমি যাকে অভিশাপমুক্ত করেছিলাম, সেই প্রবীর সরকার, তিনিও আমাকে নাম বলতে পারেননি। সম্ভবত তিনি যাকে মুক্ত করেছিলেন সে তাঁকে নাম বলে যায়নি।’
হাঁপাতে লাগল লোকটা। হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘বিদায়, স্যর। আপনার নতুন জীবনের জন্য আমার শুভ কামনা রইল । নবাব চেয়ারম্যান আজ অভিশাপমুক্ত হলো।’
আমি চেয়ারে ঢলে পড়লাম।
যখন জ্ঞান ফিরল, ধড়মড় করে উঠে বসলাম।
দেখলাম সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
কলিংবেল টিপলাম, একই সাথে গলা চড়িয়ে ডাক দিলাম, ‘সনাতন বাবু! সনাতন বাবু!! ’
‘জী, স্যর,’ প্রায় দৌড়ে ভেতরে ঢুকল সনাতন।
‘আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? রোগীরা সব কোথায়?’ আমি রাগত স্বরে বললাম।
‘আমি দু’বার এসে ফিরে গেছি। আপনি চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। দেখে এত মায়া হলো, তাই জাগাইনি আপনাকে। রোগীদের বলেছি স্যর খুব টায়ার্ড আজ। ওদেরকে কাল আসতে বলেছি। প্লিজ, স্যর, কষ্ট করে কাল সকাল-সকাল এসে রোগীগুলো দেখেন। সিরিয়াল দিয়ে রেখেছি, একশ’ বাইশ জন।’
আমি বললাম, ‘ওই লোকটা কোথায়?’
সনাতন বলল, ‘কোন্ লোক?’
আমি বললাম, ‘ওই যে, যাকে দেখছিলাম। গোপন রোগ নিয়ে এসেছিল। আপনি দেখতে বললেন তাঁকে।’
সনাতন বলল, ‘আমি আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না, স্যর। আপনি কি ঢাকা ফিরবেন নাকি আজ এখানে থাকবেন? খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে। আমাদের দোতলায়, স্যর, ভাল কেবিন আছে। আপনি রাতে ওখানে ঘুমোতে পারেন।’
‘না, ঢাকা ফিরব। আমার ছোট মেয়েটা সফেদা খেতে চেয়েছে। শ্রীনগর বাজারে কি সফেদা পাওয়া যাবে?’
বাসায় ফিরতে-ফিরতে রাত নটা বেজে গেল। ফেরার সময় বাবুবাজার ব্রিজের ওপর অনেক জ্যাম ছিল। বাসায় ঢুকতেই আমার ছোট মেয়ে আমার হাত থেকে পলিথিনের ব্যাগটা নিতে-নিতে বলল, ‘বাবা, তোমাকে সফেদা আনতে বলেছিলাম, তুমি আপেল নিয়ে এসেছ। জানো না, আপেলে ফর্মালিন দেয়া থাকে? আমি আপেল খাই না।’
আমি বললাম, ‘ভুল হয়ে গেছে, মা, আমি কাল এনে দেব।’
আমার স্ত্রী বলল, ‘তুমি কি গোসল করবে? খুব ঘেমে গেছ। আমি খাবার রেডি করছি। তুমি গোসল করে নাও।’
আমি বললাম, ‘কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। আমি একটু ঘুমাব। খুব টায়ার্ড লাগছে।’
কাপড়-চোপড় না পাল্টেই শুয়ে পড়লাম। আমি আমার পাশে এসে শুল আমার সাড়ে তিন বছরের ছোট মেয়ে।
আমাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বাবা, আমি জানি তুমি কোথায় গিয়েছিলে।’
আমি ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললাম, ‘কোথায়?’
সে বলল, ‘শ্রীনগর।’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, শ্রীনগর।’
সে বলল, ‘বাবা, তুমি আজ কটা রোগী দেখেছ?’
আমি আর উত্তর দিতে পারলাম না। তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে।
হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল।
প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি।
ধীরে-ধীরে ঘরের অন্ধকার চোখে সয়ে এল।
বিছানা থেকে নামলাম। আমার স্ত্রী ও মেয়ে ঘুমাচ্ছে।
আলো জ্বেলে বাথরুমে ঢুকলাম।
চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে আয়নার দিকে তাকালাম।
দেখতে লাগলাম নিজেকে।
আমি কি আজ পুরোটাই দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম?
আমার অবচেতন মন একটি অদ্ভুত গল্প সাজিয়ে নিয়েছিল? কেমন যেন দ্বিধা জাগল মনে।
আয়নায় আমি আমার দিকে তাকিয়ে – রইলাম।
কতক্ষণ জানিনা, হঠাৎ টের পেলাম আমার মুখের বাঁ পাশটা ফেটে গেল। আমি চিৎকার করতে যাব, মুখ থেকে গলগল করে বেরিয়ে এল রক্ত। দ্রুত বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। রাত কত হবে জানি না। নিচে রাস্তায় নেমে এসে আমি দৌড়তে শুরু করলাম।
দৌড়চ্ছি আমি।
এমন সজোরে জীবনে কোনদিন দৌড়ইনি।
যেন মাটিতে পা পড়ছে না আমার। শূন্যে উড়ে চলেছি।
আমি এখনও স্বপ্নের ভেতর কি না তা-ও বুঝতে পারছি না। আমার হাতের ত্বক ফেটে যাচ্ছে, মাংস ফেটে যাচ্ছে। রক্ত ঝরছে।
তীব্র যন্ত্রণায় যেন আগুন ধরে গেছে আমার শরীরে। যখন হোঁচট খেয়ে পড়লাম, চাঁদের আলোয় দেখলাম সাইনবোর্ডটা। ঝিকমিক করছে।
জামগাছে ঝোলানো।
নিতান্তই সাধারণ সাইনবোর্ড ।
পড়লাম ওটা।
‘কুচিয়ামোড়া হইতে সৈয়দপুর
দূরত্ব ৫ কিলোমিটার।
সৌজন্যে মিজান ডাক্তার।’
………………………………………. (সমাপ্ত) ……………………………………….